০৬. স্থাপত্য শিল্প

স্থাপত্য শিল্প

প্রাচীন বাঙলার কুটীর, প্রাসাদ, বিহার, মন্দির প্রভৃতি সম্বন্ধে উপাদানের অভাবে সবিস্তারে কিছু বলিবার উপায় নাই। অথচ, অন্তত পঞ্চম শতক হইতে আরম্ভ করিয়া লিপিমালায় ও সমসাময়িক সাহিত্যে নানাপ্রকারের সমৃদ্ধ ঘরবাড়ি, রাজপ্রাসাদ, স্তূপ, বিহার, মন্দির প্রভৃতির উল্লেখ ও স্বল্পবিস্তর বিবরণ সুপ্রচুর। পঞ্চম শতকে ফা-হিয়েন এবং সপ্তম শতকে য়ুয়ান-চোয়াঙ বাঙলার সর্বত্র অসংখ্য, স্তূপ-বিহার ও দেবমন্দির প্রত্যক্ষ করিয়াছিলেন। লিপিমালায় ভূ-ভূষণ, পর্বতশৃঙ্গস্পধী, স্বৰ্ণকলসশীর্ষ, মেঘবত্মবিরোধী নানা মন্দিরের উল্লেখ বিদ্যমান। সমসাময়িক পাণ্ডুলিপি-চিত্রে রঙে ও রেখায় নানা স্তূপ ও মন্দিরের প্রতিচিত্র রূপায়িত। সমসাময়িক তক্ষণ-ফলকেও নানা আকৃতি-প্রকৃতির গৃহ, স্তূপ ও মন্দিরের প্রতিকৃতি উৎকীর্ণ। অথচ আজ আর এই সব ঘরবাড়ি, বিহার-মন্দিরের কিছুই অবশিষ্ট নাই, মাটির ধুলায় প্রায় সবই গিয়াছে মিশিয়া, অথবা তাহাদের ধ্বংসাবশেষ বনে জঙ্গলে ঢাকা পুড়িয়া ক্ষুদ্র বৃহৎ ধ্বংসস্তূপে পরিণত হইয়া গিয়াছে। মাত্র দুই চারিটি একাদশ-দ্বাদশ শতকীয় মন্দির সকল বাধা-বিরোধ-উপেক্ষা তুচ্ছ করিয়া এখনও দাঁড়াইয়া আছে; দুই চারিটির ধ্বংসাবশেষ উদ্ধার ও সংস্কার করা হইয়াছে প্রত্নবিলাসী মনের আনন্দ-বিধান বা ঐতিহাসিকের কৌতুহল চরিতার্থ করিবার জন্য।

ধ্বংসের কারণ সহজবোধ্য। কাঠ, বাঁশ বা ইট, যাহাই হোক, এই উষ্ণ জলীয় বৃষ্টিপাত পলিমাটির দেশে কিছুই কালের সঙ্গে সংগ্রামে বেশিদিন টিকিয়া থাকিতে পারে না বাঙলাদেশ পাথরের দেশ নয়; অধিকাংশ বিহার-মন্দির ইত্যাদি এবং কিছু কিছু সমৃদ্ধ প্রাসাদে ইটে নির্মিত হইতে; কিন্তু ইটও কালজয়ী হইয়া আমাদের কালে আসিমা পীে ছিতে পারে নাই। তাহার উপর আবার মানুষের লোভ ও লুন্ঠনম্পূহা প্রকৃতির সঙ্গে হাত মিলাইয়া ধ্বংসলীলায় মাতিয়াছে। পরধর্মদ্বেষী বিধমীরাও অনেক বিহার-মন্দির লুণ্ঠন ও ধ্বংস করিয়াছেন। প্রাচীনতম হিন্দু ও বৌদ্ধ-মন্দির ধ্বংস করিয়া তাহার কিছু কিছু অংশ পরবতী কালের মসজিদ, চাবুতরা, দরবার-গৃহ প্রভৃতিতে ব্যবহৃত হইয়াছে, এমন দৃষ্টান্তের অভাব নাই। গৌড়-পাণ্ডুয়া, ত্ৰিবেণী প্রভৃতি স্থানের মধ্যযুগীয় প্রত্নাবশেষ একটু মনোযোগে বিশ্লেষণ করিলেই তাহা ধরা পড়িয়া যায়।

সাধারণ স্বল্পবিত্ত ও মধ্যবিত্ত এমন কি সমৃদ্ধ লোকেরাও নিজেদের বসবাসের জন্য যে সব ঘরবাড়ি প্রাসাদ ইত্যাদি রচনা করিতেন তাহারও উপাদান ছিল খড়, কাঠ, বাঁশ ইত্যাদি; পার্থক্য যাহা ছিল তাহা শুধু আয়তন ও অলংকরণের সমৃদ্ধি ও জটিলতার। উচ্চবিত্ত লোকদের ইট ব্যবহারের সামর্থ্য ছিল না, এমন নয়; ইটের তৈরি ছোটবড় ঘরবাড়ি নিশ্চয়ই কিছু কিছু ছিল। কিন্তু সাধারণভাবে যুক্তিটা ছিল এই যে, পঞ্চভূতে রচিত এই নশ্বর ক্ষণস্থায়ী মানবদেহের আশ্রয়ের জন্য সুচিরকালস্থায়ী গৃহের কি-ই-বা প্রয়োজন। সে-প্রয়োজন যদি কাহারও থাকে তাহা দেবতার, কারণ দেবদেহের তো বিনাশ নাই এবং সুচিরস্থায়ী আবাসের প্রয়োজন তো তাঁহারই। যাহাই হউক, মানুষের বসবাসের জন্য তৈরি গৃহের আকৃতি-প্রকৃতি কিরূপ ছিল তাহা নিশ্চয় করিয়া বলিবার মতো খুব উপাদান আমাদের নাই; তবে কিছু কিছু উৎকীর্ণ মৃৎ ও প্রস্তর-ফলকের সাক্ষ্যে কতকটা আভাস ধরিতে পারা কঠিন নয়। সাম্প্রতিক বাঙলাদেশের পল্লীগ্রামে আজও বাঁশ বা কাঠের খুঁটির উপর চতুষ্কোণ নকশার ভিত্তিতে মাটির দেয়াল বা বাঁশের চাচারীর বেড়ায় ঘেরা যে ধরনের ধনুকাকৃতি দোচালা, চৌচালা, আটচালা ঘর দেখিতে পাওয়া যায়, সেই ধরনের বাঙলা-ঘর রচনাই ছিল প্রাচীন রীতি। এই আকৃতি-প্রকৃতিই ভারতীয় স্থাপত্যের ইতিহাসে গৌড়ীয় বা বাঙলা রীতি নামে খ্যাত এবং তাঁহাই পরবর্তী কালে মধ্যযুগীয় ভারতীয় স্থাপত্যে বাঙলার দান বলিয়া গৃহীত ও স্বীকৃত হইয়াছিল। এই গঠন ও আকৃতিই উনবিংশ-শতকে ‘বাংলো-বাড়ি’ নামে ইঙ্গ-ভারতীয় সমাজে পরিচিতি লাভ করে। এই ধরনের গৌড়ীয় রীতির আবাস-গৃহই গরীবের কুটীর হইতে আরম্ভ করিয়া ধনীর প্রাসাদ পর্যন্ত সমাজের সকল স্তরে বিস্তৃত ছিল; পার্থক্য যাহা ছিল তাহা শুধু সমৃদ্ধি ও অলংকরণের। দ্বিতল-ত্রিতল গৃহও এই রীতিতেই নির্মিত হইত; উপরের চাল বিন্যস্ত হইত। ক্রমহ্রস্বায়মান ধনুকাকৃতি রেখায়। কোনও কোনও মন্দিরও ঠিক এই গৌড়ীয় রীতিতেই নির্মিত হইত; বস্তুত, একাধিক প্রস্তর ফলকে এই ধরনের মন্দির উৎকীর্ণ দেখিতে পাওয়া যায়।

যাহাই হউক, প্রাচীন বাঙলার স্থাপত্যের সুসংবদ্ধ ইতিহাস রচনা করিবার মতো উপাদান স্বল্পই। ধ্বংসস্তূপে পরিণত বা অর্ধভগ্ন যে দুই চারিটি বিহার-মন্দির ইতস্তত বিক্ষিপ্ত তাহারই ভগ্নাংশগুলি আহরণ করিয়া এবং মৃৎ ও প্রস্তরফলকে উৎকীর্ণ ও পাণ্ডুলিপি-পৃষ্ঠায় চিত্রিত মন্দিরাদির আকৃতি-প্রকৃতির সাক্ষ্য একত্র করিয়া একটি সমগ্র রূপ গড়িয়া তুলিবার চেষ্টা করা যাইতে পারে। তাহা ছাড়া, প্রত্নসাক্ষ্য যাহা কিছু আছে তাহা একান্তই বিহার-দেউল ইত্যাদি সম্বন্ধে; স্থাপত্যের অন্যান্য দিক সম্বন্ধে বলিবার মতো উপাদান একেবারে নাই বলিলেই চলে। প্রাচীন বাঙলার ধর্মগত বাস্তু মোটামুটি তিন শ্রেণীর; স্তূপ, বিহার ও মন্দির। স্তূপ ও বিহার সাধারণভাবে বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের সঙ্গে জড়িত, বিশেষভাবে বৌদ্ধধর্মের সঙ্গে। প্রাচীন বাঙলায় জৈন-স্তূপের একটি মাত্ৰ সংশয়িত উল্লেখ জানা যায় এবং জৈন-বিহারের একটি মাত্র নিঃসংশয় উল্লেখ। এই বিহারটি ছিল উত্তরবঙ্গের পাহাড়পুরে; স্তূপটিও বোধ হয় উত্তরবঙ্গেই; আর সমস্ত স্তূপ এবং বিহারই বৌদ্ধধর্মের আশ্রয়ে রচিত।

স্তূ

ধৰ্মগত স্থাপত্যের কথা বলিতে গেলে স্তূপের কথাই বলিতে হয় সর্বাগ্রে। স্তূপ প্রাক-বৌদ্ধ যুগের; বৈদিক আমলেও দেহাস্থি প্রোথিত করিবার জন্য শ্মশানের উপর মাটির স্তূপ তৈরি হইত। কিন্তু এই স্থাপত্যরূপকে বিশেষভাবে গ্রহণ করেন বৌদ্ধরাই। বৌদ্ধ ঐতিহ্যে স্তূপ তিন প্রকারের ১৭ শারীর ধাতু স্তূপ- এই শ্রেণীর স্তূপে বুদ্ধদেবের এবং তাহার অনুচর ও শিষ্যবর্গের শবীরাবশেষ রক্ষিত ও পূজিত হইত; ২: পরিভোগিক ধাতু স্তূপ— এই শ্রেণীর স্তূপে বুদ্ধদেব কর্তৃক ব্যবহৃত দ্রব্যাদি রক্ষিত ও পূজিত হইত; ৩. নির্দেশিক বা উদ্দেশিক স্তূপ— বুদ্ধদেব ও বৌদ্ধধর্মের জীবনেতিহাসের সঙ্গে জড়িত কোনও স্থান বা ঘটনাকে উদ্দেশ্য করিয়া বা তাহাকে নির্দেশ বা চিহ্নিত করিবার জন্য এই শ্রেণীর স্তূপ নির্মিত হইত। পরবর্তী কালে স্তূপ মাত্রই বুদ্ধ ও বৌদ্ধধর্মের প্রতীক হইয়া দাঁড়ায় এবং সেই ভাবেই সমগ্র বৌদ্ধসমাজের পূজা লাভ করে। তাহা ছাড়া, বৌদ্ধ তীর্থস্থানগুলিতে পূজা দিতে আসিয়া নৈবেদ্য বা নিবেদনরূপে ছোট বড় স্তূপ নির্মাণ করিয়া ভক্তি ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করাও একটা সাধারণ রীতি হইয়া দাঁড়ায়। এই স্তূপগুলিকে বলা হইত নিবেদন-স্তূপ।

কিন্তু যে-শ্রেণীর স্তূপই হোক বা যে উদ্দেশ্যেই তাহা রচিত হউক না কেন, আকৃতি-প্রকৃতি ও গঠনপদ্ধতিতে ইহাদের মধ্যে কোনও পার্থক্য ছিল না। একেবারে আদিতে স্তূপ বলিতে গোলাকার একটি বেদীর উপর অর্ধচন্দ্ৰাকৃতি একটি অণ্ড ছাড়া কিছুই বুঝাইত না। অণ্ডটির ঠিক উপরেই থাকিত হমিকা; এই হার্মিকা-বেষ্টনীর মধ্যে একটি ভাণ্ডে রাখা হইত। শারীর বা পরিভোগিক ধাতু; পর্বদিবসে ধাতুসহ এই ভাণ্ডটি নীচে নামাইয়া ভক্ত পূজারীদের দেখান হইত, পুরোভাগে রাখিয়া গণ্যযাত্রা করা হইত। এবং যেহেতু ধাতুগর্ভ এই ভাণ্ডটিই ছিল পূজা ও শ্রদ্ধার বস্তু সেই হেতু ইহাকে রৌদ্রবৃষ্টি হইতে রক্ষা করিবার জন্য, হর্মিকার ঠিক উপরেই থাকিত একটি ছত্রাবরণ। কালক্রমে ছোটই হোক আর বড়ই হোক প্রত্যেকটি অঙ্গকে পৃথক পৃথকভাবে লম্বিত করিয়া সমগ্র স্তূপটিকেই লম্বিত, সুউচ্চ করিয়া গড়িয়া তুলিবার দিকে একটা ঝোক সুস্পষ্ট হইয়া ওঠে এবং তোরণ, বেষ্টনী ও নানা অলংকরণ প্রভৃতি সংযোজিত হইতে আরম্ভ করে। সপ্তম-অষ্টম শতক নাগাদ নিম্ন ও গোলাকৃতি বেদীটি একটি গোল এবং লম্বিত মেধিতে পরিণতি লাভ করে; তাহার উপরকার অণ্ডটিও প্রমাণানুযায়ী ক্রমশ উচ্চ হইতে উচ্চতর হইতে থাকে। উচ্চতা আরও বাড়াইবার জন্য বেদীর নীচে আবার একটি সুউচ্চ চতুষ্কোণ ভিতও কোনও কোনও ক্ষেত্রে দেখা দিতে আরম্ভ করে; আর হিমিকার উপর ক্রম-হ্রস্বায়মান ছাত্রের সংখ্যা একটি দুইটি করিয়া বাড়িতে বাড়িতে সূচ্যগ্র সমগ্রতায় একটি সূচ্যগ্ৰ শিখরের আকৃতি লাভ করে। তাহার ফলে স্তূপের প্রাথমিক, অর্থাৎ নিম্নবেদীর উপর অর্ধচন্দ্ৰাকৃতি অণ্ডের যে স্থাপত্য-বৈশিষ্ট্য ছিল তাহা একেবারে অন্তহিঁত হইয়া গেল; অন্যান্য অঙ্গের সঙ্গে সমান মূলা পাইয়া অণ্ডের প্রাধান্য নষ্ট হইয়া গেল এবং স্তূপ আর যথার্থত স্তূপ থাকিল না, বিভিন্ন অঙ্গ মিলিয়া লম্বিত এবং কৌণিক একটি শিখরের আকৃতি ধারণ করিল। বাঙলাদেশে যে কয়েকটি স্তূপের ধ্বংসাবশেষের সঙ্গে আমরা পরিচিত ইহাদের সমস্তই স্তূপ-স্থাপত্যের বিবর্তনের এই স্তরের, অর্থাৎ একেবারে শেষ স্তরের এবং ইহাদের প্রত্যেকটিই নিবেদন-স্তূপ। যুয়ান-চোয়াঙ অবশ্য বলিতেছেন, বাঙলাদেশের সর্বত্র তিনি নৃপতি অশোকের পোষকতায় বুদ্ধদেবের স্মৃতির উদ্দেশ্যে নির্মিত অনেকগুলি স্তূপ দেখিয়াছিলেন, কিন্তু এ-তথ্য খুব বিশ্বাসযোগ্য নয়। তবে খুব সম্ভব বৌদ্ধধর্ম প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে নানা সময়ে উদ্দেশিক-স্তূপ বাঙলায় নানা স্থানে নির্মিত হইয়াছিল নানা জনের পোষকতায়; য়ুয়ান-চোয়াঙ হয়তো এই সব স্তূপই কিছু কিছু দেখিয়াছিলেন, কিন্তু আজ আর ইহাদের কিছুই অবশিষ্ট নাই।

সংখ্যায় বা আকৃতি-প্রকৃতির বৈচিত্র্যে সমসাময়িক বিহার-প্রান্তের অসংখ্য নিবেদন-স্তূপগুলির সঙ্গে বাঙলার স্বল্প সংখ্যক নিবেদন-স্তূপের কোনও তুলনাই হয় না। ব্রোঞ্জ-ধাতুতে ঢালাই করা কিংবা পাথর কুঁদিয়া গড়া কয়েকটি স্বল্পায়তন নিবেদন-স্তূপ বাঙলার নানাস্থানে পাওয়া গিয়াছে; এ-গুলিকে ঠিক স্থাপত্য-নিদর্শন বলা চলে না, তবু সমসাময়িক বাঙলার স্তূপ-স্থাপত্যের আকৃতি-প্রকৃতি বুঝিতে হইলে ইহাদের আলোচনা করিতেই হয়। কয়েকটি ইটের তৈরি অপেক্ষাকৃত বৃহদায়তন স্তূপের ধ্বংসাবশেষও বাঙলায় ইতস্তত বিক্ষিপ্ত অবস্থায় দেখিতে পাওয়া যায়; আকৃতি-প্রকৃতির দিক হইতে বিহারের সমসাময়িক স্তূপ-স্থাপত্যের সঙ্গে ইহাদের বিশেষ কোনও পার্থক্য কিছু নাই।

ঢাকা জেলার আস্রফপুর-গ্রামে প্রাপ্ত ব্রোঞ্জের একটি স্বল্পায়তন নিবেদন-স্তূপ বোধ হয় বাঙলার সর্বপ্রাচীন (আ সপ্তম-শতক) স্তূপ-নিদর্শন রাজশাহী জেলার পাহাড়পুর এবং চট্টগ্রাম জেলার ঝেওয়ারী গ্রামেও দুইটি ব্রোঞ্জের আকৃতি নিবেদন স্তূপ পাওয়া গিয়াছে। এই ধরনের স্তূপের প্রতিকৃতি বাঙলার সমসাময়িক প্রস্তরফলকেও উৎকীর্ণ দেখিতে পাওয়া যায়। ইহাদের আকৃতি-বৈশিষ্ট্য সম্বন্ধে বিশেষভাবে বলিবার কিছু নাই।

পাথরে কুঁদিয়া তৈরি একটিমাত্র নিবেদন-স্তূপের খবর আমরা জানি; এই স্তূপটি যোগী-শুফায় প্রতিষ্ঠিত। প্রথম দর্শনে ইহাকে স্তূপ বলিয়াই মনে হয় না। ভিত, বেদী, মেধি, অণ্ড, হর্মিকা, ছত্রাবলী প্রভৃতি সব কিছুরই গতি এমন উর্ধ্বমুখী যে সমগ্র স্তূপটিকে মনে হয় যেন একটি ক্রমহ্রস্বয়মান গোলাকৃতি স্তম্ভ এবং স্তম্ভেরই অংশে খাজ কাটিয়া কাটিয়া যেন স্তূপটির বিভিন্ন অংশের রূপ দেওয়া হইয়াছে। চতুষ্কোণ হৰ্মিকাটি তো যেন একান্তই একটি গোলাকৃতি আমলক-শিলায় পরিণত।

সমসাময়িক পাণ্ডুলিপি-চিত্রেও কয়েকটি স্তূপের প্রতিকৃতি দেখিতে পাওয়া যায়। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি পাণ্ডুলিপিতে (১০১৫ খ্ৰী) বরেন্দ্রভূমির মৃগস্থাপন-স্তূপের একটি চিত্র আছে; সপ্তম শতকে এই স্তূপটির কথাই বোধ হয় ইৎসিঙ উল্লেখ করিয়াছেন। আর একটি পাণ্ডুলিপি পত্রে বরেন্দ্রভূমির “তুলাক্ষেত্রে বর্ধমান-স্তূপ”-এর একটি চিত্র আছে। এই বর্ধমান স্থান-নাম হয়, খুব সম্ভব জৈন-তীৰ্থংকর বর্ধমানের নাম এবং যদি তাহাই হয়, তাহা হইলে এই স্তূপটির প্রাচীন বাঙলায়। জৈন-স্তূপের একমাত্র জ্ঞাত নিদর্শন। তৃতীয় আর একটি স্তূপের ছবি আছে আর একটি পাণ্ডুলিপিতে অলংকরণ-সমৃদ্ধির কথা বাদ দিলে আকৃতি-প্রকৃতির দিক হইতে সব ক’টি স্তূপ প্রায় একই প্রকারের। খাজকাটা চতুষ্কোণ ভিত্তি, ধাপে ধাপে তৈরি বেদী, পদ্মাকৃতি মেধি, ক্রমহ্রস্বয়মান অণ্ড ও ছত্রাবলী প্রত্যেকটি স্তূপেরই বৈশিষ্ট্য।

রাজশাহী জেলার পাহাড়পুরে, বিশেষভাবে সত্যপীরের ভিটায় এবং বাঁকুড়া জেলার বহুলাড়ায় খননবিষ্কারের ফলে ইটের তৈরি কয়েকটি নিবেদন-স্তূপ আমাদের দৃষ্টিগোচর হইয়াছে। এই ধরনের স্বল্পায়তন নিবেদন-স্তুপুগুলি হয় পৃথক পৃথক, না হয় একই ভিতের উপর সারি সারি সাজানো, বা একই ভিতের উপর একটি বৃহত্তর স্তূপের চারদিকে চক্রাকারে ছোট ছোট স্তূপের বিন্যাস। এই ধরনের স্তূপ প্রায় সমস্তুই দশম-একাদশ-দ্বাদশ শতকের এবং ভিত্ ছাড়া ইহাদের আর কিছুই প্রায়ই অবশিষ্ট নাই, অর্থাৎ ইহাদের ভূমি-নকশা ছাড়া আর কিছু বুঝিবার কোনও সুযোগ নাই। এই ভূমি-নকশা কোনও কোনও ক্ষেত্রে চতুষ্কোণ বা গোলাকার, কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই চতুষ্কোণ ভিতের চারদিকে, ঠিক মধ্যখানে একটি একটি করিয়া চতুষ্কোণ সংযোজিত; তাহার ফলে সমগ্র ভূমি-নকশাটি যেন একটি ক্রুশের আকার ধারণ করিয়াছে। ভিতুগুলি প্রায়ই বেশ উঁচু এবং অনেক নিদর্শনে ক্রমহ্রস্বায়মান স্তরে স্তরে বিভক্ত। ভিতের দেয়ালের গায়ে নানা বুদ্ধমূর্তি। এই রূপ ও বিন্যাসের দিক হইতে, বস্তুত, সকল দিক হইতেই সমসাময়িক বিহারের নিবেদন-স্তূপগুলির সঙ্গে ইহাদের কোনোই পার্থক্য নাই? খননবিষ্কারের ফলে দেখা গিয়াছে, এই স্তূপগুলির গর্ভে অসংখ্য বৌদ্ধসূত্রোংকীর্ণ মাটির শীলমোহর রক্ষিত থাকিত। বৌদ্ধ বিশ্বাসানুযায়ী এই সূত্রগুলিই ধর্মশরীর এবং দেহাবশেষের পরিবর্তে এই ধর্মশরীরই স্তূপগর্ভে রক্ষা করা নিয়ম দাঁড়াইয়া গিয়াছিল।

স্তূপ-স্থাপত্যে বাঙলাদেশ নূতন কোনও বৈশিষ্ট্য রচনা করে নাই বলিয়াই মনে হয়; নূতন সমৃদ্ধির সংযোজনাও নাই। বৃহদাকৃতি স্তূপ-রচনার কোনও চেষ্টাও বোধ হয় ছিল না। বস্তুত, নৈবেদ্য বা নিবেদন উদ্দেশ্য ছাড়া, স্ব-স্বতন্ত্র স্থাপত্য নিদর্শন হিসারে স্তূপ গড়িয়া তুলিবার উল্লেখযোগ্য বিশেষ কোনো চেষ্টা বোধ হয় প্রাচীন বাঙলায় কিছু ছিল না, অন্তত প্রত্নসাক্ষ্যে তেমন প্রমাণ কিছু নাই। স্থাপত্য হিসাবে স্তূপ প্রাচীন বাঙলার চিত্ত আকর্ষণ করে নাই, অন্তত যে-সব নিদর্শন আমরা দেখিতেছি। তাহাতে সে-প্রমাণ নাই। অথচ, প্রায় সমসাময়িক কালে ব্ৰহ্মদেশের রাজধানী পাগান-নগরে দেখিতেছি, স্তূপ রচনার কী সমৃদ্ধি, কী ঐশ্বর্য! প্রায় একই ধরনের কি স্তু সুবিস্তৃত ভূমি-নকশার উপর সুউচ্চ ভিত্ স্তরে স্তরে ক্রমহ্রস্বায়মান হইয়া উপরের দিকে উঠিয়া গিয়াছে; তাহার উপর সুবৃহৎ সুউচ্চ গোলাকৃতি মেধি, মেধির উপর ঘন্টাকৃতি অণ্ড, অণ্ডের উপর চতুষ্কোণ হেমিকা এবং হমিকার উপর ক্রমহ্রস্বায়মান ছত্রাবলী। পাগানের স্তূপের বিভিন্ন অঙ্গের রূপ ও বিন্যাস রচনা ও নির্মােণরীতিতে একই যুক্তি অনুসরণ করিয়াছে, অথচ পাগান স্তূপ শ্রদ্ধা আকর্ষণ করে, কল্পনাকে উদ্দীপ্ত করে শুধু তাহার বৃহদায়তন দিয়া, কল্পনার বিরাটত্ব দিয়া। তুলনায় বাঙলা-বিহারের সমসাময়িক স্তূপ-স্থাপত্যকে যেন খেলনার বস্তু বলিয়া মনে হয়, শুধু যেন নিয়মরক্ষা! তাহার কারণ সহজবোধ্য। মহাযান-বজযান বৌদ্ধধর্মের সঙ্গে স্তূপের সম্বন্ধ স্বল্পই; তাহা ছাড়া, নিবেদন-স্তূপ তো যথার্থত স্তূপই নয়, স্তূপের মৌলিক উদ্দেশ্যও বহন করে না।

স্তূপের পরই বিহারের কথা বলিতে হয়। স্তূপ যদি ছিল পূজার প্রতীক, শ্রদ্ধার বস্তু বিহার ছিল বৌদ্ধ ভিক্ষুকদের আবাসস্থল, অধ্যয়ন-অধ্যাপনার, নিয়মসংযম-পালনের আশ্ৰয়। আদিম বৌদ্ধ বা জৈন বিহার পাড়ার কুঁদিয়া তৈরি গুহা মাত্র। সাধারণত একই পাহাড়ে যেখানে খানিকটা সমতল ভূমি আছে তাহার তিন দিক ঘিরিয়া সমান-অসমান গুহার সারি; সেই পাহাড়েরই অন্যত্র সুবিধানুযায়ী এবং প্রয়োজনানুযায়ী আরও কয়েকটি গুহা। এই গুহাগুলি ভিক্ষুকদের আবাস-স্থল, বৃহত্তর একটি বা দু’টি গুহা সম্মেলন-স্থল বা পজাস্থল , সমতলে আঙ্গিনাটি সভ্যস্থল এবং সব কিছু লইয়া একটি বিহার। কিন্তু এই ধরনের বিহার-রচনা ঠিক স্থাপত্য নয়, নির্মাণগত কোনও বুদ্ধি বা সৌন্দর্যের কোনো প্রেরণা এ-ক্ষেত্রে সক্রিয় নয়। পাহাড় কুঁদিয়া এই ধরনের বিহার রচনা ছাড়া ইট বা পাথরের ভিত্ ও কাঠামোর উপর বাঁশ, কাঠ ইত্যাদির সাহায্যে বিহার রচনার একটা চেষ্টাও ছিল এবং সে-ক্ষেত্রে বিন্যাসের একটা যুক্তিও সক্রিয় ছিল। মাঝখানে সুবিস্তৃত অঙ্গন; সেই অঙ্গনের চারিদিক ঘিরিয়া কক্ষশ্রেণী; এক একদিকের কেন্দ্র-কক্ষটি বৃহত্তর; অঙ্গনের এক কোণে কুল্প ও স্নানািচমনস্থান; এবং বিহারে ঢুকিবার একটিমাত্র প্রবেশদ্বার।

বৌদ্ধ ও জৈন সংঘের বিস্তৃতি ও সমৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সমৃদ্ধ বৃহদায়তন বিহারের প্রয়োজন দেখা দেয় এবং ইটের সাহায্যে সেই বিহার-রচনার সূচনা হয়, সদ্যোক্ত বাঁশ-কাঠে নির্মিত বিহারের বিন্যাস অনুযায়ী। একতল বিহারে যখন কুলাইল না। তখন দ্বিতল, ত্রিতল, এমন কি নবতাল পর্যন্ত বিহার নির্মিত হইতে আরম্ভ করিল এবং গোড়ায় যে বিহার ছিল ভিক্ষুকদের আবাসস্থল মাত্র সেই বিহারই হইয়া উঠিল বিরাট জ্ঞান-বিজ্ঞান সাধনার, ধৰ্মকৰ্ম-সাধনার কেন্দ্র।

প্রাচীন বাঙলায়ও এই ধরনের ছোট-বড় বিহার ছিল অনেক এবং ইহাদের কথা আগেই অন্য প্রসঙ্গে বলিয়াছি। এই সব বিহারের সমৃদ্ধি ও ঐশ্বর্যের কিছু কিছু আভাস পাওয়া যায় য়ুয়ান-চোয়াঙ-কথিত পুণ্ড্রবর্ধনের পো-সি-পো বা ভাসূ-বিহার এবং কর্ণসুবর্ণের লো-টো-মো-চিহ বা রক্তমৃত্তিকা-বিহারের বর্ণনায়। ভাসু-বিহারের ধ্বংসাবশেষ দৃষ্টিগোচর মহাস্থানের সন্নিকটে বৃহৎ একটি স্তূপে, রক্তমৃত্তিকা-বিহারের ধ্বংসাবশেষ মুর্শিদাবাদ জেলার রাঙামাটির সন্নিকটে রাক্ষসডাঙ্গায়।

সোমপুর-বিহার

খননাবিষ্কারের ফলে জানা গিয়াছে রাজশাহী জেলার পাহাড়পুরে অন্তত দুইটি বিহার ছিল। ৪৭৮-৭৯ খ্ৰীষ্ট তারিখের একটি লিপিতে জানা যায়, এই স্থানের বট-গোহালী বা গোয়াল-ভিটায় আচার্য গুহনদীর একটি জৈন-বিহার ছিল, আর অষ্টম শতকের শেষার্ধে যে সোমপুরের শ্ৰীধর্মপাল-মহাবিহার প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল এবং পরবর্তীকালে এই বিহারের খ্যাতি ও প্রতিষ্ঠা দেশে-দেশান্তরে ব্যাপ্ত হইয়াছিল, এ-তথ্য তো সুবিদিত। জৈন-বিহারটির ভূমি-নকশা ও আকৃতি-প্রকৃতি কী ছিল তাহা জানিবার কোনও উপায় আজ আর নাই। কিন্তু সুবিস্তৃত ধর্মপাল-বিহারটির নকশা ও আকৃতি-প্রকৃতি দৃষ্টিগোচর। এত বৃহৎ ও সমৃদ্ধ বিহার ভারতবর্ষের এক নালন্দা ছাড়া আর কোথাও আবিষ্কৃত হয় নাই; ইহার মহাবিহার নাম যথার্থ এবং সার্থক। বিস্তৃতভাবে এই বিহারের বর্ণনা দিবার স্থান ও সুযোগ নাই, তবু কিছুটা পরিচয় লইতেই হয়।

প্রত্যেক দিকে প্রায় ৯০০ ফিট, এমন একটি সমচতুষ্কোণ জুড়িয়া বিহারটি বিস্তৃত এবং দৃঢ় সুপ্রিশস্ত বহিঃপ্রাচীরদ্বারা বেষ্টিত। এই প্রাচীর ঘেঁষিয়া ভিতরের দিকে সারি সারি প্রায় ১৮০টির উপর কক্ষ; প্রত্যেক দিকের কেন্দ্রের কক্ষটি বৃহত্তর। কক্ষসারির সম্মুখ দিয়া সুপ্ৰশস্ত বারান্দা লম্বমান হইয়া চলিয়া গিয়াছে চারিদিক ঘিরিয়া; কেন্দ্রের সিঁড়ি বাহিয়া বারান্দা হইতে নামিলেই সুপ্রিশস্ত অঙ্গন এবং অঙ্গনের একেবারে কেন্দ্ৰস্থলে সুউচ্চ সুবৃহৎ মন্দির। বারান্দার প্রান্তে সিঁড়ির উপরই স্তম্ভশ্রেণী; এই স্তম্ভশ্রেণী ও কক্ষের দেয়ালের উপর ছাদ। বহিঃপ্রাচীরের প্রশস্ততা এবং স্তম্ভশ্রেণীর ঘন সন্নিবেশ দেখিয়া মনে হয়। বিহারটির একাধিক তল ছিল এবং কেন্দ্রীয় মন্দিরের উচ্চতা ও সমৃদ্ধির সঙ্গে প্রমাণ রক্ষা করিয়া সমগ্র বিহারটির উচ্চতা ও সমৃদ্ধি নিরূপিত হইয়াছিল।

বিহার-মন্দিরে প্রবেশের প্রধান তোরণ ছিল উত্তর দিকে। সমতল ভূমি হইতে সুপ্ৰশস্ত সোপানশ্রেণী বাহিয়া উপরে উঠিয়া সুবৃহৎ একটি দরজা পার হইলেই সম্মুখে স্তম্ভসমৃদ্ধ সুপ্ৰশস্ত একটি কক্ষ; সেই কক্ষটি সোজা পার হইয়া গেলে দক্ষিণ দিকের কেন্দ্রে একটি ক্ষুদ্রতর দ্বার। এই দ্বার দিয়া ঢুকিতে হয়। আর একটি স্তম্ভযুক্ত ক্ষুদ্রতর কক্ষে। কক্ষটির পরই লম্বমান বারান্দা; এই বারান্দা ধরিয়া চতুর্দিকের কক্ষশ্রেণী সমানে ঘুরিয়া আসা যায়, আর সোপান বাহিয়া নীচে নামিলেই সুপ্ৰশস্ত অঙ্গন; একেবারে চোখের সম্মুখে সুউচ্চ মন্দিরের সম্মুখ দৃশ্য। প্রবেশের প্রধান তোরণটি ছাড়া উত্তর দিকের প্রায় পূর্বতম প্রান্তে আর একটি ছোট তোরণ। পূর্বদিকের বৃহত্তর কেন্দ্রীয় কক্ষের ভিতর দিয়া ভিতর-বাহিরে যাওয়া আসা করিবার আরও একটি খিড়কী-তোরণ বোধ হয় ছিল আবাসিকদের ব্যবহারের জন্য। দক্ষিণ ও পশ্চিম দিকে যাতায়াতের কোনও পার্থই ছিল না।

এই চতুঃসংস্থান-সংস্থিত সুবৃহৎ বিহার-মন্দিরটিকে বিপুলশ্রমিত্রের নালন্দা-লিপিতে বিশেষিত করা হইয়াছে বসুধার একতম নয়নানন্দ বলিয়া। খননবিষ্কারের ফলে বিহারটির যে ধ্বংসাবশেষ দৃষ্টিগোচর তাহাতে এই বিশেষণ অত্যুক্তি বলিয়া মনে হয় না। বলা বাহুল্য, এই সুবৃহৎ বিহার একদিনে নির্মিত হয় নাই এবং ইহার প্রায় চারি শতাব্দীর সুদীর্ঘ জীবনে একাধিকবার সংস্কার ও সংযোজনের প্রয়োজনও হইয়াছিল। তবু, এ-তথ্য অনস্বীকার্য বলিয়া মনে হয় যে, গোড়া হইতেই এই বিহারের নকশা, বিন্যাস ও আকৃতি-প্রকৃতি যাঁহারা রচনা করিয়াছিলেন তাঁহাদের বুদ্ধি ও কল্পনায় বিহারটির সামগ্রিক রূপের একটা সুস্পষ্ট ধারণা সক্রিয় ছিল এবং নির্মাণ, সংস্কার ও সংযোজনকাল বা তাহার ফলে সেই রূপটির কোনও ব্যত্যয় ঘটে নাই। তাহা ছাড়া এ-ও মনে হয়, সামগ্রিক নির্মাণ কার্যটি একটানা একবারেই হইয়াছিল, পরবর্তী কালে সংস্কার প্রয়োজন হইলেও সংযোজনের প্রয়োজন বোধহয় বিশেষ কিছু হয় নাই। সূচনায় বিহারের কক্ষগুলি বাসগৃহ রূপেই ব্যবহৃত হইত, সন্দেহ নাই। কিন্তু অধিকাংশ কক্ষের সমৃদ্ধ অলংকরণ দেখিয়া মনে হয়, পরবর্তী কালে আবাসিক ভিক্ষু সংখ্যা কমিয়া যাওয়ায় সেই কক্ষগুলি বোধ হয়। পূজাগৃহ রূপেই ব্যবহৃত হইত।

এই সুবৃহৎ বিহার-মন্দিরের ব্যবস্থা-কর্ম পরিচালনার জন্য একটি দপ্তর ছিল এবং সে দপ্তর-গৃহটি ছিল প্রধান প্রবেশ তোরণের পাশেই। তাল হইতে তলে, কক্ষ হইতে কক্ষে, অঙ্গন হইতে অঙ্গনে জল-নিঃসরণের একটি প্রণালী সুদীর্ঘ পথ বাহিয়া বাহিয়া বিহার-মন্দিরটির সমস্ত জল নিষ্কাশিত করিত বিহার-সীমার ভিতরেই একটি ক্ষুদ্রাকৃতি দীর্ঘিকায়। কক্ষশ্রেণীর মাঝে মাঝে, সুপ্রশস্ত অঙ্গনের নানা স্থানে ছোট ছোট মন্দির, নিবেদন-স্তূপ, কৃপ, স্নানািচমানাগার, অশনস্থান ইত্যাদি ইতস্তত বিক্ষিপ্ত।

নালন্দা, শ্রাবস্তি প্রভৃতি স্থানের সুবৃহৎ বিহার-প্রতিষ্ঠানগুলিও ধ্বংসাবশেষ দেখিলে, মনে হয়, সোমপুর-বিহারটির সাধারণ নকশা ও বিন্যাস ছিল প্রায় একই ধরনের, আদর্শ এবং উদ্দেশ্যও ছিল একই। কিন্তু, সন্দেহ নাই, পাহাড়পুরের মতন সুসমৃদ্ধ, সুবৃহৎ ও সবিন্যস্ত বিহার এ-পর্যন্ত আর কোথাও আবিষ্কৃত হয় নাই; বোধ হয় ছিলও না, অন্তত প্রত্নসাক্ষ্যে বা লিপি ও সাহিত্য-সাক্ষ্যে তাহা জানা যায় না।