০৪. তক্ষণ-শিল্পের দ্বিতীয় পর্ব। পূর্ব-ভারতীয় শিল্পের ধারা। মধ্যযুগীয় সংস্কৃতির সূচনা

তক্ষণ-শিল্পের দ্বিতীয় পর্ব। পূর্ব-ভারতীয় শিল্পের ধারা। মধ্যযুগীয় সংস্কৃতির সূচনা

সপ্তম-অষ্টম-নবম শতকে ভারতেতিহাস ও সংস্কৃতির দিক পরিবর্তন বা রূপান্তরের কথা আগে একবার একটু বলিয়াছি; কি ভাবে ক্ল্যাসিক্যাল পর্বের অবসান ঘটিয়া মধ্যযুগের আভাস ক্রমশ সুস্পষ্ট হইতে আরম্ভ করিল, তাহারও ইঙ্গিত করিয়াছি। পাল ও সেন আমলের (আ ৭৫০—১২৫০ খ্রী) তক্ষণশিল্পের কথা বলিবার আগে সেই ইঙ্গিতাটিই অন্যদিক হইতে আরও একটু ফুটাইয়া তুলিবার চেষ্টা করা যাইতে পারে।

তক্ষণ-শিল্পের দ্বিতীয় পর্ব। পূর্ব-ভারতীয় শিল্পের ধারা। মধ্যযুগীয় সংস্কৃতির সূচনা।

মোটামুটি ভাবে বলিতে গেলে খ্ৰীষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতক হইতে আরম্ভ করিয়া খ্ৰীষ্টোত্তর ষষ্ঠ-সপ্তম শতক পর্যন্ত ভারতীয় শিল্পসাধনার বিভিন্ন স্তরে ও পর্যয়ে একটি মৌলিক ঐক্য সুস্পষ্ট। একটি সর্বভারতীয় সার্বভৌমত্বের আদর্শও এই কয়েক শত বৎসরের রাষ্ট্রীয় ইতিহাসের পরিমণ্ডলে পরিব্যাপ্ত ছিল। এ-কথা অবশ্য স্বীকার্য, স্থানীয় এবং আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্যও থাকিয়া থাকিয়া সার্বভৌম রাষ্ট্ৰীয় এবং সাংস্কৃতিক আদর্শকে কখনও ব্যাহত কখনও সমৃদ্ধ করিয়াছে। কিন্তু তৎসত্ত্বেও এই কয়েক বৎসর ধরিয়া ভারতীয় বোধ, বুদ্ধি এবং আত্মিক সাধনার কেন্দ্রে একটি সর্বভারতীয় ঐক্য ও মানের, কল্পনা ও মননের, ভাব ও আদর্শের প্রভাব ছিল সচেতন ও সক্রিয়। গুপ্ত-পর্বে কালিদাসের কাব্য, সারনাথের ভাস্কর্য, অজস্তা-গুহার চিত্রাবলী সেই চেতনার চরম অভিব্যক্তি; তাহাই সৰ্বভারতীয় মানদণ্ড। কিন্তু সপ্তম শতকের শেষার্ধ হইতেই ভারতবর্ষের রাষ্ট্রীয় ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস নূতন বাঁেক নিতে আরম্ভ করে, শুধু রাষ্ট্ৰক্ষেত্রেই নয়, সংস্কৃতির ক্ষেত্ৰেও। সর্বভারতীয় আদর্শের চেতনা পরেও আরও কিছুদিন সক্রিয় ছিল, সন্দেহ নাই, কিন্তু আঞ্চলিক আদর্শ ও কল্পনা ভারতীয় জীবনের নানাদিকে ক্রমশ সুস্পষ্ট আকার ধারণ করিতে আরম্ভ করিল। রাষ্ট্ৰীয় পরিমণ্ডলে স্থানীয় ছোট ছোট রাজ্য ও সামন্তরাষ্ট্র মানুষের চেতনাকে অধিকার করিল এবং এই আঞ্চলিক মনোবৃত্তি সংস্কৃতির ক্ষেত্রে অনুভূত হইতে দেরি হইল না। উত্তর-ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে যে-সব বিভিন্ন প্ৰান্তীয় ভাষা ও অক্ষর প্রচলিত তাহার প্রত্যেকটিরই জন্মকাল খ্রীষ্টোত্তর নবম-দশম-একাদশ শতকের মধ্যে; সর্বভারতীয় সংস্কৃত বা প্রাকৃত এবং ব্রাহ্মীলিপি এই শতাব্দীগুলির ভিতরই প্রান্তীয় ভাষা ও অক্ষরে রূপান্তর লাভ করে। এই সময়েই ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে আঞ্চলিক স্মৃতিশাস্ত্র রচনার সূত্রপাতও দেখা দেয়; এ- ক্ষেত্ৰেও সমাজবিন্যাসে আঞ্চলিক মানস প্রত্যক্ষ। শিল্পীসাধনার ক্ষেত্রেও এই সময় সর্বভারতীয় মানদণ্ড ছাড়িয়া অথচ সেই মান হইতেই বিবর্তিত হইয়া আঞ্চলিক রূপ ও রীতিকে আশ্রয় করিয়া এক একটি আঞ্চলিক শিল্পকেন্দ্র গড়িয়া ওঠে। রাষ্ট্রে আঞ্চলিক সামস্তাদর্শ, সমাজে আঞ্চলিক স্মৃত্যাদর্শ ও স্তরভেদ, ভাষা ও অক্ষরে আঞ্চলিক রূপ ও রীতি, শিল্পেও : আঞ্চলিক রূপ ও রীতি। সর্বভারতাদর্শ ও বোধের ক্ষেত্রে এই সর্বব্যাপী আঞ্চলিক আদর্শ এবং বোধই ভারতবর্ষের ইতিহাসে মধ্যযুগের সূচক।

যাহাই হউক, বাঙলাদেশে এবং সমগ্র বঙ্গ-বিহারে, পাল-বংশকে আশ্রয় করিয়াই এই মধ্যযুগীয় লক্ষণগুলি সুস্পষ্ট হইয়া দেখা দিতে আরম্ভ করে এবং আদিপর্বের শেষ পর্যন্ত অর্থাৎ মুসলমান অধিকারের পূর্ব পর্যন্ত নিজস্ব বৈশিষ্ট্যে এই লক্ষণগুলি ক্রমশ প্রকট হইতে থাকে। কী কী কারণে এই গভীর রূপান্তর সাধিত হইয়াছিল। তাহার কিছু আভাস আগে ধরিতে চেষ্টা করিয়াছি; আমাদের আলোচনা-গবেষণার বর্তমান অবস্থায় তাহার চেয়ে বেশি বলিবার উপায় নাই। তাহা ছাড়া, বর্তমান প্রসঙ্গে প্রয়োজনও নাই। এই কয়েক শতক (৭৫০-১২৫০) ধরিয়া বাঙলায় আচরিত শিল্পকলায় কী কী রূপান্তরের ফলে আসাম-বাঙলা-বিহারে অর্থাৎ প্রাচ্য-ভারতে এক নূতন শিল্পরূপ ও রীতির উদ্ভব ঘটিয়াছিল তাহাই বর্তমান প্রসঙ্গে আলোচ্য।

মধ্যযুগীয় পূর্বী শিল্পের সামাজিক পটভূমি

পাল-রাজবংশ বৌদ্ধ, কিন্তু রাজারা ব্রাহ্মণ্য ধর্ম ও সংস্কৃতির প্রতিও যথেষ্ট অনুরক্ত ছিলেন, এবং বৌদ্ধ ও ব্রাহ্মণ্য অনুষ্ঠান-প্রতিষ্ঠান দুইই তাঁহাদের পোষকতা লাভ করিত। জনসাধারণের অধিকাংশই যে ছিলেন ব্রাহ্মণ্য বা লোকায়ত ধর্মশ্রিয়ী তাহাতে কোনও সন্দেহ নাই। পাল-পর্বের শিল্পসাধনার পশ্চাতে রাজানুকুলা কতখানি ছিল বা না ছিল, বলা কঠিন; কিন্তু সমৃদ্ধ বিত্তশালী লোকদের পোষকতা যে ছিল এবং তাঁহাদেরও বিভিন্ন ধৰ্মসম্প্রদায়ের প্রয়োজনের প্রেরণাও যে সক্রিয় ছিল, এ-সম্বন্ধে সন্দেহের অবকাশ কম। সেন-আমলে রাজবংশ ও অভিজাত-চক্রের দৃষ্টিভঙ্গির কিছু পরিবর্তন ঘটে। সেন বংশ ব্রাহ্মণ্যধর্মের অনুরাগী এবং একান্তই ঐ ধর্মের পৃষ্ঠপোষক; অভিজাত-চক্রও তাঁহাই। এই আমলের রাজসভাপুষ্ট সংস্কৃত সাহিত্যের দিকে তাকাইলে মনে হয়, রাজসভা এবং অভিজাত চক্রের সমাজে অলংকরণ ও বিলাস-ব্যসনের আতিশয্য, জাকজমক ও আড়ম্বরপ্রিয়তা অত্যন্ত বাড়িয়া গিয়াছিল। সোনা-আমল্লুের তক্ষণ-শিল্পেও একই লক্ষণ দৃষ্টিগোচর; রচনাবিন্যাসে এবং দেহভঙ্গিতে অতিরিক্তমাত্রা সংবেদনশীলতার আবেদন, ডোলে ও গড়নে ইন্দ্ৰিয়পর ইহমুখীতার আকর্ষণ। সেইজন্যে মনে হয়, এই আমলের তক্ষণ-শিল্পে রাজপ্রাসাদ ও অভিজাত-চক্রের রুচি ও ভাবনাই ছিল একান্তভাবে সক্রিয়।

এই চার-পাচ-শ’ শতাব্দীর শিল্পের মূল প্রেরণা ছিল বৌদ্ধ, জৈন ও ব্রাহ্মণ্য শাস্ত্রানুমোদিত, উচ্চকোটির ধর্ম-কল্পনা ও ভাবনা, কোনও ব্যক্তি বিশেষের বোধ বা অভিজ্ঞতাসঞ্জাত কল্পনা-ভাবনা নয়, বিশেষ বিশেষ ধৰ্মসম্প্রদায়ের যৌথ সংহত বোধ ও অভিজ্ঞতা জাত ভাবনা-কল্পনা। এই পর্বের বৌদ্ধ, জৈন এবং ব্রাহ্মণ্য প্রত্যেক ধর্মেরই প্রতিমার স্বকীয় শাস্ত্ৰনির্দিষ্ট রূপ প্রত্যক্ষ, কিন্তু সে-রূপ সাধারণত কোনও ব্যক্তিগত বোধ বা অভিজ্ঞতা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নয়। তাহা ছাড়া, প্রতিমা-শাস্ত্রের দিক হইতে বৌদ্ধ, জৈন ও ব্রাহ্মণ্য প্রতিমায় যত পার্থক্যই থাকুক না। কেন, শিল্পের দিক হইতে ইহাদের মধ্যে কোনো পার্থক্যই নাই; শিল্পীরীতি ও আদর্শ প্রতোক ক্ষেত্রেই এক। এর পর আবার, প্রতিমাশাস্ত্রের নির্দেশ কোনও কোনও ব্যক্তিগত সৌন্দর্য বা অধ্যাত্মবোধ বা অভিজ্ঞতা দ্বারা রূপান্তরিত নয়। সমগ্র ভারতীয় প্রতিমাশিল্প সম্বন্ধেই এ-কথা প্রযোজ্য, এবং সেই হেতুই এই শিল্প অনামী।

মন্দির নির্মাণ ও প্রতিমা প্রতিষ্ঠা করিয়া ধৰ্মগত পুণ্যার্জনের সৌভাগ্য সকলের ছিল না। যাহারা এই ব্যয়ভার বহন করিতে পারিতেন তাহারাই কেবল সেই সুযোগ-সৌভাগ্যের অধিকারী ছিলেন। কাজেই এ-তথ্য সুস্পষ্ট যে, সমসাময়িক কালে জনসাধারণের মধ্যে একটি বিত্তশালী সম্প্রদায় ছিল যাঁহারা তাহদের নিজ নিজ ধর্মের অনুশাসন মানিয়া চলিতেন, ধর্মগত পুণ্যার্জনে বিশ্বাস করিতেন।

যাঁহারা প্রতিমা দান ও প্রতিষ্ঠা করিতেন, তাঁহারা পুণ্যার্জনের তৃপ্তি ও আনন্দ উপভোগেই সন্তুষ্ট থাকিতেন। প্রতিমা-নির্মাণের রীতি-নিয়ম সম্বন্ধে তাহাদের কোনও ব্যক্তিগত মতামত বা নির্দেশ বা রুচি কিছু ছিল না। শিল্পী চলিত প্রথা ও আদর্শ, শাস্ত্রীয় অনুশাসন এবং শিল্পীরীতির সাধারণ ঐতিহ্য অনুসরণ করিয়া মূর্তি গঠন করিতেন। তাঁহারই চতুঃসীমার মধ্যে শিল্পী ও তাহার সহকর্মীদের যাহা কিছু ভাবাদৃষ্টি ও শিল্পনৈপুণ্যের পরিচয়। শাস্ত্রীয় ধ্যানগত কল্পনার সঙ্গে শিল্পীর দৃষ্টি ও ভাবনা, ধ্যান ও কল্পনা সব সময় একাত্ম হইত। তাহা নয়; যখন হইত, তখন যথার্থ শিল্পবস্তু রচিত হইত, যখন তাহা হইত না তখন শুধু প্রতিমাই হইত, শিল্পীসৃষ্টি হইত না, মূর্তি হইত না।

শিল্পীরা ছিলেন সমাজের নিম্নতর স্তরের লোক এবং সাধারণত সকলেই ছিলেন পেশাগত শ্রেণী, গণ বা নিগমভূক্ত। তাঁহাদের পেশা বা বৃত্তিও সাধারণত নিম্নস্তরের বলিয়াই গণ্য হইত। প্রায়শ্চিত্ত প্রকরণ-গ্রন্থে ভবদেব-ভট্ট একটি উক্তি উদ্ধৃত করিয়া যে সব নিম্নবর্ণ ও শ্রেণীর স্পষ্ট খাদ্য ব্রাহ্মণদের পক্ষে নিষিদ্ধ এবং যাঁহাদের বৃত্তি ব্ৰাহ্মণদের পক্ষে গ্রহণীয় নয় তাহার একটি তালিকা প্রকাশ করিয়াছেন। এই তালিকায় অন্যান্যদের মধ্যে নাট, নর্তক, তক্ষক, চিত্রোপজীবী, শিল্পী, রাঙ্গোপঞ্জাবী, স্বর্ণকার এবং কর্মকারের নাম উল্লিখিত আছে। অবশ্য, বিজয়সেনের দেওপাড়া-লিপিতে বরেন্দ্ৰভূমির শিল্পীগোষ্ঠীচুড়ামণি এক রািণক শূলপাণির উল্লেখ আছে। মনে হয়, কখনও কখনও শিল্পীদের মধ্যে কেহ কেহ হয়তো রাজদরবারে সম্মানিত পদ অধিকার করিতেন, তবে এ-ধরনের দৃষ্টান্ত বিরল।

তারনাথ এই আমলের দুই জন শিল্পী, ধীমান এবং তাঁহার পুত্র বিটপালের নাম করিয়াছেন এবং বলিতেছেন, এই পিতা ও পুত্র দুইজনে তক্ষণশিল্প, ধাতব মূর্তিশিল্প এবং চিত্রকলার একটি বিশিষ্ট শিল্পীগোষ্ঠীর প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন; রাজকীয় দলিলপত্রে এবং ঐতিহ্যে আর কোনও শিল্পীর নাম বা স্মৃতিমাত্রও রক্ষিত হয় নাই। পাথরের ফলকে ও তাম্রপটুে লিপি উৎকীর্ণ করিয়াছেন এমন বহু তুক্ষকের নাম জানা যায়; তাহদের কেহ কেহ শিল্পী বলিয়াও অভিহিত হইয়াছেন; কোনও কোনও ক্ষেত্রে পিতা-পিতামহের নামও উল্লিখিত হইয়াছে। মনে হয়, ইহারা শুধু লিপিই উৎকীর্ণ করিতেন না, মূর্তি নির্মাণও করিতেন! সিলিমপুর-লিপির শেষ পঙক্তিতে লিপি-লেখক ভাস্কর সম্বন্ধে যে-ইঙ্গিত আছে তাহাও এই অনুমানের সমর্থক। “প্রেমিক যেমন গভীর মনোনিবেশে তাঁহার প্রিয়ার প্রতিকৃতি চিত্রিত করেন, তেমনিই মাগধ-শিল্পী সোমেশ্বরও গভীর অভিনিবেশে এই প্রশস্তি উৎকীর্ণ করিয়াছেন।” এখানে কবি সংক্ষেপে এবং প্রায় অননুকরণীয় ভাষায় সোমেশ্বরের শিল্পাদর্শের সংজ্ঞা নির্দেশ করিয়াছেন; মনে হয়, সোমেশ্বর সত্যই কৃতী শিল্পশ্রষ্টা ছিলেন, শুধু কারুবিদ মাত্র ছিলেন না। বাঙলার এই আমলের লিপিগুলিতে আর যে-সব শিল্পীর নামোল্লেখ দেখিতেছি, তাহদের এখানে একত্র করা যাইতে পারে। ভোগটের পৌত্র শুভােটর পুত্ৰ তাতািট; সৎ-সমতট নিবাসী শুভদাসের পুত্র মাংকদাস; বিমলদাস; সূত্ৰধার বিষ্ণুভদ্র; বিক্ৰমাদিতোর পুত্র শিল্পী মহীধর; মহীধর বা মহীধর-দেবের পুত্ৰ শিল্পী শশীদেব; শিল্পী কর্ণভদ্র; শিল্পী তথাগতসার; এবং ধর্মপ্রপৌত্র মনদাসপৌত্র বৃহস্পতিপুত্ৰ ‘বরেন্দ্রকশিল্পী গোষ্ঠীচূড়ামণি’ রাণক শূলপাণি।

এই চারি পাঁচ শতাব্দীর বঙ্গীয় শিল্পধারার সামাজিক পোষকতা কাহারা করিতেন এবং প্রেরণা আসিত সমাজের কোন স্তর হইতে তাহা বুঝিতে পারা কঠিন নয়। এই প্রেরণা ও পোষকতার স্তর তালিকা।গত করিলে এইরূপ দাঁড়ায়, ১৯ রাজপ্রাসাদ, রাজদরবার, সামন্ত-চক্র ও অভিজাত-চক্র; ২৭ বিশিষ্ট ধর্ম সম্প্রদায়ের নেতৃবর্গ এবং তাঁহাদের ধ্যান-ধারণা, ভাব-কল্পনা; ৩. বিশিষ্ট ধর্ম সম্প্রদায়ের অনুশাসনাধীন শ্রেণী ও বর্ণস্তর; এবং ৪. শ্রেণী, গণ বা নিগমভুক্ত শিল্পীকুল। ১নং স্তর সম্বন্ধে বলিবার কিছু নাই। ২নং স্তর স্পষ্টতই ব্রাহ্মণ্য, বৌদ্ধ বা জৈন পরোহিত্য-শাসনের নীতি-নিয়ম, ধ্যান-ধারণা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত! ৩নং স্তর সম্বন্ধেও একই কথা প্রযোজ্য, তবে, মূর্তি, মন্দির প্রভৃতির পোষকতা যখন ইহারা করিতেন তখন ইহারা স্বভাবতই এমন শ্রেণী:স্তরের লোক ছিলেন যে-স্তর বিত্তশালী এবং অপেক্ষাকৃত হ্রস্ববিত্ত বৃহত্তর জনসাধারণেরই একাংশ, কিন্তু সমাজে তোহারা বিশেষ সম্মানের পাত্ৰ বলিয়া গণ্য নহেন। এ-তথ্য সুস্পষ্ট যে, এই চরি৷ পাচ শতাব্দীর শিল্পে বৃহৎ জনসাধারণের বিশেষ কোনও স্থান নাই; যাঁহাদের আছে তাহারা পুরোহিত শ্রেণীর এবং অল্পবিস্তর বিত্তশালী সমৃদ্ধ সংকীর্ণয়তন গোষ্ঠীর লোক; তাঁহাদেরই সংহত সমন্বিত ঐতিহ্য ভাবকল্পনা এবং চিত্তাদর্শ এই শিল্পে প্ৰতিফলিত। এই মূর্তিকলা ভাব কল্পনায় সংস্কৃত ও অভিজাত উচ্চাকোটির শিল্পকলা, সমসাময়িক সামাজিক-অর্থনৈতিক বিন্যাসের প্রতিপত্তিশীল শ্রেণীর শিল্পকলা। এই কয় শতাব্দীর লোকায়ত শিল্পের স্বাক্ষর যে কী ছিল, কেমন ছিল তাহার রূপ তাহা বলিবার মতন কোনও অভিজ্ঞান আমাদের জানা নাই।

পাল ও সেনা-পর্বের তক্ষণ-কলার সাধারণ বৈশিষ্ট্য

সাধারণভাবে বলিতে গেলে পাল ও সেনা-পর্বের সমস্ত মূর্তিই সূক্ষ্ম অথবা অপেক্ষাকৃত মোটা দানূর কষ্টিপাথরে তৈরি; ধাতব মূর্তিগুলি পিতল ‘? গড়া। সোনা এবং রূপার তৈরি দু’একটি মূর্তিও পাওয়া গিয়াছে। কাঠের মূর্তি এবং অলংকরণ রচনাও একেবারে অজ্ঞাত ছিল না : ঢাকা-চিত্রশালায় তেমন নিদর্শনও দুই চারিটি সংগৃহীত আছে। কিন্তু পাথরই হোক আর কাঠ বা ধাতুই হোক, গঠনরীতির যত পার্থক্যই থাকুক, ভািবকল্পনা ও শিল্পপৃষ্টির, ডৌল ও মণ্ডনের, কাঠামো ও বিন্যাসের কোনও পার্থক্যই এ-যুগে দৃষ্টিগোচর নয়।

এই যুগের প্রায় সমস্ত প্রস্তর ও ধাতব মূর্তিই পৃষ্ঠপটযুক্ত ফলকে উৎকীর্ণ। দুই চারিটি ক্ষেত্রে মাত্র ব্যতিক্রম দেখা যায়। পাহাড়পুরের প্রস্তর ফলকগুলিতে এবং দেউলবাড়ীর সর্বণীমূর্তিতে ইতিপূর্বেই পৃষ্ঠপট ব্যবহারের প্রচলন দেখা গিয়াছিল; অষ্টম-শতকে তাহা পূর্ণ রূপ গ্রহণ করে। কালপ্রবাহের সঙ্গে সঙ্গে ফলকোৎকীর্ণ মূর্তি ক্রমশ পৃষ্ঠপট-নিরপেক্ষ হইতে থাকে; কিন্তু তৎসত্ত্বেও মূর্তিগুলিও কখনও একান্তভাবে সমতলবদ্ধ দৃষ্টি হইতে মুক্ত হইতে পারে নাই। একেবারে দ্বাদশ শতকের দুই চারিটি প্রতিমায় পূর্ণ ত্রিভুজায়িত রূপ যেন কিছুটা প্রত্যক্ষ। ফলকের উপর উৎকীর্ণ মূল প্রতিমার শিরোদেশের পশ্চাতে প্রভামণ্ডল; গোড়ার দিকে এই মণ্ডলটি অগ্নিশিখার রূপে সীমাঙ্কিত মাত্র; ক্রমশ তাহা অলংকরণবহুল হইতে হইতে পরিণামে প্রভামণ্ডলের অলংকরণসজ্জার ও বিন্যাসের পারিপটা মণ্ডলের অর্থ হরণ করিয়া লয়। এই প্ৰতিমাগুলিতে দেবদেবীদের যে নরনারীদেহ রূপায়িত, তাহতে একাধারে পার্থিব এবং দৈবী উভয় ভাব-কল্পনারই অপরূপ সমন্বয়। ইহাই শাস্ত্রীয় বিধান। সাধনমালাল বা প্রতিমালক্ষণশাস্ত্রের যে কোনও ধ্যান বা সাধন আলোচনা ও বিশ্লেষণ করিলেই দেখা যাইবে, অধ্যাত্ম নৈর্ব্যক্তিকতা এবং প্রায় ইন্দ্ৰিয়স্পর্শক্ষম দৈহিক সৌকুমার্য ও সৌন্দর্য দুইই একই সঙ্গে এবং সমভাবে স্বীকৃত। অৰ্চনার উদ্দেশ্যে যখনই কোনও দেবদেবীর মূর্তি রচিত হইত, তখনই রূপাদর্শ থাকিস্ত রূপযৌবনময় সুকুমার নর বা নারী। নারীদেহের নারীত্বকে ইন্দ্ৰিয়স্পর্শালু করিবার জন্য যেমন দেবী-প্রতিমার স্তন-যুগল সুডৌল মাংসল এবং মেখলা ও নিতম্ব দেশকে গুরুভার ও লীলায়িত রূপ দেওয়া হইয়াছে তেমনই দেবমূর্তিতে নরদেহের প্রশস্ত স্কন্ধের রেখাকে ক্রমশ ক্ষীণায়মান করিয়া সিংহকটিতে রূপায়িত করিয়া পৌরুষের ব্যঞ্জনা প্ৰকাশ করা হইয়াছে। এ-ক্ষেত্রেও প্রতিমার যৌবনপুষ্ট দেহ, দেহভঙ্গি এবং ভাবাভিব্যক্তিতে ইন্দ্ৰিয়গ্ৰাহীতার সুউচ্চারিত আভাস কিছুতেই দৃষ্টি এড়াইবার কথা নয়। বিশুদ্ধ অধ্যাত্ম ভাব-কল্পনা ও অভিব্যক্তির সঙ্গে সুস্পষ্ট ইন্দ্ৰিয়গ্রাহীতার এইরূপ অপরূপ সমন্বয় শিল্পের ক্ষেত্রে সূদুর্লভ। বলা বাহুল্য, ইহার মূলে সক্রিয় ছিল ইন্দ্ৰিয়ভোগের প্রত্যক্ষ “অভিজ্ঞতা ও আনন্দ এবং এই আনন্দ ও অভিজ্ঞতার প্রশস্ত অঙ্গন ছিল কামযোগ ও তান্ত্রিক সাধনার জগৎ। কিন্তু, এই প্রত্যক্ষ আনন্দ ও অভিজ্ঞতাকে যখন ধ্যানসূত্রানুযায়ী নৈর্ব্যক্তিক অধ্যাত্ম ভাবনা-কল্পনায় রূপাপ্তরিত করা হয়, তখন প্রত্যক্ষ ইন্দ্ৰিয়ভোগের ইঙ্গিত বা তাৎপর্য আর থাকে না, শুধু তাহার দূরাগত ধ্বনিটুকু থাকে মাত্র। সাধারণত, ধ্যানের সূত্র এবং দূরাগত এই ধ্বনি এই দুয়ের উপরই ছিল শিল্পীদের নির্ভর। প্রত্যক্ষ ইন্দ্ৰিয়াভিজ্ঞতাকে যৌগিক প্রক্রিয়ার সাহায্যে নৈর্ব্যক্তিক অধ্যাত্মা-ভাবনায় রূপান্তরের বিভিন্ন প্রয়াসকে বিভিন্ন ধর্ম সম্প্রদায়ের সাধকগণ বিভিন্ন ধ্যানে ও সাধনে প্রায় কতকগুলি গাণিতিক সূত্রে পরিণত কবিয়ছিলেন। এই এক একটি ধান বা সাধন এক একটি দেবদেবীর বিশিষ্ট রূপকল্পনা; তাহাতে সুস্পষ্ট নির্দেশ আছে বিশিষ্ট দেবদেবীর ও তাহার, মণ্ডলের, তাহদের রচনা ও বিন্যাসের, তাহাদের বিভিন্ন অংশের পরিমিতির, ভঙ্গির ও রূপের মাপ ও মানের। শিল্পীরা সাধারণত সকলেই এই স’ নির্দেশ নিষ্ঠার সহিত মানিয়া চলিতেন; কিন্তু এই সুবিস্তৃত ও পুঙ্খানুপুঙ্খ অনুশাসনের সীমায় আবদ্ধ থাকিয়াও প্রতিভাবান শিল্পী কোনও কোনও ক্ষেত্রে গভীর অস্তদৃষ্টির পরিচয় দিয়াছেন এবং তাহদের রূপসৃষ্টির আদশে প্রবুদ্ধ ও অনুপ্রাণিত হইয়া অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্রশক্তি শিল্পীরাও কেহ কেহ পরে নূতনতর দৃষ্টির কিছু কিছু দিশা লাভও করিয়াছেন। সাধারণত, বাস্তব শাবীৱ-বিজ্ঞানের প্রতি নিষ্ঠা ও শ্রদ্ধা, ভারতীয় শিল্পের অন্যান্য পর্বে যেমন, এ-পর্বেও তেমনই কোথাও উৎকট হইয়া দেখা দেয় নাই; কিন্তু অন্যদিকে একই সঙ্গে প্রতিমাগুলির অলংকার ও অলংকরণে যে বাস্তব নিষ্ঠা ও কারুকার্থের যে অপরিমেয় সূক্ষ্মতা দৃষ্টিগোচর, তাহা বিস্ময়কর।

বলিয়াছি, শারীর বিজ্ঞানের বাস্তবতার প্রতি শিল্পীদের দৃষ্টি কখনো আকৃষ্ট হইত না, কিন্তু বিশিষ্ট মানবদেহের যে বিশেষ ধর্ম, তাহার অন্তলীন অভিজ্ঞতার যাহা ব্যঞ্জনা, তাহার সুষ্ঠু সুমিত প্রকাশে কোথাও কোনও ব্যত্যয় ঘটে নাই। সে-প্রকাশ প্রতিমাগুলির বিশিষ্ট ভঙ্গ ও ভঙ্গিতে, বিশেষ চালচলনে, অর্থবহ স্থিতি বা গতিতে। কিন্তু এ-ক্ষেত্রেও বিভিন্ন সাধকের ধ্যানদৃষ্টিই সক্রিয় এবং সেই দৃষ্টি প্রায় গাণিতিক সূত্রাকারে গ্রথিত। পাল ও সেনা-পর্বের মূর্তিকলায় যে ভঙ্গ, ভঙ্গি এবং মুদ্রার সাক্ষাৎ পাওয়া যায় তাহার বীজ উপ্ত হইয়াছিল। গুপ্তপর্বের শিল্পকলায়; কিন্তু প্ৰাচ্য-ভারতের এই চারি-পাচশত বৎসরের শিল্প সেই বীজের সমস্ত ফল-সম্ভাবনাকে একটি একটি করিয়া নিঃশেষ সার্থকতায় পরিপূর্ণতা দান করিয়াছে। দুইটি স্থিতভঙ্গির উল্লেখ করিতেছি, একটি সমপদস্থান, অপরটি বাজপর্যাঙ্কাসন। দুইটি ভঙ্গিই উচ্চস্তরের অধ্যাত্ম যোগসাধনা দ্বারা নিয়মিত। বিষম ক্ৰোধ, চরম প্রলোভন, গভীর দুঃখ ও বিষাদ, পরিপূর্ণ সুখ ও আনন্দ, পরম শান্তি ও অস্থির চাঞ্চল্য সব কিছুর সম্মুখে দাঁড়াইয়া; সব কিছুর কেন্দ্রে বাস করিয়াও যে অবিচল দৃঢ়তা এবং নিয়ত পরিবর্তনশীল বস্তুজগতের মধ্যে যে শাশ্বত অপরিবর্তনীয়তা তাহা এই দুই ভঙ্গির মধ্যে ব্যক্তি। অথচ, মূল কেন্দ্র প্রতিমা যেখানে সমপদস্থানক ভঙ্গিতে দণ্ডায়মান বা বজপর্যাঙ্কাসনে আসীন, সেইখানে তাহার আনুষঙ্গিক পার্শ্বদেবতা ও অনুচর রূপে নানা লাসাভঙ্গিমায় যে-সব দেবদেবীমূর্তি খচিত, নৃত্যশীল ভঙ্গিমায় লীলাচ্ছলে নভোমার্গে যে-সব কিন্নৱী সঞ্চবমান, পৃষ্ঠাপটে রেখা কল্পনার যে ছন্দিত লীলায়িত ভঙ্গি, তাহদের মধ্যে সংসারের নিত্যচঞ্চল চলমান রূপ প্রত্যক্ষ। এই নিতাসিঞ্চরমান লীলায়িত রূপের কেন্দ্ৰে স্থানক বা আসীন যে কোনো অবস্থায় মূল প্রতিমার মুখমণ্ডল ও দেহব্যঞ্জনা স্মিতহাসো বিকশিত, স্থির, প্রশান্ত, গম্ভীর, আচঞ্চল, সমাহিত এবং রূপাস্তরের অতীত। বারবার বলিতে বাধা নাই, এই ভাবাদৃষ্টি যৌগিক দৃষ্টি। যাহা হউক, নবম-দশম-একাদশ শতকে পাশ্বদেবতা ও অলংকরণের সঙ্গে মূল মূর্তির একটা ভারসাম্য এবং একটা যুক্তিগত সামঞ্জস্য বর্তমান ছিল। দ্বাদশ শতকে পাশ্বদেবতাদের অস্থির চাঞ্চল এবং অলংকরণ-রেখার অশান্ত আবেগ মূল মূর্তির প্রশাস্তিকে, তাহার সমাধিকে অতিক্রম ও বিপর্যস্ত করিয়াছে।

অন্যান্য দণ্ডায়মান ভঙ্গির মধ্যে ঈষৎ আভঙ্গ ও ত্ৰিভঙ্গ এবং উপবিষ্ট ভঙ্গির মধ্যে ললিতাসন বা মহারাজিলীলাসন উল্লেখযোগ্য। এই সব ভঙ্গ ও ভঙ্গিমায় সহজ আত্মসমাহিত লালিত) পরিস্ফুট। তাহা ছাড়া, গতিশীল সক্রিয়তা গন্ধৰ্ব্বকিন্নরদের নৃত্যময় ও উড্ডীয়মান ভঙ্গিতে প্রত্যক্ষ এবং বীর্য ও দৃঢ়তা সমান প্রত্যক্ষ বরাহ-বিষ্ণুর এবং অন্যান্য দেবদেবীর আলীঢ় ও প্রত্যালীঢ় ভঙ্গিমায়। এই সব প্রত্যেকটি ভঙ্গ ও ভঙ্গিই শান্ত সমাহিত অভিজ্ঞতা ও ধানযোগ হইতে সঞ্জাত। শিল্পীর মানসে বরাহ-বিষ্ণু বা সঞ্চরণশীল গন্ধর্বের যে রূপ ধরা দিয়েছে, রেখায় ও ভোলে খচিত প্রাণবন্ত ভঙ্গি তাহার একদিক মাত্র; যাহা ক্ষণিকের একটি ভঙ্গি প্রকৃতপক্ষে তাহা গভীর ধ্যানের একটি রূপ। এই রূপকে শিল্পে গতিচ্ছন্দে প্রাণপ্রবাহে প্রকাশ করা হইয়াছে মাত্র! সেই জনাই, যে-ভঙ্গিতে বীরত্বের ব্যঞ্জনা সুস্পষ্ট, যেমন মহিষমৰ্দিনী প্রতিমায় বা বরাহ-বিষ্ণু প্রতিমায়, সে-ভঙ্গিতেও মুখাবয়লে কোনও সমতুল বীরত্বের ব্যঞ্জনা নাই, সে মুখ প্রশান্ত, আনন্দ-দীপ্ত; বীরত্বের এবং উজজীবনের ব্যঞ্জনা শুধু অঙ্গপ্রত্যঙ্গের বিন্যাসে, দেহভঙ্গিতে। কোনও দেব বা দেবীর ভাব ও ভঙ্গি কিরূপ হইবে তাহা যে নিয়মিত ছিল ঐতিহ্যগত অভিজ্ঞতা এবং ধ্যানসূত্রদ্বারা তাঁহাই শুধু নয়, সেই দেব বা দেবীর বিশেষ ভঙ্গি ও বিন্যাসের অধ্যাত্ম ব্যাখ্যা যে কী তাহাও সাধনসূত্রেই নিণীত। সুতরাং বিগ্রহ ও সাধনসূত্র উভয়ই উভয়ের ব্যাখ্যার সহায়ক।

নির্মাণকালার বিবর্তন ৭৫০-১২৫০

ডৌল ও গড়নের বিবর্তনের দিক হইতে অষ্টম শতকীয় বলিয়া মনে করা যাইতে পারে এমন প্রতিমার সংখ্যা খুব বেশি নয়। বর্ধমান-বরাকরে প্রাপ্ত দুইটি দেবী প্রতিমা, মানভূম-বোরামে প্রাপ্ত একটি প্রতিমা এবং দিনাজপুর-কাকদীঘিতে প্রাপ্ত একটি বিষ্ণুপ্রতিমা, অন্যান্য অনেক প্রতিমার সঙ্গে এই চারিটি মূর্তি অম্বুম শতকে রচিত হইয়াছিল বলিয়া মনে হয়। হ্রস্ব গুরুভার দেহে এবং মুখাবয়বের ভঙ্গিতে সমকালীন মাগধী তক্ষণশৈলীর লক্ষণ সুস্পষ্ট। এই বিরলালংকার দেহসজ্জা এবং ডোলের কমনীয়তাও পাল-পর্বের প্রথম পর্যায়ের শিল্পাদর্শের। এই শতকের ধাতব প্রতিমাগুলিতেও একই লক্ষণ দৃষ্টিগোচর।

লিপি প্রমাণের উপর নির্ভর করিয়া বাঙলার যে-ক’টি প্রতিমাকে নিঃসংশয়ে পাল ও সেন-পর্বের বলিয়া চিহ্নিত করা যায় তাহাদের সংখ্যা খুব বেশি নয়। (প্রথম ) মহীপালের রাজ্যাঙ্কের তৃতীয় বৎসরে প্রতিষ্ঠিত এবং ত্রিপুরা জেলার ল’স্কাউরা গ্রামে প্রাপ্ত একটি বিষ্ণুমূর্তি। এই রাজারই চতুর্থ সম্বৎসরে স্থাপিত একটি গণেশ মূর্তি; চন্দ্ৰবংশীয় রাজা গোবিন্দ চন্দ্রের রাজত্বকালে রচিত একটি বিষ্ণু ও একটি সূর্য-প্রতিমা। তৃতীয় গোপালের রাজত্বকালে নির্মিত একটি সদাশিব মূর্তি এবং লক্ষ্মণসেনের তৃতীয় রাজ্যাঙ্কে রচিত এবং ঢাকার ডালবাজারে প্রাপ্ত একটি চণ্ডী-মূর্তি, এই কয়েকটি লিপি ও তারিখ চিহ্নিত প্রতিমাই শৈলী-নির্দেশ ব্যাপারে আমাদের নির্ভরযোগ্য সাক্ষ্য বা দিগদৰ্শন-সহায়ক। ইহাদের সাহায্যে অল্পবিস্তুর নিশ্চয়তায় বাঙলার সমসাময়িক শিল্পের গতি নির্দেশ করা সম্ভব; বিহারে আবিষ্কৃত প্রতিষ্ঠা-তারিখযুক্ত প্রতিমার সাহায্যেও তাহার সমর্থন পাওয়া যায়। তবে, মনে রাখা দরকার, বিহার ও বাঙলার সমসাময়িক নির্মাণশৈলী ঠিক একই ধারা অনুসরণ করে নাই; গুপ্তধারা ও ঐতিহ্য বাঙলা অপেক্ষা বিহারে অধিকদিন সক্রিয় ছিল; পূর্ব-ভারতের আঞ্চলিক শৈলীর বিকাশ বাঙলায় দেখা দিয়েছিল বিহারের আগে। বস্তুত, অষ্টম শতকের শেষ নবম-শতকের সূচনা হইতেই পূবী শিল্পকলা বাঙলাদেশে তাহার স্থানীয় বৈশিষ্ট্য ও মর্যাদায় সুপ্রতিষ্ঠিত হইয়া গিয়াছিল; পরবর্তী তিন শতক ধরিয়া এই শৈলীই বিবর্তনের সাধারণ সূত্র ধরিয়া স্তরে স্তরে বিকশিত হইয়াছে।

নবম শতক

দেবপাল, শূরপাল, নারায়ণপাল এবং গুর্জরপ্ৰতীহাররাজ মহেন্দ্ৰপালের রাজত্বকালে রচিত কয়েকটি প্রস্তর ও ধাতব প্রতিমা বিহারে পাওয়া গিয়াছে। ইহাদের মাংসল দেহরূপ গুপ্ত-ঐতিহ্যের আপেক্ষিক কমনীয় ডৌল সুস্পষ্ট নৈর্ব্যক্তিকতায় প্রকাশিত; মুখের ভাব প্রশান্ত, কিন্তু দেহের মাংসল গড়নে ইন্দ্ৰিয়স্পর্শালুতার স্বাক্ষর। দেহভঙ্গি কোথাও কোথাও আড়ষ্ট; দেহের বহিরেখা দৃঢ়; এই দৃঢ়রেখাই উদ্বেলিত শক্তিকে সীমার বন্ধনে শক্ত করিয়া বাধিয়াছে; রূপায়ণে যে শক্তিমত্তার পরিচয় তাহা এইখানেই। দৃঢ় বহিরেখার মধ্যে কোমল, মাংসলতার আভাস ফুটাইয়া তোলাই নবম শতকীয় শিল্পদর্শ। খুব কম নিদর্শনেই উন্নত ও গভীর মানস কল্পনার কোনও স্বাক্ষর আছে। ধ্যানের ও উপলব্ধির যাহা কিছু আভাস তাহা শুধু অর্ধনিমীলিত চক্ষু দু’টিতে এবং প্রশান্ত মুখমণ্ডলে; কিন্তু তাহাও প্রায় সবটাই প্রথাগত।

পৃষ্ঠপটটি সাধারণত শিরোদেশে প্রায় অর্ধগোলাকৃতি; কিন্তু দু’একটি ক্ষেত্রে তীক্ষ কোণাযিত অগ্রভােগও দৃষ্টিগোচর। সিক্তবসনের মতো পরিধেয় ভাজ দেহডোলের সঙ্গে মিশিয়া গিয়াছে এবং ভাজগুলি সমান্তরাল তরঙ্গায়িত রেখায় চিহ্নিত। দাঁড়াইবার ভঙ্গি হয় সমপদস্থানক না হয় আভঙ্গ বা ত্ৰিভঙ্গ; কিন্তু বসিবার ভঙ্গি প্রায় সর্বত্রই ললিতাসন। ভঙ্গিটি আরামের ব্যঞ্জনা বহন করে সত্য, কিন্তু মূর্তির রূপায়ণে আরামের ব্যঞ্জনা স্বল্পই ব্যক্ত হইয়াছে। হস্ত, পদ, অঙ্গলি ইত্যাদির বিন্যাস একান্তই শাস্ত্ৰনির্দিষ্ট; কিন্তু ইহাদের দেহের অলংকরণ, অঙ্গপ্ৰত্যঙ্গের ক্ষীণতা অথবা মাংসলতা ব্যক্তিগত রুচিনির্ভর, আর রেখার গতি ও মণ্ডণের দৃঢ়তা বা কমনীয়তা যৌথশিল্পপৃষ্টি ও রীতিনির্ভর। জানুদ্বয় সযত্নে খচিত এবং পদদ্বয়ের গড়নে ডোলের নমনীয়তাও প্রত্যক্ষ। তরঙ্গায়িত কুঞ্চিত কেশদাম স্বন্ধের দুই পার্শ্বে নিয়মিত ছন্দে দুল্যমান; দুল্যমান উত্তরীয়ও দৃঢ় নিয়মিত ছন্দে বাধা; উভয়ক্ষেত্রেই স্বচ্ছন্দ লীলার আভাস অনুপস্থিত। অলংকারগুলি ভারী এবং কারুকার্যবিহীন; পৃষ্ঠপটে আলংকারিক সাজসজ্জাও অপেক্ষাকৃত স্বল্প; সর্বত্র তাহা মণ্ডিতও নয়, শুধু রেখার আঁচড়ে চিহ্নিত।

দশম শতক

দৃঢ়, সুনির্দিষ্ট বহিরেখার মধ্যে মাংসল কমনীয়তার আদর্শ অতিক্ৰম করিয়া দশম শতকে দৃঢ় শক্তিগৰ্ভ স্কুল দেহ নির্মাণের আদর্শ আত্মপ্রকাশ করিল। এই শতকের মানবদেহ কল্পনায় আত্মসচেতন, অর্থাৎ তাহা সংযত শক্তিমত্তার ব্যঞ্জনা ডৌল ও গড়নের মধ্যে সুস্পষ্ট সচেতন শক্তির দৃঢ় সংযত প্রবাহ যেন ভিতর হইতে ঠেলিয়া সমগ্র দেহটিকে উচ্ছসিত করিয়া তুলিয়াছে। কোনও কোনও নিদর্শনে কঠোর সংযমে এই প্রবাহোচ্ছাসকে নিয়ন্ত্রণ করা হইয়াছে এবং সে-সংযম এতই কঠোর যে, মনে হয়, দেহের সজীব মাংস যেন পাথরে পরিণত হইয়া গিয়াছে। কিন্তু সাধারণ দৃষ্টি ও রীতি ঠিক তাহা নয়; বরং দৃঢ় সংযত ডোলে ও মণ্ডণে সুকুমার মসৃণতার একটি উজ্জ্বল দীপ্তি ও প্রবাহ প্রত্যক্ষ, সমগ্র প্রতিমামণ্ডল ও পৃষ্ঠপটটির উপর যেন প্রাণের আনন্দ বিচক্ষুরিত, মুখমণ্ডল হইতে আরম্ভ করিয়া অঙ্গপ্রত্যঙ্গের সীমান্ত পর্যন্ত শক্তিগৰ্ভদেহের প্রাণপ্রাচুর্য পরিব্যাপ্ত; এই উদার বিরাট প্রাণময়তাই নবম শতকের কোমল মাংসলতাকে দশম শতকে অপরিমেয় শক্তিমত্তায় রূপান্তরিত করিয়াছে। সমগ্র দশম শতক জুড়িয়া বাঙলার তক্ষণশিল্পে এই বৈশিষ্ট্য অক্ষুন্ন, বিশেষভাবে প্রস্তরশিল্পে। দিনাজপুর জেলার সুরোেহর গ্রামে প্রাপ্ত ঋষভনাথ-প্রতিমা, ফরিদপুর জেলার উজানী গ্রামে প্রাপ্ত বুদ্ধ-মূর্তি, বগুড়া জেলার সিলিমপুরে প্রাপ্ত বরাহবিতার-মূর্তি এই উক্তির সাক্ষ্য। ক্ষেত্রবিশেষে কোথাও কোথাও দেহের উচ্ছসিত শক্তি কোমল কমনীয় রূপাদর্শের অন্তরালে কিছু ঢাকা পড়িয়া গিয়াছে এবং রূপায়ণে ইন্দ্ৰিয়গ্ৰাহীতার আভাসও স্পষ্ট; কিন্তু কোমল কমনীয়তাই হোক বা ইন্দ্ৰিয়গ্রাহীতাই হোক, দুইই দৃঢ় সংযত রেখাপ্রবাহ দ্বারা সুনিয়ন্ত্রিত।

অন্যান্য বিষয়ে দশম শতক মোটামুটি নবম-শতকের রূপ ও রীতিকেই বহন করিয়া লইয়া চলিয়াছে। পরিপূর্ণ মুখমণ্ডলের আকৃতি অবিকল এক; দেহ সামান্য দীর্ঘািয়ত, কিছু ক্ষীণায়তও বটে, এবং দেহের নমনীয়তা কিছুটা বর্ধমান। তাহার ফলে, দেহের রূপায়ণে রেখার প্রয়োগ বাড়িয়াছে। এ-পর্বে ললিতাসন ও অর্ধপর্যাঙ্কাসন ভঙ্গি প্রিয়তরা। পদযুগলের মণ্ডন কঠিনতর, ঋজুত এবং অপেক্ষাকৃত অনমনীয়। পটের বিন্যাস মোটামুটি এক, কিন্তু পটভূমির অলংকরণ সূক্ষ্মতর হইয়াছে এবং অলংকারের কারুকার্যেও পারিপাট্য বাড়িয়াছে। ওষ্ঠ ও নাসিকার, ভ্ৰ ও চক্ষুদ্বয়ের, বসন ও অলংকারের রেখায় নবম-শতকীয় তীক্ষতা অন্তৰ্হিত; রেখা সুমার্জিত এবং ডোলের সঙ্গে এক সুরে বাধা; পৃষ্ঠপটের উপরিভাগ সূক্ষ্মাগ্র এবং ঠিক তাহার নীচেই কীর্তিমুখী অলংকার।

কলিকাতার আশুতোষ-চিত্রশালায় দশম শতকীয় কয়েকটি উল্লেখযোগ্য মূর্তি আছে। হুগলী জেলায় প্রাপ্ত লোকেশ্বর-প্রতিমা, অগ্রদি গুণে প্রাপ্ত একটি নারীর মুখমণ্ডল, সুন্দরবনে প্রাপ্ত একটি বিষ্ণুপ্রতিমা এবং মহাপরিনির্বাণ বুদ্ধের একটি ফলক। এই প্রতিমাগুলিতে, অল্পবিস্তর ব্যতিক্রম সত্ত্বেও, একই দশম-শতকীয় আদর্শ প্রতিফলিত।

দশম শতক বাঙলা প্রতিমাশিল্পের সুবর্ণযুগ। অষ্টম শতকে প্রতিমাশৈলী কেন্দ্রবিচ্যুত, কর্দমশিথিল। নবম শতকেও মাংসল শৈথিলা বিদ্যমান। কিন্তু তাহাকে রেখার সীমানায় বঁধিবার একটা চেষ্টা প্রত্যক্ষ। দশম শতকে কেন্দ্ৰচেতনায় সমগ্র দৃষ্টি জাগ্ৰত; শিথিল মাংসল দেহে শক্তির আবির্ভাব, চারিত্রিক দৃঢ়তা বাঞ্জিত।

একাদশ শতক

একাদশ শতকে দৃঢ় শক্তিগৰ্ভ দেহে লাগিল রসমাধুর্যের স্পর্শ, কিছু সৌষ্ঠবের চেতনা। দেহরূপের ক্ষীণতর দিকেও প্রবণতা গেল বাড়িয়া। প্রথম-মহীপালের রাজ্যাঙ্কের তৃতীয় বৎসরে যে বিষ্ণুমূর্তিটি বাঘাউড়ায় পাওয়া গিয়াছে তাহাতে এই সব লক্ষণ বিদ্যমান। এই মূর্তিটিকে পরবর্তী দুই তিন পুরুষের তক্ষণকলার মানদণ্ড হিসাবে গণ্য করা যাইতে পারে। দশম শতকে যে গভীর ও প্রশস্ত গঠন-নৈপুণ্যের পরিচয় পাওয়া যায়, এই শতকে তাহা ক্রমশ সংকীর্ণ ও সীমাবদ্ধ হইতে চলিয়াছে এবং ক্ষীণদেহে কোমল পেলাব গড়নের রীতি প্রাধান্য লাভ করিতেছে। পদযুগলের ঋজু কাঠিন্য ক্রমবর্ধমান; সাধারণ ভাবে দেহরেখার নমনীয়তাও ক্রমহ্রস্বায়মান। জানুর গড়ন ও মণ্ডনে নবম ও দশম শতকীয় মার্জিত নৈপুণ্য অন্তহিঁত; শুধু একটি গভীর বক্ররেখায় জানু চিহ্নিত। বস্তুত, দেহের উধ্বভাগের মনোরম মাধুর্যময় গড়ন এবং প্রশান্ত উদার স্মিত মুখমণ্ডলের সঙ্গে দেহের নিম্নভাগের ঋজু, কঠিন অনমনীয় গড়নের কেমন যেন কোনও মিল নেট।

অন্যদিকে পৃষ্ঠপটের বৈচিত্র্য ও অলংকার ক্রমবর্ধমান। প্ৰতিমার অলংকরণ, সহচর দেবদেবীদের অলংকার-বৈচিত্ৰ্য, বিচরমান গন্ধৰ্ব্ব-কিন্নর, পটের অলংকায় ও কারুকার্য ইত্যাদি ক্রমশ প্রতিমাকে অতিক্ৰম করিয়া অতিমাত্রায় স্বাতন্ত্র্যপরায়ণ। তবু, একাদশ শতকের প্রথমার্ধে প্রতিমা ও পার্শ্বদেবতা, প্রতিমা ও পৃষ্ঠপটের মধ্যে একটা ভারসাম্য বিদ্যমান; শেষার্ধের দিকে মূল প্রতিমার সৌষ্ঠব ও সৌন্দর্য ক্রমবর্ধমান অলংকার প্রাচুর্যে প্রায় ভারগ্রস্ত। শিল্পীর আনন্দ যেন এই প্রাচুর্যের মধ্যেই উদ্দীপ্ত। দ্বাদশ শতকে কিন্তু এই উদ্দীপ্ত প্রাচুর্যই ক্রমে হইয়া উঠিল। শিল্পের বন্ধনরজ্জু।

কেশবিন্যাসে এবং উত্তরায়ের রেখায় তরঙ্গায়িত ছন্দ, গভীর ত্রিভুজায়িত ডোলে ও তির্যক বা আলম্ব গভীর রেখায়, আলোছায়ায় স্পন্দিত লীলা! দেহভঙ্গি যেন ছাচে ঢালাই করা, কিন্তু মুখভঙ্গি সংবেদনশীল এবং গড়ন কোমল, সুকুমার। মুখাকৃতি যাহাই হউক, চিবুকের রেখাটি সজীব, ওষ্ঠীদ্বয় প্রায় গোলাকৃতি, চক্ষুদ্বয় গভীর ও প্রশস্ত। বসন দেহের রেখার ও ডোলের সঙ্গে একেবারে একাঙ্গীভূত, বস্ত্ৰাঞ্চল মনোরম তরঙ্গায়িত্ত রেখায় খচিত। ভ্র-চিত্রণে কোনও কোনও নিদর্শনে বঙ্কিম রেখাটিকে দুইবার তরঙ্গায়িত করা হইয়াছে, অর্থাৎ ভূ-র প্রান্তসীমায় আবার উপর দিকে একটু ঢেউ খেলানো হইয়াছে; উদ্দেশ্য যে মাধুর্য ও সংবেদনশীলতার প্রকাশ তাহাতে আর সন্দেহ কি! এই সংবেদনশীল মাধুর্য এবং দীর্ঘািয়ত ক্ষীণ, সৌষ্ঠবময় দেহই একাদশ শতকীয় মূর্তিকলার প্রধান বৈশিষ্ট্য। অগ্রদিগুণে প্রাপ্ত উমা-মহেশ্বর প্রতিমা, সুন্দরবনের কঙ্কনদীধির নবগ্রহ। ফলক, সুন্দরবনে প্রাপ্ত বীণাবাদিনী সরস্বতী এই বৈশিষ্টোর স্বাক্ষর।

দ্বাদশ শতক

এই ক্ষীণ দীর্ঘায়ত সৌষ্ঠবমাধুর্যময় দেহের মার্জিত শ্ৰী দ্বাদশ শতকে অলংকার ও পৃষ্ঠপটের অলংকরণের প্রাচুর্যে শুধু যে ভারগ্রস্তই হইয়া পড়িল তাঁহাই নয়, নবম-শতকীয় মাংসল শৈথিল্যও পুনরাবর্তিত হইয়া দেহরূপকে ক্রমশ নিজীবী ভারগ্রস্ত জড়তায় মণ্ডিত করিয়া দিল। দেহট্টেীলের কোমল সজীবতা ও পেলাব মাধুর্য ক্রমে বিদায় লইল। এই শতকের মূর্তিনির্মাণ-কলার স্বাক্ষর দেখিতেছি। তৃতীয় গোপালের রাজত্বকালে খচিত রাজীবপুরে প্রাপ্ত সদাশিব-মূর্তিতে এবং লক্ষ্মণসেনের তৃতীয় রাজাঙ্কে প্রতিষ্ঠিত ঢাকার ভালবাজারে প্রাপ্ত চণ্ডী-প্রতিমায়!

প্রতিমা, পাঠ্যপীঠ, কাঠামো ও পৃষ্ঠপটের বিন্যাস এই শতকে অপরিবর্তিত; দেহকাণ্ডের ক্ষীণ দীর্ঘায়ত ধারাও গোড়ার দিকে অব্যাহত। কিন্তু মুখাবয়বের স্মিত সংবেদনশীলতা আর নাই; তাহার জায়গায় দেখা দিয়াছে অকারণ গান্তীর্যের ভাব। অলংকরণ ছাড়া মার্জিত ভ্ৰ-যুগলের আর যে কোনও উদ্দেশ্য আছে এমন মনে হয় না; পদযুগল তাহার সমস্ত কমনীয়তা হারাইয়া যেন দুইটি স্তম্ভে পরিণত হইয়াছে। পৃষ্ঠপটের ত্রিকল্প বা চতুর্কল্প বিভাগে অসংখ্য গুরুভার পার্থদেবতা, সুপ্রচুর অলংকরণ অথচ সেই অলংকরণ সমগ্র মূর্তির রূপকল্পনার সঙ্গে কোনও অচ্ছেদ্য সম্বন্ধে যুক্ত নয়; সর্বত্র অকারণ ঘনবিন্যস্ত বাহুল্য। সব মিলিয়া সমগ্র প্রতিমা-পটটিকেই যেন ভারাক্রান্ত করিয়া রাখিয়াছে।

প্রতিমার দৈহিক গঠনে কমনীয়তার কোনও অভাব নাই, কিন্তু সে-কমনীয়তা যেন মন্দির, অবশ, নিজীব। বঙ্কিমায়িত ভঙ্গির সাক্ষ্য সুপ্রচুর, কিন্তু সে ভঙ্গিতে লীলায়িত গতির ব্যঞ্জনা নাই। বসন প্ৰান্ত ও অঞ্চল তরঙ্গায়িত, গন্ধৰ্ব্ব ও কোনও কোনও পার্শ্ব দেবতার দেহভঙ্গিতে ক্রীড়ালীলার প্রকাশও গোচর; বসনের বহুল রেখাবিন্যাস, পরিধেয় ও কেশ-বিন্যাসের অলংকরণ প্রাচুর্য, গভীর আলোছায়ার বৈচিত্ৰ্যখচিত অলংকার ও পাটদুশ্য প্রভৃতি সত্ত্বেও জীবনের স্বতোদৃপ্ত ও সুস্পষ্ট উজ্জ্বল স্বাক্ষর এ-পর্বের মূর্তিরচনায় অনুপস্থিত। ভোগব্যায়ত সুপূর্ণ ওষ্ঠাধর, ধনুকাকৃতিভ্রুযুগল এবং সুস্মিত মুখমণ্ডল সত্ত্বেও মুখাবয়ব তীক্ষ, প্রায় ত্রিকোণাকৃতি ও কঠিন; সমস্ত মুখমণ্ডলে কোনও গভীর আত্মিক ব্যঞ্জনার চিহ্নমাত্র নাই। দশম-একাদশ শতকের মূর্তিকলায় যে ধ্যানগম্ভীর প্রশান্ত শ্ৰীযুক্ত মুখমণ্ডলের সঙ্গে আমাদের পরিচয়, সে মুখ বিগত; ধ্যানগম্ভীর প্রশাস্তির স্থান লইয়াছে গভীর আনন্দ সম্ভোগের মন্দির পরিতৃপ্তি। এই সম্ভোগের মন্দির পরিতৃপ্তির মাধুর্যই লক্ষ্মণসেনের রাজ্যাঙ্কের তৃতীয় বৎসরে রচিত চণ্ডীর মুখমণ্ডলে। বস্তুত, এই পর্বের প্রতিম।কলায় সর্বত্র একান্ত ইহগত ভোগবাসনার মন্দির মাধুর্যের ব্যাপ্তি দুর্বল কামনার মোহময় বিলাস। তাহা সত্ত্বেও এখানে সেখানে নবতর শিল্পপ্রেরণা ও শিল্পাদর্শের পরিচয় একেবারে নাই, এমন নয়। দুই একটি নিদর্শনে পরিপূর্ণ মগুলায়িত কাঠামোর মধ্যে অমার্জিত অথচ শক্তিগৰ্ভ শিল্পক্রিয়ার প্রয়াস সুস্পষ্ট, এবং অলংকারাবাহুল্য এবং নিখুঁত বিন্যাস সত্ত্বেও এই শিল্পক্রিয়ার মধ্যে একটা সচেতন শক্তি ও মর্যাদা এবং প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার সজীবতা স্বপ্রকাশ। এই শক্তি, মর্যাদা ও সজীবতা বাঙলার প্রতিমাকলাকে চূড়ান্ত ধ্বংসের হাত হইতে হয়তো বাচাইতে পারিত। কিন্তু তাহা হইল না; সমসাময়িক সামাজিক বাতাবরণে এই শক্তি, মর্যাদা ও সজীবতা কোথাও ছিল না। তাহা থাকিলে এবং অবকাশ পাইলে হয়তো এই শিল্পকলা নব নব অভিজ্ঞতার ও চেতনার আশ্রয়ে নূতন পথ ও আদর্শের সন্ধানলাভ করিতে পারিত। কিন্তু ইসলামের দ্রুত অভিযান সমস্ত আশা-ভরসার পথ মরুঝড়ে ঢাকিয়া দিল।

দ্বাদশ শতকের প্রতিমাকলা প্রধানত সেনা-বর্মণ পর্বের শিল্পাদর্শের এবং সমাজাদর্শের অনুপ্রেরণায় রচিত ও লালিত। এই আমলের প্রতিমাগুলিতে যে, ইহগত, একান্ত পার্থিব সুখৈশ্বর্যের ব্যঞ্জনা, সেই একই ব্যঞ্জনা সেন-বৰ্মণ রাজসভার সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে। ধর্মগত বিষয়বস্তু সত্ত্বেও শিল্প ও সাহিত্য উভয়ই পার্থিব ভোেগচেতনা এবং জৈব কামনা-বাসনা দ্বারা মণ্ডিত। জয়দেবের গীতগোবিন্দ বা গোবর্ধনের সপ্তশতী তো সমসাময়িক শিল্পেরই সাহিত্যিক প্রতিরূপ। সন্দেহু নাই, ইহার মূল ধর্মগত প্রেরণা কিছুটা ছিল, কিন্তু এ-বিষয়েও কোনও সন্দেহ করা চলে না যে যাহা মূলে ছিল অধ্যাত্মপ্রেরণা তাহা রাজসভার ইহগত ভোগবাসনার স্পর্শে একান্ত ইহগত ভাবনা, কল্পনার বিবর্তিত হইয়া গিয়াছিল। সূক্ষ্ম কমনীয় ইন্দ্রিয়গ্রাহীতা বাঙলার শিল্পকলার প্রধান বলিয়া আগেও পরিগণিত হইত, কিন্তু সেনা-বর্মণ আমলে তাহা দেহগত কামনার মদিরমাধুর্যে পর্যবসিত হইল!

এই আমলের প্রতিমাকলার এই ঐহিক ভাবিদ্যুষ্টির মুলে ভিনাপ্রদেশী ভাবকল্পনার প্রভাব থাকা কিছু বিচিত্র নয়। সমসাময়িক দক্ষিণী প্রতিমা-শিল্পেও একই ঐহিক ভোগসমৃদ্ধির এবং গুরুভার অলংকরণের প্রাধান্য। অবশ্য, বাঙলার প্রতিমাকলায় যে কমনীয়তা, সজীবতা ও সংবেদনশীলতা প্ৰত্যক্ষ দক্ষিণী শিল্পে তাহা নাই; স্মরণ রাখা প্রয়োজন, বাঙলার এই কমনীয়, সজীব ও সংবেদনশীল শিল্পদর্শ পূর্বতন পাল-প্রতিমাকলার উত্তরাধিকার।

সাধারণ কয়েকটি মন্তব্য

নবম হইতে দ্বাদশ শতক এই চারিশত বৎসরে বাঙলাদেশে অসংখ্য প্রস্তর ও ধাতব প্রতিমা রচিত হইয়াছিল; তাহার স্বল্পাংশমাত্র আমাদের হাতে আসিয়া পৌঁছিয়াছে। শিল্পশৈলীর যে ধারাবাহিক বিবর্তনের কথা বলিলাম, প্রত্যেকটি প্রতিমাই যে সেই ধারা অনুসরণ করিয়াছে এমন নয়; ব্যতিক্রমও প্রচুর। তবু, এই ধারাই সাধারণ প্রবহমান ধারা। কাল কালান্তরে প্রবেশ করে; কোনও কোনও ক্ষেত্রে পরবর্তী কালের লক্ষণ আগের কালেই আত্মপ্রকাশ করে, আবার কোনও কোনও নিদর্শনে অতীতকালের বৈশিষ্ট্যও সমসাময়িক কালে আমলিন থাকিয়া যায়। বস্তুত, কোনও দুই কালপর্বের মধ্যে সুস্পষ্ট বিভেদরেখা টানা সম্ভব নয়। তাহা ছাড়া, যে কলা গতিশীল তাহাতে একই ভাবাদর্শ বা ভঙ্গিমার পুনরাবৃত্তি আশা করা যায় না; সাধারণ শিল্পাদর্শেও ব্যতিক্রম দেখা যায়। একই যুগে, এমন কি একই রাজার স্বল্পস্থায়ী শাসনকালেও বিচিত্র মুখাবয়ব, বিভিন্ন নির্মােণরীতি, মণ্ডনকৌশল, এমন কি ভিন্নতর সৌন্দর্যবোধের সাক্ষাৎও পাওয়া যায়। কিছুটা কারণ ভৌগোলিক সন্দেহ নাই; স্থানভেদে রুচির ভেদ, রীতির ভেদ এবং সেই হেতু উত্তরবঙ্গের সঙ্গে দক্ষিণবঙ্গের, পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে পর্ববঙ্গের প্রতিমাকলায় কিছুটা রূপ-পার্থক্য অনিবার্য। কিন্তু মোটামুটি মানদণ্ড এক এবং অভিন্ন, সমস্তই একই শিল্পাদর্শের সৃষ্টি। এই চারি শতকের বাঙলাদেশে নানা বিভিন্ন জাতি ও জনের বাস, নানা ভিন প্রদেশী লোকের; কোনও কোনও প্রতিমার মুখাকৃতি ও গঠনে বিশিষ্ট জন-বৈশিষ্ট্যও সেই হেতু প্রত্যক্ষ। কোনও কোনও নিদর্শনে তীক্ষা মঙ্গোলীয় প্রভাব সুস্পষ্ট; এই ভোট ব্ৰহ্ম বা মঙ্গোলীয় মুখবৈশিষ্ট্যের পশ্চাতে সমসাময়িক ইতিহাসের প্রেরণা সক্রিয় বলিয়া মনে হয়। শিল্পীর ব্যক্তিগত রুচি এবং গঠনরীতিও কিছুটা এই পার্থক্যের মূলে, সন্দেহ নাই। বাঙলার সমসাময়িক লোকায়ত শিল্পও পাশাপাশি বর্তমান ছিল; তোহার সঙ্গে উচ্চকোটি শিল্পাদর্শ ও রীতির একটা যোগাযোগ ছিল, এমনও অসম্ভব নয় এবং দুইই একে অন্যের দ্বারা কিছুটা প্রভাবিত হয়তো হইয়াছিল। তবু মোটামুটি বলা যায়, উচ্চস্তরে প্রতিমাশিল্প শাস্ত্ৰবন্ধন হইতে কখনও একেবারে মুক্তিলাভ করিতে পারে নাই। ১৫৭৯ শাকে উৎকীর্ণ একটি পার্বতী-মুর্তি (রাজশাহী-চিত্রশালা) এবং বরিশালে প্রাপ্ত আনুমানিক অষ্টাদশ শতকের চতুর্ভূজা একটি জগদ্ধাত্রী-প্রতিমায় (আশুতোষ-চিত্রশালা) সমসাময়িক শিল্পের নিজীবী, আনুষ্ঠানিক, প্রতিমালক্ষণ-শাস্ত্রশাসিত শিল্পাদর্শের লক্ষণ সুস্পষ্ট। এই সুদীর্ঘ চারিশত বৎসরের শিল্পীরূপের প্রবাহ গভীর বিরোধী ভাবতরঙ্গে আবর্তিত্ব। এই প্রবাহের গতি কখনও সুস্পষ্ট ও প্রত্যক্ষ ইন্দ্ৰিয়স্পর্শালু মাংসলতার দিকে, কখনও পরোক্ষ ও নৈর্ব্যক্তিক ইন্দ্ৰিয়ব্যঞ্জনার দিকে; কিন্তু দুইটি গতিই একই শাস্ত্রশাসনদ্বারা নিয়মিত। একটি অপরূপ মানসম্বন্দ্বের ভিতর দিয়া এই শিল্পকলার বিকাশ; এই মানসম্বন্দ্বজনিত বৈশিষ্ট্য ও মাধুর্যই এই চারিশত বৎসর শিল্পকলার প্রধান লক্ষণ। একদিকে ইহুগীত, দৈহিক, ইন্দ্রিয়গত কামনা-বাসনার সন্তা, অন্যদিকে নৈব্যক্তিক কামনা-বাসনার উপলব্ধির সন্তা একদিকে তান্ত্রিক সাধনার দেহবাদ, যে সাধনা এই রক্তমাংসের দেহকেই মরমার্থিত ঐশ্বর্যের আকর বলিয়া ধ্যান করে, অন্যদিকে আত্মসন্ধানী ব্ৰাহ্মণ্য সাধনা যে সাধনা মানুষের রক্তমাংসে গড়া দেহের অন্তর্নিহিত অপরূপ দেবত্বকে রূপমণ্ডিত করিবার স্পর্ধ রাখে- এই দুই বিরোধী ভাবাদর্শের সংঘাতবর্তে এই চারি শতকের শিল্পপ্রবাহ আন্দোলিত। এই দুই ভাবাদশের সংঘাতের ভিতর দিয়াই এই চারি-শতকের প্রতিমাকলা ধীরে ধীরে অগ্রসর হইয়াছে। প্রথম পর্বে দেহের সহজ সরস কমনীয়তা এবং ভঙ্গি, বিরল সাজসজ্জা, অলংকার ও আড়ম্বর। কিন্তু সময়ের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে দৈহিক কমনীয়তা ও ভঙ্গি অস্থির ও চঞ্চল হইতে আরম্ভ করে, সাজসজা ও অলংকরণ ক্রমশ বাহুল্যমণ্ডিত হইতে থাকে। সরল ও প্রশান্ত দেহভঙ্গি হইতে আরম্ভ করিয়া ক্রমশ চঞ্চল ও লাস্যময় দেহভঙ্গিতে রূপান্তর দৃঢ় সরল রেখায় অগ্রসরমান। পরিণামে মাত্রাহীন আতিশয্য সমস্ত শিল্পাদর্শকে অবশ্য নির্জীব মদিরতায় পল্লবিত আলংকারাড়ম্বরে একেবারে আচ্ছন্ন করিয়া ফেলে। সমসাময়িক সাহিতে কামনা-বাসনার আতিশয্য, উচ্ছসিত পল্লবিত বাক্য ও ব্যঞ্জনবিহীন লাস্যভঙ্গি সমসাময়িক শিল্পেরই প্রতিরূপ এবং দুই-ই ধ্বংসোন্মুখ ক্ষীয়মাণ সংস্কৃতির সুস্পষ্ট ঘোষণা। এই ক্ষীয়মান সংস্কৃতির উপর যবনিকা টানিয়া দিল ইসলামাভিযান। কিন্তু যবনিক পতনের পূর্ব মুহুর্তে যে প্রাণ এই শিল্পীদেহে স্পািদত হইতেছিল। সে প্রাণ দুর্বল, তাহার শক্তি আর কিছু ছিল না!