০৩. তক্ষণ-শিল্প প্রাথমিক বিকাশ ও ক্ল্যাসিক্যালপর্ব

তক্ষণ-শিল্প প্রাথমিক বিকাশ ও ক্ল্যাসিক্যালপর্ব

পোড়ামাটি, পাথর ও মিশ্রধাতুর, কচ্চিৎ কখনও কাঠের তৈরি ভাস্কর বা অঙ্কণশিল্পের যে-সব শিল্প-নিদর্শন বিগত প্ৰায় শতবর্ষ যাবৎ নানা ব্যক্তিগত, প্রতিষ্ঠানিক ও সরকারী চিত্রশালায় সংগৃহীত হইয়াছে, আজও হইতেছে, আজও যত নিদর্শন বাঙলার মাঠে-ঘাটে, ঝাড়ে-জঙ্গলে পড়িয়া আছে— ‘অজ্ঞতায়, অনাদরে, অবহেলায় তাহার প্রায় সমস্তই এক সময় ছিল কোনও না কোনও মন্দির বা বিহারের অংশ— গর্ভগৃহের দেবদেবী, প্রাচীর-ণোত্র কুলুঙ্গি বা দরজার অলংকরণ। এ-ধরনের বিহার ও মন্দিরের কথা যে পরিমাণে সমসাময়িক ভ্রমণ-বৃত্তান্ত, সাহিত্য ও লিপিপাঠ করা যায়। সেই পরিমাণে ইহাদের সাক্ষাৎ আজ আর পাওয়া যায় না; পাথর বা পোড়ামাটি বলিয়া তক্ষণ-শিল্পের নিদর্শনগুলি ইতস্তত পড়িয়া আছে মাত্র, ভগা বা অল্পবিস্তর অক্ষত অবস্থায়। ধাতব নিদর্শনগুলির অধিকাংশই মানুষ লোভের বশে গলাইয়া ফেলিয়াছে। কাজেই, স্বাভাবিক ও মৌলিক উদ্দিষ্ট পরিবেশের মধ্যে আজ আর ইহাদের সাক্ষাৎ পাইবার উপায় নাই এবং সেই হেতু ইহাদের যথার্থ শিল্পরূপও আর আমাদের দৃষ্টিগোচর নয়। ব্যক্তিগত সংগ্রহে বা সাধারণ চিত্রশালায় ইহাদের পরিপূর্ণ রসোপলব্ধি, এমন কি রূপবোধও কিছুতেই সম্ভব নয়; এ-ভাবে এ-পরিবেশে দেখিবার জন্য বা আমাদের জ্ঞানের কৌতুহল বা চিত্তের রূপতৃষ্ণ চরিতার্থ করিবার জন্য ইহাদের সৃষ্টি হয় নাই, হইয়াছিল একটা বিশেষ প্রেরণায়, বিশেষ পরিবেশে, বিশিষ্ট একটা উদ্দেশ্যসাধনের জন্য। সে-প্রেরণা ধর্মবোধগত— আমাদের প্রচলিত অর্থে নন্দনবোধগত নয়; সে-পরিবেশ বিশিষ্ট সমাজের ও সম্প্রদায়ের সামগ্রিক ঐক্য ও মিলনবোধগত, কারণ, পূজামন্দির বা তীর্থস্থানগুলিই ছিল সেই ঐক্য ও মিলনের কেন্দ্র এবং সেই উদ্দেশ্য হইতেছে সমাজ ও সম্প্রদায়গত ধর্ম ও ঐক্যবোধে ব্যক্তি ও সমাজকে উদ্ধৃদ্ধ করা, সচেতন করা। এই প্রেরণা, পরিবেশ বা উদ্দেশ্য কিছুই আজ আর উপস্থিত নাই; কাজেই সাম্প্রতিক মানুষের পক্ষে ইহাদের যথার্থ মূল্য ও আবেদনের পরিমাপ করা অত্যন্ত কঠিন। তবু, সবিনয়ে একথা স্বীকার করা ভালো যে, যে-শৈলী ও রীতি-বিবর্তনের দিক হইতে বা নন্দনবোধের দিক হইতে আমরা সাধারণত ইহাদের মূল্যবিচার করিয়া থাকি তাহাই ইহাদের সর্বাঙ্গীন পরিচয় নয়, এমন কি প্রধান পরিচয়ও নয়। শিল্প সম্বন্ধে এই একান্ত রূপগত ও ইন্দ্রিয়গত দৃষ্টি একেবারেই সাম্প্রতিক কালের।

তাহা ছাড়া, ঘরে বসিয়া বা চিত্রশালায় ঘুরিয়া আমরা ইহাদের যে-রােপ প্রত্যক্ষ করি তাহা ইহাদের উদ্দিষ্ট রূপও তো নয়। যে-মূর্তির পূজা হইত। তাহা থাকিত গর্ভগৃহের অন্ধকারে বেদীর উপর প্রতিষ্ঠিত; তাহার উপর পাড়িত প্ৰদীপের ক্ষীণ আলো। সেই প্রায়ান্ধকারে স্তিমিত আলোর জ্যোতির মধ্যে ভক্ত ও পূজারীর সম্মুখে দেবতা ধীরে ধীরে জাগিয়া উঠিতেন— নিবাতনিষ্কম্প শিখার পেলাব আলোয় প্রস্তরীভূত দেহে ধীরে ধীরে প্রাণের স্পর্শ লাগিত, দেহের রেখা ও ভঙ্গি ধূপের ধোয়ার মধ্যে ধরা-অধরার দোলায় দূলিত। তাহারই ভিতর দেবতার মুখমণ্ডল থাকিত স্থির ও আচঞ্চল। শিল্পীর এই তথ্য অজানা ছিল না; এবং সেই অনুযায়ীই তিনি পূজাবেদীর উদ্দিষ্ট মূর্তির রূপ-কল্পনা করিতেন এবং কল্পনা ও ধ্যানানুযায়ী পাথরে বা ধাতুতে সেই রূপ ফুটাইয়া তুলিতেন, যে-রূপ কালজয়ী, যে-রূপ মানুষের মৌলিক ভাবনা-কামনার উপর প্রতিষ্ঠিত। আর, যে-সব মূর্তি ও অলংকরণ থাকিত মন্দিরের বাহিরে প্রাচীর-গাত্রে তাঁহাদের রূপ-কল্পনা অন্য প্রকারের, অন্য দৃষ্টির; কারণ, তাহাদের উপর পাড়িত সারাদিনের সূর্যের আলো, কখনো রক্তিমাভায়, কখনো ছায়ায়, কখনো প্ৰদীপ্ত কিরণবাণে। সেখানে নিত্য সংসারের অফুরন্ত লীলা; দেবতা-মানুষ – পশুপক্ষী-গাছপালা সকলে মিলিয়া অনন্তকাল ধরিয়া যে-জীবনলীলায় মাতিয়াছে তাহারই গতিময় ভঙ্গিমা, ছন্দিত ছবি। তাহার উপর কালাতীত জীবনের স্বাক্ষর যেমন সুস্পষ্ট তেমনই সুস্পষ্ট কালধূত জীবনের হস্তাবলোপ। কোনোটিই উপেক্ষার বস্তু নয়। অথচ, ঘরে বা চিত্ৰশালায় ইহাদের সেই উদ্দিষ্ট রূপ ধরা পড়িবার উপায় একেবারেই নাই, এমন কি সাম্প্রতিক কালের চেতনা-কল্পনার মধ্যেও তাহা নাই। ধৰ্মগত ও সামাজিক, স্থানগত ও কালগত, অর্থ ও উদ্দেশ্যগত সমস্ত পরিবেশ হইতে বিচ্যুত হইয়া আজ ইহাদের মূল্য শুধু আসিয়া দাঁড়াইয়াছে, হয়। ইহাদের নন্দনত্ব গুণে, না হয় প্রতিমা-লক্ষণের অভিজ্ঞানে। অথচ, সেই নন্দনত্ব সবটুকু আমাদের চোখে ধরা পড়িতেছে না!

সাধারণ ভাবে এই কয়েকটি কথা মনে রাখিয়া প্ৰাচীন বাঙলার তক্ষণ-শিল্পালোচনা আরম্ভ করা যাইতে পারে। এই উষ্ণ, জলীয়, বৃষ্টিস্নাত, নদীবিধৌত বাঙলাদেশে সুপ্রাচীন নিদর্শন যে পাওয়া যাইতেছে না, তাহা কিছু অস্বাভাবিক নয়; অন্যান্য কারণের ইঙ্গিত আগেই দিয়াছি। খ্রীষ্টোত্তর ষষ্ঠ-সপ্তম শতকের আগেকার নিদর্শন যাহা পাওয়া গিয়াছে, সংস্কৃতির অন্যান্য ক্ষেত্রে যেমন, এ-ক্ষেত্রেও তাহা স্বল্পই। স্বল্পতার প্রধান কারণ, দেশের মাটি ও জলবায়ু, পাথরের অপ্রাচুর্য, যথাযথ খননবিষ্কারের অভাব, কিন্তু সর্বোপরি যে-কারণ ছিল সক্রিয় তাহা ঐতিহাসিক। প্রাচীন বাঙলাদেশে আর্য-সংস্কৃতির ঘনিষ্ঠ স্পৰ্শ খ্রীষ্টোত্তর পঞ্চম-ষষ্ঠ শতকের আগে ভালো করিয়া লাগেই নাই এবং সেই সংস্কৃতির কেন্দ্ৰস্থল। মধ্যদেশের সঙ্গে যোগাযোগও খুব ঘনিষ্ঠ হইয়া উঠে নাই। তাহার আগে আদিম কোম-সন্নিবিষ্ট রাঢ়-পূণ্ড-সুহ্ম-বঙ্গ প্রভৃতি জনপদ নিজেদের সমাজ-সংস্থা, নিজেদের শিল্প ও সংস্কৃতি, নিজেদের জীবনযাত্রা লইয়া ভারতবর্ষের এক ধারে পড়িয়াছিল আৰ্য্যমনের অবজ্ঞা ও অজ্ঞতায়। মাঝে মাঝে আর্যীকরণের এবং ভারতবর্ষের সামগ্রিক জীবনধারার স্রোতের মধ্যে টানিয়া আনিবার চেষ্টা যে হয় নাই, এমন নয়; কিন্তু আদিম কৌম মনের স্বাভাবিক প্রবণতাই ছিল সে-স্রোতকে যতটা সম্ভব ঠেকাইয়া রাখা। এই সব কৌম নরনারীর নিজেদের শিল্প কিছু ছিল না। এমন নয়; কিন্তু আগেই বলিয়াছি, সে-সব শিল্পের উপাদান-উপকরণ ছিল ক্ষীণজীবী- মাটি, খড়, বাশ, বড় জোর কাঠ। কাজেই সে-সব নিদর্শন কালের ও প্রকৃতির হাত এড়াইয়া আমাদের কালে আসিয়া পৌছায় নাই, যদিও তাহাদের ঐতিহা ও প্রাণশক্তির প্রাচুর্য আজও অব্যাহত। ভারতবর্ষে আমরা পাথর কুঁদিতে শিখিয়াছি মাত্র মৌৰ্য-আমলে বা হয়তো তাহার কিছু আগে; কিন্তু সেই শিক্ষা বাঙলাদেশে আসিয়া পৌঁছতে এবং বহুল প্রচলিত হইতে আরও কয়েক শত বৎসর লাগিয়াছিল। ধাতু। গলাইয়া মূর্তি গড়িবার কৌশল বোধ হয় শিখিয়াছি খ্ৰীষ্টোত্তর দ্বিতীয়-তৃতীয় শতকে। গুপ্ত-পর্বের আগে কিছু কিছু নিদর্শন বাঙলাদেশের নানা জায়গায় পাওয়া গিয়াছে, সন্দেহ নাই; কিন্তু তাহার বেশির ভাগই পোড়ামাটির অথবা ছোট ছোট টুকরো পাথরের এবং সেই হেতু এক জায়গা হইতে অন্য জায়গায় সহজেই বহন করিয়া লইয়া যাইবার মতো। কাজেই জোর করিয়া বলিবার উপায় নাই যে, এই নিদর্শনগুলি বাঙলার বাহির হইতে— মধ্যদেশ হইতে-সমসাময়িক শিল্পী-ব্যবসায়ী-বণিক প্রভৃতিরা বহন করিয়া আনেন নাই! অন্তত, ইহাদের মধ্যে স্থানীয় বৈশিষ্ট্য কিছু নাই, বরং সমসাময়িক কালের মধ্য-ভারতীয় শিল্পশৈলীর প্রভাব অত্যন্ত প্রত্যক্ষ। বস্তুত, সংস্কৃতির অন্যান্য ক্ষেত্রে, যেমন, এ ক্ষেত্ৰেও তেমনই, এই নিদর্শনগুলিই বাঙলাদেশে মধ্য-ভারতীয় আর্য-সভ্যতা বিস্তৃতির প্রথম পদচিহ্ন।

শুঙ্গ ও কুষাণ শিল্পের ধারা

খ্ৰীষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতক হইতে আরম্ভ করিয়া খ্ৰীষ্টোত্তর দ্বিতীয়-তৃতীয় শতক পর্যন্ত সমগ্র গঙ্গা-যমুনা উপত্যকা ও মধ্য-ভারত জুড়িয়া পোড়ামাটির এক ধরনের শিল্পশৈলী প্রচলিত ছিল। পাটলীপুত্ৰ হইতে আরম্ভ করিয়া মথুরা পর্যন্ত নানা জায়গায়— বসার, রাজঘাট, কৌশাম্বী বা কোসাম, এলাহাবাদ, ভিটা, বকসার, পটলীপুত্র ও তাহার উপকণ্ঠ, মথুরা প্রভৃতি স্থানে অল্পবিস্তর পরিমাণে এই শিল্পশৈলীর নিদর্শন আবিষ্কৃত হইয়াছে। ইহাদের মধ্যে অধিকাংশই যৌবনসমৃদ্ধ নরনারীর মূর্তি, বিশেষভাবে নারীমূর্তি, কিছু কিছু শিশুমূর্তিও আছে, কিছু কিছু আছে শুধু শিশু ও নরনারীমুণ্ড। অনেকগুলি মুণ্ডের আকৃতি ও মুখাবয়বে, কেশবিন্যাসে এবং মস্তকাভারণে সমসাময়িক যাবনিক বৈশিষ্ট্য সুস্পষ্ট। কোনও কোনোটিতে যে ব্যক্তিগত অর্থাৎ প্রতিকৃতিক বৈশিষ্ট্যও নাই, এমন নয়। সন্দেহ নাই যে, সমসাময়িক কালে শিল্পীদের চোখের সম্মুখে এই সব বিদেশীদের যাতায়াত এবং বসবাস ছিল। তাহা ছাড়া, মাটি দ্বারা প্রতিকৃতি রচনার প্রচলনও নিঃসন্দেহে ছিল। এই ধরনের নরনারী মূর্তি ছাড়া নানা চলিত কথা ও কাহিনী রূপায়ণ অজ্ঞাত ছিল না। কৌশাম্বী, মথুরা এবং অন্যান্য স্থানের ধ্বংসাবশেষ হইতে এই ধরনের কাহিনী-বর্ণনাগত ফলকও অনেক পাওয়া গিয়াছে। কিন্তু বাঙলাদেশে পোখারণা (বাঁকুড়া জেলা), তমলুক, মহাস্থান প্রভৃতি প্রত্নভূমি হইতে যে কয়েকটি পোড়ামাটির ফলক পাওয়া গিয়াছে তাহা ঠিক এই জাতীয় বর্ণনাগত ফলক নহে, বরং তাঁহাদের আত্মীয়তা পূর্বোক্ত যৌবনাগবিতা, অলংকারভারগ্রস্তা, আত্মসচেতনা নারীমূর্তিগুলির সঙ্গে। ইহাদের সর্বাঙ্গে স্কুল অথচ বিচিত্র আয়তন ও আকৃতির অলংকার; কেশভার সুপ্রচুর এবং নানা আকারে ও ভঙ্গিতে সেই কেশের বিন্যাস; যৌন ও যৌবনলক্ষণ আয়ত ও উচ্চারিত; স্থিতি ও গতিভঙ্গি সচেতন, বসন স্কুল অথচ সমৃদ্ধ এবং সমসাময়িক রুচি অনুযায়ী সুবিন্যস্ত। এই নারীমূর্তিগুলি উত্তর-ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতির বিশেষ একটা স্তরের প্রতীক। রুচি, সংস্কৃতি ও অভ্যাসের দিক হইতে আদিম-কৌম-মানসের স্কুলত্ব ইহাদের এখনও ঘুচে নাই, অথচ ইহার যে-সমাজের প্রতিনিধি সেই সমাজের আর্থিক সমৃদ্ধি ও সামাজিক পরিবেশ ইহাদিগকে দেহগত যৌবন ও সৌন্দর্য, আলংকারিক ঐশ্বর্য এবং যৌন আবেদন সম্বন্ধে সচেতন করিয়া দিয়াছে। এই দুই-এর, অর্থাৎ, একদিকে রুচির ও অভ্যাসের স্থূলত্ব, অন্যদিকে দেহ ও অর্থগত সমৃদ্ধির সচেতনতার সহজ সংঘাত ও সমন্বয় দুইই এই মূর্তিগুলির মধ্যে সুস্পষ্ট। সন্দেহ নাই যে, এই বৈশিষ্ট্য গ্রাম্য কোম-সমাজের কখনও হইতে পারে না; সে-সমাজের সহজ। সারল্য ও নিরলংকার সৌন্দর্য ইহাদের মধ্যে কোথাও নাই। এমন কি, বরহুতের প্রস্তর স্তূপবেষ্টনীর ফলকগুলির নারীমূর্তির মধ্যে বসনভূষণের প্রাচুর্য এবং সমৃদ্ধ কেশবিন্যাস সত্ত্বেও যে সলজ আড়ষ্টতা, যে নৈর্ব্যক্তিক দূরত্ব, যে ভীত মন্থরতার আভাস বর্তমান, এই নারীমূর্তিগুলি সেই স্তর বহুদিন পার হইয়া আসিয়াছে; সেই মানস আর ইহাদের মধ্যে বর্তমান নাই। সেই জন্যই, বহিরাবয়ব বা বসনভূষণ-ভঙ্গিমার দিক হইতে শুঙ্গ আমলের বলিয়া মনে হইলেও বস্তুত ইহারা আরও কিছু পরবর্তী কালের, যে-কালে সমাজের, অন্তত সমাজের একটি বিশিষ্ট স্তরের অর্থসমৃদ্ধি বাড়িয়াছে, প্রাথমিক লজা-ভয়-আড়ষ্টতা কাটিয়া গিয়াছে, সচেতন নগর-সভ্যতা বেশ কিছুটা বিস্তৃতি লাভ করিয়াছে, সেই বিশেষ স্তরের দেহগত ভাবনা সম্বন্ধে সচেতন হইয়াছে, এবং বৃহত্তর সমাজের নানা দেশি-বিদেশি আদান-প্রদানের সম্মুখীন হইয়াছে বা হইতেছে। অথচ, কি রুচি, কি শিল্পীরীতি বা ভঙ্গি কোনও দিক হইতেই ইহাদের স্থূলত্ব তখনও ঘুচে নাই। বাৎস্যায়নের কামসূত্রে যে নাগর-জীবনের আভাস আমরা পাইতেছি। সেই সূক্ষ্ম, সুরুচিসম্পন্ন, সচেতন ও বাণিজ্য সমৃদ্ধ অভিজাত নাগর-সমাজ এখনও গড়িয়া উঠে নাই, কিন্তু তাহার সূচনা কেবল দেখা দিতেছে, অর্থাৎ স্কুল কৌম সমাজ ধীরে ধীরে সমৃদ্ধ ও সচেতন নাগর-সমাজে বিবর্তিত হইতেছে মাত্র। এই অবস্থার, সমাজ-বিবর্তনের এই স্তরের ছবিই ধরা পড়িতেছে পোড়ামাটির এই অসংখ্য ফলকগুলিতে, বিশেষভাবে নারীমূর্তিগুলিতে। বাণিজ্য-সমৃদ্ধির প্রেরণায় ক্রমবর্ধমান নগরগুলির গৃহ-সজ্জায় এই সব মৃৎফলকগুলি ব্যবহৃত হইত, সন্দেহ কি! এই সামাজিক অবস্থার কিছু কিছু স্বাক্ষর পড়িয়াছে সাচী স্তূপের প্রস্তুর-তোরণের ফলকগুলিতে, স্বল্পাংশে বুদ্ধগয়াৱ বেষ্টনীর উপর, কিন্তু আরও উচ্চারিত রূপে মথুরার কয়েকটি প্রস্তর-বেষ্টনীর গাত্রে। কিন্তু, এই প্ৰত্যেকটি ক্ষেত্রে রুচিবোধ, আরও একটু সূক্ষ্ম ও অভিজাত, মন ও দৃষ্টি আরও সচেতন এবং কারুকলার আঙ্গিক আরও সুনিপুণ। তবে, সামাজিক বিবর্তনের প্রাথমিক স্তরের স্থূলতার প্রমাণ হিসাবে মৃৎফলকগুলির সাক্ষ্য অধিকতর প্রাসঙ্গিক। বাঙলাদেশে যত এ ধরনের-নিদর্শন মৃৎকলা পাওয়া গিয়াছে তাহার সঙ্গে কৌশাস্বী-পাটলীপুত্ৰ-বসার প্রভৃতি স্থানে প্রাপ্ত খ্ৰীষ্টপূর্ব প্রথম ও খ্ৰীষ্টাওর প্রথম ও দ্বিতীয় শতকের ফলকগুলির আত্মীয়তা ঘনিষ্ঠ। কিন্তু সংখ্যায় এত স্বল্প যে, ইহাদের উপর নির্ভর করিয়া বলা কঠিন, সমাজ-বিবর্তনের সদ্যোক্ত তরঙ্গ এই সময় বাঙলাদেশেও আসিয়া লাগিয়াছিল। কিনা। কিছুটা স্পর্শ হয়তো লাগিয়া থাকিতেও পারে।

পোড়ামাটির এই ফলকগুলি ছাড়া কতকটা কুষাণ শিল্পশৈলীর স্বল্পায়তন কয়েকটি পাথরের মূর্তিও বাঙলাদেশে পাওয়া গিয়াছে। লক্ষণীয় এই যে, সব ক’টিই উত্তরবঙ্গীয় এবং কুষাণ শিল্পশৈলীর কেন্দ্ৰ মথুরার স্থানীয় লাল বালি-পাথরে তৈরি নয়। সেই জন্যই এ-অনুমান স্বাভাবিক যে, মূর্তিগুলি রচিত হইয়াছিল সমসাময়িক বাঙলাদেশেই। ইহাদের মধ্যে দুইটি সূর্যমূর্তি পাওয়া গিয়াছে রাজশাহী জেলার নিয়মতপুর গ্রামে; একটি বিষ্ণুমূর্তি, প্রাপ্তিস্থান মালদহ জেলার হাকরাইল গ্রাম। তিনটি মূর্তিরই অঙ্গরচনা ও বিন্যাস, রেখা ও ডোল, গতি ও গড়ন একই প্রকার। রচনার ও শিল্পদূষ্টির আপেক্ষিক স্থূলতা সত্ত্বেও মথুরার কুষাণ ও শক(?)-রাজাদের মর্মর প্রতিকৃতিগুলির সঙ্গে ইহাদের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়তা কিছুতেই অস্বীকার করা যায় না। সে-আত্মীয়তা মূর্তি তিনটির অঙ্গরেখার আকৃতি-প্রকৃতি এবং গড়নেও সুস্পষ্ট। অথচ, ইহারা শক-কুষাণ শিল্পীদের রচনা এ-কথা কিছুতেই বলা চলে না; বরং ইহাদের অঙ্গভঙ্গির আড়ষ্টতা এবং গ্রাম্য অনাড়ম্বর প্রকাশ একান্তই আঞ্চলিক। আসল কথা, মধ্যদেশে উচ্চকোটি স্তরে যখন যে শিল্পশৈলীর প্রসার ও প্রচলন তাহার অন্তত কিছুটা তরঙ্গাভিঘাত স্তিমিত বেগে বাঙলাদেশেও আসিয়া লাগিয়াছে; এই মূর্তিগুলিতে তাহারই স্বাক্ষর কতকটা স্থানীয় রূপ ও রুচিদ্বারা প্রভাবিত হইয়া দেখা দিতেছে। বাঙলাদেশে কিছু কিছু কুষাণমুদ্রা পাওয়া গিয়াছে; এবং মুরুগু কোমের লোকেরা বোধ হয় প্রথম-দ্বিতীয়-তৃতীয় শতকের বাঙলাদেশে এক্লেবারে অজ্ঞাত ছিলেন না। কাজেই বাঙলার শিল্পের এই পর্বে শক-কুষাণ শিল্পীরীতির কিছুটা প্রভাব দেখা যাইবে, ইহা কিছু আশ্চর্য নয়।

দিনাজপুর জেলার বাণগড়ের ধ্বংসাবশেষের মধ্যে প্রাপ্ত এবং বর্তমানে কলিকাতা আশুতোষ-চিত্রশালায় সংরক্ষিত কয়েকটি ক্ষুদ্রাকৃতি পোড়ামাটির ফলকে গুপ্তপূর্ব মথুরার, সাধারণভাবে গঙ্গা-যমুনা উপত্যকার শিল্পশৈলীর লক্ষণও সুপরিস্ফুট। মথুরার নারী-মূর্তিগুলির দেহবিলাসের সচেতনতা ও অভিজাত সংবেদন বাণগড় ফলকের নারীমূর্তিগুলিতে নাই, কিন্তু প্রশস্তমেখলা, পীনপয়োধরা এবং অলংকারবহুলা এই নারীদের অঙ্গবিন্যাস একান্তই সেই মধ্যদেশীয় ধারাই অনুসরণ করিয়াছে, বিশেষভাবে মথুরা অঞ্চলের এবং এই হিসাবে ইহারা পূর্বোক্ত মহাস্থান-পোখরুণা-তাম্রলিপ্তির ফলক-চিত্রিত নারীদেরই বংশধর। তবে বাণগড়ের এই স্বল্পাকৃতি নারীমূর্তিগুলিতে সমসাময়িক ও ভাবীকালের ইঙ্গিতও সমান প্রত্যক্ষ। সে-ইঙ্গিত প্রকাশ পাইয়াছে ইহাদের ঈষাদানত পয়োধরের মসৃণ ডোলে, সুডৌল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে, গড়নের আপেক্ষিক মসৃণতায় এবং সৌকুমার্যে। ইহাদের মধ্যে যেন গুপ্ত আমলের রুচি ও রূপাদর্শের দূরাগত ক্ষীণ পদধ্বনি শোনা যাইতেছে।

গুপ্ত-পর্বের বৈশিষ্ট্য

মথুরার শক-কুষাণ তক্ষণ শেলীর কালগত স্বাভাবিক পরিণতি৯ গুপ্তপর্বের তক্ষণশৈলীতে। গুপ্ত-শিল্পকলার প্রধান কেন্দ্র ছিল সারনাথ, কিন্তু প্রভাবের ও ঐতিহ্যের বিস্তৃতি ছিল পূর্বপ্রান্তে তেজপুর হইতে পশ্চিমে গুজরাট-মহারাষ্ট্র পর্যন্ত এবং কাশ্মীর হইতে আরম্ভ করিয়া দাক্ষিণাত্য পর্যন্ত। মথুরার ভারী, দৃঢ়, স্থূল, একান্ত ইহগত এবং সূক্ষ্মানুভূতিবিহীন বুদ্ধ-বোধিসত্ত্বই ক্রমশ গুপ্ত আমলের সূক্ষ্ম, মার্জিত, পেলাব, ধানকেন্দ্রিক, যোগগৰ্ভ বুদ্ধবোধিসত্ত্ব মূর্তিতে, বিষ্ণুমূর্তিতে রূপান্তর লাভ করে। এই রূপান্তরের মধ্যে সমগ্র ভারতীয় বুদ্ধি ও কল্পনার, মনন ও সাধনার সুগভীর ও সুবিস্তৃত ইতিহাস বিধৃত; কিন্তু তাহার আলোচনা এ-প্রসঙ্গে অবাস্তর। মথুরার বৃহদায়তন মূর্তিগুলি প্রভূত মানবিক দৈহিক শক্তির দ্যোতক; গুপ্ত—আমলের অর্থাৎ পঞ্চম-ষষ্ঠ শতকীয় সারনাথের বুদ্ধবোধিসত্ত্বের মূর্তিগুলির আপেক্ষিক আয়তন হ্রস্ব, কিন্তু ইহাদের মানবিক রূপ ও ভঙ্গি ধ্যানযোগের এবং স্বচ্ছতর মনন-কল্পনার স্পর্শে এক অতি সূক্ষ্ম সংবেদনময় অপরূপ অধ্যাত্মভাব ও অলৌকিক ব্লসের দোতক হইয়া উঠিয়াছে।

সারনাথের প্রভাব পূর্বাঞ্চলে আসামের তেজপুর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল, এ-কথা আগেই বলিয়াছি। এই প্রভাবের ধারাস্ৰোত বাঙলাদেশের উপর দিয়াই বহিয়া গিয়াছে, সন্দেহ নাই; কিন্তু বাঙলাদেশে প্রাপ্ত সমসাময়িক মূর্তির সংখ্যা খুব বেশি নয়। বিহারৈল গ্রামে প্রাপ্ত চুনারের বালি-পাথরে রচিত একটি বুদ্ধ-প্রতিমায় পঞ্চম-ষষ্ঠ শতকীয় সারনাথের প্রতিধ্বনি অত্যন্ত সুস্পষ্ট। এই মূর্তিটির মসৃণ, মার্জিত রমণীয় ডোল, সুকুমার অঙ্গ-বিন্যাস ও সৌষ্ঠব, শাস্ত সৌম্য ধ্যানগম্ভীর দৃষ্টি এবং রেখা-প্রবাহের ধীর সংযত গতি একান্তই সমসাময়িক মধ্য-গাঙ্গেয় সভ্যতা ও সংস্কৃতির দান। গভীর ধ্যানলব্ধ আনন্দের চরম জ্ঞান ও উপলব্ধির, পরম পরিতৃপ্তির সহজ, সংযত ও মার্জিত প্ৰকাশই সারনাথশৈলীর বৈশিষ্ট্য; এবং এই বৈশিষ্ট্যই সারনাথের বুদ্ধ-প্রতিমাকে বিহারের সুলতানগঞ্জের বুদ্ধ-মূর্তি অপেক্ষা অথবা রাজগীরের মণিয়ার-মঠে দেহ-সচেতন, সুন্দর, পেলাব মূর্তিগুলি অপেক্ষা অধিকতর কৌলীন্য দান করিয়াছে। বিহাৱৈল প্রতিমাটি এই হিসাবে যেন সারনাথ-শৈলীরই একটি স্থানীয় রূপ, একটু কম সূক্ষ্ম, একটু কম পেলাব।

সুলতানগঞ্জের ব্রোঞ্জ বুদ্ধ-মূর্তিতে অথবা রাজগীর মণিয়ার-মঠের প্রতিমাগুলিতে সারনাথ শৈলীর যে পূর্বাঞ্চলিক ভাষা প্রত্যক্ষ, সেই ভাষারূপ কতকটা ধরা পড়িয়াছে। বগুড়া জেলার দেওয়া গ্রামে প্রাপ্ত সূর্যমূর্তিটিতে। আনুমানিক ষষ্ঠ শতকীয় এই প্রতিমাটির বলিষ্ঠ ত্ৰিবলীচিহ্ন, অলংকার-বিরলতা, কাঠামোর দৃঢ় সংযত সারল্য, চক্রাকার প্রভামণ্ডল এবং আঙ্কন্ধবিলম্বিত তরঙ্গায়িত কেশগুচ্ছ নিঃসন্দেহে মধ্য-গাঙ্গেয় গুপ্ত-ঐতিহ্য ও লক্ষণের দ্যোতক, কিন্তু ইহার মাংসল দেহের কাবোঞ্চ সংবেদনের মধ্যে এবং চক্ষুর নিম্নতটে ও নিম্নোণ্ঠের তীব্ৰ গাঢ় ছায়ার মধ্যে পূর্বাঞ্চলিক দেহমাধুর্যবেদনও সমান প্রত্যক্ষ।

সুন্দরবন-কাশীপুরে প্রাপ্ত সূর্য প্রতিমাটিতেও (আশুতোষ-চিত্রশালা) মার্জিত রসবোধ ও অধ্যাত্ম-চেতনার আভাস দৃষ্টিগোচর। এই প্রতিমাটিতে গুপ্ত শৈলীর সদ্যোক্ত পূর্বাঞ্চলিক বৈশিষ্ট্য যতটা ধরা পড়িয়াছে, বাঙলায় প্রাপ্ত আর কোনও প্রতিমাতেই এমন সুস্পষ্ট হইয়া তাহা ধরা পড়ে নাই। কালবিচারে কাশীপুরের প্রতিমাটি হয়তো দেওড়ার প্রতিমাপেক্ষা প্রাচীনতর, কিন্তু গঠন সৌষ্ঠবে কাশীপুর-সূর্য অনেক বেশি মার্জিত, দৃষ্টি ও কল্পনার গভীরতর এবং অনুভবে বেশি পেলাব ও সংযত। আকৃতি এবং প্রকাশভঙ্গির দিক হইতেও সাদৃশ্য এবং প্রমাণবোধ অধিকতর সাঁচ’তৰুণ।

বলাইধাপ স্তূপের ধ্বংসাবশেষের মধ্যে প্রাপ্ত ব্রোঞ্জধাতু-নির্মিত স্বর্ণপত্ৰমণ্ডিত মঞ্জুশ্ৰী-প্রতিমাটিতেও পূর্বাঞ্চলিক আবেগময়তা এবং ডৌল ও গঠনরীতির উষ্ণ সংবেদনশীলতা সমান প্রত্যক্ষ। সুপূর্ণ মাংসল মুখমণ্ডল, স্থূল নিম্নোষ্ঠ, বঙ্কিমায়িত করাঙ্গুলির ক্রমহ্রস্বায়মান সূক্ষ্মাগ্র এবং সুকুমার দেহ-কাঠামোর মধ্যে সমস্ত অঙ্গের পেলাব সচেতনতা যেন দানা বাধিয়াছে; দেহ-ডৌলের সঙ্গে বসনের ঘনিষ্ঠতা, অলংকার-বিরলতা, সহজ ও অনাড়ম্বর প্রকাশভঙ্গি সমস্তই পূর্বাঞ্চলিক গুপ্ত শৈলীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ আত্মীয়তায় আবদ্ধ।

মুর্শিদাবাদ-মালার গ্রামে প্রাপ্ত চক্ৰপুরুষের একটি মূর্তিও এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য (বঙ্গীয়-সাহিত্য-পরিষদ-চিত্রশালা)। এই মূর্তিটির ডোলে, গড়নে এবং রচনাবিন্যাসে গুপ্ত শৈলীর পূর্বাঞ্চলিক বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয়। তবে, বালিপাথরে গড়া এই প্রতিমাটির গড়নে দেহ-ডৌলের সেই সূক্ষ্মতা ও ভাবব্যঞ্জনা ততটা ধরা পড়ে নাই।

স্পষ্টতই দেখা যাইতেছে, পঞ্চম ও ষষ্ঠ শতকীয় বাঙলার তক্ষণ-শিল্পের সাধারণ লক্ষণ ও প্রকৃতি সমসাময়িক উত্তর-গাঙ্গেয় ভারতের শিল্প-লক্ষণ ও প্রকৃতির সঙ্গে ঐক্যসূত্রে গাঁথা। সারনাথ-শৈলীর প্রভাব সুস্পষ্ট ও অনস্বীকার্য, কিন্তু তাহার সঙ্গে সঙ্গে পূর্বাঞ্চলিক আবেগ-প্রাধান্য এবং স্থানীয় বৈশিষ্ট্যও সমান প্রত্যক্ষ। এ-তথ্য লক্ষণীয় যে, এই পর্বে গুপ্ত-শৈলীর যে-কটি নিদর্শন বাঙলাদেশে পাওয়া গিয়াছে তাহার অধিকাংশই উত্তরবঙ্গে বা প্রাচীন পুণ্ড্রবর্ধন হইতে। কিন্তু উত্তরবঙ্গই হউক আর সুন্দরবনই হউক, তেজপুরই হউক আর বাঁকুড়াই হউক, সর্বত্রই মূলগত একটি ধারা প্রত্যক্ষ এবং সে—ধারা প্রধানত মধ্য-গাঙ্গেয় গুপ্ত শৈলীর ধারারই স্থানীয় রূপ।

বিবর্তন

তৃতীয়-চতুর্থ শতকে উত্তর-ভারতীয় মনন ও কল্পনা মথুরা-বুদ্ধগয়ার যে রূপ-প্ৰচেষ্টায় স্বপ্রকাশ পঞ্চম শতকে সারনাথ-উদয়গিরি-মথুরাতে তাহার পূর্ণ পরিণতি। সূক্ষ্মতম বোধ, গভীরতম ধ্যান ও চরমতম জ্ঞানের এমন সুনিপুণ অঙ্গসৌষ্ঠবময় সুকৌশলী প্রকাশ শুধু ভারতীয় শিল্পে কেন, পৃথিবীর তক্ষণ শিল্পেই বিরল। সমসাময়িক সারনাথ ক্লাসিক্যাল শিল্পের শিখরচুড়ায় আসীন; ইহার পর এই শিল্পদর্শ ও রীতিতে অলব্ধ, অনাবিষ্কৃত আর কিছু ছিল না। সব সন্ধান যখন নিরস্ত ও নিঃশেষিত, সুচিরচেষ্টত সাফল্য যখন আয়ত্ত তখন কিছুকাল কাটে সাফল্যের দীপ্তি ও গরিমার মধ্যে; তারপর দেখা দেয় ক্লাপ্তি ও অবসাদ এবং তাহার পরের স্তরেই নিদ্ৰালু বিবশতা। ষষ্ঠ শতকের শেষার্ধ হইতেই উত্তর-ভারতীয় তক্ষণ-শিল্পে এই বিবশতা দেখা দিতে আরম্ভ করে এবং সমগ্র সপ্তম শতক জুড়িয়া তাহার আভাস সুস্পষ্ট। অন্যদিকে এই সময়েই আবার নবতর শিল্প-প্রেরণাও ধীরে ধীরে রূপ গ্ৰহণ করে। এই নবতর রীতি বা আদর্শের প্রেরণা কোন মূল, কোন উপাদান হইতে সঞ্চারিত হইয়াছিল বলা কঠিন। শতাব্দী-সঞ্চারিত ইতিহাসের নানা আবর্তে, নানা ঘটনা ও আদর্শের সংঘাতে, নানা সভ্যতা ও সংস্কৃতির মিলন-বিরোধের ফলে শিল্পে ও সাহিত্যে নূতন নূতন রীতি ও আদর্শের উদ্ভব ঘটে। এই সব আবর্ত ও সংঘাত মিলন ও বিরোধের পুঙ্খানুপুঙ্খ সকল কথা আজও আমরা জানি না এবং তাহার ফলে আমাদের জীবনযাত্রা ও সংস্কৃতিতে কী কী রূপান্তর খটিয়াছিল তাহাও সুনশ্চয় করিয়া বুলিবার উপায় নাই।

খ্ৰীষ্টীয় প্রথম শতক হইতেই মধ্য-এশিয়ার নানা যাযাবর জাতি ভারতবর্ষের বুকে আসিয়া আশ্রয় গ্রহণ করিতে আরম্ভ করে : প্রথম তরঙ্গে যুয়ে-চি-শক-কুষাণ, দ্বিতীয় ও তরঙ্গে আভীর (দ্বিতীয় তৃতীয় শতক), তৃতীয় তরঙ্গে তুণ (পঞ্চম ও ষষ্ঠ শতক)। এবং চতুর্থ তরঙ্গে গুজর-গুর্জর ও তুরুষ্কবা (সপ্তম-নবম শতক)। ইহারা প্রত্যেকেই এক একটি বিশেষ সংস্কৃতির বাহক ছিলেন, সন্দেহ নাই; কিন্তু বহু দিন সেই সংস্কৃতির কোনও সুস্পষ্ট সুগভীর স্বাক্ষর ভারতবর্ষে দেখা যায় নাই; বলবত্তর স্থানীয় রীতি ও আদর্শকে অতিক্ৰম করিয়া তাহা নিজকে ব্যক্ত করিবার সুযোগও বিশেষ পায় নাই, শক্তিও হয়তো ততটা ছিল না। কিন্তু ভিতরে ভিতরে তাহা যে পুরাতন ভারতীয় রীতি ও আদর্শকে রূপান্তরিত করিতেছিল, অন্তত শিল্পাদর্শের ক্ষেত্রে এবং দৈনন্দিন জীবনযাত্রায়, তাহার প্রমাণ ইতস্তুত বিক্ষিপ্ত। অষ্টম শতক হইতে ভারতীয় ভাস্কর্যে, প্রাচীরচিত্রে ও অন্যান্য শিল্পে তাহার স্বাক্ষরও ক্রমশ সুস্পষ্ট হইয়া দেখা দিতে আরম্ভ করে। কিন্তু এ-সব কথা আলোচনার অবসর এ-গ্ৰন্থ নয়। তাহা ছাড়া, সপ্তম শতক হইতে নেপাল ও ভোটদেশ বা তিব্বতের সঙ্গেও মধ্য ও প্রাচ্য ভারতের একটা ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ স্থাপিত হয় এবং প্রাচীন কিরাত বা বোডো সংস্কৃতির কিছু কিছু প্রভাবও অষ্টম শতক হইতেই ক্ল্যাসিক্যাল সংস্কৃতির অবসাদের ফলে স্থানীয় লোকায়ত সংস্কৃতি উচ্চকোটির সংস্কৃতি ছাপাইয়া ব্যক্ত করিবার সুযোগ লাভ করে। এই সব রাষ্ট্রীয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রবাহের সম্মিলিত প্রভাব ভারতীয় জীবন, মনন ও কল্পনাকে, রাষ্ট্র ও সমাজবিন্যাসকে কিভাবে কতদূর রূপান্তরিত করিয়াছিল তাহা লইয়া আলোচনা-গবেষণা আজও বিশেষ হয় নাই। তবে, সপ্তম-অষ্টম-নবম শতকে উত্তর-ভারতীয় ইতিহাসের যে দিক পরিবর্তন এবং সর্বতোভদ্র রূপান্তর সকল ঐতিহাসিকই লক্ষ্য করিয়াছেন তাহার মূলে এই সব প্রভাব কিছুটা সক্রিয় ছিল তাহাতে আর সন্দেহ কী! এই রূপান্তরেরই আর এক অর্থ, ক্ল্যাসিকাল যুগের অবসান ও মধ্যযুগের সূচনা। কোনও বিশেষ রাষ্ট্ৰীয় ঘটনা মধ্যযুগের সূচনা করে নাই; কোনও নির্দিষ্ট সন-তারিখও নয়। সভ্যতা ও সংস্কৃতির, রাষ্ট্র ও সমাজের যে প্রকৃতি ও আদর্শ দ্বারা মধ্যযুগ চিহ্নিত, জন-সংঘাতের ফলে সেই প্রকৃতি ও আদর্শ কয়েক শতাব্দী ধরিয়াই ভারতীয় জীবনের নানা ক্ষেত্রে দেখা দিতেছিল এবং জৈব নিয়মের বশেই তাহা ধীরে ধীরে লালিত ও বধিত হইতেছিল। উত্তর-ভারতের ইতিহাসে অষ্টম-নবম-দশম শতক সেই লালন-বর্ধনের যুগ।

যাহাই হউক, সদ্যোক্ত রূপান্তরের সূচনার মুখে অথবা ক্লাসিক্যাল আদর্শের অবসাদ-কালের (আনুমানিক সপ্তম শতক) কয়েকটি প্রতিমা বাঙলাদেশেও পাওয়া গিয়াছে। ইহাদের মধ্যে তিনটি ধাতব মূর্তি উল্লেখযোগ্য : একটি দেবখড়্গ-মহিষী প্ৰভাবতীর লিপি-উৎকীর্ণ অষ্টধাতুনির্মিত সর্বাণী-দেবীমূর্তি, প্রাপ্তিস্থান ত্রিপুরা জেলার দেউলবাড়ী গ্রাম। দ্বিতীয়টি স্বল্পায়তন, প্রায় পুতুলাকৃতি বলিলেই চলে; ইহারও প্রাপ্তিস্থান দেউলবাড়ী গ্রাম (ঢাকা-চিত্রশালা); শিল্পবিষয় রথােপরি উপবিষ্ট সপ্তাশ্ববাহিত সূর্য। তৃতীয়টি ব্রোঞ্জধাতুনির্মিত একটি দণ্ডায়মান শিবপ্রতিমা; প্রাপ্তিস্থান ২৪—পরগণা জেলার মণিরহাট গ্রাম (অজিত ঘোষ-সংগ্ৰহ, কলিকাতা)। পঞ্চম-ষষ্ঠ শতকীয় গুপ্ত-তক্ষণশিল্পে প্রতিমারূপের যে রূপান্তর পরবর্তীকালে দেখা যায় তাহা এই তিনটি নিদর্শনেই সুস্পষ্ট। সর্বাণী মূর্তিটির পরিকল্পনার ও রূপায়ণ তো স্পষ্টই পরবর্তী পাল শিল্পের পূর্বধ্বনিমাত্র; ইহার ঋজু ও আড়ষ্ট দেহভঙ্গি এবং কাঠামোর বিন্যাস এ-সম্বন্ধে আর কোনও সন্দেহই রাখে না। স্বল্পায়তন সূর্য-প্রতিমাটি সম্বন্ধেও প্রায় একই কথা বলা চলে। শিবমূর্তির গড়ন ও ডোলে গুপ্ত-বৈশিষ্ট্য এখনও তাহার কিছু স্বাক্ষর রাখিয়াছে, কিন্তু সেই স্বচ্ছ ও সূক্ষ্ম দীপ্তি আর নাই, সেই যোগনিবদ্ধ দৃষ্টি বা ভাবের নৈর্ব্যক্তিক পরিচয়ও আর নাই। গুপ্ত-মূর্তিকলার সুবর্ণযুগ অস্তমিত; পরবর্তী পাল-আমলের নবতর রীতি ও রূপাদর্শের সূচনা যেন দেখা যাইতেছে।

প্রাচ্য-ভারতীয় মূর্তিকলার এই পর্যায়ের কয়েকটি নিদর্শন এবং তাহার প্রভাবযুক্ত কয়েকটি প্রতিমা পাহাড়পুর-মন্দিরের ভিত্তিগাত্রেও দেখা যায়। কিন্তু পাহাড়পুর-মন্দিরের শিল্পকলা আরও নানাদিক হইতে উল্লেখযোগ্য। প্রাচীন বাঙলার অন্তত সুদীর্ঘ দুই শতাব্দীর সাংস্কৃতিক মানসের পূর্ণতর অভিব্যক্তি এই বিহার-মন্দিরের তক্ষণ-রূপায়ণে ভাষালাভ করিয়াছে। পাহাড়পুর-শিল্প এই কারণেই বিস্তৃততর আলোচনার দাবি রাখে।

পাহাড়পুরের বৌদ্ধ-বিহার মন্দির নির্মিত হইয়াছিল খ্ৰীষ্টীয় অষ্টম শতকের মধ্যভাগে নরপতি ধর্মপালের পৃষ্ঠপোষকতায়। কিন্তু তাহান্ন আগেও এখানে বোধ হয় কোনও ব্রাহ্মণ্য-মন্দির প্রতিষ্ঠিত ছিল এবং তাহার কিছু কিছু প্রতিমা-নিদর্শনও পরবর্তী বিহার-মন্দিরের ভিত্তিগাত্ৰসজ্জায় ব্যবহৃত হইয়া থাকিবে। বিহার-মন্দিরটির বিভিন্ন স্তরের চারিদিকের প্রাচীরগাত্ৰ অগণিত মৃৎফলকে ঢাকা; তাহা ছাড়া ভিত্তিগাত্ৰসজ্জায় উৎকীর্ণ প্রস্তরফলক ও প্রচুর ব্যবহার করা হইয়াছে (বর্তমান সংখ্যা ৬৩)। মৃৎফলকগুলির কথা পরে বলিতেছি। প্রস্তরফলকগুলি সম্বন্ধে গোড়ায়ই বলা প্রয়োজন যে, এই ৬৩টি প্রস্তরফলক সবই যেমন এক যুগের নয় তেমনই নয় একই শিল্পীরীতি ও আদর্শের।

পাহাড়পুর মন্দিরের প্রস্তরশিল্পে তিন ধারা

এই প্রস্তর-ফলকগুলির মধ্যে এক ধরনের ফলক দেখিতেছি। যাহাদের ভঙ্গি, বিষয়বস্তু ও শিল্পদূষ্টি একান্তই প্রতিমালক্ষণ শাস্ত্রদ্বারা নিয়মিত; ব্রাহ্মণ্য দেবদেবীর রূপায়ণই তাঁহাদের উদ্দেশ্য। ভঙ্গি-মর্যাদায়, সৌষ্ঠবে এবং রুচিবোধে। ইহার যে-পরিচয় বহন করে তাহা অবসরপুষ্ট ব্ৰাহ্মণ্যধর্মশ্রিত সমাজের উচ্চতর বর্ণ ও শ্রেণী:স্তরের। এই দৃষ্টি ও রীতির স্বাক্ষর পড়িয়াছে কয়েকটি ফলকেই, বিশেষভাবে রাধাকৃষ্ণ (?)-মিথুনমূর্তি, যমুনা, শিব এবং বলরামের অনুকৃতিতে। ইহাদের মধ্যে ষষ্ঠ-সপ্তম শতকীয় পূবী গুপ্ত-শিল্পদ্ধৃষ্টি ও রীতির প্রভাব সুস্পষ্ট। সেই সুকুমার দেহভঙ্গি , সূক্ষ্ম পেলাব গড়ন এবং নমনীয় ডোলের ঐতিহ্য এখনও বিস্মৃতিতে ঢাকা পড়ে নাই। নির্মাণকলার কোমল সংবেদনশীল রূপায়ণ তো আছেই; তাহা ছাড়া, ইহাদের বসনভূষণের সৌষ্ঠব, গড়ন এবং বিন্যাসেও গুপ্তাদর্শের মার্জিত রুচি ও সূক্ষ্মবোধ প্রত্যক্ষ। কিন্তু তাহার চেয়েও বেশি প্রত্যক্ষ মধ্য-গাঙ্গেয়ভূমির গুপ্তযুগীয় শিল্পদূষ্টির স্বচ্ছ দীপ্তি এবং তাঁহারই পূর্বাঞ্চলিক ঐতিহ্যের ভাবালুতা এবং ইন্দ্রিয়পরতা। বস্তুত, রাজগীর-মণিয়ার মঠের মূর্তিগুলির সঙ্গে এবং মহাস্থানে প্রাপ্ত ব্রোঞ্জধাতুনির্মিত মঞ্জুশ্ৰীমূর্তির শিল্পপৃষ্টি ও রীতির সঙ্গে এই ফলকগুলির আত্মীয়তা অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। আমার বিশ্বাস, এই ফলকগুলি ষষ্ঠ শতকীয় এবং সমসাময়িক কোনও মন্দির সজ্জায় ইহারা ব্যবহৃত হইয়াছিল; পরবর্তীকালে পূর্বতন মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ হইতে আহরণ করিয়া অষ্টম শতকীয় পাহাড়পুর বিহার-মন্দিরের ভিত্তিগাত্ৰসজায় আবার ইহাদের ব্যবহার করা হইয়াছে।

এই দৃষ্টিরই স্কুল, রূঢ়, শিথিল, গুরুভার, প্রাকৃত রূপায়ণ দেখিতেছি প্রায় ১৫/১৬টি ফলকে। ইহাদেরও বিষয়বস্তু ব্ৰাহ্মণ্য দেবদেবী এবং ইহাদের শিল্পরূপও প্রতিমালক্ষণ শাস্ত্রদ্বারা নিয়মিত। স্থূল, গুরুভার গড়নই ইহাদের প্রধান বৈশিষ্ট্য। দুই একটি মূর্তিতে একটু গতিময়তার আভাস থাকিলেও একটা রূঢ় আড়ষ্টতা কিছুতেই দৃষ্টি এড়াইবার কথা নয়। হ্রস্বদেহ, দণ্ডায়মান মূর্তিগুলির দেহভঙ্গির অনমনীয়তার ফলে মনে হয়, স্কুল পদযুগল যেন দুইটি স্তম্ভের মতো একটি গুরুভার দেহকে কোনও মতে পতন হইতে রক্ষা করিয়াছে। গুপ্ত-শৈলীর অপরূপ সূক্ষ্ম রেখাপ্রবাহের এবং স্বচ্ছ নমনীয় ডোলের কোনও চিহ্ন আর অবশিষ্ট নাই। অর্ধচন্দ্ৰাকৃতি, প্রশস্ত ও গুরুভার মুখমণ্ডলে দীপ্তি ও ভাব-লাবণ্যযোজনার বিশেষ কোনও লক্ষণ প্রায় অনুপস্থিত। সন্দেহ নাই, এই ফলকগুলি এমন সব শিল্পীর রচনা যাঁহারা প্রতিমা-লক্ষণ জানিতেন, ব্রাহ্মণ্যধর্মের অনুশাসন মানিতেন, কিন্তু যাহাদের অন্তর্নিহিত ভাব ও রসের যথার্থ কোনও বোধ ও বুদ্ধি ছিল না, যাহারা গুপ্ত-শৈলীর মূর্তিকলার সঙ্গে পরিচিত ছিলেন, কিন্তু তাহার রূপ-ভাবনা এবং আঙ্গিকের উপর কোনও অধিকারই যাঁহাদের ছিল না। খুব সম্ভব, এই ফলকগুলির শিল্পীদের পাথর কুঁদার অভিজ্ঞতাও বিশেষ ছিল না, কিন্তু পৃষ্ঠপোষকদের আদেশে ও প্রয়োজনানুরোধে এই কার্যে তাঁহাদের ব্ৰতী হইতে হইয়াছিল। রূপসৃষ্টির আনন্দের কোনও চিহ্নই যেন ফলকগুলিতে নাই। কালের দিক হইতে ইহারাও ষষ্ঠ-সপ্তম শতকীয় এবং লক্ষণীয় এই যে, এই ফলকগুলিতে পরবর্তী পাল-আমলের ফলক রচনা-বিন্যাসের পূর্বাভাস সুস্পষ্ট; কিন্তু ষষ্ঠ-সপ্তম শতকীয় পূর্ব শিল্পীরীতির সুচারু ডোল, সুষ্ঠ গড়ন, বা ভঙ্গির ব্যঞ্জনা ইহাদের মধ্যে নাই। গুপ্ত-শৈলীর মার্জিত সংস্কৃত রূপের সঙ্গে ইহাদের দূরত্ব অত্যন্ত সুস্পষ্ট।

লোকায়ত শিল্পের আভাস

কিন্তু অষ্টম শতকীয় পাহাড়পুর বিহার-মন্দিরের বিশিষ্ট শিল্পরূপ সদ্যোক্ত এই ধরনের ফলকগুলির মধ্যে নাই। সংখ্যায়। ইহাদের চেয়ে বেশি এক ধরনের অনেকগুলি ফলক আছে যাহার বালি-পাথর সাদাটে ধূসর বর্ণের এবং দানাদার, দাগবহুল। এই ফলকগুলি সবই একই আয়তনের; ভিত্তি গাত্রের ছক বিশ্লেষণ করিলেই বুঝা যায়, ছকের আয়তনানুযায়ী ফলকগুলির আয়তনও নির্ণীত হইয়াছিল। এই ফলকগুলিতে নানা কাহিনীর রূপায়ণ। অনেকগুলিতে কৃষ্ণায়ণের বিচিত্ররূপ; কিন্তু এই কৃষ্ণ একান্তভাবে ব্রাহ্মণ্য শাস্ত্রানুমোদিত কৃষ্ণ নহেন; তাহার রূপ যেন একান্তই লোকায়ত জীবনের। কতকগুলিতে রামায়ণ-মহাভারতের নানা গল্পের রূপ এবং সেইসব গল্পের লোকায়ত জীবনে যাহাদের আবেদন প্রত্যক্ষ। তাহা ছাড়া, দৈনন্দিন লৌকিক জীবনের নানা রূপও অনেকগুলি ফলকে উৎকীর্ণ-নৃত্যপরা নারী, মিথুনাসক্তা নরনারী, যষ্ঠিতে হেলান দিয়া দাঁড়ান বিশ্রামরত দ্বারপাল ইত্যাদি। ইহাদের সকলেরই বসনভূষণ স্বল্প ও নিরাভরণ; প্রকাশভঙ্গিমায় অন্তর্লেকের কোনো গভীর চিন্তা বা ভাবের অভিব্যক্তি নাই, নাই কোনও মার্জিত রুচি বা বিদগ্ধ গরিমার ব্যঞ্জনা। ইহাদের চালচলন ও মুখাবয়ব স্কুল এবং ক্ষেত্রবিশেষে অমার্জিত; দণ্ডায়মান ভঙ্গি বলিষ্ঠ, কিন্তু আড়ষ্ট’। পরিপূর্ণ সুগোল মুখমণ্ডলে, অর্ধচন্দ্ৰাকৃতি ওষ্ঠে এবং বৃহৎবিস্ফারিত নয়ন যুগলে সহজ সরল্যময় লোকায়ত জীবনের আনন্দােজুল হাসির স্বাক্ষর; এই হাসি যেন একান্তই তাঁহাদেৱ নিজস্ব। কোথাও কোনও সূক্ষ্ম আড়াল রচনা নাই, কোনও কার্পণ্য নাই, সামগ্রিক জীবন যেন ইহাদের রূপায়ণে পূর্ণ অভিব্যক্ত! প্রাণের প্রাচুর্য এবং স্বাভাবিক গতিময়ত, সহজ অথচ পরিপূর্ণ ও অপরূপ প্রকাশ-মহিমাই এই ফলকগুলির শিল্পবৈশিষ্ট্য। শিল্পশাস্ত্র এবং প্রতিমালক্ষণ শাস্ত্রের নিয়ম-বন্ধন হইতে মুক্ত এই শিল্পদূষ্টি গভীর বস্তুচেতনায় প্রত্যক্ষ বাস্তব জীবন হইতে সমস্ত রস আহরণ করিয়াছে, প্রাত্যহিক জীবনের সুখদুঃখ, হাসিকান্না, রঙ্গকোলাহলময় প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা এবং নিশ্চিছদ্র গতিময়তাই এই শিল্পে জীবন সঞ্চার করিয়াছে। সাধারণ মানুষের লৌকিক ঘটনাবলী এবং তাঁহাদের অভিজ্ঞতাই এই শিল্পের উপজীব্য। আঙ্গিকের দিক হইতে এই শিল্পরূপ স্কুল অমার্জিত ও অসম্পূর্ণ কিন্তু মানবিকবোধে গভীর, জীবনের অভিব্যক্তিতে বিস্তারিত এবং শিল্পরসে তাৎপর্যময়।

এই প্রস্তর ফলকগুলির সঙ্গে পূর্বোক্ত অন্য দুটি শিল্পরূপ ও দৃষ্টির কোথায় কোনও মিল নাই; কিন্তু প্রাচীরগাত্রের অসংখ্য ও বিচিত্র মৃৎফলকগুলির রূপ ও দৃষ্টির সঙ্গে ইহাদের আত্মীয়তা অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। সমসাময়িক শিল্পেতিহাসে পাহাড়পুর বিহার-মন্দিরের প্রাচীর গাত্রের এই ফলকগুলি এক অপরূপ বিস্ময়। শুধু পাহাড়পুরেই নয়, ময়নামতীর ধ্বংসাবশেষ হইতেও ঠিক একই ধরনের অসংখ্য মৃৎফলক সম্প্রতি আবিষ্কৃত হইয়াছে। সন্দেহ নাই, অন্যান্য বৃহদায়তন ও সমসাময়িক প্রাচীন মন্দির-বিহারের প্রাচীরগাত্রও এইভাবে মূৎফলকের আস্তরণে শোভিত ও অলংকৃত ছিল।

পাহাড়পুর ও ময়নামতীর লোকায়ত মৃৎশিল্প

পাহাড়পুর ও ময়নামতীর মৃৎফলক-কলার মৌলিক বৈশিষ্ট্য সম্পূর্ণ লৌকিক এবং সাধারণ লোকায়ত কৃষিজীবনের মানস কল্পনাই ইহাদের মধ্যে রূপ পরিগ্রহ করিয়াছে। ইহারা রস আহরণ করিয়াছে লোকায়ত দৈনন্দিন জীবন হইতে; স্থিতি ও গতির বিভিন্ন অবস্থায় বস্তু ও প্রাণী জগতের সকল জিনিসকে সহজ আবেগময় দৃষ্টিতে দেখা এবং বিচিত্রভাব ও ভঙ্গিতে সেই দেখাকে অপূর্ব স্বচ্ছন্দ গতিময়তায় এবং নিছক বস্তু-ব্যঞ্জনায় প্রকাশ করা, ইহাই যেন ছিল এই মৃৎশিল্পীদের শিল্পদর্শ। এই অসংখ্য ফলকগুলিকে সারি সারি ভাবে সাজাইয়া দেখিলে মনে হয়, লোকায়ত জীবন যেন এক বিচিত্ৰ শোভাযাত্রায় চলিয়াছে, যেন এই মৃৎশিল্পীরা অনুভূতি ও সচেতন বস্তু-অভিজ্ঞতার একপ্রাস্ত হইতে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত অবিরত আন্দোলিত হইয়াছে এবং সেই আন্দোলন ফলকগুলির উপর প্রত্যক্ষ। ধৰ্মগত, উচ্চকোটিস্তরের ঐতিহ্যগত শিল্পের কোনও স্তরে এমন সুবিস্তৃত সামাজিক পরিবেশ, মানবিক কল্পনা ও অনুভূতির এমন বৈচিত্র্য, প্রাত্যহিক জীবনের বাস্তব ঘটনা ও অভিজ্ঞতার সঙ্গে এমন গভীর সংযোগ, এমন স্বতোচ্ছসিত ভঙ্গিমা ও চালচলন, প্রকাশের এমন সজীব ও পরিপাটি ছন্দের পরিচয় সুদূর্লভ! গ্রাম্য মৃৎশিল্পীরা সুলভ আটাল মাটি লইয়া আনন্দচ্ছলে যে রূপ সৃষ্টি করিয়াছেন তাহাতে ‘সভ্য’, ‘ভদ্র’, অবসরপুষ্ট জীবনের পরিমিত সৌষ্ঠব বা মার্জিত রুচির পরিচয় বা উচ্চস্তরের ভাবানুভূতি, গভীরতর অধ্যাত্ম-ব্যঞ্জনা বা জটিল মননক্রিয়ার পরিচয় আশা করা অন্যায়; কিন্তু মানুষ ও প্রকৃতির বিস্তৃত লীলাক্ষেত্রের ক্ষুদ্রতম বৈশিষ্ট্য সম্পর্কের্তাহাদের যে গভীর চেতনা এবং জীবন সম্পর্কে তাহাদের যে শ্রদ্ধাশীল অভিনিবেশ এই ফলকগুলিতে অত্যন্ত সুস্পষ্ট তাহা কিছুতেই অস্বীকার করা চলে না। উচ্চকোটির ঐতিহ্যবাহী ভারতীয় শিল্পসাধনার যে কোনও শ্রেণী বা স্তরে এই ধরনের শিল্পদূষ্টি দুর্লভ। সমসাময়িক বাঙলার লোকায়ত সামাজিক জীবনের যথাৰ্থ বস্তুময় স্পদিত পরিচয় এই ফলকগুলিতে যতটা পাওয়া যায়, প্রস্তর-প্রতিমাশিল্পে ততটা কিছুতেই নয়। রাজপ্রাসাদ ও অভিজাত-চক্রের পরিধি হইতে দূরে সাধারণ মানুষের নিত্যকোলাহলময় জীবনধারা কিভাবে প্রবাহিত হইত, সমসাময়িক ব্যক্তি ও সামাজিক মানসের কী ছিল প্রকৃতি তাহার পরিপূর্ণ অভিজ্ঞান এই মৃৎফলকগুলি।

সমসাময়িক জীবনের কোনও বস্তুই এই মৃৎশিল্পীদের দৃষ্টি এড়ায় নাই। রামায়ণ, মহাভারত, কৃষ্ণকথার নানা গল্প, পঞ্চতন্ত্র ও বৃহৎকথার নানা কাহিনী যেমন এই ফলকগুলিতে দৃষ্টিগোচর, তেমনই দৃষ্টিগোচর প্রত্যন্ত বাঙলার নানা আদিবাসী নরনারীর নানা দেহরূপ নানা অভ্যাস, নানা সংস্কারের চিত্র, কাল্পনিক প্ৰাণীজগতের বিচিত্র নিদর্শন—গন্ধৰ্ব, কিন্নরী, অর্ধমানব-অর্ধপশুর লীলাময় কল্পনার ছন্দিত রূপ; সমৃদ্ধ পশুপক্ষী জগতের নানা বিচিত্র নিদর্শন—প্রত্যেকের নিজস্ব বিশিষ্ট ভঙ্গিমায় এবং বিষয়বস্তুর মর্যাদা ও বৈচিএানুযায়ী রূপায়িত; নানা ভঙ্গিমায় জননী ও শিশু; কুন্তীকসরত ও নানা শারীরক্রিয়ারত মল্লবীর; যষ্ঠিবৃত দ্বারপাল; কুপে জলাহরণরতা ও জলপাত্রবাহিনী নারী; গৃহপ্ৰবেশিরতা নারী; স্ত্রী ও পুরুষ যোদ্ধা, রথারোহী ধনুর্ধর; দীর্ঘশ্মশ্রু আনত পৃষ্ঠ ভ্ৰাম্যমাণ সন্ন্যাসী বা দরিদ্র ভিক্ষুক; লাঙ্গলবাহী কৃষক; মৎস্যবাহিনী ও মৎস্যকর্তনরতা নারী; নৃত্যপরা ও সংগীতরতা নারী; শিকারবাহী ব্যাধ; গীতবাদ্যরত পুরুষ; ধর্মাচরণরত ব্ৰাহ্মণ; অস্তিচর্মসার, ন্যাঙ্গোটিমাত্র পরিহিত, স্কন্ধাদেশে প্রলম্বিত যষ্ঠির দুইপ্রান্তে পুঁটুলি ঝুলানো পথিক সন্ন্যাসী বা দরিদ্র ভিক্ষুক; নানা কৌতুকময় ঘটনা, রূপ ও ভঙ্গিমা; মোেরাগের ও র্যাড়ের লড়াই প্রভৃতি জীবনের অসংখ্য বিচিত্ররূপ। দেবদেবী মূর্তিও একেবারে অপ্রতুল নয়; ব্ৰহ্মা, বিষ্ণু, গণেশের কয়েকটি মূর্তি আছে, কিন্তু সবচেয়ে বেশি আছেন শিব, সেই শিব “যে-শিবের লোকায়ত রূপ ও ভঙ্গিমা মধ্যযুগীয় বাঙলা সাহিত্যে এবং লোকায়ত শিল্পে কীর্তিত এবং আজও সুপরিচিত। বৌদ্ধ দেবদেবী, বিশেষ ভাবে মহাযান-বজযানবর্গের কয়েকটি দেবদেবীও আছেন, যেমন বোধিসত্ত্ব পদ্মপাণি, মঞ্জুশ্ৰী, তারা। কিন্তু শাস্ত্ৰ-ব্যাখ্যাত দেবদেবীর সংখ্যা প্রায় নগণ্য বলিলেও চলে।

আগেই বলিয়াছি, এই ফলকগুলির গড়নে মার্জিত স্পর্শের, সূক্ষ্ম রুচির বা গভীর ব্যঞ্জনার পরিচয় সামান্যই; কিন্তু লক্ষণীয় ইহাদের সাবলীল গতিচ্ছন্দ, ইহাদের স্বচ্ছন্দ প্রাণময়ত, জীব ও মানবদেহের গঠন, গতি ও প্রকৃতি সম্বন্ধে শিল্পীদের সচেতন দৃষ্টি, জড়াজগতের এবং দৈনন্দিন জীবনের খুঁটিনাটি সম্বন্ধে তাঁহাদের প্রত্যক্ষাবোধ! এমন অপূর্ব বস্তুময়তাও দৃষ্টি এড়াইবার কথা নয়। সন্দেহ করিবার কারণ নাই যে, এই শিল্প একান্তই লৌকিক শিল্প প্রথাবদ্ধ প্রতিমা-শিল্পের সঙ্গে ইহাদের কোনও যোগ নাই। যে বিহার-মন্দির নৃপতি ও উচ্চতর অভিজাত সম্প্রদায়ের প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় এবং প্রথাগত ধর্মের নিশ্চিত নিয়ন্ত্রণাধীনতায় রচিত, তাহার প্রাচীর-গাত্রে বিস্তার লাভ করিবার এমন প্রশস্ত সুযোগ সমসাময়িক লৌকিক শিল্প পাইল কী করিয়া, ভাবিলে বিস্মিত হইতে হয়। মৃৎশিল্প প্রাকৃত স্তরের শিল্প; প্রাচীন ভারতীয় ধারণায় এই শিল্প অপভ্রংশ পঙক্তির শিল্প; আভিজাত সংস্কৃত স্তরের শিল্পের সঙ্গে একাসনে ইহার স্থান কোথাও নাই— শিল্পশাস্ত্ৰেও নাই; সমগ্র প্রাচীন ভারতীয় মন্দির-বিহারেও তেমন সুপ্রচুর নিদর্শনও কোথাও নাই। জনসাধারণের প্রত্যক্ষ সৃজনক্রিয়ার এইসব নিদর্শন উচ্চকোটি ও সংস্কৃত শিল্পীসাধনার নিপুণতর নিদর্শনের পাশে কোথাও দাঁড়াইবার সুযোগ পায় নাই, সে স্পর্ধাও ছিল না।

এ-কথা অস্বীকার করা চলে না যে, এই লৌকিক মৃৎশিল্প পূর্বতন যুগেও সুঅভ্যস্ত ছিল, বাঙলাদেশে ছিল, সমগ্র গাঙ্গেয়ভূমি জুড়িয়াই ছিল। প্রাকৃত ভাবনা-কল্পনার তাৎক্ষণিক রূপের ভাষাই তো এই মৃৎশিল্প। কিন্তু, মনে হয়, এই শিল্প আজও যেমন তখনও তেমনই গ্রামে গ্রাম্য জনসাধারণের লোকায়ত জীবনের মধ্যেই আবদ্ধ ছিল এবং তাহাই ছিল সাধারণ নিয়ম। পাহাড়পুর এবং ময়নামতীতে যে এই শিল্পকে দেখিতেছি পুরোভাগে এবং ইহারই নিদর্শন দেখিতেছি প্রচুরতম, তাহার প্রধান কারণ, বাঙলাদেশে পাথরের অভাব এবং প্রাকৃত সংস্কৃতির আপেক্ষিক প্রাবল্য। পাহাড়পুর বা ময়নামতীর মতন সুবৃহৎ বিহার-মন্দিরের সুবিস্তৃত প্রাচীরগাত্র ঢাকিয়া দিবার মতো এত পাথর এবং প্রস্তর-তক্ষক বাঙলাদেশে ছিল না। কাজেই ডাক পড়িয়াছিল প্রাকৃত শিল্পীরূপে অভ্যস্ত লোকায়ত শিল্পীকুলের এবং তাহারা অগণিত মৃৎফলকে সমস্ত প্রাচীর গাত্র ঢাকিয়া দিয়াছিলেন। কিন্তু এমন সুযোগ তাহারা সচরাচর পাইতেন বলিয়া মনে হয় না। বস্তুত, অষ্টম-নবম শতকের পর বহুদিন এই লোকায়ত শিল্পের নিদর্শন আর কোথাও দেখিতেছি না। বহু শতাব্দী পর, বাঙলাদেশে যখন কেন্দ্রীয় অন্যতম রাজশক্তি ধর্ম ও সংস্কৃতির পোষক, রাষ্ট্র ও রাজপ্রাসাদের সংস্কৃতিবন্ধন যখন শিথিল, প্রথাগত ও উচ্চকোটির সংস্কৃত ধর্মের শাসন যখন দুর্বল, লোকায়ত ধর্ম ও সংস্কৃতির প্রভাব যখন কিছুটা প্রসারিত তখন, অর্থাৎ খ্ৰীষ্টীয় সপ্তদশ শতক হইতে উনবিংশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত, এই লোকায়ত শিল্পের আপেক্ষিক প্রসার ও প্রতিপত্তি আবার আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়। এই সময় এবং ইহার কিছু আগে হইতেই গ্রাম্য কৃষিজীবী জনসাধারণের ভাব ও চিন্তাধারায় সমৃদ্ধ দেশীয় অর্থাৎ বাঙলা সাহিত্যের বিকাশের পরিচয় পাওয়া যায় এবং মঙ্গলকাব্যে, বারমাস্যায়, মহাকাব্যের লৌকিক রূপায়ণে, নানা গাথাগীতিকায়, পদাবলীতে দেশ ও জাতির মর্মবাণী ব্যক্ত হয়। এই লোক-সাহিত্যের সমান্তরালে দেখিতেছি লৌকিক শিল্পেরও বিকাশ। ফরিদপুর, যশোহর, বর্ধমান, বীরভূম, চব্বিশ-পরগণা এবং বাঙলার অন্যান্য জেলার বহু ইটের তৈরি মন্দিরের বহিঃপ্রাচীরগাত্রে অগণিত মৃৎফলকের সমৃদ্ধ ঐশ্বর্য এই কালে আবার দৃষ্টিগোচর হইতেছে। ইহাদের শিল্পদূষ্টি ও আঙ্গিক কিছুটা ভিন্নতর, কিন্তু লোকায়ত শিল্পের যাহা প্রধান মৌলিক বৈশিষ্ট্য, অর্থাৎ সাবলীল গতিময়তা, স্বচ্ছন্দ প্রাণপ্রবাহ এবং প্রত্যক্ষ দৈনন্দিন জীবনের সমৃদ্ধ বস্তুময়ত তাহা এই দৃষ্টি এবং আঙ্গিকেও সমান প্রত্যক্ষ। রাজপ্রাসাদ, অভিজাতচক্র এবং পুরোহিতবর্গের শাস্ত্রানুগ শিল্পের স্পর্শবিমুক্ত এই লৌকিক শিল্পের ধারা বহুদিন পর্যন্ত স্বীয় বৈশিষ্ট্যে প্রতিষ্ঠিত ছিল।

পালপর্বের আগে প্রস্তর-ভাস্কর্যের নিদর্শন যে বাঙলাদেশে খুব বেশি নাই, তাহার প্রধান কারণ সুলভ মৃৎশিল্পের প্রসার। নমনীয় মাটির নিজস্ব একটা গুণ ও প্রকৃতি তো আছেই; সহজ দ্রুত অঙ্গুলি ও করতালু চালনার ফলে নানা বিচিত্র দ্রুত ভঙ্গ ও ভঙ্গি সহজেই রূপ গ্রহণ করে, ডোলের মার্জনা সহজ নয়। এই মাধ্যমে কাজ করার ফলে বাঙলার লোকায়ত শিল্পের কতকগুলি বৈশিষ্ট্য আপনি ধরা দিয়াছিল। তারপর যখন এই সব শিল্পীরা মধ্য-ভারতীয় প্রভাবে পড়িয়া পাথরের কাজে হাত দিলেন তখন প্রাথমিক বাধা কতকগুলি দেখা দিবে, তাহা বিচিত্র নয়। কিন্তু এই বাধা-সংঘাতের ভিতর দিয়াই সৃষ্টি লাভ করিল নূতন শিল্পীরীতি যে রীতিতে মৃৎশিল্পের গতিময়ত, প্ৰাণপ্ৰবাহ এবং মার্জিত ডোল একদিকে যেমন পাথরে রূপান্তরিত হইল তেমনই পাথরে কাজ করার দরুন দেহরূপে এবং ভঙ্গিতে দেখা দিল একটা দৃঢ় কাঠিন্য। এই রীতির পরিচয়ও পাহাড়পুরেরই কতকগুলি দেবদেবী মূর্তিতে (কৃষ্ণ-বলরাম, ইন্দ্ৰ, যম, কুবের, গণেশ ইত্যাদি) পাইতেছি; দুই-একটি নৃতাপরা নারীমূর্তিতেও তোহা সুস্পষ্ট। এই রীতি ও ধারাই এমপরিণতি লাভ করিয়া পাল-পর্বের মধ্যযুগীয় পূবী প্রতিমাশৈলীতে বিবর্তিত হইয়াছিল। বলা বাহুল্য। এর পশ্চাতে ছিল খহুযুগের অভ্যাস ও অনুশীলন।

বাঙলাদেশে পাথরে তৈরি নানা পর্বের যে-সব প্রতিমা বা মূর্তি নিদর্শন, পাওয়া গিয়াছে, তাহার কয়েকটি ছাড়া কোনোটিতেই কোনও সন-তারিখ উৎকীর্ণ নাই, এমন কি কোনও লেখাও যথেষ্ট উৎকীর্ণ নাই যাহার সাহায্যে ইহাদের কালনির্ণয় করা চলে। কাজেই গঠন ও রূপ-বিশ্লেষণ ছাড়া ইহাদের কাল নির্ণয়ের অন্য কোনও উপায় নাই। যেমন সাহিত্যে, শিল্পেও তেমনই নানা সামাজিক ও আদর্শগত কারণে, গঠনরীতিগত কারণে, বিবর্তনগত কারণে, এক এক যুগে এক এক দেশখণ্ডে কতকগুলি বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য রূপ গ্রহণ করে। সেই জন্য সেই বৈশিষ্ট্যগুলি আশ্রয় করিয়া মূর্তিগুলির কাল-নিরূপণ সহজ হয়।

সপ্তম-অষ্টম শতকীয় মূর্তি

বাঙলার নানা জায়গায় প্রাপ্ত সপ্তম-অষ্টম শতকীয় মূর্তিগুলি বিশ্লেষণ করিলে দেখা যায় যে, ইহাদের প্রায় সবই পূজাৰ্চনার জন্য তৈরি দেবদেবী মূর্তি এবং ইহাদের নির্মাণ ও রচনাবিন্যাস একান্তই প্রতিমালক্ষণ-শাস্ত্র দ্বারা মোটামুটি নিয়মিত। পাহাড়পুরে যে দেবদেবীর মূর্তিগুলি দেখিতেছি, এ গুলি ঠিক অৰ্চনার জন্য তৈরি দেবদেবী প্রতিমা নয়, বোধ হয় প্রাচীর বা ভিত্তিগাত্র সজ্জার জন্যই ইহাদের রচনা; কিন্তু তৎসত্ত্বেও প্রতিমাশাস্ত্রের নির্দেশ একেবারে অস্বীকৃত হয় নাই। তবে, প্রাচীর বা ভিত্তিগাত্ৰ সজ্জার জন্য যে মূর্তি রচিত হইত। তাহার আর কোনো পৃষ্ঠপট প্রয়োজন হইত না, কিংবা সাধারণত তাহার শিরোভাগের পশ্চাতে কোনো শিরশিচক্র বা প্রভামণ্ডল থাকিত না। কিন্তু গর্ভগৃহে প্রতিষ্ঠা করিয়া নিয়মিত অৰ্চনার জন্য যে-সব দেবদেবীর প্রতিমা রচিত হইত। তাহাদের পৃষ্ঠপট ও শিরশ্চিক্র দুইই প্রয়োজন হইত, কিছুটা শিল্পের। প্রয়োজনে, সৌন্দর্যবোধের প্রেরণায়, কিছুটা শাস্ত্রনির্দেশে।