০২. সংগীত ও নৃত্য

সংগীত ও নৃত্য

আগেই বলিয়াছি, দশম-একাদশ শতকের আগে নৃত্য ও গীত সম্বন্ধে কিছু বলিবার মতো উপাদান আমাদের নাই। কিন্তু দশম-দ্বাদশ শতকীয় চর্যাগীতিগুলিতে, জয়দেবের গীতগোবিন্দ এবং লোচনা-পণ্ডিতের রাগীতরঙ্গিনী-গ্রন্থে এমন সব রাগের ও তালের নামোল্লেখ পাইতেছি। যাহাতে মনে হয়, এই সময়ের বহু আগে হইতেই প্রাচীন বাঙলাদেশ ভারতীয় সংগীতের ধারাস্রোতের সঙ্গে যুক্ত হইয়া গিয়াছিল এবং সর্বভারতে অভ্যস্ত ও প্রচলিত অনেক রাগ ও তাল বাঙলাদেশেও বিস্তার লাভ করিয়াছিল।

চর্যাগীতির রাগ

চর্যাগীতির পদগুলি যে সুরে তালে গাওয়া হইত। তাহা গীতারম্ভে রাগের নামেই প্রমাণ; কিন্তু এ-সব রাগের ঠাট্ট বা কাঠামো যে কী ছিল, এখন আর তাহা বলা যায় না। এ-গুলি প্রায় সমসাময়িক লোচনা-পণ্ডিতের রাগীতরঙ্গিনীর বা কিছু পরবর্তী কালের শার্ঙ্গদেবের সংগীত-রত্নাকরের (১২১০-১২৪৭) পদ্ধতি অনুযায়ী গাওয়া হইত। কিনা, বলা কঠিন। চর্যাগীতির ৫০টি গীত “যে-সব রাগে গাওয়া হইত। তাহদের সংখ্যা ১০টি। ১, ৬-৭, ৯, ১১, ১৭, ২০, ২৯, ৩১, ৩৩, ৩৬ এবং ৪৮ নং গীতের রাগ পটমঞ্জরী এবং বারংবার ব্যবহারে মনে হয়, এই রাগটিই ছিল সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয়; ২-৩ ও ১৮ নং- গবড়া বা গউড়া; ৪— অরু; ৫, ২২, ৪১, ৪৭- গুর্জরী, গুঞ্জরী, কাহ্ন-গুর্জরী; ৮— দেবক্ৰী; ১০, ৩২- দেশাখ; ১৩, ২৭, ৩৭, ৪২— কামোদ; ১৪- ধনসী, ধানশ্ৰী; ১৫, ৫০- রামক্রী ২১, ২৩, ২৮, ৩৪— বলাড্ডী বা বরাড়ী; ২৬, ৪৬- শবরী; ৩০, ৩৫, ৪৪, ৪৫, ৪৯— মল্লারী; ৩৯— মালসী; ৪০ – মালসী-গবুড়া; ৪৩— বঙ্গাল; ১২, ১৬, ১৯, ৩৮– ভৈরবী! গবড়া ও গউড়া একই রাগী সন্দেহ নাই এবং খুব সম্ভব কাবো। যেমন গৌড়ীরীতি রাগের মধ্যেও তেমনই একটি ছিল গউড়া বা গৌড়ী রাগ এবং তাহারই সঙ্গে মালসী বা মালশ্রী (মালব-শ্ৰী?) মিশাইয়া যে মিশ্র রাগ তাহার নাম মালসী-গবুড়া (৪০)। লোচনা-পণ্ডিত কিন্তু এক গৌরী-রাগের নাম করিয়াছেন; গৌরী কি গৌড়ী-রাগ? গুঞ্জরী গুর্জরী-রাগেরই লিপিকর প্রমাদ এবং কাহ্ন-গুর্জরী গুর্জর-রাগেরই বিশেষ এক প্রকার মিশ্রিত রূপ; অসম্ভব নয়, মাৰ্গ গুর্জরীর সঙ্গে দেশী কাহ্ন-রাগের মিশ্রণেই কাহ্ন-গুর্জরীর সৃষ্টি। কাহ্ন বা কৃষ্ণভক্তরা যে ঠাটে গুর্জরী রাগ গাহিতেন তাহাই কি কাহ্নগুর্জরী? বা মথুরা-বৃন্দাবনের কৃষ্ণলীলার প্রচলিত গুর্জরীরাই কাহ্নগুৰ্জরী? রামক্রী-রাগ নিঃসন্দেহে পরবতী কালের রামকেলি, গীতগোবিন্দের রামকিরী, শ্ৰীকৃষ্ণকীর্তনের রামগিরি রাগ। কিন্তু দেবক্রীর পরবর্তী ভগ্নরূপ দেবকিরী-দেবকেলি বা দেবগিরির উল্লেখ আর কোথাও দেখিতেছি না। বস্তুত, পরবর্তী সংগীত-শাস্ত্ৰে বিভিন্ন ঘরানায় দেবক্রীরাগের কোনও স্থান যেন আর নাই। দেশাখ নিঃসন্দেহে গীতগোবিন্দ ও শ্ৰীকৃষ্ণকীর্তনের দেশাখ; কিন্তু দেশাখ কি দেশাখ্য, অর্থাৎ কোনও দেশী রাগের মার্গীকরণ? ধনসী, ধানশ্ৰী। পরবর্তী (শ্ৰীকৃষ্ণকীর্তন) কালের ধানুষী এবং মল্লারী সুপরিচিত মল্লার। কিন্তু সংগীতেতিহাসের দিক হইতে চর্যাগীতির সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য রাগ শবরী ও বঙ্গল-রাগ। শবরী রাগ তো নিঃসন্দেহে শবরদের মধ্যে প্রচলিত রাগ। এই লোকায়ত রাগটির মার্গীকরণ কবে হইয়াছিল, বলা কঠিন, তবে ইহার উল্লেখ শুধু চর্যাগীতিতেই পাইতেছি, আগে বা পরে সে-উল্লেখ আর কোথাও দেখিতেছি না। বঙ্গাল রাগও যে কী ধরনের আজ আর তাহা বুঝিবার উপায় নাই, তবে এই রাগটিও যে এক সময় গুর্জরী, মালবস্ত্রী বা মালসী, শবরী প্রভৃতি রাগের মতো স্থানীয় লোকায়ত রাগ ছিল, সন্দেহ নাই। অথচ ভারতীয় মার্গ-সংগীতে বঙ্গল-রাগ এক সময় সুপরিচিত রাগ ছিল এবং অষ্টাদশ শতকের রাজস্থানী চিত্রনির্দেশে বঙ্গল-রাগের চিত্রও দুর্লভ নয়। পরে কখন কী ভাবে যে এই রাগটি লুপ্ত হইয়া গেল তাহা জানা যাইতেছে না। বস্তুত, চর্যাগীতির দেবক্ৰী, গউড়া বা গবুড়া, মালসী-গবুড়া, শবরী, বঙ্গাল, কাহ্নগুৰ্জরী প্রভৃতি অনেক রাগই আজ বিলুপ্ত। দেশাখ-রাগ তো বোধ হয়। আজিকার দেশ-রাগে বিবর্তিত বা রূপান্তরিত হইয়া গিয়াছে। অরু-রাগ যে কি তাহাও আজ আর বুঝিবার উপায় নাই।

চর্যাগীতির ধ্রুবপদ

সমসাময়িক সংগীত-পদ্ধতির একটি সংকেত চর্যাগীতে খুব সুস্পষ্ট। এই গীতগুলির মূল পুঁথিতে এবং শাস্ত্রী-মহাশয়ের সংস্করণেও প্রতি পদের প্রত্যেক দুইলাইনের শেষে “ধু” এই শব্দটির উল্লেখ আছে। “ধু” যে ধ্রুবপদের সংকেত ইহাতে কোনো সন্দেহই থাকিতে পারে না। কয়েকটি পদের সংস্কৃত টীকাতেই ‘ধুবপদেন দৃঢ়ীকুৰ্বন’, ‘ধ্রুবপদেন চতুর্থনন্দমুদ্দীপয়ন্নাহ’ ইত্যাদি ব্যাখ্যা বর্তমান; কিন্তু মূল গীতে দ্বিতীয় পদটিকে বলা হইয়াছে ধ্রুবপদ, অথচ সংস্কৃত টীকায় ধ্রুবপদ বলা হইয়াছে। তৃতীয় পদটিকে এবং তাহাকেই দ্বিতীয় পদ বলিয়া উল্লেখ করা হইয়াছে। বুঝিতে কিছু অসুবিধা নাই যে, প্রথম পদের পর যে পদ তাহাই ধ্রুবপদ বা বাঙলা ধুয়া। তিব্বতী টীকায়ও এই পদটিকে বলা হইয়াছে “ধু পদ”। ইহার অর্থই যে, প্রত্যেকটি পদ গাহিবার পরই ‘ধু বা ধ্রুবপদটি গাহিতে হইত। এই পদটিই বর্তমান উত্তর-ভারতীয় সংগীত-পদ্ধতির ‘স্থায়ী” পদ। চর্যাপদগুলির ভাব-বিশ্লেষণ করিলেও দেখা যায়। এই ধ্রুবপদটিতেই সহজ-সাধনের সূত্রটি ধরিয়া দেওয়া হইয়াছে এবং সাধককে সতর্ক করা হইয়াছে। সেইজনাই প্ৰত্যেক পদ গাহিবার পরে বারবার এই পদই গাহিবার নির্দেশ ছিল, গায়কের এবং শ্রোতার বুদ্ধি ও দৃষ্টিকে বারবার ঐ দিকে আকৃষ্ট করিবার জন্য। উত্তর-ভারতীয় সংগীত-পদ্ধতিতে ‘স্থায়ী’র কাজও একই; স্থায়ীতেই বিশিষ্ট রাগটির প্রধান স্বর-সন্নিবেশ এবং এই সন্নিবেশই রাগটির মানচিত্রের কেন্দ্ৰবিন্দু। কাজেই বারবার স্থায়ীতে ফিরিয়া আসা প্রয়োজন, শ্রোতার মন ও দৃষ্টিকে ঐদিকে আকৃষ্ট করিবার জন্য।

গীতগোবিন্দের রাগ ও তাল

জয়দেবের গীতগোবিন্দের পদগুলিও রাগে-তালে গাওয়া হইত, এ-তথ্য সুপরিজ্ঞাত। গ্রন্থটির সমস্ত পাণ্ডুলিপিতেই রাগ ও তালের উল্লেখ আছে। এই গানগুলিতে ব্যবহৃত রাগের ও তালের সংখ্যা যথাক্রমে ১১ ও ৫; মালঞ্চ-রাগা— রূপকতাল, যতিতাল; গুর্জরী-রাগ- নিঃসার তাল, ব্যতিতাল, একতালী; বসন্তু রাগ- যতিতাল; রামকিরী— যতিতাল; কর্ণাট রাগা— যতিতাল; দেশাগ-রাগ (দেশাখ)- একতালী; দেশ-বরাড়ী-রাগ— রূপকতাল, অষ্টতালী; বরাড়ী রাগ- রূপকতাল; গোণ্ডকিরী রাগ- রূপকতাল; ভৈরবী রাগ- যতিতাল; বিভায-রাগ—একতালী। মালব নিঃসন্দেহে মালবশ্রী-মালসী-মোলশ্রী এবং গোড়ায় ছিল স্থানীয় লোকায়ত গানের রাগ, পরবর্তী কালে মার্গ-সংগীতে স্বীকৃত ও গৃহীত হয়। গুর্জরী-রাগের কথা চর্যাগীতি-প্রসঙ্গেই বলিয়াছি। বসন্ত-ভৈরবী-বিভাষ প্রভৃতি রাগ ত আজও সুপ্ৰসিদ্ধ ও সুঅভ্যস্ত। রামকিরী, রামক্ৰী, রামগিরির একই রাগের বিভিন্ন নোমরূপ। বরাড়ী ও দেশাখ (দেশাগ) বা দেশ-রাগের মিশ্রিত রূপ দেশ-বরাড়ী, এরূপ অনুমানে বাধা দেখিতেছি না। রামকিরী রাগের নামানুসরণে গোণ্ডকিরী খুব সম্ভব প্রাচীনতর গোণ্ডক্রী নামের অপভ্রংশ, এবং মনে হয়, আদিম গোন্দ বা গোণ্ডজনদের স্থানীয় লোকায়ত গানের রাগ। বাঙলাদেশে কর্ণাট-রাগের ব্যবহারের ইঙ্গিত। জয়দেবের মতো লোচনা-পণ্ডিতও দিতেছেন; ইহাতে আশ্চর্য হইবার কিছু নাই। জয়দেব ছিলেন, লক্ষ্মণসেনের অন্যতম সভাকবি, আর লোচনা-পণ্ডিতের রাগীতরঙ্গিনী রচিত হইয়াছিল। বল্লালসেনের রাজারম্ভকালে, বোধ হয় সেন-রাজসভার পৃষ্ঠপোষকতায়। আর, সেনা-বংশীয় রাজারা তো আদিতে কর্ণাটদেশবাসীই ছিলেন। দক্ষিণী কর্ণাটী সভ্যতা ও সংস্কৃতির একটি ক্ষীণধারার পরিচয় প্রাচীন বাংলাদেশে আছে, এ-কথা অস্বীকার করা যায় না। গীতগোবিন্দের গানের তালগুলির মধ্যে অন্তত নিঃসারিতালের কথা পরবর্তী কালে কোথাও শুনিতেছি না। ক্ষিতিমোহন সেন মহাশয় বলিতেছেন,

‘যে-সব ঘরানাতে জয়দেবের গান সংরক্ষিত আছে, সেখানে গীতগোবিন্দের গান শিখিতে গিয়া বিশ্বভারতীর ভূতপূর্ব সংগীতাধ্যাপক মহারাষ্ট্রদেশীয় পণ্ডিত ভীমরাওশাস্ত্রী তাহার স্বরলিপি ও তলের বাঁট লইয়া আসেন। সেই বাট দেখিয়া আচার্য ভাতখণ্ডে বলেন, “এ কি! এ-সব যে মালাবারের জিনিস!’

বস্তুত, সমসাময়িক বাঙলার সংগীত-সাধনায় দক্ষিণী প্রভাব অস্বীকার করা যায় না। লোচনের রাগীতরঙ্গিনী-গ্রন্থেও সে-প্রভাব অনস্বীকার্য। সে-কথা পরে বলিতেছি। হয়তো নৃত্যেও সে-প্রভাব ছিল, বিশেষত দেবদাসী নৃত্যে; সমসাময়িক কালে বাঙলাদেশের রাজসভায় ও অভিজাত স্তরে এই নৃত্য, কাররামাদের নৃত্য প্রভৃতি বহুল প্রচলিত ছিল। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যাইতে পারে, শিখদের শ্ৰীগুরু-গ্রন্থে জয়দেবের যে গান দুইটি উদ্ধার করা আছে সে দুটি যথাক্রমে গুজরী বা গুর্জর বা মারূ (মরুবাসী মাড়বারীদের স্থানীয় লৌকিক) রাগে গাওয়া হইত।

তক্ষুরুন্নাটক গ্ৰন্থ ও প্রাচ্যরীতি

চর্যাগীতির রাগিতালিকা এবং গীতগোবিন্দের রাগ ও তাল-তালিকা বিশ্লেষণ করিলে সহজেই মনে হয়, সমসাময়িক বাঙলাদেশে সংগীতচর্চার অপ্রাচুর্য ছিল না এবং সর্বভারতীয় মার্গ সংগীত-প্রবাহের সঙ্গে বাঙলাদেশের যোগও ছিল ঘনিষ্ঠ। সেইজন্যই মনে হয়, সংগীতশাস্ত্ৰ লইয়াও কিছু না কিছু আলোচনা নিশ্চয়ই হইয়া থাকিবে। লোচনা-পণ্ডিত রাগ-তরঙ্গিনী গ্রন্থে প্রাচীনতর তুম্বুরুন্নাটক-গ্রন্থের উল্লেখ করিয়াছেন। এই গ্রন্থের কোনও পাণ্ডুলিপি পাওয়া যায় নাই; তবে মনে হয়, কোনও নাট্যশাস্ত্ৰসম্পর্কিত গ্রন্থ ছিল এই তুম্বুরু নাটক। লোচন এই গ্রন্থ হইতে কিছু মতামত উদ্ধার করিয়াছেন; একটি উদ্ধৃতিতে আছে :

ইন্দুত্থানং সমারভ্য যাবদ্দুর্গামহোৎসবম
প্রাতার্গেয়ন্তু দেশাখে ললিতঃ পটমঞ্জরী ॥

এই যে শুক্লপক্ষের (দেবীপক্ষে) সূচনা হইতে দুর্গামহোৎসব পর্যন্ত প্ৰাতঃকালে দেশাখ, ললিত ও পটমঞ্জরী রাগে গান গাওয়া, এ যেন একান্তই বাঙালীর দুর্গাপূজার আগের কয়েকদিনের আগমনী, গান এবং রাগগুলিও সেই দিক হইতে লক্ষ করিবার মতন। এই ভাবে দুর্গমহোৎসব তো আর কোথাও হয় না, বা হইত না! সেই জন্যই মনে হয়। গ্রন্থকার যিনিই হউন, তিনি প্রাচ্য দেশ, বিশেষভাবে গৌড়-বঙ্গের কথাই যেন বলিতেছেন। সংগীত সম্বন্ধে এই গ্রন্থে বলা হইয়াছে,

দেশভাষাবিভেদাশ্চ রাগসংখ্যা ন বিদ্যতে।
ন রাগাণাং ন তালানামান্তঃ কুত্ৰাপি দৃশ্যতে।।

দেশভাষা যেমন স্বল্প বিভেদে অনন্ত, তেমনই রাগের সংখ্যাও অনন্ত; রাগ ও তালের অন্ত কোথাও দেখা যায় না। ইহাই প্রাচ্যদেশীয় মত। রক্ষণশীল উৎকট মাৰ্গপন্থীরা আজও সে মত স্বীকার করেন না, আগেও করিতেন বলিয়া মনে হয় না। সংগীতের দিক হইতে তম্বুরু নাটক গ্রন্থের মতামত অন্য কারণেও উল্লেখযোগ্য। মার্গ-সংগীতের ধারায় বিশেষ বিশেষ রাগ-রাগিণীর জন্য বিশেষ বিশেষ কাল শাস্ত্রানুসারে নির্দিষ্ট। তুম্বুরুনটকের রচিয়তা কিন্তু এই মত স্বীকার করিতেন না; তাঁহার মতে, রাগের কাল স্থিরীকৃত হয়। স্বরবৈচিত্র্যের রঞ্জকতা অনুযায়ী।

যথাকলে সমারব্ধং গীতং ভবতি রংজকম।
অতঃ স্বরস্য নিয়মাদ রাগোহপি নিয়মঃ কৃত।

নাট্যরঙ্গমঞ্চে বা রাজসভায়ও কালদোষ থাকিতে পারে না (রঙ্গভূমৌ নৃপাতায়াং কালদোষো ন বিদ্যতে), কারণ, রঙ্গভূমিতে গান গাহিতে হয় নাটকের প্রকরণ বা কালানুযায়ী এবং রাজসভায় রাজার আজ্ঞায়।

বুদ্ধনাটকের নৃত্যগীত

প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যাইতে পারে চর্যাগীতিতে বুদ্ধনাটকের কথা। কিন্তু এই নাটকের কী ছিল রূপ এবং নৃত্যগীতের কী ছিল স্থান, কী-ই বা ছিল তাহাদের প্রকৃতি, বলিবার কোনও উপায় নাই। কিন্তু প্রাচীনকালে নৃত্য বা নৃত্ত ছাড়া নাটক ছিল না; কাজেই বুদ্ধনাটকই হউক আর তুম্বুরুন্নাটাই হউক, নৃত্য ছিলই, বাদ্যও ছিল এই অনুমানে বাধা নাই। বিশেষত, আলোচ্য চর্যাগীতিটিতেই পাইতেছি, ‘নাচন্তি বাজিল গাঅন্তি দেবী, বৃদ্ধনাটক বিসমা হোই’।

লোচনের রাগীতরঙ্গিনী

প্রাচীন বাঙলায় সংগীত-শাস্ত্রোলোচনার একমাত্র নিদর্শন যাহা আমাদের কালে আসিয়া পৌঁছিয়াছে তাহা লোচনা-পণ্ডিতের রাগীতরঙ্গিনী। এই গ্রন্থেই উল্লিখিত আছে, লোচন রাগীতরঙ্গিনী ছাড়া আরও অন্তত একখানা সংগীত-গ্রন্থ রচনা করিয়াছিলেন; তাহার নাম ছিল রাগসংগীতসংগ্রহ, কিন্তু সে-গ্রন্থ এ-পর্যন্ত পাওয়া যায় নাই (এতেষাং প্রপঞ্চস্তু মৎকৃতরাগসংগীতসংগ্রহে অন্বেষ্টব্যঃ)। তাহার কালে অন্য পণ্ডিতদের রচিত আরও অনেক সংগীতশাস্ত্রের কথা লোচন ইঙ্গিত করিয়াছেন, কিন্তু সে-সব গ্রন্থের একটিও আজ পর্যন্ত আবিষ্কৃত হয় নাই। বস্তুত, লোচনের রাগীতরঙ্গিনী এবং শার্স দেবের সংগীত-রত্নাকরের চেয়ে প্রাচীনতর কোনো সংগীত-গ্রন্থের কথাই আমরা জানি না।

লোচনের রাগীতরঙ্গিনী-গ্রন্থে দেশী ভাষার গানের নমুনা হিসাবে মৈথিলী অপভ্রংশে রচিত শ্ৰীবিদ্যাপতির মৈথিলগীতি উদ্ধার করা হইয়াছে। তাহা ছাড়া, এই গ্রন্থে আমীর খুসরু (ত্ৰয়োদশ শতকের শেষ, চতুর্দশ শতকের গোড়ায়) বা তাহার কিছু পরে প্রচলিত ইমন, ফিরদৌস্তু প্রভৃতি রাগের নাম আছে। সেই হেতু পণ্ডিতেরা অনেকে মনে করেন, লোচনা চতুর্দশ শতকের আগের লোক হইতে পারেন না। কিন্তু আচার্য ক্ষিতিমোহন সেন মহাশয় প্রমাণ করিয়াছেন, লোচনা-পণ্ডিত বল্লালসেনের আমলের লোক ছিলেন এবং ১০৮২ শকাব্দী = ১১৬০ খ্ৰীষ্ট বৎসরে বল্লালসেনের রাজত্বের প্রথম বৎসরে লোচনা-পণ্ডিত রাগীতরঙ্গিনী-গ্ৰন্থ রচনা করিয়াছিলেন; বিদ্যাপতির গান বা ইমন ও ফিরদোস্ত-রাগের কথা প্রভৃতি পরবর্তী কালে এই গ্রন্থে প্রক্ষিপ্ত হইয়াছে। গ্রন্থের পপিক শ্লোকটি সুস্পষ্ট;

ভূজবসুদশমিতশাকে শ্ৰীমদ বল্লালসেনারাজাদৌ।
বর্ষৈকষষ্টিভোগে মুনয়ন্ত্ৰাসন বিশাখায়াম ॥

এই হিসাবে বল্লালসেনের রাজারম্ভে ১০৮২ শকে এই গ্রন্থ সমাপ্ত হইয়াছিল। ১০৮২ শক= ১১৬০ খ্ৰীষ্টাব্দে যে বল্লালসেনের রাজ্যারম্ভের কাল তাহা অন্য স্বাধীন ও স্বতন্ত্র সাক্ষ্য দ্বারাও সমর্থিত। আচার্য ক্ষিতিমোহন সেই সব সংক্ষোরও বিশ্লেষণ করিয়াছেন।

স্বর ও স্বরসংস্থান

গ্রন্থারম্ভেই লোচন স্বরসংস্থান সংজ্ঞার আলোচনা করিয়াছেন। তাহার মতে শুদ্ধ স্বর সাতটি এবং তাহা বাইশটি শ্রীতির মধ্যে যথাস্থনে অধিষ্ঠিত; বিকৃত স্বর হইল শুদ্ধ স্বরের তীব্র বা কোমল রূপ মাত্র; কাজেই শুদ্ধ স্বপ্নেরই দাবি মান্য এবং সাতটি শুদ্ধ স্বরই তিনি ব্যবহার করিয়াছেন। তাহার ব্যবহৃত বিকৃত স্বর হইতেছে কোমল ঋষভ, তীব্রতর গান্ধার, তীব্রতর মধ্যম, কোমল ধৈবত এবং তীব্রতর নিষাধ; বিকৃত স্বরকে তিনি বলিতেছেন কাকলী। পুরবা বা পূরবীতে লোচন নিজে তীব্র ধৈবত ব্যবহার করিয়াছেন। যে সব তালের (চঞ্চৎপুট, চাচপুট ইত্যাদি) কথা তিনি বলিয়াছেন তাহার উল্লেখ বা অভ্যাস পরবর্তীকালে দেখা যাইতেছে না।

জনক ও জন্য-রাগ

লোচনের মতে প্রাচ্যদেশে প্রচলিত রাগ বারোটি মাত্র; ইহাদের প্রত্যেকটিরই নাম ও লক্ষণও তিনি রাখিয়া গিয়াছেন। এই বারোটি রাগই (ভৈরবী, গৌরী (গৌড়ী?), কর্ণাট, কেদার, ইমন, সারঙ্গ, মেঘ, ধানশ্ৰী বা ধনশ্ৰী, টোড়ী, পূর্বা, মুখারী ও দীপক ) জনক-রাগ এবং এই জনক-রাগ কয়টি হইতেই অন্যান্য অনেক রাগের উৎপত্তি— সেগুলি হইতেছে। জন্য-রাগ, যেমন ভৈরবী হইতে দুইটি, কর্ণািট হইতে কুড়িটি, গৌবী হইতে সাতাশটি, ইমন হইতে চারিটি, কেদার হইতে তেরোটি, সারঙ্গ হইতে পাচটি, মেঘ হইতে দশটি, ধনশ্ৰী বা ধানশ্ৰী হইত দুইটি এবং টোড়ী, পূর্ব, মুখারী ও দীপক এই চারিটির প্রত্যেকটি হইতে এক একটি, এই মোট ৮৬টি জন্য-রাগ। পূরবা বা পূর্ব-পূরবী, সন্দেহ নাই; কিন্তু মুখারী রাগ আজ অপ্রচলিত। এই জন্য রাগগুলির লক্ষণ অর্থাৎ আরোহ-অবরোহ সম্বন্ধে লোচন কিছু আলোচনা করেন নাই, অন্যত্র দেখিয়া লইতে বলিয়াছেন।

লোচনের জনক ও জন্য-রাগের প্রকরণটি পড়িলে পরিষ্কার বুঝা যায়, নানা রাগের মিশ্রণে নূতন নূতন রাগ সৃষ্ট হইত; আবার সেই সব মিশ্ররাগের মিশ্রণেও নূতন নূতন সংকর-রাগের উদ্ভব ঘটিত। লোচন তাহা জানিতেন এবং সেই জন্যই তাহার অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রকরণ হইল। সকল দেশে গুণীদের মধ্যে প্রসিদ্ধ যত মিশ্র ও সংকর-রাগ তাহদের নামোল্লেখ এবং তাহাদের জনক-রাগের নির্দেশ।

লোচনের সময়ই বিভিন্ন রাগের ঠাট-কাঠামো লইয়া কিছু কিছু মতভেদ দেখা দিয়াছিল। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, লোচন মনে করিতেন, ভৈরবীতে শুদ্ধ সপ্তস্বর ব্যবহার করাই সঙ্গত; কিন্তু তখনই কেহ কেহ ভৈরবী-রাগে কোমল ধৈবত ব্যবহার করিতেন। লোচন তাহা পছন্দ করিতেন না, কারণ তাহার মতে তাহা অশুদ্ধ এবং যথেষ্ট চিত্তরঞ্জকও নয়। কোন কোন রাগ কখন গাওয়া হইবে সে-সম্বন্ধেও কিছু কিছু মতভেদ দাঁড়াইয়া গিয়াছিল; লোচন তাহা আলোচনা করিতে গিয়া তুম্বুরু নাটক-গ্রন্থের মতামত উদ্ধার করিয়া তাঁহাই সমর্থনা করিয়াছেন।

শ্ৰীকৃষ্ণকীর্তনের রাগ ও তাল

চর্যাগীতি-লোচন-জয়দেবের পর বহুদিন বাঙলাদেশে প্রচলিত মার্গবদ্ধ রাগ-রাগিণীগুলির পরিচয় আর পাইতেছি না। প্রায় আড়াইশ’ তিন-শ বৎসর পর বড়ু চণ্ডীদাস-বিরচিত শ্ৰীকৃষ্ণকীর্তনের পদগুলি যে-সব রাগে ও তালে গাওয়া হইত তাহার সুবিস্তৃত উল্লেখ পাওয়া যাইতেছে গ্রন্থটির পাণ্ডুলিপিতেই। তুলনার সুবিধা হইতে পারে ভাবিয়া রাগগুলির নামোল্লেখ এখানে করিতেছি : কোড়া, কোড়া-দেশাগ, বরাড়ী, দেশ-বরাড়ী, কাকু (কহু)-গুজরী (গুর্জরী) বিভাষ, বিভাষি-কক্‌, বঙ্গাল, বঙ্গাল-বরাড়ী, গুজরী (গুর্জরী), পাহাড়িয়া (নিঃসন্দেহে লোকায়ত রাগ), দেশাগ (দেশাখ), আহের (আহীরী, অর্থাৎ আভীর বা আহীর কোমের লোকায়াত সংগীতের রাগ?) রামগিরি (রামক্রী=রামকেলী), ধানুষী (ধানশ্ৰী), মালব (মালবস্ত্ৰী-মোলশ্রণী—মালসী), বেলাবলী, কেদার, মল্লার, ভাটিয়ালী (নিঃসন্দেহে লোকায়ত সংগীতের রাগ), ললিত, মাহারাঠা (মহারাষ্ট্র-প্রান্তের স্থানীয় লোকায়ত রাগ?), শৌরী (শৌরসেনী, অর্থাৎ শূরসেন অঞ্চলের স্থানীয় লোকায়ত রাগ?) বসন্ত, ভৈরবী, শ্ৰী, সিন্ধোড়া (পরবর্তী হিন্দোলা; গোড়ায় কি সিন্ধু-প্রান্তের স্থানীয় লোকায়ত রাগ?); পঠ (পট) মঞ্জরী। শ্ৰীকৃষ্ণকীর্তনের পদগুলির তাল-মান-লয়ের পরিচয়ও সবিস্তারে পাইতেছি। তালের মধ্যে যতি, একতাল, অষ্টতাল, রূপক, আচুকিক, লঘুশেখর, ক্রীড়া প্রভৃতির সাক্ষাৎ পাওয়া যাইতেছে। রাগের তালিকাটি একটু মনোযোগে বিশ্লেষণ করিলেই দেখা যাইবে, বাঙলাদেশের উচ্চস্তরের গান ভারতের নানা প্রান্তের লোকায়ত সংগীতের সুর ইত্যাদি যেমন স্থান লাভ করিতেছিল, তেমনই ভারতীয় মার্গ সংগীতের সঙ্গেও ক্রমশ লোকয়ত সংগীতে ঘনিষ্ঠতর আত্মীয়তা প্রতিষ্ঠিত হইতেছিল। প্রাচীন বাঙলাদেশেও এই সমন্বয়-ক্রিয়া হইতে বাদ পড়ে নাই, কিংবা উত্তর-ভারতীয় সংগীত-প্রবাহ হইতে কখনও বিচ্ছিন্ন হইয়া থাকে নাই; অন্তত দশম হইতে পঞ্চদশ শতাব্দী পর্যন্ত যে-সব সাক্ষ্য বিদ্যমান তাহাতে এই তথ্য সুস্পষ্ট।

নৃত্য-গীত-বাদ্য

বাদ্যযন্ত্রাদির কথা আগে অন্য প্রসঙ্গে বলিয়াছি; এখানে আর তাহার পুনরুল্লেখ করিয়া লাভ নাই। তবে, নৃত্যগীতবাদ্য সম্বন্ধে চর্যাগীতিতে পটমঞ্জরী রাগে গেয় একটি গান আছে; সেটি উদ্ধার করিতেছি :

সৃজ লাউ সসি লাগেলী তান্তী
অণহা দান্তী চাকি কিঅত অবধূতী।
বাজই আলো সহি হেরুআ বীণা
সূন-তান্তি-ধ্বনি বিলসই রূণা। ধ্রূ।
আলি কালি বেণি সারি সুনিআ
গঅবর সমরাস সান্ধি গুণি আ।
জবে করাহ করাহকলে চাপিউ।।
নাচন্তি বাজিল গাঅন্তি দেবী
বুদ্ধনাটক বিসমা হোই।।

সূর্য লাউ, শশী লাগিল তন্ত্রী, অনাহত দান্তী, অবধূতী হইল চাকী। হে সখি! অনাহত বীণা বাজিতেছে, শূন্য তন্ত্রীর ধ্বনি বিলাসিত হইতেছে ক্ষীণ সুরে। অ-বর্গ ও ক-বৰ্গ দূও শোনা যাইতেছে। সারিকা (বা সপ্তস্বর)। গজবরের সমরাস সন্ধি গোনা হইল। যখন হাতে করভফল চাপা হইল তখন বত্ৰিশ তন্ত্রীর ধ্বনি সকল দিকে বিত হইল। বাজিল (হেবজ্র) নাচিতেছেন, দেবী গাহিতেছেন, বুদ্ধনাটক বিসম হইতেছে।

 

লাউ-এর খোলের সাহায্যে তারের বাদ্যযন্ত্রের প্রচলন, সপ্তস্বর, সুরের বিলাস, বত্রিশটি তার, সনৃত্য গান সমস্তই এই গীতটিতে সুস্পষ্ট। জয়দেব-পত্নী পদ্মাবতীও তো স্বামীর গীতগোবিন্দ গাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তালে তালে নাচিতেন, এমন জনশ্রুতি বিদ্যমান; সেই জনশ্রুতি ষোড়শ শতকের মধ্যভাগে কোচবিহার-রাজা নরনারায়ণের ভ্রাতা শুক্লধ্বজের সভাকবি রাম-সরস্বতী তাহার জয়দেব-কাব্যে স্বীকার করিয়া লইয়াছিলেন।

জয়দেব মাধবীর স্তুতিক বৰ্ণাবে,
পদ্মাবতী আগত নাচন্তু ভঙ্গিভাবে।…
কৃষ্ণর গীতক জয়দেব নিগদতি,
রূপক তালির চেবে পদ্মাবতী।

নৃত্যের নানা লোকায়ত রূপের পরিচয় পাওয়া যায় পাহাড়পুর এবং ময়নামতীতে প্রাপ্ত পোড়ামাটির ফলকগুলিতে; আর উচ্চকোটি-লোকসমাজে যে ধরনের নৃত্য প্রচলিত ছিল তাহার কিছুটা আভাস পাওয়া যায় সমসাময়িক প্রস্তর-ফলকে উৎকীর্ণ নৃত্যপর ও নৃত্যপরা নানা দেবদেবী, অন্সরা গন্ধৰ্ব নারী, মন্দির-নর্তকী প্রভৃতিদের নৃত্যের গতিতে ও ভঙ্গিমায়।