০৭. সংযোজন – দশম শতকের একটি ধর্ম ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান

সংযোজন – দশম শতকের একটি ধর্ম ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান

এই অধ্যায়ের বিষয়বস্তুতে নূতন সংযোজনের প্রয়োজন আছে, এমন অর্থবহ তথ্যের আবিষ্কার ইতিমধ্যে তেমন কিছু হয়নি, একটি মূল্যবান তথ্য ছাড়া। সে-তথ্যটির উল্লেখ করছি একটু পরেই, এবং কিছুটা বিশদভাবেই। এখানে সেখানে দু-একটি নূতন লেখক বা পণ্ডিতের, নূতন দু-একটি গ্রন্থের সংবাদ যে পাওয়া যাচ্ছে না। এমন নয়, তবে তার ইঙ্গিত এমন নয় যে নূতন সংযোজন প্রয়োজন হয়, যেহেতু তাতে তথ্যের পরিমাণ বৃদ্ধি হয় মাত্র, নূতন অর্থ সংযোজিত হয়। না। সুতরাং সে-জাতীয় তথ্য আমি আর উল্লেখ করছি না।

তবে, দশম শতাব্দীর প্রাচীন বাঙলার পূর্বতম একটি প্রান্তের এমন একটি তথ্য ইতিমধ্যে জানা গেছে যা বাঙালীর ইতিহাসের দিক থেকে আমি যথেষ্ট মূল্যবান বলে মনে করি। তথ্যটি জানা যাচ্ছে পুণ্ড্রবর্ধন-বঙ্গ-সমতটাধিপতি চন্দ্ৰবংশীয় পরামসৌগত পরমেশ্বর পরমভট্টারক মহারাজাধিরাজ শ্ৰীচন্দ্রদেবের পঞ্চম রাজ্যান্ধে পট্টীকৃত একটি ভূমিদান-পট্টোলী থেকে। পট্টোলীটি পাওয়া গেছে শ্ৰীহট্ট জেলার পশ্চিমভাগ গ্রাম থেকে; সেজন্য পট্টোলীটি পশ্চিমভাগ-পট্টোলী বলে খ্যাত হয়েছে।

এই পট্টোলীদ্বারা শ্ৰীচন্দ্ৰ পুণ্ড্রবর্ধনভূক্তির অন্তর্গত শ্ৰীহট্টমণ্ডলে গরলা, পোগার এবং চন্দ্রপুর বিষয়ে দুই প্রন্থে দু’টি বিস্তৃত ভূমিখণ্ড দান করেছিলেন, প্রথম প্রস্থে ১২০ পাটক, দ্বিতীয় প্রস্থে ২৮০ পাটক। এই বিস্তৃত দুই ভূমিখণ্ড দানের পরও আরও একটি বিস্তৃত ভূমিখণ্ড দান করা হয়েছিল চতুশ্চরণ শাখাধ্যায়ী (চার বেদের বিভিন্ন শাখার ছাত্র ও অধ্যাপক), বিভিন্ন গোত্র ও প্রবর পরিচয়ের ৬০০০ ব্রাহ্মণকে, প্রত্যেককে সম পরিমাণে। তৃতীয় প্রস্থের সমগ্র ভূমিখণ্ডটির পরিমাণ কত তা কোথাও বলা হয়নি। কিন্তু তা না হলেও, অনুমান করা যেতে পারে, সপরিবারে শুধু বসবাস করবার জন্য প্রত্যেকটি ব্রাহ্মণ গৃহস্থের যে নূ্যনতম পরিমাণ ভূমির প্রয়োজন হতে পারে তার ছ-হাজারগুণ ভূমিপরিমাণ স্বল্পায়তন কিছু নয়। তিনটি বিষয়-জোড়া তিনপ্রস্থ এই সুবিস্তৃত ভূমির উত্তরে ছিল কোসিয়ার নদী (–বর্তমান কুসিয়ারা), দক্ষিণে মণি নদী (=বর্তমান মনু নদী), পূর্বে বৃহৎকোট্ট বাধ (কোন সীমা বোঝাচ্ছে বলবার উপায় নেই) এবং পশ্চিম জুৰ্জ্জু ও কণ্ঠপণী খাল (জুজু-বর্তমান ঝর্ণা জুজনংছাড়া; কাষ্ঠপণী যে কোনও খাল বা ছড়া, অর্থাৎ ঋণা, বলবার উপায় নেই) ও বেত্ৰিঘষ্ট্ৰী নদী (=বর্তমান খুঙ্খী নদী)। এই সুনির্দিষ্ট চতুঃসীমা বেষ্টিত ভূমিতে রাজা শ্ৰীচন্দ্ৰ শ্ৰীচন্দ্রপুর নামে একটি সুবৃহৎ “ব্রহ্মপুত্র”, অর্থাৎ ব্রাহ্মণ্যাদর্শনুযায়ী একটি আদর্শ ঔপনিবেশিক ধর্ম-সংস্থান সৃষ্টি করেছিলেন। তিন প্রস্থে সুবিস্তীর্ণ ভূমিদানের উদ্দেশ্যই ছিল এই ব্ৰহ্মপুরাণপ্ৰতিষ্ঠা। কিভাবে এই প্রতিষ্ঠা ক্রিয়া হয়েছিল তা এই ভূমিদানের বিবরণের মধ্যেই পাওয়া যাবে।

আর্যীকরণ, তথা ব্ৰাহ্মণীকরণের ক্রিয়াকৌশল (method and technique) ভারতেতিহাসের বুদ্ধি ও চক্ষুষ্মাণ পণ্ডিত ও পাঠকমাত্রেরই সুপরিজ্ঞাত। সে জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা মনের পশ্চাতে রেখে পশ্চিমভাগ পট্টোলীর সমৃদ্ধ তথ্যাবলীর দিকে তাকালে বুঝতে বিলম্ব হয় না যে, এ ধরনের ঘনসন্নিবদ্ধ সুবিস্তীর্ণ ব্ৰাহ্মণ বসতির প্রয়োজন হয়েছিল এই জন্যেই যে, এই অঞ্চলটিতে ব্ৰাহ্মণ ও ব্ৰাহ্মণ্য সংস্কৃতির প্রচলন তেমন ছিল না, অন্তত প্রভাব বিস্তার করিবার মতো যথেষ্ট ছিল না। এ অনুমান যে কল্পনা নয় তা এই তিন প্রস্থ ভূমির দান-বিবরণের মধ্যেই আছে। পূর্ব-ভারতের পূর্বতম একটি প্রান্তে দশম শতাব্দীর তদবধি অ-ব্রাহ্মণীকৃত এক বিস্তৃত অঞ্চলে ব্রাহ্মণীকরণের, অন্যার্থে সমসাময়িক ভারতীয় সংস্কৃতির সীমা-বিস্তারের চেষ্টা কিভাবে অগ্রসর হচ্ছে, এই তাম্রপট্টোলীটি তার একটি অন্যতম প্রকৃষ্ট সাক্ষ্য। একই শ্ৰীহট্ট অঞ্চলে (পঞ্চখণ্ডে) এবং রংপুর অঞ্চলে এর প্রথম প্রমাণ দেখা গিয়েছিল সপ্তম শতাব্দীর প্রথমার্ধে ভাস্করবর্মর নিধনপুর তাম্রশাসনে। এই লিপিতে দেখা যাচ্ছে চন্দ্রপুরী বিষয়ের ময়ুরুশাল্মল অগ্রহারে ভাস্করবর্মার বৃদ্ধপ্রপিতামহ ভূতিবৰ্মা (ষষ্ঠ শতাব্দীর প্রথম পাদ) ভিন্ন ভিন্ন বেদের ৫৬টি বিভিন্ন গোত্রীয় অন্তত ২০৫ জন ‘বৈদিক’ বা ‘সাম্প্রদায়িক’ ব্ৰাহ্মণের বসতি করিয়েছিলেন। কিন্তু পশ্চিমভাগ পট্টোলীতে দেখা যাচ্ছে, দু-চারশ’ নয়, ছ-হাজার ব্রাহ্মণ বসানো হচ্ছে এবং চার-চারটি মঠকে কেন্দ্র করে, যে মঠ শুধু বিভিন্ন দেবদেবীর পূজা-আরাধনার জন্য নয়, সেখানে নানা ব্ৰাহ্মণ্য বিদ্যা ও জ্ঞানবিজ্ঞানের চর্চার জন্যও।

প্রথম প্রস্থ ১২০ পাটক ভূমি দেওয়া হয়েছিল দেবতা ব্ৰহ্মা ও তার পূজাগৃহ একটি মঠের উদ্দেশে। ব্ৰহ্মার মঠ ও তার একক পূজার প্রচলন প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় ভারতবর্ষে বড় একটা দেখা যায় না; সুতরাং পূর্বভারতের পূর্বতম প্রান্তে দশম শতকে ব্ৰহ্মার একটি মঠ ইতিহাসের দিক থেকে কৌতুহলোদ্দীপক সন্দেহ নেই। এই মঠ প্রতিষ্ঠা, পোষণ ও পরিচালনার জন্য যো-পরিমাণ ভূমির প্রয়োজন তা বাদ দিয়ে ১২০ পাটকের বাকি ভূমি দান করা হয়েছিল নিম্নোক্ত ভাবে। প্রতি পাটকে দশদ্রোণ হিসেবে ১০ পাটক দেওয়া হয়েছিল জনৈক (ব্রাহ্মণ) অধ্যাপককে, চন্দ্ৰগোমিনের চান্দ্ৰ ব্যাকরণ সম্বন্ধে অধ্যাপনা করবার জন্য : ১০ পাটক ১০ জন বিদ্যার্থীর ভরণ-পোষণ ও লেখ-গুটিকার (খড়িমাটির পেন্সিল) ব্যয় নির্বাহের জন্য; ৫ পাটক প্রতিদিন ৫ জন অতিথি-সেবার জন্য; এক পাটক সেই ব্ৰাহ্মণের জন্য যিনি এই মঠ নির্মাণ করিয়েছিলেন; এই পাটক মঠসংলগ্ন গণকের জন্য; ২*পাটক মঠের কায়স্থ বা হিসাব রক্ষকের জন্য; ৪ জন ফুলওয়ালা বা ফুলমালী, ২ জন তৈলক, ২ জন কুম্ভকার, ৫ জন কাহলিক অর্থাৎ কহল বা (ছোট) ঢাকবাদক, ২ জন শঙ্খবাদক, ২ জন বৃহৎ ঢাক্কা বা ঢাকবাদক; ৮ জন প্রাগড়াবাদক (দ্রগড় এক ধরনের ঘনবাদ্য) ও ২২ জন কর্মকার (ভূত্য) ও চর্মকার, এদের প্রত্যেককে ঐ পাটক হিসেবে একুনে ২৩২ পাটক; ২ পাটক মঠ-নটের জন্য; ২ জন সূত্রধর, ২ জন স্থপতি, ২ জন কর্মকার, প্রত্যেকের ২ পাটক হিসেবে, মোট ১২ পাটক; ৮ জন চেটিকা (এরা কি দেবদাসী, না দাসী বা সেবিকামাত্র?), প্রত্যেককে ঐ পাটক হিসেবে মোট ৬ পাটক; এবং মঠের নবকর্ম বা নিয়মিত সংস্কারব্যয় নির্বাহের জন্য ৪৭ পাটক। অর্থাৎ মঠ এবং মঠশ্রিত যাবতীয় কর্মনির্বাহের জন্য মোট ১২০ পাটক।

দ্বিতীয় প্রস্থ ২৮০। পাটক ভূমি দেওয়া হয়েছিল আটটি পৃথক পৃথক মঠের জন্য; চারটি দেশান্তরী (অর্থাৎ অ-বাঙ্গাল ব্রাহ্মণ, পূজক ও ভক্তদের জন্য, আর বাকি চারটি বঙ্গাল (ব্রাহ্মণ, পূজক ও ভক্ত)-দের জন্য; প্রথম চারটির নাম দেশান্তরী (অর্থাৎ বিদেশীয়) মঠ; শেষের চারটির, বঙ্গাল মঠ। দুই প্রস্থ মঠেই এক এক জন করে যে-চারজন দেবতা প্রতিষ্টিত তারা হচ্ছেন বৈশ্বােনর বা অগ্নি, যোগেশ্বর শিব, জৈমিনি বা জৈমিনি এবং মহাকাল শিব। স্বাধীনভাবে একক বৈশ্বিানর বা অগ্নির পূজা ও তার জন্য মন্দির প্রতিষ্ঠা একটু বিস্ময়কর, যেহেতু এই ধরনের অগ্নিপূজা ও অগ্নিমন্দির বড়ই বিরল, প্রায় নেই বললেই চলে। তার চেয়েও বিস্ময়কর পূর্ব-মীমাংসা দর্শনের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রবক্তা জৈমিনির দেবত্বে উওরণ; ভারতবর্ষে জৈমিনির মঠ বা মন্দির আর কোথাও আছে বলে আমার জানা নেই। কিন্তু সবচেয়ে বিস্ময়কর ব্যাপার, প্রত্যেকটি দেবতার দুটি করে মঠ, একটি বিদেশীদের, একটি বঙ্গলদের! এই দুই দলের মধ্যে কি কলহ, বাদ-বিসম্বাদ, রেষারেষি কিছু ছিল? ছিল বলেই তো মনে হয়, কিন্তু কেন ছিল? পূজার রীতিনিয়ম পদ্ধতির কি পার্থক্য ছিল? যে দেশান্তরীয়দের কথা ইঙ্গিত করা হচ্ছে তারা কারা, কোথা থেকে এলেন, কী:করে এবং কেন এলেন শ্ৰীহট্ট অঞ্চলে? শ্ৰীচন্দ্ৰই কি এদের নিয়ে এসে বসবাস করিয়েছিলেন? শ্ৰীচন্দ্রের পিতা ত্ৰৈলোক্যচন্দ্ৰ বঙ্গালদেশের অধিপতি ছিলেন, চন্দ্ৰদ্বীপে ছিল তার রাজধানী। শ্ৰীচন্দ্ৰ যদিও তার পঞ্চম রাজ্যাঙ্কের আগেই কোনও সময় চন্দ্ৰদ্বীপ থেকে রাজধানী তুলে নিয়ে এসেছিলেন বঙ্গে, বিক্রমপুরে, তা হলেও তিনি নিজে যথার্থত বঙ্গাল। সেই বঙ্গলদের সঙ্গে দেশাস্তুরীয়দের এমন কী বিরোধ ছিল যার ফলে তারই দত্ত ভূমিতে, ব্ৰহ্মপুত্ৰ-শ্ৰীচন্দ্রপুরে, একই দেবতা-চতুষ্টয়ের স্থান করতে হলো দুই প্রস্থ মন্দির-চতুষ্টয়ে, দুই ভিন্ন নামে চিহ্নিত করে? ব্যাপারটা শুধু কৌতুহলোদ্দীপক নয়, ইতিহাসের দিক থেকে একটি প্রশ্নচিহ্নও বটে।

যাই হোক, ২৮০ পাটক ভূমি সম পরিমাণে, অর্থাৎ ১৪০ পাটক করে, ভাগ করে দেওয়া হয়েছিল দুই প্রস্থ মন্দির-চতুষ্টয়ের মধ্যে, অন্যার্থে প্রত্যেকটি মন্দিরের ভাগে পড়েছিল ৩৫ পাটক করে। বিস্তৃত ভূমিখণ্ডদানের তালিকা এইভাবে দেওয়া হয়েছে : চতুৰ্বেদ অধ্যাপনার জন্য ৮ জন অধ্যাপকের প্রত্যেককে ১০ পাটক করে, মোট ৮০ পাটক; প্রত্যেকটি মঠে ৫ জন করে, অর্থাৎ ৮টি মঠে ৪০ জন ছাত্রের ভরণ-পোষণ ও শিক্ষার জন্য প্রতি ছাত্ৰ পিছু ১ পাটক হিসেবে মোট ৪০ পাটক; প্রত্যেকটি মঠের একজন ফুলমালী, একজন ক্ষীেরকার, একজন তৈলক ও একজন রাজক এবং ৮ জন ভৃত্য বা সেবক ও চর্মকার, প্রত্যেককে ঐ পাটক হিসেবে, অর্থাৎ মোট ১৬+৩২-৪৮ পাটক; প্রত্যেকটি মঠের দুজন সেবিকা, প্রত্যেককে ঐ পাটক হিসেবে, মোট ১২ পাটক; প্রত্যেক মন্দির-চতুষ্টয়ের দুজন মহত্তর-ব্রাহ্মণ, প্রত্যেককে ১ পাটক হিসেবে, মোট ৪ পাটক; প্রত্যেক মন্দির-চতুষ্টয়ের একজন আবেক্ষক (superintendent), প্রত্যেককে ১: পাটক হিসেবে, মোট ৩ পাটক; প্রত্যেক মন্দির চতুষ্টয়ের একজন কায়স্থ বা লেখক, প্রত্যেককে ২২ পাটক হিসেবে, মোট ৫ পাটক; প্রত্যেক মন্দির-চতুষ্টয়ের একজন গণক, প্রত্যেককে ১ পাটক হিসেবে, মোট ২ পাটক; এবং প্রত্যেক মন্দির-চতুষ্টয়ের একজন চিকিৎসক, প্রত্যেককে ৩ পাটক হিসেবে, মোট ৬ পাটক; সর্বমোট ২৮০ পাটক।

আগেই বলা হয়েছে, তৃতীয় প্রস্থ ভূমি দান করা হয়েছিল ছ-হাজার ব্রাহ্মণকে, প্রত্যেককে সম পরিমাণে। এই ছ-হাজারের ভেতর ৩৫ জন ব্ৰাহ্মণ প্রমুখের নাম দেওয়া আছে; ঐদের মধ্যে কয়েকজনের নামের শেষাংশ বা অন্তঃনাম (পদবী নয়) নাগ, দত্ত, নন্দী, পাল, ধর, ঘোষ, দাস, সোম, গুপ্ত, কর ইত্যাদি দেখে মনে হয়, এই ধরনের শেষাংশ থেকেই বোধ হয়। পরবর্তীকালে অব্রাহ্মণ বাঙালীদের, বিশেষ করে কায়স্থ ও বৈদ্যদের, পদবীগুলোর সূচনা হয়ে থাকবে।

কিন্তু সে যাইহোক, এই পট্টোলী থেকে এমন তথ্য পাওয়া গেল। যা প্রাচীন বাঙলার ধর্ম ও সমাজ এবং শিক্ষা-দীক্ষার উপর নূতন আলোকপাত করেছে। ব্ৰহ্মা ও অগ্নি স্বাধীন স্বতন্ত্র পূজা ও মঠ, জৈমনি বা জৈমিনির দেবত্ব, পূজা ও মঠ ধর্মের দিক থেকে নূতন সংবাদ। শ্ৰীহট্ট অঞ্চলে দশম শতকে ব্ৰাহ্মণদের সুবৃহৎ উপনিবেশ স্থাপন সমাজেতিহাসের দিক থেকে গভীর অর্থবহ। দেশান্তরীয় ও বঙ্গলদের জন্য পৃথক পৃথক মঠ প্রতিষ্ঠাও কম অর্থবহ নয়। শিক্ষার দিক থেকে দেখতে পাচ্ছি, দশম শতাব্দীতে শ্ৰীহট্টে চন্দ্ৰগোমিনের চান্দ্র-ব্যাকরণের প্রচলন ও চতুৰ্ব্বেদের অধ্যয়ন ও অধ্যাপনা। কিন্তু সবচেয়ে যা অর্থবহ তা হচ্ছে ব্ৰহ্মপুর শ্ৰীচন্দ্রপুরের মতন একটি সুবৃহৎ ধর্ম ও শিক্ষাকেন্দ্রের প্রতিষ্ঠা।

পশ্চিমভাগ পট্টোলীর পূর্ণমৃলো পাঠোদ্ধার ও যথার্থ ব্যাখ্যা করেছেন অধ্যাপক দীনেশচন্দ্র সরকার। দীনেশচন্দ্র বলেছেন, এ-ধরনের সুবিস্তীর্ণ, সুবৃহৎ ব্রাহ্মণ্য ধর্ম ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উল্লেখ লিপিমালায় আর পাওয়া যায় না; উত্তর-ভারতে আর কোথাও এ-ধরনের প্রতিষ্ঠান ছিল বলে আজও জানা যায়নি। আছে শুধু দক্ষিণ-ভারতে, যেমন, অন্ধুপ্রদেশে তিরুমালয়-তিরুপতির শ্ৰীবেংকটেশ্বর দেবস্থানে। দক্ষিণ-ভারতের একাধিক লিপিতেও যে এই ধরনের ধর্ম ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উল্লেখ আছে, দীনেশচন্দ্ৰই তা দেখিয়েছেন। তার পাঠোদ্ধার, বর্ণনা ও ব্যাখ্যার উপরই আমার উপরোক্ত বিশ্লেষণের নির্ভর। আমি তার সঙ্গে সম্পূর্ণ সহমত এবং তার প্রতি আমি গভীর কৃতজ্ঞ।

পাঠ্যপঞ্জি ll Sircar, D.C., Epigraphic Discoveries in East Pakistan, Calcutta, 1973, pp. 19-40.