০৬. সেন-বর্মণ পর্ব

সেন-বর্মণ পর্ব

দ্বাদশ শতকের সেন-বৰ্মণ পর্ব বাঙলাদেশে সংস্কৃত সাহিত্যের সুবর্ণযুগ। সেনা-বর্মণ রাজ বংশের সঙ্গে সঙ্গেই বাঙলার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আবহাওয়া ধীরে ধীরে বদলাইতে আরম্ভ করে। এই দুই রাজবংশই বৈদিক ও পৌরাণিক ব্ৰাহ্মণ্যধর্মের পরম পৃষ্ঠপোষক, এবং ব্রাহ্মণ্যধর্মের স্মৃতি ও সংস্কারানুযায়ী সমাজ পুনর্গঠনের প্রয়াসী। এই প্ৰয়াসের স্বাভাবিক প্রকাশ হইবে সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যের পোষকতা, ব্ৰাহ্মণ্য স্মৃতিগ্ৰস্থাদির অধিকতর আলোচনা ও রচনা, ব্রাহ্মণ। জ্ঞান-বিজ্ঞানের অধিকতর প্রচার, ব্ৰাহ্মণ্য ধর্ম ও জীবনাদর্শের অধিকতর প্রসার, ইহাতে আশ্চর্য হইবার কিছু নাই। এই পর্বে বৌদ্ধ জ্ঞান-বিজ্ঞান, বৌদ্ধ তান্ত্রিক ধর্ম ও জীবনাদর্শ অনাদৃত; অন্তত রাষ্ট্রের এবং সমাজের প্রতাপবান এবং সমৃদ্ধ উচ্চতর বর্ণ ও শ্রেণীর সক্রিয় পোষকতা ইহাদের পশ্চাতে আর নাই। সংঘ-বিহার ইত্যাদি ছিল না, বা এখানে সেখানে বৌদ্ধ ও অন্যান্য অবৈদিক ও অপৌরাণিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের বা শিক্ষা-দীক্ষার চর্চা আর হইত না, তাহা নয়, কিন্তু যাহা যতটুকু হইত। তাহার পরিধি সংকুচিত হইয়া গিয়াছিল, সন্দেহ নাই, এবং সমস্ত চর্চা ও চর্য একান্ত ভাবেই সংকীর্ণ ধর্মগোষ্ঠীর মধ্যে আবদ্ধ হইয়া পড়িয়াছিল। তাহা ছাড়া, এই সব বিভিন্ন ধর্মগোষ্ঠীগুলির প্রভাব ক্রমশই সমাজের অপেক্ষাকৃত নিম্নতর স্তরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ হইয়া পড়িতেছিল। পাল-বংশের শেষ অধ্যায় হইতেই সমাজ ও সংস্কৃতির এই গতি ধীরে ধীরে ধরা পড়িতেছিল; সেনা-বর্মণ বংশ সুপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাহার বেগ বাড়িয়াই গেল। প্রাকৃতধর্মী৷ ‘বৌদ্ধ সংস্কৃত, সৃজ্যমান প্রাচীনতম বাঙলা এবং শৌরসেনী অপভ্রংশের গৌড়-বঙ্গীয় রূপের চর্চা যাহা ছিল তাহা সাধারণত বৌদ্ধ তান্ত্রিক সমাজের মধ্যেই এবং লোকায়াত স্তরের স্বল্পসংখ্যক ব্ৰাহ্মণ্য সম্প্রদায়ের লোকদের মধ্যেই আবদ্ধ ছিল বলিয়া মনে হয়।

এই পর্বে ব্ৰাহ্মণ্য ধর্ম ও সংস্কৃত সাহিত্যের পুনরভ্যুত্থান শুধু যে বাঙলাদেশেই আবদ্ধ ছিল তাহা নয়। সমগ্র উত্তর, মধ্য ও পশ্চিম ভারতবর্ষ জুড়িয়াই তখন নূতনতর এক ব্ৰাহ্মণ্য দৃষ্টির এবং সৃষ্টির তরঙ্গ বহিয়া চলিয়াছে–কাশ্মীরে, কল্যাণে (মহারাষ্ট্র), কলিঙ্গে, কনৌজে, ধারায়, মিথিলায়। এই একই ব্ৰাহ্মণ্য তরঙ্গ বাঙলাদেশেও বহিয়া আসে নাই, তাহা কে বলিবে? কিন্তু লক্ষণীয় এই যে, এই পর্বের বাঙলায় সমস্ত গ্ৰন্থ-রচনাই তিনটি রাজার রাজত্বকালে– হরিবর্মা, বল্লালসেন, লক্ষ্মণসেন, এবং সমস্ত গ্ৰন্থই প্ৰায় হয় জ্যোতিষ-মীমাংসা ধৰ্মশাস্ত্র-স্মৃতিশাস্ত্র, অর্থাৎ ব্ৰাহ্মণ্য আচার-আচরণ সম্পর্কিত, অথবা কাব্যনাটক, এবং সে কাব্য-নাটকও চিরাচরিত রীতি অনুযায়ী এবং ব্রাহ্মণ্য-ঐতিহ্যে ভরপুর। ব্যাকরণে, ন্যায় বৈশেষিক দর্শনে, বৌদ্ধ বিজ্ঞানবাদের আলোচনায়, তান্ত্রিক দর্শনে, নূতন সাহিত্যরীতির প্রবর্তন ও প্রচলনে যে-বাঙলাদেশ গুপ্তোত্তর ও পালপর্বে প্রায় সর্বভারতীয় খ্যাতি অর্জন করিয়াছিল, এই পর্বে সে-সব দিকে কোনো উল্লেখযোগ্য চেষ্টাও যে ছিল, এমন নিদর্শন পাওয়া যাইতেছে না। এই তথ্যের মধ্যে ইতিহাসের যে-ইঙ্গিত নিহিত তাহা অন্য প্রসঙ্গে একাধিকবার ধরিতে চেষ্টা করিয়াছি; এখানে পুনরুল্লেখ নিম্প্রয়োজন। আসল কথা, এই পর্বে বাঙালীর মনন ও অন্বেষণের স্রোতে ভঁটা পড়িয়া গিয়াছিল, গভীরতর এবং বহুমুখী জ্ঞানসাধনা আর ছিল না, স্বাধীন চর্চার ক্ষেত্রে স্বকীয়ত্ব প্রায় নষ্ট হইয়া গিয়াছিল। একমাত্র কবিকল্পনার ক্ষেত্রে কিছুটা সরস প্রাণপ্রবাহ ত্ৰয়োদশ শতকের প্রথম পাদ পর্যন্তও অব্যাহত ছিল, কিন্তু সে-প্রাণেরও বিস্তার বা গভীরতা স্বল্প। গীতগোবিন্দের মতো কাব্যও যথার্থত স্বল্পপ্রাণ; তাঁহার মাধুর্য আছে, শক্তি নাই; সুর আছে, তেজ নাই; দাহ আছে, দীপ্তি নাই।

মীমাংসা, ধর্মশাস্ত্ৰ, স্মৃতিশাস্ত্ৰ, ব্ৰাহ্মণ্য বিধি-বিধান

গৌড় মীমাংসক সম্বন্ধে উদয়ন ও গঙ্গেশ-উপাধ্যায় যে উক্তিই করিয়া থাকুন না কেন বাঙলাদেশে যে মীমাংসার চর্চা হইত। তাহার লিপি প্রমাণ বিদ্যমান। তাহা ছাড়া অনিরুদ্ধ ও ভবদেব-ভট্ট এই দুইজনই ছিলেন মীমাংসা-শাস্ত্ৰে সুপণ্ডিত: তাহারা দুইজনই কুমারিল-ভট্টের মীমাংসা সম্বন্ধীয় মতামতের সঙ্গে সুপরিচিত। হল্যায়ুধও বলিতেছেন, বাঙলাদেশে বৈদিক শাস্ত্রাদির আলোচনা হইত না বটে, কিন্তু মীমাংসার চর্চা ছিল। কিন্তু তাহা থাকিলেও এই পর্বে রচিত মীমাংসাশাস্ত্রের মাত্র দুটি গ্রন্থের খবর আমরা জানি। একটি ভবদেব-ভট্টকৃত তৌতান্তিতমততিলক, অর্থাৎ তোতাতিত বা কুমারিল-ভট্টের তন্ত্র-বার্তিক গ্রন্থের টীকা, আর একটি হলায়ুধের মীমাংসা সর্বস্ব। শেষোক্ত গ্রন্থটি বিলুপ্ত; আর, তৌতাতিতমততিলক-পূর্বমীমাংসাসূত্রের একাংশের মাত্র টীকা।

ভবদেব ভট্ট

এই পর্বে ধর্মশাস্ত্রের প্রসিদ্ধতম লেখক হইতেছেন বালবলভী ভূজঙ্গ (বালবলভী নামক নগরের নাগরিক), রাঢ়ন্তের্গত সিদ্ধলগ্রামবাসী , সামবেদীয় কৌঠমশাখাধ্যায়ী, সাবর্ণগোত্রীয় ব্ৰাহ্মণ ভট্ট-ভবদেব। তাঁহার এক পূর্বপুরুষ জনৈক অনুল্লিখিতনাম গৌড়রাজের নিকট হইতে হস্তিনীভিট্ট নামক গ্রাম শাসনস্বরূপ পাইয়াছিলেন; তাহার পিতামহ আদিদেব জনৈক বঙ্গরাজের সন্ধিবিগ্রহিক ছিলেন; পিতার নাম ছিল গোবর্ধন; মাতা সাঙ্গোকা ছিলেন জনৈক বন্দ্যঘটীয় ব্রাহ্মণের কন্যা। ভবদেব নিজে বর্মণরাজ হরিবর্মা এবং সম্ভবত তাঁহার পুত্রেরও মহাসন্ধিবিগ্রহিক-মন্ত্রী ছিলেন। শিক্ষিত অভিজাত পরিবারে জন্মগ্রহণ করিয়া ভবদেব রাষ্ট্ৰীয় প্রভুত্বেরও অধিকারী হইয়াছিলেন, ধর্মাচরণোদেশে অনেক দীঘি ও মন্দির নির্মাণ করাইয়াছিলেন, কিন্তু তাহার চেয়েও উল্লেখযোগা এই যে, সমসাময়িক কালে তাঁহার চেয়ে যুগন্ধর শাস্ত্ৰজ্ঞ পণ্ডিত আর কেহ ছিলেন না। তিনি ছিলেন ব্ৰহ্মাদ্বৈত দর্শনের প্রসিদ্ধ ব্যাখ্যাতা, কুমারিল-ভুট্রের মীমাংসা বিষয়ক মতামতের সঙ্গে সুপরিচিত, বৌদ্ধদের পরম শত্রু এবং পাষণ্ড বৈতণ্ডিকদের তর্কখণ্ডনে পটু, অর্থশাস্ত্ৰে সুপণ্ডিত, আয়ুর্বেদ-অস্ত্ৰবেদ-তন্ত্র গণিত্ব সিদ্ধান্তে সুদক্ষ, জ্যোতিষে ফলসংহিতায় দ্বিতীয় বরাহ। বাচস্পতি-রচিত- ভবদেব-প্রশস্তিতে বলা হইয়াছে যে, তিনি হোরাশাস্ত্র এবং ধর্মশাস্ত্ৰ সম্বন্ধে এক একখানা গ্ৰন্থ রচনা করিয়াছিলেন, এবং ভট্রোক্ত (অর্থাৎ কুমারিলোপ্ত) নীতি অনুসরণ করিয়া এক সহস্ৰ নায়ে মীমাংসা সম্বন্ধীয় আরও একটি গ্রন্থ লিখিয়াছিলেন।

ভবদেব রচিত হোরাশাস্ত্রের কোনো পুঁথি আজও পাওয়া যায় নাই। মীমাংসা সম্বন্ধীয় গ্রন্থটি পূর্বোক্ত তৌততিতমততিলক, সন্দেহ নাই। ধর্মশাস্ত্র সম্বন্ধে তিনি একাধিক গ্ৰন্থ রচনা করিয়াছিলেন; ব্যবহার, প্ৰায়শ্চিত্ত এবং আচার সম্বন্ধে অন্তত তিনখানা গ্রন্থের সংবাদ এ-পর্যন্ত জানা গিয়েছে— ব্যবহারতিলক, প্ৰায়শ্চিত্তপ্রকরণ (বা প্ৰায়শ্চিন্তু নিরূপণ), এবং ছান্দোগ্যকর্মানুষ্ঠান পদ্ধতি (বা দশকর্মপদ্ধতি বা সংস্কার-পদ্ধতি বা দশকর্মদীপিকা)। ব্যবহারতিলক-গ্রন্থের কোনো পুঁথি আজও পাওয়া যায় নাই, তবে রঘুনন্দন, মিত্ৰমিশ্র এবং বর্ধমান প্রভৃতি পরবর্তী স্মৃতিকর্তারা এই গ্রন্থের নানা মতামত উদ্ধার করিয়াছেন তাঁহাদের রচনায়। প্ৰায়শ্চিত্ত-প্রকরণ-গ্রন্থে ভবদেব প্রায় ষাট জন পূর্বগামীদের মতামত উদ্ধার করিয়া ছয় প্রকারের অপরাধ ও তাহার প্রায়শ্চিত্ত সম্বন্ধে বিস্তৃত আলোচনা করিয়াছেন। এই গ্রন্থ বাঙলাদেশে এবং বাঙলাদেশের বাহিরে প্রভূত প্রতিষ্ঠা অর্জন করিয়াছিল; পরবর্তীকালের বেদাচাৰ্য, নারায়ণভট্ট এবং গোবিন্দানন্দ প্রভৃতি প্ৰসিদ্ধ ধর্মশাস্ত্ৰ-রচয়িতারাও ভািবদেবের মতামত উদ্ধার ও আলোচনা করিয়াছেন। ছন্দোগ্য-কর্মানুষ্ঠানপদ্ধতি সামবেদীয় দ্বিজবর্ণের সংস্কার ‘সম্বন্ধীয় গ্রন্থ; গর্ভাধান, পুংসবন, সীমাস্তোন্নয়ন হইতে আরম্ভ করিয়া ষোলো প্রকারের সংস্কারের আলোচনা এই গ্রন্থে আছে।

জীমূতবাহন

ধর্মশাস্ত্র রচয়িতাদের মধ্যে ভবদেব-ভট্টের পরেই নাম করিতে হয় পারিভদ্রীয় (পরিভদ্র-কুলজাত; বোধ হয়। রাঢ়ীয় পারিহাল বা পারি-গাঞী) মহামহোপাধ্যায় জীমূতবাহনের। তাহার বাড়ি ছিল খুব সম্ভব রাঢ়দেশে। জীমূতবাহনের কাল লইয়া পণ্ডিতদের মধ্যে মতভেদ বিস্তর। তিনি রাজা ভোজ এবং গোবিন্দরাজের নাম করিয়াছেন এবং শকাব্দ ১০১৪-১০৯২ খ্রীষ্ট বৎসরের উল্লেখ করিয়াছেন; কাজেই তাহার,কাল একাদশ শতকের আগে হওয়া কিছুতেই সম্ভব নয়। অন্যদিকে বাচস্পতি মিশ্র, শূলপাণি ও রঘুনন্দন তিন জনাই জীমূতবাহনের গ্রন্থাদি হইতে মতামত উদ্ধার ও আলোচনা করিয়াছেন; কাজেই তাঁহার কাল চতুর্দশ-পঞ্চদশ শতকের পরেও হইতে পারে না। খুব সম্ভব তিনি দ্বাদশ-ত্রয়োদশ শতকে জীবিত ছিলেন। জীমূতবাহন। অন্তত তিনখানা গ্রন্থ রচনা করিয়াছিলেন- কালবিবেক, ব্যবহারমাতৃকা এবং দায়ভাগ। কালবিবেক-গ্ৰন্থ ব্ৰাহ্মণ্য ধর্মের নানা পূজানুষ্ঠান শুভকর্ম, আচার, ধর্মোৎসব প্রভৃতি পালনের শুভাশুভ কাল, সৌরমাস, চান্দ্রমাস প্রভৃতি সম্বন্ধে আলোচনা। এ-সম্বন্ধে জীমূতবাহন পূর্ববতী অসংখ্য লেখকের রচনা উদ্ধার ও আলোচনা করিয়া নিজের মতামত ও যুক্তি প্ৰতিষ্ঠা করিয়াছেন। এ-গ্ৰন্থ সমসাময়িক কালে প্রভূত সমাদর লাভ করিয়াছিল, এবং রঘুনন্দন, শূলপাণি, বাচস্পতি, গোবিন্দানন্দ প্রভৃতি সকলেই সশ্রদ্ধভাবে তাহার যুক্তি ও মতামত উদ্ধার ও স্বীকার করিয়াছেন। ব্যবহারমাতৃকা-গ্রন্থ ব্ৰাহ্মণ্যদর্শনুযায়ী বিচারপদ্ধতির আলোচনা; গ্রন্থের পাঁচটি বিভাগ : ব্যবহারমুখ, ভাষাপাদ, উত্তরপাদ, ক্রিয়াপদ এবং নির্ণয়পাদ। ব্যবহারের সংজ্ঞা, প্রাড়বিবাক বা বিচারকের গুণাগুণে ও কর্তব্য, নানা প্রকার ও স্তরের ধর্মধিকরণ, ধর্মাধিকরণ-সভ্যদের কর্তব্য, বিচারার্থীর আবেদন বা পূর্বপক্ষ, প্রতিভূ বা জমীন, প্রত্যার্থীদের চার প্রকারের উত্তর বা জবাব, প্রমাণ বা ক্রিয়া, মানুষী ও দৈবী নানা প্রকারের সাক্ষ্য, বিচার ও বিচারফল প্রভৃতি সমস্তই পূর্বোক্ত পাঁচভাগ জুড়িয়া আলোচিত হইয়াছে। এই গ্রন্থেও জীমূতবাহন পূর্বগামী পণ্ডিতদের প্রচুর বচন ও মতামত উদ্ধার ও নিপুণ আলোচনা করিয়াছেন। জীমূতবাহনের সর্বশ্রেষ্ঠ গ্ৰন্থ দায়ভাগ, এবং এই গ্রন্থ আজও মিতাক্ষরা-বহির্ভূত হিন্দুসমাজে দায় বা উত্তরাধিকার, সম্পত্তি-বিভাগ এবং স্ত্রী-ধন সম্পর্কে একতম সুবিখ্যাত ও সুপ্রতিষ্ঠিত গ্রন্থ। এই গ্রন্থে জীমূতবাহন পূর্বগামী অসংখ্য শাস্ত্রকারদের যুক্তি ও মতামত উদ্ধার করিয়া অগাধ পণ্ডিত্য এবং প্রখর বুদ্ধির সাহায্যে সে-সব আলোচনা ও খণ্ডন করিয়াছেন। দায়ভাগের টীকাকার অনেক; রঘুনন্দন বারবার তাহার গ্রন্থে দায়ভাগের যুক্তি ও মতামত গ্রহণ করিয়াছেন। সন্দেহ নাই, দায়ভাগ সমসাময়িককালেই যথেষ্ট প্রসিদ্ধি ও প্রতিষ্ঠালাভ করিয়াছিল। বাঙলাদেশে তো আজও দায়ভাগ আলোচ্য বিষয়ে একমাত্র প্রামাণিক গ্রন্থ। জীমূতবাহন যে অদ্ভুত মনীষা ও পাণ্ডিত্যসম্পন্ন ব্যক্তি ছিলেন, সুকুশলী নৈয়ায়িক ছিলেন, প্রখর ছিল তাহার বুদ্ধি ও ব্যক্তিত্ব এ-তথ্য অনস্বীকার্য।

অনিরুদ্ধ

ধমাধ্যক্ষ বা ধর্মাধিকরণিক, বরেন্দ্ৰান্তৰ্গত চম্পাহট্টীয় মহামহোপাধ্যায় অনিরুদ্ধ, এবং বরেন্দ্রীবাসী বল্লাল-গুরু, বেদ, পুরাণ ও স্মৃতিশাস্ত্ৰবিদ অনিরুদ্ধ একই ব্যক্তি, সন্দেহ নাই। বল্লালসেন ইহারই নিকট পুরাণ ও স্মৃতিশিক্ষা লাভ করিয়াছিলেন এবং দানসাগর-গ্রন্থে ইহারই সশ্রদ্ধ উল্লেখ বর্তমান। অনিরুদ্ধের হারলতা এবং পিতৃদায়িত উভয়ই সুবিখ্যাত গ্রন্থ। অনিরুদ্ধ বাস করিতেন গঙ্গাতীরে বিহার-পাটকে। কুমারিল-ভট্টের মীমাংসা সম্বন্ধীয় মতামতের সঙ্গে তাহার পরিচয় ছিল ঘনিষ্ঠ। হারলতা অশৌচ-সংক্রান্ত নানা বিষয়ের বিস্তৃত আলোচনা। পিতৃদায়িত সামবেদী গোভিলপন্থীদের শ্ৰাদ্ধাদি ব্যাপারে নানা ক্রিয়াকর্মের বর্ণনা বিধান। আচমন, দন্তধাবন, স্নান, সন্ধ্যা, পিতৃতৰ্পণ, বৈশ্বদেবতৰ্পণ, পার্বণশ্রাদ্ধ, দানন্তুতি প্রভৃতি কিছুই বাদ পড়ে নাই। রঘুনন্দন এই দুই গ্রন্থেরই বিস্তৃত ব্যবহার করিয়াছেন।

বল্লালসেন

অনিরুদ্ধ-শিষ্য সেন-রাজ বল্লালসেন অন্তত চারখানা গ্রন্থ রচনা করিয়াছিলেন— আচারসাগর, প্রতিষ্ঠাসাগর, দানসাগর এবং অদ্ভুতসাগর। দানসাগরে প্রথমে দুইটি গ্রন্থের উল্লেখ আছে; আচারসাগরের কিছু কিছু উদ্ধৃতি আছে বেদাচার্যের স্মৃতিরত্নাকর এবং বিশ্বেশ্বর-ভট্টের মদনপারিজাত গ্রন্থদ্বয়ে। কিন্তু আচারসাগর ও প্রতিষ্ঠাসাগর গ্রন্থ আমাদের কালে আসিয়া পৌঁছায় নাই। দানসাগর রচিত হইয়াছিল গুরু অনিরুদ্ধের শিক্ষার অনুপ্রেরণায়, এ-কথা বল্লালসেন নিজেই স্বীকার করিয়াছেন। কিন্তু রঘুনন্দন বলিতেছেন, গ্রন্থটি অনিরুদ্ধ-ভট্টের নিজের রচনা। গ্রন্থটিতে ৭০টি বিভিন্ন অধ্যায়ে বিভিন্ন প্রকারের দান, দানপুণ্য, দানের উদ্দেশ্য, প্রকৃতি, প্রয়োজনীয়তা, স্থান-কাল-পাত্র, কুদান, নিষিদ্ধদান, দানকরণ এবং দানগ্রহণের রীতি, ক্রম ও পদ্ধতি, ষোড়শ মহাদান, অসংখ্য ক্ষুদ্র দান প্রভৃতি সম্বন্ধে সুবিস্তৃত আলোচনা আছে। এ-বিষয়ে অন্যান্য নানা গ্রন্থ এবং সাধারণ সমস্ত পুরাণের উল্লেখও আছে। অদ্ভুতসাগর নানা শুভাশুভলক্ষণ সম্বন্ধীয় গ্রন্থ; তিনটি ভাগে গ্ৰহতারা, রামধনু, বীজ, বিদ্যুৎ, ঝড়, ভূমিকম্প অর্থাৎ আকাশী, বায়বীয় এবং ভৌতিক নানা ইঙ্গিত ও লক্ষণের আলোচনা। অদ্ভুতসাগর বল্লালসেন সম্পূর্ণ করিয়া যাইতে পারেন নাই। এই সুবৃহৎ গ্রন্থটি সমাপন করিয়াছিলেন পুত্ৰ লক্ষ্মণসেন পিতার নিকট প্রতিজ্ঞাক্ৰমে। গ্রন্থটির রচনা আরম্ভ হইয়াছিল ১০৮৯ শকে (১১৬৮ খ্ৰীষ্ট বৎসরে)।

গুণবিষ্ণু

দামুক-পুত্র গুণবিষ্ণু হয় বাঙালী ছিলেন, না হয়। মৈথিলী। হলায়ুধ তাহার ব্রাহ্মণসর্বস্ব গ্রন্থে গুণবিষ্ণুর ছান্দোগ্যমন্ত্রভাষ্য-গ্ৰন্থ প্রচুর ব্যবহার করিয়াছেন; কাজেই গুণবিষ্ণু হলায়ুধের পূর্বগামী। ছান্দোগ্যমন্ত্রভাষ্য সামবেদীয় গৃহ্যসূত্রের প্রায় ৪০০ মন্ত্রের সুবিস্তৃত টীকা! আটটি ভাগে গুণবিষ্ণু গর্ভাধান হইতে আরম্ভ করিয়া সমাবর্তন, বিবাহ প্রভৃতি সমস্ত প্রধান প্রধান সংস্কারগুলির আলোচনা করিয়াছেন; স্নান, সন্ধ্যা, পিতৃতর্পণ, শ্ৰাদ্ধ প্রভৃতির আলোচনাও আছে; তাহা ছাড়া পুরুষসূক্তের একটি টীকাও আছে। গুণবিষ্ণু ছান্দ্যোগ্য-ব্রাহ্মণ বা মন্ত্রব্রাহ্মণ-গ্রন্থের একটি টীকা এবং পারষ্কার-গৃহ্যসূত্রের একটি টীকাও রচনা করিয়াছিলেন। চতুর্দশ শতকে সায়নাচার্য গুণবিষ্ণুর নাম করেন নাই, কিন্তু ছান্দোগ্য-মন্ত্রভাষ্য হইতে প্রচুর উদ্ধৃতি গ্রহণ করিয়াছেন।

হলায়ুধ

প্রথম যৌবনে রাজপণ্ডিত, পরিণত যৌবনে লক্ষ্মণসেনের মহামাত্য, এবং প্রৌঢ় বয়সে লক্ষ্মণসেনেরই ধর্মধ্যক্ষ বা ধর্মধিকারী, আবস্থিক, মহাধৰ্মধ্যক্ষ (বা মহাধৰ্মধিকৃত বা ধর্মােগারাধিকারী) হলায়ুধও ছিলেন এ-যুগের অন্যতম যুগন্ধর পণ্ডিত এবং প্রভাবশালী ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন পুরুষ। তাহার পিতা ধনঞ্জয় ছিলেন বৎস-গোত্রীয় ব্রাহ্মণ, মাতা উজলা। ধনঞ্জয় ছিলেন ধর্মধ্যক্ষ। হল্যায়ুধের দুই জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা, ঈশান ও পশুপতি, ঈশান আহ্নিক-পদ্ধতি নামে একটি গ্রন্থ এবং পশুপতি শ্ৰাদ্ধপদ্ধতি ও পাকযজ্ঞ নামে দুইখানা গ্রন্থ রচনা করিয়াছিলেন। ঈশান এবং পশুপতির তিনটি গ্ৰন্থই বিলুপ্ত; তবে জনৈক রাজপণ্ডিত পশুপতি-রচিত শুক্ল যজুৰ্বেদীয় কাঞ্চশাখানুসারী গুহ্যানুষ্ঠানাদি সম্পর্কিত দশকর্মপদ্ধতি নামে একটি গ্রন্থের পাণ্ডুলিপি বিদ্যমান। ধনঞ্জয় পুত্র পশুপতি এবং রাজপণ্ডিত পশুপতি এক এবং অভিন্ন হওয়া বিচিত্র নয়।

ব্ৰাহ্মণসর্বস্ব, মীমাংসা সর্বস্ব, বৈষ্ণবসর্বস্ব, শৈব সর্বস্ব এবং পণ্ডিতসর্বস্ব নামে অন্তত পাচখানা গ্ৰন্থ হলায়ুধ রচনা করিয়াছিলেন। ইহাদের মধ্যে একমাত্র ব্রাহ্মণসর্বস্ব ছাড়া আর বাকী চারিটি গ্ৰন্থই বিলুপ্ত। শেষোক্ত দুটি গ্রন্থের উল্লেখ ও কিছু আলোচনা রঘুনন্দন করিয়াছেন। হলায়ুধ নিজেই বলিতেছেন, রাঢ় এবং বরোন্দ্রের ব্রাহ্মণেরা বেদপাঠ করিতেন না, এবং সেই হেতু বৈদিক ক্রিয়াকর্মের যথাযথ নিয়মও জানিতেন না। সেইজন্যই তিনি ব্রাহ্মণসর্বস্ব গ্রন্থ রচনা করিয়াছিলেন, প্রধানত শুক্লা-যজুৰ্বেদীয় কাঞ্চশাখাধ্যায়ী ব্রাহ্মণদের নিত্যকর্ম ও গৃহ্যসূত্রীয় সংস্কারাদি সম্বন্ধে শিক্ষাদানের জন্য। বৈদিক মন্ত্রভাষ্য রচনাই এই গ্রন্থের প্রধান বৈশিষ্ট্য, এবং মন্ত্রগুলি ব্যাখ্যা করিতে গিয়া হলায়ুধ প্রাতঃকৃত্য, পূজা, অতিথিসেবা, বেদপাঠ, পিতৃতৰ্পণ, দশসংস্কারাচার প্রভৃতি সমস্তই আলোচনা করিয়াছেন। এই কাজে কাত্যায়নের ছান্দােগ্যপরিশিষ্ট এবং পরিষ্করের গৃহ্যসূত্র তিনি প্রচুর ব্যবহার করিয়াছেন বলিয়া মনে হয়, এবং প্রকাশ্যে ঋণ স্বীকার করিয়াছেন। উবট এবং গুণবিষ্ণুর।

পুরুষোত্তম দেব ॥ পুরুষোত্তম

আগেই বলিয়াছি, এই পর্বে গভীর মননের কোনোও নিদর্শন বাঙলাদেশে মাই, সেই হেতু দর্শনগ্রন্থ রচনার চেষ্টাও নাই। তবে ব্যাকরণ ও কোষগ্রন্থ রচনার কিছুটা চেষ্টা হইয়াছিল, এবং রচয়িতাদের মধ্যে আর কেহ বাঙালী হউন না না হউন, এক আর্তি হরপত্র বন্দ্যঘটীয় সর্বানন্দই সকলের মুখোজ্জল করিয়াছেন। কিন্তু তাহার কথা বলিবার আগে বৈয়াকরণিক পুরুষোত্তমদেব এবং কোষকার পুরুষোত্তম সম্বন্ধে দু’একটি কথা বলিতেই হয়। এই দুই পুরুষোত্তম এক এবং অভিন্ন কিনা, নিঃসংশয়ে কিছু বলা কঠিন। ইহাদের দুইজনই বৌদ্ধ ছিলেন, নাম ছিল এক, এবং সমসাময়িক কালে জীবিত ছিলেন, শুধু এই সব কারণে দুইজনকে এক এবং অভিন্ন বলা চলে কিনা সন্দেহ। সপ্তদশ শতকে সৃষ্টিধর নামে জনৈক বৈয়াকরণিক পুরুষোত্তম দেব-রূচিত ভাষাবৃত্তি গ্রন্থের একটি টীকা রচনা করিয়াছিলেন। এই টীকায় সৃষ্টিধর বলিতেছেন, পুরুষোত্তমদেব রাজা লক্ষ্মণসেনের নির্দেশে এই গ্রন্থ রচনা করিয়াছিলেন, এবং তাঁহারই নির্দেশে ও অনুরোধে পুরুষোত্তম তাহার গ্রন্থে বৈদিক ব্যাকরণ আলোচনা করেন নাই। বেদানুরক্ত, ব্রাহ্মণ্যধর্মের পরম পৃষ্ঠপোষক লক্ষ্মণসেন কেন যে বৈদিক ব্যাকরণসূত্রগুলি বাদ দিতে বলিবেন, তাহা বুঝা কঠিন। তাহা ছাড়া, বৌদ্ধ পুরুষোত্তম বৈদিক ব্যাকরণ বাদ দিতে গিয়া বৌদ্ধরীতির অনুসরণ করিয়াছেন; বৌদ্ধের তো এমনিতেই বৈদিক ব্যাকরণের সূত্র মানিতেন না; তাহার জন্য লক্ষ্মণসেনের অনুরোধের প্রয়োজন হইবে কেন? ১১৫৯ খ্ৰীষ্ট বৎসরে সর্বানন্দ পরুষোত্তমের ভাযাবৃপ্তির উল্লেখ যদি করিয়াই থাকেন, তবু সন্দেহ থাকিয়াই যায়; কারণ প্রথমত উল্লেখটাই নির্ভরযোগ নয়; দ্বিতীয়ত ১১৫৯-এ লক্ষ্মণসেন হয়তো সিংহাসনেই আরোহণ করেন নাই! কাজেই লক্ষ্মণসেনের সঙ্গে তথা বাঙলাদেশের সঙ্গে পুরুষোত্তমের সম্বন্ধ সন্দেহাতীত নয়। পুরুষোত্তমদেব যে একাদশ বা দ্বাদশ শতকের লোক তাহাও নিশ্চয় করিয়া বলা যায় না।

কোয্যকার পুরুষোত্তমের শ্রেষ্ঠ গ্ৰন্থ ত্রিকাণ্ডশেষ বিখ্যাত অমরকোষের সম্পূরক, অমর যাহা বাদ দিয়া গিয়াছেন। পুরুষোত্তম তাহাই পূরণ করিয়াছেন। তিনি আরও অন্তত তিন খানা গ্ৰন্থ রচনা করিয়াছিলেন-হালাবলি, বৰ্ণদেশনা ও দ্বিরূপকোষ। হারাবলি ২৭৮টি শ্লোকে সাধারণত অব্যবহৃত প্ৰতিশব্দ ও সমরশব্দের সংগ্ৰহ। বৰ্ণদেশনা গদ্যে রচনা; যে-সব শব্দের বানানের রূপ নানা প্রকারের সেই সব শব্দের আলোচনা এই গ্রন্থে আছে, বিশেষভাবে গৌড়ীয় লিপিরূপের জন্য যে-সব বানানে নানা রকমের গোলমাল সেই সব শব্দের উল্লেখ ও আলোচনা আছে। দ্বিরূপকোষে ৭৫টি শ্লোকে এমন সব শব্দের একটি তালিকা আছে যাহাদের বানানের দুইটি রূপ।

একাদশ শতকের শেষভাগে বৈয়াকরণিক ক্ষীরস্বামী তাহার অমরকোষের টীকায় অনেকবারই জনৈক গৌড়ীয় বৈয়াকরণিকের উল্লেখ করিয়াছেন; কয়েকবার গৌড়ীয় বৈয়াকরণিক এক গোষ্ঠীর উল্লেখও যেন করিয়াছেন। কিন্তু গৌড়ীয় বৈয়াকরণিকটি যে কে, কিংবা গোষ্ঠীভুক্ত লোকেরাই বা কাহারা, কিছুই বলিবার উপায় নাই।

সৰ্ব্বানন্দ

আর্তিহরী-পুত্র বন্দ্যঘটীয় সর্বানন্দের প্রতিষ্ঠার নির্ভর টীকা সৰ্বস্ব নামক অমরকোষের টীকার উপর। এই গ্রন্থ বাঙলার গৌরব, এবং সুপ্রচুর বাঙলা দেশী শব্দের সর্বপ্রাচীন সংগ্ৰহ। বৃহস্পতি রায়মুকুটের পদচন্দ্ৰিকা (১৪৩১ খ্ৰীষ্ট বৎসর) নামক অমরকোষের টাকায় টীকাসর্বস্ব হইতে প্রচুর উদ্ধৃতি আছে। কিন্তু এ-পর্যন্ত টীকাসর্বম্বের একটি পাণ্ডুলিপিও বাঙলাদেশে পাওয়া যায় নাই, পাওয়া গিয়াছে দক্ষিণ-ভারতে। সর্বানন্দ নিজেই বলিতেছেন, ১৭০৮ শকাব্দে ১১৫৯-৬০ খ্রীষ্ট শতকে তাহার গ্রন্থ-রচনা চলিতেছিল।

লক্ষণীয়। এই, এই পর্বের জ্ঞান-বিজ্ঞান সাধনা একান্তু ভাবেই শিক্ষিত উচ্চ বৰ্ণস্তরে আবদ্ধ। ধর্মশাস্ত্রগুলির দৃষ্টি-পরিধির মধ্যে তো দ্বিজবৰ্ণ ছাড়া আর কাহারও স্থানই নাই। ব্যাকরণ এবং কোষগ্রন্থগুলিতে মোটামুটি ব্ৰাহ্মণ্য শিক্ষা-দীক্ষারই প্রতিফলন। এই শিক্ষা-দীক্ষায় ব্যবস্থা, পাঠক্রম, রতিপদ্ধতি এই পর্বে কিরূপ ছিল তাহা বলিনার মতো উপাদান আমাদের নাই। বৌদ্ধ শিক্ষা-দীক্ষার ব্যবস্থার সঙ্গে ব্ৰাহ্মণ্য শিক্ষা-ব্যবস্থার যে পার্থক্য তাহা তো ছিলই, অর্থাৎ বৌদ্ধ শিক্ষা-ব্যবস্থার কেন্দ্র ছিল বৌদ্ধ সংঘ ও বিহার এবং সেখানে শিক্ষাটা হইত সংঘবদ্ধ ভাবে। ব্ৰাহ্মণ্য শিক্ষা ছিল একক ও ব্যক্তিক এবং সে-শিক্ষার কেন্দ্র ছিল গুরুগৃহ। সেই গৃহে দ্বিজবৰ্ণ এবং উচ্চতর বর্ণস্তরের শিক্ষার্থী ছাড়া আর কাহারও স্থান ছিল না। তাহা ছাড়া, এই পর্বের গুরুগৃহে অধ্যয়ন-অধ্যাপনার বিষয়ও ছিল সংকীর্ণ ও সীমাবদ্ধ। লিপি-প্রমাণ ও সমসাময়িক সাহিত্যে যে সব বিষয়ের উল্লেখ পাইতেছি তাহা মীমাংসা, স্মৃতি, গৃহ্যসূত্র, ব্যাকরণ ও ফলসংহিতা-জ্যোতিযেই যেন সীমাবদ্ধ। যে-ন্যায়শাস্ত্রে বাঙলা দেশের প্রতিষ্ঠা তাহাও এই পর্বে গড়িয়া ওঠে নাই। শস্ত্ৰবেদ, আয়ুর্বেদ, অর্থশাস্ত্র প্রভৃতির উল্লেখও কোথাও দেখিতেছি না। দৰ্শন-শাস্ত্রের গভীর গহনে আত্মস্থ হইবার সাহস তো নাই। এই সব কারণেই বোধ হয় সমসাময়িক জ্ঞান-বিজ্ঞানের দৃষ্টি-পরিধিই সংকীর্ণ হইয়া পড়িতে বাধ্য হইয়াছিল; সৃষ্টির প্রেরণাও ছিল দুর্বল। সমস্ত মনন যেন শুধু টীকা ও টিল্পনীর বন্ধ্যা বন্ধনে শৃঙ্খলিত!

জ্ঞান ও বিজ্ঞান, শিক্ষা ও সংস্কৃতির এই অবস্থায় শিক্ষিত উচ্চ বৰ্ণস্তরের চিত্ত মুক্তি পাইতে চায় কবি-কল্পনার অপেক্ষাকৃত প্রশস্ততর ক্ষেত্রে। এই পর্বের শিক্ষিত সমাজে তাহাই হইয়াছিল, এবং তাহা প্রধানত রাজসভাকে কেন্দ্ৰ করিয়া। সেনা-রাজারা সকলেই, বিশেষভাবে বল্লালসেন, লক্ষ্মণসেন ও কেশবসেন পরম বিদ্যোৎসাহী ছিলেন, নিজেরা কবি ছিলেন এবং কবিজনের সমাদরও করিতেন। কবি ধোয়ী লক্ষ্মণসেনকে বলিয়াছেন বাঙলার বিক্ৰমাদিত্য। তাহার রাজসভা অলংকৃত করিতেন। অন্তত পাচজন সৃষ্টিধর কবি- গোবর্ধন বা গোবর্ধনাচার্য, শরণ, জয়দেব, উমাপতি-ধর এবং কবিরাজ। কবিরাজ বোধহয় বলা হইত ধোয়ী কবিকে, কারণ জয়দেব ধোয়ীকেই বলিয়াছেন কবি ক্ষমাপতি এবং ধোয়ী নিজেও তাঁহার পবনদূত-কাব্যে নিজেকে ঐ বিশেষণে বিশেষিত এবং কবিরাজা আখ্যায় আখ্যাত করিয়াছেন। এই পাঁচজন ছাড়াও সমসাময়িক কাব্য সংকলনগ্রন্থ সদুক্তিকর্ণামৃতে আরও অনেক বাঙালী কবির সংবাদ এবং তাঁহাদের কাব্য-নিদর্শন পাওয়া যায়। বস্তুত, সংস্কৃত গীতিকাব্যে এই পর্বের বাঙালী কবিদের দান শুধু সংখ্যা-সমৃদ্ধিতেই উল্লেখযোগ্য নয়, কাব্যসমৃদ্ধিতেও গৌরবের দাবি রাখে। তবু, স্বীকার করিতেই হয়, এ-পর্বের সমস্ত কাব্যই, এমন কি গীতগোবিন্দও ক্ষীণাত্মা ও অল্পপ্রাণ; ইহাদের সহজ সৌন্দর্য আছে, ভাবের ও দৃষ্টির গভীরতা নাই। যে কবি-কল্পনার পশ্চাতে সবল ও গভীর মননের প্রেরণা নাই, বিস্তৃত জীবনের সাধনা নাই তাহার প্রকৃতি সর্বদেশে সৰ্বকালেই এইরূপ। সদ্যোক্ত কবিদের কথা বলিবার আগে নৈষধচরিত-রচয়িতা শ্ৰীহৰ্ষ, বেণীসংহার-রচয়িতা ভট্ট-নারায়ণ এবং অন্যর্ঘরাঘব রচয়িতা মুরারী সম্বন্ধে কয়েকটি কথা বলিয়া লইতে হয়।

শ্রীহর্ষের নৈষধচরিত

নৈষধচরিত-কাব্য রচয়িতা শ্ৰীহৰ্ষ বাঙালী কিনা। এই লইয়া পণ্ডিত মহলে প্রচুর বিতণ্ডা বিদ্যমান। বাঙালী কুলপঞ্জিকাকারদের মতে শ্ৰীহয়ের পিতার নাম মেধাতিথি বা তিথিমেধা, কিন্তু যথার্থত তাহার পিতা ছিলেন শ্ৰীহীর এবং মাতা ছিলেন মামল্লদেবী নৈষধ-চরিতের সপ্তম সর্গের ১১০ সংখ্যক শ্লোকে জানা যায়, শ্ৰীহৰ্ষ অনুল্লিখিত নোম জনৈক গৌড়রাও সম্বন্ধে একটি প্রশস্তি কাব্য রচনা করিয়াছিলেন; ষোড়শ সর্গের ১৩১ সংখ্যক শ্লোকে দেখিতেছি, তাহার প্রতিভার সমাদর করিয়াছিলেন কাশ্মীরী পণ্ডিতেরা; আবার দ্বাবিংশতম সর্গের ২৬ সংখ্যক শ্লোকে জানা যাইতেছে, কানাকুজের রাজা ছিলেন তাহার পৃষ্ঠপোষক। নৈষধ-চরিতের একজন অর্বাচীন টীকাকার বাঙালী গোপীনাথ আচার্য তাহার হর্ষহীদয় নামীয় টীকায় বলিতেছেন, শ্ৰীহৰ্ষের – উল্লিখিত বিজয়প্রশস্তি-কাব্যটি সেন-ব্লাজ বিজয়সেন সম্বন্ধে। তেমনই আবার অন্যদিকে চাণ্ডুপণ্ডিত ও অন্যান্য টীকাকারেরা এবং রাজশেখর সূরি তাহার প্রবন্ধচিন্তামণি-গ্রন্থে বলিতেছেন, যে-কান্যকুব্জরাজ তাহার পৃষ্ঠপোষক ছিলেন তাহার নাম জয়চন্দ্র। জয়চন্দ্ৰ যাহার পৃষ্ঠপোষক কিংবা কাশ্মীরী পণ্ডিতেরা র্যাহার অনুরক্ত, বিজয়সেন সম্বন্ধে প্রশস্তি রচনায় তাহার কোনও বাধা থাকিবার কথা নয়। ইতিহাসগত বাধাও কিছু নাই। কাব্যটি আগাগোড়া গৌড়ী-রীতিতে রচিত; সর্বত্র অনুপ্রাসের ছড়াছড়ি, শ-ষ-স হইয়া ধ্বনিসাম্য-অর্থবৈষম্যের খেলা, বাঙালী-সুলভ দন্ত্য ‘ন’ এবং মূর্ধ্য ‘ন’, বর্গীয় ‘ব’ এবং অস্ত্যস্থ ‘ব’, বর্গীয় ‘জ’ এবং অন্তঃস্থ ‘য’ প্রভৃতির একই মূল্য দান সামাজিক বিবাহ-ভোজে ভাত এবং মাছ খাওয়া; ব্যঞ্জনে দই ও সরিষার ব্যবহার; দুগ্ধপক্ক বাটক (বা বড়া পিঠে) খাওয়া, ভোজে বসিয়া বরযাত্রীদের ব্যবহারের নানা খুঁটিনাটি, বিবাহে উলুলু ধ্বনি, শঙ্খবলয় ও সীমান্তে সিঁদুর ব্যবহার, মঙ্গলানুষ্ঠানে আলপনা আঁকা, বিবাহ উপলক্ষে মঙ্গলগীত গাওয়া, দরজার দুই ধারে কদলী বৃক্ষরোপণ, বিবাহে গাঁটছড়া বাধা, বিবাহ সংক্রান্ত নানা স্ত্রী-অ্যাচার, বাসরঘরে চুরি করিয়া দেখা বা আড়ি পাতিয়া শোনা, প্রভৃতি তথ্য একত্র করিলে শ্ৰীহৰ্ষকে বাঙালী বলিয়াই তো মনে হয়। টীকাকারেরা সকলেই তাহাকে গৌড়ীয় অর্থাৎ বাঙালী বলিয়াই উল্লেখ করিয়াছেন। কিন্তু বাঙালী হইলেও তাহার নৈষধ-চরিত কাব্য লইয়া গর্ব করিবার কিছু নাই। শ্ৰীহৰ্ষ দাবি করিয়াছেন। ‘কবিকুলের অজ্ঞাত অদৃষ্ট পথের তিনি পথিক!’ এত বড় দাবি এ-কাব্য সম্বন্ধে করা চলে না। মহাভারতের নল-দময়ন্তীর মধুর কাহিনীটির একাংশ মাত্ৰ নানা অবাস্তর বর্ণনায় অলংকৃত করিয়া বাইশটি সুদীর্ঘ সর্গে এমন একটি জটিল মহাকাব্য তিনি রচনা করিয়াছেন যাহা ছন্দ, অলংকার এবং পাণ্ডিত্যের গুরুভারে ভারাক্রান্ত, কিন্তু যথার্থ কাব্যমূল্যে দরিদ্র ও দুর্বল। কোনো সূক্ষ্মী উচ্চস্তরের কল্পনা বা গভীর জীবনদর্শন এই কাব্যকে মহিমান্বিত করে নাই। তবু, কোন প্রাচীন ভারতের পাচটি মহাকাব্যের অন্যতম বলিয়া পরিগণিত হইত, তাহা বলা কঠিন।

নৈষধ-চরিত ছাড়া শ্ৰীহৰ্ষ আরও কয়েকটি গ্রন্থ রচনা করিয়াছিলেন এবং তাহার উল্লেখ নৈষধ-চরিতেই আছে; নবসাহিসাংক-চরিত, স্থৈৰ্যবিচার-প্রকরণ, অর্ণব-বৰ্ণনা, শিবশক্তিসিদ্ধ, ছিন্দ-প্রশস্তি ও শ্ৰীবিজয়-প্রশস্তি। খণ্ডন-খণ্ড-খাদ্য নামে দর্শনের উপরও তিনি একখানা মূল্যবান

বাঙালীর ঐতিহ্য বেণীসংহার-রচয়িত শাণ্ডিল্যাগোত্রীয় ভট্ট-নারায়ণকেও বাঙালী বলিয়া দাবি করে; আদিশূর-প্রবর্তিও এবং কনৌজগত পঞ্চব্ৰাহ্মণের তিনি নাকি অন্যতম। এ-তথ্য কতটুকু বিশ্বাসযোগ্য বলা কঠিন; অন্তত ঐতিহাসিক প্রমাণ কিছু নাই। মৌদগল্য-গোত্রীয় বর্ধমানাঙ্কপুত্র, অনৰ্ঘারাঘব-রচয়িতা মুরারী-মিশ্রকেও অনেকে বাঙালী বলিয়া মনে করেন; টীিকাকার প্রেমচন্দ্র-তর্কবাগীশ তো তাহাই বলিতেছেন। পুরীর জগন্নাথ-মন্দিরে উৎসবাভিনয়ের জন্য অনঘারাঘব রচিত হইয়াছিল।

একাদশ-দ্বাদশ-ত্ৰয়োদশ শতকের বাঙলাদেশে নাট্য-রচনার যথেষ্ট প্রাচুর্য ছিল বলিয়া মনে হয়। এবং ইহাদের অধিকাংশই রামায়ণ-মহাভারত-পুরাণ প্রভৃতির কাহিনী লইয়া রচিত হইয়ছিল। ১৪৩১ খ্ৰীষ্ট বৎসরের আগে সাগরনন্দী-রচিত (“মুকুটেশ্বর নন্দিবংশ বোমাঙ্গনৈকশশী”) নাটকলক্ষণরত্নকোষ-গ্রন্থে বহু বাঙালী নাট্যকারের নাট্যরচনার উল্লেখ আছে। কয়েকটি নাম উল্লেখ করিতেছি: কীচকতীম, প্রতিজ্ঞাতীম, শৰ্মিষ্ঠা-পরিণয়, রাধা, সত্যভামা, কেলি-রৈবতক, উষাহরণ, দেবী-মহাদেব, উর্বশী-মৰ্দন, নলবিজয়, মায়া-মদালসা, উন্মত্ত চন্দ্ৰগুপ্ত, মায়া-কোপালিক, মায়া-শকুন্তু, মদানিকা-কামুক, জানকী-রাঘব, রামানন্দ, কেকয়ী-ভরত, অযোধ্যা-ভরত, বালিবধ, রামবিক্রম, মারীচ-বঞ্চিতক, ইত্যাদি।

সমসাময়িক বাঙলাদেশের কবিমনের সম্পূর্ণ পরিচয় নৈষধ-চরিতে নাই, এমন কি ধোয়ীকবি-রচিত পবনদূতেও নয়। প্রাচীনতম বাঙলায় বা শৌরসেনী অপভ্রংশের স্থানীয় রূপে যে স্বল্প কবিতা ও গান এই দ্বাদশ-ত্ৰয়োদশ শতকে রচিত হইয়াছিল। তাহদের মধ্যেও সি-পরিচয় পাইবার কথা নয়; কারণ এই সব কবিতা ও গান রচিত হইয়াছিল ধর্মের প্রেরণায়, কাব্যের প্রেরণায় নয়। তাহা ছাড়া, রচয়িতারা সকলেই কিছু শিক্ষিত ও সংস্কৃতিবান লোক ছিলেন না; মন ও বুদ্ধি শিক্ষাশাসন দ্বারা যথেষ্ট মার্জিত ছিল না, চিত্ত ছিল না কল্পনায় উজ্জ্বল। সেই জন্য কল্পনোজুল শিক্ষিত মনের পরিচয় শৌরসেনী অপভ্রংশ বা প্রাচীনতম বাঙলা পদগুলিতে বড় একটা পাওয়া যায় না; তাহা পাওয়া যায় বাঙলার কবিদের সংস্কৃত ভাষায় কাব্য-রচনার মধ্যে, এবং বিশেষভাবে যে-কাব্য রচিত হইয়াছিল রাজসভার আলোকমালার আড়ালে।

কাব্য ও কবিতা

ব্রাহ্মণ পণ্ডিত-সমাজের বাহিরেও কাব্য-সাহিত্যের প্রসিক একটি শ্রেণী ছিল, এবং সম্পাণ একখানা কাব্য বা প্রকীর্ণ শ্লোক যে সংস্কৃতে রচিত হইত। তাহা শুধু পণ্ডিত-সমাজের জন্যই নয়, বরং এই বৃহত্তর রসিক শ্রেণীটিকে উদ্দেশ্য করিয়াই। প্রধানত এই শিক্ষিত রসিক শ্রেণীটির জন্যই বোধ হয় বাঙলাদেশে সর্বপ্রথম সরস শ্লোক-সংগ্রহ বা কবিতা-চয়নিক সঙ্কলন করিবার একটা সজাগ প্রয়াস দেখা দেয়। অন্তত, সংস্কৃত সাহিত্যের ভাণ্ডারে যে কয়েকটি কবিতা-সংগ্ৰহ সুপরিচিত, তাহার মধ্যে সর্বপ্রাচীন দুটি সংগ্রহই বাঙলাদেশে বাঙালী সংকলন-কর্তদ্বারা সংকলিত ও সম্পাদিত; সে দুটি কবীন্দ্রবচনসমুচ্চয় এবং সদুক্তিকর্ণামৃত। কবীন্দ্রবচনসমুচ্চায়ের কথা আগের পর্বেই বলিয়াছি; বইখানা বোধ হয় একাদশ শতকের শেষ পর্বের সঙ্কলন।

সদুক্তিকর্ণামৃত

সদুক্তিকর্ণামৃত-গ্ৰন্থখানা সঙ্কলিত হয় ১২০৬ খ্ৰীষ্ট বৎসরে (১২২৭ শকাব্দ), বোধ হয়, কেশবসেনের রাজত্বকালে। গ্রন্থের পুম্পিক-শ্লোকে যেন কেশবসেনের নামোল্লেখ আছে। সঙ্কলয়িতা শ্ৰীধরদাসের পিতা শ্ৰীবটুদাস লক্ষণসেনের প্রতিরাজ বা লেখক এবং অন্যতম মহাসামন্ত ছিলেন। বটুদাস লক্ষ্মণসেনের ‘অনুপম প্রেমের একমাত্র পাত্র এবং “সখা ছিলেন। শ্ৰীধরদাস নিজে কবি ছিলেন। কিনা জানিবার উপায় নাই, কিন্তু তাহার সঙ্কলিত শ্লোক-সংগ্ৰহ এবং শ্রেণীবিভাগ বিশ্লেষণ করিলে এ-তথ্য অস্বীকার করা যায় না যে, তিনি একজন বিদগ্ধ কাব্যরসিক ও সাহিত্যবোদ্ধা ছিলেন। এই গ্ৰন্থ পাচটি প্রবাহ বা অধ্যায়ে বিভক্ত; প্রত্যেক প্রবাহে কয়েকটি করিয়া বীচি বা তরঙ্গ বা শ্রেণী এবং প্রত্যেক বীচিতে পাচটি করিয়া শ্লোক। প্ৰত্যেক শ্লোকের শেষে সংকলয়িতার নাম দেওয়া আছে; যে-সব ক্ষেত্রে নাম শ্ৰীধরদাসের অজ্ঞাত ছিল সে-সব ক্ষেত্রে বলা হইয়াছে ‘কস্যচিৎ’। প্রথম প্রবাহে ৯৫টি বীচিতে নানা দেবতার লীলাবিষয়ক ৪৭৫টি শ্লোক; দ্বিতীয় শৃঙ্গার প্রবাহে ১৭৯টি বীচির ৮৯৫টি শ্লোকে প্রেম, নায়ক-নায়িকা, প্রেমের নানা ভাব ও অবস্থা, বিভিন্ন ঋতু ও প্রকৃতির নানা অবস্থার সরস বর্ণনা; তৃতীয় চাটু প্রবাহে ৫৪টি বীচির ২৭০টি শ্লোকে রাজার স্তুতি, বীরের বীর্য, যুদ্ধ, সেনা, শত্ৰু, তুর্যধ্বনি, কীর্তি ইত্যাদির বর্ণনা বা প্রশংসা; চতুর্থ অপদেশ প্রবাহে ৭২টি বীচির ৩৬০টি শ্লোকে দেবতাদের দোষগুণ, পার্থিব সংসার, গাছলতাপাতা, পশুপক্ষী ইত্যাদির বর্ণনা; এবং পঞ্চম উচ্চাবাচ প্রবাহে ৭৪টি বীচির ৩৭০টি শ্লোকে গরু, ঘোড়া, মানুষ, পাখি, দেশ, কবি, স্থান, গুণ ইত্যাদি নানা বিষয়ে নানা বর্ণনার ছড়াছড়ি। গ্রন্থটিতে সর্বমোট ৪৮৫ জন বিভিন্ন কবির রচনার নমুনা আছে; ইহাদের মধ্যে পাণিনি, ভাস, ভারবি, কালিদাস, ভামহ, অমরু, বাণভট্ট, বিলহন, ভর্তৃহরি, মুঞ্জ, রাজশেখর, বাকপতিরাজ, বিশখাদত্ত প্রভৃতি সর্বভারতীয় কবির রচনা যেমন আছে, তেমনই আছে অসংখ্য বাঙালী কবির রচনা। বস্তুত, কবিদের নামের রূপ দেখিয়া মনে হয়, অর্ধেকেরও উপর বোধ হয় শ্ৰীধর দাসের সমসাময়িক অথবা কিছু আগেকার গৌড়-বঙ্গীয় কবিকুলের রচনা। সুকুমার সেন মহাশয় এই বাঙালী কবিকুলের সুদীর্ঘ নাম-তালিকা চয়ন করিয়াছেন।

সমসাময়িক বাঙলাদেশের সাহিত্যিক আবহাওয়ার চমৎকার নিদর্শন এই গৌড়-বঙ্গীয় কবিদের প্রকীর্ণ শ্লোকগুলি। এই আবহাওয়া রাজসভায় রচিত স্তৃতি-প্রশস্তিতে বা কাব্যে নাই। জয়দেব যে যুদ্ধ বীররসের কবিতা এবং মহাদেবের বন্দনা শ্লোক রচনা করিতেন, গীতগোবিন্দে সে-পরিচয় পাইবার সুযোগ নাই, অথচ সদুক্তিকর্ণামৃতে সে-পরিচয় পাইতেছি। সে-রাজসভায় যে নানা সমস্যাপূরণ লইয়া শ্লোক-রচনার প্রতিযোগিতা খেলা চলিত এ-ইঙ্গিতও পাইতেছি। এই গ্রন্থের কিছু প্রকীর্ণ শ্লোকে এবং এই সব শ্লোকাশ্ৰয়েই জানিতেছি যে, লক্ষ্মণসেন, কেশবসেন, শরণ ও জয়দেব পাল্লা দিয়া রাধাকৃষ্ণ বিষয়ক পদ রচনা করিতেন। জয়দেব-রচিত মহাদেব স্তুতি-বিষয়ক শ্লোকটি দেখিয়া মনে হয়, তিনি শুধু রাধাকৃষ্ণের লাস্যলীলার কবি ছিলেন না, এমন কি আমাদের প্রচলিত ধারণার বৈষ্ণব সাধক-মহাজনও ছিলেন না। তিনি ছিলেন বিদ্যাপতির মতো পঞ্চোপাসক স্মার্ত ব্ৰাহ্মণ, এবং তাঁহার জীবনে যুদ্ধ ও বীররসের স্পর্শও লাগিয়াছিল। কবি শরণ বা উমাপতি-ধরও শুধু বিজয়সেন ও লক্ষ্মণসেনের প্রশস্তি ও স্তুতিশ্লোক লিখিয়াই অঁতাহাদের কর্তব্য শেষ করেন নাই; রাজসভার বাহিরে বসিয়া লোকায়াত জীবনের নানা প্রকীর্ণ শ্লোকও রচনা করিয়া ছিলেন। এই গ্রন্থে লক্ষ্মণসেনের ১১টি, কেশবসেনের ১০টি এবং হলায়ুধেরও ৫টি শ্লোক আছে।

সদুক্তিকর্ণামৃত-গ্রন্থের নানা শ্লোক এই গ্রন্থের নানা অধ্যায়ে নানা প্রসঙ্গে উদ্ধার ও ব্যবহার করিয়াছি। এই শ্লোকগুলি নানা দিক দিয়া সমসাময়িক বাঙলাদেশের নানা পরিচয় বহন করে; তাহা ছাড়া, সমসাময়িক সাহিত্যিক আবহাওয়ার স্পর্শও ইহাদের মধ্যে পাওয়া যায়। ভবিষ্যৎ বাঙলার সাহিত্য ও সংস্কৃতির কিছু কিছু আভাসও ইহাদের গর্ভেই নিহিত। একটি অজ্ঞাতনামা কবি (খুব সম্ভব বাঙালী) বিবাহকালে গৌরীর বর্ণনা দিতেছেন

ব্ৰহ্মায়ং— বিষ্ণুরেষ— ত্ৰিদশপতিরসেী।- লোকপালাস্তথৈতে,
জামাতা কোহিত্র? যোহসৌ ভূজগপরিবৃতো ভস্মরূক্ষ্ম কপালী।
হা বৎসে! বঞ্চিতাসীতানভিমতবর প্রার্থনাবীড়িতাভির
দেবীভিঃ শোচ্যমানাপুপচিত পুলক শ্রেয়সে যেহস্তু গৌরী।

এই শ্লোকটিতে পার্বতীর বিবাহের যে-বৰ্ণনা এবং শিবের প্রতি যে মনোভাব তাহারই প্রতিধ্বনি শোনা যায় মধ্যযুগীয় বাঙলা সাহিত্যে, বিশেষ ভাবে ভারতচন্দ্র। কয়েকটি শ্লোকে দরিদ্র শিবের গৃহস্থালী বৰ্ণনা, শিশু কার্তিকেয়ের বেশভূষায় শিবের অনুকরণ, শিবের জটাজুট লইয়া খেলার বর্ণনা প্রভৃতি পড়িতে পড়িতে স্বতই মধ্যযুগীয় বাঙলা সাহিত্যের অনুরূপ ছবিগুলি মনে পড়িয়া যায়। এই শ্লোকগুলি তো বাঙালী কবিদেরই রচনা বলিয়া মনে হইতেছে; ভাবাত্মীয়তা একান্তই ঘনিষ্ঠ। কবি কুলশেখরের চারিটি হরিভক্তি সম্বন্ধীয় শ্লোকে এবং অজ্ঞাতনামা কোনও কবির একটি শ্লোকে চৈতন্যোত্তির গৌড়ীয় বৈষ্ণবের হৃদয়ধ্বনি যেন কানে আসিয়া প্ৰবেশ করে। সন্দেহ নাই, এই শ্লোকগুলির মধ্যে হরিভক্তির পূর্বাভাস দেখা যাইতেছে; সে যে আসে, আসে, আসে। এই গ্রন্থে জয়দেবের ৩১ শ্লোক আছে, তন্মধ্যে ৫টি মাত্ৰ গীতগোবিন্দের শ্লোক, কয়েকটি আছে প্রকীর্ণ শ্লোক, দু’একটি লক্ষ্মণসেনের স্তৃতি-শ্লোক, বাকী সবগুলিই যুদ্ধ, শৌর্য-বীৰ্য, তুর্যনিনাদ, সংগ্রাম, কীর্তি প্রভৃতি সম্বন্ধীয়। সন্দেহ হয়, জয়দেব বীররসেরও একটি কাব্য রচনা করিয়াছিলেন, এবং এই শ্লোকগুলি সেই কাব্যের; কিন্তু সে-কাব্য আমাদের কালে আসিয়া পৌছায় নাই। লক্ষ্মণসেনের প্রশস্তিমূলক শ্লোকটি এইরূপ:

লক্ষ্মীকেলি-ভুজঙ্গ! জঙ্গমহরে! সংকল্প কল্পদ্রুম!
শ্ৰেয়ঃ সাধকসঙ্গ সঙ্গর কলা-গাঙ্গেয়! বঙ্গপ্রিয়!
গৌড়েন্দ্ৰ! প্রতিরাজরাজক! সভালংকার! কারাপিত–
প্রত্যার্থিক্ষতিপাল! পালক সীতাং! দূক্টোহসি, তুষ্টা বয়ম!

বোধ হয় এই শ্লোকটি কণ্ঠে লইয়াই জয়দেব কেন্দুবিন্ধ হইতে নবদ্বীপে আসিয়া লক্ষ্মণসেনের সমীপে উপস্থিত হইয়াছিলেন! শৃঙ্গার-প্রবাহে উমাপতি-ধরের একটি সুন্দর কাব্যময় শ্লোক আছে; বনবিহার-কালে একটি সুন্দরী নারী পায়ের আঙুলে ভর দিয়া দাঁড়াইয়া উপরে গাছের ডাল হইতে ফুল পাড়িতেছেন, বাহুমূল ঊর্ধ্বে উত্তোলিত, উর্ধপ্রয়াসে স্তন ঈষদোন্মুক্ত,বসন ঈষদব্যায়ত হইয়া পড়ায় নাভিহ্রদ দেখা যাইতেছে–

দুরোদঞ্চিত বাহুমূলবিলাসচীন প্রকাশস্তনা
ভোগব্যায়ত মধ্যলম্বিবসনানিমুক্তনাভিহ্রদা
আকৃষ্ট্রোজ্বিত-পুষ্পমঞ্জরিরজঃ পাতোবরুদ্ধেক্ষণা
চিম্বত্যাঃ কুসুমং ধিনোতি সুদৃশঃ পাদ্যগ্ৰদুস্থাতনুঃ৷

এই সংকলনে শরণ, উমাপতি-ধর, জয়দেব, গোবর্ধনাচার্য, ধোয়ী-কবিরাজ, লক্ষ্মণসেন, কেশবসেন প্রভৃতিরা তো আছেনই, কিন্তু ইহাদের ছাড়া অগণিত গৌড়-বঙ্গীয় কবিদের সাক্ষাৎও পাইতেছি: জলচন্দ্র, যোগেশ্বর, বৈদ্য গঙ্গাধর, সাঞ্চাধর, বেতাল, ব্যাস-কবিরাজ, কেবাট, পপীপ, (জনৈক) বঙ্গাল, চন্দ্ৰচন্দ্ৰ, গাঙ্গোক, বিম্বোক, শুঙ্গোক ইত্যাদি অনেক অজ্ঞাতনামা কবি। ইহারা সকলেই ছিলেন সমসাময়িক বাঙলার কবি, এ-সম্বন্ধে সন্দেহ করিবার খুব কারণ নাই। বটুদাসের প্রশস্তিময় পাচটি শ্লোক যে পাচজন কবির রচনা তাহারা সকলেই সমসাময়িক বাঙালী, এ-তথ্য সন্দেহ করা বোধ হয় চলে না; এই পাঁচজন হইতেছেন মথু, সাঞ্চাধর, বেতাল, উমাপতি-ধর এবং কবিরাজ-ব্যাস।

আর্তিহরপুত্র, সর্বানন্দ দ্বাদশ শতকের মধ্যভাগে আমরকোয্যের যে টীকা রচনা করিয়াছিলেন তাহাতে অন্যান্য গ্রন্থের সঙ্গে বাঙালী কবির রচনা হইতেও কিছু কিছু শ্লোক উদ্ধার করা হইয়াছে। ইহাদের মধ্যে সাহিত্যকল্পতরু, দেবীশতক, বিদগ্ধমুখমণ্ডল, বৃন্দাবনষমক, বাসনামঞ্জরী (শ্ৰীপোবোক-রিচিত) প্রভৃতি গ্ৰন্থ বাঙালী কবির রচনা বলিয়াই তো মনে হয়। সর্বানন্দ নিজেও ছিলেন কবি, এবং তাঁহার টীকাসর্বম্বের প্রথম শ্লোকেই তিনি যে গোপাল-বন্দনা করিয়াছেন তাহাতে তাঁহার কবি-প্রতিভা কিছুটা প্ৰতিফলিত।

বহিণ বৰ্হপীড়ঃ সুষিরপরো বালীবল্লবো গোষ্ঠে।
মেদুরমুদিরশামলারুচিবাদেয গোবিন্দঃ ॥

এইবার সেন-রাজসভার পঞ্চরত্ন অর্থাৎ শরণ, ধোয়ী, গোবর্ধন, উমাপতি-ধর এবং জয়দেবের কথা একটু বিশদভাবে পৃথক পৃথক করিয়া বলা যাইতে পারে।

শরণ

শরণ বা শরণদেবের ২০টি শ্লোক সদুক্তিকর্ণামৃতে (বা সুক্তিকর্ণামৃতে) উদ্ধার করা হইয়াছে; তন্মধ্যে একটি শ্লোকে শরণ জনৈক সেনা-বংশতিলকের রাজত্বে বাসের ইঙ্গিত দান করিয়াছেন; অপর একটি শ্লোকে গৌড়লক্ষ্মী-প্রসঙ্গে চেদি, কলিঙ্গ কামরূপ এবং ম্লেচ্ছরাজের পরাজয়ের ইঙ্গিত আছে (এই শ্লোকটি রাজবৃত্ত-প্রসঙ্গে উদ্ধার করিয়াছি)। জয়দেব বলিতেছেন, “শরণঃ শ্লাঘ্যে দুরূহ-দ্রুতে”– কবি শরণ দুরূহ দ্রুত শ্লোকবন্ধনে শ্লাঘ্য ও প্রশংসনীয়।

ধোয়ী কবিরাজ

ধোয়ী (বা ধোই, ধোয়ীক, ধূয়ী)-কবিরাজ সম্বন্ধে জয়দেব বলিতেছেন, “বিশ্রুতঃ শুতিধরে ধোয়ী কবি-ক্ষমাপতিঃ”। ধোয়ী সাধারণত পবনদূত-কাব্যের রচয়িতা হিসাবেই প্রসিদ্ধিলাভ করিয়াছেন। কালিদাসের মেঘদূতের আদর্শে যত দূতকাব্য পরবর্তী কালে রচিত হইয়াছে তন্মধ্যে পবনদূত প্রাচীনতম। মন্দাক্রান্তা ছন্দে। ১০৪টি শ্লোকে ধোয়ী সুকৌশলে তাহার পৃষ্ঠপোষক লক্ষ্মণসেনের স্তুতিবাদ করিয়াছেন। লক্ষ্মণসেন নাকি দক্ষিণ-দেশে গিয়াছিলেন; সেখানে কুবলয়াবতী নামী এক গন্ধৰ্ব্ব-কন্যা তাহার প্রতি প্রেমাসক্ত হইয়াছিলেন। দক্ষিণা-মলয়াবায়ুকে দূত করিয়া বিরহিনী কুবলয়াবতী লক্ষ্মণসেনের নিকট প্রেমবার্তা প্রেরণ করিতেছেন, ইহাই পবনদূতের বিষয়বস্তু। কাব্যটির মৌলিকত্ব বিশেষ কিছু নাই, ভাব-গভীরতার পরিচয়ও স্বল্পই, তবে কোনও কোনও শ্লোকের চিত্র-গরিমা এবং কল্পনার মাধুর্য চিত্তকে স্পর্শ করে। ধোয়ী নিজেই বলিতেছেন, পবনদূত ছাড়াও তিনি অন্য একাধিক কাব্য রচনা করিয়াছিলেন; কিন্তু সে-সব কাব্য আমাদের হাতে আসিয়া পৌছায় নাই। তবে, সাদণ্ডি-কর্ণামতে তাহার রচিত ২০টি শ্লোক আছে, এবং জহলণের সূক্তিমুক্তাবলীতে আছে আরও দুইটি; এগুলি তাহার অন্যান্য কাব্যের প্রকীর্ণ শ্লোক হওয়া অসম্ভব নয়।

উমাপতি-ধর

কবি উমাপতি-ধর বল্লালসেনের পিতা বিজয়সেনের দেওপাড়া-প্রশস্তির রচয়িতা; বোধ হয় তিনি সেন-রাজসভার অন্যতম সভাকবি ছিলেন। এই প্রশস্তির চারিটি শ্লোক সদুক্তিকর্ণামৃতে উদ্ধার করা হইয়াছে! এই সংকলনে উমাপতি-পুরের নামেই আর একটি শ্লোক আছে যাহা লক্ষ্মণসেনের মাধাইনগর-পট্টোলীতেও হুবহু একই রূপে দেখিতে পাওয়া যাইতেছে। এই কারণে মনে হয়, মাধাইনগর-লিপিটিরও রচয়িতা ছিলেন উমাপতি-ধর। মেরুভূঙ্গ তাহার প্রবন্ধচিস্তামণি-গ্রন্থে বলিতেছেন, উমাপতি-ধর লক্ষ্মণসেনের অন্যতম মন্ত্রী ছিলেন। মনে হয়, বিজয়সেন হইতে আরম্ভ করিয়া লক্ষ্মণসেন পর্যন্ত তিন পুরুষ ধরিয়া উমাপতি সেন-রাজসভার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। লক্ষণসেনের নবদ্বীপ ছাড়িয়া পূর্ববঙ্গে পলায়নের পরও উমাপতি-ধর জীবিত ছিলেন এবং বিজয়ী ম্লেচ্ছরাজের সাধুবাদ করিয়া স্তুতিশ্লোকও রচনা করিয়াছিলেন! এই শ্লোকটি রাজবৃত্ত-প্রসঙ্গে উদ্ধার করা হইয়াছে। বৃদ্ধ কবির এই পরিণতির কথা অন্যত্র বলিয়াছি; এখানে আর পুনরুক্তি করিয়া লাভ নাই। সদুক্তিকর্ণামৃতে উমাপতি-ধরের নামে ৯১টি শ্লোক আছে। এই সংকলন গ্রন্থেই আর এক উমাপতির নামেও কয়েকটি শ্লোক আছে; এই উমাপতি জনৈক রাজা চাণক্যচন্দ্রের পৃষ্ঠপোষকতায় চন্দ্রচূড়-চরিত নামে একটি কাব্য রচনা করিয়াছিলেন। এই দুই উমাপতি এক এবং অভিন্ন হওয়া বিচিত্র নয়। দেওপাড়া-লিপিতে উমাপতি-ধর সম্বন্ধে বলা হইয়াছে, শব্দজ্ঞান ও শব্দার্থবোধ দ্বারা এই কবি পরিশুদ্ধবুদ্ধি ছিলেন; আর জয়দেব বলিতেছেন, উমাপতি-ধরের লেখনীতে বাক্য যেন পল্লবিত হইত (বাচঃ পল্লবয়তি)।

আচাৰ্য গোবর্ধন

গোবর্ধনাচার্য আর্য-সপ্তশতীর কবি বলিয়াই সর্বভারতে প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছেন। এই শৃঙ্গার কাব্যটি জনৈক সোনকুলতিলক ভূপতির পৃষ্ঠপোষকতায় রচিত হইয়াছিল, এবং এই কাব্যেই খবর পাইতেছি, গোবর্ধনের পিতার নাম ছিল নীলাম্বর। তাঁহার দুই ভ্রাতা ও শিষ্যের নাম ছিল উদয়ন ও বলভদ্র। নীলাম্বর ধর্মশাস্ত্র সম্বন্ধে একখানা গ্রন্থ রচনা করিয়াছিলেন, এবং উদয়ন ও বলভদ্র গোবর্ধন-রচিত কাব্যটি রচনার কাজে সাহায্য করিয়াছিলেন। গোবর্ধন যে সুদক্ষ কবি এবং সুপণ্ডিত ছিলেন তাহা তাহার আচার্য উপাধিতেও প্রমাণ। আর্য ছন্দে রচিত সপ্তশতীর কিঞ্চিদধিক সাতশত শৃঙ্গার শ্লোকও সে-সাক্ষ্য বহন করিতেছে। কবি হালের সরস ও সহৃদয় এবং সূক্ষ্ম ইঙ্গিতময় সহজ প্রকাশের সঙ্গে গোবর্ধনাচার্যের সুচতুর এবং কষ্টকল্পিত কাব্যভঙ্গির আত্মীয়তা সুদূর। তাহা ছাড়া, আর্য ছন্দের স্মৃলিত গতিও শৃঙ্গার রসের ঘন অনুভূতি বা অর্থগৰ্ভ ইঙ্গিতকে ফুটাইয়া তুলিবার যথাযোগ্য বাহন নয়। জয়দেব অবশ্য বলিয়াছেন, ত্রুটিবিহীন শৃঙ্গারকাব্য রচনায় গোবর্ধনাচার্যের কোনও তুলনা ছিল না; কিন্তু ইহাও লক্ষণীয় যে, সদুক্তিকর্ণামৃতের শৃঙ্গারপ্রবাহে বা এই গ্রন্থের অন্যত্র কোথাও আর্য-সপ্তশতীর একটি শ্লোকও উল্পত হয় নাই। জনৈক গোবর্ধনের ছয়টি শ্লোক সদুক্তিতে আছে, কিন্তু ছয়টির একটিও সপ্তশতীর শ্লোক নয়। গোবর্ধনাচার্যের নামের শাঙ্গাধরপদ্ধতি-তে একটি এবং সূক্তিমুক্তাবলীতে একটি শ্লোক উদ্ধৃত আছে; দুটিই আর্যছন্দে রচিত এবং দু’টিই সপ্তশতীর শ্লোক। পদ্যাবলীতে গোবর্ধনাচার্যের নামে চারিটি শ্লোক আছে; তিনটি সপ্তশতীর শ্লোক; চতুর্থটি সপ্তশতীতে নাই, কিন্তু সদুক্তিকর্ণামৃতে আছে জনৈক অজ্ঞাতনানা কবির রচনা হিসেবে। মনে হয়, সংকলয়িতা শ্ৰীধরদাস আর্য-সপ্তশতীর খুব অনুরক্ত পাঠক ছিলেন। বস্তুত, সপ্তশতীর শ্লোকগুলির শৃঙ্গার রস যেন একটু বেশি দেহতাপে তপ্ত!

জয়দেব ও গীতগোবিন্দ

গীতগোবিন্দ-রচয়িতা জয়দেব এ-যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ কবি, এবং প্রতিষ্ঠা ও প্রভাবের দিক হইতে স্বল্প সংখ্যক সর্বভারতীয় কবিদের মধ্যে অন্যতম। ষোড়শ শতকে সন্ত কবি নাভাজী দাস তাহার ভক্তমাল-গ্রন্থে জয়দেবের প্রশস্তি গাহিয়া বলিতেছেন,

জয়দেব কবি নৃপচক্কবৈ, খণ্ড মণ্ডলেশ্বর আনি কবি।৷
প্রচুর ভয়ো তিহুঁ লোক গীতগোবিন্দ উজাগর।
কোক-কাব্য নবরস-সরস-শৃঙ্গার-কে আগার৷।
অষ্টপদী অভ্যাস করৈ, তিহি বুদ্ধি বঢ়াবৈ।
রাধারমণ প্ৰসন্ন হাঁ নিশ্চৈ আবৈ৷।
সন্ত-সরোরুহ-খণ্ড-কৌ পদুমাবতি-সুখ-জনক রবি।
জয়দেব কবি নৃপচক্কবৈ, খণ্ড মণ্ডলেশ্বর আনি কবি৷।

কবি জয়দেব হইতেছেন চক্রবর্তী রাজা, অন্য কবিগণ খণ্ড মণ্ডলেশ্বর মাত্র। তিন লোকে গীতগোবিন্দ প্রচুর ভাবে উজাগর বা উজ্জ্বল হইয়াছে। ইহা একাধারে কোকশাস্ত্ৰ, কাব্য, নবরাস ও সরস শৃঙ্গারের আগার স্বরূপ। যে এই গ্রন্থের অষ্ট্রপদী অভ্যাস করে তাহার বুদ্ধি বধিত হয়; রাধারমণ প্ৰসন্ন হইয়া শুনেন এবং নিশ্চয় সেখানে আসিয়া বিরাজিত হ’ন! সন্তরীপ কমলদলের পক্ষে তিনি পদ্মাবতী-সুখ-জনক রবি। কবি জয়দেব চক্রবর্তী রাজা, অন্য কবিগণ খণ্ড মণ্ডলেশ্বর মাত্র।

 

এই পর্বে এবং পরবর্তী কালেও জয়দেবের কবি-চক্রবর্তীত্বে প্রতিযোগিতার স্পর্ধ রাখেন, সত্যই এমন কেহ বড় একটা নাই। তবে, নাভাজী দাস যে তাহাকে কবি-চক্রবর্তী রাজা বলিতেছেন,তাহা রাধাকৃষ্ণ বিষয়ক মধুর কোমলকান্ত কাব্য গীতগোবিন্দের রচয়িতা হিসাবেই, যথার্থ কবি-প্রতিভার জন্য কিনা তাহা উদ্ধৃত পদগুলি হইতে বুঝা যাইতেছে না। নাভাজীর উক্তি বৈষ্ণব সন্তের স্বতস্ফুর্ত ভক্তি ও প্রেমে অনুপ্রাণিত, কাব্য ও সাহিত্য বোদ্ধার উক্তি বোধ হয় নয়। বস্তুত, সর্বভারত জুড়িয়া জয়দেবের খ্যাতি যেন একান্তই ভক্ত বৈষ্ণব সাধক কবিরূপে, এবং গীতগোবিন্দ যেন সেই সাধকের দৃষ্টিতে রাধাকৃষ্ণ লীলা প্রত্যক্ষ করিবার কামমধুর ভক্তিরসময় উপায়। রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলার উপর শ্রুতিমধুর, শৃঙ্গার-ভাবনাময়, রসাবেশময় গানের রচয়িতা হিসাবে জয়দেবের পক্ষে রসিক বৈষ্ণব-সমাজে এবং জনগণের মধ্যে প্রতিষ্ঠালাভ সহজেই সম্ভব হইয়াছিল; এবং পরে একবার যখন গীতগোবিন্দ চৈতনোত্তর গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মের অন্যতম মূল প্রেরণা বলিয়া স্বীকৃত হইল। তখন গীতগোবিন্দ হইয়া উঠিল ধর্মগ্রন্থ এবং জয়দেব হইলেন দিব্যোন্মাদ সাধক। অথচ, জয়দেব একান্তই তাহা ছিলেন না, আমাদের প্রচলিত ধারণার ভক্তি ও প্রেমোন্মাদ বৈষ্ণবও ছিলেন না। আমি আগেই বলিয়াছি, তিনি ছিলেন সাধারণ ভাবে পঞ্চোপাসক স্মার্ত ব্ৰাহ্মণ; কল্কি এবং মহাদেবও তাঁহার অকুণ্ঠ স্তুতিপূজা লাভ করিয়াছেন; তিনি যোগমার্গ সাধনার উপর কবিতা লিখিয়াছেন, শৌর্য-বীৰ্য্য-যুদ্ধ-তুৰ্য্য-সংগ্রামের উপরও কাব্য তিনি রচনা করিয়াছেন। সেই জয়দেব গীতগোবিন্দও রচনা করিয়াছিলেন, এবং সন্দেহ নাই, এ-রচনা একান্তভাবে লক্ষ্মণসেনের রাজসভার জন্য, যে-রাজসভায় রাধাকৃষ্ণর প্রেমলীলা এবং নানা প্রকারের কামকল্পনা-ভাবনাকে আশ্রয় করিয়া প্রতি সন্ধ্যায় বাররামাদের নৃত্যগীত হইত, এবং নবদ্বীপকৃষ্ণ লক্ষ্মণসেন পাত্ৰমিত্রদের লইয়া সেই নৃত্যগীত উপভোগ করিতেন। গীতগোবিন্দ, আর্য-সপ্তশতীর শৃঙ্গার রসসমৃদ্ধ শ্লোক, পবনদূত সমস্তই সেই রাজসভার বিলাসলীলাসময় সংস্কৃতির সঙ্গে আচ্ছেদ্য সম্বন্ধে যুক্ত। বাঙলা দেশ যখন অর্ধেক মুসলমানদের করতলগত তখনও বিক্রমপুরে কেশবসেনের রাজসভায় একই বৃন্দাবনলীলা অব্যাহত। ধোয়ী, জয়দেব, গোবর্ধনাচার্যের মতো প্ৰতিভাও সেই ইন্ধনে আহুতি দিবার লোভ সংবরণ করিতে পারেন নাই; অথচ সেই রাজসভার বাহিরে অন্য রসের কাব্যও তাহারা রচনা করিয়াছেন।

আসল কথা, এই পর্বের বাঙলাদেশে রাজসভায়, সামন্ত-সভায়, উচ্চতর সম্প্রদায়গুলির বহির্বাটিতে, এক কথায় উচ্চকোটি সমাজের সামাজিক আবহাওয়াটাই এই ধরনের। অন্যত্র সে-ইঙ্গিত ধরিতে চেষ্টা করিয়াছি। সংস্কৃতির কথা বলিতে বসিয়া আরও কয়েকটি তথ্যের ইঙ্গিত অন্বেষণ করা যাইতে পারে। ধোয়ীই হউন, আর শ্ৰীধরদাসই হউন, জয়দেবই হউন, আর উমাপতি-ধরই হউন, সকলেই লক্ষ্মণসেনের স্তৃতি যখন গাহিয়াছেন তখন অনিবাৰ্য্যভাবেই যেন তাঁহার তুলনা করিয়াছেন কৃষ্ণের সঙ্গে এবং সে-কৃষ্ণ মহাভারতের শ্ৰীকৃষ্ণ নহেন, মথুরা-বৃন্দাবনের রাধালীলাসহচর কৃষ্ণ। শুধু তাঁহাই নয়, সর্বত্রই, এমন কি কাশী-কলিঙ্গ-কামরূপের যুদ্ধক্ষেত্রেও তাহার সঙ্গে কেলি-লীলা যেন অবিচ্ছেদ্যভাবে যুক্ত; যেখানে লক্ষ্মণসেন সেখানেই ‘কেলি’ তাহা রাজকীয় লিপিতেই হউক, বা কবির স্তুতিতেই হউক। এ-তথ্যের ঐতিহাসিক ইঙ্গিত অবহেলা বস্তু নয়। দ্বিতীয়ত, শ্ৰীহর্যের নৈষধ-চরিত বা ধোয়ীর পবনদূত, জয়দেবের গীতগোবিন্দ বা গোবর্ধনের সপ্তশতী সর্বত্রই যেন শৃঙ্গার রসের প্রাবল্য একটু বেশি, কমলালসময় ভাবনা কল্পনার দিকে আকর্ষণ প্রবল, রুচি তরল এবং ইন্দ্ৰিয়বিলাসী। সাহিত্যের এই চিত্ৰ সাধারণ ভাবে সমসাময়িক সমাজের প্রতিফলন, সন্দেহ কি, এবং এই সমাজ রাজসভাপুষ্ট অভিজাত সমাজ। কারণ, এই সমাজের বাহিরে বৃহত্তর যে সমাজ তাহার প্রতিফলনও সমসাময়িক সংস্কৃত কাব্য-সাহিত্যে কিছু কিছু আছে; সে-সাহিত্য এমন ভাবে শৃঙ্গার রসে জারিত নয়, এমন কামলালসময় ভাবনা-কল্পনা দ্বারা অভিসিঞ্চিত নয়। তাহার দৃষ্টান্ত সদুক্তিকর্ণামৃত-গ্রন্থে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত, এবং সে-সব দৃষ্টাস্তের মধ্যে ধোয়ী, জয়দেব, গোবর্ধন, উমাপতির শ্লোকও নাই, এমন নয়। তৃতীয়ত, এ-যুগের কাব্য-সাহিত্যে ধ্বনিতত্ত্বের প্রভাব আর নাই; এ-যুগ দণ্ডী-ভামহের যুগ নয়, মৰ্ম্মট-ভট্টের রসাতত্ত্বের যুগ; রস-ই এ-যুগের কাব্যে প্রধান গুণ বলিয়া কীর্তিত। সেনা-রাজসভায় এবং সমসাময়িক অভিজাত স্তরে সেই রসই কামদহনে মদ্যের পর্যায়ে উন্নীত হইয়াছে। গীতগোবিন্দেও কিছুটা পরিমাণে সেই মদ্যই পরিবেশিত হইয়াছে, অন্তত শেষতম সর্গে। অর্বাচীন জৈন-গ্রন্থে, লোকস্মৃতিতে লক্ষ্মণসেন সম্বন্ধে যে-সব কাহিনী বিধূত, রাজকীয় লিপিমালায় এবং সমসাময়িক সভা-সাহিত্যে সেন-রাজসভার এবং উচ্চকোটিস্তরের যে-চিত্র দৃষ্টিগোচর তাহার সঙ্গে গীতগোবিন্দের নৃত্যগীতলাস্যবিলাসময়, কামভাবনাময় তরল রসের কোথাও কোনও অমিল নাই। রাজসভার সুর ও আবহের সঙ্গে সঙ্গতি রক্ষা করিয়া নৃপতি ও সভাসদদের রসাবেশনিমীলিত চক্ষুর দিকে দৃষ্টি রাখিয়া জয়দেব গীতগোবিন্দ এবং গোবর্ধন সপ্তশতী রচনা করিয়াছিলেন।

শুধু জয়দেবের গীতগোবিন্দই নয়। প্রায় সমসাময়িক কাল বা কিছু পরবর্তী কালে রচিত ব্ৰহ্মবৈবর্ত-পুরাণেও ঘন কামনাবাসনাময় আবহের মধ্যে রাধাকৃষ্ণ-লীলাকে আশ্রয় করিয়া একই সঙ্গে ইন্দ্ৰিয়-কামনা ও প্ৰেমভক্তির জয়-ঘোষণার ইঙ্গিত সুস্পষ্ট। এ-ক্ষেত্রেও সামাজিক আবহাওয়ার প্রতিফলন অনস্বীকার্য।

কিন্তু পরবর্তী কালে রূপ-গোস্বামীর রাসব্যাখ্যায় প্রভাবান্বিত হইয়া গৌভীয় বৈষ্ণব সমাজ গীতগোবিন্দের মধ্যে নূতন অর্থসন্ধান লাভ করিলেন; গীতগোবিন্দ নূতন মর্যাদা ও প্রতিষ্ঠা লাভ করিল এবং অন্যতম ধর্মগ্রন্থ পর্যায়ে উন্নীত হইল। তাহার আগেই ভক্ত বৈষ্ণবসমাজ এই গ্রহকে কিছুটা ধর্মগ্রন্থের মর্যাদা দান করিয়াছিল। প্রধানত তাহারই ফলে সমগ্র উত্তর-ভারত জুড়িয়া গীতগোবিন্দের প্রতিষ্ঠা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরিয়া অব্যাহত ছিল, সমগ্র বৈষ্ণব-সমাজের মধ্যে তো বটেই, অন্যান্য ধর্ম-সম্প্রদায়ের মধ্যেও, বিশেষ ভাবে সেই সব সম্প্রদায়ে যাহাদের প্রধান আশ্রয় ভক্তি ও প্রেম। তাহারই ফলে জয়দেব সহজিয়া সম্প্রদায়েরও আদিগুরু, নব রসিকের অন্যতম রসিক। বল্লভাচারী সম্প্রদায়ও গীতগোবিন্দকে অন্যতম ধর্মগ্রন্থ বলিয়া স্বীকার করেন। বল্লভাচার্যের পুত্র  বিঠ্‌ঠলেশ্বর গীতগোবিন্দের অনুকরণেই তাহার শৃঙ্গাররসমণ্ডন-গ্ৰন্থ রচনা করেন। প্রধানত এই কারণেই ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রদেশে বিভিন্ন সময়ে গীতগোবিন্দের চল্লিশ খানারও উপর টীকা রচিত হইয়াছে, অনুকরণে দশ-বারোখানা কাব্য রচিত হইয়াছে এবং বিভিন্ন সংকলন-গ্রন্থে বারবার গীতগোবিন্দ হইতে অসংখ্য শ্লোক উদ্ধৃত হইয়াছে। গীতগোবিন্দের জনপ্রিয়তার ইহার চেয়ে বড় সাক্ষ্য আর কী হইতে পারে? গীতগোবিন্দের অন্যতম প্রাচীন প্রসিদ্ধতম টাকা মোবাড়পতি মহারাণা কুম্ভের নামে প্রচলিত রসিকপ্রিয়া (১৪৩৩-১৪৬৮ খ্ৰী.) পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের একটি ওড়িয়া শিলালেখা হইতে (১৪৯৯) জানা যায়, মহারাজ প্রতাপরুদ্রের আদেশে ঐ সময় হইতে গীতগোবিন্দের গান ও শ্লোক ছাড়া জগন্নাথ-মন্দিরে অন্য কোনও গান ও শ্লোক গীত হইতে পারিত না।

গীতগোবিন্দের লোকপ্রিয়তার অন্যতম প্রধান কারণ, ইহার পদ বা গীতগুলির ভাষা। এই কাব্যে প্রাচীন সংস্কৃত কাব্যের ভাষা এবং পরবর্তী ও সমসাময়িক কালের অপভ্রংশ ও ভাষা-কাব্যের ভাষা এক উদ্বাহ বন্ধনে আবদ্ধ। আখ্যায়িকা বা বর্ণনামূলক অংশ সংস্কৃত কাব্যের ধারা অনুসরণ করিয়াছে- ভাবে, ভাষায় ও শব্দে; কিন্তু পদ বা গীতগুলির সমস্ত আবহাওয়াটা অপভ্ৰংশ ও ভাষা থকাব্যের; ছন্দ এবং মিলও সেই কাব্যেরই। ছন্দ তো পরিষ্কার মাত্রাবৃত্ত, সংস্কৃত কাব্যের অক্ষরবৃত্ত নয়। ছত্রের অন্ত্য এবং আভ্যন্তর অক্ষরের মিলও অপভ্রংশ ও ভাষা-কাব্যের রীতি অনুসরণ করিয়াছে। শ্লোকগুলি একে অন্য হইতে বিচ্ছিন্ন নয়; অন্ত মিল এবং ধুয়া মিলিয়া প্রত্যেকটি গীতাংশের একটি সমগ্র রূপ খুব সুস্পষ্ট। এই সমগ্র রূপ একান্তই ভাষা-কাব্যের বৈশিষ্ট্য; সংস্কৃতে এই রূপ অনুপস্থিত। সেই জন্যই মনে হয়, কাব্যের এই রূপ জয়দেব গ্রহণ করিয়াছিলেন লোকায়ত চলিত ভাষা-সাহিত্য হইতে। জযদেবের কালে সংস্কৃত কাব্য ও নাট্য-সাহিত্যের অবস্থা বদ্ধ জলাশয়ের মতো; জয়দেবই বোধ হয় সর্বপ্রথম সেই সাহিত্যে নূতন স্রোত সঞ্চার করিলেন, লোকায়ত চলিত-সাহিত্যের গান ও গীতিনাট্যের খাত কাটিয়া। সেই লোকায়ত ভাষা-সাহিত্যে গান ও অভিনয় লইয়া এক ধরনের যাত্ৰা প্ৰচলিত ছিল এবং এই সময়ের সংস্কৃত কাব্য-সাহিত্যে তাহার প্রভাব অত্যন্ত সুস্পষ্ট, ভাষা এবং সাহিত্যরূপ উভয়ত। রামকৃষ্ণের গোপালকেলিচন্দ্ৰিকা, উমাপতি-উপাধ্যায়ের পারিজাত-হরণ, মহানাটক প্রভৃতি সমস্তই এই ভাষা সাহিত্যরূপের নিদর্শন; কিন্তু গীতগোবিন্দ ইহাদের সকলের আদিতে।

সমসাময়িক কালে একদিকে সেনা-রাজসভা ও উচ্চকোটির সমোজস্তর এবং অন্যদিকে ঘনায়মান অন্ধকারের প্রেক্ষাপটে জয়দেব গীতগোবিন্দ রচনা করিয়া সামাজিক কর্তব্য পালন করিয়াছিলেন। কিনা সে-সম্বন্ধে প্রশ্ন অনিবার্য হইলেও, জয়দেব যে যুগন্ধর ও সৃষ্টিধর কবি ছিলেন এবং তাঁহার গীতগোবিন্দ যে ভারতবর্ষের অন্যতম শ্রেষ্ঠ গীতিকাব্য, এ-সম্বন্ধে সন্দেহের অবকাশ কম। প্রথমত, তাহার লেখনীতে সংস্কৃতে কাব্যভাষার অপভ্রংশ ও ভাষাধর্মী সদ্যোক্ত রূপান্তর প্রায় বৈপ্লবিক বলিলেও চলে। দ্বিতীয়ত, অলৌকিক দেবকাহিনী ও লৌকিক প্রেমগাথার এরূপ সমন্বয় ইতিপূর্বে ভারতীয় সাহিত্যে আর দেখা যায় নাই; গীতগোবিন্দের এই সমন্বয় ধারায়ই পরবর্তী বৈষ্ণব মহাজন-পদাবলীর উদ্ভব। এই সমন্বয়ই মধ্যযুগের হিন্দু সাংস্কৃতিক নবজাগরণের মধ্যযুগীয়হিউম্যানিজমের মূলে। অলৌকিক দেবতাদের এইরূপ মানবীকরণের ইঙ্গিত বহুলভাবে জয়দেবই প্রথম সূচনা করিলেন। অন্য কবিদের রচিত সদুক্তিকর্ণামৃতের দু’চারটি প্রকীর্ণ শ্লোকেও সে-ইঙ্গিত কিছু কিছু পাওয়া যায়। তৃতীয়ত, সন্দেহ নাই, গীতগোবিন্দ একান্তই গীতিকাব্য, কিন্তু তৎসত্ত্বেও স্বীকার করিতেই হয়, লোকায়ত নাট্যাভিনয়ের (যাত্রার?) নাটকীয় লক্ষণও কিছুটা এই কাব্যে বর্তমান, বিশেষত রাধার সখীদের অথবা স্বয়ং রাধা ও কৃষ্ণের কথোপকথনাত্মক গীতাংশে। বস্তুত, গীতগোবিন্দে বর্ণনা-বিবৃতি, আলাপ বা কথোপকথন, এবং গীত এই তিনটি একসঙ্গে একই কাব্য বা সাহিত্যরূপের মধ্যে সমন্বিত। এই রূপও একান্তই অভিনব এবং সংস্কৃত সাহিত্যে অজ্ঞাত। চতুর্থত, কাব্যটির বিষয়বস্তু ধৰ্মগত, কিন্তু লৌকিক ইন্দ্ৰিয়কামনার এমন রসাবেশময় ব্যঞ্জনা সংস্কৃত-সাহিত্যে বিরল। বস্তুত মৌলিক যৌনকামনার এমন অপূর্ব ভক্তিরসময় রূপান্তর মধ্যযুগীয় বাঙলার পদাবলী-সাহিত্য ছাড়া আর কোথাও দেখা যায় না। পঞ্চমত, গীতগোবিন্দ একাধারে পদ-কাব্য (মধুর কোমলকান্ত পদাবলীং) এবং মঙ্গলকাব্য (শ্ৰীজয়দেব কবেবিদন কুরুতে মুদং মঙ্গলম উজ্জ্বল-গীতি), এবং এই হিসাবে পরবর্তী বাঙলা পদাবলী-সাহিত্য এবং মঙ্গলকাব্য-সাহিত্য এই দুই সাহিত্যধারার আদিতে গীতগোবিন্দের স্থান।

সদুক্তিকর্ণামৃত-গ্রন্থে জয়দেবের ৩১টি শ্লোক উদ্ধার করা হইয়াছে; তন্মধ্যে ৫টি মাত্র গীতগোবিন্দ হইতে, এ-কথা আগেই বলিয়াছি। অনুমান হয়, তিনি অন্য এক বা একাধিক কাব্যও রচনা করিয়াছিলেন। জয়দেবের রচিত দুইটি কবিতা শিখদের শ্ৰীগুরুগ্ৰন্থ বা গ্ৰন্থসাহেব (ষোড়শ শতক) স্থান পাইয়াছে, তন্মধ্যে একটি যোগমার্গের পদ। সদুক্তিকর্ণামৃতে কল্কির উপরও জয়দেব-রচিত একটি পদ আছে।

জয়দেবের পিতার নাম ছিল ভোজদেব, মাতা রামাদেবী (পাঠান্তরে, বামাদেবী, রাধাদেবী); তাহার জন্মস্থান কেন্দুবিন্ধ (অজয়-নদের তীরে কেদুঁলি গ্রাম)। স্ত্রীর নাম বোধ হয় ছিল পদ্মাবতী। কবির বন্ধু এবং তাঁহার গানের দোহার বা গায়েন ছিলেন পরাশর। জয়দেবের সম্বন্ধে নানা কাহিনী সমগ্র উত্তর-ভারতে প্রচলিত; নাভাজী দাসের ভক্তমাল (সপ্তদশ শতক)-গ্রন্থে ও চন্দ্ৰদত্তের ভক্তমালায় কিছু কিছু এই সব কাহিনীর বিবৃতি আছে। কাহিনীগুলির মধ্যে পদ্মাবতীর কাহিনী সুপরিচিত। পদ্মাবতীর পিতার ইচ্ছা ছিল কন্যাকে দেবদাসীরূপে জগন্নাথ-মন্দিরে সমর্পণ করিবেন, কিন্তু নারায়ণকর্তৃক স্বপ্নাদিষ্ট হইয়া জয়দেবের সঙ্গে তাহার বিবাহ দেন। ‘দেহিপদপল্লবমুদারম’-সংক্রান্ত আখ্যায়িকাটিও বাঙলাদেশে সুপরিচিত। গীতগোবিন্দের দুইটি পদে পদ্মাবতীর নামোল্লেখ আছে; এক জায়গায় পাইতেছি “পদ্মাবতী-রমণ-জয়দেব কবি”; অন্য জায়গায় আছে, “পদ্মাবতী-চরণচারণচক্রবর্তী”। জয়দেব গীতগোবিন্দের পদ গাহিতেন এবং পদ্মাবতী সঙ্গে সঙ্গে তালে তালে নাচিতেন, এই জনশ্রুতি ষোড়শ শতকেই স্বীকৃতিলাভ করিয়াছিল। সেকশুভোদয়া গ্রন্থেও জয়দেব-পদ্মাবতীর সম্বন্ধে একটি গল্প আছে। বাঙলাদেশের বাহির হইতে জনৈক সংগীতজ্ঞ বুঢ়নমিশ্র সেন-রাজসভায় আসিয়া জয়দেবকে সঙ্গীত-প্রতিযোগিতায় আহ্বান করেন; জয়দেবপত্নী পদ্মাবতী তাহাকে পরাজিত করিয়াছিলেন। পদ্মাবতী যে গীতিনৃত্যনিপুণা ছিলেন তাহা তাহার পিতার দেবদাসীরূপে কন্যাকে সমর্পণের বাসনায়, গীতগোবিন্দের শ্লোকে ‘পদ্মাবতীচরণ চারিণীচক্রবর্তী’ ও নাভাজী দাসের ‘পদ্মাবতীসুখজনকরবি’ এই আখ্যায় এবং সেকশুভোদয়ার এই গল্প হইতেই অনুমান করা যায়। এই সব সুবিস্তৃত কাব্য-সাহিত্য এবং প্রকীর্ণ শ্লোকাবলী ছাড়াও সেনা-বর্মণ রাজসভায় অলংকারবহুল উচ্ছসিত কাব্য রচনার পরিচয় পাওয়া যায় রাজকীয় লিপিগুলির প্রশস্তি শ্লোকাবলীতে, এবং এই সব শ্লোক প্রায় সকল ক্ষেত্রেই রাজসভাকবিদের দ্বারা রচিত। ভবদেব-প্রশস্তির কথা আগেই বলিয়াছি। বিজয়সেনের বারাকপুর-প্রশস্তি, বল্লালসেনের নৈহাটি-প্রশস্তি লক্ষ্মণসেনের আনুলিয়া, গোবিন্দপুর ও তৰ্পণদীঘি-শাসনের প্রশস্তি প্রভৃতি সমস্তই সমসাময়িক কবি-প্ৰতিভার সাক্ষ্য বহন করে।