০৪. পাল-চন্দ্ৰ পর্ব। বৌদ্ধ জ্ঞান-বিজ্ঞান। শিক্ষা ও সংস্কৃতি। শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান

পাল-চন্দ্ৰ পর্ব। বৌদ্ধ জ্ঞান-বিজ্ঞান। শিক্ষা ও সংস্কৃতি। শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান

পাল-চন্দ্ৰ পর্বে বাঙলা দেশের যথার্থ গৌরব ব্রাহ্মণ্য শিক্ষা-দীক্ষা-জ্ঞান-বিজ্ঞান-সাহিত্য সংস্কৃতিতে তত নয় যত তাহার বৌদ্ধ জ্ঞান-বিজ্ঞান-সাহিত্য-সংস্কৃতিতে। এই জ্ঞান-বিজ্ঞান-শিক্ষা-সংস্কৃতি অসংখ্য মহাযানী-বজ্রযানী-মস্ত্রযানী-সহজযানী বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যরা প্রকাশ করিয়াছিলেন সংস্কৃত, অপভ্রংশ ও প্রাচীন বাঙলা ভাষায় রচিত অগণিত গ্রন্থে। মূল গ্রন্থ অধিকাংশই আজ বিলুপ্ত কিন্তু ইহাদের তিব্বতী অনুবাদ কিছু কিছু বর্তমান এবং তিব্বতী গ্রন্থ-তালিকায় তালিকাবদ্ধ। এই সুদীর্ঘ গ্রন্থমালা তিব্বতী ঐতিহ্যে বৌদ্ধ তান্ত্রিক সাহিত্যের অন্তর্গত এবং বৌদ্ধ সূত্রসাহিত্য হইতে পৃথক। দেশীয় ব্রাহ্মণ্য ঐতিহ্যে এই সব বৌদ্ধ আচার্য এবং তাঁহাদের রচিত গ্রন্থাদির স্মৃতি একেবারে মুছিয়া গিয়াছে বলিলেই চলে। তিব্বতী গ্রন্থ-তালিকা, তিব্বতী লামা তারনাথের বৌদ্ধ ধর্মের ইতিহাস, সুমপা রচিত পাগ-সাম-জোন-জাং প্রভৃতি গ্ৰন্থই এ-সম্বন্ধে আমাদের একমাত্র উপাদান।

মহাযান বৌদ্ধধর্ম ও তদোদ্ভূত অন্যান্য বৌদ্ধ যান (মন্ত্রযান, বজ্রযান, কালচক্ৰযান, সহজযান এবং নাথধর্ম, কৌলধর্ম প্রভৃতি) সম্বন্ধে ধর্মকর্ম অধ্যায়ে বিস্তারিত বিবরণ দিতে চেষ্টা করিয়াছি। বলা বাহুল্য, এই সব বিভিন্ন যান ও ধর্মমত সম্বন্ধে আমাদের জ্ঞান আজও অত্যন্ত সীমাবদ্ধ; অধিকাংশ গ্ৰন্থ এখনও অনূদিত ও আলোচিতই হয় নাই। অনুবাদ এবং আলোচনার বাধাও বিস্তর। প্রথমত, যে সংস্কৃত ভাষায় মূল গ্ৰন্থসমূহ রচিত হইয়াছিল, সে সংস্কৃত আঁত্যস্ত ব্যাকরণদোষদুষ্ট শুদ্ধ সুবোধ্য প্রাঞ্জল ভাষা ব্যবহারের কোনও বালাই-ই যেন বৌদ্ধ আচার্যদের ছিল না। তাহারা স্পষ্টই বলিতেন, বুঝিতে পারিলেই হইল; ছন্দ, ব্যাকরণ, অলঙ্কার শব্দ বা পদবীতি ইত্যাদি অশুদ্ধ বা অপ্রচলিত হইলেও কিছু ক্ষতি নাই। কালচক্ৰযানের বিমলপ্ৰভা নামে একটি টীকায় বলা হইয়াছে, বৌদ্ধ আচার্যরা স্বেচ্ছাপূর্বক সংস্কৃত ব্যাকরণের রীতি-পদ্ধতি, ছন্দ, অলংকার প্রভৃতি অমান্য করিতেন; যাহারা মানিয়া চলিতেন তাহাদের বরং ঠাট্টা-বিদ্যুপ করিতেন! ঠিক এই কারণেই তিব্বতী অনুবাদও বহুক্ষেত্রে দুর্বোধ্য এবং তাঁহা হইতে সংস্কৃতে পুর্ননুবাদ খুব সহজ নয়। দ্বিতীয়ত, এই সব প্রত্যেকটি ধর্ম গুরুনির্ভর ধর্ম, গুরু ছাড়া এই ধর্মের গুহ্য সাধন প্রক্রিয়ার রহস্য ভেদ করা অসম্ভব বলিলেই চলে, এবং দীক্ষিত ব্যক্তি ছাড়া গুরুরা অন্য কাহারও নিকট সে রহস্য ভেদ ও ব্যাখ্যা করিতেন না। সেই হেতু এই সব ধর্মের বিস্তৃতি দীক্ষিত চক্র বা মণ্ডলের মধ্যেই ছিল সীমাবদ্ধ; সর্বসাধারণ সেই সীমার মধ্যে প্রবেশ করিতেই পারিত না। গুরুরা দীক্ষিতদের নিকট এবং দীক্ষিতারা পরস্পরের মধ্যে তাঁহাদের গুহ্যসাধনা সম্বন্ধে যে-ভাষায় কথা বলিতেন সে-ভাষাও ছিল গুহ্যভাষা। যে-ভাষার নাম ছিল সন্ধাভাষা (সন্ধিভাষা), যে ভাষার শুধু ‘মৌলিক ‘সম্পূর্ণ নিগূঢ় সত্যের কথা বলে; কিন্তু যত মৌলিক, সম্পূর্ণ এবং নিগূঢ়ই হোক না কেন সে-ভাষা, অদীক্ষিত জনের কাছে তাঁহা ছিল দুর্বোধ্য। এক ভাষায় যাহা “অভিপ্রায়িক, অর্থাৎ আপাত যে অর্থ কোনও বাক্যের বা পদের, তাহাই তাহার নিগুঢ় অর্থাৎ মৌলিক, সম্পূর্ণ অর্থ নয়; মৌলিক সম্পূর্ণ উদ্দিষ্ট অর্থের দিকে তাহা ইঙ্গিত করে মাত্র। কাজেই, সে ভাষার মৌলিক উদ্দিষ্ট অর্থ ধরিতে পারা সহজ নয়। তৃতীয়ত, ইহাদের সাধনপন্থা এবং প্রক্রিয়াও ছিল অত্যন্ত গুহ্য। নানা প্রকারের যাদুমন্ত্র, যাদুপ্রক্রিয়া, নানা বিধিবিধান, সাধনমন্ত্র, মুদ্রা, মণ্ডল, ধারণী, যোগ, সমাধি প্রভৃতি লইয়া এই বৌদ্ধাচার্যরা এমন একটি রহস্যময় জগৎ গড়িয়াছিলেন, ব্রাহ্মণ্য তন্ত্র-জগতের সঙ্গে তাহার সাদৃশ্য থাকিলেও সর্বত্র সৰ্ব্বথা তাঁহা আমাদের অধিগম্য নয়। সে-জগতের সঙ্গে আমাদের পরিচিত সাধন-রীতি-পদ্ধতি, নীতি ও প্রক্রিয়ার সম্বন্ধ কমই। গুহ্য রহস্যময় সন্ধাভাষায় বৌদ্ধ আচার্যরা গুহাতর সাধন-প্রক্রিয়া ও অধ্যাত্ম অভিজ্ঞতার কথা বলিয়াছেন। চতুর্থত, যে-সব ছায়া, রূপক, উপমা, প্রতীক এবং যোগারূঢ় শব্দ আশ্রয় করিয়া ত্যাহ্বাদের সাধন-নীতি ও আদর্শ, রীতি ও প্রক্রিয়া, এবং অধ্যাত্ম অভিজ্ঞতা বর্ণিত হইয়াছে, সে-গুলি সমসাময়িক সাধারণ নরনারীদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা, যৌন-জীবন এবং যৌন-প্রক্রিয়া হইতেই আহৃত, সন্দেহ নাই, কিন্তু সেই জীবন ও প্রক্রিয়ার প্রেক্ষাপটে তাহারা যে অর্থ ও ইঙ্গিত বহন করে তাহা একান্তই আপাত অর্থ ও ইঙ্গিত, এবং সে অর্থ ও ইঙ্গিত আমাদের বর্তমান রুচি ও সংস্কারকে আঘাত করে। কাজেই স্বচ্ছ ও নির্মোহ বিজ্ঞান-দৃষ্টি লইয়া এই সুবিস্তৃত সাহিত্য অনুশীলন না করিলে পরিচিত ছায়া-উপমাকৃপক্ষ প্রতীকের পশ্চাতে, আপাত অর্থের পশ্চাতে, যে নিগূঢ় অর্থ বিদ্যমান তাহা সহজে ধরা পড়ে না।

মহাযানোদ্ভুত মন্ত্রযান, কালচক্ৰযান ও বজযনে সীমানির্দিষ্ট পার্থক্য বিশেষ কিছু কখনো ছিল না। একই বৌদ্ধাচার্য বিভিন্ন যান সম্বন্ধীয় গ্রন্থ-রচনা করিয়াছেন, এবং একাধিক যান কর্তৃক গুরু এবং আচার্য বলিয়া স্বীকৃত হইয়াছেন। শান্তিদেব, শান্তিরক্ষিত, দীপঙ্কর প্রভৃতি আচার্যরা মহাযান, বজ্রযান, মন্ত্রযান প্রভৃতি সকল যানেই স্বীকৃত, এবং বজ্রযানী-মন্ত্রযানীরা ইহাদের আপনি গুরু বলিয়া দাবিও করিয়াছেন। ঠিক একই কথা বলা চলে সহজযান, নাথধর্ম, কৌলধর্ম প্রভৃতি সম্বন্ধে। এই সব ধর্মমত ও সম্প্রদায় সমস্তই সমসাময়িক, এবং এক সম্প্রদায়ের আচার্যরা অন্য সম্প্রদায় কর্তৃক স্বীকৃতিও লাভ করিয়াছেন, এমন দৃষ্টাস্তের অভাব নাই। বিজযান ও মন্ত্রযানের অপেক্ষাকৃত প্রতিষ্ঠাবান আচার্যরা তো সকলেই সহজযান, নাথধর্ম এবং কৌলধর্মের আদি গুরু বলিয়া স্বীকৃত। সরহ বা সরহপাদ, কৃষ্ণ বা কাহ্নপাদ, শবরপাদ, লুইপাদ-মীননাথ ইহারা প্রত্যেকেই বজ্ৰযানে যেমন স্বীকৃত, তেমনই সহজযানী-নাথপন্থী-কৌলমগী প্রভৃতিরাও ইহাদের আচার্য, বা গুরু, বা প্রতিষ্ঠাতা বলিয়া দাবি করিয়াছেন। শান্তিদেব, শান্তি বা শাস্তরক্ষিত, দীপঙ্কর প্রমুখ আচাৰ্যরা গোড়ায় ছিলেন মহাযানী, পরে ক্রমশ বিবর্তিত হইয়াছিলেন বজ্রযানীরূপে, এবং যেহেতু বোজযান মহাযান হইতেই উদ্ভূত এবং তাহারই বিবর্তিত রূপ সেই হেতু ইহার মধ্যে অস্বাভাবিক বা অনৈতিহাসিক কিছু নাই। এই কারণেই নাথপন্থী বা কৌলমগীদের গুরু লুইপাদ-মীননাথ এবং সহজযানীদের লুইপাদ দুই ব্যক্তি, এমন মনে করিবারও কোনও কারণ নাই। বজ্ৰযানোভূত এই সব ধর্মমোর্গ ও সম্প্রদায় গোড়ায়ই আপনাপন বৈশিষ্ট্য লইয়া সুনির্দিষ্ট সীমায় সীমিত হয় নাই; সে-সব বৈশিষ্ট্য ক্রমশ পরে গড়িয়া উঠিয়াছে। বরং, সূচনায় ইহাদের একই ছিল ধ্যান ও আদর্শ, একই ছিল ভাব-পরিমণ্ডল, এবং যাহারা সেই ধ্যান, আদর্শ ও ভাব-পরিমণ্ডল সৃষ্টি করিলেন তাহারা পরে প্রত্যেক স্ব-স্বতন্ত্র মত ও সম্প্রদায় কর্তৃক গুরু এবং আচার্য বলিয়া স্বীকৃত হইবেন, ইহা কিছু অস্বাভাবিক নয়। তাহা ছাড়া, মন্ত্রযান-বজ্ৰযান ধর্মের মন্ত্র, মণ্ডল প্রভৃতি বাহ্যানুষ্ঠানের প্রতি সহজযানী সিদ্ধাচার্যের মনোভাব যত বিরূপই হোক না। কেন, নাথ ও কৌলধর্মের প্রতি বিরূপ হইবার তেমন কারণ কিছু ছিলনা; ইহাদের মধ্যে, মৌলিক বিরোধ স্বল্পই। ইহাদের মধ্যে, বিশেষভাবে নাথধর্মের মধ্যে একটা সমন্বয় ও স্বাঙ্গীকরণ ক্রিয়া সমানেই চলিতেছিল। নাথধর্ম ছিল কতকটা লোকায়ত ধর্ম, সহজযানও কতকটা তাই। কাজেই ইহাদের মধ্যে এবং অন্যান্য লোকায়াত ধর্মের সঙ্গে পরস্পর যোগাযোগ কিছুটা ছিলই, এবং ছিল বলিয়াই ইহাদের ভিতর হইতে এবং ইহাদেরই ধ্যানাদর্শ লইয়া পরবর্তী বৈষ্ণব সহজিয়া-ধর্ম, শৈব, নাথাযোগী সম্প্রদায়, আউল-বাউল প্রভৃতি সম্প্রদায় ও মতামতের উদভূব সম্ভব হইয়াছিল। ধৰ্মকৰ্ম-অধ্যায়ে এ-সম্বন্ধে আলোচনা করিয়াছি, এখানে আর পুনরুক্তি করিয়া লাভ নাই।

এই সব মহাযানী-কালচক্রযানী-মন্ত্রযানী-বজ্রযানী-সহজযানী আচার্যদের দেশ ও কাল সম্বন্ধে এবং ইহাদের রচিত গ্রন্থাদি সম্বন্ধে সুনির্দিষ্ট তথ্য সংগ্রহ অত্যন্ত দুরূত্ব ব্যাপার। ইহাদের মধ্যে যাহারা দেশ ছাড়িয়া দূরে অন্যত্র নিজেদের কর্মক্ষেত্র বিস্তৃত করিয়াছিলেন। তঁহদের সমস্ত তথ্যই প্রায় বিলুপ্ত হইয়া গিয়াছে। তিব্বতী গ্ৰন্থ-তালিকায় অনেকের জন্ম ও কর্মভূমি উল্লেখিত আছে, কিন্তু অনেকের নাইও। কিন্তু র্যাহ্বাদের আছে তাহাদেরও জন্ম-কর্মভূমির স্থান-নাম সর্বদা এবং সৰ্ব্বত্র শনাক্ত করা সহজ নয়; এ-সম্বন্ধে পণ্ডিতদের মধ্যে মতভেদ বর্তমান; কিন্তু তৎসত্ত্বেও যাহাদের সম্বন্ধে সুনির্দিষ্ট উল্লেখ বিদ্যমান এবং যে-সব স্থান-নামের শনাক্তকরণ সুনির্ধারিত, তাহার উপর নির্ভর করিয়া নিঃসংশয়ে বলা চলে, এই সব আচাৰ্য্যরা অধিকাংশই ছিলেন বাঙলা দেশের অধিবাসী, স্বল্পসংখ্যক কয়েকজনের জন্মভূমি ছিল কামরূপ, ওড্রদেশ, বিহার এবং কাশ্মীর। এই তথ্যের উপর নির্ভর করিয়াই ইহাও বলা চলে যে, এই তান্ত্রিক বৌদ্ধ ধর্মের লীলাভূমি ছিল প্রাচ্য-ভারত, বিশেষ ভাবে বাঙলা দেশ। যে-সব মহাবিহারে বসিয়া বৌদ্ধ আচার্যরা অগণিত গ্রন্থাদি রচনা করিয়াছিলেন তাহদের ভিতর নালন্দা, ওদন্তপুরী ও বিক্রমশীল ছাড়া অন্য প্রত্যেকটি মহাবিহারই ছিল বাঙলা দেশে। সমসাময়িক বাঙালীর শিক্ষা-দীক্ষা, জ্ঞান-বিজ্ঞান, সাহিত্য-সংস্কৃতির অন্যান্য সুবৃহৎ কেন্দ্র ছিল জগদ্দল, সোমপুর, পাণ্ডুভূমি, ত্ৰৈকূটক, বিক্রমপুরী, দেবীকোট, সন্নগর, ফুল্লহরি, পণ্ডিত, পট্টিকেরক প্রভৃতি বিহারে; এ-সংবাদও পাইতেছি তিব্বতী বৌদ্ধ গ্ৰন্থতালিকা হইতেই। এই পর্বের নালন্দা, ওদন্তপুরী এবং বিক্রমশীল মহাবিহারও বাঙালী ও বাঙলা দেশের রাষ্ট্ৰীয় ও সংস্কৃতি সীমার অন্তর্গত। বিক্রমশীল বিহারের প্রতিষ্ঠাতাই তো ছিলেন পাল-রাজ ধর্মপাল স্বয়ং এবং ওদন্তপুরী ও নালন্দায় এ-পর্বের বিদ্যাখী ও আচার্যদের অধিকাংশই বাঙালী। নালন্দা ও ওদন্তপুরীর প্রধান পৃষ্ঠপোষকও বাঙলার পাল-বংশ। এই সব বৌদ্ধতান্ত্রিক আচার্যদের স্থিতিকাল সম্বন্ধে নির্দিষ্ট সন-তারিখ নির্ণয় কঠিন হইলেও একেবারে অসম্ভব নয়। কোনও কোনও গ্রন্থ-রচনার তারিখ উল্লিখিত আছে; সমসাময়িক বা পূর্বতন আচার্যদের ও রাজা-রাজবংশের উল্লেখের এবং গুরুপরম্পরনির্ধারণের সাহায্যে মোটামুটি ইহাদের কালনির্ণয়ের একাধিক চেষ্টা হইয়াছে। তাহার উপর নির্ভর করিয়া বলা চলে, উল্লিখিত বৌদ্ধ আচার্যদের স্থিতিকাল এবং বৌদ্ধ তান্ত্রিক গ্রন্থাদির রচনাকাল মোটামুটি অষ্টম শতক হইতে একাদশ শতকের শেষপাদ পর্যন্ত বিস্তৃত। বিশেষভাবে পাল-পর্বই যে বৌদ্ধ তান্ত্রিক ধর্মের উদ্ভব, প্রসার ও প্রভাব কাল তাহা তিব্বতী গ্ৰন্থ-তালিকা, তারনাথের ইতিহাস এবং সুমপোর পাগ-সাম-জোন-জঙ-গ্রন্থের সাক্ষ্যেও সুপ্রমাণিত।

উল্লিখিত বৌদ্ধ আচার্যরা যে শুধু অবলোকিতেশ্বর, তারা, মঞ্জুশ্ৰী, লোকনাথ, হেরুক, হেবজ, প্রভৃতি বিচিত্র দেবদেবীর সাধনমন্ত্র, স্তোত্র, সংগীতি, মন্ত্র, মুদ্রা, মণ্ডল, যোগ, ধারণী, সমাধি প্রভৃতি লইয়াই গ্রন্থ-রচনা করিয়াছিলেন তাহাই নয়, যোগ ও দর্শন হেতুবিদ্যা ও চিকিৎসা-বিজ্ঞান, জ্যোতিষ ও শব্দবিদ্যা প্রভৃতি সম্বন্ধেও নানা গ্ৰন্থ রচনা করিয়াছিলেন। কাজেই, এই সব গ্রন্থের মধ্যেই সমসাময়িক জ্ঞান-বিজ্ঞান-শিক্ষা-দীক্ষাও প্রতিফলিত।

উদ্দীযান জাহোর সাহোর

বলিয়াছি, এই সব বৌদ্ধ আচার্যরা প্রায় সকলেই ছিলেন বাঙালী, এবং ইহাদের কর্মভূমি ছিল পূর্ব-ভারত, প্রধানত প্রাচীন বাঙলা দেশ ও বিহার। কিন্তু বাঙালী বলিয়া দাবি করিবার আগে দুইটি স্থান-নাম সম্বন্ধে একটু আলোচনা প্রয়োজন। মহাযান-বজ্ৰযান-মন্ত্রযান প্রভৃতিকে আশ্রয় করিয়া এক সুবিপুল সংস্কৃত সাহিত্যের উদ্ভব ও প্রসার লাভ ঘটিয়াছিল, তাহার কিয়দংশ মাত্র তিব্বতী ভাষায় অনূদিত হইয়াছিল বাঙলা, বিহার, কাশ্মীর ও তিব্বতের নানা বৌদ্ধ বিহারে। এই অনূদিত গ্রন্থগুলির একটি তালিকা ত্রয়োদশ শতকে সংকলিত হইয়াছিল তিব্বতে, তিব্বতী লামা বু-তোন কর্তৃক; তালিকা-গ্রন্থটির নাম ত্যাঙ্গুর। এই অনুদিত গ্রন্থগুলির অধিকাংশই কালের প্রভাব এড়াইয়া আজি বীচিয়া আছে; মূল সংস্কৃত গ্রন্থগুলিরও কিছু কিছু পাওয়া গিয়াছে নেপালে এবং অন্যত্র। গ্রন্থগুলির অধিকাংশই বৃজযানী সাধন-সম্পর্কিত; তিব্বতীতে বলা হইয়াছে বৌদ্ধতন্ত্র বা র্‌গুদ (Rgyud); কিছু বৌদ্ধ সূত্র সম্বন্ধীয় বা ম্‌দো (Mdo)। যাহা হউক, এই সব গ্রন্থ-লেখকদের কাহারও কাহারও জন্মভূমি ছিল জাহোরে বা সাহেরে এবং উড্রউয়ানে, এবং লোকায়াত ঐতিহ্যমতে উদ্ভট্টীয়ানেই বজ্ৰযানের উদ্ভব। উদ্ভট্টীয়ান যে কোন স্থান তাহা লইয়া পণ্ডিত-মহলে প্রচুর মতভেদ বিদ্যমান। কাহারও মতে উড়াউীয়ান উত্তর-পশ্চিম সীমাপ্ত ও হিন্দুকুশের মধ্যবর্তী সোয়ান্টু উপত্যকায়, কাহারও মতে পূর্ব-তুৰ্কীস্থানের কাসাগরে, কাহারও মতে বাঙলা দেশে, কাহারও মতে বাঙলার পূব-সীমান্তে, আবার কাহারও মতে উড়িষ্যায়! এই সব বিভিন্ন মতামতের অরণ্য জাল ভেদ করিয়া সত্য নির্ণয় দুরূহ। তবে, একটি তথ্যের দিকে পণ্ডিত-সমাজের দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়াছেন। নলিনীনাথ দাশগুপ্ত মহাশয়। ত্যাঙ্গুরে সরোহ (বক্রুজ) বা সূরহকে বলা হইয়াছে উদ্ভট্টীয়ান-বিনির্গত, কিন্তু পাগ-সাম-জোন-জাং-গ্রন্থে আবার সেই সরহকে বলা হইয়াছে বঙ্গালের অধিবাসী। তাঙ্গুরের এক অংশে যে অবধূতপাদ অদ্বয়বজকে বলা হইয়াছে উদ্ভট্টীয়ানবাসী বলিয়া, সেই তাঙ্গুরেরই অন্য অংশে সেই অদ্বয়বজকেই বলা হইয়াছে বাঙালী। পাগ সাম-জোন-জাং-গ্রন্থে যে লুইপাদকে বলা হইয়াছে উদ্ভট্টীয়ান বিনির্গত, ত্যাঙ্গুরে সেই লুইপাদকেই বলা হইয়াছে বাঙলার অধিবাসী। তাঙ্গুরে যে তৈলিকপাদকে বলা হইয়াছে উদ্ভট্টীয়ানবাসী, সেই তৈলিকপাদকেই পাগ-সাম-জোন-জাং-গ্রন্থে চট্টগ্রামীয় এক ব্ৰাহ্মণ বলিয়া বর্ণনা করিতেছেন। আবার, পাগ-সাম-জোন-জাং-গ্রন্থে নাগবোধির বাড়ি বলা হইয়াছে বরেন্দ্রর শিবসের গ্রামে; অথচ নাগবোধি স্বয়ং নিঞ্জের বর্ণনা দিয়াছেন উড়াউীয়ান বিনিৰ্গত বলিয়া। এত সব সাক্ষ্যের পর উড্ডীয়ান যে বাঙলা দেশের কোনও স্থান নয় এ কথা বলিতে একটু দ্বিধা হয় বই কি?

জাহোর বা সাহের সম্বন্ধেও একই সংশয়। সাহোরকে কেহ কেহ মনে করেন লাহোর, কেহ। বলেন হিমাচলের মণ্ডি, কেহ মনে করেন বাঙলার যশোর বা ঢাকা জেলার সাভার; আবার কেহ। কেহ মনে করেন। সমগ্র হিন্দস্তানেরই নাম জাহোর বা সাহোর। পাগ-সাম-জোন-জং-গ্ৰন্থ একবার শাস্তুরক্ষিতের পরিচয় দিয়াছে বাঙালী বলিয়া, আর একবার বলিতেছে, তিনি ছিলেন সাহেরের রাজ-পরিবারের সন্তান। অন্যত্র তিব্বতী ঐতিহো শাস্তুরক্ষিতকে স্পষ্টতই বলা হইয়াছে গৌড়ের অধিবাসী; তিব্বতী জনশ্রুতি মতে ধর্মপাল ছিলেন সাহোরের রাজা, এবং আর এক তিব্বতী ঐতিহ্যে বাঙালী দীপঙ্কর সম্বন্ধেও বলা হইয়াছে, তিনি ছিলেন সাহোর-রাজবংশোদ্ভূত। আনুমানিক ১৪০০ খ্ৰীষ্ট শতকে বাঙালী স্মর্ত পণ্ডিত শূলপাণিও আত্মপরিচয় দিয়াছেন সাহুরিয়ান বলিয়া। এই সব সাক্ষ্যে মনে হয়, জাহোর বা সাহেরও বাঙলাদেশেরই কোনও স্থান।

এই সব বাঙালী বৌদ্ধ আচার্যদের কাল সম্বন্ধেও নিঃসংশয় হওয়া কঠিন। তবু তিব্বতী ঐতিহ্য ও অন্যান্য সংক্ষ্যের উপর নির্ভর করিয়া কিছু কিছু কাল-নির্ণয়ের চেষ্টা হইয়াছে। এই সধ প্রচেষ্টা আশ্রয় করিয়া অগণিত বৌদ্ধ আচার্যদের মধ্যে স্বল্পমাত্র কয়েকজনের সংক্ষিপ্ত পরিচয় লওয়ার চেষ্টা করা যাইতে পারে কতকটা আনুমানিক কালক্ৰমনুযায়ী।

বজ্রযানী তান্ত্রিক ও সিদ্ধাচাৰ্য আচাৰ্য-কুল। তাঁহাদের রচনা। অষ্টম-নবম শতক

প্রাচীনতম বজ্রযানী বৌদ্ধ আচার্যদের মধ্যে শান্তিরক্ষিত অন্যতম। সুমপা-বর্ণিত তিব্বতী ঐতিহ্যমতে শান্তিরক্ষিত ছিলেন জাহোর-রাজবংশের সন্তান। গোপালের রাজত্বকালে তাঁহার জন্ম, ধর্মপালের রাজত্বকালে মৃত্যু। শাস্তিরক্ষিতের জন্মভূমি বাঙলাদেশে হউক বা না হউক, তাহার কর্মভূমি যে ছিল প্ৰাচুৰ্য-ভারত এ-সম্বন্ধে সন্দেহের অবকাশ কম। তাঙ্গুর গ্রন্থ-তালিকায় দেখা যায়, তিনি অন্তত তিন খানা বৌদ্ধ তান্ত্রিক গ্ৰন্থ রচনা করিয়াছিলেন; অষ্টতথাগতস্তোত্র, বজধার-সংগীত-ভগবত-স্তোত্ৰটীকা এবং পঞ্চমহোপদেশ। তাহার অন্য নাম ছিল আচার্য বোধিসত্ত্ব, এবং সেই নামেও সপ্তস্তথাগত সম্বন্ধে আরও চারখানি বই তিনি লিখিয়াছিলেন। তিব্বতী ঐতিহ্যে এই বজ্রযানী বৌদ্ধ আচার্য শান্তিরক্ষিত এরং মহাযানী নৈয়ায়িক ও দার্শনিক শান্তিরক্ষিত একই ব্যক্তি। নৈয়ায়িক শান্তিরক্ষিত ছিলেন স্বতন্ত্র মধ্যমক মতের অনুগামী এবং নালন্দা-মহাবিহারের অন্যতম আচার্য। তিনি সুপ্ৰসিদ্ধ তত্ত্বসংগ্ৰহ, বাদনায়বৃত্তি-বিপঞ্চিতাৰ্থ এবং মধ্যম-কালঙ্কার-কারিকা প্রভৃতি গ্রন্থের প্রখ্যাত লেখক। তাঁহার অগাধ পণ্ডিত্য ও মনীষা এবং বৌদ্ধ ব্রাহ্মণ্য অধ্যাত্মচিন্তায় সুগভীর জ্ঞান সদ্যোক্ত তিনটি গ্রন্থে সুপরিস্ফুট। তাহার শিষ্য কমলশীল প্রথমোক্ত গ্রন্থটির একটি টীকা রচনা করিয়াছিলেন। এই কমলশীল ছিলেন লুই-পা বা লুইপাদের সমসাময়িক। তিব্বতী ঐতিহ্যমতে শাস্তিরক্ষিতের ভগ্নিপতি ছিলেন উদ্ভট্টীয়ান বা ওডউীয়ানবাসী রাজকুমার পদ্মসম্ভব।

তিব্বতী ঐতিহ্যমতে শাস্তিরক্ষিতের খ্যাতি ভারতবর্ষের বাহিরেও ছড়াইয়া পড়িয়াছিল। এই সময় (অষ্টম শতকের মাঝামাঝি) তিব্বতের রাজা ছিলেন বৌদ্ধধর্মানুরক্ত খ্রি-স্ৰং-লান্দ-বৃৎসান এবং শান্তিরক্ষিত কোনও কার্যব্যাপদেশে ছিলেন নেপালে। খ্রি-স্ৰাং-লান্দ-বৎসান কর্তৃক আমন্ত্রিত হইয়া শান্তিরক্ষিত গেলেন তিব্বতে, কিন্তু তিব্বত তখন যাদু ও ভূতপ্রেতিবাদের এবং নানা গুহ্যসাধনার কেন্দ্ৰ। শান্তরক্ষিতের বৌদ্ধ ধর্মের কথায় কেহ কৰ্ণপাত করিল না। তিনি ফিরিয়া গেলেন নেপালে; কিন্তু কিছুদিন পরই আবার আমন্ত্রিত হইয়া যাইতে হইল তিব্বত। কিছুদিন পর তাহারই নির্দেশে তিব্বত-রাজ পদ্মসম্ভবকেও আমন্ত্ৰণ করিয়া তিব্বতে লইয়া আসিলেন। তখন শান্তিরক্ষিত ও পদ্মসম্ভব দুইজনে মিলিয়া সেখানে বৌদ্ধ ধর্মের প্রতিষ্ঠা করিলেন; তিব্বতে লামা শ্রেণীর সৃষ্টি হইল, এবং সকৃতজ্ঞ খ্রি-স্ৰং-লদে-বৎসান মগধের ওদন্তপুরী বিহারের আদর্শে ব্‌সম-য়া (Bsam-ya) বিহার প্রতিষ্ঠা করিলেন, শান্তিরক্ষিত হইলেন সেই বিহারের প্রথম সংঘাচার্য। পদ্মসম্ভব কিছুদিন পর ধর্মপ্রচারোদেশে অন্যত্র চলিয়া গেলেন। প্রায় তেরো বৎসর প্রচার ও গ্রন্থাদি রচনার পর এক চীনা শ্রমণ তিব্বতে আসিয়া বৌদ্ধ ধর্মের অন্য আর একটি নিকায় প্রচার করিতে আরম্ভ করেন। শান্তিরক্ষিত সেই শ্রমণের সঙ্গে বিচারে প্রবৃত্ত হইয়াছিলেন, কিন্তু তর্কে তাহার সঙ্গে আঁটিয়া উঠিতে না পারিয়া খ্রি-স্ৰং-লদে-বৃৎসানকে অনুরোধ করিলেন মগধ হইতে কমলশীলকে আমন্ত্ৰণ করিয়া আনিবার জন্য। কমলশীল তিব্বতে আসিয়া চীনা শ্রমণকে তর্কযুদ্ধে হারাইয়া ( শান্তিরক্ষিতের মতবাদ পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করিলেন।

শান্তিদেব

শান্তিরক্ষিত-শান্তরক্ষিতের অভিন্নত্ব সমন্ধে যে-সমস্যা সে-সমস্যা বজ্রযানী গ্রন্থের লেখক তান্ত্রিক শাস্তিদেব এবং শিক্ষা সমুচ্চয় ও বোধিচর্যবিতার-রচয়িতা প্রসিদ্ধ মহাযানী আচার্য শান্তিদেব সম্বন্ধেও বিদ্যমান। তারমাথের মতে মহাযানী শান্তিদেব ছিলেন সৌরাষ্ট্রের রাজপরিবারসম্ভত। কিছুদিন তিনি রাজা পঞ্চমসিংহের অন্যতম মন্ত্রী ছিলেন; পরে তিনি নালন্দা-বিহারে আসিয়া আচার্য জয়দেবের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। পাগ-সাম-জোন-জাং গ্রন্থের মতে মহাযানী শান্তিদেবের বাল্যনাম ছিল শাস্তিবৰ্মা, পিতা ছিলেন কল্যাণবর্ম। এই মহাযানী আচার্য খুব সম্ভব সপ্তম-অষ্টম শতকের লোক। তাঙ্গুর গ্রন্থে বজ্রযানী তান্ত্রিক শান্তিদেবের তিনটি গ্রন্থের উল্লেখ পাওয়া যায়: শ্ৰীগুহাসমাজ-মহাযোগ-তন্ত্রাবলিবিধি, সহজঙ্গীতি ও চিত্তচৈতন্য শমনোপায়। তাঁহার বাড়ি ছিল জাহোরে। সুমপা বলিতেছেন, তান্ত্রিক শান্তিদেবের অন্য নাম ছিল ভুসুকু বা রাউতু। চর্যাগীতি-গ্রন্থের কয়েকটি গীতির রচয়িতা ছিলেন। সহজ-সিদ্ধাচার্য জনৈক ভুসুকু; সন্দেহ নাই, এই ভুসুকু ছিলেন বাঙালী। কিন্তু বজ্রযানী তান্ত্রিক শান্তিদেব ও বাঙালী সিদ্ধাচার্য ভুসুকু একই ব্যক্তি কিনা সে-সন্দেহ থাকিয়াই যায়।

শান্তিপাদ

চর্যাগীতিতে দেখিতেছি, শান্তি-পা বা শান্তিপাদনামে আর একজন বাঙালী গীত-রচয়িতা সিদ্ধাচার্য ছিলেন। এই শান্তিপাদের অন্য নাম ছিল রত্নাকর-শান্তি; তাঙ্গুর গ্রন্থ-তালিকায় দেখিতেছি, তিনি সুখদুঃখদ্বয়-পরিত্যাগসৃষ্টি নামে একটি গ্রন্থ রচনা করিয়াছিলেন; তাহা ছাড়া আরও ১৮টি তান্ত্রিক গ্রন্থেরও তিনি ছিলেন লেখক। তারনাথ বলিতেছেন, রত্নাকার শান্তির বাড়ি ছিল মগধে, বিক্রমশীল-বিহারের তিনি ছিলেন অন্যতম আচার্য, এবং সাত বৎসর তিনি সিংহলে প্রচারকার্যে রত ছিলেন। যাহাই হউক, মহাযানী শান্তিদেব ও -বজ্রযানী তান্ত্রিক শান্তিদেব ষে দুই ভিন্ন ব্যক্তি এ-সম্বন্ধে বোধ হয় সন্দেহের অবকাশ কম। তবে, তান্ত্রিক শান্তিদেব ও ভুসুকু একই ব্যক্তি হইলেও হইতে পারেন; উভয়েই একাদশ শতকের লোক। চর্যাগীতির শান্তিপাদ ও ত্যাঙ্গুরের রত্নাকরশান্তিও বোধ হয় একই ব্যক্তি।

সরোরুহবজ্র বা পদ্মবিজু

সরোরুহোবজ্র, কমলশীল, শান্তিরক্ষিত, পদ্মসম্ভব, ইহারা সকলেই প্রায় সমসাময়িক, আনুমানিক অষ্টম শতকের লোক। উদ্ভট্টীয়ান-বিনির্গত সরোরুহোবজের অন্য নাম ছিল পদ্মবঞ্জ; তিনি ছিলেন। হেবজাতন্ত্রের অন্যতম পুরোগামী আচার্য, উদ্ভট্টীয়ানবাসী অনঙ্গবজের গুরু এবং ইন্দ্রভূতির পরম গুরু। এই সরোরুহোবজকে পরবর্তীকালের সরহ-সরহপাদ বা সরহ-রাহুলভদ্রের সঙ্গে এক এবং অভিন্ন বলিয়া মনে করিবার কোনও কারণ নাই। বস্তুত, ত্যাঙ্গুর, পাগ-সাম-জোন-জাং, তারনাথ প্রভৃতির সাক্ষ্য বিশ্লেষণ করিলে মনে হয়, সরহ নামে একাধিক বৌদ্ধ আচার্য ছিলেন, এবং তাহারা সকলেই কিন্তু সমসাময়িক ছিলেন না। তারনাথ তো পরিষ্কারই দুই সরহের ইঙ্গিত দিতেছেন, একজন সারাহ-রাহুলভদ্র, আর একজন সরহ-শাকরি। তাঙ্গুর গ্রন্থ-তালিকায় অনেকবারই সরহের উল্লেখ আছে এবং তাহার পরিচয় কখনও মহাচার্য, কখনও মহাব্ৰাহ্মণ, কখনও মহাযোগী বা যোগীশ্বর, কখনও মহাশবর, কখনও কৃষ্ণবংশধর, কখনও বা উদ্ভট্টীয়ান-বিনির্গত। ইহারা প্রত্যেকে এক এবং অভিন্ন কি না, বলা কঠিন; না হওয়াই সম্ভব। তবে দোহাকার এবং বজ্রযানী-সাধন-রচয়িতা সিদ্ধাচার্য সরহ-সরহপাদ এবং তারনাথ-কথিত সরহ-রাহুলভদ্র এক এবং অভিন্ন, এ-সম্বন্ধে সন্দেহ করিবার কারণ দেখিতেছি না। সুম্পা বলিতেছেন, এই সরহ জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন প্রাচ্য দেশে রঞ্জ শহরের এক ডাকিনীর গর্ভে এবং জনৈক ব্রাহ্মণের ঔরসে। জনৈক চন্দনপালের রাজত্বকালে তিনি রত্নপাল এবং তাঁহার সভাসদ ব্রাহ্মণ ও মন্ত্রীদের বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষাদান করেন। ওড়িবিষ বা ওড়বিষয়ে তিনি মন্ত্রযান শিক্ষা করেন; পরে তিনি মহারাষ্ট্রে গিয়া যোগিনী আচারে সিদ্ধ হন এবং সরহ নামে পরিচিত হন। তিনি কিছুদিন নালন্দায় মহাচার্যও ছিলেন। দীক্ষাদানকালে তিনি দোহাগান করিতেন; বস্তুত ত্যাঙ্গুর-তালিকায় তাহার কয়েকটি দোহা ও চর্যাগীতির উল্লেখও আছে। অপভ্রংশ ভাষায় রচিত সংস্কৃত টীকাযুক্ত তদ্রচিত একটি দোহাসংগ্ৰন্থ হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয় প্রকাশও করিয়াছেন। তাহা ছাড়া, প্রাচীন বাঙলায় রচিত চারিটি গানও চর্যাগীতি গ্রন্থে স্থান পাইয়াছে। এই সব গানের ভণিতায় তাহার নাম দেওয়া হইয়াছে সরহপাদ। সুমপা-বর্ণিত চন্দনপাল ও রত্নপাল পাল-বংশেরই কেহ হইয়া থাকিবেন, যদিও ইহাদের ঐতিহাসিকত্ব কোনও স্বতন্ত্র সাক্ষ্যে সমর্থিত নয়। সরোরুহ বজা-পদ্মবঞ্জ অষ্টম শতকের লোক, কিন্তু সারাহ-রাহুলভদ্র বোধ হয় একাদশ শতকের আগেকার লোক নহেন।

কুক্কুরিপাদ কম্বলপাদ

তারনাথের মতে সরোরুহোবজ্রের সমসাময়িক ছিলেন কুঙ্কুরিপাদ ও কম্বলপাদ বা কম্বলাম্বরপাদ। কুকুরিপাদ বাঙলার এক ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন, পরে বৌদ্ধ তন্ত্রধর্মে দীক্ষা গ্ৰহণ করিয়া ডাকিনীদের দেশ হইতে মন্ত্রযান ও অন্যান্য তন্ত্র (মহামায়াতন্ত্র?) উদ্ধার করেন। চুরাশি সিদ্ধার তালিকায় কুকুরিপাদের উল্লেখ আছে। তিনিই বোধ হয় তন্ত্র-সাধনায় মহামায়া-সাধনের সূচনা করেন। তাঙ্গুরা-তালিকায় দেখিতেছি, তিনি অন্তত ছয়খানা তন্ত্র গ্রন্থ রচনা করিয়াছিলেন। এবং তন্মধ্যে কয়েকটি মহামায়া-সাধন সম্পর্কিত। তাঙ্গুরে এক জায়গায় তাহকে গুরুরাজা আখ্যা দেওয়া হইয়াছে। কুকুর-পা বা কুকুর-রাজ এবং কুকুরিপাদ যদি এক এবং অভিন্ন হন, এবং না হইবার কোনও কারণ নাই, তাহা হইলে ত্যাঙ্গুর-তালিকার বজ্ৰযান সাধন সম্পর্কিত আরও আটটি তন্ত্রগ্রন্থ (বাজসত্ত্ব, হেরুক, বৈরোচন প্রভৃতি দেবতা সম্বন্ধীয়) তাঁহারই রচনা বলিয়া স্বীকার করিতে হয়। চর্যাগীতি বা চর্যচর্যবিনিশ্চয়গ্রন্থের অন্তত দুইটি প্রাচীন বাঙলা গীতি কুকুরিপাদের রচনা, ভণিতায় তাহা সুস্পষ্ট বলা আছে।

কম্বলপাদ বা কম্বলাম্বরপাদ প্রাচীন বাঙলা ভাষায় কম্বল-গীতিকা নামে একটি দোহা গ্রন্থ রচনা করিয়াছিলেন: চর্যচর্যবিনিশ্চয়-গ্রন্থের একটি গীতিরও তিনি ছিলেন লেখক। উভয়ই হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয়ের বৌদ্ধ গান ও দোহায় স্থান পাইয়াছেন। তিব্বতী ঐতিহ্যানুসারে তিনি হেরুক সাধন সম্বন্ধে অস্তত ছয়খানা গ্ৰন্থ রচনা করিয়াছিলেন।

শবরীপাদ

ইহাদের সমসাময়িক (অষ্টম শতকের শেষ, নবম শতকের প্রথমার্ধ) এবং চুরাশি সিদ্ধার অন্যতম ছিলেন। শবরপাদ বা শবরপাদ। সুমপা বলিতেছেন, তিনি বঙ্গাল দেশের পর্বতবাসী এক ব্যাধ বা শবরী ছিলেন। রসায়নাচার্য নাগাৰ্জ্জুন যখন বাঙলা দেশে ছিলেন (ইনি প্রথম খ্ৰীষ্ট শতকীয় শূন্যবাদী নাগার্জুন নহেন)। তখন তিনিই শবরপাদ এবং তাঁহার দুই স্ত্রীকে তন্ত্রধর্মে দীক্ষাদান করেন। ত্যাঙ্গুরা-তালিকানুযায়ী তিনি প্রায় দশখানা বজ্রযানী গ্ৰন্থ রচনা করিয়াছিলেন। চর্যচর্যবিনিশ্চয়-গ্রন্থে শবরীপাদের রচিত দুইখানা বাঙলা গান আছে। শবর-শবরীপাদ এবং শবরীশ্বর যদি এক এবং অভিন্ন হন, তাহা হইলে বিজযোগিনী-সাধন সম্বন্ধেও তিনি আরও কয়েকখানা গ্ৰন্থ রচনা করিয়াছিলেন। উড়ন্তীয়ান বা ওদ্যানের রাজা ইন্দ্রভূতি ও তাঁহার ভগিনী বা কন্যা লক্ষ্মীঙ্করা, ইহারা দুইই বাঙলা দেশে বজ্ৰযোগিনী-সাধন প্রবর্তন করেন। মহাচার্য ইন্দ্রভূতি সিদ্ধ-বজ্রযোগিনী-সাধন, জ্ঞান সিদ্ধি এবং অন্যান্য আরও কয়েকখানি গ্রন্থ রচনা করিয়াছিলেন। লক্ষ্মীঙ্করাও কয়েকখানি গ্রন্থের রচয়িত্রী ছিলেন; তাহার মধ্যে অদ্বয়সিদ্ধি মূল সংস্কৃতে পাওয়া গিয়াছে। যাহা হউক, খুব সম্ভব পূর্বোক্ত শবর বা শবরপাদই বৌদ্ধ শবর সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা-আচার্য। এই শবর সম্প্রদায়ের অন্যতম প্রধান আচার্য ছিলেন অদ্বয়বজি, তাহার কথা যথাস্থানে বলিতেছি।

কুমারচন্দ্ৰ

সৌর রত্নদ্বীপের (নেপাল অন্তর্গত রত্নদ্বীপ) অন্যতম অধিবাসী এবং পূবেক্তি লক্ষ্মীঙ্করার শিষ্য লীলাবজ আচার্য-অবধূত-মহাপণ্ডিত কুমারচন্দ্ৰ—রচিত কৃষ্ণযমাৱীতন্ত্রের টীকা রত্নাবলীর একটি তিব্বতী অনুবাদ করিয়াছিলেন। কুমারচন্দ্র রত্নাবলী টীকাটি রচনা করিয়াছিলেন। বিক্রমপুরী-বিহারে বসিয়া; সেই জন্যই অনুমান হয়, কুমারচন্দ্ৰ অষ্টম-নবম শতকীয় জনৈক বাঙালী বৌদ্ধ আচার্য ছিলেন। তিনি তিনটি তান্ত্রিক পঞ্জিকা বা টীকাও রচনা করিয়াছিলেন।

টঙ্কদাস

ধর্মপালের সমসাময়িক বৃদ্ধকায়স্থ টঙ্কাদাস বা ডাঙ্কদাস পাণ্ডুভূমি-বিহারের অধিবাসী ছিলেন, এবং সেইখানে বসিয়া সুবিশদসম্পূট হেবজাতন্ত্রের একটি টীকা রচনা করিয়াছিলেন।

নাগবোধি

রসায়ানাচার্য নাগার্জুন যখন পুণ্ড্রবর্ধনে রসায়ন ও ধাতু গবেষণায় নিরত তখন তাঁহার প্রধান সহায়ক ছিলেন জনৈক নাগবোধি। সুমপা বলিতেছেন, এই নাগাধোধির বাড়ি ছিল বরেন্দ্ৰান্তর্গত শিবসের গ্রামে; যমরিসিদ্ধচক্রসাধন নামে তিনি অন্তত একখানা গ্ৰন্থ রচনা করিয়াছিলেন। এই গ্রন্থে তিনি আত্মপরিচয় দিয়েছেন উডউীয়ান-বিনির্গত বলিয়া। ত্যাঙ্গুর-তালিকামতে তিনি তেরো খানা তান্ত্রিক গ্রন্থের রচয়িতা।

এই পর্যন্ত যে-সব বৌদ্ধ আচার্যদের কথা বলা হইল তাহারা সকলেই আনুমানিক অষ্টম-নবম শতকের লোক। ইহার পর বেশ কিছুদিন উল্লেখযোগ্য বৌদ্ধ আচার্য-পণ্ডিতদের সাক্ষাৎ যেন পাইতেছি না। ইহার কারণ বলা কঠিন। তাহা ছাড়া ইহাদের দেশ সম্বন্ধেও যেমন কাল সম্বন্ধেও তেমনই আমাদের তথ্য নিঃসন্দিগ্ধও নয়। বিভিন্ন ধারায় বিভিন্ন ঐতিহ্যে কাল-সংবাদ, আচার্য-পরম্পর-সংবাদ বিভিন্ন প্রকারের; কাজেই নিশ্চয় করিয়া কিছু বলিবারও উপায় নাই। কিন্তু লক্ষণীয় এই যে, নবম শতকের মাঝামাঝি হইতে দশম শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত কোনও ঐতিহ্যেই কোনও আচার্যকে স্থাপিত করা সম্ভব হইতেছে না। এই একশত বৎসর বৌদ্ধ জ্ঞান-বিজ্ঞান সাধনার স্রোতে কি ভাটা পড়িয়াছিল? যাহাঁই হউক, দশম শতকের তৃতীয় পাদ। হইতে আরম্ভ করিয়া দ্বাদশ শতকের প্রায় শেষ পর্যন্ত আবার সেই স্ৰোত সবেগে বহমান, উপস্থিত সাক্ষ্যে এ-কথা স্বীকার করিতেই হয়। দ্বাদশ শতকে সেনা-বর্মণ পর্বে বৌদ্ধ বিহারগুলিতে রাজা ও রাষ্ট্রের পোষকতা আর ছিল না, এবং হয়তো বৌদ্ধ ধর্ম ও জ্ঞান-বিজ্ঞান সাধনায় কিছুটা ভাটাও পড়িয়াছিল, কিন্তু নিজ নিজ নিভৃত বিহারকক্ষে অথবা আপনোপন গুহ্যু সম্প্রদায়ের গুহ্যতর আশ্রয়গুলিকে কেন্দ্ৰ করিয়া তাহদের নিরলস সাধনা অব্যাহতই ছিল{ অগণিত সিদ্ধাচার্য ও বৌদ্ধ পণ্ডিত এবং তাহাদের রচিত গান, দোহা এবং সাধনই তাহার প্রমাণ।

আগেই বলিয়াছি, বজ্রযানী-মন্ত্রযানী তান্ত্রিক আচার্যদের সঙ্গে বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্য ও নাথগুরুদের গভীরতর ধ্যান ও আদর্শগত পার্থক্য যাহাই থাকুক না কেন, অন্তত সূচনায় এইসব সমসাময়িক ধৰ্মসম্প্রদায় ও আচার্যদের জীবনাচরণে বা জ্ঞান-বিজ্ঞান সাধনায় প্রভেদ বিশেষ ছিল না। আগেই বলিয়াছি, বজ্ৰযান-মন্ত্রযান-কালচক্ৰযানের বাহিরে অথচ কিছুটা ইহাদেরই ভিতর হইতে উদ্ভূত এবং ইহাদের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পূক্ত নাথধর্ম, কৌলধর্ম, সহজধৰ্ম, অবধূতধর্ম প্রভৃতির আচার্যরা প্রায় সকলেই একে অন্য ধর্ম ও সম্প্রদায় কর্তৃক গুরু ও আচার্য বলিয়া স্বীকৃত ও পূজিত হইয়াছেন। শেষোক্ত ধর্ম ও সম্প্রদায়গুলির প্রধান আচার্য ছিলেন চুরাশি জন, এবং ইহারা তিব্বতী ঐতিহ্যে চুরাশি সিদ্ধা বলিয়া খ্যাত। ইহাদের মধ্যে অনেকে আবার বিজযান সাধনা ও বজ্রযানী দেবদেবী সম্বন্ধে গ্রন্থও রচনা করিয়াছেন, মহাযানী ন্যায়ের পুঁথিও লিখিয়াছেন। সুতরাং ইহাদের একান্ত করিয়া পৃথকভাবে বিবেচনা করিবার যুক্তিসঙ্গত কিছু কারণ নাই। বস্তুত, এই কয় শত বৎসর ধরিয়া বাঙলা দেশে বৌদ্ধ ধর্ম, ব্রাহ্মণ্য ধর্ম এবং বিভিন্ন লোকায়াত ধর্মের নানা ধ্যান, নানা প্রক্রিয়ার একটা সুবৃহৎ এবং সুগভীর সমন্বয় ও স্বাঙ্গীকরণক্রিয়া সমানেই চলিতেছিল। এই সমন্বয় ও সাঙ্গীকরণই পাল-চন্দ্ৰ-পর্বের বাঙলার ইতিহাসের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য। সেনা-বর্মণ পর্বের উচ্চস্তরের সংস্কৃত স্মৃতি-দর্শন-কাব্য প্রভৃতি সাধনার কথা বাদ দিলে সংস্কৃতির ক্ষেত্রে অন্যত্র এই সমন্বয়-স্বাঙ্গীকরণ ক্রিয়া খুব বাধা পায় নাই। সেই কারণে, এই সব মহাযানী-বজ্রযানী বৌদ্ধ পণ্ডিত ও সিদ্ধাচার্যদের মধ্যে যাঁহারা বাঙালী তাহাদের কথা এক সঙ্গেই বলিতেছি, কালপরম্পরা যতটা জানা যায় ততটা বজায় রাখিয়া।

প্রসঙ্গত, এ-কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন, মহাযান-বজযান প্রভৃতি মতাবলম্বী তান্ত্রিক আচার্যরা যে-সব রচনা রাখিয়া গিয়াছেন তাহার অধিকাংশই হয় দর্শন ও যোগসাধন সম্বন্ধীয় অথবা বিভিন্ন দেবদেবীর সাধনা, স্তব ও পূজা বিষয়ক শ্লোকাবলী। শেষোক্ত পর্যায়ের রচনায় যাহাদের কবিকল্পনা ও কবিপ্রতিভার কিছু কিছু পরিচয় ধরা পড়িয়াছে, তাহাদের মধ্যে অনেকেই যে বাঙালী ছিলেন সে-সম্বন্ধেও সন্দেহের অবকাশ কম। সংস্কৃত কাব্যের রীতি-প্রকৃতিতেও ইহারা যথেষ্ট অভিজ্ঞ ছিলেন, মনে হয়। ধর্মকরমতি, শবরপাদ, কৃষ্ণপাদ, রত্নাকর, শুভাকর, কুলদত্ত, অদ্বয়বজি, ললিত-গুপ্ত, কুমুদাকরমতি, পদ্মাকর, অভয়াকর-গুপ্ত, গুণাকর-গুপ্ত, করুণাচল, কোকরদত্ত, অনুপম-রক্ষিত, চিন্তামণি-দত্ত, সুমতি-ভদ্র, মঙ্গল-সেন, অজিত-মিত্র প্রভৃতি যাহাদের নাম সাধনমালা-গ্রন্থে পাইতেছি, তাহাদের তো বাঙালী বলিয়াই মনে হইতেছে। ইহাদের রচনার দৃষ্টান্ত স্বরূপ এবং কিছুক্ষণ আগে ব্ৰাহ্মণ্য ও বৌদ্ধ তন্ত্রধর্মে যে স্বাঙ্গীকরণ ক্রিয়ার উল্লেখ করিয়াছি তাহারও দৃষ্টান্ত স্বরূপ জনৈক অজ্ঞাতনামা কবির একটি তারাস্তুতি উদ্ধার করিতেছি। এই ভক্তিরাসমিন্ধ স্তবটিতে ব্ৰাহ্মণ্য দুৰ্গা ও বেদমাতা সরস্বতী এবং বৌদ্ধ তারা ইতিমধ্যেই কবি-কল্পনায় এক এবং অভিন্ন হইয়া গিয়াছেন।

দেবী (?) ত্বমেব গিরিজা কুশলা ত্বমেব
পদ্মাবতী ত্বমসি [ত্বং হি চ] বেদমাতা।
ব্যাপ্তং ত্বয়া ত্ৰিভুবনে জগতৈক রূপা (?)
তুভ্যং নমোহস্তু মনসা বপুষা গিরা নঃ৷।
যানত্রয়েষ্ণু দশ পারমিতেতি গীতা
বিস্তীর্ণ যানিকজন্য ফলশূন্যতেতি
প্রজ্ঞাপ্রসঙ্গচন্টুলা মৃতপূৰ্ণধাত্রী
তুভ্যং নমোহগু মনসা বপুষা গিরা নঃ৷।
আনন্দানন্দবিরসা সহজ স্বভাবা
চক্ৰত্ৰয়াদ পরিবর্তিত বিশ্বমাতা।
বিদ্যুৎপ্রভাহাদয়বর্জিতজ্ঞানগম্যা
তুভ্যং নমোহস্তু মনসা বপুষ্য গিরা নিঃ৷

 

দশম-দ্বাদশ শতক
জ্যেষ্ঠ ও কনিষ্ঠ জেতারি

তারনাথ ও সুমপার সাক্ষ্যে মনে হয়, জেতার নামেও দুইজন বৌদ্ধ আচার্য ছিলেন। জ্যেষ্ঠ জেতরির বাড়ি ছিল বরেন্দ্রভূমে, তাহার পিতা গর্ভপাদ জনৈক সামান্ত সনাতনের সভাসদ ছিলেন। এই জেতারি বিক্রমশীল বিহারের অন্যতম আচার্য এবং শ্ৰীজ্ঞান-দীপঙ্কর বা অতীশের অন্যতম গুরু ছিলেন। সেই জন্য অনুমান হয়, তিনি দশ শতকের শেষার্ধের লোক ছিলেন। হেতুতত্ত্বোপদেশ, ধর্মাধৰ্মবিনিশ্চয় এবং বালাবতারতর্ক নামে বৌদ্ধ ন্যায়ের এই তিনটি গ্রন্থ বোধ হয় তাহারই রচনা। ইহা ছাড়া তিনি আরও দুইখানা সূত্রগ্রন্থও রচনা করিয়াছিলেন। তাহার মধ্যে সুগতমতবিভঙ্গকারিকা অন্যতম; এই গ্রন্থে তিনি আত্মপরিচয় দিয়াছেন বাঙালী বলিয়া। কনিষ্ঠ জেতারিও ছিলেন বাঙালী, এবং বোধিভাগ্য লাবণ্যবাঞ্জের গুরু। তিনি এগারো খানা বঞ্জযানী-সাধনের রচয়িতা। তাঁহার কাল সম্বন্ধে নিশ্চয় করিয়া কিছু বলা কঠিন।

দীপঙ্কর-শ্ৰীজ্ঞান বা অতীশ

বাঙালী বৌদ্ধ মহাচার্যদের মধ্যে দীপঙ্কর-শ্ৰীজ্ঞান (অন্য নাম অতীশ) শ্রেষ্ঠতম এবং দীপঙ্কর-চরিত্যকথা বাঙলাদেশে সুপরিচিত। কাজেই তাহার কথা বিস্তুত করিয়া বলিবার প্রয়োজন কিছু নাই। ত্যাঙ্গুরের ঐতিহ্যে একাধিক দীপঙ্করুম্মুতি বিধৃত – দীপঙ্কর, দীপঙ্কর-ভদ্র, দীপঙ্কর-রক্ষিত, দীপঙ্কর-চন্দ্ৰ, দীপঙ্কর-শ্ৰীজ্ঞান। নিঃসন্দেহে ইহারা সকলে একই ব্যক্তি হইতে পারেন না; তবে ইহাদের মধ্যে দীপঙ্কর-শ্ৰীজ্ঞান যে বাঙালী ছিলেন এ-সম্বন্ধে কোনও সন্দেহ নাই। তাঁহার জন্মভূমি বঙ্গাল-দেশের বিক্রমণিপুরে, আনুমানিক ৯৮০ খ্ৰীষ্ট বৎসরে গৌড়রাজ-পরিবারে তাঁহার জন্ম; পিতার নাম কল্যাণশ্ৰী, মাতা প্রভাবতী, তাহার নিজের বাল্য নাম ছিল চন্দ্ৰগৰ্ভ। যৌবনে তিনি জেতারির শিষ্য ছিলেন; কিছুদিন তিনি পশ্চিম-ভারতের কৃষ্ণগিরি বা কানহেরী-বিহারে থাকিয়া রাহুলগুপ্তের নিকট বৌদ্ধ ধ্যানে দীক্ষালাভ করিয়াছিলেন; সেইখানেই তাঁহার নামকরণ হয় গুহ্যজ্ঞানবজা। উনিশ বৎসর বয়সে ওদন্তপুরী-বিহারে মহাসংঘিক আচার্য শীলরক্ষিতের নিকট তিনি দীক্ষাগ্ৰহণ করেন, এবং সেই সময় তাহার নামকরণ হয় দীপঙ্কর-শ্ৰীজ্ঞান। বারো বৎসর পর তিনি ভিক্ষুব্ৰতী হ’ন এবং আচার্য ধর্মরক্ষিতের নিকট বোধিসত্ত্বব্ৰতে দীক্ষিত হন। তারপর তিনি আরও বারো বৎসর যাপন করেন সুবর্ণদ্বীপে আচাৰ্য চন্দ্ৰকীর্তির নিকট বৌদ্ধ শাস্ত্রপাঠে। সেখান হইতে তিনি তাম্রদ্বীপ বা সিংহলের পথে মগধে ফিরিয়া আসেন, এবং কিছুদিন পরই মহীপাল কর্তৃক আহূত হন বিক্রমশীল মহাবিহারের মহাচাৰ্যপদে। এই বিহারে বাসকালেই তিব্বতের বৌদ্ধ রাজা লোহ-লামা-যে-শেস দূত পঠাইয়া দীপঙ্করকে সাদর আমন্ত্রণ জ্ঞাপন করেন তিব্বত যাইবার জন্য। নিলেভি নিরহঙ্কার দীপঙ্কর সবিনয়ে এই আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করেন। ইহার কিছুদিন পর প্রতিবেশী এক রাজকারাগারে তিব্বত-রাজের প্রাণবিয়োগ ঘটে, কিন্তু তাহার আগেই তিনি তাহার অবস্থা ও প্রাণের একান্ত অভিপ্রায় জানাইয়া দীপঙ্করের উদ্দেশ্যে একটি চিঠি লিখিয়া রাখিয়া যান। লাহলামা যে-শেস-গুডের মৃত্যুর পর তাহার ভ্রাতুষ্পপুত্ৰ চান-চুবের রাজত্ব কালে তিব্বতী আচার্য বিনয়ধর (টুযুল খ্রিম-গ্যালবা) সেই পত্ৰ লইয়া দীপঙ্করের উদ্দেশ্যে বিক্রমশীল-বিহারে আসিয়া উপস্থিত হন, এবং কিছুকাল সেখানে যাপনের পর দীপঙ্করের সঙ্গে পরিচয় কিছু ঘনিষ্ঠ হইলে নিজের মনোবাসনা এবং লোহ-লামার পত্র তাহার গোচর করেন। অবশেষে দীপঙ্কর তিব্বত যাইতে স্বীকৃত হ’ন, কিন্তু তাহার হাতে যে সব কাজ ছিল তাহা সারিবার পর। এই সময় আচার্য রত্নাকর ছিলেন বিক্রমশীল-বিহারের অধিনায়ক। বিহারের ভিক্ষুসংঘ তখন নানাপ্রকার নৈতিক ও মানসিক শৈথিল্যে ভারগ্রস্ত; দীপঙ্কর ছাড়া ভিক্ষুদের নৈতিক শাসন অব্যাহত রাখার শক্তি আর কাহারও নাই। মগধ জনপদের নানা বিহারে-সংঘে দীপঙ্করের প্রতিষ্ঠা ও প্রভাব অপরিসীম। এ সব বিবেচনা করিয়া রত্নাকর দীপঙ্করকে ছাড়িয়া দিতে কিছুতেই রাজি হইলেন না। কিন্তু পরে যখন ক্রমশ জানিলেন, দীপঙ্কর বিনয়ধরকে কথা দিয়াছেন এবং তিনি নিজেও যাইতে ইচ্ছুক তখন অনুমতি দেওয়া ছাড়া আর উপায় রহিল না, কিন্তু এই শর্তে যে, তিন বৎসরের ভিতর দীপঙ্কর বিক্রমশীল-বিহারে ফিরিয়া আসিবেন। এই উপলক্ষে তিনি বিনয়ধরের নিকট যে উক্তি করিয়াছিলেন তাহা উল্লেখযোগ্য :

‘অতীশ না থাকিলে ভারতবর্ষ অন্ধকার। বহু বৌদ্ধ-প্রতিষ্ঠানের কুঞ্চিক তাঁহারই হাতে; তাহার অনুপস্থিতিতে এই সব প্রতিষ্ঠান শূন্য হইয়া যাইবে। চারিদিকের অবস্থা দেখিয়া মনে হয়, ভারতবর্ষের দুর্দিন ঘনাইয়া আসিতেছে। অসংখ্য তুরুষ্ক সৈন্য ভারতবর্ষ আক্রমণ করিতেছে; আমি অত্যন্ত চিন্তিত বোধ করিতেছি। তবু, আশীর্বাদ করিতেছি, তুমি অতীশ ও তোমাদের সঙ্গীদের লইয়া তোমাদের দেশে ফিরিয়া যাও, সকল প্রাণীর কল্যাণের জন্য অতীশের সেবা ও কর্ম নিয়োজিত হউক।‘

বিনয়ধর, তিব্বতী পণ্ডিত গ্যা-টুসন, পণ্ডিত ভূমিগর্ভ এবং অপরান্তরাজ মহারাজ ভূমিসংঘকে লুইয়া দীপঙ্কর তিব্বত যাত্রা করিলেন, নেপালের ও হিমালয়ের সুদুৰ্গম পথে। পথে দুই দুইবার তাহারা দসু্যদল কর্তৃক আক্রান্ত হইলেন; গ্যা-টুসন মারা গেলেন, নেপালরাজ অনন্তকীর্তির সঙ্গে দীপঙ্করের সাক্ষাৎকার ঘটিল, এবং অনন্তকীর্তির পুত্র পদ্মপ্রভ দীপঙ্করের নিকট বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষা গ্রহণ করিয়া তিব্বতের পথে তাহার সঙ্গী হইলেন। এই সময় বোধ হয়, নেপাল হইতেই তিনি রাজা নয়পালের নিকট একটি লিপি পাঠান। অবশেষে তিব্বতে পৌঁছিয়া দীপঙ্কর রাজসমারোহে অভ্যর্থত হইলেন এবং তিব্বতের সর্বত্র ঘুরিয়া ঘুরিয়া মহাযান বৌদ্ধ ধর্ম প্রচার করিয়া বেড়াইলেন। থাে-লিং বিহার হইল তাহার কর্মকেন্দ্র। দীপঙ্কর প্রায় তেরো বৎসর কাল তিব্বতে বাস করিয়া ৭৩ বৎসর বয়সে আনুমানিক ১০৫৩ খ্ৰীষ্ট বৎসরে সেইখানেই পরলোকগমন করেন।

সুমপা-রচিত পাগ-সাম-জোন-জাং-গ্রন্থের মতে দীপঙ্কর বিক্রমশীল ও ওদস্তূপরী উভয় বিহারেরই মহাচার্য ছিলেন; তাহার অন্য নাম ছিল জোবো বা প্রভু। বোধ হয়। সঙ্গেও তাহার সম্বন্ধ ছিল ঘনিষ্ঠ, এবং সেখানে বসিয়াই তিনি ভাব-বিবেকের মধ্যমকরত্ন-প্রদীপ-গ্রন্থের অনুবাদ রচনা করিয়াছিলেন। ত্যাঙ্গুর-ঐতিহ্যমতে তিনি প্রায় ১৭৫ মৌলিক রচনা অথবা অনুবাদ করিয়াছিলেনলেন। ইহাদের অধিকাংশই বজ্রযানী সাধন, কিন্তু কিছু কিছু মহাযানী সূত্রগ্রন্থও ত্যাঙ্গুরা-তালিকায় বিদ্যমান।

চরিত্রে, পাণ্ডিত্যে, মনীষায় ও অধ্যাত্ম-গরিমায় দীপঙ্কর সমসাময়িক বাঙলার ও ভারতবর্ষের অন্যতম উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক। পূর্ব-ভারত ও তিব্বতের মধ্যে যাহারা মিলনসেতু রচনা করিয়া গিয়াছেন, তাহদের মধ্যে দীপঙ্করের নাম সর্বাগ্রে এবং সকলের পুরোভাগে স্মর্তব্য। সমসাময়িক অবস্থার দিকে তাকাইয়া রত্নাকর বলিয়াছিলেন, দীপঙ্কর-বিহীন ভারতবর্ষ অন্ধকার’। এই উক্তির মধ্যে অত্যুক্তি কিছু নাই; সেই ঘনায়মান মেঘান্ধকারের মধ্যে দীপঙ্করই একমাত্র আলোকরেখা।

জ্ঞানশ্ৰী-মিত্র

বিক্রমশীল-বিহারের অন্যতম প্রতিষ্ঠাবান আচার্য ছিলেন জ্ঞানশ্ৰী-মিত্র; দীপঙ্করের তিব্বত-যাত্রার কিছু আগে বা পরে তিনি এই বিহারে আসিয়া অধিষ্ঠিত হন। তাহার বাড়ি ছিল গৌড়ে; গোড়ায় তিনি ছিলেন। হীনযানী বৌদ্ধ, পরে মহাযানে দীক্ষা গ্ৰহণ করেন। তাহার বৌদ্ধ ন্যায় সম্বন্ধীয় সুপ্ৰসিদ্ধ গ্রন্থ কার্যকরণ-ভাবসিদ্ধি চতুর্দশ শতকে আচার্য মাধব-রচিত সর্বদর্শনসংগ্রহে আলোচিত ও ব্যাখ্যাত হইয়াছে।

অভয়াকর-গুপ্ত

অভয়াকর-গুপ্ত নামে একজন বৌদ্ধ আচার্য ছিলেন রামপালের সমসাময়িক; বজাসন (বুদ্ধগয়া) ও নালন্দায় তিনি ছিলেন পণ্ডিত, এবং বিক্রমশীল-বিহারের অন্যতম আচার্য। তাহার জন্ম হয়। ঝারিখণ্ডে, বঙ্গাল দেশের এক ক্ষত্ৰিয়-পরিবারে। তারনাথের মতে অভয়াকর তীৰ্থিক সম্প্রদায়ের তন্ত্রশস্ত্ৰে সুপণ্ডিত ছিলেন, পরে বাঙলার বৌদ্ধ তন্ত্রেও পাণ্ডিত্য লাভ করেন। ত্যাঙ্গুর-ঐতিহ্যমতে তিনি প্রায় বিশ খানা বজ্রযানী গ্রন্থের রচয়িতা, এবং ইহাদের অন্তত চারিখানার মূল সংস্কৃত গ্রন্থ বিদ্যমান। শ্ৰীসমপুটতন্ত্ররাজগ্রন্থের তদ্রচিত একটি টীকায় এবং বজযানাপত্তিমঞ্জরী নামে তাহার একটি গ্রন্থে তাহাকে মগধের লোক বলিয়া পরিচয় দেওয়া আছে।

দিবাকর-চন্দ্ৰ

তিনি হেরুক-সাধন নামে একটি গ্রন্থ এবং আরো দুইটি অনুবাদ-গ্ৰন্থ রচনা করিয়াছিলেন। সুমপা বলিতেছেন, দিবাকর-দেবাকরচন্দ্র মৈত্রী-পা’র শিষ্য ছিলেন; দীপঙ্কর তাহাকে বিক্রমশীল-বিহার হইতে বহিষ্কৃত করিয়া দেন। এক পণ্ডিত শ্ৰীদিবাকরচন্দ্ৰ পাকবিধি নামে একটি সংস্কৃত গ্রন্থ রচনা করিয়াছিলেন ১১০১ খ্ৰীষ্ট বৎসরে; তিব্বতী ঐতিহ্যে দিবাকর ও দিবাকর-চন্দ্ৰ নামে আরও দুইজন পণ্ডিত গ্রন্থকারের সাক্ষাৎ মেলে! ইহারা সকলেই বোধ হয় এক এবং অভিন্ন। পূর্বোক্ত জেতারির সমসাময়িক এবং দীপঙ্কর-অতীশের অন্যতম শিক্ষাগুরু, রাজাচার্য, মহাগুরু রত্নাকরশান্তি অথবা শান্তিপাদ বাঙালী ছিলেন। কিনা, নিঃসংশয়ে বলা কঠিন।

তবে মহীপাল-নয়পালেরই সমসাময়িকু কুমারবাজ নিশ্চয়ই ছিলেন বাঙালী। হেরুকসাধন নামে একটি গ্রন্থ তিনি রচনা করিয়াছিলেন, এবং দারিকপাদের চক্রসম্বর-সাধনতত্ত্বসংগ্রহ’ গ্রন্থের অনুবাদ করিয়াছিলেন।

রত্নাকরশান্তি, কুমারবজ্র, দানশীল, বিভূতিচন্দ্ৰ, বোধিভদ্র, প্রজ্ঞাবর্ম

রামপাল-প্রতিষ্ঠিত জগদ্দল-বিহারের দুইটি স্বনামধন্য পণ্ডিত হইতেছেন দানশীল ও বিভূতিচন্দ্র। বিভূতিচন্দ্র ছিলেন রাজপুত্র; ত্যাঙ্গুর ঐতিহ্যমতে তিনি ছিলেন পণ্ডিত, মহাপণ্ডিত, আচার্য, উপাধ্যায়; তাহার কর্মভূমি ছিল পূর্ব-ভারতের (উত্তরবঙ্গের) জগদ্দল-বিহার। তিনি একাধারে ছিলেন গ্ৰন্থকার, টীকাকার, অনুবাদক ও সংশোধক। বিভূতিচন্দ্র কিছুকাল নেপালে ও তিব্বতে বাস করিয়াছিলেন, এবং তিব্বতীতে অনেক গ্রন্থও অনুবাদ করিয়াছিলেন। তিনি কয়েকখানি মূল সংস্কৃত গ্রন্থ রচনা করিয়াছিলেন, অনেক গ্রন্থের টীকা রচনাও করিয়াছিলেন। লুই-পা’র দুইটি গ্রন্থের এবং অভয়াকরের দুই বা ততোধিক গ্রন্থের অনুবাদ তাঁহারই রচনা।

অভয়াকর-গুপ্ত ও শুভাকর-গুপ্তের খান কয়েক গ্রন্থের অনুবাদ করিয়াছিলেন আচার্য দানশীল। তাহার বাড়ি ছিল ভগল বা বঙ্গল দেশে এবং জগদ্দল-বিহারের তিনি ছিলেন অন্যতম আচার্য। প্রায় ষাটখানা তন্ত্র-গ্রন্থের তিব্বতী অনুবাদ তাহার রচনা; নিজে তিনি পুস্তকপাঠোপায়। নামে একখানা গ্ৰন্থ রচনা করিয়াছিলেন এবং নিজেই তিনি তাহার তিব্বতী রূপান্তরও করিয়াছিলেন। শুভাকর ছিলেন অভয়াকরের সমসাময়িক মগধের একজন বৌদ্ধ আচার্য, তিনিও কিছুদিন জগদ্দল-বিহারের অধিবাসী ছিলেন। অভয়াকরশিষ্য এবং রামপালের সমসাময়িক, মগধবাসী শুভাকর গুপ্ত এবং জগদলের শুভাকরকে এক এবং অভিন্ন মনে না করিবার কোনও কারণ নাই।

প্রজ্ঞাবর্মী নামে একজন বাঙালী কাপট-বিহারের অন্যতম আচার্য ছিলেন। তিনি তন্ত্রশাস্ত্রের উপর দুইটি টীকা রচনা করিয়াছিলেন, ধৰ্মকীর্তির হেতুবিন্দুপ্রকরণ নামক ন্যায় গ্রন্থের তিব্বতী অনুবাদ রচনা করিয়াছিলেন এবং উদানবগগের ওপর ধর্মাত্রাতের অসমাপ্ত টীকাখানা সমাপ্ত করিয়াছিলেন। প্রজ্ঞাবর্মার গুরু বোধিভদ্র সোমপুরী-বিহারের অধিবাসী ছিলেন। এই বোধিভদ্র এবং তারনাথ কথিত বিক্রমশীল-বিহারের আচার্য বোধিভদ্র বোধ হয় এক এবং অভিন্ন। বোধিভদ্র প্রায় আট দশখানা তন্ত্রগ্রন্থ রচনা করিয়াছিলেন। তাহার গুরু ছিলেন মহামতি।

মোক্ষাকর-গুপ্ত পুণ্ডরীক

জগদ্দল-বিহারের আর একজন আচার্য ছিলেন মোক্ষাকর-গুপ্ত। তিনি তর্কভাষা নামে বৌদ্ধ ন্যায়ের উপর একখানা গ্ৰন্থ রচনা করিয়াছিলেন। অপভ্রংশ দোহাকোষের উপর টীকাও বোধ হয়। তাঁহারই রচনা।

পুণ্ড্রৱীক নামে একজন রাজা আর্যমঞ্জনামসংগীতি-টীকার উপর বিমলপ্ৰভা নামে একটি টীকা রচনা করিয়ছিলেন। বর্মণ বংশীয় রাজা হরিবর্মদেবের ৩৯ রাজ্যঙ্কে লিখিত এই টীকার একটি পুঁথি নেপালে পাওয়া গিয়াছে। এই পুণ্ড্ররীক বোধ হয় বাঙালী ছিলেন, কারণ তাহার-বাড়ি বলা হইয়াছে উডউীয়ানে। তাহার অন্য আর একটি নাম ছিল জ্ঞানবাজ।

লুই-পা মৎস্যেন্দ্রনাথ

সিদ্ধাচার্যদের মধ্যে যিনি শ্রেষ্ঠতম সেই লুই-পা বা লুইপাদ খুব সম্ভব রামপালের সমসাময়িক ছিলেন। তারনাথের ইঙ্গিত অনুসরণ করিয়া আচার্য লেভি,শহীদুল্লাহ্ প্রভৃতি পণ্ডিতেরা লুই-পাকে খ্ৰীষ্টোত্তর সপ্তম শতকের লোক বলিয়া মনে করেন। কিন্তু লুই-পা রচিত অভিসময়বিভঙ্গ-গ্রন্থের পুস্পিকায় স্পষ্টতই বলা আছে যে, আচার্য দীপঙ্কর তাহাকে এই গ্ৰন্থ রচনায় বা তিব্বতী অনুবাদে সাহায্য করিয়াছিলেন। তাঙ্গুরা-তালিকায় তদ্রচিত কয়েকখানা বজযান-গ্রন্থের উল্লেখ আছে, এবং তিব্বতী ঐতিহ্যমতে তিনিই আদিসিদ্ধ। চর্যাগীতি-গ্রন্থে তাহার প্রাচীন বাঙলায় রচিত দুইটি দোহা। আছে, ་་ হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয় মনে করেন, লুইপাদ-গীতিকা নামে তাহার একখানা পৃথক গ্রন্থও ছিল।

অনেকের মতে তিব্বতী ঐতিহ্যের আদিসিদ্ধ লুই-পাদ এবং ভারতীয় ঐতিহ্যের আদিসিদ্ধ মীননাথ বা মৎস্যেন্দ্ৰনাথ এক এবং অভিন্ন। এরূপ মনে করিবার কারণও আছে; প্রথমত তিব্বতী ভাষায় লুই-পার রূপাস্তুর মৎস্যোদির বা মৎস্যাস্ত্রাদ! দ্বিতীয়ত, তিব্বতী ঐতিহো লুই-পা বাঙলা দেশের ধীবর শ্রেণীর লোক; ভারতীয় ঐতিহ্যেও মীননাথ-মৎস্যেন্দ্রনাথ প্রাচ্য সমুদ্রতীরের চন্দ্ৰদ্বীপের ধীবরশ্রেণীসভূত। তৃতীয়ত, যোগিনী কৌল সম্প্রদায়ের যে কয়েকটি সংস্কৃত পুঁথি আমাদের জানা আছে, যেমন কৌলঙ্ঞাননির্ণয়, এবং নেপালে প্রাপ্ত আরো ৩/৪ খানা পুঁথি, তাহাদের প্রত্যেকটিতেই মীননাথ-মৎস্যেন্দ্রনাথকে সেই সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা ও আদিগুরু বলিয়া স্বীকার করা হইয়াছে; অন্যদিকে তারনাথ বলিতেছেন, লুইপাদই যোগিনী ধর্মমতের স্রষ্টা। বস্তুত, সমস্ত পূর্ব ও উত্তরবঙ্গ জুড়িয়া এবং কামরূপে হঠযোগ, যোগিনী কৌলধর্ম এবং নাথধর্মকে কেন্দ্ৰ করিয়া যে-সব সম্প্রদায় বহু শতাব্দী ধরিয়া আপনাপন প্রভাব বিস্তার করিয়াছিল। তাহারা প্রত্যেকেই লুইপাদ ও মৎস্যেন্দ্রনাথকে এক এবং অভিন্ন বলিয়া মনে করে এবং নিজেদের আদিগুরু বলিয়া স্বীকার করে। লুই-পাদ-মৎস্যেন্দ্রনাথের ধর্মমতই সহজসিদ্ধি নামে খ্যাত। এই সহজিসিদ্ধির সঙ্গে একদিকে যেমন বজ্ৰযান-মন্ত্রযানের সম্বন্ধ অত্যস্ত ঘনিষ্ঠ, তেমনই অন্যদিকে কৌলধর্ম, নাথধর্ম প্রভৃতি এই সহজসিদ্ধি হইতেই উদ্ভূত। সেইজন্য দেখা যাইবে, এই সব সিদ্ধাচার্যদের অনেকেই বজ্রযানী গ্ৰন্থ রচনা করিয়াছেন, এবং বৌদ্ধতন্ত্রের সঙ্গে তাহদের সম্বন্ধ নিবিড়। বস্তুত, যোগিনী কৌলের কুল বৌদ্ধ তন্ত্রেরই পঞ্চকুল এবং এই পঞ্চকুল পঞ্চাধ্যানী বুদ্ধেরই প্রতীক; আর সহজ সিদ্ধির সহজ এবং বোজযানের বীজ প্ৰায় একই বস্তুর দুই ভিন্ন নাম মাত্র। তিব্বতী ঐতিহ্যান্তরে কিন্তু মৎস্যাস্ত্ৰাদকে মৎস্যেন্দ্রনাথ হইতে পৃথক বলিয়া ধরা হইয়াছে এবং মৎস্যেন্দ্রনাথকে মীননাথের সন্তান বা বংশধর বলা হইয়াছে।

মীননাথ-মৎস্যেন্দ্রনাথের অন্যতম পূর্বপুরুষ ছিলেন মীনপাদ, তিনি বোধিচিত্তের উপর একখানা গ্ৰন্থ রচনা করিয়াছিলেন। সহজসিদ্ধি মত নেপালে এবং তিব্বতে সুপ্রচলিত হইয়াছিল এবং উভয় দেশেই তিনি অবলোকিতেশ্বর অবতার বলিয়া পরিগণিত হইয়াছিলেন। বাঙলাদেশে তিনি শিবের অবতার বলিয়া প্ৰসিদ্ধিলাভ করিয়াছেন। মৎস্যেন্দ্রনাথের নামে প্রচলিত কয়েকখানা সংস্কৃত পুঁথি নেপালে পাওয়া গিয়াছে।

গোরক্ষনাথ

মীননাথ-মৎস্যেন্দ্রনাথের শিষ্য ছিলেন গোরক্ষনাথ। বাঙলাদেশে গোরক্ষনাথ-কথা সুপরিজ্ঞাত। গোরক্ষনাথের রচিত কোনও পুঁথি এ-পর্যন্ত পাওয়া যায় নাই; তবে ত্যাঙ্গুর তালিকায় এক গোরক্ষের নামে একটি বৌদ্ধ তান্ত্রিক গ্রন্থের উল্লেখ আছে। হয়তো এই গোরক্ষ এবং গোরক্ষনাথ একই ব্যক্তি। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয় অবশ্য বলিয়াছেন, জ্ঞানকারিকা নামে একটি গ্রন্থ গোরক্ষনাথের নামের সঙ্গে জড়িত। গোরক্ষনাথ কাহিনী নানা রূপে রূপান্তরিত হইয়া উত্তর-ভারতের সর্বত্র– নেপালে, তিব্বতে, মধ্য দেশে, মহারাষ্ট্রে, গুজরাটে, পাঞ্জাবে— ছড়াইয়া পড়িয়াছিল। পঞ্জাবের যোগীরা, বাঙলাদেশের নাথাযোগীরা, নাথপন্থীরা সকলেই গোরক্ষনাথকে গুরু বলিয়া স্বীকার করেন। পরবর্তী কালে গোরক্ষাসংহিতা, গোরক্ষসিদ্ধান্ত প্রভৃতি গ্রন্থে গোরক্ষনাথের প্রতিষ্ঠিত ধর্ম সম্প্রদায়ের মতামত বিধূত হইয়া আছে। বাঙলাদেশে প্রচলিত কাহিনী অনুযায়ী গোরক্ষনাথ রাজা গোপীচন্দ্র বা গোবিন্দচন্দ্রের সমসাময়িক ছিলেন।

জলন্ধরীপাদ

গোরক্ষনাথের শিষ্য ছিলেন জলন্ধরীপাদ বা জলন্ধরপাদ। বাঙলাদেশে প্রচলিত কাহিনী অনুসারে গোপচাদের গল্পের হাড়ি-পা এবং জলন্ধরীপাদকে অনেকে এক এবং অভিন্ন বলিয়া মনে করেন। তারনাথের মতে জলন্ধরীর শিষ্য ছিলেন কৃষ্ণাচার্য এবং তাহার সঙ্গে হাড়ি-পা’র একটা সম্বন্ধও ছিল। তারনাথ এবং সুমপা দুই জনই বলিতেছেন, জলন্ধরীর যথার্থ নাম ছিল সিদ্ধ বালপাদ, কিন্তু নেপাল ও কাশ্মীষ্মের মধ্যবর্তী জলন্ধর নামক স্থানে তিনি কিছুদিন বাস করিয়াছিলেন বলিয়া লোকে তাহাকে জলন্ধরের আচার্যবলিয়াই জানিত। তিনি উদ্যান, নেপাল, অবন্তী এবং চাটিগ্রাম বা চট্টগ্রামে গিয়াছিলেন ভ্রমণে; গোপীচন্দ্রের পুত্র বিমলচন্দ্র তখন চট্টগ্রামের রাজা। ত্যাঙ্গুর-তালিকায় এক মহাপণ্ডিত, মহাচার্য জালন্ধর, আচার্য জলন্ধরী বা সিদ্ধাচার্য জালন্ধরী পাদের উল্লেখ আছে; এই মহাচার্য জালন্ধর বা জালন্ধরীপাদ আর গোপীৰ্চাদগুরু জলন্ধরী পাদ বোধ হয় এক এবং অভিন্ন ব্যক্তি। পূর্বোক্ত জলন্ধরের নামে তাঙ্গুর-তালিকায় চারিখানা বজ্রযানী-গ্রন্থের উল্লেখ আছে।

জালন্ধরীপাদের অন্যতম শিষ্য ছিলেন বিরূ-পা বা বিরূপাদ। তারনাথ বলিতেছেন, এই বিরূ-পা ছিলেন সিদ্ধাচার্যদের অন্যতম। সুমপার মতে এই বিরূ-পার জন্ম হইয়াছিল ত্রিপুরের (ত্রিপুরা) পূর্বদিকে, এবং দেবপালের রাজত্বকালে। তাঙ্গুর-তালিকায় দেখিতেছি, আচার্য-মহাচার্য বিরূ-পা এবং মহাযোগী-যোগীশ্বর বিরূপ প্ৰায় দশখানা বজ্রযানী পুঁথি, এবং বিরূপাদ-চতুরশীতি এবং দোহাকোষ নামে দুইখানা পদ ও দোহাগ্ৰন্থ রচনা করিয়াছিলেন। চর্যাগীতিতে বিরূপার একটি গীতি স্থান পাইয়াছে, এবং হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয়ের মতে বিরূপগীতিকা ও বিরূপবজগীতিকা নামক দুইটি গীতিগ্রন্থেরও লেখক ছিলেন বিরূ-পা। বিরূ-পা মহাসিদ্ধ ডোম্বি-হেরুকের অন্যতম গুরু ছিলেন। তিব্বতী ঐতিহ্যমতে ডোম্বি-হেরুক ছিলেন মগধের জনৈক ক্ষত্রিয় রাজা।

সরহ বা সরহপাদের কথা আগেই সরোরুহোবজ প্রসঙ্গে বলিয়াছি; এখানে পুনরুল্লেখের আর প্রয়োজন নাই।

তিলো-পা

তিলপ, তিল্লাপ, তিল্পিপা, তিলিপা, তিল্লোপা, তৈলোপ, তোল্লাপা, তেলোপা, তিলোপা, তৈলিকপাদ বা তেলিযোগী নামে একজন প্ৰসিদ্ধ সিদ্ধাচার্য ছিলেন মহীপালের সমসাময়িক। তিব্বতী ঐতিহ্যে তিনি ছিলেন ট্রাসাটির্গাও বা চট্টগ্রামের এক ব্ৰাহ্মণ, পরে বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষা গ্রহণ করিয়া প্রজ্ঞাবাৰ্মা বা প্রজ্ঞাভদ্ৰ নামে পরিচিত হন। তিনি চারখানা বোজযানী গ্ৰন্থ, একখানা দোহাকোষ, একখানা সহজওগ্রন্থ রচনা করিয়াছিলেন। তিব্বতী ঐতিহ্যে আর এক সিদ্ধাচার্য তৈলিকপাদের কথা আছে র্যাহার বাড়ি ছিল ওদ্যানে। এই দুই সিদ্ধাচার্য তৈলিকপাদ এক এবং অভিন্ন বলিয়া মনে না করিবার কোনও কারণ নাই।

নাড়ো-পা

তৈলিকপাদের প্রধান শিষ্য ছিলেন নারো, ন্যারোপা, ন্যারোৎপা, নাড়োপা, নাড়, নাড়পাড়া, প্রভৃতি নামে পরিচিত জনৈক সিদ্ধাচার্য। তাহার অন্য দুইটি নাম বা উপাধি ছিল জ্ঞানসিদ্ধি ও যশোভদ্র। নাড়োপা জাতে ছিলেন শুড়ি, তাহার বাসস্থান ছিল প্রাচ্য-ভারতে সালপুত্ৰ নামক স্থানে; মগধের পশ্চিমে ফুল্লহরি নামক স্থানে (বিহার?)। তিনি তন্ত্রাভ্যাস করিতেন। এক তিরুবতী। ঐতিহ্যে তিনি ছিলেন প্রাচ্য দেশের রাজা শাক্য শুভশাস্তিবর্মর পুত্র; আর এক ঐতিহ্যমতে তিনি ছিলেন জনৈক কাশ্মীরী ব্রাহ্মণের পুত্র, পরে হন এক তীৰ্থিক (ব্রাহ্মণ) পণ্ডিত, এবং সর্বশেষে যশোধর বা জ্ঞানসিদ্ধি নাম লইয়া বৌদ্ধধর্মে সিদ্ধি লাভ করেন। তাঙ্গুরে তাঁহাকে মহাচার্য, মহাযোগী এবং শ্ৰীমহামুদ্রাচার্য উপাধিতে ভূষিত করা হইয়াছে। আচার্য জেতারির পশ্চাদগামী হিসাবে তিনি বিক্রমশীল-বিহারের উত্তরদারী পণ্ডিত নিযুক্ত হইয়াছিলেন, এবং বিদায় লইবার সময় আচার্য দীপঙ্করের উপর বিহারের দায়িত্বভার অর্পণ করিয়া যান। বৌদ্ধ আগমে ছিল তাহার পরম পাণ্ডিত্য; হেরুক, হেবজ এবং অন্যান্য বজ্রযানী দেবদেবীর উপর তিনি প্রায় দশখান। সাধন গ্রন্থ, সেকোদেশ-টীকা নামে কালচক্রযানী দীক্ষা সম্বন্ধে অন্তত একখানা গ্ৰন্থ, দুখানি বঙ্গীতি, একটি নাড়-পণ্ডিতগীতিকা এবং বর্জপদসারসংগ্ৰহ গ্রন্থের উপর একটি পঞ্জিকা বা টীকা রচনা করিয়াছিলেন।

কাহ্ন-পা

লুইপা-মৎস্যেন্দ্রনাথ এবং গোরক্ষনাথের পরই যে সিদ্ধাচার্যের প্রসিদ্ধি তাহার নাম কৃষ্ণ বা কৃষ্ণপাদ বা কতু-পা বা কাহ্ন-পা। কাহ্ন-পা ছিলেন জলন্ধৱীপাদের শিষ্য, এবং নাথপন্থী ও সহজপন্থীদের অন্যতম প্রধান আচার্য। তারনাথ বুলিতেছেন, জলন্ধরীশিষ্য কৃষ্ণাচার্যের বাড়ি ছিল পাদ্যানগর বা বিদ্যানগর; তিব্বতী ঐতিহ্যান্তর মতে কাহ্ন-পা ছিলেন দেবপালের সমসাময়িক জনৈক কায়স্থ, বাসস্থান ছিল সোমপুরী (বিহার)। সুমপা বলিতেছেন, জালন্ধর শিষ্য কাহ্ন ছিলেন ব্ৰাহ্মণ বংশজাত জনৈক তান্ত্রিক আচার্য। তারনাথ জ্যেষ্ঠ ও কনিষ্ঠ দুই কৃষ্ণাচার্যের কথা বুলিতেছেন; তাহার মতে কনিষ্ঠ কৃষ্ণাচার্যই ছিলেন হেবজ, শম্বর, এবং জামন্তক প্রভৃতি বজ্রযানী দেবতার সাধনগ্রন্থের লেখক এবং দোহ-রচয়িতা; বর্ণে ছিলেন তিনি ব্রাহ্মণ। অন্য আর এক তিব্বতী ঐতিহ্যমতে এক কৃষ্ণ ছিলেন সোমপুরী-বিহারের অধিবাসী। জালন্ধর-শিষ্য কাহ্ন-কাহ্নপা-কৃষ্ণাচার্য এক এবং অভিন্ন, সন্দেহ নাই; তিনিই ছিলেন সোমপুরী বা সোমপুরী-বিহারের অধিবাসী, তান্ত্রিক ও বজ্রযানী সাধনগ্রন্থের লেখক এবং দোহা—রচিয়তা, এবং তারনাথ কথিত কনিষ্ঠ কৃষ্ণাচার্য। যাহা হউক, কাহ্ন-কাহ্নপা কৃষ্ণাচার্য পঞ্চাশ খানারও উপর গ্রন্থ রচনা করিয়াছিলেন; অধিকাংশই বজ্ৰযান সাধন-সম্পর্কিত। তাহা ছাড়া চর্যাগীতি-গ্রন্থে কাহ্ন-কৃষ্ণাচার্যপদ-কৃষ্ণপদের দশখানা গীতি আছে প্রাচীনতম বাঙলা ভাষায়, এবং কৃষ্ণাচার্য-রচিত একখানা দোহাকোষ হরপ্রসাদ শাস্ত্রী কর্তৃক সম্পাদিত হইয়া প্রকাশিত হইয়াছে। পণ্ডিতাচার্য শ্ৰীকৃষ্ণপাদ-বিরচিত, গোবিন্দপালের ৩৯ রাজ্যাঙ্কে লিখিত হেবজ্রপঞ্জিকা নামে একখানা পুঁথি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারে রক্ষিত আছে।

দারিক, কিল-পা, কর্মার, বীণা-পা, গুণ্ডারীপাদ, কঙ্কণ, গর্ভপাদ

বাঙলার সিদ্ধাচার্যদের তালিকা সুদীর্ঘ। সকলের কথা বলিবার স্থান নাই; প্রয়োজনও নাই। কয়েকজনের কথা উল্লেখ করিতেছি মাত্র। লুই-পা ও নারো-পার এক শিষ্য ছিলেন দারিক বা দারিপাদ; তিব্বতী ঐতিহ্যমতে তাহার বাড়ি ছিল সালিপুত্ৰ (মগধ) নামক স্থানে এবং তিনি (পালবংশীয়?) ইন্দ্ৰপালের সমসাময়িক। ত্যাঙ্গুর—তালিকায় তদ্রচিত বারোখানা বজ্রযানী-গ্রন্থের উল্লেখ আছে; চর্যাগীতিতে একটি গীতিও স্থান পাইয়াছে। লুই-পাঁর এক বংশধর ছিলেন কিল-পা বা কিল-পাদ; দোহাচাৰ্য-গীতিকাদৃষ্টি নামে তিনি একখানা গ্ৰন্থ রচনা করিয়াছিলেন। বিরূ-পা’র এক বংশধর ছিলেন কর্মর বা কর্মরি বা কমরি; তিনি মগধান্তৰ্গত সালিপুত্রের এক কর্মকার ছিলেন, এবং অন্তত একখানা বজ্রযানী গ্রন্থ রচনা করিয়াছিলেন। বীণাপাদ বা বীণা-পাও ছিলেন বিরূপার অন্যতম বংশধর। তিনি খুব ভালো বীণা বাজাইতেন, গহুরের (গৌড়ের?) এক ক্ষত্রিয় পরিবারে তাহার জন্ম হয়। বজাডাকিনী এবং গুহ্যসমাজের উপর তিনি অন্তত দুখানি গ্রন্থ রচনা করিয়াছিলেন; চর্যাগীতিতে তদ্রচিত একটি গীতিও স্থানলাভ করিয়াছে। কৃষ্ণের বা কৃষ্ণপদের এক বংশধর ছিলেন ধর্মপাদ বা গুণ্ডারীপাদ। ত্যাঙ্গুর-তালিকায় তদ্রচিত বারোখানা গ্রন্থের নামোল্লেখ আছে এবং চর্যাগীতিতে আছে দু’টি গীত। কম্বলপাদের এক বংশধর ছিলেন কঙ্কন; চর্যাগীতিতে তদ্রচিত একটি গীত আছে; তাহা ছাড়া চর্যান্দোহাকোর্যগীতিকা নামে তিনি একখানা গ্রন্থও রচনা করিয়াছিলেন। গর্ভরী-পা বা গর্ভপাদ বা গাভুরসিদ্ধ হেবজের উপর একখানা গ্রন্থ এবং একখানা বজ্ৰযান টীকা রচনা করিয়াছিলেন।

বাঙলাদেশে রচিত মহাযান গ্রন্থাদি

বজ্রযানী-কালচক্রযানী মন্ত্রযানী এবং বৌদ্ধ তান্ত্রিক অন্যান্য পন্থর পণ্ডিত ও আচার্যদের যে সংক্ষিপ্ত উল্লেখ ও পরিচয় দেওয়া হইল তাহা হইতে এ কথা মনে হওয়া স্বাভাবিক যে, এই সব আচার্যরা শুধু কেবল বজ্রযানী সাধন, দোহা এবং গীতই শুধু রচনা করিয়াছেন, শুধু তন্ত্রধর্মেরই অনুশীলন করিয়াছেন শত শতু গ্রন্থে। এ-ধারণা কতকাংশে সত্যু হইলেও সর্বাংশে নয়। এই সব পণ্ডিত ও আচার্যরা মহাযানী ন্যায়শাস্ত্র, বিশুদ্ধ বিজ্ঞানবাদী দর্শন প্রভৃতির আলোচনাও করিয়াছেন, এবং কিছু কিছু মৌলিক চিন্তার প্রমাণও দিয়াছেন। ধর্মপালের সময় হইতেই সে-চেষ্টা আরম্ভ হইয়াছিল।

অষ্টসাহস্ত্ৰিকা প্রজ্ঞাপারমিতার উপর আচার্য হরিভদ্র-রচিত অভিসময়ালঙ্কারাবলোক নামীয় টীকায় হরিভদ্র নাগার্জুন-প্রবর্তিত মধ্যমক চিন্তা ও মৈত্ৰেয়নাথের যোগাচার-চিন্তার যে সমন্বয় চেষ্টা করিয়াছেন তাহা উল্লেখযােগ্য। টীকাখানি লেখা হইয়াছিল ধর্মপালের পৃষ্ঠপোষকতায়, ত্ৰৈকূটক-বিহারে। একাদশ শতকের গোড়ায় আচার্য রত্নভদ্র কর্তৃক এই গ্ৰন্থ তিব্বতীতে অনুদিত হয়। তিব্বতী ঐতিহ্যে জানা যায়, হরিভদ্র এই সুপ্রসিদ্ধ টীকাটি ছাড়া আরও অনেকগুলি গ্রন্থ রচনা করিয়াছিলেন মহাযান তত্ত্বাদি সম্বন্ধে; তন্মধ্যে পঞ্চবিংশতিসাহস্ত্ৰিকার একটি সংক্ষিপ্তসার, সঞ্চয়টীিকাসুবোধিনী, স্ফুটার্থনামক টীকা এবং প্রজ্ঞাপারমিতভাবনাই উল্লেখযোগ্য! আচার্য অসঙ্গ ও বিমুক্তসেনের মতামত ও গ্রন্থাদির উপরও তিনি কিছু আলোচনা করিয়াছিলেন।

হরিভদ্রের প্রধান শিষ্য ছিলেন আচার্য বুদ্ধশ্ৰীজ্ঞান বা বুদ্ধজ্ঞানপাদ। তিব্বতী জনশ্রুতিমতে তিনি ছিলেন ধর্মপালের সমসাময়িক এবং বিক্রমশীলা-মহাবিহারের অধ্যক্ষ; তাহার বাড়ি ছিল উড্ডয়ানে। তিনি মহাযানলক্ষ্মণসমুচ্চয় নামক একখানা মৌলিক গ্রন্থ এবং প্রজ্ঞাপ্ৰদীপাবলী নামে অভিসময়ালঙ্কারের একটি বৃত্তি রচনা করিয়াছিলেন।

জিনমিত্র নামে আর একজন বৌদ্ধ আচার্য ছিলেন নরপতি ধর্মপাল, আচার্য দানশীল ও শীলেন্দ্ৰবোধির সমসাময়িক। শেষোক্ত দুইজন আচার্যের সঙ্গে একযোগে এবং তিব্বতরাজের অনুরোধে জিনমিত্র একখানি সংস্কৃত-তিব্বতী অভিধান রচনা করিয়াছিলেন; এই তিনজন একযোগে নাগার্জনের প্রতীত্যসমুৎপাদহািদয়কারিকা-গ্ৰন্থখানি তিব্বতীতে অনুবাদও করিয়াছিলেন। জিনমাত্র আর একটি গ্রন্থ তিব্বতী ভাষায় অনুবাদ করিয়াছিলেন তিব্বতী পণ্ডিত জ্ঞানসেনের সহযোগিতায়; গ্রন্থটির নাম অভিধর্মসমুচ্চয়ব্যাখ্যা।

শাস্তুরক্ষিতের মধ্যমকালঙ্কার-কারিকা ও তাহার বৃত্তি এবং সত্যদ্বয়বিভঙ্গপঞ্জিকাও মহাযানী গ্রন্থ। দশম শতকের শেষে বা একাদশ শতকের গোড়ায় রত্নাকরশান্তি মৈত্ৰেয়নাথের অভিসময়ালঙ্কার-গ্রন্থের উপর শুদ্ধিমতী নামে একটি টীকা রচনা করিয়াছিলেন। তদ্রচিত সারোত্তমা, প্রজ্ঞাপারমিতাভাবনোপদেশ এবং প্রজ্ঞাপারমিতোপদেশ এই তিনখানি গ্ৰন্থ প্রজ্ঞাপারমিতাতত্ত্বের ব্যাখ্যা। দীপঙ্করগুরু জেতারির বোধিচিত্তোৎপাদসমাদানবিধি এবং বোধিসত্ত্বশিক্ষাক্রম দুইই মহাযানী গ্ৰন্থ।

তিব্বতী ঐতিহ্য মতে দীপঙ্কর মহাযানের উপর প্রায় শতাধিক গ্ৰন্থ রচনা করিয়াছিলেন; তন্মধ্যে শিক্ষাসমুচ্চয়-অভিসময়, সূত্রার্থসমুচ্চায়োপদেশ, প্রজ্ঞাপারমিতাপিণ্ডার্থপ্রদীপ, মধ্যমোপদেশ সত্যদ্বয়বার, সংগ্ৰহগর্ভ বোধিসত্ত্বমণাবলী, মহাযানপথসাধনবৰ্ণসংগ্রহ এবং বোধিমাগপ্রদীপ উল্লেখযোগ্য।

রামপালের রাজত্বকালে অভয়াকর-গুপ্ত যোগাবলী, মৰ্মকৌমুদী, এবং বোধিপদ্ধতি নামে তিনখানা গ্ৰন্থ রচনা করিয়াছিলেন; তিনখানাই মহাযান গ্ৰন্থ এ-সম্বন্ধে সন্দেহ নাই। কুলদত্ত-রচিত মহাযানের ক্রিয়ানুষ্ঠান সম্বন্ধে বিস্তৃত ভাষ্য ক্রিয়াসংগ্ৰহপঞ্জিকাও এ-প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য। সোমপুর-বিহারবাসী বোধিভদ্রের জ্ঞানসারসমুচ্চয়ও মহাযানগ্রন্থ সন্দেহ নাই। জগদলের। বিভূতিচন্দ্ৰ শান্তিদেব-রচিত বোধিচর্যবিতারের একখানি টাকা লিখিয়াছিলেন; আর একখানি টীকা রচনা করিয়াছিলেন দীপঙ্কর স্বয়ং।

বাঙলার বৌদ্ধ বিহার

এতক্ষণ যে-সব বৌদ্ধ আচার্য ও তাঁহাদের জ্ঞান-বিজ্ঞান সাধনার কথা বলা হইল তাহার কেন্দ্র ছিল বাঙলার বৌদ্ধ-বিহারগুলি, এবং তাহাদের সংখ্যা কিছু কম ছিল না। জ্ঞান-বিজ্ঞান সাধনার বিবৃতি-প্রসঙ্গে এই সব বিহারের কথা কিছু কিছু উল্লিখিত হইয়াছে; কিন্তু সমসাময়িক বাঙলার সংস্কৃতি-প্রচেষ্টায় ইহাদের দানের পরিমাপ করিতে হইলে সমগ্রভাবে ইহাদের একটু পরিচয় লণ্ডয়া প্রয়োজন।

পাল-চন্দ্র পর্বের আগেও বাঙলাদেশে বিহার-সংঘারামের কিছু যে অপ্রতুলতা ছিল না, তাহার সাক্ষ্য রাজকীয় লিপিমালা, ফা-হিয়েন, যুয়ান-চোয়াঙ ও ই-ৎসিঙের বিবরণ। বৈনাগুপ্তের গুণাইঘর-পট্টে তিন তিনটি বিহারের উল্লেখ আছে- রুদ্রদত্তের আশ্রম-বিহার, রাজবিহার ও জিনসেন-বিহার। ফা-হিয়েনের সময় এক তাম্রলিপ্তিতেই বাইশটি বিহার ছিল এবং বহু স্থবির ও আচার্য সেই সব বিহারে বাস করিতেন। য়ুয়ান-চোয়াঙের কালে পুণ্ড্রবর্ধনে ছিল বিশটি বিহার, সমতটে ত্রিশটি, তাম্রলিপ্তিতে দশটি, কযঙ্গলে ছয়-সাতটি এবং কর্ণসুবৰ্ণে দশটি। পুণ্ড্রবর্ধন-রাজধানীর প্রায় তিন মাইল দক্ষিণে ছিল পো-চি-পো বিহার; সুপ্ৰশস্ত ও আলোকজজুল ছিল ইহার অঙ্গন, সুউচ্চ ছিল ইহার মণ্ডপ ও চূড়া। সাত শত মহাযানী শ্রমণ এবং পূর্ব-ভারতের অনেক খ্যাতনামা আচার্যের অধিষ্ঠান ছিল সংঘারাম। মহাস্থান-সমীপবর্তী ভাসূ-বিহারের ধ্বংসাবশেষই বোধ হয় য়ুয়ান-চোয়াঙ-বর্ণিত পো-চি-পো বিহার। কর্ণসুবর্ণের সর্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ বিহার ছিল লো-টো-মো-চি বা রক্তমৃত্তিক (রাঙামাটি)-বিহার। এই বিহারেরও কক্ষগুলি ছিল প্রশস্ত এবং সুউচ্চ সৌধগুলি ছিল একাধিক তলযুক্ত। ক্যঙ্গলের উত্তরাংশে গঙ্গার অনতিদূরে একটি সুউচ্চ সুগঠিত বিহার ছিল; চারিদিকের দেয়ালে নানা অলংকরণ, নানা দেবদেবীর খোদিত মূর্তি। ই-এসিঙের কালে তাম্রলিপ্তির শ্রেষ্ঠ বিহার ছিল পো-লো-হো বা বরাহ বিহার। এই বিহারের ভিক্ষুদের জীবনযাত্রা, তাহাদের দৈনন্দিন নিয়ম-সংযম খ্যাতি ও সমৃদ্ধি ভিক্ষু-ভিক্ষুণীদের পরস্পর সম্বন্ধ প্রভৃতি বিষয়ে কিছু কিছু বিবরণ ই-ৎসিঙ রাখিয়া গিয়াছেন। এই সমস্ত বিহারের ব্যয়ভার কীভাবে নির্বাহ হইত ফা-হিয়েন ও ই-ৎসিঙ তাহারও কিছু আভাস রাখিয়া গিয়াছেন। ফা-হিয়েন বলিতেছেন,

‘দেশের রাজা-রাজড়া, নাগরিক ও অন্যান্য সম্রাপ্ত ব্যক্তিরা বৌদ্ধ শ্রমণদের জন্য বিহার নির্মাণ এবং তাঁহাদের সকল প্রকার ব্যয়ভার নির্বাহের জন্য ভূমি-ঘরবাড়ি, উদ্যান আরাম প্রভৃতি দান করিয়া থাকেন। এক রাজার পর অন্য রাজা সেই উদ্দেশ্যে তাম্রশাসন দান ও পট্টিকৃত করিয়াছেন। সেই জন্য কেহই সে-সব আত্মসাৎ বা বাজেয়াপ্ত করিতে পারে না।‘

ই-ৎসিঙের বর্ণনাও উল্লেখযোগ্য।

‘বুদ্ধ ভিক্ষুদের পক্ষে চাষবাসের কাজ নিষেধ করিয়া গিয়াছিলেন, সেই জন্য তাঁহারা বিহার বা ভিক্ষুসংঘের কৃষিভূমি বিনা করে অন্যকে চাষবাস করিতে দিতেন এবং পরিবর্তে উৎপাদিত শস্যের অংশমাত্র গ্রহণ করিতেন। তাহার ফলে তাহারা সাংসারিক চিস্ত হইতে মুক্ত থাকিতেন, জলসেচনের ফলে প্ৰাণীহত্যাও তাঁহাদের করিতে হইত না, শীল ও সদাচার পালন করা সহজ হইত। ভিক্ষুদের পরিচ্ছদের ব্যয় সংঘের সাধারণ সম্পত্তি হইতেই বহন করা হইত। বিহারগুলি যে নিষ্কর ভূমি ভােগ করিত সেই ভূমির উৎপাদিত শস্য, বৃক্ষ ও ফল হইতে ভিক্ষু-শ্রমণদের চীবর, অন্তর্বাস, বহির্বােস প্রভৃতি সব কিছুর ব্যয় নির্বাহ হইত। গৃহী ভক্ত ও উপাসকের নিকট হইতে তাঁহারা নানাপ্রকারের দানও গ্রহণ করিতেন; আহার্য গ্রহণেও কাহারও কোনও আপত্তি ছিল না। আহার্য ও পরিচ্ছদ সম্বন্ধে তাহারা নির্ভাবনা ছিলেন বলিয়াই সুস্থ ও স্বচ্ছন্দচিত্তে ধান ও পূজায় (এবং জ্ঞান-বিজ্ঞান সাধনায়) তাহারা কালাতিপাত করিতে পারিতেন।‘

উপরে উল্লিখিত গ্ৰন্থ-লেখকদের জীবনী এবং গ্রন্থনামগুলি বিশ্লেষণ করিলেই বুঝিতে পারা যায়, এই সব বিহারের আচাৰ্যরা তাঁহাদের নিজ নিজ ধৰ্মশাস্ত্ৰে অধ্যয়ন-অধ্যাপনা তো করিতেনই, তাহা ছাড়া মহাযান ন্যায় ও দর্শন, ব্রাহ্মণ্য তীৰ্থিক শাস্ত্রাদি, ব্রাহ্মণ্য তন্ত্র, শব্দবিদ্যা; ব্যাকরণ, জ্যোতিষ প্রভৃতির অধ্যয়ন-অধ্যাপনাও হইত। পুঁথি নকল ও অনুবাদ করা, বৌদ্ধ বজ্রযানী-তান্ত্রিক দেবদেবীর ছবি আঁকা (ফা-হিয়েন এই ধরনের ছবি আঁকাও অভ্যাস করিয়াছিলেন তাম্রলিপ্তির বিহারে) প্রভৃতিও বিহারের ভিক্ষুকদের অন্যতম অনুশীলনের বিষয় ছিল। প্রত্যেক বিহারের ছোট বড় গ্রন্থাগারও ছিল, এ-অনুমানও খুব অযৌক্তিক নয়; নালন্দা-মহাবিহারের ইতিহাস এবং প্রত্নসাক্ষ্যই ভাহার প্রমাণ। ই-ৎসিঙের প্রায় সমসাময়িক :আচার্য বন্দ্য সংঘমিত্রের একটি বিহার ছিল, এ-খবর পাওয়া যায় দেবখঙ্গের আশ্রফপুর লিপিটিতে।

অষ্টম শতকীয় বাঙলার প্রসিদ্ধতম বৌদ্ধ বিহার সোমপুরী-মহাবিহার। এই বিহারেরই ধ্বংসাবশেষ লোকলোচনের গোচর হইয়াছে রাজশাহী জেলার পাহাড়পুরে। ক্রমহ্রস্বায়মান সুউচ্চ ত্রিতল মন্দির-বিহার; সর্বতোভদ্র তাহার স্থাপত্যরূপ। উত্তর দিকে সুপ্ৰশস্ত সিঁড়ি ধাপে ধাপে উঠিয়া গিয়াছে ত্রিতল পর্যন্ত। দ্বিতীয় তলায় মন্দির-প্রকোষ্ঠী; বিহারের অধিষ্ঠাতা দেবতা এই মন্দিরে পূজিত হইতেন। ত্রিতলের উপরে শিখরাকৃতি (?) চূড়া। মন্দিরের চারিদিকে সুপ্রশস্ত অঙ্গন; প্রত্যেক কোণে একটি করিয়া মণ্ডপ; সর্বতোভদ্র বিহার-মন্দিরের চারিদিকে ভিক্ষুদের বাসকক্ষ, সর্বসুদ্ধ ১৭৭টি। গোড়ায় বোধ হয়। এখানে একটি জৈন-বিহার ছিল। অষ্টম-শতকের শেষার্ধে ধর্মপাল নরপতির পৃষ্ঠপোষকতায় বিস্তৃত অঙ্গন ব্যাপিয়া সুপ্ৰশস্ত সুসমৃদ্ধ বিহার-মন্দির গড়িয়া ওঠে। একাদশ শতকের শেষ বা দ্বাদশ শতকের গোড়া পর্যন্ত এই মহাবিহার সমসাময়িক বৌদ্ধ জ্ঞান-বিজ্ঞান ও অধ্যাত্ম-সাধনার অন্যতম সুপ্ৰসিদ্ধ কেন্দ্ররূপে বিরাজমান ছিল। ধৰ্মপালের পৃষ্ঠপোষকতায় প্রতিষ্ঠিত ও বর্ধিত বলিয়া বিহারটির অন্যতম নামই ছিল শ্ৰীধৰ্মপালদেবী-মহাবিহার; পাহাড়পুরের ধ্বংসাবশেষের মধ্যে যে মাটির শীলমোহর পাওয়া তারনাথ ও সুমপা দুইজনই বলিতেছেন, বিহারটির নির্মাতা দেবপাল; একটু ভুল করিয়াছেন, সন্দেহ কি? সুপ্ৰসিদ্ধ আচার্য ও মহাপণ্ডিত বোধিভদ্র, আচার্য কালপাদ বা কালমহাপাদ, স্বনামধন্য দীপঙ্কর, স্থবিরবৃদ্ধ বীৰ্য্যেন্দ্ৰ আচার্য করুণাশ্ৰীমিত্র পমুখেরা কোনও না কোনও সময়ে এই মহাবিহারের অধিবাসী ছিলেন। এই বিহারের অন্তেবাসী মহাযান যায়ী বিজয়াচার্য স্থবিরবুদ্ধ বীৰ্যেন্দ্র বুদ্ধগয়ায় একটি স্থানক বুদ্ধমূর্তি প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন। পাহাড়পুরের ধ্বংসস্তূপের মধ্যে আবিষ্কৃত খ্ৰীষ্টীয় একাদশ শতকের লিপি-উৎকীর্ণ একটি লেখা হইতে জানা যায়, জনৈক শ্ৰীদশাবলগৰ্ভ সমস্ত জীবের কল্যাণার্থ এই বিহার-চত্বরের কোথাও একটি স্তম্ভ প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন। একাদশ শতকের শেষাশেষি বা দ্বাদশ শতকের গোড়ায় সোমপুরের এই বিহারে যতি বিপুল শ্ৰীমিত্রের পরম গুরুর গুরু, যতি করুণাশ্ৰীমিত্র বাস করিতেন। তখন একদিন বঙ্গালী-সৈন্যদল আসিয়া বিহারে অগ্নিসংযোগ করে; প্ৰজ্বলমান আলয়ে দেবতার পদাশ্ৰয় করিয়া করুণাশ্ৰী পড়িয়ছিলেন; তবুও সেই গৃহ পরিত্যাগ করেন নাই; সেই ভাবেই অগ্নিদগ্ধ হইয়া তিনি প্রাণত্যাগ করেন। বিপুলশ্রমিত্র অগ্নিদাহে বিনষ্ট প্রকোষ্ঠগুলির সংস্কার সাধন করেন, বিহার-প্রাঙ্গণে একটি তারা-মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন এবং সোমপুরীর বুদ্ধমূর্তিকে বিচিত্র স্বর্ণভরণে অলংকৃত করেন। তিনি নিজে বহুকাল বশী সন্ন্যাসীর মতো সেই বিহারে যাপন করিয়াছিলেন।

সোমপুরীর পরই বাঙলার প্রসিদ্ধ বিহার ছিল জগদ্দল-মহাবিহার। এই বিহারটি প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল একাদশ শতকের শেষে, না হয় দ্বাদশ শতকের গোড়ায়, নরপতি রামপালের আনুকূল্যে ও পৃষ্ঠপোষকতায়। রামাবতীতে রামপালের রাজধানীর সন্নিকটেই ছিল বোধ হয় ইহার অবস্থিতি। এই বিহারের অধিষ্ঠাতা দেবতা ও অধিষ্ঠাত্রী দেবী ছিলেন যথাক্রমে অবলোকিতেশ্বর ও মহত্তারা। জগদলের আয়ু স্বল্পকাল, কিন্তু সেই স্বল্পকালের মধ্যেই সমসাময়িক বৌদ্ধ জগতের সর্বত্র জগদলের প্রতিষ্ঠা বিস্তৃতি লাভ করিয়াছিল। বিভূতিচন্দ্ৰ, দানশীল, মোক্ষাকর-গুপ্ত, শুভাকর গুপ্ত, ধর্মােকর প্রভৃতি মনীষী আচার্যরা কোনও না কোনও সময়ে এই মহাবিহারের অধিবাসী ছিলেন।

উত্তরবঙ্গে যেমন সোমপুরী-বিহার ও জগদ্দল-বিহার, পূর্ববঙ্গে তেমনই সুপ্ৰসিদ্ধ বিহার ছিল বিক্রমপুরী-বিহার, ঢাকা জেলার বিক্রমপুর-পরগণায়। এই বিক্রমপুরী বিহারও বোধ হয় বিক্রমশীল-ধৰ্মপালের আনুকূল্যেই প্রতিষ্ঠিত ও লালিত হইয়াছিল। এই বিক্রমপুরী-বিহারই অন্তত কিছুদিনের জন্য অবধূতাচার্য কুমারচন্দ্র এবং লক্ষ্মীঙ্কর্যশিষ্য লীলাবজের কর্মভূমি ছিল।

ধর্মপালের সমসাময়িক আর একটি বিহার ছিল বাঙলাদেশে, কিন্তু কোন স্থানে তাহা বলা কঠিন। এই বিহারটির নাম ত্ৰৈকূটক-বিহার এবং এই বিহারে বসিয়াই আচার্য হরিভদ্র অষ্টসাহস্ত্ৰিকা-প্রজ্ঞাপারমিতার উপর তাহার সুপ্রসিদ্ধ টীকাটি রচনা করিয়াছিলেন। সুমপা রাঢ়দেশের এক ত্ৰৈকূটক-দেবালয়ের কথা বলিয়াছেন; ত্ৰৈকূটক-দেবালয় ও ত্ৰৈকূটক-বিহার এক এবং অভিন্ন হওয়া অসম্ভব নয়।

চট্টগ্রাম অঞ্চলেও একটি প্রসিদ্ধ বিহার ছিল; তাহার নাম পণ্ডিত-বিহ্বার। এই বিহার ছিল সিদ্ধাচার্য তৈলপাদের কর্মভূমি। বর্তমান ত্রিপুরা-জেলার পট্টিকেরক নামক স্থানে একটি বিহার ছিল, তাহার নাম কনকস্তূপ-বিহার; কাশ্মীরী ভিক্ষু বিনয়শ্ৰীমিত্র এবং তাহার কয়েকজন সহকর্মীর স্মৃতি এই বিহারের সঙ্গে জড়িত। সম্প্রতি ময়নামতী পাহাড়ের উপর যে সুবিস্তৃত ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হইয়াছে তাহা বোধ হয় এই বিহারেরই ধ্বংসাবশেষ।। ১২২০ খ্ৰীষ্ট বৎসরের রণবঙ্কমল্ল হরিকালদেবের তাম্রপট্টোলীতেও পট্টিকের নগরীতে দুৰ্গােত্তার নামে উৎসৰ্গীকৃত একটি বিহারের উল্লেখ আছে।পট্টিকেরকের কনকন্তুপ-বিহার এবং পট্টিকেরার দুর্গেত্তারা-বিহার একই বিহার কিনা বলা কঠিন। উত্তরবঙ্গে আর একটি বিহার ছিল, তাহার নাম দেবীকেট-বিহার; আচার্য অদ্বয়বজি, ভিক্ষুণী মেখলা প্রভৃতির নাম এই বিহারের সঙ্গে জড়িত। ফুল্লহরি ও সন্নগর-বিহার নামে আরও দুইটি বিহার ছিল প্রাচ্য-ভারতে। ফুল্লহরির অবস্থিতি ছিল উত্তর-বিহারে, বোধ হয় মুঙ্গেরের নিকটে। এই বিহারেও অনেক গ্ৰন্থ রচিত ও অনূদিত হইয়াছিল। সন্নগর-বিহারও বৌদ্ধ জ্ঞান-সাধনার অন্যতম কেন্দ্র ছিল, এবং আচার্য বনরত্ন সেই বিহারে বাস করিতেন; কিন্তু ফুল্লহরির মতন এই বিহারটির অবস্থিতিও বোধ হয় ছিল প্রাচীন বাঙলাদেশের বাহিরে।