০২. গুপ্ত ও গুপ্তোত্তর পর্ব

গুপ্ত ও গুপ্তোত্তর পর্ব

মহাস্থান-লিপির কাল হইতে আরম্ভ করিয়া বাঙলায় গুপ্তাধিকার বিস্তৃতির কাল পর্যন্ত আর্য ভাষার রূপ ও প্রকৃতি কিরূপ ছিল এবং সে-ভাষার জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রসার কিরূপ হইয়াছিল তাহা জানিবার কোনো উপায় নাই। অনুমান করা চলে, আৰ্য-ভাষার প্রাচ্য মাগধী-প্ৰাকৃত রূপই ক্রমশ বিস্তার লাভ করিতেছিল, কিন্তু এ-কথাও বোধ হয়। সত্য যে, পোশাকী ভাষা হিসাবে অর্থাৎ পণ্ডিত-সমাজে এবং রাজকীয় ক্রিয়াকর্মে সেই ভাষা স্বীকৃতি ও সমাদর লাভ করিতে পারে নাই। কারণ, পঞ্চম-ষষ্ঠ শতকে যে ক’টি গুপ্তবংশীয় রাজকীয় পট্টোলী আমাদের হস্তগত হইয়াছে তাহার একটিরও ভাষা প্রাচ্য প্রাকৃত নয়, মধ্য ভারতীয় বিশুদ্ধ সংস্কৃত। বাঁকুড়া জেলার শুশুনিয়া পাহাড়ের নিকট পোখরুণা বা পুষ্করণ গ্রামে প্রাপ্ত চতুর্থ শতকের চন্দ্ৰবৰ্মার লিপির ভাষাও সংস্কৃত। লক্ষণীয় এই যে, এই প্রত্যেকটিই লিপিই রচিত গদ্যে এবং সাহিত্যরসের কোনো আভাসও এই রচনাগুলিতে নাই। বস্তুত, সপ্তম শতকীয় লোকনাথের ত্রিপুরা পট্টোলী বা কামরূপরাজ ভাস্করবর্মার নিধনপুর পট্টোলীর আগে সমসাময়িক মধ্য-ভারতীয় অলংকারবহুল কাব্যরীতির কোনও পরিচয়ই বাঙলাদেশে পাইতেছি না। মনে হয়, ষষ্ঠ-সপ্তম শতকের আগে বাঙালী পণ্ডিত-সমাজ সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যের প্রাপধারার সঙ্গে ভালো করিয়া আত্মীয়তা স্থাপন করিতেই পারেন নাই। চেষ্টাটা বোধ হয় আরম্ভ হইয়াছিল আরও কয়েক শতাব্দী আগে হইতেই এবং বৌদ্ধ সংঘারাম এবং ব্রাহ্মণ্য ধর্মকেন্দ্রগুলি ক্ষুদ্র বৃহৎ শিক্ষায়তন হইয়া গড়িয়াও উঠিতেছিল। নহিলে পঞ্চম শতকে তাম্রলিপ্তিতে বসিয়া অধ্যয়ন ও পুঁথি নকল করিয়া চীনা পরিব্রাজক ফা-হিয়েন সুদীর্ঘ দুই বৎসর কাটাইতেন না। সপ্তম শতকে যখন য়ুয়ান-চোয়াঙ কযঙ্গল, পুণ্ড্রবর্ধন, কামরূপ, সমতট, তাম্রলিপ্তি এবং কর্ণসুবর্ণ ভ্ৰমণে আসিয়াছিলেন তখন বৌদ্ধ, নিগ্ৰস্থ ও ব্রাহ্মণ্য শিক্ষা-দীক্ষার প্রসার আরও বাড়িয়া গিয়াছে। এই সব জনপদের লোকদের জ্ঞানস্পাহা ও জ্ঞানচর্চার তিনি ভূয়সী প্রশংসা করিয়াছেন। কযঙ্গলে তখন ছ’সাতটি বৌদ্ধ বিহারে তিন শতের উপর বৌদ্ধ শ্রমণ; পুণ্ড্রবর্ধনের বিশটি বিহারে তিন হাজারের উপর শ্রমণ সংখ্যা, সমতটের ত্রিশটি বিহারে শ্রমণ সংখ্যা দুই হাজারের উপর, কর্ণসুবর্ণের দশটি বিহারে দুই হাজারের উপর এবং তাম্রলিপ্তির দশটি বিহারেও প্রায় একই সংখ্যক শ্রমণের বাস। পুণ্ড্রবর্ধনের পো-সি —পো-(মহাস্থানের সন্নিকটে ভাসু বিহার?)। বিহার এবং কর্ণসুবর্ণের রক্তমৃত্তিকা -(লো-টো-মো-চি) বিহার যে খুবই প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছিল, যুয়ান-চোয়াঙের সাক্ষ্যই তাহার প্ৰমাণ। নালন্দার-মহাবিহারের সঙ্গে ষষ্ঠ-সপ্তম শতকীয় বাঙলার জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিক্ষাদীক্ষার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল এবং বাঙলার শিক্ষার্থী, আচার্য ও রাজবংশ নালন্দা-মহাবিহারের সংবর্ধনের জন্য যে প্রয়াস করিয়াছেন তাহা তুচ্ছ করিবার মতো নয়। এই মহাবিহারের মহাচার্য বিশ্রুতকীর্তি শীলভদ্র ছিলেন সমতটের ব্রাহ্মণ্য রাজবংশের অন্যতম সন্তান এবং তিনিই ছিলেন। য়ুয়ান-চোয়াঙের গুরু। শীলভদ্র ভারতের নানাস্থানে জ্ঞানান্বেষণে ঘুরিয়া ঘুরিয়া অবশেষে নালন্দায় আসিয়া স্থিতিলাভ করেন এবং আচার্য ধর্মপালকে গুরুত্বে বরণ করিয়া লন। দেখিতে দেখিতে বৌদ্ধধর্মের সূক্ষ্ম ও জটিল চিন্তাধারায় তাহার গভীর জ্ঞানলাভ ঘটে এবং তাহার জ্ঞান ও জীবনচর্যার খ্যাতি দেশে বিদেশে ছাড়াইয়া পড়ে। শীলভদ্রের যখন মাত্র ত্রিশ বৎসর বয়স তখন দক্ষিণ-ভারত হইতে এক ব্রাহ্মণ আচার্য নালন্দায় আসেন আচার্য ধর্মপালের সঙ্গে বিতর্কের জন্য। ধর্মপাল শীলভদ্রকে আদেশ করিলেন বিচারে প্রবৃত্ত হইতে। শীলভদ্র অচিরেই সেই ব্ৰাহ্মণ আচার্যকে বিতর্কে পরাভূত করিয়া আপন সিদ্ধান্ত প্রতিষ্ঠা করিলেন। মগধের রাজা সন্তুষ্ট হইয়া শীলভদ্রকে একটি গ্রামের রাজস্ব পুরস্কার স্বরূপ দিতে চাহিলেন; শীলভদ্র প্রথমে রাজী হন নাই; পরে তাঁহাকে স্বীকৃত হইতে হয়। সেই অর্থ দ্বারা তিনি একটি বিহার নির্মাণ করেন এবং বাৎসরিক রাজস্ব দান করিয়া দেন। সেই বিহারের ব্যয় নির্বাহের জন্য। কালক্ৰমে শীলভদ্র নালন্দা মহাবিহারের মহাচার্যের পদে প্রতিষ্ঠিত হন; মহাবিহারের তখন প্রায় ১০,০০০ শ্রমণের বাস। তাঁহাদের মধ্যে একমাত্র শীলভদ্রই সমস্ত শাস্ত্র ও সূত্রে সুপণ্ডিত ছিলেন। বিনীত শ্রদ্ধায় মহাবিহারের সকল শ্রমণেরা তাঁহাকে ‘সদ্ধার্মের ভাণ্ডার বলিয়া সম্ভাষণ করিত। শীলভদ্রের নিকট য়ুয়ান-চোয়াঙ যোগশাস্ত্ৰ অধ্যয়ন করিতেন; য়ুয়ান-চোয়াঙের সঙ্গে সঙ্গে একটি ব্রাহ্মণও সেই অধ্যয়নে যোগদান করিয়াছিলেন। শীলভদ্রের অনুরোধে রাজা শিলাদিত্য হর্ষবর্ধন সেই ব্ৰাহ্মণকে তিনটি গ্রামের ভূমি-রাজস্ব দান করিয়াছিলেন। শীলভদ্র রচিত অন্তত একটি গ্রন্থের কথা আমরা জানি; সে-গ্রন্থটি হইতেছে আৰ্য-বুদ্ধ-ভূমি-ব্যাখ্যান; এই গ্রন্থটি তিব্বতী ভাষায় অনূদিত হইয়াছিল।

সমসাময়িক তাম্রলিপ্তির শিক্ষাদীক্ষার সংবাদ আরও একাধিক চীনা শ্রমণের সাক্ষ্য হইতে জানা যায়। তা চে’ঙ-টেঙা নামে এক চীনা শ্রমণ বারো বৎসর তাম্রলিপ্তিতে বসিয়া সংস্কৃত বৌদ্ধগ্রন্থাদি অধ্যয়ন করিয়া বৌদ্ধধর্মে অসাধারণ বুৎপত্তি লাভ করিয়াছিলেন এবং তাহার পর চীনদেশে ফিরিয়া গিয়া সেখানে উল্লঙ্গের নিদানশাস্ত্ৰ ব্যাখ্যা করিয়াছিলেন। তাও-লিন নামে আর একজন চীনা শ্রমণ তিন বৎসর তাম্রলিপ্তিতে বসিয়া সংস্কৃত শিখিয়া ছিলেন এবং সর্বাস্তিবাদ-নিকায় দীক্ষা গ্রহণ করিয়াছিলেন। ইৎসিঙ তাম্রলিপ্তি আসিয়াছিলেন ৬৭৩ খ্ৰীষ্ট শতকে; সুবিখ্যাত পো-লো-হো (বরাহ?)-বিহারে তা চে’ঙ-টেঙা’র সঙ্গে তাহার দেখা য়াছিল; তিনি এই বিহারে কিছুকাল কাটাইয়াছিলেন, সংস্কৃত ভাষা এবং শব্দবিদ্যার চর্চা করিয়াছিলেন এবং নাগাৰ্জ্জুন-বোধিসত্ত্ব-সুহৃল্লেখ নামে অন্তত একখানি সংস্কৃত গ্রন্থ চীনা ভাষায় অনুবাদ করিয়াছিলেন। অন্য এক চীনা পরিব্রাজক সং-চি বলিতেছেন, সমতটের তদানীন্তন রাজা প্রতিদিন মহাপ্রজ্ঞাপারমিতা-সূত্রের লক্ষ শ্লোক আবৃত্তি করিতেন।

বৌদ্ধ বিহার-সংঘারামগুলির প্রত্যেকটিই ছিল বৌদ্ধ জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিক্ষা-দীক্ষার কেন্দ্র এবং য়ুয়ান-চোয়াঙ এবং অন্যান্য চীনা-সাক্ষ্যেই সপ্রমাণ যে, এই কেন্দ্রগুলিতে শুধু বৌদ্ধধর্মের চর্চা এবং বৌদ্ধ শাস্ত্ৰই শুধু পঠিত হইত। তাহা নয়, ব্যাকরণ, শব্দবিদ্যা, হেতুবিদ্যা, চিকিৎসাবিদ্যা, চতুর্বেদ, সাংখ্য, সংগীত ও চিত্ৰকলা, মহাযান শাস্ত্ৰ, অষ্টাদশ নিকায়বাদ, যোগশাস্ত্র, জ্যোতির্বিদ্যা প্রভৃতি জ্ঞানের বিভিন্ন দিকও বৌদ্ধ শ্রমণদের অধিতব্য বিষয়ের অন্তর্গত ছিল। য়ুয়ান-চোয়াঙ যে অসংখ্য দেবমন্দিরের কথা বলিয়াছেন, তাহদের কেন্দ্ৰ করিয়া ব্ৰাহ্মণ-আচার্য –উপাধ্যায় ইত্যাদিও কম ছিলেন না এবং যে অগণিত দেবপূজকের কথা য়ুয়ান-চোয়াঙ বলিয়াছেন, তাহারা যে শুধু ব্ৰাহ্মণ্য ধর্মশাস্ত্রেরই চর্চা করিতেন, এমন মনে করিবার কারণ নাই। নানা পার্থিব, দৈনন্দিন সমস্যাগত জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিক্ষা-দীক্ষার চর্চাও নিশ্চয়ই তাহদের মধ্যে প্রচলিত ছিল। যাহাই হউক, এ-তথ্য সুস্পষ্ট যে, ষষ্ঠ-সপ্তম শতকের মধ্যে বাঙলাদেশে সংস্কৃত ভাষা এবং বৌদ্ধ-জৈন-ব্ৰাহ্মণ্য ধর্মকে আশ্রয় করিয়া আর্য জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিক্ষা-দীক্ষা বাঙলাদেশে প্রোথিত মূল হয় এবং শতাব্দী কালের মধ্যেই ফসল ফলাইতে আরম্ভ করে। সপ্তম শতকের লিপিগুলির অলংকারময় কাব্যরীতিই তাহার প্রমাণ। এই কাব্যরীতি একান্তই মধ্য-ভারতীয় রচনাস্ত্রীতি ও আদর্শের প্রেরণা ও অনুকরণে সৃষ্ট, সন্দেহ নাই। কিন্তু এই লিপিগুলি ছাড়া কাব্যসাহিত্য-চৰ্চার আর কোনো প্রমাণ আমাদের সম্মুখে অনুপস্থিত।

ব্যাকরণচন্দ্ৰগোমী ও চান্দ্র-ব্যাকরণ

জ্ঞান-বিজ্ঞানের নানাদিক সম্বন্ধে অনুশীলনের কিছু কিছু পরিচয় বিদ্যমান। ব্যাকরণের চর্চায় প্রাচ্য-ভারত, তথা বাঙলাদেশ অতি প্রাচীন কালেই প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছিল; পাণিনির সাক্ষ্যই তাহার প্রমাণ। সপ্তম শতকে ইৎ-সিঙ যে-সব বিদ্যা অনুশীলন করিবার জন্য তাম্রলিপ্তি আসিয়াছিলেন তাহার মধ্যে শব্দবিদ্যা অন্যতম। প্রাচীন বাঙলার এই ব্যাকরণ প্রসিদ্ধি যাঁহাদের জ্ঞান ও খ্যাতির উপর প্রতিষ্ঠিত তাহাদের মধ্যে চান্দ্র-ব্যাকরণ পদ্ধতির স্রষ্টা চন্দ্ৰগোমী অন্যতম। চান্দ্র-ব্যাকরণ ও তাহার বৃত্তি বা টীকা চন্দ্ৰগোমীর সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তি। এই ব্যাকরণ মুখ্যত পাণিনি-অনুসারী, এবং এক সময়ে কাশ্মীর নেপাল-তিব্বত-সিংহলে ইহার প্রচলনও ছিল প্রচুর, কিন্তু মৌলিকতা এবং নূতন কোনও তত্ত্ব বা রীতির অভাবে এই প্রসার বা প্রসিদ্ধি পরবতী কালে স্থায়িত্ব লাভ করিতে পারে নাই। পাগ-সাম-জোন-জাং-গ্রন্থে বলা হইয়াছে যে, চন্দ্ৰগোমী ছিলেন পতঞ্জলির মহাভাষ্য-রীতিপদ্ধতির বিরোধী। ভর্তৃহরি তাহার বাক্যপদীয়-গ্রন্থে জনৈক বৈয়াকরণিক চন্দ্রাচার্যের নাম করিয়াছেন এবং তিনি যে মহাভাষ্য-মতবিরোধী ছিলেন এরূপ ইঙ্গিতও করিয়াছেন; কলহণও তাহার রাজতরঙ্গিনী-গ্রন্থে চন্দ্রাচার্য ও তাহার ব্যাকরণের উল্লেখ করিয়াছেন, কিন্তু বলিতেছেন, চন্দ্রাচার্য মহাভাষ্য-চৰ্চার পুনঃপ্রচলন করিয়াছিলেন। যাহাই হউক, বিশেষজ্ঞরা অনেকেই মনে করেন, চন্দ্ৰগোমী ও চন্দ্রাচার্য একই ব্যক্তি। চন্দ্ৰগোমিন ও তাহার ব্যাকরণের সন-তারিখ লইয়া পণ্ডিতদের ভিতরে মত-বিরোধের অন্ত নাই। তবে মোটামুটি বলা চলে, জয়াদিত্য ও বামনের কাশিকা-গ্রন্থের (পাণিনি-টীকা) আগেই চান্দ্র-ব্যাকরণ রচিত ও সুপ্রচলিত হইয়াছিল; কারণ এই টীকায় চন্দ্ৰগোমীর মূল ৩৫টি সূত্র বিনা স্বীকৃতিতে উদ্ধৃত হইয়াছে। এই ৩৫টি সূত্র পাণিনি-ব্যাকরণে কোথাও নাই। যাহাই হউক, চন্দ্ৰগোমী সপ্তম শতক বা.. সপ্তম শতকের আগেই কোনও সময়ে বিদ্যমান ছিলেন, এ-সম্বন্ধে কোনও সংশয় নাই। চন্দ্ৰগোমী ছিলেন বৌদ্ধ; তাহার অস্ত্যনাম গোমিন (বাঙলা বর্তমান গুই?) এবং তদ্রচিত ব্যাকরণের বৃত্তি বা টীকার প্রারম্ভে মঙ্গলশ্লোকের সর্বজ্ঞ-স্তুতিই তাহার প্রমাণ। তাহার জন্মভূমি ছিল বরেন্দ্রীতে; কিন্তু পাগ-সাম-জোন-জাং গ্রন্থের সাক্ষ্য প্রামাণিক হইলে স্বীকার করিতে হয়, তিনি পরবর্তী জীবনে কোনও কারণে বরেন্দ্রী হইতে নির্বাসিত হইয়া চন্দ্ৰদ্বীপে গিয়া বাস করেন। তিব্বতী ত্যাঙ্গুরে তালিকাবদ্ধ চন্দ্ৰগোমীর একটি গ্রন্থে তিনি পরিষ্কার দ্বৈপা বলিয়া উল্লিখিত হইয়াছেন। তিব্বতী ঐতিহ্যমতে চন্দ্ৰগোমী যে শুধু বৈয়াকরণিক ছিলেন, তাহাই নয়। তর্কবিদ্যায়ও তিনি পারদর্শী ছিলেন এবং ন্যায়সিদ্ধালোক নামে তৰ্কশাস্ত্রের একটি গ্রন্থ রচনা করিয়াছিলেন। শুধু তাঁহাই নয়, তিনি বৌদ্ধ তান্ত্রিক বজ্ৰযান সাধনাগত ৩৬টি গ্রন্থের লেখক ছিলেন; তারা এবং মঞ্জুশ্ৰীর উপর কয়েকটি সংস্কৃত স্তোত্র রচনা করিয়ছিলেন, লোকানন্দ নামে একটি নাটক এবং শিষ্যের নিকট গুরুর পত্র হিসাবে রচিত শিষ্যলেখধর্ম নামে একটি ক্ষুদ্র কাব্যও রচনা করিয়াছিলেন। লোকানন্দ নাটকটির তিব্বতী অনুবাদ ছাড়া আর কিছু পাওয়া যায় নাই; শিষ্যলেখধর্ম কাব্যটিতে বিভিন্ন ছন্দে ১১৮টি সংস্কৃত শ্লোক; রচনারীতি দুর্বল ও বহুঅর্ভ্যস্ত শৃঙ্খলাবদ্ধ সংস্কৃত কাব্যানুসারী। এই তিব্বতী ঐতিহ্যমতেই চন্দ্ৰগোমী এক সময় নালন্দা মহাবিহারে গিয়া আচার্য স্থিরমতির শিষ্যত্ব গ্রহণ করিয়াছিলেন এবং সেখানে মাধ্যমিক শাস্ত্ৰে সুপণ্ডিত চন্দ্ৰকীর্তির সঙ্গে তাহার দেখা হইয়াছিল। তারনাথ বলেন, চন্দ্ৰগোমীর ব্যাকরণ চন্দ্ৰকীর্তির শ্লোক্যবদ্ধ ব্যাকরণগ্রন্থে সমন্তভদ্রকে প্রায় বিলুপ্ত করিয়া দিয়াছিল। চন্দ্ৰগোমী নালন্দা-মহাবিহারে আচার্য স্থিরমতির নিকট সূত্র ও অভিধর্মপিটক অধ্যয়ন করিয়াছিলেন এবং ব্যাকরণ, সাহিত্য, জ্যোতিষ, তৰ্কশাস্ত্ৰ, চিকিৎসাবিদ্যা এবং নানা কলায় বুৎপত্তি লাভ করিয়াছিলেন। আচার্য অশোক তাহাকে বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষাদান করেন এবং তিনি তারা ও অবলোকিতেশ্বরের পরমভক্ত হন। চন্দ্ৰগোমী সিংহল ও দক্ষিণ ভারতে গিয়াছিলেন এবং দক্ষিণ-ভারতে বসিয়াই নাকি চান্দ্র-ব্যাকরণ রচনা করিয়াছিলেন। নালন্দা-মহাবিহারের আচার্যরা গোড়ায় তাহার প্রতি খুব শ্রদ্ধিত ছিলেন না; কিন্তু পরে চন্দ্ৰকীর্তি তাহার প্রতিভার পরিচয় পান এবং তাহারই প্রেরণায় ও চেষ্টায় চন্দ্ৰগোমী ক্রমে সকলের শ্রদ্ধা আকর্ষণ করেন। চন্দ্ৰগোমী যোগাচায়ী ছিলেন এবং যোগাচার দর্শন লইয়া বিচারালোচনা করিতেন।

প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, বৈয়াকরণিক চন্দ্ৰগোমী, তিব্বতী ঐতিহ্যের নৈয়ায়িক চন্দ্ৰগোমী এবং একই ঐতিহ্যের বজ্রযানী বৌদ্ধ তান্ত্রিক চন্দ্ৰগোমী কি একই ব্যক্তি? এ-প্রশ্নের সঠিক উত্তর দেওয়া কঠিন; তবে বৈয়াকরণিক এবং নৈয়ায়িক চন্দ্ৰগোমী এক ব্যক্তি হইলেও বজ্রযানী চন্দ্ৰগোমী একই ব্যক্তি হওয়া প্রায় অসম্ভব বলিলেই চলে; খুব সম্ভব, পরবর্তী তিব্বতী ঐতিহ্য প্রাচীনতর চন্দ্ৰগোমী এবং অর্বাচীন চন্দ্ৰগোমীকে এক ব্যক্তিতে পরিণত করিয়া দুই জনের জীবন-কাহিনী একত্র মিশাইয়া দিয়াছিল।

গৌড়পাদ ও গৌড়পাদ-কারিকা

এই পর্বে ব্যাকরণ ও তর্কশাস্ত্র ছাড়া দর্শনের আলোচনায় বাঙলাদেশের কিছু প্ৰসিদ্ধি লাভ ঘটিয়াছিল। গৌড়পাদকীরিক নামে সুপরিচিত একটি আগম-শাস্ত্রগ্রন্থ এই যুগে বাঙলাদেশে রচিত হইয়াছিল, এ তথ্য নিঃসংশয়; তবে ইহার রচয়িতা কে ছিলেন তাহা লইয়া পণ্ডিত মহলে নানা মতামত বিদ্যমান। গ্রন্থকারের নাম বা উপাধি ছিল গৌড়পাদ, এইরূপ অনুমিত হইয়াছে; তিনি গৌড়াচার্য বলিয়াও কারিকায় উল্লিখিত হইয়াছেন। তাহার বাড়ি ছিল গৌড়দেশে, এই অনুমানেও সংশয় কিছু নাই। গৌড়পাদ ছিলেন শুকের শিষ্য এবং আচার্য শংকরের পরমগুরু বা গুরুর গুরু। শংকরাচার্যের শিষ্য সুরেশ্বর তাহার নৈষ্কর্মসিদ্ধি নামক গ্রন্থে গৌড়পাদকীরিকা হইতে দুইটি শ্লোক উদ্ধার করিয়াছেন। শংকরের ব্রহ্মসূত্ৰভাষ্যে গৌড়পাদের কোনো উল্লেখ নাই, কিন্তু কারিকার উদ্ধৃতি আছে; গ্রন্থকারের ইঙ্গিত আছে। ‘সম্প্রদায়বিদ’ ও ‘বেদার্থ সম্প্রদায়বিদ-আচাৰ্য’ এই পদে। গৌড়পাদ কারিকার দার্শনিক মতবাদ প্রাক-শংকর বৈদান্তিক মত ও বৌদ্ধ মাধ্যমিক শূন্যবাদের সূক্ষ্ম সংমিশ্রণ ও স্বাঙ্গীকরণ। সমগ্র গ্রন্থ ২১৫টি শ্লোকে গ্রথিত (প্রথম ভাগে আগম ২৯টি শ্লোক; দ্বিতীয় ভাগে বৈতথ্য ৩৮টি শ্লোক; তৃতীয় ভাগে অদ্বৈত ৪৮টি শ্লোক; চতুর্থ ভাগে অলাতশান্তি ১০০টি শ্লোক)। শাস্তুরক্ষিত, কমলশীল প্রভৃতি পরবর্তী কালের মাধ্যমিক মতবাদী একাধিক বৌদ্ধ আচার্য গৌড়পাদের গ্রন্থ হইতে শ্লোক উদ্ধার করিয়া তাহাদের মতামত ব্যক্ত করিয়াছেন। গৌড়পাদ আরও দুইটি কারিকা রচনা করিয়াছিলেন, একটির নাম সাংখ্য-কারিকা, আর একটির উত্তরগীতা। অল-বেরুনী জনৈক গৌড়-সন্ন্যাসী রচিত এক সাংখ্য-কারিকার কথা জানিতেন; গৌড়পাদের গ্রন্থ এবং আল-বেরুনী-উদ্দিষ্ট গ্রন্থ বোধ হয় একই গ্রন্থ।

রোমপাদ।৷ পালকাপ্য কাহিনী ॥ হস্ত্যায়ুৰ্বেদ

আর একটি বিদ্যায়ও প্রাচ্য ভারতের এবং বাঙলাদেশের কিছু প্ৰসিদ্ধি লাভ ঘটিয়াছিল বলিয়া মনে হয়; সে-বিদ্যার নাম হস্তী-আয়ুৰ্বেদবিদ্যা। কৌটিল্য ও গ্ৰীক-ঐতিহাসিকবৰ্গ হইতে আরম্ভ করিয়া য়ুয়ান-চোয়াঙ পর্যন্ত সকলেই প্রাচ্য দেশকে হস্তীর লীলাভূমি বলিয়া বর্ণনা করিয়াছেন; কৌটিল্য তো হস্ত্রী-চিকিৎসকদের কথাও বলিয়াছেন। কাজেই এ-দেশে হস্তী-চিকিৎসা সম্বন্ধে এক বিশেষ শাস্ত্র গড়িয়া উঠিবে, ইহা কিছু আশ্চর্য নয়। চম্পার রাজা রোমপাদের সঙ্গে এক ঋষি পাল্যকাপ্য বা পালক্যাপ্লের সুদীর্ঘ বাক্যালাপ হইয়াছিল হস্তী-চিকিৎসা সম্বন্ধে। গ্রন্থাকারে গ্রথিত এই সুদীর্ঘ। কথোপকথনই হস্তায়ুৰ্বেদ (বা গজ-চিকিৎসা, বা গজবিদ্যা, বা গজবৈদ্য বা গজায়ুৰ্বেদ)-গ্ৰন্থ নামে খ্যাতি লাভ করিয়াছে। লৌহিত্য যেখানে হিমালয় হইতে নিৰ্গত হইয়াছে সেইখানে ছিল ঋষি পালক্যাপ্যের আশ্রম। পালক্যাপ্যের নাকি জন্ম হইয়াছিল কাপ্যগোত্রে, এক ঋষির ঔরসে, হস্তিনীর গর্ভে। আর, রোমপাদ নাকি ছিলেন রামায়ণ-কীর্তিত দশরথের সমসাময়িক! সমস্ত বর্ণনাটিই পৌরাণিক স্বপ্ন-কল্পনার সৃষ্টি, সন্দেহ নাই। পালকাপ্য নামে যথার্থ কোনও পুরুষ ছিলেন, কিনা তাহাও সন্দেহজনক; দ্রাবিড় ভাষায় পাল অর্থই হন্তী এবং কপিও এক অর্থে হন্তী। তবে, গ্রন্থটি বিদ্যমান এবং দশম-একাদশ শতকের আগেই যে ইহা রচিত হইয়াছিল তাহারও প্রমাণ একাধিক। অগ্নিপুরাণের গজ-চিকিৎসা অধ্যায় পালকাপ্যরোমপাদের কথোপকথনের উপর ভিত্তি করিয়া রচিত হইয়াছিল, এ-কথা অগ্নিপুরাণেই বলা হইয়াছে; এবং অগ্নিপুরাণের শাস্ত্রীয় অংশ দশম শতকের আগেই রচিত হইয়াছিল, সন্দেহ নাই। একাদশ শতকে ক্ষীরস্বামী-রূচিত আমরকোয-টীকায় একাধিক বার পালক্যাপ্যের উদ্ধৃতি আছে। রঘুবংশ কাব্যে ইন্দুমতীর স্বয়ম্বর বর্ণনা-প্রসঙ্গে এক অঙ্গরাজার হন্তীশালায় সূত্রকারগণ কর্তৃক হস্তীকে-শিক্ষাদানের উল্লেখ আছে। পালকাপ্য এই সূত্রকারদের অন্যতম হওয়া অসম্ভব নয়। যাহাই হউক, এ-তথ্য প্রায় নিঃসংশয় যে, বহু প্রাচীনকাল হইতেই হন্তী-চিকিৎসার একটি ঐতিহ্য প্রাচ্য দেশে বর্তমান ছিল, কিছু গ্ৰন্থও রচিত হইয়াছিল সন্দেহ নাই; কিন্তু পালকাপের হন্তী-আয়ুৰ্বেদ গ্রন্থ যে-ভাবে ও রূপে আমরা পাইয়াছি তাহা এত সুপ্রাচীন কালের নয়, যদিও রোমপাদ-পালক্যাপ্যের কাহিনীর মূল সুপ্রাচীন হইলেও হইতে পারে। বর্তমান গ্রন্থটি খুব সম্ভব খ্ৰীষ্টোত্তর ষষ্ঠ-সপ্তম শতকে, ব্ৰহ্মপুত্র তীরে, কোথাও সংকলিত হইয়াছিল, প্রাচীনতর গ্রন্থাদির উপর নির্ভর করিয়া।

এ-পর্যন্ত যে ক’টি গ্রন্থের উল্লেখ করা হইল তাহার প্রত্যেকটিই জ্ঞান-বিজ্ঞানগত। এইগুলি ছাড়া আরও অনেক গ্ৰন্থ এই পর্বে রচিত হইয়াছিল, সন্দেহ নাই, কিন্তু সে সব গ্রন্থ কালের প্রভাব এড়াইয়া মানুষের স্মৃতিতেও বাচিয়া থাকে নাই। নানা শাস্ত্র, নানা জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা যে বাঙলাদেশে হইত। তাহা তো আগেই দেখিয়াছি এবং যে দেশে এই পর্বে চান্দ্র-ব্যাকরণ ও গৌড়পাদকীরিকার মতো গ্ৰন্থ রচিত হইয়াছিল, সে-দেশে সেই পর্বে অন্য বহু গ্ৰন্থ রচিত হইয়া ভূমি ও পশ্চাদপট রচনা করে নাই, এমন হইতে পারে না। চন্দ্ৰগোমী তো কাব্য ও নাটকও রচনা করিয়াছিলেন। সাহিত্যরচনার একটা ধারাও প্রবহমান ছিল সন্দেহ নাই, কিন্তু তাহার উল্লেখ অথবা অবশেষ কোথাও দেখিতেছি না।

সাহিত্য-রচনার একটি বেগবান প্রবাহ যে বাঙলাদেশের পলিভূমির উপর দিয়া বহিয়া যাইত তাহার নিঃসংশয় প্রমাণ পাওয়া যায়। এই পর্বে গৌড়ী রীতির উদ্ভব, বিকাশ ও প্রসিদ্ধির মধ্যে। সপ্তম শতকের প্রথমার্ধে হর্ষচরিত-গ্রন্থের মুখবন্ধে বাণভট্ট সমসাময়িক ভারতবর্ষে প্রচলিত সাহিত্য-রচনারীতি সম্বন্ধে বলিতেছেন,

‘শ্লেষপ্রায়মুদীচ্যেযু প্রতীচ্যেধর্থমাত্ৰকম।
উৎপ্রেক্ষা দাক্ষিণাত্যেষু গৌড়েম্বাক্ষরডম্বরম।।
নবোহর্থো জাতিরগ্রাম্য শ্লেষো ক্লিষ্ট স্ফুটো রসঃ।
বিকটাক্ষরবন্ধশ্চ কৃৎসমেকত্র দুষ্করম।।

উত্তর-ভারতের রচনারীতিতে শ্লেষই (অর্থাৎ শব্দ-ব্যবহারের চাতুর্য) সমধিক, পশ্চিমে কেবল অর্থগৌরব; দক্ষিণে উৎপ্রেক্ষালঙ্কারের প্রাবল্য (অর্থাৎ, কবিকল্পনার অবাধ সঞ্চারণ) এবং গৌড়জনদের মধ্যে অক্ষর-ডম্বর (অর্থাৎ, মাত্রার আড়ম্বর)। বস্তুত, নূতন অর্থ, অগ্রাম্য জাতি বা রচনাশৈলী, অক্লিষ্ট শ্লেষ, স্ফুটিরস এবং বিকটাক্ষরবন্ধ, এই সকল গুণের একত্র সমাবেশ দুষ্কর। বাণভট্ট দুঃখ করিয়াছেন, ভারতবর্ষের কোথাও একই জনপদে সু-কাব্যের এই সমস্ত লক্ষণগুলি একত্ৰ দেখিতে পাওয়া যায় না; কোথাও শুধু শ্লেষের প্রাধান্য, কোথাও অর্থগৌরবের, কোথাও অক্ষরাড়ম্বরের প্রাবল্য, কোথাও বা শুধু কল্পনার অবাধসঞ্চরণ। তাঁহার মতে ভালো কাব্যের যাহা লক্ষণ তাহা যে এই তালিকাতেই শেষ হইয়া গেল এমন নয়; এই লক্ষণগুলি শুধু কয়েকটি দৃষ্টান্ত মাত্র। কাজেই গৌড়ীয় কবিদের নিন্দাচ্ছলে বাণভট্ট অক্ষরাড়ম্বরের কথা বলিয়াছেন, এমন মনে করিবার কারণ নাই। অক্ষরাড়ম্বরের অর্থ হইতেছে শব্দপ্রয়োগগত ধ্বনি-সমারোহ; এই সাহিত্যিক গুণটিকেই বলা হইয়াছে বিকটাক্ষরবন্ধ (বিকট-উদারতা লক্ষণযুক্ত)।

গৌড়ীরীতি

সপ্তম-অষ্টম শতকে গৌড়-বঙ্গে যে একটি বিশেষ কাব্যরচনা-রীতির প্রবর্তনা হইয়াছিল এবং সমস্ত ভারতবর্ষে সেই রীতি সুপরিচিত স্বীকৃতি লাভ করিয়াছিল তাহার প্রমাণ আলংকারিক ভামহ ও দণ্ডীর (সপ্তম-অষ্টম-শতক) সাক্ষ্য। এই দুই জনই গৌড়ীরীতি বা গৌড়মার্গের কথা বলিতেছেন বৈদৰ্ভরীতির সঙ্গে সঙ্গে, অর্থাৎ বৈদভী ও গৌড়ী, এই দুই রীতিই যে তখন প্রধান প্রচলিত কাব্যরীতি, তাহার সুস্পষ্ট সাক্ষ্য দিতেছেন। দণ্ডীর পক্ষপাত ছিল বৈদভী রীতির প্রতি এবং এই রীতিই কাব্যরচনার মানদণ্ড বলিয়া তিনি মনে করিতেন। তাহার মতে এই মানদণ্ডের বিচারে গৌড়ী রীতি বিপর্যয় লক্ষণাক্ৰান্ত, তাহার রূপ পৃথক, রীতি পৃথক, কিন্তু এই পৃথক রূপ ও রীতি সহজেই প্রস্ফুট। বৈদভী, বিশুদ্ধ মাৰ্গপদ্ধতির অনুসারী, গৌড়ী একটু অলংকার ও আড়ম্বরবহুল, পল্লবিত। দণ্ডী পরিষ্কারই বলিতেছেন, গৌড়জনেরা অতি ও উচ্চকথন এবং অলংকার ও আড়ম্বর প্রিয়; গৌড়ী রীতির প্রধান লক্ষণই হইতেছে ‘আর্থ-ডম্বর’ এবং “অলংকার-ড়ম্বর, অনুপ্রাসপ্রিয়তা এবং বন্ধগৌরব বা রচনার গাঢ়তা। ভামহ। কিন্তু বৈদভী রীতির শ্রেষ্ঠত্ব সম্বন্ধে সন্দিহান ছিলেন; বরং সুপ্রযোজিত গৌড়ী রীতির প্রতিই তাহার কিছুটা পক্ষপাত সুস্পষ্ট। বৈদভী রীতির প্রধান গুণ ছিল শ্লেষ, প্রসাদ, মাধুর্য, সৌকুমাৰ্য ইত্যাদি।

বাণভট্ট, ভামহু এবং দণ্ডীর সাক্ষ্যে এ-তথ্য পরিষ্কার যে, গৌড়জনেরা সপ্তম শতকের আগেই সুস্পষ্ট লক্ষণাক্ৰান্ত একটি বিশিষ্ট কাব্যরীতি গড়িয়া তুলিয়াছিলেন এবং এই রীতি সর্বভারতগ্রাহ্য বৈদন্তী রীতিমানের পাশেই আপন আসন এতটা সুপ্রতিষ্ঠিত করিয়াছিল যে, বাণভট্ট, ভামহ বা দণ্ডী কেহই তাহাকে অস্বীকার করিতে পারেন নাই; দশম-একাদশ শতকে গৌড়ী রীতির যখন পূর্ণ বিকশিত অবস্থা, যখন আড়ম্বরা অলংকার এবং পল্লবিত বিস্তৃতির প্রসার আরও বেশি, তখন রাজশেখর (দশম শতক) তাঁহার কাব্য মীমাংসা-গ্রন্থে গৌড়ী রীতির উল্লেখ করিয়াছেন, কিন্তু কোনও উৎসাহ প্রকাশ করেন নাই। বোধ হয়, সেই জনাই কপূরমঞ্জরী-গ্রন্থে বিভিন্ন রীতির তালিকা দিতে গিয়া তিনি গৌউী রীতির উল্লেখ করেন নাই, তাহার স্থানে মাগধী রীতির কথা বলিয়াছেন। মাগধী রীতিকে যথার্থত কোনও বিশিষ্ট সম্পূর্ণ ও স্বতন্ত্র রীতি রাজশেখর ছাড়া আর কেহ বলেন নাই। একাদশ শতকে ভোজদেব গৌড়ী ও মাগধী, এই দুই রীতির কথা বলিয়াছেন, সন্দেহ নাই, কিন্তু মাগধীকে বলিয়াছেন খণ্ডরীতি, অর্থাৎ অসম্পূর্ণ, অ-স্বতন্ত্র, অপ্রস্ফুটিত রীতি। নাটকেও বোধ হয় অন্যান্য প্রাচ্য দেশের সঙ্গে বাঙলাদেশে একটি বিশিষ্ট রূপ ও রীতির প্রচলন হইয়াছিল। ভারতের নাট্যশাস্ত্ৰে চারিটি বিশিষ্ট নাটকীয় রীতির বা প্রবৃত্তির উল্লেখ আছে : অবন্তী, পঞ্চাল-মধ্যমা, দক্ষিণাত্যা এবং ওড্র মাগধী। ওড্র, বঙ্গ, পৌণ্ড এবং নেপালে ওড্র-মাগধী প্রবৃত্তি প্রচলিত ছিল।

এই গৌড়ী রীতির (মাগধী রীতি এবং ভরতনাট্যশাস্ত্ৰ কথিত ওড্র-মাগধী প্রবৃত্তিরও বটে) উদ্ভব ও বিকাশের ইতিহাস প্রাচীন বাঙলার সংস্কৃতির ইতিহাসের দিক হইতে গভীর অর্থবহ। আর্যমঞ্জুশ্ৰীমূলকল্প-কথিত ‘গৌড় তন্ত্র কথাটি এই প্রসঙ্গে স্মর্তব্য। ষষ্ঠ শতকের মাঝামাঝি হইতেই গৌড়জনেরা নিজেদের স্বাতন্ত্র্য সম্বন্ধে সচেতন হইতে আরম্ভ করেন; ঈশানবৰ্মার হড়াহা-লিপি তাহার প্রথম প্রমাণ। তাহার পর হইতেই গৌড় ধীরে ধীরে নিজস্ব জন্য দিকে আশ্রয় করিয়া স্বাধীন স্বতন্ত্র রাষ্ট্র গড়িয়া তুলিতে যত্নবান হয়, শশাঙ্কে আসিয়া তাহা একটা সুস্পষ্ট রূপ গ্রহণ করে। মালব-স্থানীশ্বর-কনৌজ -উজ্জয়িনী-প্ৰয়াগ-বান্নারসীকেন্দ্ৰিক মধ্য-ভারতীয় রাষ্ট্ৰীয় প্রভাব হইতে মুক্ত, স্বতন্ত্র রাষ্ট্রই হইয়া উঠিল গৌড়তন্ত্রের রাষ্ট্রদর্শ। সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে এই গৌড়তন্ত্র রূপ লাভ করিল গৌড়ী রীতিতে—সর্বভারতীয়, বৈদভী রীতিকে অস্বীকার করিয়া, তাহার প্রভাব হইতে মুক্ত হইয়া স্বাধীন স্বতন্ত্র রীতির উদ্ভবে ও বিকাশে। সন্দেহ নাই, এই উদ্ভব ও বিকাশ ঘটিয়াছিল। গৌড়জনের নিজস্ব প্রতিভা, প্রকৃতি, রুচি ও সংস্কার অনুযায়ী এবং ইহাদেরই প্রেরণায়, শুধু বিশিষ্ট জনপদসুলভ অহংকৃত স্বতন্ত্রপ্রিয়তা ও স্বাধিকার প্রমত্ততায় নয়।