০৯. সংযোজন – রাজবৃত্ত

সংযোজন – রাজবৃত্ত

মুরণ্ড-মুরুণ্ড

ইতিমধ্যে শ্ৰীহট্ট জেলায় মৌলবীবাজার মহকুমার শ্ৰীমঙ্গল থানার অন্তর্গত কলপুর গ্রাম থেকে একটি তাম্রপট্ট আবিষ্কৃত হয়েছে। জয়স্বামী নামে এক শৈব ব্রাহ্মণ ভগবৎ অনন্তনারায়ণের (অনস্তশিয়ান বিষ্ণুর) একটি মঠ নির্মাণ করিয়েছিলেন, এবং সেই মঠের বলি, চরু এবং সত্র যাতে নিয়মিত রক্ষিত হয় তার জন্য স্থানীয় রাজপুরুষদের কাছে কিছু ভূমি প্রার্থনা করেছিলেন, সন্দেহ নেই, যথাযথ মূল্যের পরিবর্তে। পট্টোলীটি সেই প্রার্থিত ভূমিদানের, এবং তা রক্ষিত ছিল অথবা পট্রিকৃত হয়েছিল ‘কুমারামাত্য অধিকরণে। ঐ অঞ্চলের, অর্থাৎ শ্ৰীহট্ট অঞ্চলের তদানীন্তন অধিপতি ছিলেন জনৈক সামন্ত শ্ৰীমরুণ্ডনাথ র্যার অব্যবহিত পূর্বপুরুষ ছিলেন “সামপ্ত সৈন্যপতি শ্ৰীনাথ! পট্টোলীটির পাঠ ও ব্যাখ্যা পাওয়া যাচ্ছে কমলাকান্ত চৌধুরী মশায়-প্রণীত Copper Piates of Sylhet, Wol. Il (7th—11th. Century A.D.), Sylhet, 1967–বইটিতে। অক্ষরের আকৃতি-প্রকৃতি দেখে চৌধুরী মশায় যথার্থ অনুমান করেছেন, পট্টোলীটির কাল খ্ৰীষ্ট্ৰীয় সপ্তম শতাব্দী। এ-তারিখ যে যথার্থ তা মনে করবার আর একটি বড় কারণ আছে। একাধিক দিক থেকে এই লিপিটির শীলমোহর, প্রতীক চিহ্ন, পট্টীকরণ কর্তার অধিকরণ প্রভৃতির সঙ্গে সপ্তম শতাব্দীর সমতট অঞ্চলের আরও অন্তত দু’টি পট্টোলীর আশ্চর্য মিল আছে; একটি শ্ৰীধারণ রাতের কৈলান পট্টোলী, অন্যটি সামন্ত লোকনাথের ত্রিপুরা পট্টোলী। যাই হোক, এ-তথ্য আগেই জানা ছিল, ঢাকা ও ত্রিপুরার খড়্গ রাজবংশ (যাদের জয়স্কন্ধাবার ছিল কর্মাস্তবাসক=ত্রিপুরা জেলার বড় কামতা), সামন্ত লোকনাথের বংশ এবং রাত বংশ, এই তিনটি বংশই সপ্তম শতাব্দীর; প্রায় সমসাময়িকই বোধ হয় বলা যায়, কেউ কিছু আগে বা পরে। তিনটি বংশই, অন্তত শেষোক্ত দু’টি তো বটেই, সামন্ত বংশ এবং তিনটিই সমতটের বিভিন্ন অংশের সামন্তাধিপতি ছিলেন; কিন্তু ইহাদের সমতটেশ্বর মহারাজাধিরাজ যে কে ছিলেন তা কিছু জানা যাচ্ছে না। এখন কলপুর পট্টোলী থেকে জানা গেল যে, এই সপ্তমতম শতাব্দীতেই, এই সমতটমণ্ডলেরই আর এক অংশে, অর্থাৎ শ্ৰীহট্ট অঞ্চলে, আর একজন সামস্ত ছিলেন, সামন্ত সৈন্যপতি শ্ৰীনাথের পুত্র সমস্ত শ্ৰীমুরগুনাথ। এই মুরগুনাথ কে, এই অদ্ভুত নামটি তিনি কোথা থেকে পেলেন?

এ-গ্রন্থের পূর্ববর্তী সংস্করণে ভারতবর্ষের পূর্বাঞ্চলের মুরাণ্ড কোম সম্বন্ধে এবং তৎসম্পর্কে কুষাণ মুদ্রার প্রচলন সম্বন্ধে দু’চারটি কথা বলেছিলাম। মুরাণ্ডরা যে খ্ৰীষ্ট্ৰীয় দ্বিতীয় ও তৃতীয় শতাব্দীতে বিহার অঞ্চলে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন, এ-তথ্য আগেই জানা ছিল। ষষ্ঠ শতাব্দীর গোড়ার উচ্চকল্পের (মধ্যপ্রদেশের সাতনা জেলায়) রাজা জয়নাথের মহিষী এবং রাজা শর্বনাথের মাতার নাম ছিল মুরুগুস্বামিনী মুরুগুদেবী, এ-তথ্যও জানা ছিল। এখন দেখতে পাওয়া যাচ্ছে, সপ্তম শতাব্দীর শ্ৰীহট্ট অঞ্চলে এক সামন্ত মুরগুনাথকে। তিনি যে মুরাণ্ড বা মুরাণ্ড কোমেরই একজন নায়ক, সে-সম্বন্ধে সন্দেহের অবকাশ কম। শাক-কুটুম্ব মুরুগু, মুরুগুরা কি তখনও তাদের স্বতন্ত্র অস্বিত্ব রক্ষা করছিলেন?

পাঠ-পঞ্জি৷ Chaudhury, Kamalakanta, Copper-plates of Sylhet, Wol. II (7th—1 i th. Century A.D.), Sylhet, 1967, pp. 68-80; Sircar, D.C., Epigraphic Discoveries in East Pakistan, Sanskrit College, Calcutta, 1973, pp. 14-18.

গৌড়াধিপ শশাঙ্ক ৷ সপ্তম শতক

বছর দেড় দুই আগে মেদিনীপুর জেলার এগরা থানায় এগরা গ্রামে শশাঙ্কের রাজত্বকালীন একটি তাম্রশাসন পাওয়া গিয়েছে। শাসনটিতে শশাঙ্কের রাজ্যসংবৎসরের তারিখ উল্লিখিত নেই। বিশেষ কিছু নূতন খবরও নেই যা সমসাময়িক অন্যান্য লিপি থেকে জানা যায় না। তবে, শাসনে বিষয়াধিকরণান্তর্গত অনেকগুলি গ্রামের উল্লেখ আছে; তার ভেতর অস্তুত চারটি অগ্রহার-গ্রাম। শাসনানুসারে কার্পাসপত্রক নামক একটি গ্রামে জনৈক ব্ৰাহ্মণকে ১০০ দ্রোণবাপ ভূমি দেবার ব্যবস্থা করা হয়েছিল; প্রতি দ্রোণের মূল্য ধার্য হয়েছিল চারপণ কড়ি হিসেবে, ১০০ দ্রোণবাপের জন্য ৪০০ পণ কড়ি। লক্ষণীয় এই যে, সপ্তম শতকের প্রথমার্ধেই ভূমির মূল্য নির্ধারিত ও প্রদত্ত হচ্ছে কড়িতে, দীনারে নয়, দ্রহ্মেও নয়।

শাসনটি এখনও অপ্রকাশিত, তবে অধ্যাপক শ্ৰীদীনেশচন্দ্র সরকার। এটির পাঠোদ্ধার, অনুবাদ ও সম্পাদনা শেষ করেছেন, এবং রচনাটি প্রকাশোনূখ। র্তার একান্ত সহৃদয় আনুকূল্যেই সম্ভব হলো সদ্যোক্ত সংযোজনটি। আমি তার কাছে কৃতজ্ঞ।

একটি নূতন রাজবংশ ৷ দেববংশ (আ. ৭৫০ খ্ৰীষ্টাব্দ)

সপ্তম শতাব্দীতে বিভিন্ন সময়ে সমতটমণ্ডলের বিভিন্ন স্থানে অন্তত তিনটি ছোট বড় রাজবংশের আধিপত্য ছিল। তারা কেউ ছিলেন সামন্ত, কেউ বা স্বাধীন নরপতিত্বও দাবি করেছেন। খড়্গ বংশ, লোকনাথের বংশ এবং রাতবংশ ছাড়া ইতিমধ্যে এই সমতটমণ্ডলেরই শ্ৰীহট্ট অঞ্চলে আর এক সামন্ত শ্ৰীমুরগুনাথের সন্ধান পাওয়া গেছে; তার কথা এই পরিশিষ্টে একটু আগেই বলা হয়েছে। এই শতাব্দীতে এবং এই সময় থেকে প্রাচীন বাঙলার সামাজিক কাঠামোটি যেন মোটামুটি বোঝা যাচ্ছে: সে-কাঠামোটিতে সামগ্ৰস্তুতন্ত্রের ক্রমবর্ধমান প্রচলন ও প্রসার যেন সুস্পষ্ট। এ-তথ্য উল্লেখযোগ্য যে সমতটমণ্ডলভুক্ত শ্ৰীহট্ট অঞ্চলের সামন্ত মুরগুনাথের পিতৃপরিচয় ‘সামস্ত সৈন্যপতি’ হিসেবে। সামন্তদের সৈন্যদল গঠন ও পোষণ করতে হতো। এ—তথ্যের ইঙ্গিত যেন এই পদবীটিতে স্পষ্ট। যুদ্ধের সময় অধীশ্বর মহারাজাধিরাজকে সৈন্য-সাহায্য দেবার প্রতিশ্রুতিও কি ছিল? যদি তা থেকে থাকে তাহলে তো সামন্ত-সমাজবিন্যাস (যুরোপীয় feudalism  অর্থে নয়) আর অস্বীকার করবার উপায় থাকে না।

যাই হোক, ঠিক সপ্তম শতাব্দীতে নয়, কিন্তু অক্ষর-স্যাক্ষ্যে মনে হয়, শতাব্দীর মাঝামাঝি কোনও সময় এই সমতটমণ্ডলেই পতিকের (=পট্টিকের, কুমিল্লা শহরের অদূরবতী ময়নামতী) অঞ্চলে আর একটি নূতন রাজবংশের খবর ইতিমধ্যে পাওয়া গেছে। এই রাজবংশের রাজা ভবদেবী ছিলেন পরামসৌগত (অর্থাৎ বুদ্ধদেবভক্ত) এবং তিনি ছিলেন পরমভট্টারক ও মহারাজাধিরাজ। আমার ধারণা, এই রাজবংশ মৎস্যন্যায়-পর্বেরই অন্যতম সংকেত, অনেক সংকেতের মধ্যে একটি। এই দারুণ রাষ্ট্ৰীয় দুর্যোগের সময় ক্ষুদ্র কোনও অঞ্চলের অধিপতিও স্বাধীন সার্বভৌম মহারাজাধিরাজের পদবী দাবি করবেন, এতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই।

লালমাই (লালমাটি) পূর্ব বাংলার পুরাভূমির একটি অংশ; এই অংশে, কুমিল্লা শহর থেকে পাঁচ-ছয় মাইল দূরে, ময়নামতীর নাতিউচ্চ পাহাড়; উত্তর-দক্ষিণে প্রায় দশ-এগারো মাইল তার বিস্তার। এরই একটি অংশে, শালবনে ঢাকা বিস্তৃত একটি উচু ঢিবিতে, গত দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময়, যুদ্ধেরই প্রয়োজনে মাটি খুঁড়তে গিয়ে বেরিয়ে পড়লো এক বৌদ্ধ মহাবিহারের ধ্বংসাবশেষ, দু’টি স্থানীয় রাষ্ট্ৰাধিপতি, আনন্দদেব ও ভবদেবের নামাঙ্কিত দু’টি তাম্রশাসন, “ভবদেবী-মহাবিহার” মুদ্রিত একটি লাল বেলে পাথরের শীলমোহর, এবং সঙ্গে সঙ্গে বেশ কিছু রৌপ্যমুদ্রা যাতে মুদ্রিত আছে ‘পতিকের’ শব্দটি। সন্দেহ নেই, পতিকের, পটিকেরা, পট্টিকেরা, পট্টিকেরক, পাইটকেরা সমস্তই সমার্থক। একটি নূতন স্থানীয় রাজবংশ এই ভাবে বাঙালীর ইতিহাসে সংযোজিত হলো।

দু’টি তাম্রশাসনই পাওয়া গেছে বেশ ক্ষতাবস্থায়, এবং একটিরও পাঠ এ-পর্যন্ত প্রকাশিত হয়নি। তবে, পরমভট্টারক মহারাজাধিরাজ ভবদেবের শাসনটির মোটামুটি একটি বিবরণ প্রকাশিত হয়েছে। (Journal of the Asiatic Society, Letters, Wol XVI, 1957, p.83 ff, and plates)। এই বিবরণ থেকে জানা যায়, ভবদেবের পিতা ছিলেন আনন্দদেব এবং পিতামহের নাম ছিল বীরদেব। ভবদেবের আর একটি নাম ছিল অভিনব মৃগাঙ্ক। ভবদেবের প্রধান কীর্তি তার নিজের নামে “ভবদেবী-মহাবিহার” প্রতিষ্ঠা; শালবনপুরে এই বিহারের ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হয়েছে বলে স্থানীয় জনসাধারণের কাছে এই বিহার শালবনবিহার বলে পরিচিত। ভবদেব সমগ্র সমতটমণ্ডলের অধীশ্বর ছিলেন। কিনা বলাকঠিন, কিন্তু রাজ্যের পরিধি যে বেশ বিস্তুত ছিল, তা অনুমান করা চলে। তাঁর রাজধানী ছিল চণ্ডীমূড়া পাহাড়ের উপর দেবপর্বত নগরে; চণ্ডীমুড়া পাহাড় ময়নামতী শৈলশ্রেণীর প্রায় দক্ষিণতম প্রান্তে।

লামা তারনাথের “চন্দ্ৰ’ বংশ কাহিনী

ষোড়শ-সপ্তদশ শতাব্দীর তিব্বতী ঐতিহাসিক বৌদ্ধ লামা তারনাথ (জন্ম ১৫৭৩ খ্ৰীষ্টাব্দ) তার বৌদ্ধধর্মের ইতিহাস-গ্রন্থে (১৬০৮ খ্ৰীষ্টাব্দ) বলেছেন, ভঙ্গল (বঙ্গল দেশ, সাধারণভাবে পূর্ব ও দক্ষিণবঙ্গ) দেশে পাল-সম্রাটদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার আগে এই দেশ চন্দ্ৰান্তনামা রাজাদের এক রাজবংশের অধীন ছিল। তিনি এই রাজাদের অনেকের নামোল্লেখ করেছেন, অনেকের কীর্তিকাহিনীর সংক্ষিপ্ত বর্ণনাও কিছু দিয়েছেন। তার মতে, গোবিন্দচন্দ্র ও ললিতচন্দ্র এই বংশের শেষ দুই রাজা, এবং তারপরই এই দেশে নৈরাজ্য। তখন–

“পূর্বাঞ্চলের পাচটি প্রদেশে, অর্থাৎ ভঙ্গল, ওড়িবিস ও অন্যান্য তিনটিতে প্রত্যেক ক্ষত্রিয়, অভিজাত, ব্রাহ্মণ এবং বৈশ্য, সকলেই নিজ নিজ গৃহে এবং প্রতিবাসীদের মধ্যে বুজাবু মুক্ত ব্যবহার করতেন, সমগ্র দেশের উপর আধিপত্য করবার মতন রাজা কেউ ছিল না।“

স্পষ্টতই তারনাথ প্রায় আটশত বছর পর শোনা কথার, পরম্পরাগত মৌখিক ইতিহাসের উপর নির্ভর করেছিলেন, কারণ, পালপর্বের আগে চন্দ্ৰান্ত্যনামা রাজাদের কোনও রাজবংশের কোনও সাক্ষ্য এ-যাবৎ পাওয়া যায়নি, না প্রত্নসাক্ষ্যে না অন্য কোনো সাহিত্য-সাক্ষ্যে। এ-তথ্য যথার্থ যে, পালপর্বে, দশম-একাদশ শতকের বঙ্গ-বঙ্গালে বেশ কোনও বংশব্যাপী চন্দ্ৰান্ত্যনামা রাজাদের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়, এবং তঁদের সম্বন্ধে গত পঁচিশ বছরের ভেতর আরও অনেক নূতন তথ্য আমরা জেনেছি (সে-কথা বলা হবে একটু পরেই)। এমন হতে পারে, তারনাথ এই চন্দ্ৰান্ত্যনামা রাজাদের সঙ্গে তার নিজের শোনা বা পড়া কাহিনী গুলিয়ে ফেলেছিলেন; সন-তারিখের বা দেশ-কাল-পাত্রের হিসেবটা তিনি গ্রাহ্য করেন নি। মন্ত্রতন্ত্রবিশ্বাসী, আধিভৌতিক ক্রিয়াকর্মে বিশ্বাসী বৌদ্ধ লামার তা করবার কথাও নয়। পালপর্বের ইতিহাস সম্বন্ধেও তিনি যা লিখে রেখে গেছেন, সে-সম্বন্ধেও একই মন্তব্য প্রযোজ্য। সেখানেও ইতিহাস, গালগল্প, কথাকাহিনীর অদ্ভুত সংমিশ্রণ।

পালায়ন

(প্রথম) শূরপাল (আ ৮৪৭-৬০ খ্ৰীষ্টাব্দে) পূর্ববর্তী সংস্করণে বলা হয়েছিল, দেবপালের পর পাল-সিংহাসনে আরোহণ করেছিলেন (প্রথম) বিগ্রহপাল, এবং শূরপাল ও বিগ্রহপাল ছিলেন একই ব্যক্তি, অর্থাৎ শূন্নপাল ছিল বিগ্রহপালের অন্য আর একটি নাম। শুধু তা-ই নয়, অনুমান করা হয়েছিল, বিগ্রহপালের পিতা ছিলেন দেবপালের সমরনায়ক বাকপাল। ইতিমধ্যে উত্তরপ্রদেশের মীর্জাপুর জেলার কোনও এক স্থানে শূত্নপালের একখানি তাম্রশাসন আবিষ্কৃত হয়েছে; এই শাসনের সাক্ষানুসারে সদ্যোক্ত তিনটি তথ্যই অযথাৰ্থ বলে প্রমাণিত হয়েছে। এই সাক্ষ্য থেকে এখন জানা যাচ্ছে, দেবপালের পর সম্রাট হয়েছিলেন তারই পুত্র শূরপাল, এবং তিনি, রাজেন্নাগ্রামে প্রাপ্ত একটি প্রতিমা লেখ-সক্ষ্যে, অন্তত পাঁচ বৎসর রাজত্ব করেছিলেন; আনুমানিক ৮৪৭ থেকে ৮৬০ পর্যন্ত তার রাজত্বকাল বলে ধরে নেওয়া যেতে পারে। শূরপালের পর সম্রাট হয়েছিলেন (প্রথম) বিগ্ৰহপাল; তিনি ছিলেন ধর্মপালের কনিষ্ঠ ভ্রাতা বাকপালের পৌত্র এবং জয়পালের পুত্র। এমন হতে পারে, কোনও কারণে বিগ্রহপাল শূরপালকে সিংহাসনচ্যুত করে নিজে সম্রাট হয়েছিলেন, কিন্তু যে-কারণেই হোক, তার পক্ষে বেশিদিন রাজত্ব করা সম্ভবপর হয়নি, কারণ তার পুত্ৰ নারায়ণপাল যে আ. ৮৬০ থেকে ৯১৭ খ্ৰীষ্টাব্দ পর্যন্ত, প্রায় ৫৬/ ৫৭ বৎসর, রাজত্ব করেছিলেন তার লিপিসাক্ষ্য বিদ্যমান। বিগ্রহপাল (আ. ৮৫৭-৮৬০) তার পুত্ৰ নারায়ণপালের হাতে রাজ্যভার অর্পণ করে বানপ্রস্থ অবলম্বন করেছিলেন, কেন, তা জানিবার কোনো উপায় নেই।

শূরপালের এই শাসনটি থেকে জানা যাচ্ছে ১. তার পিতা দেবপাল নেপালরাজকে পরাজিত করেছিলেন এবং ২. সুবর্ণদ্বীপের অধিপতি দেবপালের চরণে প্রণত হয়েছিলেন। নেপালের সঙ্গে যে দেবপালের পিতা ধর্মপালের কিছু সংঘর্ষ হয়েছিল এবং ধর্মপাল সেই সংঘর্ষে জয়ী হয়েছিলেন সে-ইঙ্গিত মূল গ্রন্থমধ্যেই আছে। এ-সময়ে নেপাল ছিল। তিব্বতের অধীনে। অসম্ভব নয় যে, দেবপালের সঙ্গেও নেপালের কিছু সংঘর্ষ হয়েছিল, এবং এই নেপালীরা ছিল ভোট-ব্রহ্মীয় কম্বোজ কোমের লোক। সুবর্ণদ্বীপাধিপতির প্রণতির উল্লেখ নিঃসন্দেহে দেবপালের নালন্দা তাম্রশাসনোক্ত শৈলেন্দ্ৰবংশীয় শ্ৰীবিজয়াধিপতি (সুমাত্ৰা-মালয় উপদ্বীপ) বালপুত্রদেবের প্রতি ইঙ্গিত। দেবপালের অনুমতিক্রমে বালপুত্রদেব নালন্দায় একটি বৌদ্ধবিহার নির্মাণ করিয়েছিলেন। তারই অনুরোধে দেবপাল এই বিহারের পরিপোষণের জন্য পাঁচটি গ্রাম দান করেছিলেন। শূরপালের তাম্রশাসনের ইঙ্গিত এই ঐতিহাসিক তথ্যটির প্রতি। গ্রন্থের পূর্ববর্তী সংস্করণে দেবপাল-প্রসঙ্গে এই মূল্যবান তথ্যটি উল্লেখ করতে ভুলে গিয়েছিলাম; এই সুযোগে সে-অপরাধ স্বীকার করছি।

শূরপালের এই তাম্রশাসন থেকে জানা যাচ্ছে যে, তিনি তঁর মাতা, অর্থাৎ দেবপাল-মহিষীর নির্দেশে শ্ৰীনগরভুক্তিতে, অর্থাৎ পাটনা অঞ্চলে, চারটি গ্রাম দান করেছিলেন, দুটি বারাণসীতে রাজমাতা-প্রতিষ্ঠিত একটি শিবলিঙ্গ-মন্দিরের উদ্দেশ্যে এবং অন্য দুটি রাজমাতারই শ্রদ্ধার পাত্র শৈবাচার্যদের পরিপোষণের জন্য।

পাঠ-পঞ্জি৷ দীনেশচন্দ্র সরকার “প্রথম শূরপালের তাম্রশাসন”, সাহিত্য-পরিষৎ-পত্রিকা, ১৩৮৩, ৮৩ বৰ্ষ, ১২ সংখ্যা, ৪০-৪৩

রাঢ়া-গৌড়ে কম্বোজাধিপত্য

এই কম্বোজরা পূর্বদক্ষিণ ভারতের (Camobodia-Laos-Vietnam) কম্বুজ হওয়া একেবারেই সম্ভব নয়, যেহেতু কম্বোজ ও কম্বুজ দুই এক শব্দই নয় (কন্তু = শঙ্খ, কম্বুজ = শঙ্খজাত, অর্থাৎ সমুদ্রের সঙ্গে তাদের সম্বন্ধ) { উত্তর-পশ্চিম সীমান্তের গন্ধার-কুটুম্ব কম্বোজদের সঙ্গেও রাঢ়া-গৌড়ের কম্বোজাদের কোনও সম্বন্ধ ছিল বলে মনে হয় না। আমার ধারণা, আমাদের এই কম্বোজরা “পাগ সাম-জোন-জাং”-গ্রন্থের কম-পো-ৰেস বা কম্বোজ, এবং এদেরই বংশধর বর্তমান উত্তর-বাংলার কোচেরা।

বঙ্গে-বঙ্গালে চন্দ্ৰাধিপত্যু

এ-সম্বন্ধে এ-গ্রেন্থের পূর্ববর্তী সংস্করণে যা লেখা ও ছাপা হয়েছিল তার প্রায় সবটাই নূতন করে লিখবার প্রয়োজন হয়েছে। গত পঁচিশ বৎসরের নূতন আবিষ্কার সবচেয়ে বেশি আলোকিত করেছে। এই বিষয়টিকে, বিশেষভাবে লালমাই-ময়নামতী পাহাড়ের উৎখননের ফলে। শ্ৰীহট্ট জেলার পশ্চিমভাগ গ্রামে তার রাজত্বের পঞ্চম বৎসরে পট্টীকৃত রাজা শ্ৰীচন্দ্রের একটি তাম্রশাসন পাওয়া গেছে। আর, তিনটি তাম্রপট্টোলী পাওয়া গেছে ময়নামতী পাহাড়ের চারপত্ৰমুড়া অঞ্চলের উৎখনন থেকে; এই তিনটির প্রথম ও দ্বিতীয় পট্টোলীটি জনৈক চন্দ্রাস্ত্যনামা রাজা লড়হচন্দ্রের নামাঙ্কিত এবং তৃতীয়টি একই চন্দ্রাস্ত্য রাজা গোবিন্দ চন্দ্রের নামাঙ্কিত। চতুর্থ একটি পট্টোলীও একই উৎখনন থেকে পাওয়া গেছে, জনৈক রাজা শ্ৰীবীরধর দেব বিষ্ণুচক্রলাঞ্ছিত এই পট্টোলীদ্বারা ১৭ পদ ভূমি দান করেছিলেন। পট্টোলীটির অক্ষর-সংক্ষ্যে মনে হয়, বীর্যধরদেব একাদশ-দ্বাদশ শতকের কোনও সময়ে সমতটমণ্ডলের ময়নামতী অঞ্চলে কোথাও রাজত্ব করতেন। কিন্তু তার বংশ-পরিচয় কী, সমতটমগুলেশ্বর চন্দ্রাস্ত্যনাম রাজা শ্ৰীচন্দ্রের বংশধরদের সঙ্গে তার কোনও আত্মীয়তা ছিল কি না, এ-সম্বন্ধে অন্য কোনও তথ্যই জানা যায় না।

যাই হোক, পূর্বোক্ত রাজা শ্ৰীচন্দ্ৰ, লড়হচন্দ্র ও গোবিন্দচন্দ্রের পট্টোলী চারিটিতে দক্ষিণ-পূর্ব বাঙলার দশম-একাদশ শতকের চন্দ্ৰবংশীয় রাজাদের সম্বন্ধে অনেক নূতন খবর জানা যাচ্ছে। এই রাজাদের বেশ কয়েকটি পট্টোলীর খবর আগেও আমাদের জানা ছিল, কিন্তু নূতন আবিষ্কারের ফলে শুধু রাজবৃত্ত ব্যাপারে নয়, সাংস্কৃতিক ব্যাপারেও নূতন আলোকপাত ঘটেছে। যথাস্থানে তা উল্লেখ করা হবে।

এই রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন রোহিত্যাগরি চন্দ্ৰবংশীয় জনৈক পূৰ্ণচন্দ্র। দীনেশচন্দ্ৰ সরকার মনে করেন, এই রোহিতাগিরি বিহারান্তর্গত বর্তমান শাহাবাদ জেলার রাইটাসগড়। নলিনীকান্ত ভট্টশালী মনে করতেন, এবং আমিও মনে করি, রোহিতাগিরি লালমাই (লালমাটি-রক্তমৃত্তিকা) শব্দটিরই সংস্কৃত রূপমাত্র মাত্র, এবং চন্দ্ৰবংশীয় রাজারা এই লালমাই-ময়নামতী অঞ্চলেরই অধিবাসী ছিলেন। যাই হোক স্বাধীন নরপতি না হলেও পূৰ্ণচন্দ্র যে একজন স্থানীয় প্রতাপশালী প্রধান ছিলেন, এমন অনুমানে কোনও বাধা নেই।

পূৰ্ণচন্দ্রের পুত্র সুবর্ণচন্দ্ৰই বোধ হয়। এ-বংশের প্রথম পুরুষ যিনি বৌদ্ধ ধর্মের আনুগত্য স্বীকার করেছিলেন, কিন্তু এ-বংশের প্রথম স্বাধীন নরপতি ছিলেন সুবর্ণচন্দ্রের পুত্র পরামসৌগত পরামমেশ্বর পরমভট্টারক মহারাজাধিরাজ ত্ৰৈলোক্যচন্দ্ৰ (এই দীর্ঘ পরিচয়টি শুধু পশ্চিমভােগ পট্টোলীতেই পাওয়া যায়; পরবর্তী অন্যান্য পট্টোলীতে তিনি শুধু মহারাজাধিরাজ মাত্র)। ত্ৰৈলোক্যচন্দ্ৰ নানাদিকে তার সামরিক প্রভাব বিস্তারে সচেষ্ট ছিলেন। হরিকেল (শ্ৰীহট্ট) অঞ্চল যে তীর প্রভুত্ব স্বীকার করতো, সে-খবর আগেই জানা ছিল। এখন জানা যাচ্ছে, তিনি সমতটও (কুমিল্লা-শ্ৰীহট্ট-নোয়াখালি) আঁর অধিকারে এনেছিলেন। তখন সমতটের রাজধানী ছিল ক্ষীরোদানদী (কুমিল্লা শহরোপান্তে গোমতী নদীর শাখা খিরা বা খিরনাই নদী)-তীরবর্তী দেবপৰ্বত, যে দেবপর্বত ছিল দেববংশীয় রাজা ভবদেবের এবং বোধ হয় রাজা কান্তিদেবেরও রাজধানী। দেবপর্বতের অবস্থিতি ছিল। লালমাই—ময়নামতী পাহাড়ের উপরই। ত্ৰৈলোক্যচন্দ্রের কিছু আগে কাম্বোজ (কোচ বংশীয়?) রাজাদের হাতে দেবপর্বত বিধ্বস্ত হয়েছিল, এমন একটি ইঙ্গিত শ্ৰীচন্দ্রের পশ্চিমভাগ পট্টোলীতে পাওয়া যায়। তার রাজধানী ছিল বঙ্গে, চন্দ্ৰদ্বীপে।

হয় ত্ৰৈলোক্যচন্দ্র নিজেই, অথবা তার পুত্র পরামসৌগত পরমেশ্বর পরমভট্টািরক মহারাজাধিরাজ শ্ৰীচন্দ্ৰ তার রাজত্বের (৯২৫-৯৭৫ খ্ৰীষ্টাব্দে) পঞ্চম বৎসরের আগে কোনও একসময় চন্দ্ৰদ্বীপ থেকে বঙ্গের বিক্রমপুরে তঁদের রাজধানী স্থানান্তরিত করেন। শ্ৰীচন্দ্রের নামাঙ্কিত পট্টোলীগুলি থেকে তার রাজ্যের বিস্তৃতি সম্বন্ধে একটা ধারণা করা কঠিন নয়। চন্দ্ৰদ্বীপ, বিক্রমপুর, হরিকেল প্রভৃতি অঞ্চল তো চন্দ্ৰবংশীয় রাজাদের করতলগত ছিলই। এখন পশ্চিমভাগ পট্টোলী থেকে জানা যাচ্ছে, পুণ্ড্রবর্ধনভূক্তির সমতটমণ্ডলের শ্ৰীহট্ট অঞ্চলও এই রাজ্যভুক্ত ছিল। ইদিলপুর পট্টোলী থেকে আগেই জানা ছিল, ফরিদপুর অঞ্চলও চন্দ্রদের আধিপত্য স্বীকার করতো। অর্থাৎ, সমগ্র দক্ষিণ-পূর্ব বঙ্গদেশ জুড়ে (ঢাকা, ফরিদপুর, ত্রিপুরা, নোয়াখালি, শ্ৰীহট্ট) চন্দ্ররাজ্য বিস্তৃত ছিল। পশ্চিমভাগ লিপি-সংক্ষ্যে মনে হয়, শ্ৰীচন্দ্ৰ লোহিত্য-বিধৌত কামরূপে একটি বিজয়াভিযান পাঠিয়েছিলেন এবং গৌড়দের পরাজিত করেছিলেন। (লড়হচন্দ্রের ১ম ময়নামতী লিপি)। তবে, শ্ৰীচন্দ্রের সবচেয়ে মহৎকীর্তি শ্ৰীহট্ট অঞ্চলে একটি বিরাট দেবস্থান ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পত্তন, যার বিস্তৃত বিবরণ জানা যায় নবাবিষ্কৃত পশ্চিমভােগ পট্টোলীতে। ধর্মকর্ম-অধ্যায়ের সংযোজন]াসে বিবরণ পাওয়া যাবে। শ্ৰীচন্দ্রের পুত্র কল্যাণচন্দ্রের (আ. ৯৭৫-১০০০ খ্ৰীষ্টাব্দ) সম্বন্ধে বলা হয়েছে, তিনি লৌহিত্যতীরে স্নেচ্ছদের এবং গৌড়দের অপমানিত করেছিলেন। মনে হয়। এই দাবি তার একান্ত নিজস্ব একক দাবি নয়। হয়তো তিনি পিতা শ্ৰীচন্দ্রের সঙ্গে তার কামরূপ-প্ৰাগজ্যোতিষ ও গৌড় বিজয়াভিযানে যোগ দিয়েছিলেন; এই দাবি সেই ইঙ্গিত বহন করছে মাত্র। কিন্তু এই স্লেচ্ছারা কারা? গৌড়রাজ বলতেই বা কার প্রতি ইঙ্গিত করা হচ্ছে? কেউ কেউ মনে করেন, ম্লেচ্ছ বলতে কামরূপের শালস্তম্ভবংশীয় রাজাদের প্রতি ইঙ্গিত করা হচ্ছে। কিন্তু এ-ও তো হতে পারে, এই ম্লেচ্ছ শব্দটি মেচু এই কৌম নামেরই সংস্কৃতিকরণ, যেমন দীনেশচন্দ্রের মতো আমারও ধারণা কাম্বোজ শব্দটি কোচ কৌমানামেরই সংস্কৃতিকরণ। আর, গৌড়দের অধিপতি এই দশম-একাদশ শতাব্দীতে তো সুপরিচিত পালবংশী রাজাদের কেউ ছিলেন না, কারণ এই সময় গৌড় তাদের হস্তচু্যত হয়ে চলে গিয়েছিল কম্বোজবংশীয় পালরাজাদের স্থাতে। ধর্মপাল-দেবপালের বংশধরদের রাজত্ব তখন পূর্ব ও দক্ষিণ বিহারে সীমিত।

কল্যাণচন্দ্রের পুত্র ছিলেন পরামসৌগত পরমেশ্বর পরমভট্টারক মহারাজাধিরাজ লড়হচন্দ্ৰ (নামটি যে দেশজ, সন্দেহ নেই)। বস্তুত শ্ৰীচন্দ্রের কাল থেকেই চন্দ্ৰবংশীয় প্রত্যেকটি রাজার এই একই ঔপধিক-পরিচয়। লড়হচন্দ্ৰ বোধ হয় একাধিকবার বারাণসী এবং প্রয়াগে গিয়াছিলেন। ধর্মাচরণোদ্দেশ্যে। তিনি পট্রিকেরকে একটি বিষ্ণুমন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এবং সেই মন্দির স্বনামের সঙ্গে যুক্ত করে লড়হমাধব-ভট্টারক নামে এক বিষ্ণুমূর্তি স্থাপন করেছিলেন।

লড়হচন্দ্রের (আ. ১০০০—-১৫ খ্ৰীষ্টাব্দে) পর তঁর পুত্ৰ গোবিন্দচন্দ্র (আ. ১০১৫-৪৫ খ্ৰীষ্টাব্দ) রাজসিংহাসন অধিকার করেন। তিনি শিব-ভট্টারকের নাম করে নটেশ্বর-ভট্টারকের (নৃত্যপর শিবের) উদ্দেশ্যে পেরনাটন-বিষয়ে (পৌণ্ডবর্ধনভূক্তির সমতটমণ্ডলে) সাহরতলাক গ্রামে দুই পাটক ভূমি দান করেছিলেন। এই গোবিন্দচন্দ্ৰই বোধ হয়। চন্দ্রবংশের শেষ রাজা, এবং ইনিই বোধ হয়। বঙ্গালদেশের সেই গোবিন্দচন্দ্র যিনি চোল-সম্রাট রাজেন্দ্ৰ চোলের কাছে পরাজিত হয়ে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন। বোধহয় ইনিই মধ্যযুগীয় ময়নামতীর গানের রাজা গোবিন্দচন্দ্র। কিন্তু চন্দ্ৰবংশের পতন বোধ হয় রাজেন্দ্ৰ চোলের বঙ্গালদেশ বিজয়ের জন্য নয়, কারণ রাজেন্দ্ৰচোল পূর্বভারতে রাজত্ব বিস্তার করতে আসেননি; তঁর অভিযান সাময়িক দিগ্বিজয়াভিযান ছিল মাত্র। মনে হয়, চন্দ্রবংশের পতন হয়েছিল কলচুরীরাজ কর্ণের বঙ্গবিজয়াভিযানের ফলে। কৰ্ণ দাবি করেছেন, তিনি পূর্বদেশের রাজাকে এক বিষম যুদ্ধে পরাজিত ও পর্যুদস্ত করেছিলেন। এই রাজা গোবিন্দচন্দ্র হওয়াই সম্ভব। যাই হোক, এর পর চন্দ্ৰবংশীয় রাজাদের কথা আর শোনা যাচ্ছে না।

আত্মপরিচয় বর্ণনায় এই রাজ্যবংশের সকলেই, বোধ হয়। সুবর্ণচন্দ্রের সময় থেকেই অন্তত শ্ৰীচন্দ্রের সময় থেকেই তো-বটেই, পরামসৌগত অর্থাৎ বৌদ্ধধর্মানুগত। পট্টোলীগুলি সমস্তই বৌদ্ধ ধৰ্মচক্রলাঞ্ছিত। কিন্তু লড়হচন্দ্র ও গোবিন্দচন্দ্র সম্বন্ধে তাদের বৌদ্ধ—ধর্মানুগত্যের পরিচয় অত্যন্ত শিথিল, বোধহয় পরম্পরা রক্ষা মাত্র। লড়হচন্দ্ৰ তো স্পষ্টতই বৈষ্ণবধর্মানুরক্ত ছিলেন। তিনি ভূমিদান করেছেন বাসুদেব-ভট্টারককে প্ৰণাম জানিয়ে, লড়হমাধবভট্টািরক নামে এফ বিষ্ণু-কৃষ্ণের প্রতিমা প্রতিষ্ঠা করেছেন এবং তার উদ্দেশ্যে ভূমিদান করেছেন, প্রয়াগ-বারাণসী গেছেন ধর্মাচরণোদ্দেশ্যে। তার পট্টোলী দুটির বক্তব্য ব্রাহ্মণ্য পৌরাণিক দেবদেবী, পৌরাণিক স্মৃতিকথা ও কাহিনী, এবং পৌরাণিক বাতাবরণে আচ্ছন্ন। বারাণসী তীর্থ-প্রসঙ্গে বুদ্ধদেবের উল্লেখও নেই, আছে। শিব, পার্বতী ও ব্ৰহ্মার। গোবিন্দ চন্দ্রের পট্টোলীর বক্তব্যও তাই। তিনি ছিলেন শিবধর্মানুরক্ত; তিনি ভূমিদান করেছেন শিবভট্টারককে প্ৰণাম জানিয়ে নট্টেশ্বর ভট্টারক অর্থাৎ নৃত্যপর শিব দেবতার উদ্দেশ্যে। এই দুই নৃপতির কোনও পট্টোলীর বিষবস্তুতেই কোথাও বৌদ্ধধর্মানুগত্যের কোনও পরিচয় নেই, একমাত্র ‘পরমাসৌগত পরিচয় ও ধর্মচক্রলাঞ্ছনটি ছাড়া। কালটি একাদশ শতকের প্রথমার্ধ বা মধ্যপদ। পূর্ব-ভারতের পূর্বাঞ্চলে ধর্ম ও সমাজের বাতাস কোনদিকে বইছে, বৌদ্ধধর্মের বাতাবরণ ক্রমশ কী ভাবে শিথিল হয়ে পৌরাণিক ব্ৰাহ্মণ্যধর্মের অনুকূলে বইতে আরম্ভ করেছে, লড়হচন্দ্র ও গোবিন্দচন্দ্রর পট্টোলীগুলি তার ইঙ্গিত বহন করছে। এ-সম্বন্ধে মূলগ্রন্থে ত্ৰিশ বৎসর আগে যা বলেছিলাম নবাবিষ্কৃত পট্টোলীগুলিতে তার সুস্পষ্ট সমর্থন পাওয়া গেল।

এই পরিশিষ্টের [সংযোজিত] রাজবৃত্ত অধ্যায়ে লামা তারনাথের চন্দ্ৰবংশ কাহিনী অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, পাল-পূর্ব কালে প্রাচীন বাংলায় চন্দ্রান্ত্যিনাম রাজাদের একটি সুদীর্ঘ রাজবংশের রাজত্বের কথা তারনাথ তার বৌদ্ধধর্মের ইতিহাসে লিখে রেখে গেছেন। তারনাথের এই সাক্ষ্যের যে কোনও ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই, সে কথা ইতিপূর্বে বলা হয়েছে। তবে, প্রাচীন বাংলা-সংলগ্ন আরাকানে চন্দ্ৰান্তনামা রাজাদের এক সুদীর্ঘ রাজবংশের ইতিহাসের সঙ্গে ঐতিহাসিকদের পরিচয় অনেকদিনের। সে-ইতিহাস তদানীন্তন আরাকান রাজধানী বেসলী বা বৈশালীর প্রত্নসাক্ষ্যে এবং মধ্য-বর্মর পগান রাজবংশের পুরাণ কাহিনীতে সমর্থিত। আরাকানের চন্দ্ৰবংশীয় রাজা আনন্দ চন্দ্রের (অক্ষর-সংক্ষে। আনুমানিক ৭৩০ খ্ৰীষ্টাব্দ) একটি সুদীর্ঘ প্রশস্তি-শিলালেখ পাওয়া গেছে, বৈশালী সংলগ্ন সিখাউংর একটি স্তম্ভগাত্রে। এই প্রশস্তিতে আনন্দ চন্দ্রের উধ্বতন চব্বিশ পুরুষের উল্লেখ আছে এবং একুশ জন রাজার নাম দেওয়া আছে। অর্থাৎ, আনুমানিক চতুর্থ খ্ৰীষ্টীয় শতাব্দীর মাঝামাঝি কোনও সময় এই রাজবংশের প্রতিষ্ঠা হয়ে থাকবে। এ-অনুমান বোধ হয় করা যেতে পারে যে, তারনাথ এই রাজবংশের সঙ্গে বঙ্গ-বঙ্গালের চন্দ্ৰবংশের কাহিনী গুলিয়ে ফেলেছিলেন।

যাই হোক, কেউ কেউ মনে করেন, আরাকানের এই চন্দ্রবংশের সঙ্গে দক্ষিণ-পূর্ববঙ্গের চন্দ্ৰবংশের একটি ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। মনে করবার কারণও আছে। আরাকানের চন্দ্ৰবংশীয় রাজাদের প্রচুর ধাতুমুদ্রা পাওয়া গেছে; শঙ্খ বৃষ, অংকুশ, চামর, শ্ৰীবৎস্যচিহ্ন প্রভৃতি লাঞ্ছিত এই মুদ্রগুলির সঙ্গে দক্ষিণ-পূর্ববঙ্গের চন্দ্ৰবংশীয় রাজাদের মুদ্রার সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ। আরাকানের প্রাচীন রাজধানীর ধ্বংসাবশেষের মধ্যে এমন অনেক প্রতিমা পাওয়া গেছে যার সঙ্গে লালমাই-ময়নামতীর নবাবিষ্কৃত প্রতিমা-সংক্ষ্যের সম্বন্ধও ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের। তাছাড়া, বর্মী হমন্নানয়াজাবিন (Hmannan Yazawin)—গ্রন্থে আছে, পাগান রাজ আনাউরহথা (১০৪৪-১০৭৭ খ্ৰীষ্টাব্দ) উত্তর আরাকান জয় ও অধিকার করেন, যার ফলে তার রাজ্যের পশ্চিম সীমা পট্টিকের পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। আন্নাউরহথার পুত্র, চ্যানজিথার এক কন্যা পট্টিকেরার এক রাজপুত্রের প্রতি প্রেমাসক্ত হন, কিন্তু এ-প্রেম পরিণয়ে পরিণতি লাভ করেনি। এক পুরুষ পরে এই বঞ্চিত নারীরই পুত্র রাজা অলৌঙসিথু (১১১২-১১৬৭ খ্ৰীষ্টাব্দ) পট্টিকেরার এক রাজকন্যাকে বিয়ে করেন। অলৌঙসিথুর মৃত্যুর পর, তারই পুত্র রাজা নরথু বিধবা বিমাতাকে হত্যা করেন। বিধবা কন্যার নৃশংস হত্যার খবর পেয়ে পট্টিকের-রাজ ব্রাহ্মণের ছদ্মবেশে আটটি যোদ্ধাকে পাঠান এই হত্যার প্রতিশোধ নেবার জন্য। পগানে পৌঁছে রাজাকে আশীবাদ করবার ছল করে তঁরা রাজপ্রাসাদে ঢুকে রাজাকে হত্যা করেন এবং নিজেরাও নিহত হন, অথবা আত্মহত্যা করে মৃত্যুবরণ করেন। এ-কাহিনী অবিশ্বাস করবার আমি কোনও কারণ দেখিলে। অন্তত পট্টিকেরা রাজ্যের সঙ্গে যে পাগান রাজবংশের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল, এ সম্বন্ধে তো সন্দেহের অবকাশ থাকতে পারে না।

যাই হোক, কেউ কেউ মনে করেন, আনাউরহথার আরাকান বিজয়ের পর আরাকান-চন্দ্ৰবংশের অস্তিত্ব আর সেখানে ছিল না; সেই রাজবংশ আরাকান পরিত্যাগ করে চলে এসেছিলেন প্রতিবেশী পট্রিকের রাজ্যে এবং সেখানে নূতন এক চন্দ্ৰবংশ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এই কংশেই দক্ষিণপূর্ব বাংলার, বঙ্গ-বঙ্গালের চন্দ্ৰবংশ। এই অনুমানের যুক্তি ও সাক্ষ্যসম্মত কোনও কারণ এখনও কিছু দেখতে পাচ্ছিনে। আনাউরহথার আরাকান-বিজয় ১০৪৪ খ্ৰীষ্টাব্দের আগে হতে পারে না। শ্ৰীচন্দ্রের রাজবংশ তার আগেই সমতট মণ্ডলে, অর্থাৎ দক্ষিণপূর্ব বাংলায় (পট্টিকের যার অন্তর্ভুক্ত) সুপ্রতিষ্ঠিত। তবে দুই চন্দ্রবংশের মধ্যে ঘনিষ্ঠ আত্মীয়তা ও যোগাযোগ ছিল, এমন অসম্ভব নয়।

[পাঠ-পঞ্জি : Sirkar. D. C. Epigraphic Discoveries in East Pakistan, op. cit, pp. 19-59, Khan, A. F. and Dani, A H, “Excavations on Manamati Hills near Comilla,” in further Excavations in East Pakistan-Mainarnati, 1956, pp. 20 ff; Dani, A. H. Pakistan Archaeology, Karachi, no. 3, 1956 pp. 2255; Majumdar, R. C., History of Ancient Bengal, First reprint edn, 1974, Calcutta, pp. 167-169, 199-206 and 278-80; Sircar. D. C. “Chandra Kings of Arakan’ in Ep. ind. XXXII, pp. 103-09.

নয়পাল (আ. ১০২৭- ১০৪৩ খ্ৰীষ্টাব্দ)

কিছুদিন আগে, ১৯৭১ খ্ৰীষ্টাব্দের শেষদিকে, বীরভূম জেলার বোলপুর শহরের অনতিদূরে সিয়ান গ্রামের শাহজাহানপুর পাড়ার মখদুম শাহ জালানের জীর্ণ একটি দরগায় দুটি শিলা ফলক পাওয়া যায়। ফলক দুটি বস্তুত একটি বৃহৎ ফলকের দুই ভগ্ন অংশ। দুটি ফলকই ক্ষত-বিক্ষত, জীর্ণ, অস্পষ্ট, প্রথমটি অপেক্ষাকৃত কম, দ্বিতীয়টি বেশি। সুতরাং উভয় ফলকেরই সম্পূর্ণ পাঠোদ্ধার অসম্ভব। বহু পরিশ্রমে, বহু অধ্যবসায়ে দীনেশচন্দ্র সরকার মশায় যতটা সম্ভব বিভিন্ন অংশের কিছু কিছু পাঠোদ্ধার করেছেন; কিন্তু যতটুকু করেছেন তার ফলে পালবংশের কোনও কোনও রাজা সম্বন্ধে, বিশেষ করে (প্রথম) মহীপালপুত্র রাজা নয়পাল সম্বন্ধে নূতন আলোকপাত ঘটেছে। শিলালেখটি কে উৎকীর্ণ করিয়েছিলেন তা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না, কিন্তু রাজা নয়পালের রাজত্বকালেই যে তা করানো হয়েছিল, এবং যে নরপতির কীৰ্তিকলাপ এই লেখতে কীর্তিত হয়েছে তিনি যে রাজা নয়পাল ছাড়া আর কেউ হতে পারেন না, এ-অনুমান সহজেই করা যায়। প্রশস্তি-লেখটির সূচনায়, দীনেশচন্দ্র বলছেন,

‘পালবংশের ধর্মপাল, তৎপুত্র দেবপাল, বিগ্রহপাল (দ্বিতীয়), এবং নয়পালের নাম উদ্ধার করা গিয়াছে। কিন্তু ইহাতে ধর্মপালের পিতা গোপাল এবং নয়পালের পিতা এবং দ্বিতীয় বিগ্রহপালের পুত্র প্রথম মহীপালেরও নামোল্লেখ ছিল বলিয়া অনুমান করিবার কারণ আছে। নয়পালের পরবর্তী কোন পাল-রাজার নাম উদ্ধার করা সম্ভব হয় নাই। প্রশস্তিটিতে যাহার ধর্মকীর্তির বিষয় উল্লিখিত হইয়াছে তাহাকে অনেক সময় নরপতি রূপে উল্লেখ করা হইয়াছে। এই রাজা যে নয়পাল ব্যতীত অপর কেহ তাহার কোন প্রমাণ প্রশস্তিতে পাওয়া যায় না।‘

এই প্রশস্তিটির ১৬নং শ্লোকে বলা হয়েছে যে, নরপতি (নয়পাল) চেন্দিরাজ কর্ণের কোটি কোটি সৈন্য ধ্বংস করে। প্ৰজাগণের আনন্দবিধান করেছিলেন। কিন্তু তিব্বতী সাক্ষ্য থেকে মনে হয়, চেদিরাজের সঙ্গে যুদ্ধ কোনও পক্ষেরই জয়পরাজয়ে মীমাংসিত হয়নি। মূলগ্রন্থে সে কথা বলা হয়েছে, এখানে আর পুনরুক্তি করে লাভ নেই।

সিয়ান গ্রামের এই প্রশস্তিটির প্রধান উদ্দেশ্য ছিল যেন নরপতি নয়পালের কীর্তিকলাপ বর্ণনা, এবং সে-সব কীর্তি প্রায় সমস্তই ধৰ্মকৰ্ম সংক্রাপ্ত। অনেক এই ধরনের কীর্তির মধ্যে কয়েকটি তালিকাগত করা যেতে পারে; পুরারি বা শিবের একটি মন্দির প্রতিষ্ঠা এবং শৈব সাধুদের বাসের জন্য একটি দ্বিতল মঠ; একাদশ রুদ্রমূর্তি প্রতিষ্ঠা; জগন্মাতার জন্য স্বৰ্ণকলসশোভিত শিলাবলভী (পাথরের চূড়া) নির্মাণ; পাথরের তৈরী মন্দিরে নয়টি চণ্ডিকামূর্তি প্রতিষ্ঠা; দেবীকোটে হেতুকেশ শিবের মন্দির প্রতিষ্ঠা; ক্ষেমেশ্বর শিবের পাথরের মন্দির, মঠ ও সরোবর প্রতিষ্ঠা; উচ্চদেব-সংজ্ঞক বিষ্ণুমন্দির, তৎসংলগ্ন আরোগ্যশালা ও বৈদ্যাবাস প্রতিষ্ঠা ঘন্টী বা শিব ও তার চারদিকে চৌষট্টি মাতৃকামূর্তি প্রতিষ্ঠা; চম্পা নগরীতে বটেশ্বরের শিলামন্দির প্রতিষ্ঠা; (প্ৰতীহাররাজ) মহেন্দ্ৰপাল-প্রতিষ্ঠিত চর্চা বা জগদম্বার শৈলমন্দিরে শিলাদ্বারা চূড়া ও সোপান নির্মাণ, ধর্মারণ্যে মাতঙ্গব্যাপীর সংস্কার, মাতঙ্গেশ্বর শিবের মন্দির নির্মাণ এবং সেই মন্দিরে শিবের কন্যা শ্ৰী বা লক্ষ্মীর প্রতিষ্ঠা; সূর্যমন্দির প্রতিষ্ঠা; বৈদ্যনাথ শিকের স্বর্ণখোল নির্মাণ এবং মন্দির-শিখরে স্বর্ণকলস স্থাপন, অট্টহাসে জগন্মাতার মন্দিরে স্বৰ্ণকলস স্থাপন; গঙ্গাসাগরে স্বর্ণত্রিশূল, রৌপ্যের সদাশিব প্রতিমা, স্বর্ণের চণ্ডিকা ও গণেশ প্রতিমা এবং এই প্রতিমা দুটির স্বৰ্ণপীঠ নির্মাণ; চন্দ্র প্রতিমা, রৌপ্যের সূর্য প্রতিমা, শিবের স্বর্ণপ্রতিমা এবং নবগ্রহের জন্য স্বর্ণপদ্ম নির্মাণ, শৈবসাধুদের জন্য মঠ প্রতিষ্ঠা, একটি মঠ নির্মাণ ও তন্মধ্যে বৈকুণ্ঠ বিষ্ণু প্রতিমা প্রতিষ্ঠা; এবং পিঙ্গালার্য নামী জগন্মাতার মন্দিরে চুড়া এবং সরোবর নির্মাণ।

এ-প্রসঙ্গে দীনেশচন্দ্ৰ যে মন্তব্য করেছেন তা সৰ্ব্বথা যথার্থ। তিনি বলছেন,

‘…সিয়ান-প্রশস্তিতে যে-নরপতির ধর্মকীর্তি লিপিবদ্ধ হইয়াছে, তাঁহার ভক্তি সর্বাপেক্ষা অধিক ছিল শিবের প্রতি এবং তঁহার কাছে শিবের পরই ছিল জগন্মাতার স্থান। কিন্তু তিনি বিষ্ণু, সূর্য, গণেশ, লক্ষ্মী প্রভৃতি দেবতার প্রতিও একেবারে ভক্তিহীন ছিলেন না।
পালবংশীয় রাজা নয়পালকে পূর্বে বৌদ্ধ মনে করা হইত। বাণগড় শিলা-প্রশস্তির আবিষ্কারের ফলে দেখা গিয়াছে যে, তিনি শৈব্যাচার্য সর্বশিবের নিকট শিবমন্ত্রে দীক্ষিত হইয়াছিলেন। সুতরাং তিনি শিব এবং শক্তির উপাসক ছিলেন বলা যায়; কিন্তু পৌরাণিক বা স্মার্ত মতাবলম্বী হিন্দুর ন্যায় অন্যান্য দেবদেবীকেও তিনি অবজ্ঞা করিতেন না। লক্ষ্য করিবার বিষয় এই যে, সিয়ান-প্রশস্তিতে রাজার কীর্তিকলাপের মধ্যে বৌদ্ধবিহার নির্মাণ এবং বুদ্ধমূর্তি প্রতিষ্ঠার কোন স্পষ্ট উল্লেখ নাই।‘

কালটি একাদশ শতকের প্রথমার্ধ। সুতরাং ধর্মের এই দিক পরিবর্তনে আশ্চর্য হবার কিছু নেই।

(এই সংযোজনাংশের সমস্ত তথ্যই আহৃত হয়েছে; দীনেশচন্দ্র সরকার, “সিয়ান গ্রামের শিলালেখ”, সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকা, ৮৩ বর্ষ, ৩-৪ সংখ্যা, মাঘ-চৈত্র, ১৩৮৩, ১-২২ পৃ প্ৰবন্ধটি থেকে।)

পাল-রাজাদের তারিখ

পাল-বংশীয় রাজাদের ব্লাজত্বের আরম্ভ ও অবসানের তারিখ ইত্যাদি নিয়ে তর্কবিতর্কের শেষ নেই; একজন পণ্ডিতের নির্ধারণের সঙ্গে আর একজনের মতামতের ঐক্য আর কিছুতেই হচ্ছে না। বোধ হয় হ’বার কথাও নয়। এখনও মাঝে মাঝে রাজাদের নাম ও রাজ্যাঙ্কের উল্লেখ-সম্বলিত নূতন শিলা বা তাম্রলেখ, প্রতিমালিপি, পাণ্ডুলিপি ইত্যাদি পাওয়া যাচ্ছে। তার ফলে কারও কারও রাজত্বকাল বেড়ে যাচ্ছে, যেমন রামপালের। নূতন রাজার নামও পাওয়া যাচ্ছে, যেমন শুরপালের। যে-কোনও রাজার রােজ্যাঙ্কের শেষ-জ্ঞাত তারিখটিই সাধারণত ধরা হয় তার রাজত্বের অবসানের তারিখ বলে; এই তারিখটি যখন নূতন কোনও সাক্ষ্যে এগিয়ে যায় দু’চার পাঁচ-সাত বছর কি তারও বেশি তখন জানা তারিখ সাজিয়ে যে সৌধটি খাড়া করা হয়েছিল তা তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ে। সুতরাং, নূতন করে আবার তখন আর একটা কাঠামো দাড় করাতে হয়, কারণ মোটামুটি একটা কাঠামো ছাড়া ইতিহাসকে দাড় করানো যায়না। সেজন্য মনে রাখা ভালো যে, কোনও রাজত্বের আরম্ভ বা অবসানের তারিখ একান্ত সুনিশ্চিত নয়, আনুমানিক মাত্র এবং তা-ও নূতন সাক্ষ্যে নূতনতর বিলম্বিত তারিখ পাওয়া গেলে পরিবর্তনীয়।

যাই হোক, এ-গ্ৰন্থ রচনার পর এ-প্রসঙ্গে, নূতন আবিষ্কার ও নূতন আলোচনা-গবেষণার ফলে যে-সব নূতন তথ্য জানা গেছে তার সংক্ষিপ্ত উল্লেখ করা প্রয়োজন, যেহেতু গ্রন্থমধ্যে তারিখগুলি তদনুযায়ী সংশোধন করা হয়েছে।

(প্রথম) গোপালদেব কবে প্রকৃতিপুঞ্জের ‘নির্বাচনে পাল-সিংহাসনে বসেছিলেন তা সুনির্ধারিতভাবে আমাদের জানা নেই। সকল দিক বিবেচনা করে মোটামুটি ধরে নেওয়া হয়েছে। খ্ৰীষ্টােব্দ ৭৫০-এ। তার পুত্র ধর্মপাল অন্তত ৩২ বৎসর এবং ধর্মপালের পুত্র দেবপাল অন্তত ৩৫ বা ৩৯ বৎসর রাজত্ব করেছিলেন। সমগ্র তালিকাটির চালাচালির সুবিধার জন্য বিলম্বিত ৩৯ বৎসরটি ধরে গণনা করাই যুক্তিযুক্ত।

দেবপাল-পুত্র শূরপাল সম্বন্ধে সংবাদটি নূতন। তার মীর্জাপুর তাম্রশাসন থেকেই আমরা প্রথম জানতে পারলাম যে, দেবপালের মৃত্যুর পর শূরপালই পাল-সিংহাসন আরোহণ করেছিলেন। রাজীেনা-প্রতিমালিপি অনুসারে তিনি অন্তত ৫ বৎসর রাজত্ব করেছিলেন। আগেই জানা ছিল, তার উত্তরাধিকারী (প্রথম) বিগ্রহপাল অন্তত ৩ বৎসর এবং তৎপুত্ৰ নারায়ণপাল অন্তত ৫৪ বৎসর রাজত্ব করেছিলেন।

নারায়ণপালের পুত্র রাজ্যপালের রাজত্বের কাল সম্বন্ধে একটি নূতন তথ্য জানা গেছে। লণ্ডনের ভিকটোরিয়া ও অ্যালবার্ট মু’জিয়ুমে বলরামের একটি প্রতিমা আছে; সেই প্রতিমাটির পাদপীঠে একটি লিপি উৎকীর্ণ। রাজ্যপালের রাজত্বের পূর্বজ্ঞাত শেষ তারিখ ছিল ৩২ বৎসর; এখন এই নূতন সাক্ষ্যে জানা যাচ্ছে, তিনি অন্তত ৩৭ বৎসর রাজত্ব করেছিলেন। তার উত্তরাধিকারী (দ্বিতীয়) গোপাল রাজত্ব করেছিলেন অন্তত ১৭ বৎসর। এই তারিখটি জানা যাচ্ছে মৈত্ৰেয়-ব্যাকরণের একটি তালপাতার পুঁথি থেকে। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী তারিখটি পড়েছিলেন। ৫৭, রাখালদাস বন্দোপাধ্যায় ১৭, এবং দেবদত্ত রামকৃষ্ণ ভাণ্ডারকর, ১১। আমি ১৭ পাঠটিই গ্রহণ করেছি, কারণ ৫৭ বৎসরের সুদীর্ঘ রাজত্ব পাল-কাঠামোতে গুছিয়ে তোলা কঠিন যেহেতু এতটা সময়ের জায়গা পাওয়া কঠিন; এবং ১১ বড় বেশি কম।

(দ্বিতীয়) গোপালের পর রাজা হন (দ্বিতীয়) বিগ্রহপাল। বিগ্ৰহপাল নামাঙ্কিত একটি মৃৎফলক-লিপি বহুদিন জ্ঞাত; এই ফলকের রােজ্যাঙ্ক তারিখ ৮। একই নামাঙ্কিত তিনটি প্রতিমালিপিও আছে; তিনটিই বিহারের কুর্কিহার থেকে। তিনটি প্রতিমাই মুকুট-পরিহিত বুদ্ধের, তিনটিই সর্বতোভাবে একই শৈলীর একই প্রতিমালক্ষণ যুক্ত। একটির রােজ্যাঙ্ক-তারিখ ৩ বা ২, আর দুইটির ১৯। তিনটি প্রতিমাই যে একই রাজার আমলের এ-সম্বন্ধে সন্দেহের কোনও কারণ নেই। তা ছাড়া, ব্রিটিশ মুজিয়ুমে রক্ষিত বৌদ্ধ পঞ্চরক্ষার একটি পাণ্ডুলিপির ভণিতায় এক পরমেশ্বর পরমভট্টারক পরামসৌগত মহারাজাধিরাজ শ্ৰীমদ বিগ্রহপালদেবের উল্লেখ আছে; এই পাণ্ডুলিপিটি লেখা শেষ হয়েছিল তার রাজত্বের ২৬তম বৎসরে। কেউ কেউ বলেছেন, এই রাজ্যাঙ্ক-তারিখগুলি (দ্বিতীয়) বিগ্রহপালের হতে পারে, (তৃতীয়) বিগ্রহপালের হতেও কোনও বাধা নেই। এবং এ-দুজনের একজন অন্তত ২৬ বৎসর রাজত্ব করেছিলেন। আমার ব্যক্তিগত ধারণা, এই ২৬ বৎসরের রাজত্বকাল (তৃতীয়) বিগ্রহপালের, (দ্বিতীয়) বিগ্রহপালের নয়। কেন, তা বলছি।

(প্রথম) মহীপালের বাণগড় শাসনে বলা হয়েছে, তার পিতৃরাজ্য বিলুপ্ত হয়েছিল অনধিকারীদের (কম্বোজ।=কোচদের?) হাতে; তিনি তার পুনরুদ্ধার করেছিলেন। এই বিলুপ্তি ঘটেছিল (দ্বিতীয়) বিগ্রহপালের রাজত্ব কালে। সেই বিগ্রহপাল তার ১৯ রােজ্যাঙ্ক বৎসরে নিজেকে পরমভট্টারক মহারাজাধিরাজ বলে বর্ণনা করেছেন, এমন করা একটু অস্বাভাবিক। তঁর রাজত্বকালে পাল-রাজ্যে বড় দুর্যোগ; সেই দুর্যোগের মধ্যে তিনি বেশিদিন রাজত্ব করতে পেরেছিলেন মনে হয় না। অন্যদিকে, যদি ধরা যায়, নালন্দা মৃৎফলক-লিপি এবং তিনটি কুর্কিহার প্রতিমালিপি, সব ক’টিই (তৃতীয়) বিগ্রহপালের তাহলে এই রাজার রাজ-জীবনে একটি সঙ্গতি ও ধারাবাহিকতা পাওয়া যায়। প্রথম কুর্কিতার প্রতিমালিপিটিতে রােজ্যাঙ্ক তারিখ ৩ (বা ২); এই লিপিতে বিগ্রহপালের পরিচয় শুধু ‘শ্ৰীমন’ বলে; ৮ রােজ্যাঙ্কের নালন্দা মৃৎফলক লিপিটিতে সে-পরিচয় বিবর্তিত হয়েছে ‘শ্ৰীমন মহারাজ’এ এবং ১৯ রােজ্যাঙ্কের কুর্কিহার প্রতিমালিপি-দুটিতে একেবারে ‘শ্ৰীমন বিগ্রহপালদেব রাজাধিরাজ পরমভট্টারক’ রূপে। (দ্বিতীয়) বিগ্রহপালের দুর্যোগময় রাজত্বকালে এ ধরনের ক্রমবিবর্তন অনুমান করা কঠিন, বিশেষ করে যখন তারই রাজত্বকালে রাজ্যের বৃহৎ একটি অংশ ছেড়ে দিতে হয়েছিল শত্রুর হাতে। কিন্তু, (তৃতীয়) বিগ্রহপোলই দীর্ঘতর। কাল, অর্থাৎ, অস্তুত ২৬ বৎসর রাজত্ব করেছিলেন, এ-অনুমানের বড় কারণ কুর্কিহারের মুকুট-শোভিত বুদ্ধদেবের প্রতিমা তিনটির শিল্পশৈলী ও প্রতিমালক্ষণ। এ-তথ্য সুবিদিত যে, মুকুট-পরিহিত বুদ্ধের প্রতিমালক্ষণ প্রতিষ্ঠিত হ’য়েছিল গন্ধারে, তবে খ্ৰীষ্টীয় দ্বিতীয়-তৃতীয় শতকের আগে নয়। গন্ধার থেকে এই বিশিষ্ট প্রতিমা শৈলীটি কাশ্মীরে প্রসারিত হয়েছিল, মনে হয়, ষষ্ঠ-সপ্তম শতকে। তারপরে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে কুর্কিহারের এই মূর্তি তিনটিতে। আর, পাওয়া যাচ্ছে বর্মাদেশে, পগানের আনন্দমন্দিরে ও অন্যত্র, যেখানে প্রতিমাটির পরিচয় জম্বুপতি নামে। পাগান-প্রতিমাগুলির সুস্থির তারিখ মোটামুটি একাদশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধ (১০৫০-১১০০)। এই প্রতিমাগুলির সঙ্গে কুর্কিহারের প্রতিমাগুলির শিল্পশৈলী ও প্রতিমালক্ষণ-সাদৃশ্য এত ঘনিষ্ঠ যে, কুর্কিহারের প্রতিমাগুলি একাদশ শতকের প্রথমার্ধের আগে কিছুতেই হতে পারে না। সুতরাং এই প্রতিমালিপি তিনটির বিগ্রহপাল (তৃতীয়) বিগ্রহপাল হওয়াই বেশি সঙ্গত।

(দ্বিতীয়) বিগ্রহপাল কতকাল রাজত্ব করেছিলেন তার ইঙ্গিত কোথাও পাওয়া যাচ্ছেনা। মনে হয়, দশম শতাব্দীর দুর্যোগময়ী সন্ধ্যায় বেশিদিন তার রাজত্ব করা সম্ভব হয়নি।

(দ্বিতীয়) বিগ্রহপালের মৃত্যুর পর রাজা হয়েছিলেন (প্রথম) মহীপাল; তিনি অন্তত ৪৮ বৎসর রাজত্ব করেছিলেন। তঁর রাজত্বকালের মধ্যে একটি স্থিরনির্দিষ্ট তারিখকে স্থান দিতেই হয়। সারনাথে প্রাপ্ত একটি প্রতিমালিপিতে বলা হয়েছে, (প্রথম) মহীপালের আদেশে সেখানে কিছু কিছু নূতন মন্দিরাদি নির্মাণ ও কিছু পুরাতন মন্দিরাদির সংস্কার-ক্রিয়ার ভার দেওয়া হয়েছিল তার দুই ভাই স্থিরপাল ও বসন্তপালের উপর। লিপিটির তারিখ ১০৮৩ বিক্ৰমান্দ-খ্ৰীষ্টােব্দ ১০২৬। সুতরাং এই তারিখটি বহু অনিশ্চয়তার মধ্যে একটি স্থিরনিশ্চিত চিহ্ন। মহীপালের পর পাল-সিংহাসন আরোহণ করেন রাজা নয়পাল, নয়পাল অন্তত ১৫ বৎসর রাজত্ব করেছিলেন। তার রাজত্বকালেরও মোটামুটি একটি স্থিরবিন্দু আছে: কলচুরী-রাজ কর্ণের সঙ্গে তার একটি সংঘর্ষ হয়েছিল। কৰ্ণ খ্ৰীষ্টীয় ১০৪১-এ সিংহাসন আরোহণ করেছিলেন; সুতরাং এই তারিখটিকে নয়পালের ১৫ বছর রাজত্বকালের মধ্যে স্থান দিতে হয়।

নয়পালের উত্তরাধিকারী (তৃতীয়) বিগ্রহপাল অন্তত ২৬ বৎসর রাজত্ব করেছিলেন, সে-কথা আগেই বলা হয়েছে।

(তৃতীয়) বিগ্রহপালের পরে পর পর রাজা হয়েছিলেন (দ্বিতীয়) মহীপাল ও (দ্বিতীয়) শূরপাল। এদের রাজত্বকাল সম্বন্ধে আমাদের কিছুই জানা নেই; তবে দু-জনের কেউই বোধ হয় খুব সংক্ষিপ্তকালের বেশি রাজত্ব করতে পারেন নি।

(দ্বিতীয়) শূরপালের উত্তরাধিকারী রামপাল অন্তত ৫৩ বৎসর রাজত্ব করেছিলেন। দিল্লীর ন্যাশনাল মুজিয়ুমে বৌদ্ধ পঞ্চরক্ষা-গ্রন্থের একটি পাণ্ডুলিপি আছে; পাণ্ডুলিপিটি লেখা শেষ হয়েছিল রামপালের রােজ্যাঙ্ক ৫৩ বৎসরে। রামপালের পরে পর পর রাজা হয়েছিলেন কুমারপাল এবং (তৃতীয়) গোপাল। কুমারপালের রাজত্বের কাল সম্বন্ধে কিছুই জানা যায়না; অনুমান করা চলে মাত্র। (তৃতীয়) গোপাল অন্তত ১৪ বৎসর রাজত্ব করেছিলেন।

(তৃতীয়) গোপালের পর রাজা হয়েছিলেন মদনপাল। তিনি অন্তত ১৮ বৎসর রাজত্ব করেছিলেন। তার রাজত্বকালের দুটি স্থির নির্দিষ্ট তারিখ জানা যায়। বলগুন্দর প্রতিমালিপিটিতে “তার রাজ্যাঙ্ক তারিখ দেওয়া আছে ১৮, আর বৎসরটি উল্লেখ করা হয়েছে শকাব্দ ১০৮৩ বলে, অর্থাৎ মদনপালের ১৮ তম রাজ্যাঙ্ক হচ্ছে খ্ৰীষ্টােব্দ ১১৪৩। এই রাজারই নানগড় প্রতিমালিপিটির তারিখ হচ্ছে বিক্ৰমাব্দ-এর ১২:০১, অর্থাৎ খ্ৰীষ্টােব্দ ১১৪২-৪৩। সুতরাং মদনপালের রাজত্বকাল খ্ৰীষ্টােব্দ ১১৪৮-এ অবসিত হয়েছিল, এমন অনুমানে বাধা নেই। মদনপালের পর গোবিন্দপাল রাজা হয়েছিলেন। এই রাজার গয়া-শিলালেখতে তারিখ দেওয়া আছে বিক্রমাব্দ ১২:৩২ —শ্ৰীষ্টােব্দ ১১৭৪ ৷৷ গোবিন্দপাল অন্তত এই তারিখটি পর্যন্ত রাজত্ব করেছিলেন, সন্দেহ নেই।

তালিকা।গত করলে পাল-রাজাদের রাজত্বের তারিখগুলি এই রকম দাঁড়ায়।

রাজার নাম রাজত্বকাল মোটামুটি তারিখ (খ্ৰীষ্টাব্দে )
গোপাল ২৫ ৭৫০-৭৫
ধর্মপাল ৩৫ ৭৭৫-৮১০
দেবপাল ৩৭ ৮১০-৪৭
প্রথম শূরপাল ১২ ৮৪৭-৬০
প্রথম বিগ্রহপাল অজ্ঞাত ৮৬০-৬১
নারায়ণপাল ৫৫ ৮৬১-৯১৭
রাজ্যপাল ৩৫ ৯১৭-৫২
দ্বিতীয় গোপাল ২০ ৯৫২-৭২
দ্বিতীয় বিগ্রহপাল ৯৭২-৭৭
প্রথম মহীপাল ৪৮ ৯৭৭-১০২৭
নয়পাল ১৫ ১০২৭-৪৩
তৃতীয় বিগ্রহপাল ২৬ ১০৪৩-৭০
দ্বিতীয় মহীপাল অজ্ঞাত ১০৭০-৭১
দ্বিতীয় শূরপাল বা সুরপাল অজ্ঞাত ১০৭১-৭২
রামপাল ৫৩ ১০৭২-১১২৬
কুমারপাল অজ্ঞাত ১১২৬-৪৩
তৃতীয় গোপাল ১৫ ১১২৮-৪৩
মদনপাল ১৮ ১১৪৩-৬১
গোবিন্দপাল ৪(?) ১১৬১-৬৫