০৮. সেনায়ন

সেনায়ন

বাঙলার সেন-রাজবংশ “দাক্ষিণাত্য-ক্ষৌণীন্দ্র” এবং ব্ৰহ্মক্ষত্ৰিয়; “কর্ণাট-ক্ষত্ৰিয়” বলিয়াও তাহারা আত্মপরিচয় দিয়াছেন। ইহাদের পূর্বপুরুষ বীরসেনকে চন্দ্ৰবংশীয় এবং পুরাণ-কীর্তিত বলিয়া দাবি করা হইয়াছে। বিজয়সেনের পিতামহ সামন্তসেন দাক্ষিণাত্যে কর্ণাট-লক্ষ্মীর লুণ্ঠনকারীদের হত্যা করিয়াছিলেন বলিয়া একটি উক্তিও সেন-লিপিতে দেখা যায়। ইহার প্লর সেন-রাজাদের পূর্বপুরুষ যে দাক্ষিণাত্যের কর্ণাটদেশ হইতে আসিয়াছিলেন, এ-সম্বন্ধে আর কোনও সন্দেহ করা চলে না। কর্ণাটাগত চন্দ্ৰবংশীয় কোনও সেনা-পরিবার রাঢ়া ভূমিতে আসিয়া বসতি স্থাপন করিয়াছিলেন। সেই পরিবারে সামন্তসেনের জন্ম হয়। সামন্তসেনের বাল্য এবং যৌবন বোধ হয় কাটিয়াছিল কর্ণাটে; দক্ষিণাতো যুদ্ধবিগ্রহে লিপ্ত হইয়া কিছু সুখ্যাতিও তিনি অর্জন করিয়া থাকিবেন; পরে বৃদ্ধ বয়সে রাঢ়দেশে আসিয়া বানপ্ৰস্থ অবলম্বন করিয়া গঙ্গাতীরে আশ্রমবাসে দিন কাটাইয়াছিলেন।

ব্ৰহ্ম-ক্ষত্রি বা ব্ৰহ্মক্ষত্রিয় সেন-পরিবারের পূর্বপুরুষেরা আগে ব্ৰাহ্মণ ছিলেন, পরে ব্রাহ্মণদের আচার-সংস্কার এবং জীবিকা পরিত্যাগ করিয়া ক্ষত্ৰিয়বৃত্তি গ্রহণ করেন। সামন্তসেন নিজে ব্ৰহ্মবাদী ছিলেন, তাহা ছাড়া সেন-রাজারা যে একসময় বৈদিক—যাগ-যজ্ঞকারী ব্ৰাহ্মণ ছিলেন তাহার কিছু আভাসও সেন-লিপিতে আছে। ভারতবর্ষের অন্যত্রও ৪/৫টি ব্ৰহ্মক্ষত্ৰিয় রাজবংশের খবর জানা যায়।

বংশপরিচয় ॥ অভূত্যুদয় ৷ পিতৃভূমি

এই ব্ৰহ্মক্ষত্রিয়, ক্ষত্ৰিয় বা কর্ণাট-ক্ষত্ৰিয় সেনা-পরিবার কী করিয়া কখন বাঙলা দেশে আসিয়াছিলেন, তাহা নিশ্চয় করিয়া বলা কঠিন। পালরাজাদের সৈন্যদলে (এবং বোধ হয়। আমলাতন্ত্রেও) অনেক ভিনাপ্রদেশি—খস-মালব-কুণ-কলিক-কর্ণাট-লাট-লোক নিযুক্ত হইতেন; কৰ্ণাটীরাও তাহা হইতে বাদ পড়েন নাই। কোনও সেনবংশীয় কর্ণাটী রাজকর্মচারী হয়তো ক্ৰমে ক্ষমতাশালী হইয়া উঠিয়া আপন সামন্তত্ব প্রতিষ্ঠা করিয়া থাকিবেন, এবং পরে পালবংশের দুর্বলতার সুযোগ লইয়া নিজ আধিপত্য বিস্তার করিয়া থাকিবেন। অথবা, দক্ষিণাগত কোনও সমারাভিযানের সঙ্গেও এই কর্ণাটী সেনা-পরিবারের বাঙলা দেশে আসা বিচিত্র নয়। কর্ণাটী চালুক্যরাজ যষ্ঠ্য বিক্ৰমাদিত্য একবার উত্তর-ভারতে সমরাভিযানে আসিয়াছিলেন, এবং অঙ্গ, বঙ্গ, কলিঙ্গ, গৌড়, মগধ, নেপাল প্রভৃতি দেশ জয় করিয়াছিলেন (১১২১, ১১২৪)। তঁহারই এক সামন্ত আর একবার কলিঙ্গ, বঙ্গ, গুর্জর, মালব প্রভৃতি দেশ জয় করিয়াছিলেন। (১১২২-২৩)। কর্ণাটী চালুক্যবংশের রাজা তৃতীয় সোমেশ্বর (১১২৭-৩৮) ও তাঁহার পুত্র সোম বঙ্গ, কলিঙ্গ, মগধ, নেপাল, অন্ধ, গৌড় ও দ্রাবিড় দেশে বিজয়ী সমারাভিযানের দাবি করিয়াছেন। বস্তুত, এই বংশের রাজা প্রথম সোমেশ্বর কর্তৃক পরমাররাজ প্রথম ভোজ এবং কলচুরীরাজ কর্ণের পরাজয়ের পর হইতেই উত্তর-ভারতে কর্ণাটী প্রতাপ-প্রবাহের দ্বার উন্মুক্ত হয়। এই সব বিচিত্র কর্ণাটী সমরপ্রবাহের সঙ্গেই কর্ণাটী সেনবিংশ বাঙলায় আসিয়া থাকিবেন। বস্তুত, বাঙলাদেশে যখন সামন্ত সেনপুত্ৰ হেমন্তসেন এবং তৎপুত্র বিজয়সেন ধীরে ধীরে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করিতেছেন, তখন মিথিলা ও নেপালে আর একটি কর্ণাটী সেনা-বংশও ধীরে ধীরে মস্তকোত্তালন করিতেছিল; এই বংশই নান্যদেবের বংশ। এই সময়েই কন্যকুব্জ-বারাণসীতে গাহািড়বাল রাজবংশও নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করিতেছিলেন; ইহারাও কর্ণাটাগত বলিয়া কোনও কোনও ঐতিহাসিক মনে করেন। লক্ষ করা প্রয়োজন, এই প্রত্যেকটি রাজবংশই গোড়া পৌরাণিক ব্ৰাহ্মণ্যধর্ম, সংস্কার এবং সংস্কৃতি আশ্রয়ী।

সামন্তসেনের পুত্ৰ হেমন্তসেন দ্বিতীয় মহীপালের রাজত্বকালে সামন্ত-চক্রের বিদ্রোহের এবং ভ্ৰাতৃবিরোধের সুযোগ লইয়া রাঢ়দেশ অঞ্চলে কিছু স্থানীয় সামন্তাধিপত্যের প্রতিষ্ঠা করিয়া থাকিবেন। তাহার সম্বন্ধে আর কিছুই জানা যায় না, তবে তাহার পুত্র-পৌত্রদের লিপিতে তিনি মহারাজাধিরাজ, আখ্যায় ভূষিত হইয়াছেন।

বিজয়সেন ॥ আঃ ১০৯৬-১১৫৯ ৷৷

হেমন্তসেনের পুত্র বিজয়সেন (আ. ১০৯৬-১১৫৯) শূর-পরিবারের কন্যা বিলাসদেবীকে বিবাহ করিয়াছিলেন। রাজেন্দ্রচোলের পূর্বভারতে সমরাভিযানের সময় এক রণশ্বর দক্ষিণ রাঢ়ের রাজা ছিলেন; আর এক শুর-নিরপতি লক্ষ্মীশূরের খবর পাওয়া যায় রামচরিতে; তিনি অপর-মন্দারের (হুগলী জেলার পশ্চিমাঞ্চল) সামন্ত নৃপতি ছিলেন এবং ভীমের বিরুদ্ধে যুদ্ধে রামপালকে সাহায্য করিয়াছিলেন। আর এক শূররাজ আদিশূর বাঙলার লোকস্মৃতিতে আজও বঁচিয়া আছেন; কুলজী-গ্রন্থের মতে আদিশূরের নাম বাংলার কৌলীন্যপ্রথার সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত। শুর-পরিবারে এই বিবাহ রাঢ়দেশে বিজয়সেনের প্রভাব বিস্তারে সহায়তা করিয়া থাকিবে। কিন্তু তিনি কী করিয়া রাঢ়দেশের অন্যান্য সামন্তদের জয় করিয়াছিলেন, কী করিয়া বর্মণদের পরাজিত করিয়া পূর্ববঙ্গে আধিপত্য বিস্তার করিয়াছিলেন এবং পাল-বংশের প্রভুত্ব হইতে উত্তরবঙ্গ কড়িয়া লইয়াছিলেন, তাহা নিশ্চয় করিয়া বলা কঠিন। দেওপাড়া-লিপিতে তাহার হস্তে গৌড়, কামরূপ এবং কলিঙ্গরাজ এবং বীর, নান্য, রাঘব এবং বর্ধন নামে কয়েকজন সামন্ত-নিরপতির পরাজয়ের দাবি করা হইয়াছে। বর্ধন রামচরিতোক্ত কৌশাম্বীর (বগুড়া বা রাজশাহী জেলায়)। নরপতি দ্বোরপবর্ধন; বীর কোটাটবীর নরপতি বীরগুণ হওয়া অসম্ভব নয়। ইহারা দুইজনই ছিলেন বরেন্দ্রীযুদ্ধে রামপালের সহায়ক। রাঘব সম্ভবত কলিঙ্গ নরপতি অনন্তবর্মণ চোড়গঙ্গের (১১৫৬-১১৭০) দ্বিতীয় পুত্র। নান্য মিথিলার কর্ণাট-বংশীয় সেনা-রাজ নান্যদেব বলিয়াই মনে হয়। আর যে গৌড়পতিকে বিজয়সেন পরাজয়ের দাবি করিয়াছেন, তিনি মদনপাল হওয়াই সম্ভব। গৌড়-জয় অর্থ বরেন্দ্রী-জয়, কারণ গৌড়েশ্বর পাল-রাজাদের আধিপত্য মদনপালের সময়ে বাঙলাদেশে বরেন্দ্রীর বাহিরে আর কোথাও ছিল না। বিজয়সেন প্ৰদ্যুমেশ্বরের একটি মন্দির নির্মাণ করিয়াছিলেন, রাজশাহী শহরের ৭}৮ মাইল পশ্চিমে পদুমসহর দীঘির পাড়ে এই মন্দিরের বিস্তৃত ধ্বংসাবশেষ এখনও ইতস্তত বিক্ষিপ্ত। লক্ষ্মণসেনের আগে গৌড়বিজয় বিজয়সেন বা তৎপুত্র বল্লালের ভাগ্যে সম্ভব হইয়াছিল বলিয়া মনে হয় না; কারণ ইহাদের নিজেদের লিপিতে ইহারা গৌড়েশ্বর উপাধি দাবি করেন নাই। লক্ষ্মণসেনই সৰ্ব্বপ্রথম এই উপাধি-অলংকার ধারণা করিয়াছেন, এবং তাহাও তোহার রাজত্বের শেষ দিকে। বিজয়সেন বর্মণবংশীয় রাজাদের হাত হইতে (পূর্ব)-বঙ্গও কাড়িয়া লইয়াছিলেন; রাজকীয় লিপিই তাহার অকাট্য সাক্ষ্য। বস্তুত, সেনা-বংশের গোড়াকার দিকে সমস্ত লিপিরই উৎস “বঙ্গে বিক্রমপুরভাগে”; এই বিক্রমপুর জয়স্কন্ধাবারেই বিজয়সেন-মহিষী মহাযজ্ঞ তুলাপুরুষ মহাদান অনুষ্ঠান করেন। বিজয়সেনের কলিঙ্গ ও কামরূপ-জয়ের প্রকৃতি নির্ধারণ কঠিন। তাহার পৌত্র লক্ষ্মণসেনও এই দুই দেশে বিজয়ী সমারাভিযান প্রেরণের দাবি করিয়াছেন।

সেনরাজবংশ-কথার সামাজিক অর্থ

যাহাই হউক, সুদীর্ঘকাল রাজত্ব এবং রামপাল-পরবর্তী বাঙলাদেশের রাষ্ট্ৰীয় ভগ্নদশার সুযোগ ‘লইয়া পরমেশ্বর পরমভট্টারক মহারাজাধিরাজ বিজয়সেনই বাঙলায় সেন বংশের অধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত করেন। পরস্পর ঈৰ্ষাপরায়ণ ও বিবদমান সামন্ত নরপতিদের অন্ধ রাষ্ট্রবুদ্ধিতে আচ্ছন্ন ও ক্লিষ্ট বাঙলাদেশ পরাক্রান্ত রাজবংশ ও রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠায় শান্তি ও স্বস্তি লাভ করিল বটে; কিন্তু একথা স্মরণ রাখা প্রয়োজন যে, এই রাষ্ট্র ও রাজবংশ বাঙলার ও বাঙালীর নয়। কবি উমাপতিধর কিংবা শ্ৰীহৰ্ষ বিজয়সেনের, কিংবা পরবর্তী সভাকবিরা সেন রাজাদের স্তুতি ও চাটুবাদে যতই উচ্ছসিত হইয়া থাকুন না কেন—রাষ্ট্র বা রাজপ্ৰসাদপুষ্ট কবিরা তো তাহা হইয়াই থাকেন—সমসাময়িক বাঙালী জনসাধারণ এই রাজবংশকে আপনার জন বলিয়া মনে করিয়াছিল, এমন কোনও প্রমাণ বা ইঙ্গিত কোথাও পাওয়া যায় না। গোপাল বাঙালী ছিলেন, পালবংশের পিতৃভূমি বাঙলাদেশ; সেই হিসাবে পাল-রাজারা যতটা বাঙালী জনসাধারণের হৃদয়ের নিকটবর্তী ছিলেন, সেন-রাজারা তাহা হইতে পারেন নাই। তারনাথের আমলে যে-ভাবে গোপাল-নির্বাচনের কাহিনী লোকস্মৃতিতে বিধৃত ছিল, ধর্মপালের যশ যেভাবে দোকানে-চত্বরে জনসাধারণের কণ্ঠে গীত হইত, মহীপালী-যোগীপাল-ভোগী।পালের গানের স্মৃতি যে-ভাবে বাঙালী জনসাধারণ আজও ধারণ করে, বহুদিন পর্যন্ত লোকে যে-ভাবে “ধান ভানতে মহীপালের গীত’ গাহিত, বল্লালসেন ছাড়া সেন-রাজাদের কাহারও সে-সৌভাগ্য হয় নাই। এই তথ্যের ঐতিহাসিক ইঙ্গিত অবহেলার জিনিস নয়। সেনরাজাদের মহিমা যাহা যতটুকু গীত হইয়াছে তাহা সভাকবিদের কণ্ঠে, যেটুকু তীহাদের স্মৃতি আজও জাগরূক, তাহা ব্ৰাহ্মণ্যস্মৃতিশাসিত সমাজের উচ্চতর শ্রেণীগুলিতে মাত্র। এ-তথ্যও ঐতিহাসিকদের বিচারের বস্তু। গোপাল বা ধর্মপাল-দেবপাল-মহীপালের সঙ্গে বিজয়-বল্লাল-লক্ষ্মণের তুলনা নিরর্থক এবং অনৈতিহাসিক। পালবংশকে বাঙালী ভালবাসিয়াছিল, এবং তাহদের গৌরবকে নিজেদের জাতীয় গৌরব বলিয়া মানিয়া লইয়াছিল; বাঙলাদেশে তাহার প্রমাণ ইতস্তত বিক্ষিপ্ত। বল্লাল ব্যতীত সেনা-রাজাদের একজনের সম্বন্ধেও একথা বলা চলে কি না সন্দেহ। একটি লোকগীতিও সেনা-রাজাদের কাহারও নামে রচিত হয় নাই; বাঙলা সাহিত্যে লোকস্মৃতিতে সেন-রাজারা বাঁচিয়া নাই।

 

বল্লালসেন ।। আঃ ১১৫৯-৭৯

বিজয়সেনের পুত্ৰ বল্লালসেন (আ. ১১৫৯-৭৯) একবার গৌড় আক্রমণ ও জয় করিয়াছিলেন, বোধহয় গোবিন্দপালের আমলে। বল্লালের অদ্ভুতসাগর গ্রন্থে এই গৌড়-বিজয়ের একটু ইঙ্গিত আছে। বল্লাল-চরিত গ্রন্থে তাহার মগধ ও মিথিলায় বিজয়ী সমারাভিযানের ইঙ্গিত পাওয়া যায়; কিন্তু এই দুই শতক পরবর্তী গ্রন্থের সাক্ষ্য কতখানি প্রামাণিক বলা কঠিন। তবে, মিথিলা অধিকার একেবারে অমূলক না-ও হইতে পারে। যদি তাহা না হয়, তাহা হইলে বল্লালের সময় বঙ্গ, রাঢ়, বরেন্দ্রী এবং মিথিলা সেনরাজ্যভুক্ত ছিল; আর একটি ছিল বাগড়ী (সুন্দরবন-মেদিনীপুর অঞ্চল)। বল্লাল কর্ণাট-চালুক্যরাজ দ্বিতীয় জগদেকমল্লের কন্যা রামদেবীকে বিবাহ করিয়াছিলেন। অদ্ভুতসাগর-গ্রন্থ সমাপনের (আরম্ভ শকাব্দ। ১০৯০) আগেই বল্লালসেন পুত্ৰ লক্ষ্মণসেনের স্কন্ধে রাজ্যভার এবং গ্রন্থ-সমাপনাভার অর্পণ করিয়া সপত্নীক গঙ্গা-যমুনা সঙ্গমে (ত্রিবেণীতে?) নিরঞ্জরপরে গমন করেন। ইহার অর্থ হয়তো তিনি সপত্নীক গঙ্গা-যমুনা সঙ্গমে নিরঞ্জরপুর নামক স্থানে বানপ্রস্থে গিয়াছিলেন, অথবা গঙ্গা-যমুনা সঙ্গমে দুইজনেই জলে ঝাঁপ দিয়া স্বৰ্গারোহণ করিয়াছিলেন।

লক্ষ্মণসেন ৷ আঃ ১১৭৯-১২০৬ ৷৷

লক্ষ্মণসেন যখন সেন-সিংহাসনে আরোহণ করিলেন তখন তিনি প্রায় ষাট বৎসরের পরিণত প্রৌঢ়। পিতামহ বিজয়সেনের আমলেই গৌড়-কলিঙ্গ-কামরূপের রণক্ষেত্রে তিনি শৌর্য-বীৰ্য প্রকাশ করিয়াছিলেন বলিয়া অনুমিত হয়; তাহার রাজত্বকালে এই তিনটি দেশুই যে সেন-রাজ্যভুক্ত হয়, এসম্বন্ধে নিঃসংশয় লিপিপ্রমাণ বিদ্যমান। তাহার পুত্রদের লিপিতে বলা হইয়াছে লক্ষ্মণসেন পুরী, বারাণসী ও প্রয়াগে বিজয়স্তম্ভ প্রোথিত করিয়াছিলেন। পুৱী-জয়ের ইঙ্গিত বোধ হয় কলিঙ্গ-জয়ের মধ্যেই পাইতেছি। কাশী-জ্বয়ের সুস্পষ্ট উল্লেখ লক্ষ্মণসেনের নিজের লিপিতেই আছে। পশ্চিমে তাঁহার রাজত্ব প্রয়াগ পর্যন্ত বিস্তৃত হইয়াছিল বলে মনে হইতেছে। শেষ পালরাজ গোবিন্দপালের পর মগধাঞ্চল গাহড়বাল রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হইয়া গিয়াছিল; বিজয়সেন এই অঞ্চল সেন-রাজ্যভুক্ত করিবার চেষ্টা করিয়াছিলেন, কিন্তু সে-চেষ্টা খুব সার্থক হয় নাই। ১১৯২ খ্ৰীষ্টাব্দেও বুদ্ধগয়া অঞ্চল গাহড়বালদের অধিকারে ছিল বলিয়া লিপি প্রমাণ বিদ্যমান। কাশীও গাহড়বালদের অধীনেই ছিল, এবং যে কাশীরাজকে লক্ষ্মণসেন। পরাজয়ের দাবি করিয়াছেন তিনি নিশ্চয়ই গাহড়বাল-রাজ জয়চন্দ্র। লক্ষ্মণসেন প্ৰয়াগ পর্যন্ত দেশ গাহািড়বালদের কারচু্যত করিয়াছিলেন। কিনা বলা কঠিন; তবে মুসলমান-বিজয় পর্যন্ত গয়া অঞ্চল যে লক্ষ্মণসেনের আধিপত্যের অন্তর্গত ছিল অশোকচল্লের দুইটি লিপিই তাহার প্রমাণ। বারাণসী-প্ৰয়াগেও হয়তো একবার তিনি বিজয়ী সমারাভিযান করিয়া থাকিবেন। লক্ষ্মণসেনের মগধাধিকার এবং প্রয়াগ পর্যন্ত সমরাভিযান গাহড়বালশক্তিকে দুর্বল করিয়াছিল, সন্দেহ নাই। এই রাজ্যই ছিল ক্ৰমাগ্রসরমান মুসলমানদের বিরুদ্ধে শেষ প্রতিরোধ-প্রাচীর; সেই প্রাচীরকে দুর্বল করিয়া লক্ষ্মণসেন রাষ্ট্র ও সমরবুদ্ধির কতটুকু পরিচয় দিয়াছিলেন, এ-সম্বন্ধে ঐতিহাসিকদের প্রশ্ন অনিবার্য। এ-তথ্য সুবিদিত যে, মুহম্মদ ব্যক্তিয়ার খিলজি প্রায় বিনা বাধায় সমস্ত বিহার ও বাঙলা জয় করিয়াছিলেন; গাহড়বাল রাজশক্তির প্রতিরোধ-প্রাচীর ভাঙিয়া পড়ার পর আর কোনও বাধাই তাহার সন্মুখে উত্তোলিত হয় নাই। যে অস্ত্র ও সৈন্যবল কামরূপ-কাশী-কলিঙ্গ জয় করিয়াছিল। সেই অস্ত্র ও সৈন্যবল কোথায় আত্মগোপন করিয়াছিল? যাহা হউক, লক্ষ্মণসেন যে-রাজ্য ও রাষ্ট্র গড়িয়া তুলিয়াছিলেন, সেই রাজ্য ও রাষ্ট্র ভিতর হইতে আপনি দুর্বল ও ক্ষীণ হইয়া পড়িতে আরম্ভ করিল। স্থানীয় আত্ম-কর্তৃত্বের যে-ব্যাধি পাল-রাষ্ট্রকে ভিতর হইতে দুর্বল করিয়া দিয়াছিল, সেন-রাষ্ট্রের ক্ষেত্রেও তাহার ব্যতিক্রম হয় নাই। এই ব্যাধিরই এক রাষ্ট্ৰীয় রূপ সামন্ততন্ত্র।

শ্ৰীডোন্মানপাল ॥। রণবঙ্কমল্ল হরিকালদেব

সুন্দরবন অঞ্চলে (পূর্ব-খাটিকা) এক পরমমহেশ্বর মহামাণ্ডলিকের পুত্ৰ মহারাজাধিরাজ শ্ৰীডোমনপাল প্রধান হইয়া উঠিয়া স্বাধীন রাজ্যখণ্ড প্রতিষ্ঠা করিলেন (১১৯৬)।

এই সময়ই বোধ হয় অথবা অব্যবহিত পরই ত্রিপুরা অঞ্চলে পট্টিকের-রাজ্য আবার কতকটা প্রাধান্য লাভ করে, এবং রণবঙ্কমল্ল হরিকালদেব নামে এক নরপতি সেখানে স্বাতন্ত্র ঘোষণা করেন (১২০৪-১২২০)। বর্তমান কুমিল্লা শহরের পাঁচ মাইল পশ্চিমে ময়নামতী পাহাড় অঞ্চলেই ছিল বোধ হয় তাহার রাজধানী। প্রাচীন পট্টিকেরা, ব্ৰহ্মদেশীয় ইতিকথার পটিক্কর-পটেইঙ্কর, আদি ব্রিটিশযুগের পাটিকেরা-পাইটকেরা পরগণা এবং বর্তমান পাইটিকারা-পাটিকেরা এক এবং অভিন্ন।

দেববংশ

মেঘনার পূর্বতীরে আর একটি নূতন স্বাধীন স্বতন্ত্র রাজবংশও এই সময়ই গড়িয়া উঠিল। এই বংশ দেববংশ নামে (দেবাম্বয়গ্রামণী) ইতিহাসে খ্যাতি লাভ করিয়াছে। দ্বাদশ শতকের শেষে বা ত্রয়োদশ শতকের গোড়াতেই পুরুষোত্তমদেবের পুত্ৰ মধুমথন বা মধুসূদনদেব প্রথম স্বাতন্ত্র্য স্বীকার করিয়া রাজা আখ্যা গ্ৰহণ করেন। তাঁহার পুত্র বাসুদেব; বাসুদেবের পুত্র দামেদারদেবই এই বংশের পরাক্রান্ত নরপতি (১২৩১-১২৪৩)। “অরিরাজ-চানুর-মাধব-সকল-ভূপতি চক্রবর্তী”-দামোদর বর্তমান ত্রিপুরা-নোয়াখালি চট্টগ্রামে স্বীয় আধিপত্য বিস্তার করিয়াছিলেন, এ সম্বন্ধে লিপি-প্রমাণ পাওয়া যায়। কিন্তু পরবর্তীকালে এই বংশের আর এক রাজা দশরথদেব তাহার রাজা আরও বিস্তুত করিয়াছিলেন, এবং বিক্রমপুরে রাষ্ট্ৰকেন্দ্র গড়িয়া ঢাকা অঞ্চলও তাহার রাজ্যভুক্ত করিয়াছিলেন। কিন্তু সে কথা পরে বলিতেছি।

গুপ্তবংশ

বাঙলার বাহিরে, গুপ্ত-উপান্তনামা এক গুপ্ত-বংশ মুঙ্গের অঞ্চলে সেনবংশের মহামাণ্ডলিক সামন্ত ছিলেন বলিয়া মনে হয়। ইহাদের রাষ্ট্রকেন্দ্র ছিল মুঙ্গের জেলার লখীসরাইর নিকট জয়নগর (প্রাচীন জয়পুর) নামক স্থানে। এই বংশের রাজা “পরমমাহেশ্বর বৃষভধ্বজ…. পরমেশ্বর” কৃষ্ণগুপ্ত ও তাহার পুত্ৰ সংগ্রামগুপ্ত স্বাতন্ত্র্য ঘোষণা করিয়াছিলেন লক্ষ্মণসেনের রাজত্বকালেই। অনৈক্য ও বৈষম্যমূলক স্থানীয় আত্মকর্তৃত্ব ব্যাধির এই সব দুর্লক্ষণ যখন ধীরে ধীরে রাষ্ট্রকে ভিতর হইতে দুর্বল করিতেছিল, তখন অন্যদিকে পশ্চিম হইতে ক্ৰমাগ্রসরমান মুসলমান রাজশক্তি পূর্বদিকে লুব্ধ বাহু বাড়াইয়া দিতেছিল। কুতব-উদ-দীন তখন দিল্লীর তত্তে আসীন। উত্তর-ভারতের হিন্দুরাষ্ট্ৰশক্তি তখন একে একে সকলই ভাঙিয়া পড়িয়াছে; রাষ্ট্ৰীয় শান্তি ও শৃঙ্খলা বলিতে বিশেষ কিছু নাই। স্থানীয় রাষ্ট্রকর্তৃত্ব ইতস্তত বিক্ষিপ্ত হিন্দু ও তুরুস্ক সামন্তদের করুকবলে, কিন্তু দুধর্ষ পরাক্রান্ত শত্রুকে ঠেকাইয়া রাখিবার শক্তি কাহারও নাই। এই ধরনের বিশৃঙ্খল রাষ্ট্ৰীয় অবস্থায় মুসলমান অভিযাত্রীর রাষ্ট্ৰীয় ও সামরিক প্রতাপকে আশ্রয় করিয়া সেনাপতিদের সামরিক উচ্চাকাঙক্ষা পরিতৃপ্তি খুঁজিয়া বেড়াইবে, ইহা কিছু বিচিত্র নয়।

খ্‌ত্‌-ইয়ারের বঙ্গ-বিহার জয়৷ ১২০১ খ্ৰীষ্টাব্দ

এই উচ্চাকাঙক্ষী ভাগ্যান্বেষীদের মধ্যে তুর্ক জাতীয় যুদ্ধব্যবসায়ী মুহম্মদ বখত্-ইয়ার খিলজী অন্যতম। দিল্লীর তক্ত তাহাকে বিহার ও বাঙলাদেশ জয় করিবার জন্যই আদেশ করে নাই; বখতি-ইয়ার স্বেচ্ছায় তাহার সৈন্যদল লইয়া বিহারে-বাঙলায় ভাগ্যান্বেষণে অগ্রসর হইয়াছিলেন। বখতি-ইয়ার কর্তৃক বিহার-বাঙলা জয়ের কাহিনী লক্ষ্মণসেনের পক্ষ হইতে কেহ লিখিয়া রাখে। নাই। সভাকবি শরণ অবশ্য লক্ষ্মণসেন কর্তৃক একবার এক ম্লেচ্ছরাজের পরাজয়ের কথা ইঙ্গিত করিয়াছেন; হইতে পারে এই ম্লেচ্ছ।রাজ বখত ইয়ার। অথবা এমনও হইতে পারে, বখতি-ইয়ারের বঙ্গবিজয়ের পর লক্ষ্মণসেন যখন বিক্রমপুর অঞ্চলে রাজত্ব করিতেছিলেন তখন লখনৌতি বা লক্ষ্মণাবতীর কোনও সুলতানের সঙ্গে সেন-রাজের সংঘর্ষ হইয়া থাকিতে পারে; কবি শরণ সেনরাজ কর্তৃক সেই যুদ্ধজয়ের ইঙ্গিত করিয়া থাকিবেন। শরণ-রচিত শ্লোকটি উদ্ধার করিতেছি, এই শ্লোকে ম্লেচ্ছবিনাশ ছাড়া লক্ষ্মণসেনের অন্যান্য দেশ জয়ের ইঙ্গিতও আছে।

ভ্ৰক্ষেপাদ গৌড়লক্ষ্মীং জয়তি বিজয়তে কেলিমাত্ৰাৎ কলিঙ্গন
চেতশ্চেদিক্ষিতীন্দোস্তপতি বিতপতে সূর্যবদ দুর্জনেষু।
স্বেচ্ছাম্লেচ্ছন বিনাশং নয়তি বিনয়তে কামরূপাভিমানং
কাশীভর্তুঃ প্রকাশং হরতি বিহরতে মুপ্নি যে মাগধস্য৷।

লক্ষ্মণসেন কর্তৃক গৌড়, কলিঙ্গ, চেদি, কামরূপ, কাশী ও মগধে যুদ্ধজয়ের কথা লক্ষ্মণসেনের লিপি-সাক্ষ্যে এবং অন্যতম সভাকবি উমাপতিধরের বিচ্ছিন্ন দুইটি শ্লোকেও পাওয়া যায়; কাজেই তঁহার ম্লেচ্ছ-বিনাশের কথা অস্বীকার করার কোনও কারণ নাই। ইহারা-শরণ বা –উমাপতিধর-লক্ষ্মণসেনের নাম করিতেছেন না। সত্য, তবে যেহেতু তাহারা লক্ষ্মণসেনের সভাকবি ছিলেন এবং যে-সব বিজয়কীতির উল্লেখ তাহারা করিতেছেন সেগুলি লক্ষ্মণসেনের সঙ্গেই যুক্ত সেই হেতু এ-সম্বন্ধে সন্দেহ প্রকাশের কোনও অবসর নাই। কিন্তু, উমাপতিধর যে শ্লোকে লক্ষ্মণসেনের সঙ্গে ম্লেচ্ছ সংঘর্যের ইঙ্গিত করিয়াছেন, সেই শ্লোকেই তিনি ম্লেচ্ছ রাজার সাধুবাদও করিয়াছেন এবং তাহা প্রায় হাস্যকর স্তুতিবাক্যে!

সাধু ম্লেচ্ছ নরেন্দ্ৰ সাধু ভাবতো মাতৈব বীরপ্রসূর
নীচেনাপি ভবদ্বিধন বসুধা সূক্ষত্ৰিয় বর্ততে।
দেবে কুট্যাতি যস্য বৈরিপরিষন্মারাঙ্কমপ্লে পুরঃ
শস্ত্ৰং শস্ত্ৰমিতি স্মৃফুরন্তি রসনাপত্ৰান্তরালে গিরঃ৷
ম্লেচ্ছরাজা, সাধু, সাধু! আপনার মাতাই (যথার্থ) বীরপ্রসবিনী; নীচ (বংশোদ্ভব) হইলেও আপনার মতো লোকের জন্যই বসুধা এখনও সূক্ষত্ৰিয় আছে; (যেহেতু) মারাঙ্কমল্লদেব (লক্ষ্মণসেন) যখন সন্মুখ (যুদ্ধে) শত্রুসৈন্য ধ্বংস করিতেছিলেন তখন আপনার রসনারূপ পত্রাপ্তরাল হইতে শস্ত্ৰ, শস্ত্ৰ, এই বাক্য নিৰ্গত হইতেছিল।

 

পর পর তিনটি রাজার রাজসভাকবির, বৃদ্ধ না হউন অন্তত প্রৌঢ় উমাপতিধর কি বখতুি-ইয়ার কর্তৃক নবদ্বীপজয়ের পর সেন-রাজসভা পরিত্যাগ করিয়া নিজের ভক্তি ও স্তুতি অর্পণ করিবার পাত্র পরিবর্তন করিয়াছিলেন, এবং ম্লেচ্ছ রাজকেই সেই পাত্ৰ বলিয়া নির্বাচন করিয়াছিলেন!। সভাকবি সভাকবিই থাকিয়া গিয়াছিলেন সন্দেহ নাই, কিন্তু সেন-রাষ্ট্র, সেনা-রাজসভা, সেই সভার অলংকার কবি ও পণ্ডিত, এবং সমসাময়িক কাল ও সমাজের উপর ইহা যে কত বড় কটাক্ষ, উমাপতিধর কি তাহা বুঝিতে পারিয়াছিলেন?

যাহাই হউক, লক্ষ্মণসেনের সঙ্গে ম্লেচ্ছদের (তুরুস্কদের) একটা সংঘর্ষ হইয়াছিল, এবং সে-সংঘর্ষে সেনা-রাজ জয়ী হইয়াছিলেন, এ-সম্বন্ধে সন্দেহ নাই; তবে তাহা নবদ্বীপ জয়ের আগে না। পরে, ঐতিহাসিক গবেষণার বর্তমান অবস্থায় তাহা বলা কঠিন। আমার মনে হয়, নবদ্বীপ জয়ের অব্যবহিত পরে।

নবদ্বীপ-জয় সম্বন্ধে মুসলমান অভিযাত্রীদের পক্ষে এ-বিষয়ে বিস্তৃত সাক্ষ্য উপস্থিত, এবং এই সাক্ষ্য দিতেছেন ঘটনার প্রায় ৫০ বৎসর পর দিল্লীর ভূতপূর্ব প্রধান কাজী মৌলানা মিনহাজ-উদ-দীন তিনি লখনৌতিতে দুই বৎসর কাটাইয়াছিলেন এবং সেখানে দুইটি বৃদ্ধ সুপ্রাচীন সৈন্যর মুখে বখত্-ইয়ারের বিহার-বিজয় কাহিনী এবং অন্যান্য “বিশ্বস্ত” লোকের মুখে বঙ্গ-বিজয় কাহিনী শুনিয়াছিলেন। তিনি এই দুই দেশ বিজয় সম্বন্ধে যাহা লিখিয়া রাখিয়া গিয়াছেন তাহার সংক্ষিপ্ত সারমর্ম জানা প্রয়োজন। বখত্-ইয়ারের আক্রমণের সময় সেনরাজ। লক্ষ্মণসেন (রায় লখমনিয়া) নৃদীয়া (নদীয়া= নবদ্বীপ) রাজধানীতে বাস করিতেছিলেন।

বর্তমান চুনারের ১১ মাইল পূর্বে ভুইলি গ্রাম; এই গ্রামই ছিল বখত্-ইয়ারের জায়গীরের কেন্দ্রভূমি। গাহড়বাল-সামন্তরাজদের পরাভূত করিয়া বখতৃ-ইয়ার মুনের ও বিহার অঞ্চলের নানা জায়গায় লুঠতরাজ আরম্ভ করিয়া দিলেন এবং তাঁহারই লোভে প্রচুর খিলজি ও তুর্কী দস্যুব্রতী তাহার সামন্তুদণ্ডের চারিদিকে ঘিরিয়া দাঁড়াইল। উত্তর-বিহারে মিথিলাকে আশ্রয় করিয়া তখন হিন্দু কর্ণাটক রাজবংশের আধিপত্য; কনৌজের সিংহাসনে তখনও জয়চন্দ্ৰপুত্র হরিশচন্দ্র আসীন; রোহতাস অঞ্চলের হিন্দু মহানায়কেরা তখনও নিজেদের স্বাধীনতা বজায় রাখিয়াছেন; বিহারের শোননদীর তীরবর্তী অঞ্চলে নিবনেরাপত্তনের সামন্তদের আধিপত্য বিদ্যমান। এই সব হিন্দুরাজশক্তিকে উৎখাত করা বা দেশব্যাপী বিরাট চাঞ্চল্য সৃষ্টি করা বখত্-ইয়ারের উদ্দেশ্য ছিল না। কাজেই রাজশক্তি যেখানে শিথিল বা প্রায় অনুপস্থিত,সেই সব স্থান লুণ্ঠন ও অধিকার করাই হইল তাহার উদ্দেশ্য। বৎসর দুই এই ভাবে কাটাইবার পর বখতি-ইয়ার হঠাৎ একদিন হিসার-ই-বিহার বা বিহার-দুর্গ আক্রমণ এবং অধিকার করিয়া বসিলেন এবং তাহার অধিবাসীদের প্রায় সকলকেই হত্যা করিলেন, প্রচুর ধনরত্ন লুটিয়া লইলেন এবং প্রচুর গ্রন্থ পোড়াইলেন (১১৯৯)। বস্তুত, যে দুর্গ-নগরটি তিনি অধিকার করিলেন তাহা দুৰ্গই নয়, এক বিরাট বৌদ্ধ-বিহার, এবং এই বিহারই প্রখ্যাত ঔদণ্ড বা ওদণ্ডপুর বিহার; যে-অধিবাসীদের তিনি হত্যা করিলেন তাঁহারা সকলেই মুণ্ডিতশির বৌদ্ধ ভিক্ষু। এই বিহার হইতেই বর্তমান বিহার জনপদের নামকরণ। এই জনপদে এক সময় বৌদ্ধবিহারও ছিল অনেকগুলি।

ওদণ্ডপুর-বিহার ধ্বংসের প্রায় এক বৎসর পর দ্বিতীয়বার বখত-ইয়ার বিহারে সমারাভিযানে আসেন এবং নিজ অধিকার প্রতিষ্ঠা করিতে চেষ্টা করেন (১২০০ খ্ৰীঃ)। প্ৰসিদ্ধ কাশ্মীরী বৌদ্ধ ভিক্ষু ও আচার্য শাক্যশ্ৰীভদ্র এই সময় মগধে বেড়াইতে আসিয়াছিলেন; তিনি দেখিয়ছিলেন ওদণ্ডপুর ও বিক্রমশীলা বিহার তখন ধ্বংস হইয়া গিয়াছে। তিনি নিজেও তুর্কীদের নিষ্ঠুর অত্যাচারে ভীত সন্ত্রস্ত হইয়া পলাইয়া গিয়াছিলেন জগদ্দলবিহারে।

যাহাই হউক, ইতিমধ্যে বিহার—ধ্বংস ও মগধাধিকারের সংবাদ নদীয়ায় রায় লখমনিয়ার এবং তাহার কর্মচারীদের কর্ণগোচর হয়। রাষ্ট্রের প্রধান প্রধান ব্যক্তি, মন্ত্রীবর্গ এবং জ্যোতিষীরা তখন লক্ষ্মণসেনকে পরামর্শ দিলেন, তুকী অভিযাত্রীকে বাধা দিয়ে কাজ নাই, দেশ পরিত্যাগ করাই যুক্তিযুক্ত, কারণ শাস্ত্ৰে লেখা আছে, এই দেশ তুর্কীদের দ্বারা বিজিত হইবে! খোজ লইয়া জানা গেল, তুকী অভিযাত্রীটির চেহারা একেবারে শাস্ত্রের বর্ণনার সঙ্গে মিলিয়া যাইতেছে! রায় লখমনিয়া মন্ত্রী ও জ্যোতিষীবর্গের পরামর্শ গ্ৰহণ করিলেন না। অধিকাংশ ব্রাহ্মণ ও বণিকেরা পূর্ববঙ্গে, আসামে ও অন্যান্য স্থানে পলাইয়া গেলেন; রায় লখমনিয়া পলাইলেন না। ইহার (মগধজয়ের) পর বৎসরই (১২০১) বখতি-ইয়ার একদল সৈন্য গঠন করিয়া বিহার-সরিফ হইতে গয়া ও ঝাড়খণ্ড জনপদের ভিতর দিয়া নদীয়ার দিকে অগ্রসর হইলেন। তঁহার অধিকাংশ সৈন্য রহিল পশ্চাতে। একদিন বেলা দ্বিপ্রহরে তিনি আঠারোজন অশ্বারোহী সৈন্যমাত্ৰ লইয়া ধীরে ধীরে পথ অতিক্রম করিয়া একেবারে রাজপ্রাসাদের দ্বারে আসিয়া পৌছিলেন; অশ্ববিক্রেতা মনে করিয়া কোথাও কেহ তঁহাকে বাধা দিল না। প্রাসাদের ভিতরে ঢুকিয়াই বখত্-ইয়ার ও তাঁহার সঙ্গীরা তরবারী উন্মুক্ত করিয়া লোকেদের মুণ্ডচ্ছেদ করিতে আরম্ভ করিলেন। তখন দ্বিপ্রহর, রায় লখমনিয়া ভোজনে বসিয়াছেন; এমন সময় প্রাসাদের দরজা এবং নগরের মধ্যস্থল হইতে তুমুল আর্তনাদ ও কোলাহল উত্থিত হইল। ততক্ষণ বখাৰ্ত্ত-ইয়ারের বাকী সৈন্যদলের একটি বৃহৎ অংশ নগরের ভিতরে ঢুকিয়া পড়িয়াছে এবং বোধ হয় নগর অবরুদ্ধও হইয়া গিয়াছে। ব্যাপার যে কি তাহা রায় লখমনিয়া বুঝিবার আগেই বখত্যু-ইয়ার রাজপ্রাসাদে ঢুকিয়া পড়িয়াছেন; অনেক লোক তাঁহার তরবারীর আঘাতে প্রাণও দিয়েছে। উপায়ান্তর না দেখিয়া রায় লখমনিয়া প্রাসাদের পশ্চাৎ দ্বারা দিয়া নগ্নপদে সংকলাট এবং বংগ অভিমুখে পলাইয়া গেলেন। সমস্ত সৈন্যদল আসিয়া যখন নদীয়া এবং তাহার পার্শ্ববর্তী সমস্ত স্থান অধিকার করিল, বখত- ইয়ার তখন সেইখানে (প্রাসাদে?)। শিবির স্থাপন করিলেন। রায় লখমনিয়া (পূর্ব) বঙ্গে আরও কিছুকাল রাজত্ব করিবার পর লোকান্তর গমন করেন। মিনহাজের তত্ত্বকাত্-ই-নাসিরী রচনার কালেও (১২৬০’র পরও) রায় লখমনিয়ার বংশধরেরা (পূর্ব)-বঙ্গে রাজত্ব করিতেছিলেন। রায় লখমনিয়ার প্রাসাদ ও নগর অধিকারের পর বখত ইয়ার কয়েকদিন ধরিয়া নদীয়া বিধ্বস্তু করিয়া গৌড়-লখনৌতিতে ফিরিয়া গিয়া নিজ শাসনকেন্দ্ৰ স্থাপন করিলেন। ইহার পর তিনি মহোবায় গিয়া কুত্ব-উদদীনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। কয়েক বৎসর পর (১২০৬) তিনি তিব্বত-জয়ের জন্য দশহাজার অশ্বারোহী সৈন্য লইয়া এক সমারাভিযানে গিয়াছিলেন; মিনহাজ এই অভিযানের বিবরণও রাখিয়া গিয়াছেন। বখতুি ইয়ার তিব্বত পর্যন্ত অগ্রসরই হইতে পারেন নাই; মধ্যপথেই নানাভাবে লাঞ্ছিত ও পর্যুদস্ত হইয়া তাহাকে ফিরিয়া আসিতে হইয়াছিল। মিনহাজ কথিত তিব্বতাভিযানের একটু পরোক্ষ সমর্থন বোধ হয় পাওয়া যায় কামরূপের একটি লিপিতে। লিপিটি গৌহাটির নিকটে ব্ৰহ্মপুত্রের উত্তর তীরে কানাইবারশীবোয়া নামক স্থানে একটি পাষাণাগাত্রে খোদিত; ইহার পাঠ এইরূপ: “শাকে ১১২৭ (২৭ মার্চ, ১২০৬ আনুমানিক) শাকে তুরগযুগেশে মধুমাস ত্রয়োদশে! কামরূপং সমাগত্য তুরুস্কাঃ ক্ষয়মাযযুঃ৷” আবার, এমনও হইতে পারে তুরুস্কগণ কর্তৃক তিব্বত ও কামরূপাভিযান দুই পৃথক অভিযান।

মিনহাজ-বিবরণের সামাজিক পটভূমি

ইহাই বখত্-ইয়ারের অষ্টাদশ অশ্বারোহী সৈন্য কর্তৃক বিহার, গৌড় ও বরেন্দ্রী বিজয়ের প্রায় ঔপন্যাসিক কাহিনী। প্রথমত, মিনহাজ পঞ্চাশ বৎসর পর যাঁহাদের মুখ হইতে শুনিয়া এই কাহিনী লিপিবদ্ধ করিয়া গিয়াছেন। তঁহাদের স্মৃতিশক্তি এবং বিশ্বস্ততা কতটুকু নির্ভরযোগ্য, বলা কঠিন। দ্বিতীয়ত, বিহার-নগর ধ্বংস করিবার পর এবং দিল্লী হইতে বখত্যু-ইয়ারের ঘুরিয়া আসিয়া সেই দেশ অধিকারের ভিতর লক্ষ্মণসেন সময় যথেষ্ট পাইয়াছিলেন। এই সময়ের মধ্যে কি লক্ষ্মণসেন নিজ রাজ্য রক্ষার কোনও ব্যবস্থাই করেন নাই? মগধ-জয়ের পরও এক বৎসর না। হউক, অন্তত কিছু সময় তো সেন-রাষ্ট্র নিশ্চয়ই পাইয়াছিল; সেই সময়ের মধ্যে কি লক্ষ্মণসেন শত্ৰু প্রতিরোধের কোনও ব্যবস্থাই করেন নাই? যে অস্ত্র ও সৈন্যবল, যে শৌর্য-বীৰ্য কাশী-কলিঙ্গ-কামরূপ জয় করিয়াছিল তাহারা কোথায় আত্মগোপন করিয়াছিল? মগধরাজ্যের পশ্চিম সীমা হইতে আরম্ভ করিয়া নদীয়া পর্যন্ত কোথাও কি লক্ষ্মণসেন নিজের রাজ্য ও রাষ্ট্ররক্ষার জন্য কোনও প্রতিরোধ দান করেন নাই? নদীয়ার রাজপ্রাসাদ রক্ষারও কি কোনও ব্যবস্থাই ছিল না? এ-সব সহজ ও স্বাভাবিক প্রশ্নের কোনও উত্তরই মিনহাজের বিবরণীতে নাই। তৃতীয়ত, মিনহাজ অলৌকিক গালগল্পেও আস্থা স্থাপন করিয়া গিয়াছেন; লক্ষ্মণসেনের জন্মকাহিনীই তাহার প্রমাণ। বিহার-বঙ্গবিজয় কাহিনীতেও এই ধরনের প্রচলিত গালগল্প-কিছু ঢুকিয়া পড়ে নাই, এ কথাই-বা কী করিয়া বলা যাইবে?

মিনহাজ-বিবরণ রচনার এক শতকের মধ্যে ইসমী নামে এক ঐতিহাসিক ফুতুহ-উস-সালাতিন নামক গ্রন্থে নদীয়া অধিকারের আর একটি বিবরণ রাখিয়া গিয়াছেন। মিনহাজ ও ইসমীর বিবরণ দুইটির বঙ্গানুবাদ পাশাপাশি উদ্ধার করা যাইতে পারে।

‘মিনহাজ বলিতেছেন, “ইহার পর (মগধ অধিকারের) দ্বিতীয় বৎসরে বখত্-ইয়ার তাহার সৈন্যগঠন করিয়া বিহার (বিহার-সিরিফ) হইতে যাত্ৰা করিলেন; এবং সহসা নদীয়ায় প্রবেশ করিলেন, এত সহসা এবং দ্রুত যে, তাহার অশ্বারোহীদের ভিতর ১৮ জন ছাড়া আর কেহ তাহার সঙ্গে তাল রাখিতে পারিল না; বাকী সকলে পিছন পিছন অগ্রসর হইতে লাগিল। নগরের দ্বারে পৌছিয়া তিনি কাহারও উপর কোনও অত্যাচার করিলেন না, বরং নীরবে এবং বিনীতভাবে অগ্রসর হইতে লাগিলেন; কেহই সন্দেহও করিতে পারিল না যে, ইনিই বখতি-ইয়ার; বরং সকলেই ভাবিল, এই আগস্তুকেরা বোধহয় ব্যবসায়ী এবং মহার্ঘ অশ্ববিক্রয় উদ্দেশ্যেই ইহাদের আগমন। বখতি-ইয়ার রাজপ্রাসাদের দ্বারে আসিয়াই কোষ হইতে তরবারী উন্মুক্ত করিলেন, এবং বিধর্মীদের হত্যা শুরু করিয়া দিলেন। তখন দ্বিপ্রহর; রায় লখমনিয়া ভোজনে বসিয়াছেন, এমন সময় সহসা রাজপ্রাসাদের দ্বার হইতে এবং নগরের কেন্দ্ৰস্থল হইতে তুমুল আর্তনাদ উথিত হইল। (লক্ষ্মণসেন) ব্যাপার কি বুঝিবার আগেই বখত্-ইয়ার প্রাসাদের ভিতর এবং অন্তঃপুরে ঢুকিয়া পড়িলেন, এবং নরহত্যা আরম্ভ করিয়া দিলেন। রায় তখন নগ্নপদে প্রাসাদের পশ্চাৎ দ্বারা দিয়া পলাইয়া গেলেন। ….’

ইসমীও বলিতেছেন, বখত্-ইয়ার অশ্ববিক্রেতার ছদ্মবেশেই নদীয়ায় প্রবেশ করিয়াছিলেন। নগরে প্রবেশ করিয়া তিনি লক্ষ্মণসেনকে সংবাদ পাঠাইলেন, প্রাসাদের বাহিরে আসিয়া তাহাদের আনীত তাতার-অশ্ব, চীনা বস্ত্ৰসম্ভার এবং অন্যান্য মূল্যবান দ্রব্যাদি পরীক্ষা করিবার জন্য। রায় যখন কারবানে (অশ্বদের বিশ্রামস্থল) আসিয়া দাঁড়াইলেন, তখন বখত্-ইয়ার তাহাকে বহুমূল্য এক উপটৌকন দান করিলেন, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই তঁহার অনুচরদের ইঙ্গিত করিলেন হিন্দুদের উপর ঝাপাইয়া পড়িতে। তুকী সৈন্যরা তৎক্ষণাৎ তাহাই করিল। হিন্দু রক্ষী সৈন্যরা অতর্কিত আক্রমণ ঠেকাইতে না পারিয়া পরাভূত হইল, কিন্তু তাঁহারদের একদল রায় লখমনিয়াকে ঘিরিয়া দাঁড়াইয়া স্থির বিক্রমে আক্রমণ প্রতিহিত করিতে লাগিল এবং তুর্কী সৈন্যদের মনে ত্ৰাস সঞ্চার করিল…। অবশেষে যখন দুর্ধর্ষ খিলজি অশ্বারোহীরা ঝড়ের মতন ছুটিয়া আসিয়া কয়েকজন হিন্দু-সওয়ারকে হত্যা করিল, তখন রায় লখমনিয়া বখত্ব-ইয়ারের হাতে বন্দী হইলেন। উপরোক্ত দুই বিবরণেই এবং সমসাময়িক ইতিহাসে কয়েকটি তথ্য পরিষ্কার। প্রথমত, আক্রমণটা ঘটিয়াছিল। বেলা দ্বিপ্রহরে যখন প্রাতঃসভা শেষ করিয়া সভাসদ, কর্মচারী ও রক্ষী সৈন্যরা সকলেই যে র্যাহার ঘরে ফিরিয়া গিয়া স্নানাহার ও বিশ্রামে রত। দ্বিতীয়ত, ১৯ জন অশ্বারোহী তুকী সেনাকে কেহই আক্রমণকারী বলিয়া মনে করে নাই। অশ্ববিক্রেতা মনে করিয়াই রক্ষীরা তঁহাদের কেহ বাধা দেয় নাই। তৃতীয়ত, সহসা অতর্কিত অবিশ্বস্ত আক্রমণ ঠেকাইবার জন্য কেহ প্ৰস্তুতও ছিল না। চতুর্থত, প্রথম ১৯ জনের (বখত্-ইয়ার ও ১৮ জন তুকী অশ্বারোহী) পক্ষেই প্রাসাদ ও নগরাধিকার সম্ভব হইত না, যদি না পশ্চাতের বৃহত্তর তুকী ও খিলজি অশ্বারোহী সেনাদল ততক্ষণে নগরের ভিতর ঢুকিয়া পড়িয়া চারিধারে আক্রমণ ও লুণ্ঠন শুরু করিয়া দিত। পঞ্চমত, নবদ্বীপ সেন-রাজাদের রাজধানী ছিল না, ছিল গঙ্গাতীরবর্তী একটি তীৰ্থস্থান এবং সেখানে একেবারে গঙ্গর কুল ঘেষিয়া ছিল রাজার প্রাসাদ। এই প্রাসাদ সুদৃঢ় অট্টালিকা নয়, তদানীন্তন বাঙলার রুচি ও অভ্যাসানুযায়ী কাঠ ও বাশের তৈরী সমৃদ্ধ বাংলা-বাড়ি। নবদ্বীপ দুৰ্গাঁও নয়, একটি তীর্থ-নগর মাত্র এবং নগর-প্রাচীর বা দ্বারবলিতে বাঁশ ও কাঠের তৈরী বেড়া ও দরজা ছাড়া আর কিছু নয়। মুঘল-প্রাসাদ বা দুর্গ-নগর বলিতে যাহা বুঝায় নবদ্বীপে তাহার কিছুই ছিল না, এ-তথ্য অনুমানে কিছুমাত্র বাধা নাই। ষষ্ঠত, বিদেশি অশ্ববিক্রেতার আসা-যাওয়া নগরে নিশ্চয়ই ছিল; সুতরাং অশ্ববিক্রেতার ছদ্মবেশে ১৯ জন অশ্বারোহীর আগমন কাহারও মনে কোনও সন্দেহের উদ্রেক করে নাই। সপ্তমত, প্রাচ্য ইতিহাসে স্বল্পসংখ্যক অশ্বারোহী সেনা কর্তৃক অতর্কিত আক্রমণে কোনও নগরাধিকার একেবারে অজ্ঞাত নয় এবং নিছক কল্পনার সৃষ্টিও নয়।

এ-সব অবস্থার প্রেক্ষাপটে বখত্-ইয়ারের নবদ্বীপধিকার কিছু বিস্ময়কর ব্যাপার বলিয়া মনে হয় না, কিংবা তাহাতে তদানীন্তন বাঙালীর ভীরুতাও কিছু প্রমাণিত হয় না। আলোচিত সাক্ষ্যে স্পষ্টই বুঝা যায়, নবদ্বীপে শত্রু-আক্রমণের কোনও প্রতিরোধ-ব্যবস্থাই ছিল না। রাজমহলের নিকটে, বোধ হয় তেলিয়াগড়ে, কোথাও ছিল দক্ষিণ-বিহার হইতে বাঙলায় প্রবেশের পথ, সেখানে প্রতিরোধের কী ব্যবস্থা ছিল বা না ছিল, জানিবার উপায় নাই। থাকিলেও বখত-ইয়ারের পক্ষে যে তাহা যথেষ্ট বাধা রচনা করিতে পারে নাই তাহা তো পরিষ্কার! আর ঝাড়খণ্ডের দুর্ভেদ্য জঙ্গল ও দুর্গমপথ অতিক্ৰম করিয়া কোনও দুঃসাহসী শত্রুসৈন্য যে বীরভূমের পথে বাঙলায় আসিয়া প্রবেশ করবে, সেন-রাজ ও রাষ্ট্র বোধ হয় তেমন আশঙ্কাও করেন নাই।

যাহা হউক, মোটামুটিভাবে মিনহাজ ও ইসমীর বিবরণের সত্যতা অস্বীকার করা চলে না। বখত্-ইয়ার, তথা বিদেশী শক্তির কাছে নবদ্বীপ তথা সেনরাষ্ট্র ও বাঙালীর পরাজয়ের কারণ আরও গভীর, আরও অর্থবহ এবং তাহা সমগ্ৰ উত্তর-ভারতের সমসাময়িক ইতিহাসের সঙ্গে যুক্ত। ইসলামধর্মী আরব, তুকী, খিলজি প্রভৃতি বিদেশী আক্রমণকারীদের বিরুদ্ধে উত্তর-ভারত তো। কয়েক শতাব্দী ধরিয়া সমানেই যুঝিতেছিল; সাহস ও বীর্যের পরিচয়, দেশাত্মবোধের পরিচয়ও কম দেয় নাই; কিন্তু তৎসত্ত্বেও তিল তিল করিয়া এই সব বৈদেশিক আক্রমণকারীদের প্রভুত্বও স্বীকার করিয়া লইতে হইতেছিল—নানা রাষ্ট্ৰীয়, সামাজিক ও অর্থনৈতিক কারণে, সামরিক শক্তির অভাবে নয়। ভারতীয় পদাতিক, হন্তীসৈন্য ও স্বল্পসংখ্যক মাত্র অশ্বসৈন্যনির্ভর সামরিক শক্তি অপেক্ষা আরব-খিলজী-তুকীদের দ্রুত ও সুকৌশলী ঘোড়সওয়ারী সেনাদল অধিক কার্যকারী ছিল, সন্দেহ নাই। তবু এই সব কারণ ছাড়া, সমসাময়িক বাঙলাদেশে যে মনোবৃত্তি এই বৈদেশিক পরাভাবের হেতু তাহাও এই প্রসঙ্গে আলোচ্য। উত্তর-ভারত তো একটু একটু করিয়া ইতিপূর্বেই দিল্লীর তত্তের অধীন হইয়া গিয়াছিল; সাহাব-উদ-দীন ঘোরী কর্তৃক গাহািড়বালরাজ জয়চন্দ্রের পরাজয়ের (১১৯৪) পর পূর্বদিকের একমাত্র পরাক্রান্ত স্বাধীন রাজ্য ও রাষ্ট্র ছিল লক্ষ্মণসেনের। এই রাজ্যেরই কিয়দংশ যখন অধিকৃত হইয়া গেল, বিহার ধ্বংস হইল, অর্থ লুষ্ঠিত হইল, প্ৰাণ বিসৰ্জিত হইল তখন জনসাধারণের আতঙ্কগ্ৰস্থ হইয়া পড়া কিছু বিচিত্র নয়। এই আতঙ্কেই দেশের লোক (পূর্ব) বঙ্গে, কামরূপে পলাইয়া গিয়াছিল, এমন কি নবদ্বীপও প্রায় জনশূন্য হইয়া পড়িয়াছিল, মিনহাজের এই ইঙ্গিত মিথ্যা না-ও হইতে পারে। সাধারণ যুক্তিতে এইরূপ হওয়া খুবই স্বাভাবিক, বিশেষত ব্ৰাহ্মণ ও বণিকদের পক্ষে। বৌদ্ধ ভিক্ষু ও অনেক ব্ৰাহ্মণের দল যে এই সময় নানাদিকে পলাইয়া গিয়াছিলেন, এ সাক্ষ্য তো বৌদ্ধ লামা তারনাথও রাখিয়া গিয়াছেন। জনসাধারণের প্রতিরোধের মনোবৃত্তি যে ছিল না, এবং গড়িয়া তুলিতে চেষ্টাও কেহ করে নাই, এ-তথ্য একেবারে অস্বীকার করিবার উপায় নাই। জ্যোতিষী ব্ৰাহ্মণ ও মন্ত্রীবর্গ যে লক্ষ্মণসেনকে যুদ্ধ না করিয়া দেশত্যাগ করিয়া চলিয়া যাইতে বলিয়াছিলেন, তাহাতে মনে হয়, রাষ্ট্রেরও প্রতিরোধ-ইচ্ছা বিশেষ ছিল না; ভাগ্যনির্ভর পরাজয়ী মনোবৃত্তি রাষ্ট্রকেও গ্রাস করিয়াছিল। দ্বিতীয়ত, ব্ৰাহ্মণ জ্যোতিষীদের জ্যোতিষ-গণনা ও শাস্ত্রের দোহাইয়ের যে ইঙ্গিত মিনহাজ রাখিয়া গিয়াছেন, তাহাও অস্বীকার করিবার কারণ দেখিতেছি। না। লক্ষ্মণসেনের জন্মকাহিনী অলৌকিক, অবিশ্বাস্য, এমন কি হাস্যকর, সন্দেহ নাই; কিন্তু সে-ক্ষেত্রেও জ্যোতিযে সমসাময়িক জনসাধারণের অত্যধিক বিশ্বাসই সূচিত করে। নিঃসন্দিগ্ধ ঐতিহাসিক প্রমাণ দ্বারা এই তথ্য সমর্থিত। এই যুগের খ্যাতনামা পণ্ডিতদের, ভবদেব ভট্ট, হল্যায়ুধ প্রভৃতি সকলেরই পাণ্ডিত্যখ্যাতি স্মৃতি ও জ্যোতিষনির্ভর। আর, যে-সব সুবিস্তৃত ব্ৰাহ্মণ্য ক্রিয়াকাণ্ডের উল্লেখ, বিভিন্ন তিথি-নক্ষত্রে স্নান, পূজা, উপবাস, হোম, যাগযজ্ঞ ইত্যাদির দর্শন সেন-আমলের লিপিগুলিতে পাওয়া যায়, তাহা তো সমস্তই জ্যোতিষনির্ভর। রাজ-পরিবার, মন্ত্রী-সেনাপতি ইত্যাদিরা, ব্রাহ্মণ ও পুরোহিতেরা এবং উচ্চতর বর্ণের লোকেরা যে স্মৃতি ও জ্যোতিষ ছাড়া জীবনচর্চার আর কোনও নির্দেশ মানিতেন, সেন-আমলের লিপি ও সুবিপুল সংস্কৃতসাহিত্য পড়িলে তাহা মনে হয় না। আর, রাজারা স্বয়ং জ্যোতিষচর্চা করিতেছেন, বল্লাল ও লক্ষ্মণসেন দু’জনই জ্যোতিষের গ্রন্থ লিখিতেছেন, এমন তথ্যও রাজবৃত্তের ইতিহাসে সচরাচর দেখা যায় না। কাজেই, সেই সংকটময় মুহুর্তে মিনহাজ জ্যোতিষীদের উক্তি ও আচরণ সম্বন্ধে যাহা বলিতেছেন, তাহা একেবারে অবিশ্বাস৷ বলিয়া মনে হইতেছে না; কিছু অত্যুক্তি হয়তো থাকিতে পারে! তৃতীয়ত, যদি মানিয়া লওয়া যায় যে (এবং তাহা করিতে কিছু বাধা দেখা যাইতেছে না), লক্ষ্মণসেন বিহারে, বাঙলার পথে এবং নবদ্বীপে শত্ৰু প্রতিরোধের ব্যবস্থা করিয়াছিলেন, তাহা হইলেও স্বীকার করিতে হয়, এই বাধা যথেষ্ট ছিল না, এবং সংঘর্ষের পশ্চাতে সৈন্যদলের চিত্তশক্তি ও প্রতিরোধ-কামনা খুব প্রবল ছিল না। মিনহাজ বখত্-ইয়ারের তিব্বতাভিযানের ব্যর্থতা এবং লাঞ্ছনার কথা গোপন করেন নাই; প্রতিরোধ প্রবল এবং সংঘর্ষ সঙ্কটময় হইলে এক্ষেত্রেও মিনহাজ অন্তত তাহার উল্লেখ করিতেন। সংবাদদাতা নিজামী-উদ-দীন ও সামস-উদ-দীন এই সংঘর্ষের উল্লেখের ভিতর দিয়াই নিজেদের শৌর্য-বীর্যের কথা ভালো ব্যক্তি করিতে পারিতেন, অথচ তাহা করেন নাই। তাহা ছাড়া, বিহার—ধ্বংসের যে বিবরণ তারনাথ রাখিয়া গিয়াছেন, তাহা পাঠে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের আচরণও খুব প্রশংসনীয় বলিয়া মনে করা যায় না। আচরণ দেখিয়া মনে হয়, ইহারা গোড়া ব্ৰাহ্মণ্যধর্মাবলম্বী সেন-রাজবংশ ও রাষ্ট্রের প্রতি খুব প্রসন্ন ছিলেন না! অন্য কারণ কিছু থাকাও বিচিত্র নয়। নবদ্বীপেও প্রতিরোধ ব্যবস্থা হয়তো কিছু হইয়াছিল, কিন্তু বাখতু ইয়ারের বুদ্ধি ও আক্রমণ কৌশল তাহা সহজেই ব্যর্থ করিয়া দিয়াছিল, তাহাও অস্বীকার করিবার উপায় নেই। আসল ব্যাপার এই যে, যেখানে জনসাধারণ আতঙ্কগ্রস্থ ও পলায়মান, উপদেষ্টা ও মন্ত্রীবর্গ পরাজয়ী মনোবৃত্তি দ্বারা আচ্ছন্ন, এবং জ্যোতিষ যেখানে রাষ্ট্রবুদ্ধির নিয়ামক সেখানে সৈন্যদলের ও জনসাধারণের প্রতিরোধ দুর্বল হইতে বাধ্য। সেইজন্যই কোনও প্রতিরোধই হয়তো যথেষ্ট কার্যকরী হয় নাই। মিনহাজের বিবরণী পড়িয়া যে মনে হয়, বখতি-ইয়ার একেবারে বিনা বাধায় বিহার ও বাঙলাদেশ জয় করিয়াছিলেন, তাহা এই কারণেই। বস্তুত, লক্ষ্মণসেনের রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রযন্ত্র নানা রাষ্ট্ৰীয় ও সামাজিক কারণে ভিতর হইতে দুর্বল হইয়া পড়িয়াছিল। গাহড়বালদের প্রতিরোধ-প্রাচীর যতদিন বজায় ছিল। ততদিন নিশ্চিন্ত হইয়া কলিঙ্গ-কামরূপ-কাশী জয় লক্ষ্মণসেন ও তাঁহার সেনাদের পক্ষে খুব কঠিন ব্যাপার হয় নাই। কিন্তু সে-প্রাচীর যখন ভাঙিয়া পড়িল যখন দুর্ধর্ষ মুসলমান অভিযাত্রীদের ঠেকাইয়া রাখিবার মতন ইচ্ছা বা শক্তি রাষ্ট্রযন্ত্রের ছিল না। ব্রাহ্মণ, বণিক, উপদেষ্টা, জ্যোতিষী ও মন্ত্রীবর্গের আচরণই তাহার প্রমাণ।

লক্ষণসেনের আচরণ

চারিদিকে যখন এই আতঙ্ক ও পরাজয়-মনোবৃত্তির আচ্ছন্নতা তখন বৃদ্ধ লক্ষ্মণসেনের নিজের আচরণ সত্যই প্ৰশংসনীয় এবং যথার্থ রাজকীয় মর্যাদাবোধের পরিচয়। শত্রু অগ্রসরমান জানিয়া এবং উপদেষ্টা ও মন্ত্রীবর্গের পরামর্শে বিচলিত হইয়া তিনি রাজধানী পরিত্যাগ করেন নাই। শেয পর্যন্ত তিনি স্বীয় পদে ও কর্তব্যে অবিচল ছিলেন। তারপর যখন প্ৰায় সকলে তাঁহাকে পরিত্যাগ করিল, পায়ের নীচ হইতে মাটি খসিয়া পড়িল, শত্রুসৈন্য অতর্কিতে এবং অশ্ববিক্রেতার ছদ্মবেশে রাজপ্রাসাদ আক্রমণ ও অধিকার করিল, তখন তাহার পলায়ন ছাড়া আর কোনও পথ ছিল না। লক্ষ্মণসেন কাপুরুষ ছিলেন না, তিনি হতভাগ্য! সমাজ-ইতিহাসের অমোঘ নিয়মে, ইতিহাস-চক্রের জটিল ও অমোঘ আবর্তনে বাঙলার ইতিহাস শতাব্দী ধরিয়া যে অনিবার্য পরিণতির দিকে অগ্রসর হইতেছিল, লক্ষ্মণসেন তাহার শেষ অধ্যায় মাত্ৰ! তোহার ব্যক্তিগত শৌর্যবীর্য ও অন্যান্য গুণাবলী তাহাকে কিংবা বাঙলাদেশকে সেই পরিণতির হাত হইতে বাঁচাইতে পারে নাই; পারা সম্ভব ছিল না। লক্ষ্মণসেনের ব্যক্তিগত পরাক্রম ও অন্যান্য গুণাবলীর সাক্ষ্য তো মিনহাজ নিজেও দিয়াছেন :

‘রায় লখমনিয়া মহৎ রাজা (great Rae) ছিলেন; হিন্দুস্থানে তাঁহার মতো সম্মানিত রাজা আর কেহ ছিল না। তাহার হাত কাহারও উপর কোনও অত্যাচারে অবিচারে অগ্রসর হইত না। এক লক্ষ কড়ির কমে তিনি কাহাকেও কিছু দান করিতেন না।‘

নদীয়া বা নবদ্বীপ আক্রমণ ও অধিকার ঠিক কবে হইয়াছিল। তাহা লইয়া পণ্ডিতদের মধ্যে বিতণ্ডার অন্ত নাই। মোটামুটি মনে হয় ১২০০ খ্ৰীষ্টােব্দ বা তাহার কিছু পরে (১২০১ খ্ৰী) এই ঘটনার সংঘটন কাল। শোক শুভোদয়া-গ্রন্থে এই ঘটনার তারিখ দেওয়া হইতেছে ১১২৪—১২০২ খ্ৰীষ্টাব্দ, এবং এই তারিখ পাগ-সাম-জোন-জাং নামক তিব্বতী গ্রন্থদ্বারা সমর্থিত।

বিশ্বরূপ সেন ॥ কেশব সেন

নদীয়া-নৃদীয়া-নবদ্বীপ পরিত্যাগ করিয়া লক্ষ্মণসেন (পূর্ব)-বঙ্গে যান এবং সেখানে অত্যল্পকাল রাজত্ব করিয়া পরলোকগমন করেন (১২০৬?), মিনহাজ একথা বলিতেছেন। সদুক্তিকর্ণামৃত-গ্রন্থের সাক্ষ্যে মনে হয়, লক্ষ্মণসেন ১২০৫ খ্ৰীষ্টাব্দেও জীবিত এবং রাজত্ব করিতেছিলেন। বিক্রমপুর জয়স্কন্ধাবার হইতে নিৰ্গত লক্ষ্মণসেনের লিপিগুলির মধ্যে ভাওয়াল ও মাধাইনগর লিপি দুইটি তুর্কী-বিজয়ের পরবর্তী হওয়া একেবারে অসম্ভব নয়। কবি উমাপতিধরও একটি বিচ্ছিন্ন শ্লোকে লক্ষ্মণসেন কর্তৃক এক স্নেচ্ছারাজ জয়ের ইঙ্গিত করিয়াছেন। ম্লেচ্ছ-বিনাশ প্রসঙ্গে কবি শরণেরও একটি শ্লোক আগে উদ্ধার করিয়াছি। হইতে পারে, বঙ্গে বিক্রমপুরে গিয়া অধিষ্ঠিত হইবার পর মুসলমান সৈন্যর সঙ্গে কোথাও কোনও সংঘর্ষ তাহার হইয়া থাকিবে। এই অনুমানের কারণ এই যে, লক্ষ্মণসেনের পুত্র বিশ্বরূপসেন ও কেশবসেনের লিপিতে যাবানদের সঙ্গে তঁহাদের সংঘর্ষের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। গৌড় ও বরেন্দ্রীর মুসলমান নরপতি ও সেনানায়কেরা কেহ কেহ হয়তো পূর্ব ও দক্ষিণ-বঙ্গের সেন-রাজ্যের বাকী অংশও অধিকার করিতে চাহিয়াছিলেন। কিন্তু প্ৰায় এক শতাব্দীকাল সে-চেষ্টা সার্থক হয় নাই। প্রধান কারণ, নদনদীবহুল পূর্ববঙ্গের ভৌগোলিক সংস্থান, সন্দেহ নাই। যাহাই হউক, লক্ষ্মণসেন, বিশ্বরূপ ও কেশব তিনজনই এই সব সংঘর্যের জয়ী হইয়াছিলেন, লিপিগুলিতে যেন তাহারই ইঙ্গিত। লিপি প্রমাণ হইতে এ-তথ্য নিঃসংশয় যে, লক্ষ্মণসেনের বংশ বঙ্গে আরও অর্ধ শতাব্দী কালের উপর রাজত্ব করিয়াছিলেন, এবং তঁহাদের রাজ্য পূর্ব ও দক্ষিণ-বঙ্গে বিস্তৃত ছিল। মিনহাজ বলিতেছেন, তাহার গ্ৰন্থরচনা কালেও সেন-রাজারা বঙ্গে রাজত্ব করিতেছিলেন। বিশ্বরূপ ও কেশব দুইজনই লক্ষ্মণসেনের ন্যায় নিজেদের ‘গৌড়েশ্বর” এবং “পরমেশ্বর পরম-ভট্টারক মহারাজাধিরাজ” বলিয়া আত্মপরিচয় দিয়াছেন। রাজ্যের অধিকাংশই তাঁহাদের কারচু্যত হইয়া গিয়াছিল; একাধিকবার যবনদের সঙ্গে ঠাহীদের সংঘর্ষও হইয়াছিল; কিন্তু তৎসত্ত্বেও নিজেদের রাজকীয় দলিলপত্রে অভ্যস্ত ও চিরাচরিত ধরাবাধা ঔপধিক আড়ম্বরের ত্রুটি হয় নাই। হয়তো তাহারা ভাবিয়াছিলেন, নিজেদের স্বাধীনতা তখনও অক্ষুন্নাই আছে, এবং পূর্ববতী অনেক ভিনাপ্রদেশী রাজবংশ কর্তৃক আক্রমণ ও পরাজয়ের মতো এই আক্রমণ এবং পরাজয়ও অধিককাল স্থায়ী হইবে না। বস্তুত, নবদ্বীপ, করচু্যত এবং বখত্-ইয়ার লখনৌতিতে প্রতিষ্ঠিত হুইবার পরও সেনরাজারা যেভাবে তাহদের লিপিগুলিতে সর্বপ্রকার ঔপধিক আড়ম্বর এবং চিরাচরিত রীতি ও অভ্যাস বজায় রাখিয়াছেন, তাহাতে মনে হয় না, এই মুসলমান বিজয়েব যথার্থ ঐতিহাসিক ইঙ্গিত তাহারা যথেষ্ট উপলব্ধি করিয়াছিলেন। সমসাময়িক সাহিত্যেও এই সঙ্কটময় বৈপ্লবিক আবর্তনের কোনও পরিচয় কোথাও পাওয়া যাইতেছে না। সমাজের শিক্ষিত জ্ঞানী-গুণীরা বা জনসাধারণও কি সে ইঙ্গিত ধরিতে পারেন নাই?

বিশ্বরূপ ও কেশব দুইজনই “সগৰ্গ-যবিনাশ্বয়—প্ৰলয়-কালরুদ্র” বলিয়া নিজেদের পরিচয়-দান করিয়াছেন। একাধিক মুসলমান সুলতান—গিয়াস-উদ-দীন বলবন (১২১১-১২২৬), মালিক সৈফ।-উদ-দীন (১২৩১-৩৩), ইজ-উদ-দীন বলবন (১২৫৮) প্রভৃতি কয়েক বারই বঙ্গ (পূর্ব ও দক্ষিণ-বঙ্গ) বিজয়ের চেষ্টা করিয়াছেন, মুসলমান ঐতিহাসিকদের বিবরণী হইতেই তাহা জানা যায়। তবে, সে-চেষ্টা সার্থক হয় নাই। আগেই বলিয়াছি যে, মিনহাজের সাক্ষ্যেই জানা যায় সেনা-রাজারা ১২৬০ খ্ৰীষ্টাব্দেও বঙ্গে রাজত্ব করিতেছিলেন। বিশ্বরূপ ও কেশবের পরও আরও কয়েকজন সেন-রাজার নাম আবুল ফজলের আইন-ই-আকবরী এবং রাজাবলী-গ্রন্থে পাওয়া যায়। তবে, স্বতন্ত্র ও বিশ্বাসযোগ্য সাক্ষ্য দ্বারা এই সব রাজার নাম বা কীর্তিকাহিনী সমর্থিত নয়। ইহাদের মধ্যে মাধবসেন এবং শূরসেনের নাম একান্ত অনৈতিহাসিক না-ও হইতে পারে। পঞ্চরক্ষা গ্রন্থের একটি পাণ্ডুলিপিতে (১২৮৯খ্ৰী) গৌড়েশ্বর, পরামসৌগত পরামরাজাধিরাজ মধুসেন নামে এক নরপতির খবর পাওয়া যায়। বিশ্বরূপের সাহিত্য-পরিষৎ-লিপিতে সূর্যসেন (শূরসেন?) এবং পুরুষোত্তম সেন নামে দুই রাজকুমারের উল্লেখ আছে। সেনা-বংশীয় কোনও কোনও রাজপুত্র-রাজকুমার স্থানীয় সামস্তরাজ রূপেও রাজত্ব করিয়া থাকিবেন।

অবসান

পূর্ববঙ্গেও সেন-রাষ্ট্র ভিতর হইতে ক্রমশ দুর্বল হইয়া পড়িতেছিল। ১২২১ খ্ৰীষ্টাব্দের আগেই কোনও সময়ে পট্টিকেরা (ত্রিপুরা জেলা) রাজ্যে রণবঙ্কমল্ল হারিকালদেব স্বাতন্ত্র্য ঘোষণা করিলেন। লক্ষ্মণসেনের জীবিতাবস্থায়ই বোধ হয় মেঘনার পূর্বতীরে ত্রিপুরা-নোয়াখালি-চট্টগ্রামে এক দেববংশ মাথা তুলিয়াছিল, এসব কথা তো আগেই বলিয়াছি। এই তিনটি জেলাই এই রাজবংশের রাজা দামোদরের (১২৩১-১২৪৩) অধিকারভুক্ত ছিল, এ-বিষয়ে লিপি প্রমাণ বিদ্যমান। কিছুদিন পর, ১২৮৩ খ্ৰীষ্টাব্দের আগেই, বোধ হয় এই দেববংশেরই অন্যতম রাজা দশরথদেব বর্তমান ঢাকা জেলাও তাহার রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করিয়াছিলেন, এবং বিক্রমপুরে তাহার রাজধানী স্থাপন করিয়াছিলেন। দেববংশেরই আরও দুই একটি লিপি ক্রমশ আবিষ্কৃত হইতেছে। মনে হয়, ত্রয়োদশ শতকের শেষ পর্যন্ত পূর্ব ও দক্ষিণবঙ্গ কোনও রকম করিয়া মুসলমানাধিকারের হাত হইতে নিজেদের স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করিয়াছিল, কোথাও সেনা-বংশীয় রাজাদের নায়কত্বে, কোথাও অন্য কোনও স্থানীয় রাজা বা সামন্তের নায়কত্বে। নদীবহুল জলমগ্ন ভাটি অঞ্চলে অশ্বনির্ভর মুসলমান অভিযাত্রীরা বহুদিন পর্যন্ত নিজেদের অধিকার বিস্তৃত করিতে পারেন নাই। অশ্বারোহী সৈন্য লইয়া নবদ্বীপ অধিকার করা যায়, কিন্তু জলপথে অনভ্যস্ত নৌকাবাহিনীবিহীন মুসলমান সেনাপতিদের পক্ষে (পূর্ব ও দক্ষিণ)—বঙ্গ বিজয় নিশ্চয়ই খুব সহজ ছিল না। কিন্তু, তাহা ক’দিনের জন্য? ত্ৰয়োদশ শতকের পর বাঙলাদেশের কোথাও আর কোনও স্বাধীন স্বতন্ত্র হিন্দু নরপতির নাম শোনা যাইতেছে না।

সেনায়ন-কাহিনী বিবৃতির সঙ্গে সঙ্গে এই যুগের রাজবংশ এবং রাষ্ট্রসম্বন্ধগত সামাজিক ইঙ্গিত আগেই কিছু কিছু ধরিতে চেষ্টা করিয়ছি। এখানে একটু বিস্তৃত করিয়া একটা সামগ্রিক দৃষ্টি লওয়ার চেষ্টা করা যাইতে পারে।

সামাজিক ইঙ্গিত

সেন-রাজবংশ বাঙালী ছিলেন না, দক্ষিণের কর্ণাট দেশ হইতে এ দেশে আসিয়া রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করিয়া পাল-যুগসৃষ্ট বাঙলাদেশ ও বাঙালীজাতির আধিপত্য লাভ করিয়াছিলেন। লক্ষণীয় এই যে, এই যুগে আর একটি রাজবংশ (পূর্ব)-বঙ্গে আধিপত্য বিস্তার করিয়াছিলেন; এই বর্মণ রাজবংশও কিন্তু অবাঙালী, ইহারাও বিদেশাগত, বোধ হয়। কলিঙ্গগত। পাল-বংশ মুখ্যত বৌদ্ধধর্মাবলম্বী, সেনা-বংশ গোড়া ব্রাহ্মণ্যধর্মাবলম্বী। আর, যে-চন্দ্ররাজবংশকে অধিকারচু্যত করিয়া বর্মণ-বংশ প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল তাহারও পালরাজাদের মতো পরম সুগত অর্থাৎ বৌদ্ধ, আর বর্মণেরা এবং মেঘনা-অঞ্চলের দেব-বংশের রাজারা সেনদের মতনই গোড়া ব্ৰাহ্মণ্যধর্ম ও ব্ৰাহ্মণ্য সংস্কারাশ্রয়ী। এই দুই তথ্যের মধ্যে এই যুগের সামাজিক ইঙ্গিত অনেকাংশ নিহিত; ইহাদের ঐতিহাসিক ব্যঞ্জনা অবহেলার বস্তু নয়। ক্ৰমে তাহা স্পষ্ট করিবার চেষ্টা করিতেছি।

রাষ্ট্রীয় আদর্শ ॥ সংকীর্ণ সামাজিক দৃষ্টি ৷ আমলাতন্ত্রের বিস্তৃতি ৷ রাষ্ট্রযন্ত্রে পৌরোহিত্যের প্রভাব

সুদীর্ঘ পালযুগের রাষ্ট্ৰীয় আদর্শ এই যুগে অপরিবর্তিত নূতনু কোনও রাষ্ট্ৰীয় আদর্শ এই যুগে গড়িয়া উঠে নাই, রাষ্ট্রযন্ত্রেরও কোনও পরিবর্তন হয় নাই। স্থানীয় স্বাতন্ত্রা ও আত্মকর্তৃত্বের আদশ সমভাবে বিদ্যমান। সুপ্রতিষ্ঠিত ও ক্রমাগ্রসরমান বৈদেশিক মুসলমানশক্তির নিরস্তর করাঘাতেও রাষ্ট্রীয় আদর্শের কোনও পরিবর্তন হয় নাই; সামগ্রিক ভারতীয় ঐক্যবোধ ও আদর্শ, বৃহত্তর রাষ্ট্ৰীয় আদর্শ কিছু গড়িয়া উঠে নাই। সামস্ততন্ত্র সমভাবে সক্রয়। উত্তরারোত্তর ভূমির চাহিদা বাড়িতেছে; পুরোহিত-ব্ৰাহ্মণেরাও ভূমিসংগ্রহে তৎপর হইয়া উঠিয়াছেন, সমাজ ক্রমশ ভূমিনির্ভর, কৃষিনির্ভর হইয়া উঠিতেছে। অথচ, রাষ্ট্রের দৃষ্টিতে ক্ষেত্রকর বা কৃষক সম্প্রদায় অবজ্ঞাত; রাজকীয়-ভূমিসংক্রান্ত দলিলপত্রে তাঁহারা ভুলেও উল্লিখিত হইতেছেন না। সমাজের নিম্নতম স্তােরর লোকদেরও কোনও উল্লেখ দেখিতেছি না। অথচ, পালযুগের লিপিমালায় সর্বত্রই কৃষক-কর্ষক-ক্ষেত্রকরদের উল্লেখ তো আছেই, চণ্ডালদের পর্যন্ত উল্লেখ আছে; অর্থাৎ, সমাজের কোনও স্তরই তখন রাষ্ট্রের দৃষ্টির বহির্ভূত ছিল না। স্পষ্টই দেখিতেছি, সেন-যুগে রাষ্ট্রের সামাজিক দৃষ্টি সংকীর্ণ হইয়া আসিয়াছে!! রাষ্ট্রের আধিপত্যের বিস্তার, অর্থাৎ, রাজ্যপরিধিও পাল-সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি লাভ করিতে পারে নাই; তাহাও সংকীর্ণই বলা যায়, যদিও লক্ষ্মণসেন প্রায় মহীপালের রাজ্যসীমা উদ্ধার করিয়াছিলেন, তবে স্বল্পকালের জন্য মাত্র। অথচ, অন্যদিকে ক্ষুদ্র বৃহৎ সকল রাজ ও সামন্তবংশেরই রাষ্ট্ৰীয় আমলাতন্ত্র ক্রমবর্ধমান। নূতন নূতন রাজকর্মচারীদের নাম এই যুগে প্রথম শোনা যাইতেছে; সঙ্গে সঙ্গে ক্রমসংকুচীয়মান নূতন নূতন রাজ্যবিভাগ— খণ্ডল, চতুরক, আবৃত্তি, পাটক ইত্যাদি। ছোট ছোট রাজপদ যেমন বাড়িয়াছে তেমনই বাড়িয়াছে “মহা”-পদের সংখ্যা— মহামন্ত্রী, মহাপুরোহিত, মহাসান্ধিবিগ্রহিক, মহাপিলুপতি, মহাগণস্থ, মহাধৰ্মধ্যক্ষ, ইত্যাদি— “মহা”-পদের আর শেষ নাই! কম্বোজরাজ। নয়পালের ইর্দা পট্টোলীতে নূতন রাষ্ট্রযন্ত্র বিভাগের নামও শোনা যায়; কারণ অর্থাৎ কেরানী মণ্ডলসহ “অধ্যক্ষবৰ্গ”, সেনাপতিসহ “সৈনিকসংঘমুখ্য”, দূতসহ “গূঢ়পুরুষ”-বৰ্গ, এবং আরও কত কি! পরিষ্কার বুঝা যাইতেছে, একদিকে রাষ্ট্রের সমাজদূষ্টি যত সংকীর্ণ হইতেছে, পরিধি যত সংকীর্ণ হইতেছে, আমলাতন্ত্রের বিস্তার হইতেছে তত বেশী, রাজ্যপাদোপজীবীর সংখ্যা তত বাড়িতেছে, চাকুরীজীবী মধ্যবিত্ত সম্প্রদায় তত বিস্তৃত হইতেছে। দীর্ঘ হইতে দীর্ঘতর তালিকা দিয়াও যখন ইহাদের শেষ করা যাইতেছে না। তখন বলা হইতেছে, ইহার পর অন্যান্য অনুল্লিখিত রাজকর্মচারী যাঁহারা রহিলেন তঁহাদের নাম অর্থশাস্ত্ৰ-গ্রন্থের অধ্যক্ষ-প্রচার অধ্যায়ে লিখিত আছে। আমলাতন্ত্র যে সংখ্যায় ও অধিকার-বৃদ্ধিতে স্ফীত ও অতিমাত্রায় সচেতন হইয়াছে, এ-সম্বন্ধে সন্দেহ করিবারও অবকাশ নাই। শুধু তাঁহাই নয়, রাজার সর্বময় কর্তৃত্বও বাড়িয়াছে এবং সঙ্গে সঙ্গে বোধ হয় আড়ম্বরও। এই যুগেই দেখিতেছি, তাহার নূতন নূতন উপাধি গ্রহণের আতিশয্য। স্মলযুগের রাজকীয় বিজ্ঞপ্তিতে রানীর উল্লেখ দেখা যায় না; কিন্তু এখন দেখিতেছি। রাজ্ঞী-মহিষীরাও উল্লিখিত হইতেছেন। রাজপরিবারের আভিজাত্য ও দরবারী জৌলুস ও বাড়িতেছে, এমন অনুমান করা বোধ হয়। অন্যায় নয়! বৰ্মণ, কম্বোজ ও সেনা-বংশ সকলেই তো বিদেশাগত; মাতৃপ্রধান অথবা মাতৃতান্ত্রিক সমাজের স্মৃতি তাহারা বহন করিয়া আনিয়াছিলেন, এমনও হইতে পারে! এইখানেই শেষ নয়; পুরোহিত, মহাপুরোহিত, শাস্ত্যাগরিক, শাস্ত্যাগোরাধিকৃত, শান্তিবারিক, মহাতন্ত্রাধিকৃত প্রভৃতি নূতন নূতন রাজপুরুষ (ইহারা সকলেই ধর্মীচরণ-ধর্মানুষ্ঠান সংক্রান্ত কাজে নিযুক্ত) রাজসভা জাকাইয়া বসিয়া আছেন। সঙ্গে সঙ্গে ব্ৰাহ্মণ রাজপণ্ডিতও আছেন; তিনিও এই যুগে অন্যতম রাজকর্মচারী। আমলাতন্ত্রের এই সুদীর্ঘ ও সর্বব্যাপী বাহু এবং সর্বময় প্রভুত্ব জনসাধারণ কী দৃষ্টিতে দেখিত তাহা জানিবার কোনও উপায় নাই।

শিল্পী-বণিক-ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের স্থান

রাষ্ট্রের সামাজিক দৃষ্টি-সংকীর্ণতার কথা বলিয়াছি। অন্য সাক্ষ্য-প্রমাণ হইতেও এই উক্তির সমর্থন পাওয়া যায়। পূর্বতর যুগের মতন পালযুগের রাষ্ট্রে শিল্পী-বণিক-ব্যবসায়ীর প্রাধান্য ছিল না, এ-কথা সত্য; কিন্তু সমাজে তাঁহাদের একটা স্থান ছিল, স্বীকৃতি ছিল! সেন-আমলে দেখা যাইতেছে, শিল্পী ও ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের লোকেরা সমাজের নিম্নস্তরে নামিয়া গিয়াছে। বৃহদ্ধর্মপুরাণ ও ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে এ-সম্বন্ধে যে-সাক্ষ্য পাওয়া যায় তাহার বিস্তৃত বিচারালোচনা বর্ণ-বিন্যাস ও শ্রেণী-বিন্যাস অধ্যায়ে করা হইয়াছে। এই দুই গ্রন্থে বর্ণ-বিন্যাসের যে-ছবি পাওয়া যায়, যদি তাহা সেন-আমলের সমাজ-বিন্যাসের কিছু ইঙ্গিতও বহন করে তাহা হইলে স্বীকার করিতেই হয়, অনেক শিল্পী ও ব্যবসায়ী সম্প্রদায় সংশুদ্ৰ বলিয়াও গণ্য হইতেন না; বর্ণ-বিন্যাসের নিম্নতর স্তরে ছিল তাহদের স্থান।

রাষ্ট্রের সামাজিক আদৰ্শ৷ বৌদ্ধধর্ম ও সংঘের প্রতি রাষ্ট্রের আচরণ

এই দৃষ্টি-সংকীর্ণতা সেনা-রাজবংশ ও রাষ্ট্রের উপর কেন আরোপ করিতেছি তাহার কারণ বলিতে হইলে রাষ্ট্রের সামাজিক আদর্শ সম্বন্ধে কয়েকটি কথা বলা দরকার। সেন-আমলের রাজকীয় লিপিমালার সাক্ষ্য লইয়াই আরম্ভ করা যাইতে পারে। বর্মণ ও সেন বংশের প্রত্যেকটি লিপিতেই দেখা যায়, ব্ৰাহ্মণ্য স্মৃতি, সংস্কার ও পূজাৰ্চনার জয়জয়কার; বিভিন্ন তিথি উপলক্ষে তীর্থস্নান, উপবাস; নানা প্রকারের বৈদিক ও পৌরাণিক যাগযজ্ঞ হোম ইত্যাদির বিবরণ; এই সব অনুষ্ঠান উপলক্ষে যত ভূমি দান সমস্তই লাভ করিতেছেন ব্রাহ্মণের। এই যুগের একটি লিপিতেও এমন প্রমাণ নাই। যেখানে বৌদ্ধধর্মাবলম্বী কেহ বা কোনও বৌদ্ধ বিহার বা সংঘ কোনও প্রকার রাজানুগ্রহ লাভ করিতেছেন। বাঙলাদেশে যত বৌদ্ধমূর্তি ইত্যাদি পাওয়া গিয়াছে তাহার অধিকাংশই অষ্টম হইতে একাদশ শতকের। অল্প কয়েকটি মূর্তিই দ্বাদশ-ত্রয়োদশ শতকের। পট্টিকেরা রাজ্যের এক রণবঙ্কমল্ল হারিকালদেবী ছাড়া এই যুগে আর কোনও বৌদ্ধ নরপতির খোজ পাওয়া কঠিন। মধুসেন পরমসুগত সন্দেহ নাই, কিন্তু তিনি সেনা-বংশের রাজা কিনা নিশ্চয় করিয়া বলা কঠিন; আর, এই ধরনের ২/১টি দৃষ্টান্তের সাহায্যে রাষ্ট্রের সামাজিক আদর্শ ধরাও কঠিন; বর্মণ ও সেনা-বংশীয় রাজারা কেহ শৈব, কেহু বৈষ্ণব, কেহ সৌর, কিন্তু প্রত্যেকেরই আশ্রয় পৌরাণিক ব্রাহ্মণ্য স্মৃতি ও সংস্কার, এবং তাঁহারা প্রত্যেকেই এই স্মৃতি ও সংস্কার প্রচার ও বিস্তারে সদা উৎসুক। রাজপরিবারের লোকদেরও এ-সম্বন্ধে আগ্রহের সীমা নাই। বৌদ্ধধর্ম এই সময় বিলীন হইয়া গিয়াছিল, সংঘ-বিহার ইত্যাদি ছিল না, একথা বলা চলে না; অথচ রাষ্ট্রের কোনও অনুগ্রহই সেদিকে বর্ষিত হইল না! শুধু যে বর্ষিত হয় নাই,তাহা নয়; বৌদ্ধধর্ম ও সংস্কৃতির প্রতি একটা বিরোধিতাও বোধহয় আরম্ভ হইয়াছিল, এবং রাষ্ট্রের সমর্থনও এই বিরোধিতার পশ্চাতে ছিল। বৰ্মণরাজ জাতবর্মীর রাজত্বকালেই সম্ভবত বর্মণ-রাষ্ট্রের বঙ্গাল সৈন্যদল সোমপুরের বৌদ্ধ মহাবিহারের অন্তত একাংশ পূড়াইয়া দিয়াছিল; নালন্দার একটি লিপিতে এই ঐতিহাসিক ঘটনার স্মৃতি উল্লিখিত আছে। এই আক্রমণ শুধু কৈবর্তনায়ক দিব্যর বিরুদ্ধেই নয়; বৌদ্ধধর্মেরও বিরুদ্ধে। ভট্ট-ভবদেব ছিলেন রাজা হরিবর্মর সন্ধিবিগ্রহিক; তাহার পিতামহ আদিদেব ছিলেন বঙ্গরাজের সান্ধিবিগ্রহিক; এই পরিবারের রাষ্ট্ৰীয় প্রভাব সহজেই অনুমেয়। তাহার উপর ভবদেব নিজে ছিলেন সমসাময়িক কাল এবং সংস্কৃতির একজন প্রধান নায়ক, কুমারিলভট্টের মীমাংসা-বিষয়ক তন্ত্রবার্তিক গ্রন্থের টীকাকার, হোরাশাস্ত্ৰ, মীমাংসা-সিদ্ধান্ত-তন্ত্র-গণিত এবং ফলসংহিতা বিষয়ক গ্রন্থাদির রচয়িতা, কর্মানুষ্ঠান পদ্ধতি বা দশকর্মপদ্ধতি, প্রায়শ্চিত্তপ্রকরণ প্রভৃতি স্মৃতি বিষয়ক গ্রন্থের লেখক এবং ব্রহ্মবিদ্যাবিদ পণ্ডিত। এই ভবদেব-ভট্ট ‘অগস্ত্যের মতো বৌদ্ধরূপ সমুদ্রকে গণ্ডযে পান করিয়াছিলেন এবং তিনি পাষণ্ডবৈতপ্তিকদের যুক্তিতর্কখণ্ডনে দক্ষ ছিলেন বলিয়া তাহার প্রশস্তিলিপিতে দাবি করা হইয়াছে। পাষণ্ডবৈতণ্ডিকেরা যে বৌদ্ধ নৈয়ায়িক এসম্বন্ধে সন্দেহ নাই। দেখা যাইতেছে, এই যুগের ব্রাহ্মণ্যধর্ম, সংস্কার ও সংস্কৃতি, বৌদ্ধ দর্শন ও সংস্কৃতির বিরোধী। বর্মণ বংশের রাষ্ট্র’ভবদেব যেমন সামাজিক আদর্শের প্রতিনিধি সেন-রাষ্ট্রে তেমনই হলায়ুধ। এই হলায়ুধও ভবদেবেরই মতন ব্রাহ্মণকুলতিলক, এবং তেমনই প্রথমে রাজপণ্ডিত, তারপর লক্ষ্মণসেনের মহামাতা, এবং সর্বশেষ লক্ষ্মণসেনেরই ধর্মধিকারী বা ধর্মধ্যক্ষ। তাহার পিতা ধনঞ্জয়ও छिन्नन् রাজকীয় ধর্মাধ্যক্ষ। এই পরিবারেরও রাষ্ট্রীয় প্রভাব অনস্বীকার্য হলায়ুধের দুই ভাই ঈশান এবং পশুপতি যথাক্রমে আহ্নিক এবং শ্ৰাদ্ধ সম্বন্ধে দুইটি পদ্ধতি রচনা করিয়াছিলেন। পশুপতি একখানা পাকযজ্ঞ-গ্রন্থেরও রচয়িতা। আর, হল্যায়ুধ নিজে তো ব্রাহ্মণসর্বস্ব, মীমাংসাসৰ্বস্ব, বৈষ্ণবসর্বস্ব শৈব সর্বস্ব এবং পণ্ডিতসর্বস্ব প্রভৃতি গ্রন্থের রচয়িতা। সুস্পষ্ট বিরোধিতার ইঙ্গিত ভবদেবী ছাড়া আর কাহারও জীবনে পাওয়া যায় না, কিন্তু এ-কথা সত্য যে, এ-যুগের রাষ্ট্রের সামাজিক আদর্শ একান্তই ব্রাহ্মণ্য ধর্ম, সংস্কার ও সংস্কৃতি আশ্রয়ী। দু’টি মাত্র দৃষ্টান্ত আহরণ করা হইল; কিন্তু বস্তুত, বাঙলাদেশ আজও যে স্মৃতিশাসনে শাসিত, যে বর্ণ-বিন্যাসে বিন্যস্ত সেই স্মৃতি ও বর্ণ-বিন্যাস দুইই এই সেন-বৰ্মণ যুগের সৃষ্টি। বল্লালসেনের গুরু অনিরুদ্ধ হইতে আরম্ভ করিয়া জিতেন্দ্ৰিয়, বালক, ভবদেব, হল্যায়ুধ এবং বোধ হয় জীমূতবাহন, ইহারা প্রত্যেকেই সেনা-বর্মণ আমলের লোক; এবং T হারলতাপিতৃদায়িতা হইতে আরম্ভ করিয়া ব্যবহারমাত্রিকা-দায়ভাগ-কালবিবেক পর্যন্ত সমস্ত স্মৃতি, ব্যবহার ও মীমাংসা গ্রন্থ এই যুগের রচনা। এই স্মৃতি-ব্যবহার-মীমাংসাই শূলপাণিরঘুনন্দন কর্তৃক পরিবর্ধিত ও পরিশোধিত হইয়া আজও বাঙলার সমাজ শাসন করিতেছে। এই ধর্ম ও সাংস্কৃতিক আদর্শের পশ্চাতে রাষ্ট্রের সক্রয় পোষকতা ও সমর্থন না থাকিলে একশত-দেড়শত বৎসরের মধ্যে ইহাদের এমন সমৃদ্ধ রূপ কিছুতেই দেখা যাইত না। পোষকতা ও সমর্থন যে ছিল তাহার প্রমাণ বল্লালসেন ও লক্ষ্মণসেন স্বয়ং। বল্লাল স্বয়ং আচারসাগর, প্রতিষ্ঠাসাগর, দানসাগর এবং আংশিকত অদ্ভুতসাগর এই চারিটি স্মৃতি বিষয়ক গ্রন্থের রচয়িতা। দানসাগর তিনি লিখিয়াছিলেন তাহার গুরু] অনিরুদ্ধের শিক্ষায় অনুপ্রাণিত হইয়া। অসম্পূর্ণ অদ্ভুতসাগর সম্পূর্ণ করিয়াছিলেন লক্ষ্মণসেন স্বয়ং, এবং তাহা পিতৃ নির্দেশে।

এই একান্ত ব্ৰাহ্মণ্য আদর্শের শাসন অন্যদিক দিয়াও কী করিয়া রাষ্ট্রে প্রতিফলিত হইয়াছে তাহার ইঙ্গিত আগেই করিয়াছি। এই যুগের সেন-বৰ্মণ রাষ্ট্রেই প্রথম দেখা যাইতেছে, পুরোহিত-মহাপুরোহিত, শান্ত্যাগরিক-শাস্তবারিক, তন্ত্ৰাধিকৃত প্রভৃতির রাজকর্মচারী বলিয়া গণ্য হইতেছেন। রাষ্ট্রে ব্রাহ্মণ-প্রাধান্য, ব্ৰাহ্মণধর্ম ও সংস্কৃতির প্রভাব বৃদ্ধি পাইয়াছে, এবং রাষ্ট্র ও রাজবংশ এই সংস্কৃতি বিস্তারে সচেষ্ট, ইহা কিছুতেই অস্বীকার করিবার উপায় নাই। সমাজ নিয়ন্ত্রণ রাজার কর্তব্য বলিয়া ভারতবর্ষে বরাবরই স্বীকৃত হইয়াছে; পাল-রাজারাও বর্ণাশ্রম রক্ষণ ও পালন করিয়াছেন; কিন্তু সেন-আমলে রাষ্ট্র ও রাজবংশ যেমন করিয়া দেশের সকলের দৈনন্দিন জীবনের ছোট-খাট ক্রিয়াকর্তব্য হইতে আরম্ভ করিয়া সমস্ত ধর্ম ও সমাজগত আচার ও আচরণ, পদ্ধতি ও অনুষ্ঠান নিয়ন্ত্ৰণ করিতে চেষ্টা করিয়াছিলেন, এমন সজ্ঞান সচেতন এবং সর্বব্যাপী কর্তৃত্বমূলক চেষ্টা বাঙলাদেশে ইহার আগে বা পরে আর কখনো হয় নাই। এই যুগের সর্বপ্রধান চেষ্টাই যেন হইতেছে, বাঙলার সমাজকে একেবারে নূতন করিয়া ঢালিয়া সাজা, নূতন করিয়া গড়া এবং তোহা একান্ত পৌরাণিক ব্ৰাহ্মণ্য স্মৃতি-সংস্কৃতির আদর্শনুযায়ী। সেই চেষ্টার পশ্চাতে রাষ্ট্র ও রাজবংশের পরিপূর্ণ সক্রয় সমৰ্থন; উচ্চতর বর্ণ ও শ্রেণীর লোকেরাও তাহার পোষক ও সমর্থক। এই যুগের লিপিমালা এবং ধর্মশাস্ত্ৰ-গ্রন্থগুলি পাঠ করিলে এ তথ্য যেন কিছুতেই অস্বীকার করা চলে না। কুলজী গ্রন্থমালার সাক্ষ্য, বাঙলার কৌলীন্য প্রথার সাক্ষ্য হয়তো ইতিহাসে, প্রামাণিক ও বিশ্বাসযোগ্য নয়; সে আলোচনা অন্যত্র করিয়াছি। কিন্তু, লোকস্মৃতি ও লোকেতিহাসের যদি কিছুমাত্র ঐতিহাসিক মূল্যও থাকে তাহা হইলে স্বীকার করিতে হয়, শ্যামলবৰ্মা এবং বল্লালসেনের সঙ্গেই বাঙলার প্রচলিত বর্ণ-বিন্যাস ও সামাজিক স্তন্ন-বিভাগের ইতিহাস অঙ্গাঙ্গী জড়িত। লোকস্মৃতির নীচে সাধারণত কোথাও একটা কিছু সত্য গোপন থাকে, বৰ্মণ ও সেনা-বংশের সামাজিক আদর্শ সম্বন্ধে যে অকাটা নিঃসংশয় প্রমাণ সুবিদিত, লোকস্মৃতি এই ক্ষেত্রে তাহার বিরুদ্ধাচরণ করিতেছে না। আনন্দভট্টের বল্লালচরিত-গ্ৰন্থ খুব প্রামাণিক না হইতে পারে (সে আলোচনাও অন্যত্র করিয়াছি) কিন্তু ইহার সামাজিক ইঙ্গিত একেবারে হয়তো মিথ্যা নয়। বল্লালসেন বণিকদের উপর অত্যাচার এবং সুবর্ণবণিকদের পতিত্ব’ করিয়া দিয়াছিলেন, এবং কৈবর্ত, মালাকার, কুম্ভকার ও কর্মকারদের সৎশুদ্রস্তরে উন্নীত করিয়াছিলেন বলিয়া এই গ্রন্থে যে বৰ্ণনা আছে, তাহা অক্ষরে অক্ষরে সত্য না-ও হইতে পারে, কিন্তু সেন-রাষ্ট্র ও রাজবংশের আমলে এইভাবে সমাজের বিভিন্ন স্তর নির্ণয় এবং কোন স্তরে কোন সম্প্রদায়ের স্থান ইত্যাদি নির্দেশ করা হইতেছিল, তাহা অস্বীকার করা চলে না। হয়তো তাহার পশ্চাতে রাষ্ট্রের বা রাজকীয় নির্দেশও কিছু ছিল।

এই ব্ৰাহ্মণ্যধর্ম ও সংস্কৃতির কেন্দ্র ছিল বরেন্দ্রী ও রাঢ়দেশ, এবং পরবর্তীকালে বিক্রমপুর অঞ্চল। কিন্তু বিক্রমপুর বৌদ্ধ সাধনা ও সংস্কৃতির অন্যতম কেন্দ্ৰস্থল থাকাতে সেখানে ব্রাহ্মণ্যধর্ম ও সংস্কৃতির প্রতাপ রাঢ়-বরেন্দ্রীর মতন এতটা প্রবল হইয়া উঠিতে পারে নাই। আর ত্রিপুরা-চট্টগ্রাম অঞ্চলে বৌদ্ধ সাপ্লনার প্রভাব বহুদিন পর্যন্ত প্রবল ছিল। এ-সম্বন্ধে লিপি প্রমাণ বিদ্যমান। বোধ হয়, এইজন্যই মৈমনসিংহ-ত্রিপুরা-চট্টগ্রাম-শ্ৰীহট্ট অঞ্চলে আজও ব্রাহ্মণ্য স্মৃতির শাসন অপেক্ষাকৃত শিথিল।

সেন ও বর্মণ উভয় বংশ‍ই দক্ষিণাগত; এ তথ্য সুবিদিত যে, অন্ধ-সাতবাহন আমল হইতেই দক্ষিণদেশ ব্রাহ্মণ্যধর্ম, সংস্কার ও সংস্কৃতির খুব বড় কেন্দ্র। পল্লব, চোল, চালুক্য, ইত্যাদি সকল রাজবংশই এই ধর্ম ও সংস্কৃতির পোষক, ধারক ও সমর্থক। বস্তুত, উত্তর-ভারত অপেক্ষা দক্ষিণ-ভারত এই বিষয়ে অধিকতর গোড়া, পরিবর্তন-বিবর্তন বিমুখ। শুধু আজই এইরূপ নয়; প্রাচীনকালেও তাহাই ছিল। কালঙ্গ-কৰ্ণটি হইতে বর্মণ ও সেনের সেই আদর্শ লইয়াই বাঙলাদেশে আসিয়াছিলেন, এবং রাষ্ট্রের বিপুল ও সক্রয় সমর্থন এবং রাজবংশের মর্যাদার বলে সহায়তায় সেই আদর্শ এবং তদনুযায়ী স্মৃতি ও ব্যবহার শাসন বাঙলাদেশে প্রতিষ্ঠিত করিতে চেষ্টা করিয়াছিলেন। তঁহাদের এই চেষ্টা সফল হুইয়াছিল। বাধা-বিরোধীতা তখনও হইয়াছিল, পরেও হইয়াছে; বাঙালী সমাজ পদ্ধতি ও শাসন বাঙলার সর্বত্র সমভাবে স্বীকৃত ছিল না, এখনও নাই; কিন্তু কোনও বাধাই যথেষ্ট কার্যকরী হয় নাই। আজ পর্যন্ত উচ্চতর বর্ণ ও সমাজ সেই যুগেরই স্মৃতি ও ব্যবহার-শাসন মানিয়া চলিতেছে, নিম্নতর বর্ণেরও তাঁহাই আদর্শ ও মাপকাঠি। কিন্তু, সমসাময়িক বাঙলাদেশের পক্ষে কি তাহা সার্থক ও কল্যাণকর হইয়াছিল? পরবর্তী ইতিহাসের কথা বলিব না, তাহা এই গ্রন্থের বিষয়ীভূত নহে। কিন্তু সমসাময়িককালে ইহার ঐতিহাসিক ইঙ্গিত নির্ধারণ ঐতিহাসিকের কর্তব্য।

আগের পর্বে দেখিয়াছি, পাল-যুগের সামাজিক আদর্শ ছিল বৃহত্তর সামাজিক সমন্বয় ও স্বাঙ্গীকরণ। ইতিহাসের চক্রাবর্তে বৈদিক ও পৌরাণিক ব্ৰাহ্মণ্যধর্মের যে-শ্রোত বাঙলাদেশে প্রবাহিত হইতেছিল। সেই স্রোতকে ব্রাহ্মণেতার ধর্ম ও সংস্কৃতির স্রোতের সঙ্গে মিলাইয়া মিশাইয়া ব্ৰাহ্মণ্য ধর্মেরই কাঠামো ও আদর্শনুযায়ী একটি বৃহত্তর সামাজিক সমন্বয় গড়িয়া তোলাই ছিল পাল-চন্দ্র পর্বের সাধনা। সমসাময়িক সমাজ, রাষ্ট্র ও রাজবংশের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আদর্শ তাহাই ছিল। গুপ্ত-আমল হইতে আরম্ভ করিয়া ব্ৰাহ্মণ্যধম ও সংস্কৃতির প্রভাব বাঙলাদেশে সুস্পষ্ট এবং ক্রমবর্ধমান; তখন হইতেই না হউক, অন্তত সপ্তম-অষ্টম শতক হইতে ব্ৰাহ্মণ্যধর্ম ও সংস্কৃতিই বলবত্তর; কখনো তাহা অস্বীকৃত হয় নাই। বৌদ্ধ খড়্গ বা পাল বা চন্দ্র রাজারাও তোহা করেন নাই, বরং তাহারা সেই আদর্শই মানিয়া লইয়াছেন, ব্রাহ্মণদের ভূমিদান করিয়াছেন, পুরোহিত অৰ্চিত শান্তিবারি মস্তকে গ্রহণ করিয়াছেন, ব্রাহ্মণ্য দেবদেবীর মন্দির স্থাপন করিয়াছেন, চাতুৰ্ব্বণ্য সমাজ রক্ষা ও পালন করিয়াছেন, রামায়ণ-মহাভারত-পুরাণ পাঠ শুনিয়াছেন। শুধু তাহাই নয়, পাল-যুগে ব্রাহ্মণ্য এবং বৌদ্ধ দেবদেবীদের মধ্যেও একটা বৃহৎ সমন্বয়-স্বাঙ্গীকরণ-ক্রিয়া চলিতেছিল; বৌদ্ধ ও শৈব তন্ত্রধর্ম ও চিন্তা বৌদ্ধ ও ব্রাহ্মণ্য দেবদেবীদের একটি বৃহৎ সমন্বয় সূত্রে গীথিয়া তুলিতেছিল; বৌদ্ধের অসংখ্য ব্ৰাহ্মণ্য দেবদেবীকে স্বীকার করিয়া লইয়াছিলেন; আর্যোিতর, ব্রাহ্মণেতর সংস্কৃতির দেবদেবীদের পংক্তিভূক্ত করিতেছিলেন। অন্যদিকে ব্রাহ্মণেরও বৌদ্ধ ও ব্রাহ্মণেতর, আর্যোিতর দেবদেবীদের কিছু কিছু মানিয়া লইতেছিলেন। জীবনের সকল ক্ষেত্রেই এই সমন্বয়স্বাঙ্গীকরণ ক্রিয়া সমভাবে চলিতেছিল। বর্ণ-বিন্যাস ও সামাজিক স্তরভেদের ব্যাপারেও তাহা দৃষ্টিগোচর। পাল-আমলে চণ্ডাল পর্যন্ত সকল শ্রেণী ও বর্ণের লোকেরাই রাষ্ট্রের দৃষ্টিভূত; সেন-আমলে শুধু উচ্চতর বর্ণের লোকেরাই রাষ্ট্রের দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়া আছেন। এমন কি রাষ্ট্রযন্ত্রেও ব্রাহ্মণ ও পুরোহিতদের প্রাধান্য। পাল-রাজারা চাতুৰ্ব্বণ্য সমাজ রক্ষা ও ধারণ করিয়াছেন, কিন্তু সেন ও বর্মণ রাজারা ইচ্ছামত এবং স্মৃতি-নিৰ্দেশমত চতুৰ্বর্ণের বিভিন্ন স্তর ঢালিয়া সাজাইয়াছেন। বস্তুত, পাল আমলের ধর্ম, সমাজ ও সংস্কৃতির সমন্বয় ও স্বাঙ্গীকরণের আদর্শ এই যুগে যেন একেবারে পরিত্যক্ত হইয়াছিল; সেই আদর্শের স্থানে সবলে ও সোৎসাহে তাহারা এক নূতন আদর্শ প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন। এই আদর্শ স্মৃতি-শাসিত বৈদিক ও পৌরাণিক ব্ৰাহ্মণ্যধর্ম ও সংস্কৃতির আদর্শ, সর্বপ্রকার যুগোপযোগী সমন্বয় ও স্বাঙ্গীকরণ-বিরোধী আদর্শ।

কুলজী-গ্ৰন্থধুত লোকস্মৃতির। যদি কিছু মাত্র মূল্যও থাকে, বল্লাল-চরিত গ্রন্থোক্ত-কাহিনীর পশ্চাতে যদি কোনও সত্য থাকে, তাহা হইলে স্বীকার করিতে হয়, সেন ও বর্মণ আমলে পালযুগ গঠিত বাঙলার সমাজ ও বাঙালী জাতিকে খণ্ড খণ্ড করিয়া ভাঙিয়া নূতন করিয়া গড়া হইয়াছিল। এই গড়ার মূলে কোনও সমন্বয় বা স্বাঙ্গীকরণের আদর্শ সক্রয় ছিল না। বর্ণ-বিন্যাসের দিক হইতে দেখিলে দেখা যাইবে, সমাজ বিভিন্ন স্তরে স্তরে বিভক্ত; প্রত্যেকটি স্তর সুনির্দিষ্ট সীমায় সীমিত; এক স্তরের সঙ্গে অন্য স্তরের মিলন ও আদান-প্রদানের বাধা প্রায় দুর্লঙ্ঘ্য, অন্যতিক্রম্য। মাঝে মাঝে কৃচিৎ যেখানে মিলন ও আদান-প্ৰদান হইতেছে সেখানে স্মৃতি-শাসনের ব্যতিক্রম হইতেছে, এবং এই ব্যতিক্রমগুলিও সুনির্দিষ্ট নিয়মে নিয়মিত। বৃহদ্ধর্মপুরাণ ও ব্ৰহ্মবৈবর্তপুরাণের বর্ণ-বিন্যাস ও তাহার যুক্তি, এই যুগের অসংখ্য স্মৃতি-গ্ৰস্থাদির বিবরণ ও যুক্তি পাঠ করিলে সমাজের এই স্তরভেদ কিছুতেই অস্বীকার করিবার উপায় থাকে না। সর্বোচ্চ বৰ্ণ-ব্রাহ্মণদের সঙ্গে যদি বা উত্তর সংকর বা সৎশুদ্রদের খাওয়া-দাওয়া বিষয়ে আদান-প্রদানের পথ খানিকটা উন্মুক্ত ছিল, মধ্যম সংকর ও অন্ত্যজদের সঙ্গে একেবারেই ছিল না। এক স্তরের সঙ্গে আর এক স্তরের, কিংবা একই স্তরের মধ্যে এক শাখার সঙ্গে আর এক শাখার বৈবাহিক আদান-প্ৰদান একেবারেই নিষিদ্ধ ছিল। এক একটি স্তরের মধ্যেও আবার নানা ক্ষুদ্র বৃহৎ উপস্তর; এবং সেখানেও বিভিন্ন বিচিত্র উপস্তরের মধ্যে বিচিত্র বাধা-নিষেধের প্রাচীর। এ সব সাক্ষ্য কুলজী গ্রন্থমালা বা বল্লালচরিত্যের নয়, এই যুগেরই স্মৃতি-গ্ৰস্থাদির, লিপিমালার এবং এই যুগেরই প্রতিফলন যে-সব গ্রন্থে পন্ডিয়াছে অর্থাৎ বৃহদ্ধর্মপুরাণ ও ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণের সাক্ষ্য। এবং, তাহা অস্বীকার করা কঠিন। শেষোক্ত পুরাণ দুটিতে দেখা যাইবে, ব্ৰাহ্মণদের মধ্যেই বিভিন্ন স্তর। এই সমস্ত তথ্যই বর্ণ-বিন্যাস অধ্যায়ে সবিস্তারে আলোচিত হইয়াছে; এখানে রাষ্ট্র ও রাজবৃত্ত ব্যাপারে তাহার ইঙ্গিত উল্লেখ করিতেছি মাত্র। এ-যুক্তি স্বীকার্য যে, সেনা-বর্মণ আমলে এই সব স্তরভেদ ও বিভিন্ন স্তুর উপস্তরের মধ্যে বিধি-নিষেধের প্রাচীর পরবর্তীকালের মতো সুনির্দিষ্ট, এত কঠোর হয়তো হইয়া উঠে নাই; কিন্তু রাষ্ট্র ও উচ্চতর বর্ণগুলির সামাজিক আদর্শ যে তাঁহাই ছিল এবং সেই আদৰ্শই তাহারা সবলে প্রচার করিতে আরম্ভ করিয়াছিলেন, এ-সম্বন্ধে সন্দেহের এতটুকু অবকাশ নাই। সেন-বৰ্মণ যুগের লিপিমালা এবং স্মৃতিগ্রন্থমালাই তাহার অকাট্য প্রমাণ। সমাজের এই স্তরভেদ এবং স্তরে স্তরে আদান-প্রদানের বিচিত্র বিধিনিষেধ নবগঠিত বাঙলার সমাজ ও বাঙালী জাতিকে দুর্বল ও পঙ্গু করে নাই, তাহা কে বলিবে? পরবতী কালে যে করিয়াছে তাহা তো অনস্বীকার্য, কিন্তু বাঙলাদেশ ও বাঙালী জাতির সেই শৈশবে এই ভেদবুদ্ধি ও বিভেদাদর্শ নবজাত শিশুকে বিভ্ৰান্ত করে নাই, কে বলিৰে?

বর্ণ-বিন্যাসের ক্ষেত্রে যেমন শ্রেণী-বিন্যাসের ক্ষেত্রেও তাঁহাই। কৃষক-ক্ষেত্রকর হইতে আরম্ভ করিয়া অন্ত্যজ চণ্ডাল পর্যন্ত লোকেরা তো রাষ্ট্রের দৃষ্টির অন্তর্ভুক্ত ছিল না; আর, ব্রাহ্মণেরা যে রাষ্ট্রে ক্রমশ আধিপত্য বিস্তার করিতেছিলেন, ধর্মানুষ্ঠানের কর্তারা যে ক্রমশ রাজপাদাপোজীবী হইতেছিলেন, তাহা তো আগেই বলিয়াছি। ভবদেব-ভট্টের মতন একজন পণ্ডিত ও রাষ্ট্রনায়ক ব্ৰাহ্মণদের কৃষিকার্য সমর্থনা করিয়াছেন; লিপিমালায় প্রমাণ পাইতেছি, ব্রাহ্মণের রাষ্ট্রকার্যে, সামরিক ও অন্যান্য ব্যাপারে উচ্চ রাজপদে নিযুক্ত আছেন, অথচ ভবদেবই ব্ৰাহ্মণদের পক্ষে অন্য প্রায় সকল বৃত্তিই নিষিদ্ধ বলিয়া বলিতেছেন, এমন কি অব্রাহ্মণকে শিক্ষাদান, এবং অব্রাহ্মণ্যের যাগযজ্ঞ-পূজা-অনুষ্ঠানে পৌরোহিত্য পর্যন্ত। শ্রেণীতে শ্রেণীতে বিভেদের সৃষ্টি, ভেদবুদ্ধি সৃষ্টির প্রমাণ ইহার চেয়ে আর কী থাকিতে পারে! ব্ৰাহ্মণদের পক্ষে চিকিৎসাবিদ্যার চর্চা, চিত্রবিদ্যার চর্চাও নিষিদ্ধ ছিল; যাঁহারা তাহা করিতেন তাঁহারা ‘পতিত’ হইয়াছিলেন। অথচ জ্যোতিবির্দার চর্চাও নিষিদ্ধ ছিল; দেবল ব্রাহ্মণরা তো এইজন্যই পতিত হইয়াছিলেন। অথচ ভবদেব-ভট্ট, বল্লালসেন প্রভৃতির স্বয়ং এবং আরও অনেক সমসাময়িক প্রধান প্রধান পণ্ডিত-ব্রাহ্মণ, জ্যোনিয, ফলসংহিতা, হোরাশাস্ত্ৰ ইত্যাদির চর্চা করিতেন। তাহারা তা পতিত্ব’ হন নাই! ব্রাহ্মণেতার বর্ণের পৌরোহিত্য যাঁহারা করিতেন তাহারা ঐ সব নিম্ন বর্ণের বর্ণভুক্ত হইতেন! শ্রেণী ভেদবুদ্ধির আর কী প্রমাণ প্রয়োজন? এই সব সাক্ষ্য সমস্তই সমসাময়িক। ইহার উপর বল্লাল-চরিতের সাক্ষ্য যদি প্রামাণিক হয়, তাহা হইলে স্বীকার করিতে হয়, বল্লালের সেনারাষ্ট্রকোনও না কোনও কারণে বণিকদের সমর্থন হারাইয়াছিল, এবং তাঁহারই ফলে সমাজে সুবর্ণবণিকদের পতিত হইতে হইয়াছিল। সেক-শুভোদয়ার একটি গল্পে দেখিতেছি, লক্ষ্মণসেনের এক শ্যালক, রানী বল্লভার এক ভ্রাতা কুমারদও, এক বণিক-বধুর উপর পাশবিক অত্যাচার করিতে গিয়াছিল। বণিকবধু মাধবী যে শেষপর্যন্ত রাজসভায় সুবিচার পাইয়াছিলেন তাহা শুধু তেজস্বী ব্রাহ্মণ সভাকবি ও পণ্ডিত গোবর্ধন আচার্যের জন্য। নাহিলে রাজসভায় মন্ত্রী, রাজমহিষী ও স্বয়ং রাজার যে আচরণ এই গল্পের মধ্যে প্রকাশ তাহা সেন-রাজসভার পক্ষে খুব প্রশংসনীয় নয়! বল্লালসেন যে মালাকার, কর্মকার, কুম্ভকার এবং কৈবর্তদের উন্নীত করিয়াছিলেন, এইখানেও তো শ্রেণীগত ভেদবুদ্ধির প্রমাণ সুস্পষ্ট। বৃহদ্ধর্ম ও ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণেও খিতেছি, অনেকগুলি সমৃদ্ধ ও অর্থশালী শিল্পী ও বণিক সম্প্রদায় মধ্যম সংকর ও অসৎশুদ্ৰ পর্যায়ভুক্ত এবং স্বর্ণকার ও সুবর্ণবণিকদের স্থান এই পর্যায়ে। বৌদ্ধ ধর্ম-সম্প্রদায়ের লোকেরা যে সেন-রাষ্ট্রের প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন ছিলেন না, তাহার ইঙ্গিত তো তারনাথের বিবরণীতেও খানিকটা পাওয়া যাইতেছে। তঁহাদের দোষও দেওয়া যায় না; সেন-বৰ্মণ রাষ্ট্র তো তাহাদের প্রতি শ্রদ্ধিত ও সহানুভূতিসম্পন্ন ছিল না, আর, রাষ্ট্রের সামাজিক আদর্শও বৌদ্ধস্বর্থ বিরোধী ছিল। বৰ্ণভেদবুদ্ধি এবং এই শ্রেণীভেদবুদ্ধি একত্র জড়িত হুইয়া নবগঠিত বাঙলাদেশ ও জাতিকে, সেন-রাষ্ট্রকে ভিতর হইতে দুর্বল করিয়া দেয় নাই। এ-কথাই বা কে বলিবে? সামন্ততন্ত্র এবং অস্বাভাবিকরূপে স্ফীত আমলাতন্ত্র-বিন্যস্ত সেন-বৰ্মণরাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় আদর্শে ভেদবুদ্ধির দুর্বলতা, স্থানীয় আত্ম-কর্তৃত্বের দুর্বলতা তো ছিলই, তাহার উপর বর্ণ ও শ্রেণীগত এই ভেদবুদ্ধি, সমোজাদর্শগত ভেদবুদ্ধি বৈদেশিক আক্রমণকে প্রশ্ৰয় দেয় নাই, সহজ করিয়া দেয় নাই, তাহ কে বলিবে? বিহার-ধ্বংসের কথা শুনিয়াই নবদ্বীপের প্রায় সমস্ত লোক ভয়ে আতঙ্কে পলাইয়া গিয়াছিল, রাষ্ট্রের প্রধান প্রধান উপদেষ্টা ও মন্ত্রীবর্গ লক্ষ্মণসেনকে পলায়নের পরামর্শ দিয়াছিলেন, রাজ-জ্যোতিষীরা লক্ষ্মণসেনকে বিভ্ৰান্ত করিয়াছিলেন। সমসাময়িক সামাজিক আদর্শ ও বিন্যাসের দিক হইতে দেখিলে মিনহাজ-উদ-দীনের এই সব উক্তি একেবারে মিথ্যা বলিয়া মনে হয় না। বণিকেরা বিরোধীতা করেন নাই, তাহাই বা কে বলিবে? অন্তত তাহারাও নিজেদের কর্তব্য ফেলিয়া দিয়া পলাইয়াছিলেন, মিনহাজ বলিয়াছেন। এই সব সর্বব্যাপী ভেদবুদ্ধির আচ্ছন্নতার মধ্যে লক্ষ্মণসেনের কিংবা তাহার পুত্রদের ব্যক্তিগত শৌর্যবীর্য বা সৈন্যদলের প্রতিরোধ কতটুকু কার্যকরী বইতে পারে?

শুধু তো এইখানেই শেষ নয়। আর্যোিতর ধর্মের আচারানুষ্ঠান এবং তন্ত্রধর্মের বিকৃতি এই সময় বৌদ্ধ ও ব্রাহ্মণ্য উভয় ধর্ম ও সমাজকেই স্পর্শ করিয়াছিল, এবং উভয় ধর্মেরই আচারানুষ্ঠানকে নানাপ্রকার যৌনাতিশয্যে ব্যাধিগ্রস্ত করিয়াছিল। বোধ হয়, তাহারই ফলে সমাজে, বিশেষভাবে উচ্চ বর্ণ ও শ্রেণীগুলিতে নানাপ্রকারের কাম ও যৌনবিলাস দেখা দিয়াছিল। সেনা-বর্মণ যুগের স্মৃতি ও কাব্যগ্রন্থাদি, লিপিমালা ও ধর্মানুষ্ঠানের বিবরণগুলি পাঠ করিলে এ-সম্বন্ধে আর কোনও সন্দেহ থাকে না। বস্তুত, যৌন আচার-ব্যবহারে কোনোপ্রকার শীলতা জ্ঞান এই সমাজে ছিল। বলিয়াই মনে হয় না। নাগর-সমাজে প্রায় প্রত্যেকের বাড়িতে ব্যক্তিগত উপভোগের জন্য দাসী রাখা নিয়মের মধ্যে দাঁড়াইয়া গিয়াছিল। জীমূতবাহন এবং টীকাকার মহেশ্বরের সাক্ষ্য এ-সম্বন্ধে প্রামাণিক বলিয়া স্বীকার করা যাইতে পারে। আর, সেন-আমলেই বোধ হয় দেবদাসী প্রথা বাঙলাদেশে বিস্তৃতি লাভ করে। বাঙলাদেশে এই প্রথা কল্যাণকর হয় নাই। এই প্রথা ক্রমশ যৌনাতিশয্যের দ্যোতক হইয়া উঠিয়াছিল এবং রাজরাজড়া হইতে আরম্ভ করিয়া উচ্চতর বর্ণ ও শ্রেণীর সমৃদ্ধ লোকেরা এই প্রথার আশ্রয়ে তাহাদের কাম-বাসনার চরিতার্থতা খুঁজিয়া পাইয়াছিলেন, এ-সম্বন্ধেও সন্দেহ করিবার কারণ নাই। বিজয়সেন ও ভট্ট ভবদেবী দুইজনই তাহাদের প্রতিষ্ঠিত ধর্মমন্দিরে শত শত দেবদাসী উৎসর্গ করিবার গৌরব দাবি করিয়াছেন! সুহ্মদেশে আর এক সেনরাজ (বোধ হয়, লক্ষ্মণসেন)-প্রতিষ্ঠিত মন্দিরে দেবদাসীর (বার-ব্লামা) উল্লেখ ধোয়ী কবির পবনদূত ‘কাব্যে পাওয়া যায়। সন্ধ্যাকরনদীর রামচরিতেও দেববারবনিতার উল্লেখ সুস্পষ্ট। হয়তো পালযুগেই এই প্রথা প্রবর্তিত হইয়াছিল; রাজতরঙ্গিণী-গ্রন্থে কমলা-নর্তকীর কাহিনী প্রাসঙ্গিক। কিন্তু সেন আমলে ইহার বিস্তৃতি ও সমসাময়িক কবিকণ্ঠে এই সব বাররামা-বারবনিতাদের উচ্ছা।সময় নির্লজ্জ স্তুতিগান অনস্বীকার্য। ধোয়ী এবং ভবদেব-প্রশস্তির কবি এই বারবনিতাদের উপর কবিকল্পনার অজস্ৰ মধুময় বাণী বর্ষণ করিয়াছেন। সেন-বৰ্মণরা বোধ হয়। দক্ষিণ-দেশ হইতে এই দেবদাসী প্রথার প্রবাহ নূতন করিয়া বাঙলাদেশে লইয়া আসিয়াছিলেন। সমসাময়িক বাঙলার নাগর-সমাজের যুবক যুবতীদের যে কামলীলার বিবরণ ধোয়ী কবির পবনদূতে পাওয়া যায় তাহাও খুব প্রশংসনীয় নয়, অথচ কবি তাহাকে সাধারণসমাজ জীবনের অঙ্গ বলিয়াই বর্ণনা করিয়া গিয়াছেন। বাৎস্যায়ন তাহার কামসূত্রে গৌড়-বঙ্গের রাজান্তঃপুরে কামচাতুর্যলীলার এবং নির্লজ্জ কামক্রিয়ার উল্লেখ করিয়াছেন (তৃতীয়-চতুর্থ শতক), এবং বৃহস্পতিও বলিয়াছেন যে, প্রাচ্যদেশের দ্বিজবর্ণের মেয়েরা যৌনব্যাপারে দুনীতিপরায়ণ। কিন্তু সমাজ তখনকার সেই সওদাগরী ধনতন্ত্র এবং সুগঠিত কেন্দ্রীয় রাজতন্ত্রের আমলে এত দুর্বল ছিল না, ভেদবুদ্ধি এত প্রবল ছিল না, এবং এই সব দুনীতি দ্বিজবৰ্ণ, রাজান্তঃপুর এবং অভিজাতশ্রেণী অতিক্রম করিয়া সমাজের সকল স্তরে বিস্তৃত হইয়া পড়ে নাই। পাল-আমলের শেষের দিক হইতেই তাহা দেখা দিল এবং সেন আমলে সমগ্র সমাজদেহকে তাহা কলুষিত করিয়া দিল। ব্ৰাহ্মণ শূদ্র নারীকে বিবাহ করিতে পারিত না, কিন্তু শূদ্র নারীর সঙ্গে বিবাহবহির্ভূত যৌন সম্বন্ধে তাহার বিশেষ কোনও বাধা ছিল না; নামমাত্র শাস্তিতেই সে-অপরাধ কাটিয়া যাইত, ইহাই সমসাময়িক বাঙলার স্মৃতিশাস্ত্রের বিধান! বিলাস ও আড়ম্বরাতিশয্যও এই সময় নাগরি সমাজকে গ্রাস করিয়াছিল। সন্ধ্যাকর নন্দী রামাবতী এবং ধোয়ী কবি বিজয়পুরের যে বর্ণনা দিয়াছেন তাহাতে এ-সম্বন্ধে কোনও সন্দেহ থাকে না। এই যুগের প্রস্তরশিল্পেও তাহার প্রমাণ পাওয়া যায়। পল্লবিত বাক্য, ভাবোচ্ছাসবিলাসময় কল্পনা, আড়ম্বরময় অতিশয়ৌক্তি, অলংকার প্রাচুর্য এবং লাস্যবিলাসময়, শূঙ্গাররসাবিষ্ট দৃষ্টি তো এই যুগেরই সাহিত্য ও শিল্পের বৈশিষ্ট্য! সদ্যোক্ত যৌনাতিশয্য ও কামবিলাস জনসাধারণের ধর্মানুষ্ঠানগুলিকেও স্পর্শ করিয়াছিল। শারদীয়া দুৰ্গাপূজার সময় দশমী তিথিতে শারদোৎসব নামে একটি নৃত্যগীতোৎসব প্রচলিতু ছিল। গ্রামে নগরে এই উৎসবে নরনারীর দল কর্দমলিপ্ত এবং বৃক্ষপত্ৰমাত্র পরিহিত ও অর্ধ উলঙ্গ হইয়া নানাপ্রকার যৌনক্রিয়াগত অঙ্গভঙ্গি করিয়া এবং তদ্বিষয়ক গান গাহিয়া উন্মত্ত নৃত্যে মাতিত; তাহা না করিলে নাকি দেবী ভগবতী ক্রুদ্ধা হইতেন, সমসাময়িক কালবিবেক-গ্ৰন্থ এবং প্রায় সমসাময়িক বা কিছু পরবর্তী কালিকাপুরাণে তাহা উল্লেখ করা হইয়াছে। বৃহদ্ধর্মপুরাণে এই সম্বন্ধে একটু বিধিনিষেধের বর্ণনা আছে, কিন্তু তাহা শক্তি-উপাসক বা উপাসিকার পক্ষে প্রযোজ্য নয়। তাহারা এইরূপ করিলে নাকি দেবীর সুখ উৎপাদিত হইত! যৌন অধোগতির প্রমাণ ইহার চেয়ে বেশী আর কি হইতে পারে! বসন্তে হোলক (হোলী) এবং চৈত্র মাসে কাম-মহোৎসবে প্রায় অনুরূপ অনুষ্ঠান প্রচলিত ছিল। কালবিবেক-গ্রন্থে বলা হইয়াছে, কামমহোৎসবে নানাপ্রকার যৌন অঙ্গভঙ্গি এবং জুগুন্সিতোক্তি করিয়া নৃত্যগীত করিলে কামদেবতা গ্ৰীত হন, এবং তাহার ফলে ধনপুত্রে লক্ষ্মীলাভ হয়! ইহাই বুঝি ছিল সমসাময়িক কালের বিবেক!

এইখনেই শেষ নয়। সেন-রাজসভায় কবি ও পণ্ডিতদের সমাদর ছিল খুব। বিজয়বল্লাল-লক্ষ্মণ-কেশবের রাজসভা অনেক কবিরাই অলংকৃত করিতেন; আর বল্লাল-লক্ষ্মণ এবং তাঁহার একপুত্র তো নিজেরাও ছিলেন কবি ও পণ্ডিত। বস্তুত, সেন-আমল বাঙলাদেশে সংস্কৃত সাহিত্যের সুবর্ণযুগ। এই ক্ষেত্রেও সেন-রাজাদের সামাজিক আদর্শ সক্রয়! কিন্তু, এই সংস্কৃত কাব্য-সাহিতও সমসাময়িক ঐশ্বৰ্য্য-বিলাস এবং কামবাসনার আতিশয্যা দ্বারা স্পষ্ট। জয়দেব স্বয়ং বলিতেছেন, ত্রুটিবিহীন শৃংগার কাব্য রচনায় গোবর্ধন কবির তুলনা ছিল না। আর্যা সপ্তশতীই তাহার সাক্ষ্য। আর জয়দেবের গীতগোবিন্দও তো এক হিসাবে শৃংগার কাব্যই; কামবাসনার কাব্যোচ্ছাসময় কল্পনাই তো এই কাব্যের বৈশিষ্ট্য। ষোড়শ শতকে সন্ত কবি নাভাজী দাস তাঁহার ভক্তমাল গ্রন্থে এই কাব্যকে বলিয়াছেন কোকশাস্ত্র (কামশাস্ত্র) এবং শৃংগার রসের আগার। বস্তুত, এই যুগের সর্বোৎকৃষ্ট কাব্য এবং কবিতাগুলি ঐশ্বৰ্যবিলাসে এবং যৌনকামবাসনায় মন্দির এবং মধুর। রাজসভায় বসিয়া রাজা ও পত্রমিত্রসভাসদ সকলে এই সব মদির-মধুর কাব্য উপভোগ করতেন। এই পরিবেশ ও আবেষ্টনীর সঙ্গে দেববারবনিতা ও দেবদাসীদের যে উচ্ছসময় স্তব সমসাময়িক কবিরা করিয়াছেন তাহার কোথাও কোনো অমিল নাই। এই মন্দিরমাধুর্য এবং বিলাসলালসাময় ভাবকল্পনা কি রাজসভার বাহিরেও বিস্তার লাভ করে নাই, বৃহত্তর সমাজদেহের নাড়ীতে প্রবেশ করে নাই? এই প্রসঙ্গে সভাকবি উমাপতিধরের ম্লেচ্ছ রাজার সাধুবাদ সম্বন্ধে যে শ্লোকটি আগে উদ্ধার করিয়াছি তাহার সামাজিক ইঙ্গিত, এবং সেক-শুভোদয়া কথিত কুমারদত্ত মাধবী কাহিনী আবার স্মরণ করা যাইতে পারে। সেন-রাজসভার চরিত্র ও আবহাওয়া তাহা হইতেও কতকটা বুঝা যায়। সেক-শুভোদয়ায় প্রতিপন্ন করিবার চেষ্টা হইয়াছে যে, লক্ষ্মণসেনের রাজসভার অন্যতম অলংকার, কবি, স্মার্তা পণ্ডিত, বাল্যে রাজপণ্ডিত, যৌবনে মহামন্ত্রী এবং প্রৌঢ়াবস্থায় মহার্ধর্মাধ্যক্ষ, রাজার সর্বোত্তম আবাল্য সুহৃদ হলায়ুধ মিশ্র শেখ জালাল উদ-দীন তব্রিজির খুব পক্ষপাতী হইয়া উঠিয়াছিলেন। এ-তথ্য যদি সত্য হয়, সেক-শুভোদয়ার সাক্ষ্য যদি প্রামাণিক হয় তাহা হইলে স্বীকার করিতে হয়, সেনারাষ্ট্র ও সেন রাজসভার চরিত্র বলিয়া কিছু ছিল না! সভাকবি উমাপতিধর এবং মহার্ধর্মাধ্যক্ষ হলায়ুধ মিশ্র এই চরিত্রহীনতার দুইটি দৃষ্টান্ত মাত্র! পৃথিবীর সর্বত্রই তো রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক অধোগতির এই একই চিত্র–প্রাচীন গ্রীসে, রোমে, অষ্টাদশ শতকের প্যারিসে, অষ্টাদশ শতকের কৃষ্ণনগরে, উনবিংশ শতকের প্রথমার্ধের কলিকাতায়। সে-চিত্ৰ-সামাজিক দুর্নীতির, চারিত্রিক অবনতির, মেরুদণ্ডবিহীন ব্যক্তিত্বের, কামপরায়ণ বিলাসলীলার, শৃংগাররসাবিষ্ট, অলংকারবহুল, মদির-মধুর শিল্প ও সাহিত্যের, তরল রুচি ও দেহগত বিলাসের, অতিমাত্রায় ভেদ বৈষম্যের, ব্যক্তিগত ও শ্রেণীগত বিশ্বাসঘাতকতার। একাদশ-দ্বাদশ শতকের রামাবতী, বিজয়পুর, নবদ্বীপেও সেই একই ছবি দেখিতেছিা।

উত্তর-পূর্ব ভারতের রাষ্ট্ৰীয় অবস্থাটাও এই ফাকে একটু দেখিয়া লওয়া যাইতে পারে। বখত-ইয়ার কর্তৃক বিহার-লুণ্ঠনের মিনহাজ-কথিত কাহিনী তো আগেই উল্লেখ করা হইয়াছে। এ-সম্বন্ধে বৌদ্ধ লামা তারনাথও কিছু বর্ণনা রাখিয়া গিয়াছেন। তারনাথের বর্ণনা জনশ্রুতিনির্ভর; কাজেই তঁহার সব উক্তি বিশ্বাসযোগ্য হয়তো নয়। তবু সামাজিক তথ্যের খানিকটা ইঙ্গিত এই বর্ণনার মধ্যে পাওয়া যাইতে পারে। তারনাথ বলিতেছেন, চন্দ্ৰবংশীয় (?) লবসেনের বংশধরেরা (তারনাথ কর্ণাটাগত ব্ৰহ্মক্ষত্ৰিয় সেনা-বংশের খবর নিশ্চয়ই জানিতেন না) আশি বৎসর রাজত্ব করিয়াছিলেন। মগধে এই সময় তীৰ্থিক (ব্রাহ্মণ্য) ধর্ম ক্রমশ বিস্তার লাভ করিতেছিল, এবং তাজিক (ইসলাম) ধর্মবিশ্বাসী অনেক লোকের উদয় হইতেছিল। ইহার পর গঙ্গা-যমুনার মধ্যস্থিত অস্তর্বেদিতে তুরস্কারাজ ‘চন্দ্র” (মূল তুরস্ক-নামের তিব্বতী অনুবাদ হওয়া বিচিত্র নয়; তিব্বতী পণ্ডিতেরা তো নামও অনুবাদ করিতেন) আবির্ভূত হন। তিনি অনেক সংবাদবাহী ভিক্ষুকদের মধ্যবর্তিতায় বাঙলা ও তাহার পার্শ্ববর্তী ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র তুরস্ক রাজাদের নিজের দলভুক্ত করিয়া মগধ লুণ্ঠন করিতে থাকেন এবং অনেক বৌদ্ধ আচার্যকে হত্যা করিয়া, ওদন্তপুরী ও বিক্রমশিলা বিহার ধ্বংস করেন। এই সব ও অন্যান্য বৌদ্ধবিহারের অনেক পণ্ডিত নানাদিকে পলাইয়া যাইতে বাধ্য হন, এবং তাহার ফলে মগধে বৌদ্ধধর্ম বিলুপ্ত হইয়া যায়।

তারনাথের বিবরণী হইতে মনে হয়, একদল বৌদ্ধ ভিক্ষু মুহম্মদ বখত্-ইয়ারের গুপ্তচরের কাজ করিয়াছিলেন, এবং বাঙলার সঙ্গে তাহার যোগাযোগের ব্যবস্থাও করিয়া দিয়াছিলেন। মিনহাজ ও তারনাথের বিবরণ একত্র মিলাইয়া দেখিলে মনে হয়, বিহার-বাঙলারই একদল লোক বিভীষণ-বাহিনীর কাজ করিয়াছিল। মগধে তখন পরিপূর্ণ নৈরাজ্য, কিন্তু ভিতরে ভিতরে অবস্থােটা যে অচিরেই কী হইবে তাহা সকলেই বুঝিতে পারিতেছিল। তাহা না হইলে, বিক্রমশীলা-বিহারের প্রধান মন্ত্রাচার্য রত্নরক্ষিত যে ভবিষ্যদ্বাণী করিয়াছিলেন, দুই বৎসরের মধ্যেই তাজিকেরা মগধের দুইটি বিহার ধ্বংস করিবে, এই ভবিষ্যৎদ্বাণীর কোনও অর্থই হয় না। মিনহাজ ও লক্ষণসেনের রাজজ্যোতিষীদের মুখে যে-ভবিষ্যদ্বাণীর ইঙ্গিত দিয়াছেন তাহার অর্থও এই যে, সকলেই অবস্থােটা জানিত, এবং তুরুস্ক জাতীয় মুসলমান শত্ৰুরাই যে আক্রমণ-কর্তা, তাহা জানিত। অথচ, প্রতিরোধের ব্যবস্থা তেমন কিছু হইয়াছিল, বলা যায় না। সাহাব-উদ-দীন ঘোরী দুইবার পরাজিত হইয়া তৃতীয় বারের চেষ্টায় পঞ্জাব অধিকার করিয়াছিলেন, এবং তাহাও রাজমহিষীর বিশ্বাসঘাতকায়। পরেও হিন্দুরাষ্ট্রশক্তিপুঞ্জ মুসলমান শক্তির বিরুদ্ধে কোনও সামগ্রিক প্রতিরোধ রচনা করিতে পারেন নাই। গজনীর মামুদের সফল আক্রমণের পর হইতে উত্তর-ভারতের অনেক স্থানেই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মুসলমান বসতি কেন্দ্র গড়িয়া উঠিয়াছিল বলিয়া মনে হয়। গাহড়বাল রাজ্যেও বোধহয় এই ধরনের ছোট ছোট তুরুস্ক কেন্দ্ৰ ছিল। জয়চন্দ্রের পিতামহ গাহড়বাল-রাজ গোবিন্দচন্দ্রের লিপিতে তুরুস্কদণ্ড নামে একপ্রকার করের উল্লেখ আছে; এই সব কর বোধ হয় আদায় করা হইত গাহড়বাল রােজ্যান্তৰ্গত তুরুস্ক-বাসিন্দাদের নিকট হইতে। মুহম্মদ বখতুি ইয়ারের আক্রমণের আগেই উত্তর-ভারতের বিহার পর্যন্ত যে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র তুরুস্ক-কেন্দ্র কিছু কিছু গড়িয়া উঠিয়ছিল তারনাথের বিবরণ হইতেও তাহার কিছু ইঙ্গিত পাওয়া যায়। বৌদ্ধ ভিক্ষুরা কি এই সব তুরুস্ক কেন্দ্রের সঙ্গেই বখত্-ইয়ারের যোগসাধন করিয়া দিয়াছিলেন? উত্তর-পূর্ব ভারতের এই উচ্ছঙ্খল অবস্থা কি লক্ষ্মণসেন ও তাঁহার উপদেষ্টা ও মন্ত্রীবর্গ জানিতেন না? বোধ হয় জানিতেন, কিন্তু প্ৰতিকারের অর্থাৎ সামাজিক ও রাষ্ট্ৰীয় এই নিম্নগামী প্রবাহকে রোধ করিবার মতন সাহস ও শক্তি, বুদ্ধি ও চরিত্র, দৃষ্টি ও ব্যক্তিত্ব, ইচ্ছা ও প্রবৃত্তি কাহারও ছিল না, না সেন-রাজসভায়, না বৃহত্তর সমাজে। সকলেই যেন অনিবার্য গড্ডলিকা প্রবাহে গা’ ভাসাইয়া দিয়াছিলেন।

একদিকে উত্তর-ভারতের অধিকাংশ যখন মুসলমানদের করতলগত, উত্তর-গাঙ্গেয় ভারতে, অর্থাৎ বর্তমান যুক্তপ্রদেশ [উত্তর প্রদেশ] ও বিহারে যখন রাষ্ট্ৰীয় অবস্থা প্রায় নৈরাজ্য বলিলেই চলে, তখন বাঙলাদেশের রাষ্ট্র ও সমাজ ভেদবুদ্ধিদ্বারা আচ্ছন্ন, স্তরে উপস্তরে দুর্লঙ্ঘ্য সীমায় বিভক্ত; রাজসভা চরিত্র ও আত্মশক্তিহীন; ধর্ম ও সমাজ বিলাসালালসায় ও যৌনাতিশয্যে পীড়িত; শিল্প ও সাহিত্য বস্তুসম্বন্ধবিচু্যত ভাবকল্পনার জগতে পল্লবিত বাক্য, উচ্ছসময় অত্যুক্তি, আলংকারিক আতিশয্য এবং দেহগত লীলাবিলাসে ভারগ্রস্ত ও মন্দির; জনসাধারণের দেহ,মন বৌদ্ধ বজ্ৰযান-সহজযান প্রভৃতির এবং তান্ত্রিক সিদ্ধাচার্য-ডাকিনী-যোগিনীদের অলৌকিক ক্রিয়াকাণ্ড তুকতাকে পঙ্গু; উচ্চতর বর্ণসমাজ ব্রাহ্মণ্য পুরোহিততন্ত্র এবং ব্রাহ্মণ্য রাষ্ট্রের সর্বময় কর্তৃত্বে আড়ষ্ট। রাষ্ট্ৰীয় ও সামাজিক অধোগতির চিত্র সম্পূৰ্ণ; উভয় চরিত্রে ও আত্মশক্তিতে দুর্বল ও দৈন্যপীড়িত। এই দুর্বল ও দৈন্যপীড়িত রাষ্ট্র ও সমাজ ভাঙিয়া পড়িবে, এবং সমাজ-প্রকৃতির নিয়মে পরবর্তীকালে শতাব্দীর পর শতাব্দী ব্যাপিয়া দেশ তাহার মূল্য দিয়া যাইবে, ইহা কিছু বিচিত্র নয়। বখত্-ইয়ারের নবদ্বীপ-জয় এবং এক শত বৎসরের মধ্যে সমগ্ৰ বাঙলাদেশ জুড়িয়া মুসলমান রাজশক্তির প্রতিষ্ঠা কিছু আকস্মিক ঘটনা নয়, ভাগ্যের পরিহাসও নয়, রাষ্ট্রীয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধোগতির অনিবার্য পরিণাম!

মুসলমান অভ্যুদয়ের অব্যবহিত পূর্বের ভারতীয় বুদ্ধি ও সংস্কৃতির অবস্থার কথা বলিতে গিয়া প্রসিদ্ধ উর্দুভাষী মুসলমান কবি হালি বলিয়াছেন :

ইধর হিন্দ মে হরক্তরক অন্ধেরা।
কি থা গিয়ান গুণক লড়াইয়াসে ডরা ৷

বাস্তবিকই হিন্দুস্থানে তখন চারদিকে অন্ধকার!