০৭. পলায়ন

লায়ন

মাৎস্যন্যায় হইতে রক্ষা পাইবার জন্য বাঙলার প্রকৃতিপুঞ্জ যাঁহাকে রাজা নির্বাচন করিয়াছিল সেই গোপালদেব ছিলেন দায়িতবিষ্ণুর পুত্র এবং বপ্যটের পৌত্র। সমসাময়িক যুগসুলভ পৌরাণিক বংশ মর্যাদায় নিজেদের কৌলীন্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা পাল অধিপতিদের কাহারও দেখা যায় না; বস্তুত, পাল রাজাদের দলিলপত্রে অথবা রাজসভায় রচিত কোনও গ্রন্থেই সে ‘চেষ্টা নাই। খালিমপুর লিপিতে তিনটি মাত্র শ্লোকে ধর্মপালের বংশ পরিচয়; প্রথম শ্লোকটিতে দয়িতবিষ্ণুর উল্লেখ, দ্বিতীয় শ্লোকে বপ্যাটের; তৃতীয় শ্লোকে বলা হইয়াছে মাৎস্যন্যায় দূর করিবার অভিপ্ৰায়ে প্রকৃতিপুঞ্জ গোপালকে রাজলক্ষ্মীর কর গ্রহণ করাইয়াছিলেন, অর্থাৎ রাজা নির্বাচন করিয়াছিল। তাহারই পুত্র ধর্মপাল।

অভ্যুদয় ৷ বংশ পরিচয় ৷ পিতৃভূমি

এই প্রকৃতিপুঞ্জ কাহারা? প্রকৃতির অভিধানগত অর্থ প্ৰজা। কিন্তু বাঙলার তৎকালীন সমস্ত প্ৰজাবৰ্গ অর্থাৎ জনসাধারণ সম্মিলিত হইয়া গোপালকে রাজা নির্বাচন করিয়াছিলেন, এমন মনে হয় না। কেহ কেহ মনে করেন, প্রকৃতি অর্থ রাষ্ট্রের প্রধান প্রধান কর্মচারী এবং গোপালকে রাজা নির্বাচন তাহারাই করিয়াছিলেন। এই মতও সমর্থনযোগ্য নয়। কারণ, সেই নৈরাজ্যের যুগে বাঙলাদেশে পরস্পর বিবদমান অনেকগুলি রাষ্ট্রের আধিপত্য; কোন রাষ্ট্রের প্রধান কর্মচারীরা একত্র হইয়া এই নির্বাচন করিয়াছিলেন? একটি কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রের ব্যাপারে হইলে হয়তো এইরূপ নির্বাচন সম্ভব হইতে পারিত যেমন একবার কাশ্মীরে হইয়াছিল তৃতীয় শতকে জলৌকের ক্ষেত্রে। সমস্ত প্রজাবর্গের সম্মিলিত নির্বাচনও সেই নৈরাজ্যের যুগে সম্ভব ছিল না; তাহা হইলে বিভিন্ন রাষ্ট্রের সমস্ত—লনায়কদের সঙ্গে প্রজাবর্গের একটা প্রবল বিরোধের ইঙ্গিত কোথাও পাওয়া যাইত। বরং মনে হয়, এই সামস্ত—নায়কেরাই বহু বৎসর নৈরাজ্য ওঁ মাৎস্যন্যায়ে উৎপীড়িত হইয়া শেষ পর্যন্ত সকলে একত্র হইয়া এই নির্বাচন কার্যটি নিম্পন্ন করিয়াছিলেন। এই সামান্তু-বনায়কদের এবং সামন্তুতন্ত্রের কথা তো আগেই একাধিকার ইঙ্গিত করিয়াছি; ইহঁদের প্রভাব ও প্রতিষ্ঠা যে কম ছিল না, তাহাও বলিয়াছি। দেশে কেন্দ্রীয় রাষ্ট্র যখন বিদ্যমান তখনই সামন্ত-নায়কদের সংখ্যা অনেক ও নৈরাজ্য ও মাৎস্যন্যায়ের পর্বে কেন্দ্রীয় রাষ্ট্র যখন দুর্বল হইয়া বা ভাঙিয়া পড়িয়াছে তখন ইহাদের সংখ্যা আরও বাড়িয়াই গিয়াছে। বস্তুত, দেশ জুড়িয়া ছোট বড় এই সামন্ত-নায়কেরাই তখন দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। ইহারা যখন দেশকে বারবার বৈদেশিক শত্রুর হাত হইতে আর বাঁচাইতে পারিলেন না, শান্তি ও শৃঙ্খলা বজায় রাখিতে পারিলেন না, তখন একজন রাজা এবং একটি কেন্দ্রীয় রাষ্ট্র গড়িয়া তোলা ছাড়া বঁচিবার আর পথ ছিল না। ইহারাই গোপাল-নির্বাচনের নায়ক। যাহা হউক, এই শুভবুদ্ধির ফলে বাঙলাদেশ নৈরাজ্যের অশান্তি ও বিশৃঙ্খলা এবং বৈদেশিক শত্রুর কাছে বারবার অপমানের হাত হইতে রক্ষা পাইল। শুধু বাঙলার ইতিহাসে নয়, সমগ্ৰ ভারতবর্ষের ইতিহাসেই এই ধরনের শুভ সামাজিক বুদ্ধি এবং রাষ্ট্ৰীয় চেতনার দৃষ্টান্ত বিরল। পাল রাজাদের লিপিতে এবং সন্ধ্যাকর নদীর রামচরিতে এই নির্বাচন কাহিনীর সংক্ষিপ্ত উল্লেখ আছে বটে, কিন্তু ভারতীয় সাহিত্যে কোথাও তাহা যথােচিত কীর্তন ও মর্যাদা লাভ করে নাই। তবে, লোকস্মৃতিতে ইহার গৌরব ও উদ্দীপনা যোড়শ শতক পর্যস্ত জাগ্রত ছিল, তাহার, প্রমাণ তারনাথের বিবরণীতে পাওয়া যায়।

খ্ৰীষ্টীয় অষ্টম শতকের মাঝামাঝি কোনও সময় গোপালদেব পাল বংশের প্রতিষ্ঠা করেন এবং দ্বাদশ শতকের তৃতীয় পাদে গোবিন্দপালের সঙ্গে সঙ্গে এই বংশের বিলয় ঘটে। সুদীর্ঘ চারিশত বৎসর ধরিয়া নিরবচ্ছিন্ন একটি রাজবংশের রাজত্ব খুব কম দেশের ইতিহাসেই দেখা যায়। গোপালদেবের কুলগৌরব কিছু ছিল বলিয়া মনে হয় না, তেমন দাবিও কোথাও করা হয় নাই। হয়তো তিনিও একজন অন্যতম সামন্ত-নায়ক ছিলেন। অষ্টসাহস্ত্ৰিক প্রজ্ঞাপারমিতার হরিভদ্রকৃতটীকায় ধর্মপালকে “রাজভটাদিবংশপতিত” বলিয়া উল্লেখ করা হইয়াছে; খালিমপুর লিপির “ভদ্রাত্মজা” শব্দ কেহ কেহ ধৰ্মপালের মাতা দেদাদেবীর বিশেষণ বলিয়া মনে করিয়াছেন। এই দুই পদের অর্থ লইয়া পণ্ডিত মহলে মতভেদের অtyনাই। মোটামুটি চেষ্টাটা হইয়াছে পালবংশের রাজকীয় আভিজাত্য প্রমাণের দিকে। কিন্তু এই দুইটি পদের একটিও নিঃসংশয়ে তেমন কিছু ইঙ্গিত করে না। তৃতীয় বিগ্রহপালের মন্ত্রী বৈদ্যদেবের কমৌলি লিপিতে পাল রাজাদের সূর্যবংশীয় বলা হইয়াছে; সোঢ়ঢ়ল কবির উদয়সুন্দরীকথায় পালরাজাদের সূর্যবংশীয় মান্ধাত পরিবার-সস্তুত বলা হইয়াছে। এই সব দাবির মূলে কোনও সত্য আছে কিনা সন্দেহ। সন্ধ্যাকর নদীর রামচরিতে, ধর্মপালকে বলা হইয়াছে “সমুদ্রকুলদীপ”; তারনাথও ধর্মপালের সঙ্গে সমুদ্রের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের ইঙ্গিত করিয়াছেন। ঘনরামের ধর্মমঙ্গল কাব্যেও সমুদ্রের সঙ্গে ধর্মপাল মহিষীর একটা সম্পর্কের ইঙ্গিত আছে। সমুদ্রাশ্রয়ী ও জলনিধিদুগনির্ভর গৌড়জনদের সঙ্গে অথবা সামুদ্রিক ও সমুদ্রাশ্রয়ী আদি-অষ্ট্রেলীয়-পলিনেশীয় নরগোষ্ঠীর সঙ্গে বাঙলার পাল বংশের কোনও সম্বন্ধের ইঙ্গিত এই সব কাহিনীর সঙ্গে জড়িত থাকা অসম্ভব নয়। সুপ্রাচীন বাঙলাদেশে, বাঙালীর জাতিতত্ত্ব ও ভাষায় এই নরগোষ্ঠীর দানের কথা তো আগে বিস্তৃতভাবেই উল্লেখ করিয়াছি। রামচরিতে এবং তারনাথের ইতিহাসে পাল রাজাদের ক্ষত্ৰিয়ত্বের দাবি উপস্থিত করা হইয়াছে; এ-দাবি কিছু অস্বাভাবিক নয়, কারণ ভারতীয় আর্য-ব্রাহ্মণ্য স্মৃতিতে রাজা মাত্রেই ক্ষত্ৰিয়। ইহার ঐতিহাসিক বর্ণগত ভিত্তি কিছু না-ও থাকিতে পারে। মঞ্জুশ্ৰীমূলকল্প গ্রন্থে পালবংশকে বলা হইয়াছে “দাসজীবিনঃ”। আবুল ফজল বলিয়াছেন “কায়স্থ”। যাহা হউক, উপরোক্ত সাক্ষ্য-প্রমাণ হইতে এ তথ্য পরিষ্কার যে, ইহারা উচ্চতর বংশ বা বর্ণসভূত নহেন, এমন কি আর্য-ব্রাহ্মণ্য স্মৃতি ও সংস্কারের উত্তরাধিকারের দাবি পরোক্ষেও কোথাও তাহারা করেন নাই। সমসাময়িক রাজবংশের ইতিহাসে এই ধরনের দৃষ্টান্ত বিরল।

সন্ধ্যাকর নদী সুস্পষ্ট বলিতেছেন, পালরাজাদের জনকভূমি বরেন্দ্রদেশ। ভোজদেবের গোয়ালিয়র লিপিতে পাল-রাজ (ধর্মপাল)-কে বলা হইয়াছে বঙ্গপতি। ইহারা যে বাঙালী ছিলেন এ সম্বন্ধে সন্দেহ করিবার এতটুকু কারণ নাই। মনে হয়, ইহাদের আদিভূমি বরেন্দ্ৰভূমি এবং সেখানেই গোপাল কোনও সামন্ত-নায়ক ছিলেন; রাজা নির্বাচিত হইবার পর তিনি বঙ্গদেশেরও রাজপদে প্রতিষ্ঠিত হন এবং বোধ হয়, গৌড়েরও। তারনাথ ঠিক এই কথাই বলিতেছেন : পুণ্ড্রবর্ধনের কোনও ক্ষত্ৰিয়বংশে গোপালের জন্ম, কিন্তু পরে তিনি ভঙ্গলের (= বঙ্গল বা বঙ্গালের) রাজা নির্বাচিত হন।

গোপালদেব বরেন্দ্রী ও বঙ্গে বাজা হইয়াই দেশে অন্য যত “কামকারী” বা যথেচ্ছপরায়ণশক্তি রা সামস্ত বা নায়কেরা ছিলেন তাহদের দমন করেন এবং বোধ হয়, সমগ্র বাঙলাদেশে আপনি প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠিত করেন। এই প্ৰভুত্ব প্রতিষ্ঠা সম্ভব হইয়াছিল বহু সামন্ত-নায়কের সহায়তায় সন্দেহ নাই; এই সামন্ত-নায়কেরাই তো স্বেচ্ছায় তাহাকে তাহাদের অধিরাজ নির্বাচন করিয়াছেন।

ধর্মপাল ৷ আঃ ৭৭৫-৮১০ ৷ সাম্রাজ্য-বিস্তার

গোপালদেবের পুত্র ধর্মপাল সিংহাসন আরোহণ করিবার সঙ্গে সঙ্গে উত্তর ভারতের আধিপত্য লইয়া গুর্জরপ্রতীহার-রাষ্ট্ৰকুট-পালবংশে বংশপরম্পরাবিলম্বিত এক তুমুল সংগ্রাম আরম্ভ হইয়া গেল। এই যুগে উত্তর-ভারতাধিপত্যের প্রতীক ছিল কানীজ-রাজলক্ষ্মী বা মহোদয়শ্রীর অধিকার। গুর্জরপ্রতীহার বংশের কেন্দ্ৰভূমি গুর্জরত্র ভূমি (রাজস্থান); রাষ্ট্রকুটেরা চালুক্য বংশের অধিকার লইয়া দাক্ষিণাত্যের অধিপতি; আর, গোপালদেবের উত্তরাধিকার লইয়া ধর্মপাল সমগ্র বাঙলাদেশের সর্বময় রাষ্ট্রনায়ক। ধর্মপালের সাম্রােজ্যালিন্সা পশ্চিমমুখী, বৎসরাজের পূর্বমুখী। এই সময় উত্তর ভারতে আর কোনও পরাক্রান্ত রাষ্ট্র ও রাজবংশ না থাকাতে এই রাজচক্রবর্তীত্বের সংঘর্ষ প্রথম আরম্ভ হইল ধর্মপাল (আঃ ৭৭৫-৮১০) ও প্ৰতীহাররাজ বৎসরাজের (আঃ ৭৭৫-৮০০) মধ্যে। ধর্মপাল পরাজিত হইলেন এবং হয়তো আরও পর্যুদস্ত হইতেন, কিন্তু দক্ষিণ হইতে রাষ্ট্রকূটরাজ ধ্রুব (আঃ ৭৮১-৭৯৪) একেবারে গাঙ্গেয় উপত্যকায় ঝড়ের মতন আসিয়া পড়িয়া প্রথমে বৎসরাজ এবং পরে ধর্মপাল উভয়কেই পরাজিত করিলেন। বৎসরাজ রাজস্থানের পথহীন মরুভূমিতে পলাইয়া গেলেন; কিন্তু ধ্রুব দাক্ষিণাত্যে ফিরিয়া যাওয়াতে ধর্মপালের বিশেষ কিছু অসুবিধা আর হইল না। তিনি অবাধে এবং নির্বিবাদে তাহার রাজ্যবিস্তারে মনোনিবেশ করিলেন এবং স্বল্পকালের মধ্যে ভোজ (বর্তমান বেরারের অংশ, প্রাচীন ভোজকটক), মৎস্য (আলওয়ার এবং জয়পুর-ভরতপুরের অংশ), মদ্র (মধ্য-পাঞ্জাব), কুরু (পূর্ব-পঞ্জাব), যদু (বোধ হয় পঞ্জাবের সিংহপুর, যাদব রাষ্ট্র), যবন (বোধ হয়, পাঞ্জাব বা উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের কোনও আরব খণ্ডরাষ্ট্র), অবন্তী (বর্তমান মালব), গন্ধার (পশ্চিম-পঞ্জাব) এবং কীর (পঞ্জাবের কাংড়া জেলা) রাজ্য জয় করেন। এই সাম্রাজ্য বিস্তার চক্রেই তিনি কনৌজ বা মহোদয়শ্রীর অধিপতি ইন্দ্ররাজ (ইন্দ্ৰায়ুধ)-কে পরাজিত করেন এবং সেই সিংহাসনে অধিষ্ঠিত করেন চক্রায়ুধকে। কনৌজে চক্রায়ুধের অভিষেকের সময় উপরোক্ত বিজিত রাজ্যের রাজারা ধর্মপালের নিকট “প্ৰণতি পরিণত” হন। এই দিগ্বিজয়চক্ৰ উপলক্ষেই তাহার সৈন্য-সামন্তরা কেদার, গোকৰ্ণ ও “গঙ্গাসমেতাম্বুধি’তে তীর্থপূজাক্রিয়া ইত্যাদি সমাপন করিয়াছিলেন। কেদার (হিমালয়সানুতে গাড়োয়াল জেলায়) এবং গোকর্ণের (নেপাল রাজ্যে বাগমতী নদীর তীরে) উল্লেখ দেখিয়া মনে হয় ধর্মপাল নেপালও জয় করিয়াছিলেন; স্বয়ন্ত্রপুরাণে তো স্পষ্টই বলা হইয়াছে, গৌড়রাজ ধৰ্মপাল নেপালেরও অধিপতি ছিলেন। ধর্মপালের মুঙ্গের লিপির একটি শ্লোকে হিমালয়ের সানুদেশ ধরিয়া ধৰ্মপালের সমারাভিযানের একটু ইঙ্গিতও আছে। কেহ কেহ মনে করেন “গঙ্গাসমেতাম্বুধি” স্থানটিও নেপালেই। হয়তো এই নেপালের অধিকার লইয়াই তিব্বতরাজ মু-তিগ-বৎসন-পো’র সঙ্গে ধর্মপালের সংঘর্ষ হইয়া থাকিবে, কারণ নেপাল এই সময় তিব্বতের অধীন ছিল। পঞ্চগৌড়াধিপ। ধর্মপাল যে উত্তর ভারতের প্রায় সর্বাধিপত্য লাভ করিয়াছিলেন তাহা গুর্জররাষ্ট্রবাসী সোঢ়ঢ়ল কবির উদয়সুন্দরীকথাতেও (একাদশ শতক) স্বীকৃত হইয়াছে; এই গ্রন্থে ধর্মপালকে বলা হইয়াছে “উত্তরাপথস্বামী”। যাহা হউক, এই সব বিজিত রাজা ধর্মপালের সর্বাধিপত্য স্বীকার করিয়াছিলেন, সন্দেহ নাই; কিন্তু, ধর্মপাল ইহাদের তঁহার গৌড়-বঙ্গ-মগধধূত কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রের অন্তর্গত করেন নাই; স্ব স্ব রাজ্যে ইহাদের রাজারা স্বাধীন নরপতি রূপেই স্বীকৃত হইতেন, কিন্তু ধর্মপালের বশ্যতা ও আনুগত্য স্বীকার করিতে হইত। কিন্তু, ইতিমধ্যে বৎসরাজ পুত্র দ্বিতীয় নাগভট প্ৰতীহার-সিংহাসন আরোহণ করিয়াছেন এবং সিন্ধু, অন্ধ, কলিঙ্গ ও বিদর্ভ রাজ্যের সঙ্গে মৈত্রী বন্ধনে আবদ্ধ হইয়া পূর্ব পরাজয়ের প্রতিশোধ লইতে কৃতসংকল্প হইয়াছেন। প্রথমেই কনৌজ আক্রান্ত হইল এবং চক্রায়ুধ পরাজিত হইয়া ধৰ্মপালের নিকট পলাইয়া গেলেন। নাগভট পূর্বদিকে অগ্রসর হইতেছিলেন, এমন সময় মুদগগিরি বা মুঙ্গেরের নিকট এক তুমুল সংগ্রাম হইল। ধৰ্মপাল পরাজিত হইলেন, কিন্তু এবারও রাষ্ট্রকূট-রাজ তৃতীয় গোবিন্দ আসিয়া নাগভটকে একেবারে পরাজিত ও পযুদস্ত করিয়া দিলেন এবং এই পরাক্রান্ততর নরপতির কাছে ধর্মপাল ও চক্রায়ুধ দুইজনেই স্বেচ্ছায় নতি স্বীকার করিলেন। কিন্তু গোবিন্দ আবার দাক্ষিণাত্যে স্বরাজ্যে ফিরিয়া গেলেন এবং ধর্মপাল আবার রাহুমুক্ত হইলেন। এই সাময়িক নতি স্বীকার সত্ত্বেও ধর্মপালের মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত উত্তর ভারতে তাহার সর্বময় আধিপত্য ক্ষুন্ন হইয়াছিল, এমন কোনও সাক্ষ্য উপস্থিত নাই। তঁহার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী প্ৰতীহার রাষ্ট্র দুই দুইবার পর্যুদস্ত হইয়া শীর্ণ ও দুর্বল হইয়া পড়িয়াছিল, আর রাষ্ট্রকুটেরা দুই দুইবার জয়ী হওয়া সত্ত্বেও উত্তর-ভারতে রাজ্যবিস্তারের সচেতন চেষ্টা বোধ হয় করেন নাই। যাহা হউক, ধর্মপাল-পুত্র দেবপালের সিংহাসন আরোহণের কালে রাজ্যে কোথাও কোনও যুদ্ধবিগ্রহ বা অশান্তি কিছু ছিল না বলিয়াই মনে হয়।

দেবপাল ৷ আঃ ৮১০-৮৪৭ ৷৷

ধর্মপালের পুত্র দেবপাল (আঃ ৮১০-৮৪৭) রাজা হইয়া পিতৃ-আদর্শনুযায়ী পাল সাম্রাজ্য বিস্তারে মনোযোগী হইলেন। তাহা ছাড়া উপায়ও ছিল না; প্ৰতীহার ও রাষ্ট্রকুটেরা তখনও প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী; আরও নিকট উৎকল ও প্ৰাগজ্যোতিষ (কামরূপ)। তখন নিজ নিজ রাজবংশের অধীনে পরাক্রান্ত রাষ্ট্র গড়িয়া তুলিয়াছে; দূরে দক্ষিণে পাণ্ডারাও প্রবল হইয়া উঠিতেছে। এমন সময়ে স্বীয় রাজ্য ও রাষ্ট্র বজায় রাখিতে হইলেও বাধ্য হইয়া আক্রমণমুখী হওয়া ছাড়া অন্য উপায়ই বা কী? তাহা ছাড়া, উত্তর ভারতাধিপত্যের আদর্শ তখনও উত্তর ভারতের রাষ্ট্ৰক্ষেত্রে সক্রয়। মৌর্য ও গুপ্ত যুগের আদর্শ ছিল সর্বভারতের একরাট হওয়া; হর্ষবর্ধন-পরবর্তী রাষ্ট্ৰীয় আদর্শ “সকলোত্তরপথনাথ” বা “সকলোত্তর পথস্বামী” হওয়া। নবম শতক পর্যন্তও এই আদর্শ উত্তর ভারতে সক্রয় ও প্রায় সর্বব্যাপী, এই আদর্শ অনুসরণে দেবপালের সহায়ক হইলেন পর পর তাহার দুই প্রধান মন্ত্রী : ব্রাহ্মণ দৰ্ভপাণি ও তাহার পৌত্র কেদারমিশ্র। লিপিমালার সাক্ষ্য এই যে, এই দুই মন্ত্রীর সহায়তায় দেবপাল হিমালয় হইতে বিন্ধ্য পর্যন্ত এবং পূর্ব হইতে পশ্চিম সমুদ্রতীর পর্যন্ত সমস্ত উত্তর ভারত হইতে কর ও প্ৰণতি আদায় করিয়াছিলেন; কুণ-উৎকল- দ্রাবিড়-গুর্জরনাথদের দৰ্প খর্ব করিয়া তিনি সমুদ্রমেখলা রাজ্য ভোগ করিয়াছিলেন; তাহার এক সমরনায়কের (খুল্লতাত ভ্ৰাতা জয়পাল) সহায়তায় তিনি উৎকল-রাজকে রাজ্য ছাড়িয়া পলাইতে এবং প্ৰাগজ্যোতিষ-রাজকে বিনা যুদ্ধে আত্মসমৰ্পণ করাইতে বাধ্য করিয়াছিলেন। তাহার বিজয়ী সমারাভিযান তাহাকে উত্তর পশ্চিমে কম্বোজ এবং দক্ষিণে বিন্ধ্য পর্যন্ত লইয়া গিয়াছিল। দেবপাল, দেবপালের মন্ত্রী ও সমরনায়কদের এই দাবি খুব মিথ্যা বলিয়া মনে হয় না। যুণরাষ্ট্র (উত্তরাপথে হিমালয়ের সানুদেশে), কম্বোজ, উৎকল ও প্ৰাগজ্যোতিষ রাজ্য ধর্মপালবিজিত সাম্রাজ্যের প্রত্যন্ত সীমায় অবস্থিত; কাজেই দেবপাল কর্তৃক এই সব রাজ্য নিজ সাম্রাজ্যভুক্ত করিবার চেষ্টা স্বাভাবিক। গুর্জররাষ্ট্র ও প্ৰতীহারিদের এবং প্ৰতীহারিদের সঙ্গে পালদের সংগ্রামের সূচনা ও পরিণতি কতকটা ধর্মপালের সাম্রাজ্যবিস্তার উপলক্ষেই আমরা দেখিয়াছি। নাগভটের সঙ্গে দেবপালের কোনও সংগ্রাম হইয়াছিল বলিয়া মনে হয় না; তঁহার পুত্র রামভদ্রও উল্লেখযোগ্য নরপতি ছিলেন না। কিন্তু রামভদ্রপুত্র ভোজ প্ৰতীহারিদের হৃতগৌরব অনেকটা উদ্ধার করিয়াছিলেন; এবং বোধ হয় ভোজদেবের সঙ্গেই দেবপালের সংঘর্ষ উপস্থিত হইয়াছিল। এই সংঘর্ষে ভোজদেব জয়ী হইতে পারেন নাই; কিছুদিন পর রাষ্ট্রকূট-রাজের কাছেও তিনি পরাজিত ও পর্যুদস্ত হন। যে-দ্ৰাবিড়নাথকে দেবপাল পরাজিত করিয়াছিলেন বলিয়া দাবি করিয়াছেন, তিনি বোধ হয় রাষ্ট্ৰকুট-রাজ অমোঘবর্ষ। কেহ কেহ মনে করেন, এই দ্রাবিড়নাথ হইতেছেন। পাণ্ডারাজ শ্ৰীমার শ্ৰীবল্লব, কিন্তু তাহার স্বপক্ষে যুক্তি দুর্বল। যাহা হউক, এই তথ্য সুস্পষ্ট যে, দেবপাল ধর্মপালের সাম্রাজ্য আরও বিস্তৃত করিয়াছিলেন এবং হিমালয়ের সানুদেশ হইতে আরম্ভ করিয়া অন্তত বিন্ধ্য পর্যন্ত এবং উত্তর-পশ্চিমে কম্বোজদেশ হইতে আরম্ভ করিয়া প্ৰাগজ্যোতিষ পর্যন্ত তাহার আধিপত্য স্বীকৃত হইত। সেতুবন্ধ রামেশ্বর পর্যন্ত এক সমারাভিযানের ইঙ্গিত মুঙ্গের লিপিতেও আছে; ইহার সত্যতা সম্বন্ধে নিশ্চয় করিয়া কিছু বলা কঠিন, কারণ, রাজসভাকবির অত্যুক্তি বলিয়াই মনে হয়। দেবপালের সময়েই পালসাম্রাজ্য সর্বাপেক্ষা বিস্তৃতি লাভ করিয়াছিল। আরব-দেশী বণিক ও পর্যটক সুলেমান এই সময় (৮৫১) যি কয়েকবারই ভারতবর্ষে আসা-যাওয়া করিয়াছিলেন। তাহার বিবরণীতে দেখা যাইতেছে, পালরাজ গুর্জর-প্ৰতীহারও রাষ্ট্রকূটদের সঙ্গে সংগ্রামরত ছিলেন। তাহার সৈন্যদলে ৫০,০০০ হাজার হাতি ছিল এবং সৈন্যদলের সাজসজ্জা ও পোষাক পরিচ্ছদ ধোওয়া, গুছানো ইত্যাদি কাজের জন্যই ১০ হইতে ১৫ হাজার লোক নিযুক্ত ছিল। ধর্মপালের সাম্রাজ্যে যেমন, দেবপালের সময়ও তেমনই বিজিত রাজ্যের রাজারা স্ব স্ব রাষ্ট্রে স্বাধীন বলিয়া গণ্য হইতেন; কেন্দ্রীয় রাজ্য ও রাষ্ট্রের অন্তর্গত ঘৃতাহারা ছিলেন না, যদিও দেবপালের সর্বময় আধিপত্য তাহাদের স্বীকার করিতে হইত।

সাম্রাজ্যের বিলয় ৷ আঃ ৮০০—৯৮৮ ॥ নারায়ণ পাল ৷ আঃ ৮৬১-৯১৭ ৷৷

দেবপালের মৃত্যুর (আঃ ৮৪৭) কিছুদিন পর হইতেই পালবংশের সাম্রাজ্য-গৌরবসূর্য পশ্চিমাকাশে হেলিয়া পড়িতে আরম্ভ করে। যে-সাম্রাজ্য প্রায় শতাব্দীর তিনপাদ ধরিয়া প্রধানত ধর্মপাল ও দেবপালের চেষ্টা ও উদ্যমে গড়িয়া উঠিয়াছিল, তাহা প্রথম বিগ্ৰহপাল (আঃ ৮৬০-৬১) হইতে আরম্ভ করিয়া দ্বিতীয় বিগ্রহপালের রাজত্বের মধ্যে (আঃ ৯৭২-৭৭) স্ট্রীরে ধীরে ভাঙিয়া পড়িল। প্রথম বিগ্রহপাল দেবপালের পুত্র ছিলেন না; দেবপালের সমরনায়ক বাকপাল বোধ হয় ছিলেন তাহার পিতা। দেবপালের পুত্র থাকা সত্ত্বেও এই উত্তরাধিকার পরিবর্তন কেন হুইয়াছিল। বলা কঠিন; তবে, ইহার মধ্যে কেহ কেহ পারিবারিক অনৈক্যের হেতু বিদ্যমান বলিয়া মনে করেন। হয়তো পাল-সাম্রাজ্যের শক্তিহীনতা এবং অস্তবিরোধও অন্যতম কারণ হইতে পারে। এই অনুমান কতটা ঐতিহাসিক বলা কঠিন, তবে মোটামুটি ইহা যুক্তিসিদ্ধ { বিগ্রহপালের অন্য নাম শুরপাল; তিনি ধর্মনিষ্ঠ ধর্মাচরণরত নৃপতি ছিলেন বলিয়া মনে হয়; পুত্ৰ নারায়ণপালকে সিংহাসন অৰ্পণ করিয়া তিনি ধর্মাচরণোদেশে বানপ্রস্থ অবলম্বন করেন। নারায়ণপাল (আঃ ৮৬১-৯১৭) অন্যান ৫৪ বৎসর রাজত্ব করিয়াছিলেন; কিন্তু এই সুদীর্ঘ রাজত্বকালে বাঙলার গৌরবের হেতু হইতে পারে নাই। সম্ভবত, এই সময়ই রাষ্ট্ৰকুট-রাজ অমোঘবর্ষ একবার অঙ্গ-বঙ্গ-মগধে বিজয়ী সমারাভিযান প্রেরণ করিয়াছিলেন; উড়িষ্যার শুন্ধিরাজ মহারাজাধিরাজ রণস্তম্ভও বোধ হয়। এই সময়ই রাঢ়ের কিয়দংশ জয় করেন। প্ৰতীহাররাজ ভোজদেবও নারায়ণপালের রাজত্বকালেই প্রায় মগধ পর্যন্ত সমস্ত পালসাম্রাজ্য অধিকার করেন এবং কলচুরীরাজ গুণাম্বোধিদেব এবং গুহিলোট্র-রাজ দ্বিতীয় গুহিল ভোজদেবের এই বিজয়ের অংশীদার হন। এই সময়ই বোধ হয় ডাহািলরাজ প্রথম কোকল্পদেবী (৮৪০-৮৯০) বঙ্গরাজ্যভাণ্ডার লুণ্ঠন করেন। ভোজদেকের পুত্ৰ প্ৰতীহার মহেন্দ্ৰপাল পাটনা এবং গয়া পার হইয়া একেবারে পুণ্ড্রবর্ধনের পাহাড়পুর অঞ্চল-পর্যন্ত প্ৰতীহার-সাম্রাজ্য বিস্তৃত করেন। মহেন্দ্ৰপালের পঞ্চম রােজ্যাঙ্কের একটি লিপি পাহাড়পুরের ধ্বংস্তুপের মধ্যে পাওয়া গিয়াছে। মহেন্দ্ৰপাল বেশি দিন উত্তরবঙ্গ ও বিহার ভোগ করিতে পারেন নাই বলিয়া মনে হয়; নারায়ণপাল তঁহার মৃত্যুর পূর্বে বঙ্গ-বিহার পুনরাধিকার করিয়াছিলেন, এ-সম্বন্ধে লিপি-প্রমাণ বিদ্যমান। প্ৰতীহারিদের কতকটা খর্ব করা সম্ভব হইলেও রাষ্ট্ৰকুট-রাজ দ্বিতীয় কৃষ্ণের নিকট নারায়ণপালকে বোধ হয় কিছুটা আনুগত্য স্বীকার করিতে হইয়াছিল। দেওলিতে প্রাপ্ত এক শাসনে কৃষ্ণ গৌড়বাসীদের বিনয় শিক্ষা দিয়াছিলেন এবং অঙ্গ-বঙ্গ-কলিঙ্গ-মগধে তাহার আদেশ মান্য ও স্বীকৃত হইত, এই বলিয়া দাবি করা হইয়াছে। পিঠাপুরমের এক লিপিতে কৃষ্ণা জেলার বেলনাণ্ডুর এক রাজা বঙ্গ, মগধ এবং গৌড়দের পরাজিত করিয়াছিলেন বলিয়া দাবি করিতেছেন; এই রাজা হয়তো দ্বিতীয় কৃষ্ণৈর সমরাভিযানের সঙ্গে আসিয়া এই সব দেশজয়ে কিছু অংশ গ্রহণ করিয়া থাকিবেন। দেবপালের সময়ে উৎকল ও কামরূপ দেবপালের আধিপত্য স্বীকার করিয়াছিলেন, কিন্তু নারায়ণপালের কালে রাজা মাধববর্মী শ্ৰীনিবাসের নেতৃত্বে (আঃ ৮৫০)। শৈলোদ্ভব বংশ উড়িষ্যায় এবং রাজা হর্জর ও পুত্ৰ বনমালের নেতৃত্বে কামরূপ প্রবল পরাক্রান্ত হইয়া উঠে।

নারায়ণপালের পুত্র রাজ্যপাল (আঃ ৯১৭-৫২) এবং পৌত্র দ্বিতীয় গোপালের (আঃ ৯৫২-৯৭২) রাজত্বকালে পাল-সাম্রাজ্য অন্তত মগধ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। কিন্তু দ্বিতীয় গোপালের পুত্র দ্বিতীয় বিগ্রহপালের আমলে মগধের অধিকার বোধ হয় পালবংশের কারচু্যত হইয়া থাকিবে। প্ৰতীহার ও রাষ্ট্রকূটভয় এই সময় আর ছিল না বটে, কিন্তু উত্তর-ভারতে চন্দেল্ল ও কলচুরী এই দুই রাজবংশ এই সময় প্রবল পরাক্রান্ত হইয়া উঠে। চন্দেল্লরাজ যশোবর্মা “লতারূপ গৌড়দের তরবারী স্বরূপ” ছিলেন, এবং তাঁহার পুত্র ধঙ্গা (আঃ ৯৫৪—১০০০) রাঢ়া এবং অঙ্গের রাজমহিষীদের কারারুদ্ধ করিয়াছিলেন। কাব্যিক ভাষার আশ্রয় ছাড়িয়া দিলে বুঝা যায়। এই দুই চন্দোল্ল নরপতি গৌড়, অঙ্গ এবং রাঢ়দেশকে সমরে পযুদস্ত করিয়াছিলেন। কলচুরীরাজ প্রথম যুবরাজ (আঃ দশম শতকের প্রথম পদ) গৌড়-কর্ণাট-লাট কাশ্মীর-কলিঙ্গকামিনীদের লইয়া নাকি কেলি করিয়াছিলেন অর্থাৎ এই সব দেশে সমরাভিযান প্রেরণ করিয়াছিলেন, এবং তাহার পুত্ৰ লক্ষ্মণরাজ (আঃ দশম শতকের দ্বিতীয় ও তৃতীয় পাদ) বঙ্গালদেশ জয় করিয়াছিলেন। এই সব ক্ৰমান্বয় পরাজয় ও সামরিক বিপর্যয় পাল-সাম্রাজ্যের এবং রাষ্ট্রের সামরিক ও রাষ্ট্ৰীয় দৈন্য সূচিত করে, সন্দেহ নাই। চন্দোল্ল ও কলচুরী লিপিমালায় গৌড়-অঙ্গ-রাঢ়া-বঙ্গালের পৃথক পৃথক উল্লেখ হইতেও মনে হয় বাঙলাদেশেও পালরাজ্য বিভিন্ন জনপদ রাষ্ট্রে বিভক্ত হইয়া পড়িবার দিকে ঝোক স্পষ্ট হইয়া উঠিয়াছে। অন্তত রাঢ়া অঞ্চল ও বঙ্গালদেশে যে স্বতন্ত্র স্বাধীন রাষ্ট্র গড়িয়া উঠিয়াছে। এ-সম্বন্ধে সুস্পষ্ট লিপি-প্রমাণ বিদ্যমান। বস্তুত, বাণগড়-লিপিতে সুস্পষ্ট উল্লেখ আছে যে, দ্বিতীয় বিগ্রহপালের রাজত্বকালে পাল-রাজ্য “অনধিকৃতবিলুপ্ত” হইয়া গিয়াছিল।

রাঢ়া-গৌড়ের কম্বোজাধিপত্য

বাণগড়-লিপির এই উক্তি মিথ্যা নয়। এই সময় উত্তর ও পূর্ববঙ্গে কম্বোজ নামক এক রাজবংশ প্রবল হইয়া উঠে। দিনাজপুর-স্তম্ভলিপিতে এক কম্বোজান্ধয় গৌড়পতির উল্লেখ আছে। ইর্দা-তাম্রপট্টে এই “কম্বোজান্ধয় গৌড়পতি”দের, তথা “কম্বোজকুলতিলক”-দের কয়েকজন রাজার খবর পাওয়া যায়। লিপিটি কম্বোজবংশীয় রাজ্যপাল-ভাগ্যদেবীর পুত্র এবং নারায়ণপালদেবের কনিষ্ঠভ্রাতা পরমেশ্বর পরমভট্টারক মহারাজাধিরাজ শ্ৰীজয়পালের ত্রয়োদশ রােজ্যাঙ্কের এবং এই লিপি দ্বারা জয়পাল বর্ধমানভুক্তিতে কিছু ভূমিদান করিয়াছিলেন। স্পষ্টতই ‘বুঝা যায়, পশ্চিমবঙ্গের অস্তুত কিয়দংশ এবং বোধ হয় উত্তরবঙ্গেরও কিয়দংশ কম্বোজকুলতিলকদের করায়ত্ত হইয়াছিল। ইহাদের রাষ্ট্রকেন্দ্র ছিল প্রিয়ঙ্গু নামক স্থানে; স্থানটি কোথায় এখনও জানা যায় নাই। ইর্দাপট্টকথিত রাজ্যপাল ও পালরাজ রাজ্যপাল এক এবং অভিন্ন কিনা ইহা লইয়া পণ্ডিত মহলে প্রচুর তর্কবিতর্ক আছে। এক হইলে স্বীকার করিতে হয়, রাজ্যপালের পর বাঙলার পালরাজ্য দ্বিধা বিভক্ত হইয়া গিয়াছিল; এক এবং অভিন্ন না হইলে স্বীকার করিতে হয়, কম্বোজবংশীয় রাজ্যপাল পালরাষ্ট্রের দৈন্য এবং দীর্ধলোর সুযোগ লইয়া রাঢ়া-গৌড়ে নিজ বংশের প্রভুত্ব স্থাপন করিয়াছিলেন। এই কম্বোজাদের আদিভূমি কোথায় তাহা লইয়াও বিতর্কের অন্ত নাই। কেহ কেহ বলেন, ইহারা উত্তর-পশ্চিম-সীমান্তের কম্বোজদ্দেশাগত; কেহ কেহ বলেন, কম্বোজ দেশ তিব্বতে; আবার কাহারো মতে পূর্ব-দক্ষিণ ভারতের কম্বুজ (Combodia) এই কম্বোজদেশ। পাগ-সাম-জোন-জাং নামক তিব্বতী গ্রন্থে লুসাই পৰ্ব্বতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে এক কম-পো-ৎসা-বা কম্বোজ দেশের উল্লেখ দেখিতে পাওয়া যায়। এই কম-পোৎস এবং বাণগড় ইর্দা-লিপির কম্বোজ এক এবং অভিন্ন হওয়া কিছু বিচিত্র নয়।

পূর্ব ও দক্ষিণবঙ্গও এই সময় পাল-বংশের কারচুপ্ত হইয়া গিয়াছিল। হরিকেল অঞ্চলে মহারাজাধিরাজ কান্তিদেব (আঃ দশম শতকের প্রথমার্ধ) নামে এক বৌদ্ধ রাজার খবর পাওয়া যায় চট্টগ্রামের একটি তাম্র-পট্টোলীতে। ইহার রাষ্ট্রকেন্দ্র ছিল বর্ধমানপুর। এই বর্ধমানপুরের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমানের কোনও সম্পর্ক আছে বলিয়া মনে হয় না। বর্ধমানপুর শ্ৰীহট্ট-ত্রিপুরা-চট্টগ্রাম অঞ্চলে বোধ হয় কোনও স্থান হইবে।

ত্রিপুরা জেলার ভারেল্লা গ্রামে প্রাপ্ত নটেশ শিবের এক প্রস্তর মূর্তির পাদপীঠে লহয়চন্দ্র (আঃ দশম শতকের শেষার্ধ) নামে এক রাজার নাম পাওয়া যায়। বোধ হয় ত্রিপুরা অঞ্চলেই তাহার আধিপত্য বিস্তৃত ছিল। লহয়চন্দ্ৰ অন্তত ১৮ বৎসর রাজত্ব করিয়াছিলেন (আঃ দশম শতকের তৃতীয় পাদ)।

ঢাকা জেলার রামপাল ও ধুল্লা, ফরিদপুর জেলার ইদিলপুর এবং কেদারপুর অঞ্চলে প্রাপ্ত চারিটি লিপি হইতে এক চন্দ্র রাজবংশের চারিজন রাজার খবর পাওয়া যাইতেছে : পূৰ্ণচন্দ্র, পুত্র সুবৰ্ণচন্দ্ৰ, মহারাজাধিরাজ ত্ৰৈলোক্যচন্দ্ৰ (পত্নী শ্ৰীকাঞ্চনা) এবং পুত্ৰ মহারাজাধিরাজ শ্ৰীচন্দ্ৰ, সুবৰ্ণচন্দ্ৰ হইতে আরম্ভ করিয়া সকলেই বৌদ্ধধর্মশ্রিয়ী। ত্ৰৈলোক্যচন্দ্র ও শ্ৰীচন্দ্ৰ হরিকেলে অধিপতি ছিলেন এবং চন্দ্ৰদ্বীপ (বাখরগঞ্জ জেলা) ছিল তাঁহাদের রাষ্ট্রকেন্দ্র। লিপি-প্রমাণ হইতে মনে হয়, শ্ৰীহট্ট, ত্রিপুরা, ঢাকা ও ফরিদপুর অঞ্চল। ইহাদের রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল।

বঙ্গে-বঙ্গালে চন্দ্ৰাধিপত্য

গোবিন্দচন্দ্ৰ নামে আর একজন চন্দ্রাস্ত্যনামা রাজার নাম জানা যায় চোলরাজ রাজেন্দ্ৰ চোলের তিরুমালয়-লিপি হইতে (১০২১)। ইনি বঙ্গলদেশের অধিপতি ছিলেন। লহয়চন্দ্র এবং গোবিন্দচন্দ্রের সঙ্গে পূর্ণচন্দ্রের বংশের কোনও সম্বন্ধ ছিল। কিনা বলা যায় না; তবে, দশম শতকের প্রথমার্ধ হইতে আরম্ভ করিয়া একাদশ শতকের দ্বিতীয় পাদ পর্যন্ত পূর্ব ও দক্ষিণ-বঙ্গের অন্তত কিয়দংশ পালবংশের রাজসীমার বাহিরে ছিল, এ-সম্বন্ধে সন্দেহ করিবার কোনও কারণ নাই। বোধ হয়, চন্দ্ৰবংশীয় রাজাদের এবং গোবিন্দচন্দ্ৰকে যথাক্রমে কলচুরীরাজ এবং অন্তত একজন চোলরাজের পরাক্রান্ত সৈন্যবাহিনীর সম্মুখীন হইতে হইয়াছিল। কলচুরীরাজ কোক্কল্প একবার বঙ্গরাজের রাজকোষ লুণ্ঠন করিয়াছিলেন; লক্ষ্মণরাজ একবার বঙ্গালরাজকে পরাজিত করিয়াছিলেন; কর্ণােদব একবার বঙ্গরাজ্য আক্রমণ করিয়া প্রাচ্যদেশের রাজাকে যুদ্ধে নিহত করিয়াছিলেন বলিয়া দাবি করিয়াছেন। চোলরাজ রাজেন্দ্ৰচোল কর্তৃক রাজা গোবিন্দচন্দ্রের বঙ্গাল দেশ জয় সুবিদিত।

সাম্রাজ্য পুনরুদ্ধারের চেষ্টা

দ্বিতীয় বিগ্রহপালের পুত্র প্রথম মহীপালের (আঃ ৯৭৭-১০২৭) প্রথম ও প্রধান কীর্তি “অনধিকৃতবিলুপ্ত পিতৃরাজ্য” পুনরুদ্ধার। সমস্ত বঙ্গদেশেই তো পালরাষ্ট্রের কারচু্যত হইয়া গিয়াছিল এবং পাল-রাজ্য মগধাঞ্চলেই কেন্দ্রীভূত হইয়া গিয়াছিল। মহীপাল হৃত উত্তর ও পূর্ববঙ্গ পুনরুদ্ধার করিলেন। ত্রিপুরা জেলায় তাহার তৃতীয় ও চতুর্থ রােজ্যাঙ্কের লিপি আবিষ্কৃত হইয়াছে; লিপি দুইটি বীলকীন্দক গ্রামবাসী (দবিদা থানার বাইলকান্দি গ্রাম?) দুই বণিক কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত একটি বিষ্ণু ও একটি গণেশমূর্তির পাদপীঠে উৎকীর্ণ। দিনাজপুর জেলায় বাণগড়ে প্রাপ্ত নবম রাজ্যাঙ্কের আর একটি লিপি তাহার উত্তর-বঙ্গাধিকারের প্রমাণ। উত্তর-বিহার বা অঙ্গদেশে মহীপালের লিপি পাওয়া গিয়াছে; মনে হয় মহীপাল এই দেশও পুনরুদ্ধার করিয়াছিলেন। মগধ তো পিতৃ-অধিকারে ছিলই; সারনাথে একটি এবং নালন্দায় দুইটি মহীপালের রােজ্যাঙ্কের লিপিও পাওয়া গিয়াছে। পশ্চিম ও দক্ষিণ-বঙ্গ তিনি পুনরাধিকার করিয়াছিলেন বলিয়া প্রত্যক্ষ প্রমাণ কিছু নাই, তবে, রাজেন্দ্রচোলের তিরুমালয়-লিপির সাক্ষ্যে মনে হয়, পশ্চিমবঙ্গের অন্তত কিয়দংশে তাহার আধিপত্য স্বীকৃত হইত। রাজেন্দ্ৰচোল গঙ্গা হইতে পুণ্য তীর্থবারি। আনিয়া নিজের রাজ্যভূমি পবিত্রকরণোদেশে উত্তর-পূর্বভারতে সেনাবাহিনী প্রেরণ করিয়াছিলেন (১০২১—১০২৩)। ওডডবিষয় (উড়িষ্যা) এবং কোসলৈ নাড়ু (দক্ষিণ-কৌশল) জয়ের পর তাহার সেনাবাহিনী ধর্মপালকে পরাজিত করিয়া তণ্ডাবুক্তি (দণ্ডভুক্তি) অধিকার করেন; রণশ্বরকে পরাজিত করিয়া তককণলাড়ম (দক্ষিণ-রাঢ়)। অধিকার করেন; রাজা গোবিন্দচন্দ্রকে পলায়মান করিয়া বিরামহীন বৃষ্টিস্নাত বঙ্গলদেশ অধিকার করেন; তুমুল যুদ্ধে মহীপালকে ভীতিসন্ত্রস্ত করিয়া নারী, ধনরত্ন এবং পরাক্রান্ত হস্তী অধিকার করেন এবং মুক্তাপ্রসূ বিস্তৃত সমুদ্রতীরশায়ী উত্তিরল্যাড়ম (উত্তর রাঢ়) অধিকার করেন। স্পষ্টই দেখা যাইতেছে। এই সময় দণ্ডভুক্তি, দক্ষিণ-রাঢ় এবং বঙ্গালদেশ স্বতন্ত্র এবং স্বাধীন নরপতির অধীন। কেবল উত্তর-রাঢ় মহীপালের অধীন বলিয়া মনে হইতেছে, তাহা না। হইলে মহীপাল এবং উত্তর-রাঢ় বিজয় লিপিটিতে এইভাবে উল্লিখিত হইত না। যাহাই হউক। রাজেন্দ্ৰ চোলের দিগ্বিজয় সাম্রাজ্যবিস্তার বলিয়া মনে হয় না, উদ্দেশ্য তাহা ছিল না; যে-ভাবেই হউক তঁহার এই দিগ্বিজয় স্থায়ী হয় নাই বলিয়াই মনে হয়। রাজত্বের শেষদিকে পুনর্বিজিত সাম্রাজ্যের কিয়দংশ আবার বোধ হয় মহীপালের কারচ্যুত হইয়াছিল। ১০২৬ খ্ৰীষ্টাব্দের পরে কোনও সময়ে কলচুরীরাজ গাঙ্গেয়দেব অঙ্গদেশ জয় করিয়াছিলেন বলিয়া গোহারবা-লিপিতে দাবি করা হইয়াছে। ১০৩৪ খ্ৰীষ্টাব্দে আহমদ জিয়লতিগিন যখন বারাণসী আক্রমণ করেন, তখন বারাণসী কলচুরীরাজ গাঙ্গেয়দেবের অধীন ছিল।

মহীপাল ও সমসাময়িক ভারতবর্ষ ৷ মহীপাল, আঃ ৯৭২-১০২৭ ৷৷

বহু আয়াসে অনেক বৎসরের অবিরত সংগ্রামের পর মহীপাল শুধু যে পিতৃরাজা পনরুদ্ধার করিয়াছিলেন তাঁহাই নয়, বিলুপ্ত সাম্রাজ্যেরও অস্তুত বৃহদংশের উদ্ধার সাধন করিয়া পাল-বংশের লুপ্ত গৌরবও খানিকটা ফিরাইয়া আনিয়াছিলেন। সারনাথের অনেক জীর্ণ বিহার ও মন্দিরের সংস্কার, নূতন বিহার-মন্দিরের প্রতিষ্ঠা, বুদ্ধগয়াবিহারের সংস্কার ইত্যাদি সাধনের ফলে আন্তর্জাতিক বৌদ্ধজগতেও বাঙলাদেশ। কতকটু, তাহার স্থান ফিরিয়া পাইয়াছিল। পনরুত্থানের চেষ্টা ও অভ্যাসে বাঙালীর দেশ ও রাষ্ট্র আত্মগৌরব এবং প্রতিষ্ঠা খুঁজিয়া পাইয়াছিল; সেই জন্যই বাঙালীর লোকসম্মুতি মহীপালের গানে মহীপালকে ধারণ করিয়া রাখিয়াছে; লোকে আজও “ধান ভানতে মহীপালের গীত ভুলে নাই; মহীপালী-যোগীপাল-ভোগী।পালের গান তঁহাদের কণ্ঠে। রংপুর জেলার মাহীগঞ্জ (মহীগঞ্জ), বগুড়া জেলার মহীপুর, দিনাজপুর জেলার মহীসন্তোষ, মুর্শিদাবাদ জেলার মহীপাল, দিনাজপুর জেলার মহীপালদীঘি, মুর্শিদাবাদ জেলার (মহীপালের) সাগরদীঘি প্রভৃতি নগর ও দীঘিকা এখনও এই নৃপতির স্মৃতি বহন করিতেছে। মহীপালের সমগ্র রাজ্যকাল কাটিয়াছিল। পিতৃরাজ্য পুনরুদ্ধারে, সাম্রাজ্যের হৃত অংশ ও গৌরব পুনঃপ্রতিষ্ঠার চেষ্টায় এবং রাজ্যের অভ্যন্তরীণ শাপ্তি ও শৃঙ্খলা পুনঃস্থাপনে। বোধ হয়, এই জন্যই তিনি এই সময়ে পঞ্জাবের শাহী রাজারা গজনীর সুলতান মামুদের বিরুদ্ধে যে সমবেত হিন্দুশক্তিসংঘ গড়িয়া তুলিতেছিলেন, মহীপাল তাঁহাতে যোগদান করিতে পারেন নাই। সমসাময়িক হিন্দু-শক্তিপুঞ্জ পশ্চিমদিকে সুলতান মামুদের পৌনঃপুনিক আক্রমণে বিব্রত ও বিপর্যস্ত ছিলেন বলিয়াই বোধ হয় মহীপালের পক্ষে হৃত সাম্রাজ্য পুনরুদ্ধার অস্তুত আংশিকত সম্ভব হইয়াছিল। মহীপালের স্বপক্ষে যুক্তি আরও দেওয়া যাইতে পারে; তিনি হয়তো ভাবিয়াছিলেন, স্বাধীন পরাক্রাপ্ত এবং সুশৃঙ্খল একটি রাষ্ট্রের পক্ষেই দুর্ধর্ষ নূতন বৈদেশিক অভিযাত্রীদের বাধা দেওয়া সম্ভব, বিচিত্র ও দুর্বল খণ্ড খণ্ড রাষ্ট্রের সম্মিলিত শক্তিপুঞ্জের পক্ষে নয়। হয়তো এই ভাবিয়াই তিনি তাহার রাষ্ট্র ও সাম্রাজ্য পুনর্গঠনের দিকে, এক কথায় বৈদেশিক অভিযাত্রীদের বিরুদ্ধে কঠিনতর প্রতিরোধ-প্রাচীর গড়িয়া তুলিবার দিকে মনঃসংযোগ করিয়াছিলেন। এই দৃষ্টিভঙ্গিকে অযৌক্তিক কিছু বলিতেছি না, কিন্তু ইহা যথার্থ বস্তুনিষ্ঠ ঐতিহাসিক দৃষ্টি কিনা, এ-সম্বন্ধে বোধ হয় সন্দেহ করা চলে। মহীপাল বোধ হয় বুঝিতে পারেন। নাই যে, একাধিক সামাজিক ও অর্থনৈতিক কারণেই উত্তর-ভারতের রাষ্ট্রব্যবস্থা ভাঙিয়া পড়িতেছিল এবং বিভিন্ন রাষ্ট্ৰপুঞ্জ একে একে পশ্চিমাগত মুসলিম অভিযাত্রী কর্তৃক পরাজিত ও পযুদস্ত হইতেছিল। ভারতের সামগ্রিক রাষ্ট্রীয় ঐক্যের আদর্শের স্থলে স্থানীয় প্রাদেশিক সচেতনতার উত্তরোত্তর বৃদ্ধি দেখা দিতেছিল; অষ্টম শতকের সূচনা হইতেই ভারতের সমৃদ্ধ বৈদেশিক বাণিজ্যে আরব ও পারসিক বণিকেরা বৃহৎ অংশীদার হইতে আরম্ভ করিয়াছিলেন; ভারতের রাষ্ট্রীয় ও বাণিজ্যিক কেন্দ্র ক্রমশ উত্তর-ভারত হইতে দক্ষিণ-ভারতে হস্তান্তরিত হইতেছিল; আর্য-ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির আদর্শবাদ ক্রমশ রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্রের প্রধান সহায়ক উচ্চতর বর্ণ ও শ্রেণীগুলির স্বচ্ছ বাস্তব সামাজিক দৃষ্টিকে আচ্ছন্ন করিয়া দিতেছিল। এই সব কারণে বিস্তুত তথ্যগত বিশ্লেষণ করিয়া দেখাইবার স্থান এখানে নয়, তবে মোটামুটি বলা যায়, অষ্টম শতকের সূচনা হইতেই এই সব সামাজিক ও অর্থনৈতিক কারণ সক্রয় হইতে আরম্ভ করে এবং ভারতের সমাজে ও রাষ্ট্রে ইহাদের অনিবার্য। ফলের সূচনা দেখা দেয়। মহীপাল কিংবা উত্তর ও দক্ষিণ-ভারতের কোনও রাষ্ট্রই এ-সম্বন্ধে যথেষ্ট সচেতন ছিলেন বলিয়া মনে হয় না; রাষ্ট্ৰক্ষেত্রে যে রাষ্ট্রীয় আদর্শের প্রেরণা মৌর্য বা গুপ্তসাম্রাজ্য গড়িয়াছিল, সেই আদর্শ সক্রয় থাকিলে বৈদেশিক অভিযাত্রী প্রতিরোধ অনেকটা সহজ হইত, কিন্তু এই যুগে আর তাহা ছিল না। তবু, পঞ্জাবের শাহী রাজারা সেই আদর্শে উদ্ধৃদ্ধ হইয়া দেশের সমগ্র রাষ্ট্রশক্তিতে ঐক্যবদ্ধ করিয়া একটি প্রতিরোধ রচনার চেষ্টা করিয়াছিলেন; ভারতবর্যের সমসাময়িক ইতিহাসে ভারতীয় রাষ্ট্রপুঞ্জের ইহাই ছিল ঐতিহাসিক কৰ্তব্য। মহীপাল এই সামগ্রিক ঐক্যাদর্শ দ্বারা অনুপ্রাণিত হন নাই এবং সমসাময়িক ঐতিহাসুিক কৰ্তব্য পালন করেন নাই। স্থানীয় প্রান্তিক আত্মকর্তৃত্বের আদর্শই তাহার কাছে বড় হইয়া দেখা দিয়াছিল, এই ঐতিহাসিক সত্য অস্বীকার করা যায় না। সেই ক্রমবর্ধমান আপদের সম্মুখে ভারতীয় ইতিহাসের সামগ্রিক আদৰ্শই স্মর্তব্য, স্থানীয় আত্মকর্তৃত্বের বা পাল-সাম্রাজ্যের আদর্শ নয়। সেই সুবৃহৎ বিপদের সম্মুখে পাল-সাম্রাজ্যের আদর্শ সমগ্ৰ ভারতবর্ষের ঐতিহাসিক কৰ্তব্যের কাছে ক্ষুদ্র। তবে, এ-সম্বন্ধে শুধু মহীপালকেই দায়ী করা চলে না, দক্ষিণ-ভারতের রাষ্ট্রকূট ও চোলেরা এবং উত্তর-ভারতের দু’একটি রাষ্ট্র সমান দায়ী। রাষ্ট্রকুটেরা তো এই সব বৈদেশিক অভিযাত্রীদের সহায়তাই করিয়াছিলেন। বস্তুত, অষ্টম শতক হইতেই রাষ্ট্ৰক্ষেত্রে স্থানীয় প্রান্তিক আত্মকর্তৃত্বের যে আদর্শ বলবত্তর হইতেছিল। সেই আদর্শই ইহার জন্য দায়ি। অন্যান্য সামাজিক ও অর্থনৈতিক কারণ তো ছিলই। মহীপাল যোগদান করিলেই যে হিন্দু শক্তিপুঞ্জের চেষ্টা সার্থক হইত, তাহা বলা যায় না; সে-সম্ভাবনা বরং কমই ছিল। কী হইলে কী হইত, এই আলোচনা করিয়া ইতিহাসে লাভ কিছু নাই; কী কারণে কী হুইয়াছে এবং কী হয় নাই, তাহাঁই ইতিহাসে আলোচ্য। তথ্য এই যে, মহীপাল সমবেত শক্তিসংঘে যোগ দেন নাই।

মহীপাল গৌড়তন্ত্রের, তথা পাল-সাম্রাজ্যের পুনরুদ্ধারে অনেকটা সার্থকতা লাভ করিয়াছিলেন, সন্দেহ নাই; কিন্তু এই পুনরুদ্ধার স্থায়ী হওয়া সম্ভব ছিল না। নারায়ণপালের সময় হইতেই পাল-সাম্রাজ্যের যে ভগ্নদশা আরম্ভ হইয়াছিল এবং দ্বিতীয় বিগ্রহপালের সময় যে চরম অবনতি দেখা দিয়াছিল, মহীপাল তাহা রোধ করিয়া পূর্ব গৌরব অনেকটা ফিরাইয়া আনিলেন সত্য, কিন্তু মহীপালের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই আবার সেই রাজ্য ও রাষ্ট্র ধীরে ধীরে ভাঙিয়া পড়িতে আরম্ভ করিল। ভাঙন—রোধের চেষ্টা যে কিছু হয় নাই তাহা নয়, কিন্তু কোনও চেষ্টাই সফল হয় নাই! হওয়া সম্ভব ছিল না। যে রাষ্ট্ৰীয় ও সামাজিক কারণের ইঙ্গিত আগে করিয়াছি তাহা বঙ্গ-বিহারের পক্ষেও সত্য ছিল; স্থানীয় আত্মকর্তৃত্বের রাষ্ট্রীয় আদর্শ বাহির ও ভিতর হইতে ক্রমাগতই পাল-রাজ্য ও রাষ্ট্রকে আঘাত করিতে আরম্ভ করিল এবং সেই আঘাতে রাজ্য ও রাষ্ট্র ক্রমশ দুর্বল হইয়া পড়িল। তাহা ছাড়া, আভ্যন্তরীণ অন্যান্য সামাজিক কারণও ছিল; যথাস্থানে তাহা বলিতে চেষ্টা করিব। এই সব কারণ সম্বন্ধে রাষ্ট্রের সচেতনতা যে খুব বেশি ছিল, মনে হয় না। সেই জন্য রাজা ও রাষ্ট্র গঠন এবং রক্ষার চেষ্টার ত্রুটি না হইলেও সমাজ-ইতিহাসের অমোঘ নিয়মের ব্যতিক্রম হইল না; ভাঙনের গতি মন্থর হইল বটে, কিন্তু তাহা রোধ করা সম্ভব হইল না।

ভগ্নদশা

মহীপালের পুত্র নয়পালের (আঃ ১০২৭-১০৪৩) রাজত্বকালে কলচুরীরাজ কর্ণ বা লক্ষ্মীকর্ণের যুদ্ধ হয়, কিন্তু তিব্বতী সাক্ষ্য হইতে মনে হয়, এই যুদ্ধ জয়-পরাজয়ে মীমাংসিত হয়। নাই। দীপঙ্কর-শ্ৰীজ্ঞানের (অতীশ) মধ্যস্থতায় দুই রাষ্ট্রের মধ্যে একটা সন্ধি-শাস্তির প্রতিষ্ঠায় এই যুদ্ধ পরিণতি লাভ করিয়াছিল। কিন্তু, নয়পালের পুত্র তৃতীয় বিগ্রহপালের রাজত্বকালে (আঃ ১০৪৩-৭০) কর্ণ বোধ হয়। দ্বিতীয়বার বাঙলাদেশ আক্রমণ করেন এবং অন্তত বীরভূম পর্যন্ত অগ্রসর হন। বীরভূমের পাইকোর গ্রামে একটা প্রস্তরস্তম্ভের উপর কর্ণের একটি লিপি খোদিত আছে। এই দ্বিতীয় আক্রমণের পরিণতিই বোধ হয় তৃতীয় বিগ্রহপাল এবং কর্ণ-কন্যা যৌবনশ্ৰীীর বিবাহ। বঙ্গে এই সময় চন্দ্ৰ বা বর্মারা রাজত্ব করিতেছিলেন এবং কর্ণ প্রথমবারের আক্রমণে ইহাদেরই একজন রাজাকে পরাজিত করিয়া থাকিবেন।

লক্ষ্মীকর্ণের হাত হইতে উদ্ধার সম্ভব হইলেও পশ্চিমবঙ্গ বোধ হয় বেশি দিন। আর পাল-সাম্রাজ্যভুক্ত থাকে নাই। মহামাণ্ডলিক ঈশ্বর ঘোষ নামে এক সামন্তরাজা এই সময়ে বর্ধমান অঞ্চলে স্বাধীন স্বতন্ত্র মহারাজাধিরাজরূপে আত্মপ্রকাশ করেন। ইহার কেন্দ্র ছিল বর্ধমান জেলার ঢেঙ্করী নামক স্থানে। পূর্ববঙ্গে ত্রিপুরা অঞ্চলে এই সময়ে পট্টিকের রাজ্য গড়িয়া উঠে; এই রাজ্যের সঙ্গে সমসাময়িক পগানের (ব্রহ্মদেশ) আনাহউরহ থা বা অনিরুদ্ধের রাজবংশের কয়েক পুরুষের রাষ্ট্রীয় ও বৈবাহিক সম্বন্ধের বিবরণ জানা যায়। দ্বাদশ শতকে রণবঞ্চমল্ল নামে অন্তত একজন নরপতির নামও আমরা জানি। পূর্ববঙ্গের অন্যান্য স্থানে একাদশ শতকের শেষার্ধে এবং দ্বাদশ শতকে চন্দ্ৰবংশ এবং পরে বর্মণ বংশের রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত ছিল। কাজেই পূর্ববঙ্গ পুনরুদ্ধার পালরাজারা আর করিতেই পারেন নাই;

কর্ণাটাক্রমণ

তৃতীয় বিগ্রহপালের রাজত্বকালে (আঃ ১০৪৩-৭০) বাঙলাদেশে আর এক নূতন বহিঃশত্রুর আক্রমণ দেখা দিল। বিক্রমাঙ্কদেবচরিত-রচয়িতা বিলহন বলিতেছেন, কর্ণাটের চালুক্যরাজ প্রথম সোমেশ্বরের জীবিতকালেই পুত্র (ষষ্ঠ) বিক্ৰমাদিত্য এক বিপুল সৈন্যবাহিনী লইয়া দিগ্বিজয়ে বাহির হইয়াছিলেন (আঃ ১০৬৮)। চালুক্য-লিপিতেও এই দিগ্বিজয়ের কিছু আভাস আছে এবং বাঙলায় একাধিক চালুকারাজ কর্তৃক একাধিক সমারাভিযানের উল্লেখ আছে। এই সব কর্ণাটদেশীয় সমারাভিযানকে আশ্রয় করিয়াই কিছু কিছু কর্ণাট ক্ষত্ৰিয়সামন্ত-পরিবার এবং অন্যান্য কিছু কিছু লোক বাঙলাদেশে আসিয়াছিলেন এবং সৈন্যাভিযান স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের পরও তাহারা এখানেই থাকিয়া গিয়াছিলেন। বিহার ও বাঙলাদেশের সেন-রাজবংশ এবং (পূর্ব) বঙ্গের বর্মণ রাজবংশ এই সব দক্ষিণী কর্ণাটী-পরিবার হইতে উদ্ভূত বলিয়া ইতিহাসে বহুদিন স্বীকৃত হইয়াছে। একাদশ শতকের মধ্যভাগে বাঙলার উপর আর একটি ভিনাপ্রদেশী আক্রমণের সংবাদ জানা যায়। উড়িষ্যার রাজা মহাশিবগুপ্ত যযাতি গৌড়, রাঢ়া এবং বঙ্গে বিজয়ী সমারাভিযান প্রেরণ করিয়াছিলেন বলিয়া দাবি করিয়াছেন। আর এক উড়িষ্যারাজ উদ্যোত কেশরী, তিনিও একবার গৌড়সৈন্যবিজয়ের দাবি জানাইতেছেন : তাহাও সম্ভবত এই সময়ই। এই সব ভিনাপ্রদেশী আক্রমণের ফলে অনুমান করা কঠিন নয়; (পূর্ব)-বঙ্গ তো আগেই করাচ্যুত হইয়া গিয়াছিল; জয়পাল-বিগ্রহপালের আমলে পশ্চিমবঙ্গও তাহার হারাইয়াছিলেন। ক্ষীণায়মান পাল-রাজা এখন এই সব ভিনাপ্রদেশী আক্রমণে প্রায় ভাঙিয়া পরিবার উপক্রম হইল। মগধেও পাল-রাজাদের শাসনমুণ্ঠি শিথিল হইয়া আসিতেছিল। জয়পালের সময় হইতেই পরিতোয্য এবং তৎপুত্র শূদ্ৰক নামে দুই সামন্ত গয়া অঞ্চলে প্রধান হইয়া উঠিতেছিলেন; বস্তুত, বাহুবলে তাহারা গয়া পরিচালনা করিতেছিলেন বলিয়া আঁহাদের লিপিতে দাবি করা হইয়াছে। শূদ্রক, শূদ্রকের পুত্র বিশ্বরূপ বা বিশ্বাদিত্য এবং তৎপুত্র যক্ষপালের সময় এই বংশ ক্রমশ আরও পরাঞিান্ত হইয়া উঠে। গৌড়রাজ তো শূদ্ৰককে নিজে রাজপদে অভিষিক্ত করিয়া সম্মানিত করিয়াছিলেন বলিয়া দাবি করা হইয়াছে। তাহার পুত্র বিশ্বরূপ নৃপ বা রাজা বলিয়াই কথিত হইয়াছেন। বিহার ও বাঙলার পাল-রাজ্যের অবস্থা কল্পনা করা কঠিন নয়। বৰ্মণ রাজবংশ পূর্ববাঙলায় স্বতন্ত্র ও স্বাধীন রাজ্য গড়িয়া তুলিল; কামরূপরাজ রত্নপাল গৌড়রাজকে উদ্ধত অস্বীকারে অপমানিত করিতে এতটুকু ভীতিবোধ করিলেন না!

তৃতীয় বিগ্রহপালের তিন পুত্র : দ্বিতীয় মহীপাল (আঃ ১০৭০-১০৭১), দ্বিতীয় শূরপাল (আঃ ১০৭১-৭২ ) এবং রামপাল (আঃ ১০৭২-১১২৬) ৷ মহীপাল যখন রাজা হইলেন তখন ঘরে-বাহিরে অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয়। নিজ পরিবারের মধ্যে নানা চক্রান্ত, সামন্তরা বিদ্রোহোন্মুখ।। ভ্রাতা রামপাল পারিবারিক চক্রান্তের মূল ভাবিয়া মহীপাল শুরপাল ও রামপাল দুই ভ্রাতাকেই কারারুদ্ধ করিলেন। কিন্তু এখানেই বিপদের শান্তি হইল না। বিদ্রোহী সামন্তদের দমনে তিনি কৃতসংকল্প হইলেন, অথচ তাহার সৈন্যদল এবং যুদ্ধোপকরণ যথেষ্ট ছিল বলিয়া মনে হয় না। মন্ত্রীবর্গের সুপরামর্শেও তিনি কৰ্ণপাত করলেন না। বরেন্দ্রীর কৈবর্ত-সামন্তদেরবিদ্রোহ দমন করিতে গিয়া তিনি যুদ্ধে পযুদস্ত এবং নিহত হইলেন; কৈবর্ত-নায়ক দিব্য (দিকেবোক, দিবোক) বরেন্দ্রীর অধিকার লাভ করিলেন।

কৈবর্ত-বিদ্রোহ; বরেন্দ্রীতে কৈবর্তাধিপত্য । আঃ ১০৭৫-১১০০

সন্ধ্যাকর নন্দীর রামচরিত-কাব্যে এ-বিদ্রোহ, মহীপাল হত্যার বিবরণ এবং রামপাল কর্তৃক বরেন্দ্রীর পুনরুদ্ধার ইত্যাদির সুবিস্তৃত ইতিহাস কাব্যকৃত করা হইয়াছে। সন্ধ্যাকর রামপালপুত্র মদনপালের অনুগ্রহভাজন; মহীপালের উপর তিনি যে খুব শ্রদ্ধিত ছিলেন, মনে হয় না। তিনি মহীপালকে নিষ্ঠুর এবং দুনীতিপরায়ণ বলিয়া কটুক্তিও করিয়াছেন। মহীপাল লোকশ্রুতিতে বিশ্বাস করিয়া জনপ্রিয় রামপালকে চক্ৰান্তকারী বলিয়া মনে করিয়াছিলেন, অথচ রামপাল যথার্থতি তাহা ছিলেন না। তাহা ছাড়া তিনি যুদ্ধকামী হইয়া মন্ত্রীবর্গের আদেশ অমান্য করিয়া, অনন্ত-সামন্তচক্রের বিরুদ্ধে অপরিমিত সেনাদল লইয়া বিদ্রোহ দমনে অগ্রসর হইয়াছিলেন, এসব সংবাদ সন্ধ্যাকরুই দিতেছেন; মহীপালের প্রকৃতি, চরিত্র এবং রাষ্ট্রবুদ্ধি সম্বন্ধে সন্ধ্যাকরের সাক্ষ্য কতখানি প্রামাণিক বলা কঠিন। অন্য কোনও সাক্ষ্য উপস্থিতও নাই। এই অবস্থায় মহীপালের ভালোমন্দ বা কর্তব্যাকর্তব্য বিচারের দোষগুণ কিছুই চলিতে পারে না। তবে, তিনি যে যে দুর্বল এবং রাষ্ট্রবুদ্ধিবিহীন ছিলেন, এ-সম্বন্ধে বোধ হয় সংশয় নাই। ঘটনাচক্রের পরিণতিই তাহার প্রমাণ।

দিব্য ৷ আঃ ১০৭১-৮০ ৷৷

দিব্য সম্বন্ধেও সন্ধ্যাকরের সাক্ষ্য কতটুকু গ্রাহ্য, বলা কঠিন। পালরাজাদের পারিবারিক শত্রুর প্রতি সন্ধ্যাকর সুবিচার করিতে পারিয়াছেন বলিয়া মনে হয় না। রামচরিত পাঠে মনে হয়, দিব্য ছিলেন একজন নায়ক, পালরাষ্ট্রেরই একজন নায়ক-কর্মচারী। কী কারণে তিনি বিদ্রোহপরায়ণ হইয়াছিলেন, আর কোন কোন সমস্ত তাঁহার সঙ্গে যোগ দিয়াছিলেন, ইত্যাদি কিছুই সন্ধ্যাকর বলেন নাই। অনন্ত সামন্তচক্রের সম্মিলিত বিদ্রোহের তিনি নায়কত্ব করিয়াছিলেন, এমন কোনও প্রমাণও নাই। সন্ধ্যাকর তাহাকে বলিয়াছেন। ‘দস্য’ এবং ‘উপধি-ব্রতী’ (ছলাকলায় অজুহাতে অন্যায় কৌশলে কার্যোদ্ধারপরায়ণ)। মনে হয়, দিব্য পাল-রাজাদের অন্যতম রাষ্ট্রনায়ক ছিলেন এবং পালরাষ্ট্রের দুর্বলতায় রাজপরিবারে ভ্রাতৃবিরোধের সুযোগ লইয়া তিনি “বিদ্রোহপরায়ণ হুইয়াছিলেন। অন্তত, তিনি যে কোনো প্রজাবিদ্রোহের নায়কত্ব করিয়াছিলেন, এমন কোনও প্রমাণ উপস্থিত নাই; সন্ধ্যাকর নদী অন্তত তাহা বলেন নাই, অন্যত্রও তেমন প্রমাণ নাই। সন্ধ্যােকর তো দিব্যকে ‘কুৎসিত কৈবর্ত নৃপ বলিয়াছেন, এই বিদ্রোহকে ‘অনীক ধর্ম-বিপ্লবী বলিয়াছেন (অনীক = অন্যায়, অপবিত্র) এবং এই উপপ্লবকে “ভাবস্য আপদম” বলিয়া বৰ্ণনা করিয়াছেন। সন্ধ্যাকরের সাক্ষ্য যে পক্ষপাতদুষ্ট নয়, এমন অবশ্যই বলা যায় না। যাহাই হউক, বরেন্দ্রীর এই কৈবর্ত-বিদ্রোহে মহীপাল নিহত হইলেন এবং দিব্য বরেন্দ্রীর অধিকার লাভ করিলেন।

রামপাল ৷ জন্মঃ ১০৭২-১১২৬ ৷৷

বরেন্দ্ৰাধিপ দিব্যকে যুদ্ধে বর্মণ-বংশীয় বঙ্গরাজ জাতবর্মার সম্মুখীন হইতে হইয়াছিল; কিন্তু তাহাতে কৈবর্ত-রাজ্যের কিছু ক্ষতি হয় নাই বলিয়া মনে হয়। শূরপাল বেশি দিন রাজত্ব করিতে পারেন নাই; রামপাল রাজা হইয়া দিব্যর রাজত্বকালেই বরেন্দ্রী পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করিয়াছিলেন, কিন্তু সফলকাম হইতে পারেন নাই। বরং কৈবর্তপক্ষ একাধিকবার রামপালের রাজ্য আক্রমণ করিয়াছিল। দিব্যর পর রুদোকের আমলেও রামপাল বোধ হয় কিছু করিয়া উঠিতে পারেন। নাই। রুদোকের ভ্রাতা বরেন্দ্রীর অধিপতি হওয়ার পর সুপ্রতিষ্ঠিত কৈবর্ত শক্তি এক নূতন ও পরাক্রান্ততর আকারে দেখা দিল। ভীম জনপ্রিয় নরপতি ছিলেন; তাহার স্মৃতি আজও জীবিত। রামপাল শঙ্কিত হইয়া প্রতিবেশী রাজাদের ও পালরাষ্ট্রের অতীত ও বর্তমান, স্বাধীন ও স্বতন্ত্র সামন্তদের দুয়ারে দুয়ারে তঁহাদের সাহায্য ভিক্ষা করিয়া ঘুরিয়া ঘুরিয়া ফিরিলেন। অপরিমিত ভূমি ও অজস্র অর্থ দান করিয়া এই সাহায্য ক্রয় করিতে হইল। রামচরিতে এই সব রাজা ও সামন্তদের যে তালিকা দেওয়া আছে তাহা বিশ্লেষণ করিলেই দেখা যাইবে, তদানীন্তন বাঙলা ও বিহারের রাষ্ট্ৰতন্ত্র অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিচ্ছিন্ন অংশে বিভক্ত হইয়া পড়িয়াছিল। রামপালের প্রথম ও প্রধান সহায়ক হইলেন ১৭ তাহার মাতুল রাষ্ট্রকূটবংশীয় সামন্ত মথন (মহন) ও তাহার মহামাণ্ডলিক দুই পুত্র ও এক মহাপ্ৰতীহার ভ্রাতুষ্পপুত্র; ২) পীঠি ও মগধাধিপতি ভীমযশ; ৩০ কোটাটবার রাজা বীরগুণ; কোটাটৰী বিষ্ণুপুরের পূর্বে বর্তমান কোটেশ্বর; ৪. দণ্ডভুক্তির রাজা জয়সিংহ; ৫. বাল-বলভীর অধিপতি বিক্রম রাজ; বাল-বলভী মেদিনীপুরের পশ্চিম-দক্ষিণ সীমান্তে বলিয়া মনে হয়; ৬ অপর-মন্দারের অধিপতি লক্ষ্মীশূর; অপর-মন্দার পরবর্তীকালের মাদারুণ বা মন্দারণ-সরকারের পশ্চিমাংশ, বর্তমান হুগলী জেলায়; লক্ষ্মীশূর ছিলেন এই অঞ্চলের সমস্ত আটবিক খণ্ডের সামন্তচক্ৰ-চুড়ামণি। ৭. কুজবটীর রাজা শূরপাল; কুজবটী সাঁওতাল পরগণায়, নয়া-দুমকার ১৪ মাইল উত্তরে; ৮. তৈলকম্প বা বর্তমান তেলকুপির (মানভূম জেলা) অধিপতি রুদ্রশিখর; ৯° উচ্ছালাধিপতি ভাস্কর বা ময়গল সিংহ; উচ্ছল বর্তমান বীরভূমের উঝিয়াল পরগণা; ১০. কাজঙ্গল-মণ্ডলাধিপতি নরসিংহাৰ্জন; ১১. সঙ্কটগ্রামের চণ্ডাৰ্জ্জুন; সঙ্কটগ্রাম বল্লালচরিত-গ্রন্থের সংককোট, আইন-ই-আকবরী গ্রন্থের সকোট, বোধ হয়। হুগলী জেলায়; ১২ ঢেঙ্করীয় (কাটোয়া মহকুমার ঢেকুরী)-রাজ প্রতাপসিংহ; ১৩. নিদ্রাবলীর বিজন্মেরাজ; ১৪, কৌশাম্বী-অধিপতি দ্বোরপবর্ধন; কৌশাম্বী রাজশাহীর কুসুম্বা পরগণা, অথবা বগুড়া জেলার তাপে কুসুম্বি পরগণা; ১৫, পদুবন্ধার সোম; পদ্মবন্ধ পাবনা হইতে পারে, কিন্তু হুগলী জেলার পোনান পরগণা হওয়াই অধিকতর সম্ভব।

স্পষ্টই দেখা যাইতেছে, পদুবন্ধা যদি পাবনাও হয়, তাহা হইলে পদুবন্ধ এবং কৌশাম্বী ছাড়া আর সমস্ত সামান্তরাই দক্ষিণ-বিহার ও দক্ষিণ-পশ্চিম বঙ্গের। বুঝিতে পারা যায়, অঙ্গ বা উত্তর-বিহার এবং উত্তর-পশ্চিম বঙ্গ ছাড়া রামপালের রাজত্বের বিস্তার আর কোথাও ছিল না। কৌশাম্বীর দ্বোরপবর্ধনকে এই তালিকায় দেখিয়া মনে হইতেছে, খাস বরেন্দ্রীতেও রামপাল ২।। ১ জন সহায়ক সংগ্ৰহ করিয়াছিলেন।

ক্ষৌণী-নায়ক ভীম

এই সম্মিলিত শক্তিপুঞ্জের সঙ্গে ক্ষৌণী-নায়ক ভীমের পক্ষে আঁটিয়া ওঠা সম্ভব ছিল না। রামচরিতে রামপাল কর্তৃক বরেন্দ্রীর উদ্ধার-যুদ্ধের বিস্তৃত বিবরণ আছে। এইখানে এইটুকু বুলিলেই যথেষ্ট যে, গঙ্গার উত্তর-তীরে দুই সৈন্যদলে তুমুল যুদ্ধ হয় এবং ভীম জীবিতাবস্থায় বন্দী হন। ভীমের অগণিত ধনরত্নপূর্ণ রাজকোষ রামপালের সেনাদল কর্তৃক লুষ্ঠিত হয়। কিন্তু ভীম বন্দী হওয়ার অব্যবহিত পরেই ভীমের অন্যতম সুহৃদ ও সহায়ক হরি পরাজিত ও পযুদস্ত কৈবর্তী সৈন্যদের একত্র করিয়া আবার যুদ্ধে রামপালের পুত্রের সম্মুখীন হন, কিন্তু অজস্র অর্থদানে কৈবর্তসেনা ও হরিকে বশীভূত করা হয়। ভীম সপরিবারের রামপালহস্তে নিহত হন। ঘরেন্দ্রী এবং কৈবর্ত-রাজকোষ রামপালের করায়ত্ত হইল, কারভার-পীড়িত বরেন্দ্রীতে সুখ ও শান্তি ফিরিয়া আসিল। রামাবতী নগরে বরেন্দ্রী রাষ্ট্রকেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হইল।

বরেন্দ্রী উদ্ধারের পর রামপাল হৃতরাজ্যের অন্যান্য অংশ উদ্ধারে যত্নবান হইলেন। (পূর্ব)-বঙ্গের এক বৰ্মণরাজ, বোধ হয়। হরিবর্মা, নিজ স্বার্থে রামপালের আনুগত্য স্বীকার করিলেন। রামপালের এক সামন্ত কামরূপ জয় করিয়া রামপালের প্ৰিয়পাত্ৰ – হইলেন। রাঢ়দেশের সামন্তদের সহায়তায় উড়িষ্যারও অস্তুত কিয়দংশ জয় তাহার পক্ষে সম্ভব হইল; অবশ্য তাহা করিতে গিয়া কলিঙ্গের চোড়গঙ্গা-রাজদের সঙ্গে, অন্তত পরোক্ষে, কিছু সংঘর্ষে তাহাকে আসিতে হইয়াছিল। বোধ হয় উৎকলে-কিলিঙ্গে রাজ্যবিস্তারের চেষ্টা করিতে গিয়াই রামপালকে চোলরাজ কুলোত্তঙ্গের (আঃ ১০৭০-১১১৮) আক্রমণের সম্মুখীন হইতে হয়; বঙ্গ-বঙ্গাল এবং মগধ, কুলোত্তঙ্গকে কর প্রদান করিত এবং কুলোত্তঙ্গ গঙ্গা হইতে কাবেরী পর্যন্ত সমস্ত ভূভাগের অধিকারী হইয়াছিলেন বলিয়া অস্তুত একটা দাবি কুলোত্তঙ্গের পক্ষ হইতে করা হইয়াছে। এই দাবি কতটুকু ঐতিহাসিক, বলা কঠিন।

কর্ণাটাভু্যদয়

এই সময় কর্ণাটের লুব্ধদৃষ্টি বরেন্দ্রীর উপর পতিত হয়। বাঙলাদেশে কর্ণাটাক্রমণের কথা তো আগেই বলা হইয়াছে। কিন্তু রামচরিতে বরেন্দ্রীর বর্ণনা প্রসঙ্গে বলা হইয়াছে “অধরিত-কর্ণাটক্ষণ-লীলা”। এই কর্ণাটীরা কি সেই সুদূর দক্ষিণের কর্ণাটবাসী? বোধ হয় তাহা নয়। ইহারা সম্ভবত পশ্চিমবঙ্গ ও মিথিলার দুই কর্ণািট রাজবংশ। কর্ণাটাগত এক সেনা-বংশ ইতিমধ্যেই পশ্চিমবঙ্গে এবং আর এক সেনা-বংশ মিথিলায় নিজেদের বংশের আধিপত্য সুপ্রতিষ্ঠিত করিয়াছিলেন। আপাতত, মিথিলার সেনা-বংশীয় রাজা নান্যদেবের (আঃ ১০৯৭) সঙ্গে রামপালের সংঘর্ষ উপস্থিত হইল। নান্যদেব বঙ্গ এবং গৌড়ের পরাক্রম খর্ব করিয়াছিলেন বলিয়া দাবি করিয়াছেন; সমসাময়িক গৌড়রাজ রামপাল বলিয়াই মনে হয় এবং বঙ্গরাজ হইতেছেন বিজয়সেন। বিজয়সেনও অবশ্য ন্যান্যদেবকে পরাজয়ের দাবি করিয়াছেন। যাহা হউক, মিথিলা (উত্তর-বিহার) যে রামপালের কারচু্যত হইয়াছিল এ-সম্বন্ধে সন্দেহের কারণ मांश्।

কাশী-কানাকুন্তুজাধিপতি পরাক্রান্ত গাহড়বাল রাজাদের সঙ্গেও রামপালকে যুঝিতে হইয়াছিল। বলিয়া মনে হয় ৷ গাহড়বাল বংশীয় গোবিন্দচন্দ্রের পুত্র মদনপালের সঙ্গে গৌড়-সৈন্যের সংগ্রামের ইঙ্গিত গহড়বাল-লিপিতে পাওয়া যায়; কিন্তু মদনপাল নিশ্চিত জয়লাভ করিয়াছিলেন, এমন বলা যায় না। বরং রামচরিতে এমন ইঙ্গিত আছে যে, বরেন্দ্রী মাধ্যদেশের বিক্রম সংযত করিয়া রাখিয়াছিলেন।

রামপাল বৃদ্ধ বয়স পর্যন্ত রাজত্ব করিয়াছিলেন বলিয়া মনে হয়। তিনি কৃতী পুরুষ ছিলেন, সন্দেহ নাই। নির্বাসনে জীবন আরম্ভ করিয়া বিদ্রোহীদের হাত হইতে পিতৃভূমি বরেন্দ্রী উদ্ধার, অধিকাংশ বাঙলার, পুনরুদ্ধার, উড়িষ্যা ও কামরূপে আধিপত্য বিস্তার এবং একাধিক ঘহিঃশত্রু কর্তৃক আক্রান্ত হইয়াও পালরাজ্য ও রাষ্ট্রের সীমা এবং আধিপত্য মৃত্যু পর্যন্ত অক্ষুঃ রাখা, এক জীবনের পক্ষে এত কর্মকীর্তি তাহার রাষ্ট্রবুদ্ধি, দৃঢ়চিরিত্র এবং অদম্য শৌর্যবীর্যের পরিচায়ক, স্বীকার করিতেই হয়।

কিন্তু রাষ্ট্রীয় আদর্শ বা সামাজিক ব্যবস্থার সময়োপযোগী পরিবর্তন না হইলে শুধু কোনও রাজা বা সম্রাটের ব্যক্তিগত চরিত্রের গুণ রাজ্য বা রাষ্ট্রকে পরিণাম-বিনষ্টির হাত হইতে বাঁচাইতে পারে না। মহীপালের মতন সম্রাট পারেন নাই, রামপালও পাব্রিলেন না। বিনষ্টিকে তাহারা তঁহাদের শৌর্যে বীর্যে পরাক্রমে কুটবুদ্ধিতে দূরে ঠেলিয়া সরাইয়া দিয়াছেন সন্দেহ নাই; কিন্তু যে বিচ্ছিন্ন স্থানীয় সংকীর্ণ আত্মসচেতনতা ভারতীয় রাষ্ট্রবৃদ্ধিকে এই যুগে আচ্ছন্ন করিয়া দিয়াছিল, মহীপাল বা রামপাল কেহই তাহা দূর করিতে পারেন নাই। এই অনুরাষ্ট্ৰীয় আদর্শের এতটুকু পরিবর্তন এই সময়ে ভারতবর্ষের কোথাও হয় নাই। বস্তুত, ভারতবর্ষের কোনও রাজা বা রাজবংশই এই যুগে সেদিকে সচেষ্ট হন নাই! বরং একে অন্যের দুর্বলতার সুযোগ লইয়া নিজেদের রাজ্যসীমা বাড়াইবার চেষ্টাই কেবল করিয়াছেন; অথচ, অন্যদিকে তখন বৈদেশিক আধিপত্যের ঘন কৃষ্ণমেঘ ভারতের রাষ্ট্ৰীয় আকাশ ক্রমশ ঢাকিয়া ফেলিতেছিল; মুসলমান অধিকারের সীমা ক্রমশ পূর্বদিকে বিস্তৃত হইতেছিল। রামপাল যখন মাতুল মথনের মৃত্যুশোক সহ্য করিতে না পারিয়া পরিণত বার্ধক্যে গঙ্গায় আত্মবিসর্জন করেন তখন হয়তো তিনি সার্থক জীবনের পরম পরিতৃপ্তি লইয়াই ইকুলোক ত্যাগ করিয়াছিলেন। কিন্তু যে স্থানীয় সংকীর্ণ আত্মসচেতনতা মহীপালের চেষ্টাকে সার্থক হইতে দেয় নাই, তাহাঁই রামপালের চেষ্টাকেও পরিণামে ব্যর্থ করিয়া দিল। ইহার সঙ্গে অন্যান্য সামাজিক ও অর্থনৈতিক কারণ তো ছিলই।

বঙ্গে বর্মণাধিপত্য ৷ আঃ-১০৫০

সুদীর্ঘ চারিশত বৎসর পরে এই বিষাদান্ত পরিণতির কথা বলিবার আগে বঙ্গের বর্মণ-বংশের কথা একটু বলিয়া লইতে হয়। ইহাদের কথা আগেও একাধিক প্রসঙ্গে উল্লিখিত হইয়াছে। যাদববংশীয় এই বর্মণ রাজারা কলিঙ্গ দেশের সিংহপুর নামক স্থান হইতে একাদশ শতকের দ্বিতীয় অথবা তৃতীয় পদে কোনও সময় পূর্ববঙ্গে আসিয়া আধিপত্য স্থাপন করেন। বজবর্মপুত্র জাতবর্মী এই বংশের প্রথম রাজা। জাতবর্ম কলচুরীরাজ কর্ণের কন্যা বীরত্রীকে বিবাহ করেন, এবং অঙ্গ, কামরূপ এবং বরেন্দ্রী-নায়ক দিব্যকে পরাজিত করেন বলিয়া দাবি করিয়াছেন। অঙ্গ এই সময় বোধ হয়। রামপালের অধীন ছিল এবং দিব্য নিশ্চয়ই বরেন্দ্রীর কৈবর্ত-নায়ক। দ্বিতীয় মহীপালের মৃত্যুর পর পাল-রাজ্যে যে বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়াছিল, জাতবর্ম তাহার পূর্ণ সুযোগ লাইতে বোধ হয় দ্বিধা বোধ করেন নাই। জাতবর্মর পশ্চাতে কলচুরীরাজ গাঙ্গেয়দেব এবং কর্ণের সহায়তা ছিল, এ-সন্দেহ অমূলক নয়। জাতবর্মর পর পুত্র মহারাজাধিরাজ হরিবর্মী রাজা হন; বিক্রমপুরে ছিল তাহার রাজধানী এবং তাহার সান্ধিবিগ্রহিক মন্ত্রী ছিলেন ভট্ট ভূবদেব। এই হরিবর্ম রামচরিত্যেক্ত ভীমবন্ধু হরি এবং রামপাল শরণাগত বৰ্মণরাজ এক এবং অভিন্ন বলিয়া কেহ কেহ মনে করেন। এই অনুমান যুক্তিসঙ্গত বলিয়া মনে না করিবার আপাতত কোনও কারণ নাই। হরিবর্মর পর ভ্রাতা শ্যামলবৰ্মা বঙ্গের রাজা হন; তাহার রাষ্ট্রীয় কোনও কীর্তিই জানা নাই, তবে তিনি বাঙলার বৈদিক ব্ৰাহ্মণদের লোকস্মৃতিতে আজও বঁচিয়া আছেন। কুলজী-গ্রন্থের মতে শ্যামলবৰ্মার আমলেই বাঙলায় বৈদিক ব্রাহ্মণদের আগমন। তঁহার পুত্র ভোজ্যবর্ম এই বংশের শেষ রাজা; ইহারও রাষ্ট্ৰকেন্দ্র ছিল বিক্রমপুর, কিন্তু তিনি পুণ্ড্রবর্ধনভূক্তির অন্তৰ্গত কৌশাম্বী-অষ্টগচ্ছ-খণ্ডলে কিছু ভূমি দান করিয়াছিলেন দেখিয়া মনে হয়, পুণ্ড্রবর্ধনের রাজশাহী-বগুড়া অঞ্চলেও ভোজবর্মার আধিপত্য এক সময় বিস্তৃতি লাভ করিয়াছিল। তাহার রাজত্বকালে অথবা তাহার অব্যবহিত পরেই পূর্ববঙ্গের বর্মণরাজ্য সেন-রাজবংশের করতলগত হয়।

পালায়নের পরিনির্বাণ ॥ আঃ ১১২০-১১৬২

রামপালের চারিপুত্রের মধ্যে দুই পুত্র, বিওপাল ও রাজ্যপালের সিংহাসন আরোহণের সৌভাগ্যলাভ ঘটে নাই। অন্য দুই পুত্র, কুমারপাল ও মদনপালের মধ্যে কুমারপাল (আঃ ১১২৬-২৮) রাজা হন; তাহার পর কুমারপাল-পুত্র তৃতীয় গোপাল (আঃ ১১২৮-৪৩) এবং গোপালের পর রামপালের অন্যতম পুত্র মদনপাল (আঃ ১১৪৩-৬১) রাজা হইয়াছিলেন। রামচরিত-কাব্যপাঠে মনে হয়, সিংহাসনারোহণের এই ক্ৰম সম্বন্ধে একটা রহস্য কোথাও ছিল। রামচরিত রামপালকে লইয়াই রচনা, কিন্তু বস্তুত মদনপালের রাজত্ব পর্যন্ত কাব্যটি বিস্তারিত, অথচ রামপালের পর কুমারপাল এবং গোপাল সম্বন্ধে এই কাব্যে প্রায় কিছু বলা হয় নাই বলিলেই চলে। মদনপালে পৌঁছিয়া সন্ধ্যাকরা যেন স্বপ্তির নিঃশ্বাস ছাড়িয়া বাচিয়াছেন। কোনও বংশগত বা পারিবারিক গোলমালের কল্পনা একেবারে অলীক না-ও হইতে পারে!

যাহা হউক, এই তিন জনের রাজত্বকালেই চারিশত বৎসরের সযত্নলালিত, বাঙালীর গৌরব পাল-রাজ্য ও রাষ্ট্র ধীরে ধীরে একেবারে ভাঙিয়া পড়িয়া গেল। ধর্মপাল-দেবপাল যে-সাম্রাজ্য গড়িয়া তুলিয়াছিলেন, মহীপাল যাহাকে ধ্বংসের মুখ হইতে বাঁচাইয়া ছিলেন, রামপাল যাহাকে শেষবারের জন্য আত্মপ্রতায় এবং প্রতিষ্ঠা ফিরাইয়া দিয়াছিলেন, কেহ আর তাহাকে রক্ষা করিতে পারিলেন না। ঘরে এবং বাহিরে স্থানীয় আত্মসচেতন, একান্ত ব্যক্তিক রাষ্ট্রবুদ্ধি উৎকট হইয়া দেখা দিল; ইহাকে ব্যাহত করিবার মতন শক্তি ও বুদ্ধি লইয়া কোনও মহীপাল বা রামপাল আর সিংহাসন আরোহণ করিলেন না!

কুমারপালের নিজের প্রিয় সেনাপতি বৈদ্যদেব কামরূপে এক বিদ্রোহ দমন করিয়া নিজেই এক স্বতন্ত্র স্বাধীন নরপতিরূপে আত্মপ্রতিষ্ঠা করিয়া লইলেন। পূর্ববঙ্গে ভোজ্যবর্মার নেতৃত্বে বর্মণরা স্বতন্ত্র ও স্বাধীন হইল। দক্ষিণ হইতে কলিঙ্গের গঙ্গবংশীয় রাজারা আরম্য (= বর্তমান আরামবাগ) দুর্গ জয় করিয়া মেদিনীপুরের (মিধুনীপুর) ভিতর দিয়া গঙ্গাতীর পর্যন্ত ঠেলিয়া চলিয়া আসিলেন। কুমারপালের রাজত্বকালে সেনাপতি বৈদ্যদেব বোধ হয় সাফল্যের সঙ্গে এই আক্রমাণ কতকটা ব্যাহত করিয়াছিলেন এবং মদনপালও বোধ হয় একবার কলিঙ্গ পর্যন্ত বিজয়াভিযান করিয়া থাকিবেন। কিন্তু, কিছু দিনের মধ্যেই পাল ও গঙ্গদের সংগ্রামের এবং দক্ষিণের কল্যাণ-চালুক্যদের আক্রমণের সুযোগ লইয়া দক্ষিণ-পশ্চিমবঙ্গে কর্ণাটাগত সেন-রাজবংশ মস্তক উত্তোলন করিল। এই সেন-রাজবংশ ইতিপূর্বেই পূর্ববঙ্গে আধিপত্য বিস্তার করিয়াছিল! এইবার তাহারা একেবারে গৌড়ের হৃদয়দেশ আক্রমণ করিল। কালিন্দী-নদীর তীরে, বোধ হয় মদনপালের রাজধানীর নিকটেই, এক তুমুল যুদ্ধ হইল। এই যুদ্ধের ফলাফল অনিশ্চিত, কারণ রামচরিতে যেমন মদনপালের জয় দাবি করা হইয়াছে, তেমনই দেওপাড়া-লিপিতে সেন-রাজ বিজয়সেনের পক্ষ হইতেও জয়ের দাবি জানানো হইয়াছে। অন্যদিকে দুর্বলতার সুযোগ লইয়া গাহড়িকাল-রাজারাও এই সময় বাঙলাদেশে আবার নূতন করিয়া সমারাভিযানে উদ্যত হইলেন। ১১২৪ খ্ৰীষ্টাব্দের আগেই পাটনা অঞ্চল তাহদের অধিকারে চলিয়া গেল; ১১৪৬ খ্ৰীষ্টাব্দের আগে গেল মুদগগিরি বা মুঙ্গের অঞ্চল। মদনপালের রাজত্বের অষ্টম বৎসর পর্যন্ত বরেন্দ্রীর অন্তত কিয়দংশ তাহার অধিকারে ছিল বলিয়া লিপি-প্রমাণ বিদ্যমান। এইটুকু ছাড়া বাঙলাদেশের আর কোনও অংশই তাহার অধিকারে ছিল বলিয়া মনে হয় না; তবে বিহারের মধ্যে ও পূর্বাঞ্চল তখনও পাল-রাজ্যভুক্ত ছিল। মদনপালের মৃত্যুর পর দশ বৎসরের মধ্যে তাহাও আর রহিল না এবং পাল-রাজ্যের শেষচিহ্নও বিলুপ্ত হইয়া গেল। মদনপালই পালবংশের শেষ রাজা। তবে, তাহার পরও গোবিন্দচন্দ্র (আঃ ১১৫৫—১১৬২) নামে একজন পরমেশ্বর পরমভট্টারক মহারাজাধিরাজ গৌড়েশ্বরের নামে পাওয়া যায় { লিপি-প্ৰমাণ হইতে মনে হয়, গয়া জেলাই ছিল তাহার রাজ্যকেন্দ্ৰ; গৌড়রাজ্যের কিয়দংশও হয়তো এক সময় তাহার রাজ্যের অন্তর্গত ছিল।

সামাজিক ইঙ্গিত

বাঙলার ইতিহাসে পালবংশের আধিপত্যের চারিশত বৎসর নানাদিক হইতে গভীর ও ব্যাপক অর্থ বহন করে। বর্তমান বাঙলাদেশ ও বাঙালী জাতির গোড়াপত্তন হইয়াছে এই যুগে; এই যুগই প্রথম বৃহত্তর সামাজিক সমীকরণ ও সমন্বয়ের যুগ। এই চারিশত বৎসরের সামাজিক ইঙ্গিীতগুলি কতকটা বিস্তৃতভাবেই নানা অধ্যায়ে বিভিন্ন দিক হইতে ধরিতে চেষ্টা করিয়াছি। এখানে রাষ্ট্রের ও রাজবৃত্তের দিক হইতে ইঙ্গিীতগুলি ব্যাখ্যার সংক্ষিপ্ত একটু চেষ্টা করা যাইতে পারে।

রাষ্ট্রীয় আদর্শ

খ্ৰীষ্টপূর্ব তৃতীয় শতক হইতে আরম্ভ করিয়া প্রায় খ্ৰীষ্টপরবর্তী ষষ্ঠ-সপ্তম শতক পর্যন্ত ভারতবর্ষের রাষ্ট্রীয় আদর্শ সর্বভারতীয় একরাটত্ব, সমস্ত ভারতের একচ্ছত্ৰাধিপত্য; মাঝে মাঝে এই আদর্শ হইতে বিচূতি ঘটিয়াছে, সন্দেহ নাই, কিন্তু যখন তাহা হইয়াছে, তখনই ভারতবর্ষকে রাষ্ট্ৰক্ষেত্রে বিদেশীর নিকট অনেক লাঞ্ছনা ও অপমান সহ্য করিতে হইয়াছে এবং প্রচুর মূল্য দিয়া আবার সেই পুরাতন আদর্শকেই মানিয়া লইতে হইয়াছে। মৌর্য ও গুপ্তরাজবংশ এই আদর্শের প্রতীক। সপ্তম শতকেও এই আদর্শ সক্রয়, কিন্তু তখন সীমা সংকীর্ণতর হইয়া গিয়াছে সর্বভারত হইতে সকল-উত্তরাপথে সেই আদর্শ নামিয়া আসিয়াছে; ‘সকলোত্তরপথনাথ হওয়াই এই যুগের সর্বোচ্চ রাষ্ট্ৰীয় স্বীকৃতি। অষ্টম শতকেও এই আদর্শকে কেন্দ্ৰ করিয়াই প্ৰতীহার ও পালবংশের সংগ্রাম অক্ষুন্ন এবং তাঁহাকে ব্যর্থ করিবার চেষ্টায় দক্ষিণের রাষ্ট্রকূটবংশ সদা জাগ্রত। অন্যদিকে ধীরে ধীরে অন্য একটি রাষ্ট্ৰীয় আদর্শ গড়িয়া উঠিতেছিল; এই আদর্শের অস্তিত্ব যে ছিল না তাহা নয়, তবে সৰ্ব্বভারতীয় আদর্শের মতন এতটা সক্রয় কখনো ছিল না। এই আদর্শ স্থানীয় ও প্রাদেশিক আত্মকর্তৃত্বের আদর্শ। গুপ্ত-সাম্রাজ্যের পতনের সঙ্গে সঙ্গেই ক্রমশ এই আদর্শ মাথা তুলিতে আরম্ভ করে; কিন্তু ধর্মপাল-দেবপাল, বৎসরাজ-নাগভটের সময়েও উত্তরাপথস্বামীত্বের আদর্শ একেবারে বিলুপ্ত হয় নাই। কিন্তু তাহার পর হইতেই স্থানীয় ও প্রাদেশিক আত্মকর্তৃত্বের আদর্শের জয়জয়কার। এই সময় হইতেই যেন ভারতবর্যের বিভিন্ন দেশখণ্ডের অর্থ-সংস্থান, ভাষা ও সংস্কৃতিকে কেন্দ্ৰ করিয়া এক একটি রাষ্ট্র গড়িয়া উঠে এবং এই রাষ্ট্রগুলি নিজেদের প্রাদেশিক আত্মিকর্তৃত্বের প্রতিষ্ঠা ও বিস্তারে সচেষ্ট হইয়া উঠে। সংস্কৃত্তির ক্ষেত্রেও দেখা যায়, মোটামুটি অষ্টম শতক বা তাহার কিছু পর হইতে এক একটি বৃহত্তর জনপদ রাষ্ট্রকে কেন্দ্ৰ করিয়া মূলগত এক কিন্তু এক একটি বিশিষ্ট লিপি বা অক্ষর রীতি, ভাষা এবং শিল্পদর্শ গড়িয়া উঠিতে আরম্ভ করিয়াছে এবং দ্বাদশ-ত্রয়োদশ শতকের মধ্যে তাহদের এক একটি প্রাদেশিক বৈশিষ্ট্য দাঁড়াইয়া গিয়াছে। বস্তুত, ভারতবর্ষের, বিশেষত উত্তর-ভারতের, মহারাষ্ট্র ও উড়িষ্যার প্রত্যেকটি প্রাদেশিক লিপি ও ভাষার ভ্রণ ও জন্মাবস্থা মোটামুটি এই চারিশত বৎসরের মধ্যে। বাঙলা লিপি ও ভাষার গোড়া খুঁজিতে হইলে এই চারিশত বৎসরের মধ্যেই খুজিতে হইবে। বাঙলার ভৌগোলিক সত্ত্বও এই যুগেই গড়িয়া উঠিয়াছে। ভারতের অন্যান্য লিপি, ভাষা ও প্রাদেশিক ভৌগোলিক সত্ত্বা সম্বন্ধেও একই উক্তি প্রযোজ্য।

জাতীয় স্বাতন্ত্র্য

এই লিপি, ভাষা, ভৌগোলিক সত্ত্বা ও রাষ্ট্রীয় আদর্শকে আশ্রয় করিয়া এক একটি স্থানীয় সত্ত্বও গড়িয়া উঠে এই যুগেই। বঙ্গ-বিহারে এই রাষ্ট্ৰীয় সত্ত্বার সূচনা সপ্তম শতকেই দেখা দিয়াছিল এবং তাহার প্রতীক ছিলেন শশাঙ্ক। কিন্তু পরবর্তী একশত বৎসরের মৎস্যন্যায়ে এই রাষ্ট্রীয় সত্ত্বাই আহত হইয়াছিল। সকলের চেয়ে বেশি। পাল-রাজারা আবার তাহা জাগাইয়া তুলিলেন; বাঙালী নিজস্ব স্বাধীন স্বতন্ত্র রাষ্ট্র লাভ করিল এবং চারিশত বৎসর ধরিয়া তাহা ভোগ করিল। শুধু তাহাই নয়, ধর্মপাল-দেবপাল-মহীপালের সাম্রাজ্য বিস্তারের কৃপায় এই রাষ্ট্র একটা আন্তর্ভারতীয় রাষ্ট্রীয় সত্তার স্বাদও কিছুদিনের জন্য পাইয়াছিল। অধিকন্তু, এই পালরাজাদের এবং পালরাষ্ট্রের পোষকতা ও আনুকূলো, নালন্দা-বিক্রমশীলা-ওদন্তপুরী-সারনাথের বৌদ্ধ সংঘ ও মহাবিহারগুলিকে আশ্রয় করিয়া আন্তর্জাতিক বৌদ্ধজগতেও বাঙলাদেশ ও বাঙালীর রাষ্ট্র একটি গৌরবময় স্থান ও প্রতিষ্ঠা লাভ করিয়াছিল। এই সকলের সম্মিলিত ফলে বাঙলায় এই যুগেই, অর্থাৎ এই প্রায় চারিশত বৎসর ধরিয়া একটা সামগ্রিক ঐক্যবোধ গড়িয়া ওঠে। ইহাই বাঙালীর স্বদেশ ও স্বজাতবোধের মূলে এবং ইহাই বাঙালীর একজাতীয়ত্বের ভিত্তি। পাল-যুগের ইহাই সর্বশ্রেষ্ঠ দান।

সাংস্কৃতিক এবং সামাজিক সমন্বয়

এই দানের মূলে পালরাজাদের কৃতিত্ব স্বীকার করিতেই হয়। পালরাজারা ছিলেন বাঙালী, বরেন্দ্রী তাঁহাদের পিতৃভূমি। বংশ-প্রতিষ্ঠায়ও ইহারা পুরাপুরি বাঙালী; পৌরাণিক ব্ৰাহ্মণ্য-সমাজের বংশাভিজাত্যের দাবি ইহাদের নাই। রামচরিতে ক্ষত্ৰিয়ত্বের দাবি করা হইয়াছে কিংবা ক্ষত্রিয় রাজবংশের সঙ্গে তাঁহাদের বিবাহাদি হইত, এজন্য তঁহাদের ক্ষত্ৰিয় মনে করা কঠিন। রাজা মাত্ৰেই তো ক্ষত্রিয়, বিশেষত পৌরাণিক ব্ৰাহ্মণ্য সংস্কৃতি প্রবর্তনের পর। আর, রাজরাজড়ার বৈবাহিক সম্বন্ধ অধিকাংশ ক্ষেত্রে তো রাষ্ট্রীয় কারণেই হইয়া থাকে; তাহদের তো কোনও বর্ণ নাই! আবুল ফজল যে ইহাদের কায়স্থ বলিতেছেন তাহার মূলেও কোনও বস্তুভিত্তি আছে কিনা সন্দেহ; তবে তাহারা উচ্চতর তিন বর্ণের কেহ নহেন। এই সংস্কার লোকস্মৃতিতে ষোড়শ শতকেও বিদ্যমান ছিল বলিয়া মনে হয়। তারনাথ এবং মঞ্জশ্ৰীমূলকল্পের গ্রন্থকারই বোধ হয় যথার্থ ঐতিহাসিক ইঙ্গিতটি রাখিয়াছেন। তারনাথ বলিতেছেন, জনৈক বৃক্ষদেবতার ঔরসে ক্ষত্ৰিয়াণীর গর্ভে গোপালের জন্ম। কাহিনীটি টটেম-স্মৃতি জড়িত বলিয়া সন্দেহ করিলে অনায় বা অনৈতিহাসিক কিছু করা হয় না। পৌরাণিক-ব্রাহ্মণ্য-সংস্কৃতি-বহির্ভূত, আর্যসমাজ-বহির্ভূত সমাজের সংস্কার এই গল্পের মধ্যে বিদ্যমান। গোপাল এই সমাজ, সংস্কার ও সংস্কৃতির লোক। বোধ হয় এই জন্যই মঞ্জুশ্ৰীমূলকল্পের গ্রন্থকার পালরাজাদের বলিয়াছেন “দাসজীবিনঃ”। অথচ এই পালরাজারা ব্ৰাহ্মণ্যধর্ম, স্মৃতি, সংস্কার ও সংস্কৃতির ধারক ও পোষক, চার্তৃবর্ণের রক্ষক ও সংস্থাপক; লিপিগুলিতে তাহার প্রমাণ ইতস্তত বিক্ষিপ্ত। ধর্মে ইহারা বৌদ্ধ, পরম সুগত; ইহারা মহাযানী বৌদ্ধসংঘ ও সম্প্রদায়ের পরম অনুরাগী পোষক; অথচ বৈদিক ও পৌরাণিক ব্রাহ্মণ্যধৰ্মও ইহাদের আনুকূল্য ও পোষকতা লাভ করিয়াছে। শুধু তাঁহাই নয়, একাধিক পালরাজা ব্ৰাহ্মণ্যধর্মের পূজা এবং যাগযজ্ঞে নিজেরা অংশ গ্রহণ করিয়াছেন, পুরোহিত্য-সিঞ্চিত শান্তিবারি নিজেদের মস্তকে ধারণ করিয়াছেন। রাষ্ট্রের বিভিন্ন কর্মে ব্ৰাহ্মণের নিয়োজিত হইতেন, মন্ত্রী এবং সেনাপতিও হইতেন, আবার কৈবর্তরাও স্থান পাইতেন না, এমন নয়। এই ভাবে পালবংশকেও কেন্দ্র ও আশ্রয় করিয়া বাঙলাদেশে প্রথম সামাজিক সমন্বয় সম্ভব। হইয়াছিল; একদিনে নয়, চারিশত বৎসর ধরিয়াই তাহা চলিয়াছিল। ব্রাহ্মণ ও ব্রাহ্মণেতার স্মৃতি ও আচার, আর্য ও আর্যেতর সংস্কার ও সংস্কৃতি, বৌদ্ধ ও ব্রাহ্মণ্য পুরাণ, পূজা, শিক্ষা ও আদর্শ, দেবদেবী সমস্তই পালবংশকে কেন্দ্র ও আশ্ৰয় করিয়া পরস্পরে আদান-প্ৰদান করিয়াছে এবং এক মিলন সমন্বয় সূত্রে গ্রথিত হইয়া একটি বৃহৎ সামাজিক সমন্বয় গড়িয়া তুলিয়াছে। গুপ্ত—আমল হইতে আরম্ভ করিয়া আর্য জৈন ও বৌদ্ধধর্মের উপর যে ব্রাহ্মণ্যধর্ম ও সংস্কৃতির স্রোত বাঙলার বুকের উপর দ্রুত প্রবাহিত হইতেছিল, এবং মোটামুটি সপ্তম শতকে যে সাংস্কৃতিক সংঘর্যের সৃষ্টি করিয়াছিল—শশাঙ্ক তো ইহারই প্রতীক—সেই স্রোত ও সংঘর্ষ সমন্বিত হইল। এই চারিশত বৎসর ধরিয়া পাল-রাজাদের বৃহৎ ছত্ৰছায়ায়। এই আর্য সংস্কার ও সংস্কৃতির বাহিরে যে বৃহৎ আর্যোিতর সংস্কার ও সংস্কৃতি দেশের অধিকাংশ জুড়িয়া বিরাজ করিতেছিল তাহাও অন্তত কিছুটা যে পাল-রাজচ্ছত্রের আশ্রয় লাভ করিয়াছিল, তাহার কিছু প্রমাণ পাওয়া যায় পাহাড়পুরের অসংখ্যা পোড়ামাটির ফলকগুলিতে এবং সমসাময়িক ধর্মমত ও সম্প্রদায়গুলিতে। বৌদ্ধ এবং ব্রাহ্মণ্য উভয় ধর্মেই এই সময়ই আযেতির দেবদেবী, আচার ও সংস্কার ধীরে ধীরে নিজেদের প্রভাব বিস্তার করিতে থাকে এবং কিছু কিছু স্বীকৃতিও লাভ করে। এই যুগের দেবদেবীর মূর্তিতত্ত্ব তাহার সর্বশ্রেষ্ঠ প্রমাণ এবং এ-প্রমাণ অনস্বীকার্য। এই সুবৃহৎ সমন্বয় অবশ্যই সংগঠিত হইয়াছিল আর্য ব্রাহ্মণ্য স্মৃতি ও সংস্কৃতির আদর্শনুযায়ী; পলি-রাজারাও তাঁহা স্বীকার করিয়া লইয়াছিলেন। ভূমি-ব্যবস্থা, উত্তরাধিকার, চাতুৰ্ব্বণের স্বীকৃতি, সমাজ ও রাষ্ট্র-ব্যবস্থা, সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যের স্বীকৃতি এবং প্রচলন শুধু নয়, সেই ভাষায় কাব্যময় সাহিত্য রচনা এই সমস্তই সেই আদর্শের নিঃসন্দিগ্ধ পরিচয় বহন করে। এই আর্য বৌদ্ধ এবং ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির আশ্রয় করিয়াই বাঙলাদেশ উত্তরোত্তর উত্তর ভারতীয় সমাজ ও সংস্কৃতির ক্রমবর্ধমান ধারার সঙ্গে আত্মীয়তায় যুক্ত হয়। এই সচেতন যোগ সাধন আরম্ভ হইয়াছিল গুপ্ত—আমলেই, কিন্তু পর্ণরূপ গ্ৰহণ করিল পাল-আমলে; এবং বাঙলাদেশে তাহা এক বৃহত্তর সমন্বয়ের আশ্রয় হইল, আর্যেতর এবং মহাযান-বজ্রযান-তন্ত্রযান-বৌদ্ধধর্মের সংস্কার ও সংস্কৃতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ আত্মীয়তায় যুক্ত হইয়া এই সমন্বিত এবং সমীকৃত সংস্কৃতিই বাঙালীর সংস্কৃতির ভিত্তি, এবং ইহাও পাল-আমলের অন্যতম শ্রেষ্ঠদান। সমন্বয় এবং সমীকরণের এই রূপ ও প্রকৃতি ভারতের অনাত্র আর কোথাও দেখা যায় না।

সামন্ততন্ত্র

কিন্তু জাতীয় স্বাতন্ত্র্যবোধ এবং সমন্বয় ও সমীকরণ পালযুগের রাষ্ট্রীয় সমস্যার সমাধান করিতে পারে নাই! স্থানীয় প্রাদেশিক আত্মকর্তৃত্বের রাষ্ট্রীয় আদর্শের কথা বলিয়াছি। এই আদর্শ শুধু যে বৃহত্তর রাষ্ট্ৰীয় ক্ষেত্রেই সক্রয় ছিল তাহা নয়, সাম্রাজ্যিক গুপ্ত-আমলের পর হইতে আন্তরাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রেও এই আদর্শ ক্রমশ কার্যকরী হইল। ইহা হইতেই সামন্ততন্ত্রের উদ্ভব, এবং আগেই দেখিয়াছি মোটামুটি যষ্ঠ শতক হইতে বাঙলা দেশেও মহারাজাধিরাজের বৃহত্তর রাজ্যের মধ্যে অনেক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সামন্ত-নায়ক ও সামগু-রাজার রাজ্য ও রাষ্ট্রের বিস্তার। নিজেদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যে ইহারা প্রায় স্বাধীন নরপতির মতনই ব্যবহার করিতেন; শুধু মৌখিকত মহারাজাধিরাজকে মানিয়া চলিতেন মাত্র। পাল-আমলে এই সামন্ত প্ৰথা ভারতের অন্যান্য প্রদেশের ন্যায় বাঙলাদেশেও পূর্ণ পরিণতি লাভ করিয়াছিল। বস্তুত, পালরাষ্ট্রের রাষ্ট্রভিত্তিই এই সামন্ততন্ত্র এবং এই সমস্তুতন্ত্রই পাল-রাষ্ট্রের শক্তি এবং সঙ্গে সঙ্গে দুর্বলতাও। বিজিত রাষ্ট্রসমূহকে মৌর্য বা গুপ্ত রাষ্ট্রের মতো এই আমলে আর কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত করা হইত। না; বস্তুত, তাহারা স্বাধীন স্বতন্ত্র রাষ্ট্রই থাকিস্ত, পাল-রাষ্ট্রের সর্বাধিপত্য স্বীকার করিত মাত্র। কিন্তু এই কেন্দ্রীয় অন্তরাষ্ট্রেও যে অসংখ্য সামন্ত নরপতি ও নায়ক ছিলেন, পাল-লিপিমালা ও রামচরিতই তাহার প্রমাণ। উভয় ক্ষেত্রেই স্থানীয় আত্মকর্তৃত্বের আদৰ্শই জয়ী হইয়াছে, এ-কথা অস্বীকার করিবার উপায় নাই। কেন্দ্রীয় রাষ্ট্র ও রাজবংশ যখন দুর্বল হইত। তখন উভয়ই মস্তকোত্তালন করিত। দেবপালের মৃত্যুর পর বিজিত রাষ্ট্রসমূহ স্থানীয় আত্মকর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করিয়াই পালসাম্রাজা ভাঙিয়া দিয়াছিল; মহীপাল সেই সাম্রাজ্যের কতকাংশ জোড়া লাগাইয়াছিলেন, কিন্তু বেশিদিন তাহা স্থায়ী হয় নাই। বিজিত ও অবিজিত রাষ্ট্র এবং অন্তরাষ্ট্রের স শাস্তবর্গ মহীপালের চেষ্টাকে ব্যর্থ করিয়া দিয়াছিল। আর, দ্বিতীয় মহীপালের বিরুদ্ধে যাহারা বিদ্রোহ করিয়াছিলেন তাহারা তো অন্তরাষ্ট্রেরই অনন্ত-সামন্তচক্র। আবার, রামপাল যখন বরেন্দ্রী পুনরুদ্ধার করিয়া পাল-রাজ্যের লুপ্ত গৌরব ফিরাইয়া আনিয়াছিলেন তখনও তাহার প্রধান সহায়ক ছিলেন এই সামন্তবর্গ। আবার ইহারাই রামপালের মৃত্যুর পর পালরাজ্য ও রাষ্ট্রকে বিচ্ছিন্ন ও দুর্বল করিয়া তাঁহাদের বিলুপ্তির পথে আগাইয়া দিয়াছিলেন। সামন্ত-মহাসামন্ত, মণ্ডলিক-মহামাগুলিক, মণ্ডলেশ্বর-মহামণ্ডলেশ্বর ইহারা সকলেই ক্ষুদ্র বৃহৎ সামন্ত, এবং অনেক রাজা-মহারাজা ও সামন্ত; ইহাদের সাক্ষাৎ পাল-লিপিগুলিতে বরাবরই পাওয়া যায়। রাজন, রািণক, রাজনক, রাজনাক ইহারা সকলেই সামন্ত। আর সামন্ততন্ত্র যখন ছিল তখন সামন্ততান্ত্রিক বীরধর্ম এবং সেই ধর্মোণ্ডুত বীরগাথাও প্রচলিত নিশ্চয়ই ছিল। এই বীরধর্মের কতকটা পরিচয় পাওয়া যায় দেবপালের সমস্ত বলবৰ্মার (নালন্দা-লিপি) চরিত্রে, রামচরিতে রামপালের সমস্তদের আচরণ, ভীম-সহায়ক হারির আচরণে। আর বীরগাথার পরিচয় পাওয়া যায় ধৰ্মপাল-সম্বন্ধীয় গাথায় (খালিমপুর-লিপি), উত্তরবঙ্গের মহীপালের গানে, যোগীপাল ভোগী।পালের গীতে। সুতরাং (পরবর্তী কালের ভাট-ব্রাহ্মণেরা) যে বীরগাথা গাহিয়া বেড়াইতেন তাহার অন্তত একটি প্রমাণ পাওয়া যায় মহামাণ্ডলিক ঈশ্বর ঘোষের লিপিটিতে। ঈশ্বর ঘোষের বংশের প্রতিষ্ঠাতা ধূর্তঘোয্যের পুত্র বালিঘোেষ যুদ্ধব্যবসায়ী ছিলেন; আঁহার পুত্ৰ ধবলঘোষের বীরত্ব ও গৌরব গাথায় গীত হইত। কিন্তু এই বীর্যধর্ম বা স্বামী ধর্ম সম্বন্ধে সবচেয়ে সন্দবু সংবাদ পাওয়া যায় বোধ হয় তৃতীয় গোপালের নিমদীঘি বা মাণ্ড শাসনে। এই লিপিটির পাঠ নিঃসন্দিগ্ধ নয়। নলিনীকাপ্ত ভট্টশালী মহাশয়ের পাঠ গ্রহণযোগ্য। কিনা, এ-বিষয়ে সন্দেহ পোষণের যথেষ্ট কারণ বিদ্যমান। এই পাঠ অনুযায়ী মিজং নামে গোপালের এক সামন্ত কলিখেছিলেন,

‘শ্ৰীমদ গোপালদেব স্বেচ্ছায় শরীর ত্যাগ করিয়া স্বৰ্গত হইয়াছেন এবং তাহার পদধূলি মিজং নামে প্রথিত আমি (হায়!) এখনও বাচিয়া আছি। পিতৃ আজ্ঞায় (রাজার প্রতি) প্রতিজ্ঞাবদ্ধ অসীম কৃতজ্ঞাসম্পন্ন ঐড়দেব সেনশত্রুকে একশত তীক্ষ্ণশরদ্বারা পূরিত করিয়া আটজন সহচরসহ রাজার সহিত স্বর্গে গিয়াছেন। যুদ্ধদ্বারা নিজের (জীবিতাবস্থা) অতিক্রম করিয়া চন্দ্ৰকিরণের মতো আমল যশ অর্জন পূর্বক শুভদেবানন্দন (ঐড়দেব) দেবতাগণের মতো ত্ৰিদশ সুন্দরীগণের দৃষ্টি লইয়া খেলা করিতেছেন। তঁহার (ঐড়দেবের) গীতবাদ্যপ্রিয়, ধর্মধর অমৎসর, গলবস্ত্ৰ, দানশূর সুসংযত বেশ বৈমাত্ৰেয় ভ্ৰাতা শ্ৰীমান ভাবিক যজ্ঞাদি ধর্মকার্য (শ্রাদ্ধ?) সম্পাদন করেন। শরশিল্য দ্বারা পূরিত বহু প্ৰাণীকে (সৈন্যকে) যে স্থানে দগ্ধ করা হইয়াছিল, সেই স্থানে ভাবকাদাসকৃত এই কীর্তি (মন্দির?) বিরাজ করিতেছে।…’

সামন্ততান্ত্রিক স্বামীধৰ্ম, বীরধর্ম পালনের ইহার চেয়ে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত আর কী হইতে পারে? ঐড়দেব ও মিজং দুইটি নামই অ-সংস্কৃত, অনা-আর্য; দুইজনই প্রাচীন বাঙলার স্বামীধর্ম ও বীরধর্মের জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত। তাহা ছাড়া, সামন্ততান্ত্রিক যুগের অন্যতম বৈশিষ্ট্য সতীদাহ প্রথাও পাল-ভীমামলের শেষ দিকে এবং সেন আমলে প্রসার লাভ করিয়াছিল বলিয়া মনে হয়। বৃহদ্ধৰ্মপুরাণ গ্রন্থে (২।৮।৩-১০) মৃত স্বামীর সঙ্গে পুড়িয়া মরিবার জন্য সমাজ-নায়কেরা দ্বিজ নারীদের পুণ্যলোভে প্রলুব্ধ করিয়াছেন। ইহার চেয়ে বীরত্ব নাকি তঁহাদের আর কিছু নাই; সহমরণে গেলে নাকি এক পূর্ণ মন্বন্তর স্বামীসঙ্গসুখ ভোগ করা যায়; বাঙলাদেশ একাদশ-দ্বাদশ শতকেই সামন্ততন্ত্রের সব ক’টি লক্ষণ ফুটাইয়া তুলিয়াছিল, সন্দেহ নাই।

আমলাতন্ত্র

সামন্ততান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা যেমন প্রসারিত হইয়াছিল, তেমনই প্রসারিত হইয়াছিল আমলা বা কর্মচারীতন্ত্র। বস্তুত, পাল-যুগের লিপিমালায় রাজকর্মচারীদের যে সুদীর্ঘ তালিকা দৃষ্টিগোচর হয়। তাহা হইতে এই তথ্য সুস্পষ্ট যে, এই যুগে রাষ্ট্রের বৃহদ্বাহু সমাজের সর্বাঙ্ক ব্যাপিয়া বিস্তুত। বিভিন্ন রাষ্ট্রকর্মের বিচিত্র বিভাগে বিচিত্র কর্মচারী রাষ্ট্রর প্রধান কেন্দ্ৰ হইতে আরম্ভ করিয়া একেবারে গ্রামের হাট খেয়াঘাট পর্যন্ত বিস্তৃত ৷ লৌকিক প্রায় সমস্ত ব্যাপারই ব্লাষ্ট্রশাসনের গাওঁীর অন্তর্ভুক্ত, এমন কি পারলৌকিক ধর্মাচরণ পর্যন্ত। লিপিগুলিতে এই সব বিক্রিত” বিভাগের বিচিত্র কর্মচারীর সুদীর্ঘ তালিকা দেওয়ার পরও যখন তাহা শেষ হয় নাই তখন “অন্যাংশ্চকীর্তিতান” বলিয়া বাকি সকলকে অন্তর্ভুক্ত করা হইয়াছে। একটা বৃহৎ আমলাতন্ত্র যে পাল-যুগে গড়িয়া উঠিয়াছিল। এই সব সাক্ষ্যই তাহার প্রমাণ। প্রধান প্রধান কঁর্মচারী, যেমন মন্ত্রী, সেনাপতি ইত্যাদির হাতে ক্ষমতাও প্রচুর কেন্দ্রীকৃত হইত। অত্যন্ত স্বাভাবিক উপায়েই। এই সব কর্মচারীরাও কখনো কখনো সুযোগ পাইলে রাষ্ট্রের স্বার্থের প্রতিকূল আচরণ করিতেন না, এমন নয়। দিব্য তো একজন উচ্চ রাজকর্মচারী ছিলেন বলিয়া মনে হয়; আর, বৈদ্যদেব তো কুমারপালের সেনাপতিই ছিলেন।

সমাজের কৃষি-নির্ভরতা

এই সামন্ততন্ত্র ও আমলাতন্ত্র অকারণে গড়িয়া উঠে নাই। এই আমলে বাঙলাদেশের সামুদ্রিক বাণিজ্যের খবর একেবারেই পাওয়া যাইতেছে না। তাম্রলিপ্তি মৃত; নূতন কোনো বন্দর গড়িয়া উঠিয়াছে বলিয়া খবর নাই। বিহার-বাঙলার সঙ্গে সুমাত্রা-যবদ্বীপ-ব্ৰহ্মদেশ ইত্যাদি পূর্ব-দক্ষিণ এশিয়ার দেশ ও দ্বীপগুলির যোগাযোগ অব্যাহত; নালন্দায় প্রাপ্ত শৈলেন্দ্ৰবংশীয় বালপুত্রদেবের লিপিই তাহার অন্যতম প্রমাণ! এই সব দ্বীপ ও দেশগুলির ইতিহাসেও এই যোগাযোগের অনেক প্রমাণ পাওয়া যায়; কিন্তু একটি প্রমাণও ব্যাবসা-বাণিজ্যিক যোগাযোগের দিকে ইঙ্গিত করে বলিয়া মনে হয় না, সবই যেন ধর্ম ও সংস্কৃতি সম্বন্ধীয়। তবে আন্তঃদেশীয় ব্যাবসা-বাণিজ্য অব্যাহত; লিপিগুলিতে বণিক-ব্যবসায়ী ইত্যাদির সংবাদ অপ্রতুল নয়। নানাপ্রকার কারু এবং চারুশিল্পের সংবাদও পাওয়া যাইতেছে এবং শিল্পীদের গোষ্ঠী যে ছিল তাহার অন্তত একটি প্রমাণ আছে। জনৈক শিল্পীগোষ্ঠী-চুড়ামণি তো একজন সামন্ত বা উচ্চ রাজপদও (রাণক) লাভ করিয়াছিলেন। কিন্তু তৎসত্ত্বেও মনে হয় রাষ্ট্রে বা সমাজে শিল্পী-বণিক-ব্যবসায়ীর প্রাধান্য খুব ছিল না। তাহা ছাড়া, বর্ণ ব্ৰাহ্মণা-সমাজে তাহারা উচ্চস্থান অধিকার করিতেন বলিয়া মনে হয়। না। রৌপ্যমুদ্রা প্রচলনের খবর যদি বা পাওয়া যাইতেছে। সুবর্ণমুদ্রা একেবারে নাই। এই সাক্ষ্য হইতে মনে হয়, শিল্পী-বণিক-ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের প্রতিপত্তি রাষ্ট্রে ও সমাজে খুব ছিল না। অথচ অন্যদিকে সমাজে ভূমি ও কৃষিনির্ভরতা ক্রমশ বাড়িয়া যাইতেছে তাহার প্রমাণ প্রচুর। ব্ৰাহ্মণ সম্প্রদায়, রাজপাদোপজীবী ও মধ্যবিত্ত শ্রেণী (মহত্তর, কুটুম্ব প্রভৃতি) ইত্যাদি সকলেই তো ভূমিনির্ভর। তাহা ছাড়া, ক্ষেত্রকর, কৃষক, কর্ষকেরা বারবার লিপিগুলিতে উল্লিখিত হইতেছেন দেখিয়া এ-অনুমান করা চলে যে, সমাজে তাহাদের স্বীকৃতি বাড়িয়াছে। প্রধানত ভূমি-নির্ভর সমাজে সামস্ততান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা কতকটা স্বাভাবিক। ভূমিই যে-সমাজে জীবিকার প্রধান উপায় এবং ভূমির উপর ব্যক্তিগত ভোগাধিকার যেখানে স্বীকৃত, সেখানে সামন্ততান্ত্রিক ভূম্যধিকারগত সমাজ-ব্যবস্থা গড়িয়া উঠিবে, ইহা কিছু আশ্চর্য নয়।

এই একান্ত ভূমি-নির্ভরতার ছবি পাল-যুগের রাজকর্মচারীদের তালিকাটি দেখিলেও চোখে পড়ে। আশ্চর্য এই সুদীর্ঘ তালিকাটির মধ্যে নাকাধ্যক্ষ (নৌকাধ্যক্ষ-নাবাধ্যক্ষ), শোন্ধিক (যিনি শুল্ক আদায় করেন) এবং তরিক (পারাপার-কর্তা) ছাড়া আর একটি পদও ব্যাবসা-বাণিজ্য ইত্যাদির সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। এবং এই তিনটি পদও যে একান্তই ব্যাবসা-বাণিজ্য সংক্রান্ত তাহাও বলা চলে না। অন্যদিকে সামরিক ও শাসনসংক্রান্ত কর্মচারী ছাড়া অধিকাংশ রাজপদ ভূমি ও কৃষিসম্পর্কিত।