০৫. যুগান্তর ও বঙ্গ-গৌড়ের স্বাতন্ত্র্য ৷ আঃ ৫০০-৬৫০

যুগান্তর ও বঙ্গ-গৌড়ের স্বাতন্ত্র্য ৷ আঃ ৫০০-৬৫০

খ্ৰীষ্টোত্তর পঞ্চম শতকে দুর্ধর্ষ হ্রণেরা ভারতবর্ষের উপর ঝাপাইয়া পড়িল এবং গুপ্তসাম্রাজ্যের বুকের উপর বসিয়া তাহার ভিত্তি একেবারে ঝাকিয়া নাড়িয়া দুর্বল করিয়া দিল। প্রায় এই সময়ই বা তাহার কিছু আগে এই কুণদেরই আর এক শাখা য়ুরোপের বুকের উপর পড়িয়া পূর্ব ও মধ্য-য়ুরোপের রাষ্ট্র ও সমাজ-ব্যবস্থা তছনছ করিয়া দিয়াছিল। ষষ্ঠ শতকের গোড়ায় গুপ্ত-সাম্রাজ্যের দুর্বলতা সুস্পষ্ট হইয়া উঠিল; পূর্বতম প্রত্যন্তের সামন্ত নরপতি মহারাজ বৈন্যগুপ্ত স্বাতন্ত্র্য লাভ করিয়া মহারাজাধিরাজ হইয়া উঠিলেন। মধ্য-ভারতে মান্দাসের অঞ্চলের বংশগোত্র পরিচয়-বিহীন যশোধৰ্মণ নামে জনৈক দিগ্বিজয়ী বীর প্রবল প্রতাপশালী হইয়া উঠিয়া শিথিলমূল গুপ্তসাম্রাজ্যসৌধটিকে প্রায় ধরাশায়ী করিয়া দিলেন। যশোধৰ্মণ লৌহিত্যতীর পর্যন্ত তাঁহার অপরাভূত সৈন্যবাহিনী লইয়া অগ্রসর হইয়াছিলেন এবং সম্ভবত বাঙলাদেশ আর একবার বৈতসীবৃত্তি আশ্রয় করিয়া এই অপরাজেয় যোদ্ধার কাছে মস্তক অবনত করিয়াছিল। তিনি দুর্ধর্ষ কুণদেরও পরাজিত করিয়া তঁহাদের নেতা মিহিরকুলকে তাড়াইয়া লইয়া গিয়াছিলেন। কাশ্মীরে। কিন্তু যশোবর্মার দিগ্বিজয় ছিল ক্ষণস্থায়ী এবং তিনি কোনও রাজবংশ বা স্থায়ী রাজ্য বা রাজত্ব গড়িয়া তুলিতে পারেন নাই। সুযোগ পাইয়া উত্তর-ভারতের বড় বড় সামন্তেরা স্বাতন্ত্র্য ঘোষণা করিয়া নূতন নূতন রাজ্য ও রাজবংশ গড়িয়া তুলিলেন; কনৌজ-কোশলে মৌখরী রাজবংশ এবং স্থানীশ্বরে পুষ্যভূতি-বংশ মস্তক উত্তোলন করিল। গুপ্ত-রাজবংশের দুর্বল বংশধর ও প্রতিনিধিরা মগধ-মালবকে কেন্দ্ৰ করিয়া কোনও প্রকারে একদা-প্রদীপ্ত সূর্যের স্মৃতি একটি ক্ষুদ্র দীপশিখায় জিয়াইয়া রাখিলেন। বাঙলাদেশও এই সুযোগ গ্রহণে অবহেলা করিল না। সর্বাগ্রে স্বাতন্ত্র্য ঘোষণা করিল পূর্ব ও দক্ষিণবঙ্গ এবং পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান অঞ্চল। ৫০৭-৮ খ্ৰীষ্টাব্দে ত্রিপুরা অঞ্চল অর্থাৎ পূর্ববঙ্গ বৈন্যগুপ্তের অধীন ছিল; বর্ধমান অঞ্চল তখন বৈন্যগুপ্তের সামন্ত বিজয়সেনের শাসনাধীনে। অনুমান হয়, এই অঞ্চল হইতে আরম্ভ করিয়া ত্রিপুরা পর্যন্ত বৈন্যগুপ্তের রাজ্য বিস্তৃত ছিল; এই অঞ্চলই ষষ্ঠ শতকের প্রথম অথবা দ্বিতীয় পাদে, ৫০৭-৮’র কিছু পরে, স্বাতন্ত্র্য ঘোষণা করিয়া বসিল। এই শতকের শেষ পাদে কোনও সময়ে স্বাতন্ত্র্য ঘোষণা করিল গৌড়। গৌড় ও বঙ্গের স্বাতন্ত্র্যের ইতিহাসই ষষ্ঠ শতকের দ্বিতীয় পাদ হইতে সপ্তম শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত বাঙলাদেশের ইতিহাস; এবং এই ইতিহাস একদিকে ধর্মাদিত্য-গোপচন্দ্ৰ —সমাচার দেবের রাজবংশ এবং অন্যদিকে গৌড়াধিপ শশাঙ্ককে আশ্রয় করিয়া কেন্দ্রীকৃত।

বঙ্গ-গোপচন্দ্রের বংশ

ফরিদপুর জেলার কোটালিপাড়া অঞ্চলে প্রাপ্ত পাঁচটি এবং বর্ধমান অঞ্চলে আবিষ্কৃত একটি, এই ছয়টি পট্টোলীতে তিনটি মহারাজাধিরাজের খবর পাওয়া যাইতেছে; গোপচন্দ্র, ধর্মাদিত্য এবং নরেন্দ্ৰাদিত্য সমাচারদেব। ইহাদের পরস্পরের সঙ্গে পরম্পরের কী সম্পর্ক তাহা নিশ্চয় করিয়া বলিবার উপায় নাই, তবে ইহারা তিনজনে মিলিয়া অনূ্যন ৩৫ বৎসর রাজত্ব করিয়াছিলেন এবং এই রাজত্বের কাল মোটামুটি ষষ্ঠ শতকের দ্বিতীয় পাদ হইতে তৃতীয় পাদ পর্যন্ত। লিপি-প্রমাণ হইতে মনে হয়, গোপচন্দ্ৰই ইহাদের প্রথমতম এবং প্রধানতম, এবং ইহাদের রাজ্য বর্ধমান অঞ্চল হইতে আরম্ভ করিয়া একেবারে ত্রিপুরা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল; কেন্দ্ৰস্থল ছিল বোধ হয় ফরিদপুর অথবা ত্রিপুরা অঞ্চলে। রাজ্যের ছিল দুইটি বিভাগ, একটি বর্ধমানভুক্তি, অপরটি নব্যাবকাশিকা (নূতন অবকাশ বা নবসৃষ্ট ভূমি = ফরিদপুরের কোটালিপাড়া অঞ্চল?)। বর্ধমান অঞ্চলের যে-বিজযসেন একদা ছিলেন মহারাজ বৈন্যগুপ্তের সামন্ত তিনি এখন সামন্ত হইলেন গোপচন্দ্রের। আবিষ্কৃত সুবর্ণমুদ্রা হইতে মনে হয়, সমাচার দেবের পরও আরও কয়েকজন রাজা এই সব অঞ্চলে রাজত্ব করিয়াছিলেন; ইহাদের মধ্যে একজনের নাম পৃথুজবীর (মতান্তরে, পৃথুবীর অথবা পৃথুবীরাজ) ও আর একজনের নাম সুধন্যা (বা শ্ৰীসুধন্যাদিত্য)। বাতাপী বা বাদামীর চালুক্যরাজ কীর্তিবর্মী। ৫৯৭-৯৮ খ্ৰীষ্টাব্দের আগে কোনও সময় একবার বঙ্গদেশ জয় করিয়াছিলেন। বোধ হয় তাহার এই আক্রমণের ফলে, অথবা গৌড়ে শশাঙ্কের অভ্যুদয় ও রাজ্যবিস্তারের ফলে, অথবা দুইয়েরই সম্মিলিত ফলে বঙ্গের স্বাতন্ত্র্য কিছুদিনের জন্য ক্ষুগ্ধ হইয়া থাকিবে।

বঙ্গ ও সমতট ৷ বৌদ্ধ খড়্গ বংশ

সপ্তম শতকের প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় পাদে সমতটে একটি বৌদ্ধ রাজবংশের খবর পাওয়া যাইতেছে আশ্রফপুরের দুইটি লিপিতে এবং চীন পরিব্রাজক ইৎ-সিঙ ও সেং-চি’র বিবরণীতে। আশ্ৰফপুরের লিপি দুইটিতে নৃপধিরাজ খড়েগাদ্যম, (পুত্র) জাতখড়্গ, (পুত্র) দেবখড়্গ এবং (পুত্র) রাজরাজ (ভট্ট) নামে চারজন রাজার খবর পাওয়া যাইতেছে। এই বংশ ইতিহাসে খড়্গ বংশ নামে খ্যাত। ত্রিপুরা জেলার দেউলবাড়ীতে প্রাপ্ত শর্বাণী দেবীর (দুর্গার) একটি মূর্তির পাদপীঠে দেবখড়্গের স্ত্রী এবং রাজরাজভট্টের মাতা প্রভাবতীর নাম উৎকীর্ণ আছে। সোং-চি’ রাজভটি নামে সমতটের এক বৌদ্ধ রাজার নাম করিয়াছেন, এবং ইৎসিঙও দেববর্মী নামে পূৰ্বদেশের এক রাজার খবর দিতেছেন। দেববর্ম ও দেবখড়্গ এক ব্যক্তি হইলেও হইতে পারেন, না-ও হইতে পারেন; কিন্তু সেং-চি-কথিত রাজভটি যে আম্রফপুর-পট্টোলীর রাজরাজীভট্ট, এ-তথ্য নিঃসংশয় বলিলেই চলে। যাহা হউক, এই বংশের অন্তত একটি জয়স্কন্ধাবার ছিল কর্মন্তবাসক (বোধ হয়, ত্রিপুরা জেলার বর্তমান বড়কামাতা)। আম্রফপুর ঢাকার ত্ৰিশ মাইল উত্তর-পূর্ব দিকে। অনুমান হয়, অন্তত বর্তমান ঢাকা ও ত্রিপুরা অঞ্চল এই বংশের রাজ্যের অন্তর্গত ছিল। যাহাই হউক, খড়্গ এই উপান্ত নাম দেশজ বলিয়া মনে হয় না। খড়্গ বংশের রাজারা কোনো পার্বত্য কোমের প্রতিনিধি হইলেও হইতে পারেন। খড়্গ বংশ বোধ হয় স্বাধীন রাজবংশ ছিল না। রাজরাজ্যভট্টের আস্রফপুর-লিপিতে একখণ্ড ভূমির উল্লেখ আছে; এই ভূমিখণ্ড ইতিপূর্বেই জনৈক ‘বৃহৎ-পরমেশ্বর” কর্তৃক দান করা হইয়াছিল। এই “বৃহৎ পরমেশ্বর” কে ছিলেন, বলা কঠিন, তবে খড়্গরা যে সদোক্ত বৃহৎ-পরমেশ্বরের সামন্তবংশ ছিলেন, এমন অনুমান অযৌক্তিক নয়। সামন্তরাও যে অনেক সময় ‘নৃপধিরাজ’, ‘অধিমহারাজ বলিয়া উল্লিখিত হইতেন, এমন প্রমাণ দুর্লভ নয়। খড়্গবংশীয় রাজারা প্রথমে বোধহয় বঙ্গে রাজত্ব করিতেন, পরে সমতট রাজত্ব বিস্তার করিয়া থাকিবেন।

সমতট

ত্রিপুরা জেলায় প্রাপ্ত সপ্তম শতকীয় একটি পট্টোলীতে আর একটি সামন্ত রাজবংশের খবর পাওয়া যাইতেছে। এই বংশের প্রতিষ্ঠাতা। একজন অধিমহারাজ ছিলেন; তাহার পুত্র ছিলেন মহাসামন্ত শিবনাথ, শিবনাথের পুত্ৰ শ্ৰীনাথ, শ্ৰীনাথের পুত্র ভবনাথ, তারপর লোকনাথ। অনেকে মনে করেন এই সামন্ত-রাজবংশের খড়্গবংশীয় নৃপধিরাজদের অধিরাজত্ব স্বীকার করিতেন। এ-সম্বন্ধে নিশ্চয়ই করিয়া কিছু বলিবার উপায় নাই।

সমতটেশ্বর রাতবংশ

লোকনাথের ত্রিপুরা-পট্টোলীতে লোকনাথেরই সমসাময়িক জনৈক নৃপ জীবধারণের উল্লেখ আছে। এই জীবধারণ যে-বংশের রাজা ছিলেন সেই বংশকে রাতবংশ বলা যাইতে পারে। ত্রিপুরা জেলার কৈলান গ্রামে অধুনাবিষ্কৃত একটি পট্টোলী হইতে এই বংশের দুইটি রাজার খবর পাওয়া যাইতেছে। অক্ষর-সাক্ষ্য হইতে মনে হয়, এই সামন্ত রাজবংশ সপ্তম শতকের দ্বিতীয় ও তৃতীয় পাদে সমতটের অধীশ্বর ছিলেন। এই বংশের প্রতিষ্ঠাতা বোধ হয় ছিলেন সমতটেশ্বর প্রতাপোেপনত্যসামন্তচক্ৰ-শ্ৰীজীবধারণ রাত; তাহার পুত্র ছিলেন সমতটেশ্বর প্রাপ্তপঞ্চমহাশব্দ (অর্থাৎ যিনি একাধারে মহাপ্ৰতীহার, মহাসান্ধিবিগ্রহিক, মহাঅশ্বশালাধিকৃত, মহাভাণ্ডাগারিক এবং মহাসােধনিক) শ্ৰীশ্ৰীধারণ রাত; শ্ৰীধারণের পুত্র ছিলেন যুবরাজ বলধারণ রাত। বলা বাহুল্য, এই রাতবংশও সামন্তবংশ, স্বাধীন রাজবংশ নহেন। তবে খড়্গ বংশ বা লোকনাথের বংশ বা রাতবংশ, ইহারা নামেই শুধু ছিলেন সামন্তবংশ; কার্যত ইহারা স্বাধীন নরপতিদের মতই ব্যবহার করিতেন। রাতবংশের রাজারা ছিলেন ব্ৰাহ্মণ্যধর্মাবলম্বী, এবং শ্ৰীধারণ নিজে ছিলেন পরম বৈষ্ণব; কিন্তু কৈলান-পট্টোলীদ্বারা যে-ভূমি বিক্রীত এবং পট্টিকৃত হইয়াছিল সে-ভূমি রাজার মহাসান্ধিবিগ্রহিক জয়নাথ দান করিয়াছিলেন একটি বৌদ্ধবিহারে, আর্যসংঘের অশন,বসন এবং গ্রন্থাদির ব্যয় নির্বাহের জন্য এবং কতিপয় ব্রাহ্মণকে, তাহাদের পঞ্চমহাযজ্ঞের ব্যয় নির্বাহের জন্য। শ্ৰীধারণ ছিলেন পরমকারুণিক এবং একাধারে কবি, মধুর চিত্র রচয়িতা (অতি মধুরচিত্ৰসীতেরুৎপাদয়িতা), শব্দবিদ্যাপারঙ্গম এবং নানা বিদ্যা ও কলায় পারদর্শী। তাহার পুত্ৰ বলধারণও শব্দবিদ্যা, শস্ত্রবিদ্যা এবং হন্তী ও অশ্ববিদ্যায় সুনিপুণ ছিলেন।

খড়্গ বংশ, লোকনাথের বংশ এবং রাত বংশের রাজারা প্রায় সমসাময়িক; ইহারা সকলেই আবার সমতটে রাজত্ব করিয়াছিলেন। কে কাহার পরে সমতটের অধিকার লাভ করিয়াছিলেন, নিশ্চয় করিয়া বলা কঠিন; ইহাদের বৃহৎ-পরমেশ্বর মহারাজাধিরাজরাই-বা কাহারা ছিলেন, তাহাও বলা যায় না। তবে, মনে হয়, খড়্গ বংশ প্রথমে বঙ্গেই রাজত্ব করিতেন, পরে রাজা দেবখড়্গ সমতটে রাজ্যবিস্তার করেন। বোধ হয়, খড়্গদের সামন্ত হিসাবে, অথবা তাহাদের অবসানের পর আর কাহারও সামন্ত হিসাবে লোকনাথ সমতটের অধীশ্বর হন এবং লোকনাথকে পরাজিত করিয়া রাতবংশীয় জীবধারণ নিজ বংশের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেন। সপ্তম শতকের প্রথমার্ধে সমতট একটি ব্ৰাহ্মণ রাজবংশ রাজত্ব করিতেছিলেন এবং নালন্দার বৌদ্ধ মহাস্থবির য়ুয়ান-চোয়াঙের গুরু শীলভদ্র সেই রাজবংশের সন্তান ছিলেন বলিয়া য়ুয়ান-চোয়াঙ নিজেই সাক্ষ্য দিতেছেন। এই ব্ৰাহ্মণ রাজবংশ রাত বংশ হওয়া কিছু অসম্ভব নয়।

অসম্ভব নয় যে, সপ্তম শতকে গৌড়ে এবং উত্তর ও পশ্চিম-দক্ষিণবঙ্গে শশাঙ্ক যে গৌড়ত স্ত্ৰ প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন খড়্গ ও রাতবংশীয় রাজারা গোড়ায় তাহারই সামন্ত ছিলেন। শশাঙ্কের মৃত্যুর পর গৌড় তন্ত্র বিনষ্ট হইলে এই সব সামন্ত বংশ একে একে কার্যত স্বাধীন হইয়া উঠেন। ৮ এই সংক্ষিপ্ত তথ্যবিবৃতি হইতেই বুঝা যাইবে, সপ্তম শতকের শেষাশেষি পর্যন্ত কি অষ্টম শতকের গোড়া পর্যন্ত বঙ্গ ও সমতটের স্বাতন্ত্র্য বজায় ছিল; কিন্তু ঘন ঘন রাজবংশ পরিবর্তন ও প্রবল সামস্তাধিপত্য দেখিয়া মনে হয়, এই স্বাতন্ত্র্যের মূল শিথিল হইয়া পড়িতেছিল। তাহা ছাড়া, সমসাময়িক অন্যান্য সাক্ষ্য প্রমাণ হইতে জানা যায়, বঙ্গ ও সমতট এই সময় একাধিকবার বহিঃশত্রু দ্বারা আক্রান্ত হইতেছে এবং রাষ্ট্রে বিশৃঙ্খলার সূচনা দেখা দিতেছে। এই বিশৃঙ্খলার ইতিহাস পরবর্তী পর্বে আলোচনা করা যাইবে।

সপ্তম শতকের প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় পাদে যখন বঙ্গ ও সমতটে খড়্গ ও রাজবংশীয় সামন্তদের প্রভুত্ব চলিতেছে তখন গৌড়ের অবস্থােটা কি, তাহা দেখা যাইতে পারে।

গৌড়তন্ত্র

৫ নং দামোদরী-লিপির সাক্ষ্যানুযায়ী পুণ্ড্রবর্ধন ৫৪৪ খ্ৰীষ্ট—শতকেও জনৈক গুপ্তরাজের অধীন ‘ মহাসেনগুপ্ত নামক জনৈক গুপ্তান্তনামা নরপতি (আনুমানিক ষষ্ঠ শতকের চতুর্থ পাদ) লোহিত্যতীরে কামরূপরাজ সুস্থিতবর্মকে পরাজিত করিয়াছিলেন বলিয়া লিপি-প্রমাণ বিদ্যমান। পুণ্ড্রবর্ধন ও গৌড় ষষ্ঠ শতকের চতুর্থ পাদের আগে স্বাতন্ত্র্য লাভ করিতে পারিয়াছিল বলিয়া মনে হয় না। যাহা হউক, সপ্তম শতকের সূচনায় দেখা যাইতেছে, জনৈক শ্ৰীমহাসামন্ত শশাঙ্ক গৌড়ের স্বাধীন স্বতন্ত্র নরপতিরূপে দেখা দিতেছেন এবং গৌড়রাষ্ট্র উত্তর-ভারতের ইতিহাসে একটি স্বতন্ত্র বিশিষ্ট অধ্যায় রচনা করিতেছে।

গৌড়ের এই স্বাতন্ত্র্য লাভ ঐতিহাসিকেরা সাধারণত যতটা আকস্মিক বলিয়া মনে করেন, ততটা আকস্মিক নয়। ৫৫৪ খ্ৰীষ্টাব্দে বা তাহার অব্যবহিত আগে কোনও সময়ে কনৌজ-কোশলের মৌখরীরাজ। ঈশানবৰ্মার সঙ্গে একবার গৌড়জনদের এক সংঘর্ষ উপস্থিত হইয়াছিল। হোড়াহালিপিতে ঈশানবৰ্মা দাবি করিয়াছেন, তিনি গৌড়জনদের সমগ্র জনপদের ভবিষ্যৎ বিনষ্ট করিয়া দিয়া তাহাদিগকে সমুদ্রাশ্রয়ী করিতে বাধ্য করিয়াছিলেন। ঈশানবৰ্মার দাবি একটু অভিনিবেশে বিশ্লেষণ করিলে মনে হয়, ষষ্ঠ শতকের মাঝামাঝি সময়েই গৌড় জনপদ স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যলাভ করিতে আরম্ভ করিয়াছে এবং এই জনপদ একান্তই সমুদ্রনির্ভর। একাদশ শতকের গুরগি-শিলালিপিতেও দেখা যাইতেছে, গৌড়জনদের একটি সমুদ্র-জলদুর্গ ছিল (জলনিধিজলদুর্গং গৌড়েরাজ্যোহধিশেতে)। যাহা হউক, এই গৌড় জনপদ বোধ হয় যষ্ঠ শতক হইতে স্বাতন্ত্র্যাভিলাষী, অথবা নামে মাত্র গুপ্তবংশধরদের আয়ত্বে এবং ঈশানবৰ্মার গৌড়বিজয় বোধ হয় বংশপরম্পর-বিলম্বিত গুপ্ত-মৌখরী সংঘর্ষের একটি ক্ষুদ্র কাহিনী মাত্র। গুপ্তরাজ মহাসেনগুপ্তের ভগিনীকে বিবাহ করিয়াছিলেন পুষ্প বা পুষ্যভূতিরাজ প্রভাকরবর্ধন; তাহাদের দুই পুত্র ও এক কন্যা : রাজ্যবর্ধন, হর্ষবর্ধন ও রাজ্যশ্ৰী। রাজ্যশ্ৰীকে বিবাহ করিয়াছিলেন মৌখরীরাজ গ্রহবর্মী। গৌড়-স্বাতন্ত্রোর নায়ক শশাঙ্ক ইহাদের সকলের এবং মহাসেনগুপ্তের পরবর্তী গুপ্তরাজ দেবগুপ্তের সমসাময়িক; কাজেই তাহার ইতিহাস এবং গৌড়-স্বাতন্ত্র্যের ইতিহাস ইহাদের সকলের সঙ্গে জড়িত। সে-ইতিহাস সমসাময়িক লিপিমালা, বাণভট্টের হর্ষচরিত, যুয়ান-চোয়াঙের বিবরণী এবং আর্যমঞ্জুশ্ৰীমূলকল্প প্রভৃতি গ্রন্থে উল্লিখিত, ব্যাখ্যাত ও কীর্তিত হইয়াছে। তাহার ফলে পুষ্যভূতিরাজ হর্ষবর্ধনের সঙ্গে সঙ্গে শশাঙ্ক-কাহিনীও অল্পবিস্তর সুপরিচিত।

শশাঙ্ক

শশাঙ্কের প্রথম পরিচয় মহাসামন্তরূপে। কাহার মহাসামপ্ত তিনি ছিলেন, নিঃসংশয়ে বলা কঠিন, তবে, মনে হয়, মহাসেনগুপ্ত বা তৎপরবর্তী মালবাধিপতি দেবগুপ্ত তাহার অধিরাজ ছিলেন। রাজ্যবর্ধন কর্তৃক দেবগুপ্তের পরাজয়ের পর শশাঙ্কই যে দেবগুপ্তের দায়িত্ব ও কর্তব্যভার (মৌখরী-পুষ্যভূমি মৈত্রীবন্ধনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম) নিজের স্কন্ধে তুলিয়া লইয়াছিলেন; তাহা হইতে মনে হয়, শশাঙ্ক মগধ-মালবাধিপতি গুপ্তরাজাদেরই মহাসামন্ত ছিলেন। যাহা হউক, এ তথ্য নিঃসংশয় যে, ৬০৬-৭ খ্ৰীষ্টাব্দের আগে কোনও সময়ে শশাঙ্ক গৌড়ের স্বাধীন নরপতিরূপে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন এবং কর্ণসুবৰ্ণে (মুর্শিদাবাদ জেলার রাঙ্গামাটির নিকট কানসোনা) নিজ রাজধানী প্রতিষ্ঠিত করেন।

মৌখরীদের সঙ্গে গুপ্তদের একটা সংগ্রাম কয়েক পুরুষ ধরিয়াই চলিয়া আসিতেছিল এবং তাহা গৌড় ও মগধের অধিকার লইয়াই মনে হয়। দুই পুরুষ সংগ্রাম চলিবার পর বোধ হয়। মহাসেনগুপ্তের পিতা নিজের শক্তিবৃদ্ধির উদ্দেশে নিজ কন্যা মহাসেনগুপ্তাকে পুষ্যভূতিরাজ প্রভাকরবর্ধনের মহিষীরূপে অৰ্পণ করেন। এই মৈত্রীবন্ধনের ভয়ে কিছুদিন মৌখরী বিক্রম শান্ত ছিল। কিন্তু অবন্তীবার্মার পুত্র গ্রহবর্ম যখন মৌখরী বংশের রাজা, তখন মালবের সিংহাসনে রাজা দেবগুপ্ত উপবিষ্ট। পক্ষ-প্রতিপক্ষের রূপ তখন বদলাইয়া গিয়াছে। মগধ ইতিমধ্যেই গুপ্তহস্তচু্যত হইয়া গিয়াছিল। মালবিরাজ মহাসেনগুপ্তের দুই পুত্র, কুমার ও মাধব, প্রভাকরবর্ধনের গৃহে আশ্রয় লইয়াছিলেন এবং মালবের অধিপতি হইয়াছিলেন দেবগুপ্ত। দেবগুপ্তের মৈত্রীবন্ধন গৌড়াধিপ শশাঙ্কের সঙ্গে, যে-শশাঙ্ক মঞ্জুশ্ৰীমূলকল্প-গ্রন্থের মতে ইতিমধ্যেই বারাণসী পর্যন্ত তাহার আধিপত্য বিস্তার করিয়াছিলেন। অন্যদিকে গ্রহবর্মও ইতিপূর্বেই প্রভাকরবর্ধনের কন্যা এবং রাজ্যবর্ধন-হৰ্ষবর্ধনের ভগিনী রাজ্যশ্ৰীকে বিবাহ করিয়াছিলেন; সেই সূত্রে তাহার মৈত্রীবন্ধন পুষ্যভূতি বংশের সঙ্গে। বৃদ্ধ প্রভাকরবর্ধনের অসুস্থত এবং মৃত্যুর সুযোগে মালবিরাজ দেবগুপ্ত মৌখরীরাজ গ্রহবর্মকে আক্রমণ ও হত্যা করিয়া রানী রাজ্যশ্ৰীকে কনৌজে কারারুদ্ধ করেন। হর্ষচরিত পাঠে মনে হয়, প্রভাকরবর্ধনের মৃত্যু এবং শেষোক্ত দুইটি ঘটনা একই দিনে সংঘটিত হইয়াছিল। দেবগুপ্ত তাহার পর যখন স্থানীশ্বরের দিকে অগ্রসরমান শশাঙ্কও তখন দেবগুপ্তের সহায়তার জন্য কনৌজের দিকে অগ্রসর হইতেছিলেন; কিন্তু দেবগুপ্তের সৈন্যের সঙ্গে মিলিত হইবার আগেই সদ্যসিংহাসনারূঢ় রাজ্যবর্ধন সসৈন্যে দেবগুপ্তের সম্মুখীন হইয়া তাহাকে আক্রমণ, পরাভূত ও নিহত করেন। তাহার পর হয়তো তিনি ভগিনী রাজ্যশ্ৰীকে কারামুক্ত করিবার জন্য কনৌজের দিকে অগ্রসর হইতেছিলেন, কিন্তু উদ্দেশ্য সিদ্ধির আগেই তাহাকে শশাঙ্কের সম্মুখীন হইতে হয় এবং তিনি তাহার হস্তে নিহত হন। বাণভট্ট ও য়ুয়ান-চোয়াঙ বলিতেছেন, শশাঙ্ক রাজ্যবর্ধনকে বিশ্বাসঘাতকতা করিয়া হত্যা করিয়াছিলেন; অন্যদিকে হর্ষবর্ধনের লিপির সাক্ষ্য এই যে, রাজ্যবর্ধন সত্যানুরোধে (হয়তো কোনও প্রতিজ্ঞা রক্ষার জন্য) তাহার শত্রুর শিবিরে গিয়াছিলেন। এবং সেইখনেই তনুত্যাগ করিয়াছিলেন। মঞ্জুশ্ৰীমূলকল্পের গ্রন্থকারের মতে রাজ্যবর্ধন নগ্নজাতির কোনও রাজ-আততায়ী কর্তৃক নিহত হইয়াছিলেন। বাণভট্ট ও য়ুয়ান-চোয়াঙ দুইজনেই শশাঙ্কের প্রতি কিছুটা বিদ্বিষ্ট ছিলেন, তাহা ছাড়া দুই জনই রাজ্যবর্ধনের ভ্রাতা হর্ষবর্ধনের কৃপাপাত্র ছিলেন। কাজেই তাঁহাদের সাক্ষ্য কতটুকু বিশ্বাসযোগ্য বলা কঠিন। যাহাই হউক, এই বিতর্ক কতকটা অবাস্তুর, কারণ শশাঙ্কের ব্যক্তি-চরিত্রগত এই তথ্যের সঙ্গে জনসাধারণের ইতিহাসের যোগ প্রায় অনুপস্থিত। রাজ্যবর্ধনের মৃত্যুর পর শশাঙ্ক আর স্থানীশ্বরের দিকে অগ্রসর হইয়াছিলেন বলিয়া মনে হয় না, কারণ মৌখরী রাজবংশের পরাভাবের আর কিছু বাকী ছিল না। হর্ষবর্ধন রাজসিংহাসনে অভিষিক্ত হইয়াই তৎক্ষণাৎ সসৈন্যে গৌড়রাজ শশাঙ্কের বিরুদ্ধে অগ্রসর হন। পথে কামরূপরাঞ্জা ভাস্করবর্মীর সঙ্গে সাক্ষাৎ ও মৈত্রীবন্ধন, সংবাদবাহক ভক্টর মুখ হইতে রাজ্যবর্ধন-হত্যার বিস্তৃততর বিবরণ ও বিন্ধ্যপৰ্ব্বতে রাজ্যশ্ৰীর পলায়ন-বৃত্তান্ত প্ৰাপ্তি, সসৈন্যে ভণ্ডীকে গৌড়রাজের বিরুদ্ধে পাঠাইয়া নিজে রাজ্যশ্ৰীীর উদ্ধারে গমন ও অগ্নিকুণ্ডে ঝাপ দিবার আগেই রাজশ্ৰীর উদ্ধার এবং তাহার পর গঙ্গাতীরে ভণ্ডীচালিত সৈন্যের সঙ্গে পুনর্মিলন ইত্যাদি বাণভট্টের কৃপায় আজ অতি সুবিদিত ঐতিহাসিক তথ্য। কিন্তু তাহার পর শশাঙ্কের সঙ্গে হর্ষবর্ধনের সম্মুখ যুদ্ধ কিছু হইয়াছিল। কিনা এ-সম্বন্ধে বাণভট্ট নীরব। মঞ্জুশ্ৰীমূলকল্পের গ্রন্থকারের মতে এই সময় প্রাচ্যদেশের রাজা ছিলেন সোম (=চন্দ্র= শশাঙ্ক); তাহার রাজধানী ছিল পুঞ্জ। হর্ষবর্ধন এই সোমরাজকে পরাজিত করিয়া তঁহাকে নিজ রাজ্যসীমার মধ্যে আবদ্ধ থাকিতে বাধ্য করিয়াছিলেন। মঞ্জুশ্ৰীমূলকল্পের বিবরণ কতটুকু সত্য ও বিশ্বাসযোগ্য বলা কঠিন; তবে, তাহার এই জয় যে দীর্ঘ স্থায়ী হয় নাই এবং কামরূপরাজ ভাস্করবর্মী ও হর্ষবর্ধনের সম্মিলিত শত্রুতা সত্ত্বেও মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত শশাঙ্ক যে সমগ্র গৌড় দেশ, মগধ-বৃদ্ধগয়া অঞ্চল এবং উৎকল ও কঙ্গোদ দেশের অধিপতি ছিলেন, তাহার প্রমাণ বিদ্যমান। কঙ্গোব্দী-এ শৈলোদ্ভব-বংশীয় অধিপতি মহারাজা-মহাসামন্ত দ্বিতীয় শ্ৰীমাধবরাজের (৬১৯ খ্ৰীষ্ট শতক) একটি লিপিতে মাধবরাজ শশাঙ্ককে তাহার অধিরাজ বলিয়া উল্লেখ করিয়াছিলেন। সামন্ত-মহারাজ সোমদত্ত এবং মহাপ্ৰতীহার শুভকীর্তির অধুনাবিষ্কৃত মেদিনীপুর (প্রাচীন নাম, মিথুনপুর) লিপি দুইটিতেও শশাঙ্ক অধিরাজ বলিয়া উল্লিখিত হইয়াছেন। এই লিপি দুইটির সাক্ষ্যে প্রমাণিত হয়, দণ্ডভুক্তিদেশ শশাঙ্কের রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল এবং উৎকলদেশ দণ্ডভুক্তি-বিভাগের অন্তর্গত ছিল। ৬৩৭-৩৮ খ্ৰীষ্টাব্দের কিছু পূর্বে শশাঙ্কের মৃত্যু হইয়া থাকিবে, কারণ ঐ সময় য়ুয়ান-চোয়াঙ মগধ-ভ্ৰমণে আসিয়া শুনিলেন, কিছুদিন আগেই শশাঙ্ক বুদ্ধগয়ার বোধিদ্রুম কাটিয়া ফেলিয়াছেন, এবং স্থানীয় বুদ্ধমূর্তিটি নিকটেই একটি মন্দিরে সরাইয়া রাখিয়াছেন; এই পাপের ফলেই নাকি শশাঙ্ক কুণ্ঠ-জাতীয় কোনও ব্যাধিগ্রন্থ হইয়া অল্পদিনের মধ্যে মারা যান। মঞ্জুশ্ৰীমূলকল্প-গ্রন্থেও এই গল্পের পুনরাবৃত্তি দেখিতে পাওয়া যায়; কিন্তু গল্পটি কতদূর বিশ্বাসযোগ্য, বলা কঠিন।

শশাঙ্ক কীর্তিমান নরপতি ছিলেন, সন্দেহ নাই। তঁহাকে ‘জাতীয় নায়ক অথবা বীর বলা যাইতে পারে কিনা সে-সম্বন্ধে গভীর সন্দেহ থাকিলেও তিনি যে অজ্ঞাতকুলশীল মহাস্যমন্তরূপে জীবন আরম্ভ করিয়া তদানীন্তন উত্তর-ভারতের সর্বোত্তম রাষ্ট্রগুলির সমবেত শক্তির (কনৌজ-স্থানীশ্বর-কামরূপ মৈত্রী) বিরুদ্ধে সার্থক সংগ্রামে লিপ্ত হইয়া, শেষ পর্যন্ত স্বতন্ত্র স্বাধীন নরপতিরূপে সুবিস্তৃত রাজ্যের অধিকারী হইয়াছিলেন, এ-তথ্যই ঐতিহাসিকের প্রশংসিত বিস্ময় উদ্রোকের পক্ষে যথেষ্ট। পুরুষপরম্পরাবিলম্বিত কনৌজ-গৌড়-মগধ সংগ্রাম তাহারই শৌর্য ও বীর্যে নূতন রূপে রূপান্তরলাভ করিয়াছিল; সকলোত্তরপথনাথ হর্ষবর্ধনকে যদি কেহ সাৰ্থক প্রতিরোধ প্ৰদান করিয়া থাকেন তবে শশাঙ্ক এবং চালুক্যরাজ দ্বিতীয় পুলকেশীই তাহা করিয়াছিলেন। উত্তর-ভারতের আধিপত্য লইয়া পালরাজ ধর্মপাল-দেবপাল প্ৰভৃতির আমলে গৌড়-কনৌজের যে সুদীর্ঘ সংগ্রাম পরবর্তী কালের বাঙলার রাষ্ট্ৰীয় ইতিহাসুকে উজ্জ্বল ও গৌরবান্বিত করিয়াছে, তাহার প্রথম সূচনা শশাঙ্কের আমলেই দেখা দিল এবং তিনিই সর্বপ্রথম বাঙলাদেশকে উত্তর-ভারতের রাষ্ট্ৰীয় রঙ্গমঞ্চে অবতীর্ণ করাইলেন। বাণভট্ট-য়ুয়ানচোয়াঙ-মঞ্জুশ্ৰীমূলকল্পের গ্রন্থকার যদি তাহার প্রতি বিদ্বিষ্ট হইয়া থাকেন তবে তাহার মূলে ঈর্ষা ও হিংসা একেবারেই কিছু ছিল না, এমন বলা যায় না।

শশাঙ্কের মৃত্যুর পর গৌড় ও মগধের অধিকার লইয়া প্রায় কড়াকড়ি পড়িয়া গেল! মঞ্জুশ্ৰীমূলকল্পের গ্রন্থকার মানব নামে শশাঙ্কের এক পুত্রের নাম করিয়াছেন; এই পুত্র নাকি ৮ মাস ৫ দিন রাজত্ব করিয়াছিলেন। অন্য কোনও সাক্ষ্যে এই তথ্যের উল্লেখ নাই, কাজেই ইহা সত্য হইতে পারে, না-ও হইতে পারে। তবে, শশাঙ্কের মৃত্যুর পর পারস্পরিক হিংসা, বিদ্বেষ ও অবিশ্বাসে গৌড়তন্ত্র বিনষ্ট হইয়া গিয়াছিল, মঞ্জুশ্ৰীমূলকল্পের এই সাক্ষ্য অবিশ্বাস্য নয় বলিয়াই মনে হয়। ৬৩৮ খ্ৰীষ্টাব্দে যুয়ান-চোয়াঙ যখন বাঙলাদেশ ভ্রমণে আসেন তখন এই দেশ পাঁচটি বিভাগে বিভক্ত : কােজঙ্গল, পুণ্ড্রবর্ধন, কর্ণসুবর্ণ, তাম্রলিপ্তি ও সমতট। এই পাঁচটি জনপদের কোনোটিরই রাজা বা রাষ্ট্র সম্বন্ধে যুয়ান-চোয়াঙ কিছু বলেন নাই। পাচটি জনপদের মধ্যে এক সমতট ছাড়া আর বাকী চারটিই নিঃসন্দেহে শশাঙ্কের রােজ্যান্তর্গত ছিল। মনে হয়, তাহার মৃত্যুর অব্যবহিত পরে প্রত্যেকটি জনপদই স্বাধীন ও স্বতন্ত্রপরায়ণ হইয়া উঠে এবং ৬৪২ খ্রীষ্টাব্দে কােজঙ্গলে ভাস্করবর্মা-হৰ্ষবর্ধন সাক্ষাৎকারের আগেই ভাস্করবর্মা কোনও সময় পুণ্ড্রবর্ধন-কর্ণসুবর্ণ জয় করিয়া কর্ণসুবর্ণের জয়স্কন্ধাবার হইতে এক ভূমিদানি পট্টোলী নির্গত করাইয়াছিলেন। চীন-রাজতরঙ্গের সাক্ষানুযায়ী ৬৪৮ খ্ৰীষ্টাব্দে ভাস্করবর্ম পূর্ব ভারতের নরপতি ছিলেন। ৬৪২-৪৩ খ্ৰীষ্টােব্দ নাগাদ কঙ্গোদ এবং কজঙ্গলও হর্ষবর্ধন কর্তৃক বিজিত ও অধিকৃত হইয়াছিল, য়ুয়ান-চোয়াঙের বিবরণ হইতে এইরূপ মনে হয়। তাম্রলিপ্তি-দণ্ডভুক্তি সম্বন্ধে কিছু বলা কঠিন, তবে ৬৩৭-৩৮ খ্ৰীষ্টাব্দে মগধের রাজা ছিলেন পূৰ্ণবর্ম, কিন্তু ৬৪১ খ্ৰীষ্টাব্দে কি তাহার অব্যবহিত আগে মগধও হর্ষবর্ধন কর্তৃক অধিকৃত হইয়াছিল, কারণ চীনদৃত মা-তোয়ান-লিন বলিতেছেন, শিলাদিত্য (হর্ষবর্ধন) ঐ বৎসর “মগধাধিপ” এই আখ্যা গ্রহণ করেন।

কামরূপরাজ ভাস্করবর্মা বোধ হয় বেশিদিন গৌড়-কর্ণসুবর্ণ নিজ-করায়ত্ত রাখিতে পারেন। নাই। শশাঙ্কের গৌড়তন্ত্র বিনষ্টের স্বল্পকাল পরেই গৌড়ে জয় নামক কোন নাগরাজ রাজত্ব করিয়াছিলেন, মঞ্জশ্ৰীমূলকল্পে এইরূপ একটি ইঙ্গিত আছে। আনুমানিক সপ্তম শতকের প্রথমার্ধে মহারাজাধিরাজ জয়নাগ নামক এক রাজা কর্ণসুবর্ণের জয়স্কন্ধাবার হইতে কিছু ভূমিদানের আদেশ মঞ্জর করিয়াছিলেন। জয় নামক এক রাজার নামাঙ্কিত কয়েকটি মুদ্রাও বীরভূম-মুর্শিদাবাদ অঞ্চলে পাওয়া গিয়াছে। মুদ্রার জয়, মঞ্জুশ্ৰীমূলকল্পের জয়, এবং বপ্লঘোষবাট-পট্টোলীর জয়নাগ এক এবং অভিন্ন বলিয়া বহুদিন স্বীকৃত হইয়াছেন। মঞ্জুশ্ৰীমূলকল্পের বিবরণ হইতে মনে হয়, ভাস্করবর্মার কর্ণসুবর্ণাধিকারের পর শশাঙ্কপুত্র মানব পিতৃরাজ্য পুনরাধিকারের একক চেষ্টা করিয়া থাকিবেন এবং সে চেষ্টা হয়তো ক্ষণস্থায়ী সার্থকতাও লাভ করিয়া থাকিবে। কিন্তু তাহার পরই কর্ণসুবর্ণ জয়নাগের করায়ত্ত হয় এবং তিনি মহারাজাধিরাজ, আখ্যায় স্বতন্ত্র নরপতিরূপে পরিচিত হন। অথবা এমনও হইতে পারে। ভাস্করবর্মী কর্তৃক কর্ণসুবর্ণ জয়ের আগেই জয়নাগ কোনও সময় ঐ রাজ্য কিছুদিনের জন্য ভোগ করিয়াছিলেন। যাহাই হউক, ৬৫০ খ্ৰীষ্টাব্দের মধ্যেই শশাঙ্কের গৌড় রাজ্য একেবারে তছনছ হইয়া গেল। শশাঙ্ক গৌড়কে কেন্দ্ৰ করিয়া যে বৃহত্তর গৌড়তন্ত্র গড়িয়া তুলিতে চাহিয়াছিলেন তাহা অন্তত কিছুকালের জন্য ধূলিসাৎ হইয়া গেল। যতদিন তিনি বাচিয়াছিলেন ততদিন এই রাষ্ট্রদর্শ কার্যকরী ছিল সন্দেহ নাই; কিন্তু একদিকে ভাস্করবর্মা, অন্যদিকে হর্ষবর্ধন, এ-দুয়ের টানা-পোড়েনের মধ্যে পড়িয়া শশাঙ্কের অব্যবহিত পরই গৌড়তন্ত্র প্রায় বিনষ্ট হইয়া গেল। অষ্টম শতকের দ্বিতীয় পাদে জনৈক গৌড়াধিপ আবার, বোধ হয় শশাঙ্কের আদর্শে অনুপ্রাণিত হইয়া, মগধ হইতে গুপ্তবংশের অবশেষ অবলুপ্ত করেন এবং মগধেরও আধিপত্য লাভ করেন। কিন্তু সে-চেষ্টা সত্ত্বেও গৌড়তন্ত্র আর পুনরুদ্ধার করা গেল না। শশাঙ্কের ধনুকে গুণ টানিবার মতন বীর অব্যবহিত পরে আর দেখা গেল না। তাহার পর সুদীর্ঘ একশত বৎসর গৌড়ের, শুধু গৌড়েরই বা কেন, বঙ্গেরও, অর্থাৎ সমগ্র বাঙলাদেশের ইতিহাসে গভীর ও সর্বব্যাপী বিশৃঙ্খলা, মাৎস্যন্যায়ের অপ্ৰতিহত প্রভাব {

সামাজিক ইঙ্গিত ৷ আমলাতন্ত্র

এই যুগের স্বাধীন গৌড়-রাষ্ট্রের আদর্শ ছিল গৌড়তন্ত্র গড়িয়া তোলা; শশাঙ্কের কর্মকীর্তি এবং মঞ্জুশ্ৰীমূলকল্পের সাক্ষ্য এবিষয়ে প্রমাণিক বলিয়া স্বীকার করিতে আপত্তি হইবার কারণ নাই।

চাহিয়াছিলেন তাহা তো আগেই আমরা দেখিয়াছি। কিন্তু বঙ্গে-সমতটে এবং গৌড়িতন্ত্রে রাষ্ট্রের সামাজিক আদর্শ কী ছিল তা এখন একটু দেখিবার চেষ্টা করা যাইতে পারে; রাষ্ট্রের গঠন-বিন্যাস এবং পরিচালনা-পদ্ধতি গুপ্ত-আমলের মতই ছিল বলিয়া মনে হয়; রাষ্ট্র-বিভাগ এবং রাজকর্মচারীদের যে-ইঙ্গিত সমসাময়িক লিপিগুলিতে পাওয়া যাইতেছে তাহার দ্বারা এই অনুমান সমর্থিত হয়। এই যুগে নূতন একটি রাষ্ট্র বিভাগ, বীথীর নাম শুনা যাইতেছে, অন্তত বঙ্গে-সমতটে; ভুক্তি এবং বিষয়-বিভাগের মতো বীথী-বিভাগেরও একটি অধিকরণ থাকিত। ভুক্তির যিনি উপরিক বা শাসনকর্তা থাকিতেন। তঁহার মর্যাদা এই যুগে ক্রমশ যেন বাড়িয়া যাইবার দিকে। তাহাকে কখনো কখনো মহারাজ বলা হইয়াছে, যেমন গুপ্ত—আমলেও বলা হইত; কিন্তু কখনো কখনো নূতন উপাধি তাহার উপর অর্পিত হইয়াছে। যেমন, সমাচার দেবের কৃপালা-পট্টোলীতে ভুক্তির শাসনকর্তকে বলা হইয়াছে, “ পৌরোপকারিক-ব্যাপারপরমহাপ্ৰতীহার ” শশাঙ্কের অন্যতম মেদিনীপুর লিপিতেও দণ্ডভুক্তির শাসনকর্তাকে বলা হইয়াছে মহাপ্ৰতীহার; সমাচার দেবের ঘুগ্রাহাটি-লিপিতে উপরিক জীবদ্যুত্তকে অধিকন্তু বলা হইয়াছে অস্তুরঙ্গ। মনে হয়, ভুক্তি-উপরিকের ক্ষমতা এই যুগে বাড়িয়াছে। তাহা ছাড়া, মল্লসরুল-পট্টোলীতে (গোপচন্দ্রের আমল) অনেক নূতন নূতন রাজপুরুষের নামের দীর্ঘ তালিকা সর্বপ্রথম পাওয়া যাইতেছে; এই সব নাম ও রাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্রিয়াকর্তব্য সম্বন্ধে রাষ্ট্র-বিন্যাস অধ্যায়ে বিস্তৃতভাবে বলা হইয়াছে, কিন্তু এখানে এ-কথা নির্দেশ করা প্রয়োজন যে, এই নূতন নূতন রাজপুরুষ এবং রাজকর্মবিভাগ সৃষ্টি একেবারে অর্থহীন নয়; ইহার সামাজিক ইঙ্গিত লক্ষণীয়। স্পষ্টই বুঝা যাইতেছে, রাষ্ট্ৰীয় স্বাতন্ত্র্য লাভের সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্র অনেক বেশী আত্মসচেতন হইয়াছে, নূতন নূতন সামাজিক দায় ও কর্তব্য রাষ্ট্রের স্বীকৃতি লাভ করিতেছে। ইহার পর হইতে এই সচেতনতা ও স্বীকৃতি ক্রমশ বাড়িয়াই যাইবে এবং তাহার পূর্ণতর রূপ দেখা যাইবে পাল-আমলে, পূর্ণতম রূপ সেন ও বর্মণবংশীয় রাজাদের আমলে। যাহা হউক, বিস্তৃত কর্মচারীতন্ত্র (এখন আমরা যাহাকে বলি আমলাতন্ত্র) রচনার সূত্রপাত এই যুগেই প্রথম দেখা যাইতেছে। ছোটখাট সামাজিক দায় ও কর্তব্য সম্বন্ধেও রাষ্ট্র সচেতন হইতেছে; সমাজের অভ্যন্তরেও রাষ্ট্র-হস্ত সম্প্রসারণের চেষ্টা চলিতেছে; আগে যাহা ছিল পল্লী বা স্থানীয় সুগ্নয়নের অন্তর্গত তাহা ধীরে ধীরে রাষ্ট্রর বৃক্ষগত হইতেছে,এই ইঙ্গিত কিছুতেই অবহেলা করিবার নয়।

বিষয়াধিকরণ যাঁহারা গঠন করিতেছেন তাহাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠী-সার্থবাহ-কুলিকদের দেখিতেছি। না; পরিবর্তে পাইতেছি মহত্তর এবং ব্যাপারী বা ব্যবহারী প্রভৃতিদের। মহত্তরেরা স্থানীয় প্রধান, ব্যাপারী-ব্যবহারীরা তো স্পষ্পটতই শিল্পী-বণিক-ব্যবসায়ী সমাজের প্রতিনিধি। দেখা যাইতেছে, রাষ্ট্রে শিল্পী-বণিক-ব্যবসায়ীদের আধিপত্য এখনও বিদ্যমান; তবে সে-আধিপত্য এখন অন্যান্য স্থানীয় প্রধানদের সঙ্গে ভাগ করিয়া ভোগ করতে হইতেছে, অথবা এমনও হইতে পারে, যে-অঞ্চলের বিষয়াধিকরণে এই গঠন-বিন্যাস পাওয়া যাইতেছে সেই অঞ্চলে এই সমাজের নির্বাধ নিরবচ্ছিন্ন প্রাধান্য ছিল না। মল্লসারল-লিপিতে বীর্থী-অধিকরণ গঠন-বিন্যাসেরও সংবাদ পাওয়া যাইতেছে; এই অধিকরণটি গঠিত হইয়াছিল। একজন বাহনায়ক এবং মহত্তর, অগ্রহরী ও খড়গীদের লইয়া। বাহনায়ক পথঘাট-যানবাহনের কর্তা এবং রাজপুরুষ বলিয়াই মনে হয়। অগ্রহারীরা বোধ হয় (যে-সব ব্রাহ্মণ ব্রহ্মোত্তর ভূমি ভোগ করিতেন। তঁহাদের, এক কথায় ব্রাহ্মণদের প্রতিনিধি অথবা অগ্রহার-ভূমি বা গ্রামের শাসনকর্তা। মহত্তরেরা স্থানীয় প্রধান প্রধান গৃহস্থ। খাড়গীি কাহারা বুঝা কঠিন, তবে পরবর্তী কালের খড়্গগ্রাহী এবং খড়গী বোধ হয় একই শ্রেণীর রাজপুরুষ। শিল্পী-বণিক-ব্যবসায়ী সমাজের প্রতিনিধি এই বীথী-অধিকরণে দেখিতেছি। না, অথচ বীথীটি বর্তমান বর্ধমান জেলায় অবস্থিত ছিল। এই গ্রামে কি এই সম্প্রদায়ের প্রাধান্য ছিল না? গ্রামের বা গ্রামসমূহের অধিকাংশ ব্রাহ্মণই কি ব্রহ্মোওর ভোগ করতেন? বাহনায়ককে দেখিয়া মনে হয়, এই বীথীর পথঘাট নদী-নালা দিয়া নৌকো, শকট, পশু ইত্যাদির যাতায়াত খুব বেশিই ছিল; ইহার কিছু তো নিশ্চয়ই ব্যাবসা-বাণিজ্য সংক্রান্ত, এ সম্বন্ধে সন্দেহ কি?

সামন্ততন্ত্র

এই যুগে রাষ্ট্রের আর একটি বৈশিষ্ট্যও লক্ষ্য করিবার মতন। বাঙলাদেশে এই আমলেই পুরাপুরি সামন্ত্রতন্ত্র রচনারও সূত্রপাত দেখা যায়। শশাঙ্কের জীবনই তো আরম্ভ হইয়াছিল। মহাসামন্তরূপে; বোধ হয় তিনি গুপ্তদেরই মহাসামন্ত ছিলেন। তাহা ছাড়া, মেদিনীপুরে প্রাপ্ত শশাঙ্কের একটি লিপিতে দণ্ডভুক্তির শাসনকর্তা সামন্ত-মহারাজ সোমদত্তের উল্লেখ পাইতেছি; সোমদত্ত বোধ হয় আগে দণ্ডভুক্তির রাজা ছিলেন; দণ্ডভুক্তি শশাঙ্ক কর্তৃক বিজিত হইবার পর তিনি হয়তো সমস্ত শাসনকর্তা রূপে উহার উপরিক নিযুক্ত হন। কঙ্গোদেব শৈলোদ্ভব বংশীয় মহারাজ দ্বিতীয় শ্ৰীমাধবরাজও শশাঙ্কের একজন মহাসামন্ত ছিলেন। তিনিও বোধ হয় শশাঙ্ক কর্তৃক কঙ্গোব্দ-বিজয়ের পর মহাসামন্ত নিযুক্ত হইয়া থাকিবেন। গুণাইঘর-লিপির দূতক মহাপ্ৰতীহার মহাপিলুপতি পঞ্চাধিকরণেপরিক মহারাজ বিজয়সেনও গোপচন্দ্রের একজন শ্ৰীমহাসামন্ত ছিলেন। বিজয়সেন গোপচন্দ্রের আগে মহারাজ বৈন্যগুপ্তেরও অন্যতম মহাসামন্ত ছিলেন। মহারাজাধিরাজ সমাচার দেবের কুপালা-লিপিতে এবং জয়নাগের বপ্লঘোষবাট-লিপিতেও সামন্তের উল্লেখ পাওয়া যাইতেছে; শেষোক্ত লিপিটিতে দেখিতেছি, সামন্ত নারায়ণভদ্র ঔদুম্বরিক বিষয়ের (= আইন-ই-আকবরী গ্রন্থের ঔদম্বর পরগণা = বীরভূম-মুর্শিদাবাদের কিয়দংশ) বিষয়পতি ছিলেন। খড়্গ-বংশীয় রাজারাও বোধ হয় সামন্ত নরপতিই ছিলেন; এবং লোকনাথের বংশও তো সামন্ত বংশ। রাতবংশীয় রাজারাও সামন্ত-মহাসামন্ত ছিলেন, সন্দেহ কী? এই সামন্তদের সঙ্গে মহারাজাধিরাজদের সম্বন্ধের রূপ ও প্রকৃতি কী ছিল, পরস্পরের দায় ও অধিকার কী ছিল, বলা কঠিন; এ সম্বন্ধে কোনও তথ্য অনুপস্থিত। তবে অনুমান হয়, কোনও কোনও সামস্ত (তাহারা একেবারে মহাসামন্ত অথবা সামস্ত-মহারাজ, যেমন কঙ্গোদাধিপ মাধবরাজ বা শ্ৰীমহাসামন্ত শশাঙ্ক, অথবা দূতক বিজয়সেন, অথবা খড়্গ ও রাত-বংশীয় রাজার) প্রকৃত পক্ষে প্রায় স্বতন্ত্র স্বাধীন নরপতিরূপেই রাজত্ব করিতেন, শুধু মৌখিকত বা দলিলপত্রে নিজেদের সেই ভাবে প্রচার করিতেন না। তবে, মহারাজাধিরাজের ক্ষমতা ও রাষ্ট্র দুর্বল হইলে অথবা কোনও উপায়ে সুযোগ পাইলেই তাহারা স্বাধীনতা ও স্বাতন্ত্র্য ঘোষণা করিয়া বসিতেন।। কোনও কোনও সামন্ত-মহাসামন্ত মহারাজাধিরাজের উচ্চ রাজকর্মচারী (যথা ভুক্তিপতি বা বিষয়াপতি) রূপেও কাজ করিতেন। সামান্ত রাজাদেরও আবার সামন্ত থাকিতেন; লোকনাথ পট্টোলীতে দেখিতেছি, লোকনাথের এক মহাসামন্ত ছিলেন ব্রাহ্মণ প্রদোষশৰ্মা। পরবর্তীকালের সাক্ষ্য যদি প্রামাণিক হয় (যেমন, রামচরিতের) তাহা হইলে সামন্তদের অন্যতম প্রধান কর্তব্য ছিল যুদ্ধবিগ্রহের সময় সৈন্যবাহিনী দিয়া এবং নিজে যুদ্ধে যোগ দিয়া মহারাজাধিরাজকে সাহায্য করা। এই সামন্ত-মহাসামন্তরা বস্তুত মহারাজাধিরাজেরই একটি ক্ষুদ্রতর সংস্করণ মাত্র। সামন্ত প্রথা এখন হইতে ক্রমশ বিস্তার লাভ করিয়াই চলিবে এবং পাল-আমলে তাহার পূর্ণতর রূপ দেখা যাইবে। এ-পর্বের বঙ্গ ও সমতট রাষ্ট্র এবং গৌড়তন্ত্র এই আমলাতন্ত্র ও সামন্ততন্ত্র লইয়াই গঠিত।

রাষ্ট্র ও সামাজিক ধন

সুবৰ্ণমুদ্রার এই প্রচলন এই যুগেও দেখা যাইতেছে-বঙ্গ, সমতট এবং গৌড় প্রত্যেক রাষ্ট্রেই। কিন্তু সুবর্ণমুদ্রার সেই নিকষোন্তীর্ণ সুমুদ্রিত রূপ আর নাই; নকল মুদ্রার প্রচলনও আরম্ভ হইয়াছে। রৌপ্য মুদ্রা তো একেবারেই নাই। ইহার ঐতিহাসিক ইঙ্গিত অন্যত্র ধরিতে চেষ্টা করিয়াছি (ধনসম্বল অধ্যায়ে মুদ্রাপ্রসঙ্গ); এখানে শুধু এইটুকু বলিলেই যথেষ্ট যে, বৈদেশিক ব্যাবসা-বাণিজ্যের বিবর্তন মুদ্রার এই অবনতির অন্যতম কারণ হইতেও পারে। রাষ্ট্রও যেন সামাজিক ধনোৎপাদনের দিকে এই যুগে খুব বেশি দৃষ্টি রাখে নাই; কর্মচারী তন্ত্রের বিস্তৃতি এবং বিচিত্ৰ পদনাম ও বিভাগ বিশ্লেষণ করিলে মনে হয়, উৎপাদিত ধনের বণ্টন-ব্যবস্থার দিকেই রাষ্ট্রের ঝোকটা যেন বেশি! কৃষিসমাজ এবং ব্যাপারী-ব্যবহারী সমাজের কিছু কিছু খবর পাওয়া যাইতেছে, কিন্তু রাষ্ট্রে বিশেষভাবে কাহারও প্রাধান্য দেখা যাইতেছে না, অন্তত তেমন কোনও সাক্ষ্য উপস্থিত নাই। বাণিজ্য-ব্যাবসায় ব্যাপারে যেন একটু মন্দা পড়িয়াছে; মহত্তর-গ্রামিক কুটুম্বদের প্রতিপত্তি বাড়িতেছে। এই যুগেই ভূমির চাহিদা বাড়িতে আরম্ভ হইয়াছে এবং সমাজ ক্রমশ ভূমি নির্ভর হইয়া পড়িতে আরম্ভ করিয়াছে। পাল ও সেন আমলে দেখা যাইবে, বাণিজ্য-ব্যাবসায়ে, বিশেষত বহির্বাণিজ্যে একেবারেই মন্দা পড়িয়া গিয়াছে এবং সমাজ উত্তরোত্তর ভূমি ও কৃষিনির্ভর হইয়া পড়িয়াছে। বাৎস্যায়নের আমলে নাগর-সমাজকেই যেমন সভ্যতা ও সংস্কৃতির আদর্শ বলিয়া তুলিয়া ধরা হইয়াছিল— সওদাগরী ধনতন্ত্রের প্রকৃতিই নগরকেন্দ্ৰিক—এই আমলে সেই আদর্শে যেন একটু ভাটা পড়িতে আরম্ভ হইয়াছে। ভূমি ও কৃষিনির্ভরতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সমাজ যেন ক্রমশ গ্রামকেন্দ্ৰিক হইবার লক্ষণ প্রকাশ করিতেছে; কৃষিনির্ভর সমাজের প্রকৃতিই তো গ্রামকেন্দ্ৰিক। কিন্তু এই প্রকৃতি এখনও সুস্পষ্ট হইয়া দেখা দেয় নাই; কোটালিপাড়ার পট্টোলীগুলিতে তাহার ক্ষীণ আভাস মাত্র পাওয়া যাইতেছে। একশত বৎসর পরে তাহা একেবারে সুস্পষ্ট হইয়া দেখা দিবে।

ধর্ম ও সংস্কৃতি

এই যুগের বঙ্গ ও সমতটের রাজারা সকলেই ব্ৰাহ্মণ্য ধর্মাবলম্বী; রাত-বংশ ও আচার্য শীলভদ্রের পিতৃবংশও ব্রাহ্মণ্য ধর্মাবলম্বী; লোকনাথের সামন্ত-বংশও তোহাই। শশাঙ্ক ছিলেন। শৈব; তৎপ্রচলিত মুদ্রা এবং যুয়ান-চোয়াঙের বিবরণই তাহার প্রমাণ! নিধনপুর-শাসনের সাক্ষ্যে ভাস্করবর্মাকেও শৈব বলা যাইতে পারে। সমাচার দেবের রাজত্বকালে বলি-চরু-সত্ৰ প্রবর্তনের জন্য জনৈক ব্রাহ্মণ রাজকীয় ভূমিদানি গ্রহণ করিয়াছিলেন। বস্তুত, ধর্মাদিত্য, গোপচন্দ্ৰ, সমাচারদেব, জয়নাগ বা লোকনাথের আমলের যে-কয়টি ভূমিদানি লিপি এ পর্যন্ত পাওয়া গিয়াছে তাহার প্রত্যেকটিই ব্ৰাহ্মণদের ভূমিদান সম্পর্কিত পট্টোলী এবং ব্রাহ্মণ্যধর্মের পোষকতার প্রমাণ। চতুর্থ ও পঞ্চম শতকের রাজকীয় লিপিগুলিতে দেখিয়াছি, বিভিন্ন নামে ও রূপে বিষ্ণু ক্রমশ পূজা ও সমাদর লাভ করিতেছেন; মহারাজ বৈন্যগুপ্ত মহাদেব-ভক্ত ছিলেন এবং পুণ্ড্রবর্ধনে পঞ্চম শতকে বুধগুপ্তের আমলেই নামলিঙ্গ পূজা প্রবর্তিত হইয়াছিল। এই যুগে, অর্থাৎ ষষ্ঠ-সপ্তম শতকে গৌড়ে-কামরূপেও শৈবধর্ম বিস্তারুলাভ করিয়াছে; উভয়স্থানেই রাজা শৈব। কিন্তু বিষ্ণু এবং কৃষ্ণধৰ্মই অধিক প্রচলিত বলিয়া মনে হয়। পাহাড়পুরের মন্দির-প্রাচীরে সপ্তম-অষ্টম শতকের যে সব মৃৎ ও প্রস্তরচিত্র দেখা যায় তাহাতে মনে হয়, কৃষ্ণলীলার যমলার্জন, কেশীবধ, কৃষ্ণ-বলরামের সঙ্গে কংসরাজের মল্লদের যুদ্ধ, গোবর্ধনধারণ, গোপবালকদের সঙ্গে কৃষ্ণ-বলরাম, কৃষ্ণকে লইয়া বাসুদেবের গোকুলে গমন, গোপীলীলা প্রভৃতি কাহিনী ইতিমধ্যেই বাঙলাদেশে সুপ্রচলিত হইয়াছিল। রাজবংশের মধ্যে একমাত্র খড়্গ রাজারাই ছিলেন বৌদ্ধ; আর কোথাও বৌদ্ধধর্ম রাজকীয় পোষকতা লাভ করিতে পারে নাই।

ষষ্ঠ শতকের গোড়ায় গুণাইঘর লিপির (৫০৭-৮) সাক্ষ্যে দেখিয়াছিলাম, বৌদ্ধধর্ম ত্রিপুরা অঞ্চলে রাষ্ট্র ও রাজবংশের পোষকতা লাভ করিতেছে। প্রায় দেড় শত বৎসর এই ধর্ম ও সংস্কৃতির প্রতি বাঙলার কোনও রাষ্ট্রের কোনও অনুগ্রহ বা সমর্থন দেখা যায় না, তাহার পর সপ্তম শতকের শেষপাদে দেখিতেছি, বৌদ্ধধর্ম আবার রাষ্ট্র ও রাজবংশের পোষকতা ও সমর্থন লাভ করিতেছে। খড়্গ বংশই বৌদ্ধরাজবংশ; রাজারা সকলেই পরম সুগত, কাজেই এই পোষকতা খুবই স্বাভাবিক। লক্ষণীয় এই যে, এই পোষকতা ঢাকা-ত্রিপুরা অঞ্চলেই যেন সীমাবদ্ধ; কালপ্রান্তিক দুইটি সাক্ষাই বঙ্গ ও সমতটে ৷ আশ্চর্য হইতে হয় এই ভাবিয়া যে, এই সুদীর্ঘকালের মধ্যে গৌড়ে বা বাঙলার অন্য কোনও স্থানে বৌদ্ধ বা জৈনধর্ম ও সংস্কৃতি কোথাও রাষ্ট্রের কোনোপ্রকার স্বীকৃতি ও সমর্থন লাভ করিতেছে, এমন একটি দৃষ্টান্তও এ পর্যন্ত জানা যায় নাই। অথচ, অন্যদিকে এই যুগের সব কয়টি রাজবংশই ব্রাহ্মণ্যধর্ম ও সংস্কারাশ্রয়ী এবং এই ধর্ম ও সংস্কৃতি সমানেই রাজকীয় সমর্থন ও পোষকতা লাভ করিতেছে; ব্রাহ্মণ্য দেবদেবীর পূজা প্রসারিত হইতেছে—খেড়গ বংশীয় বৌদ্ধরাজত্বেও এবং বৌদ্ধ-রাজমহিষী প্ৰভাবতী দেবীর পোষকতায়ও তাহা হইয়াছে – পৌরাগিক গল্পকথা প্রচারিত হইতেছে। এই যুগের রাষ্ট্র ও রাজবংশ বৌদ্ধ (বা জৈন) ধর্ম ও সংস্কৃতি সম্বন্ধে যে খুব শ্রদ্ধা ও অনুগ্রহপরায়ণ ছিলেন এমন মনে হয় না; অথচ দেশে বৌদ্ধ অনুষ্ঠান-প্রতিষ্ঠানের কিছু অপ্রতুলতা ছিল, এমন নয়। জনসাধারণের বেশ একটা অংশ বৌদ্ধধর্ম ও সংস্কারাশ্রয়ী ছিল; য়ুয়ান-চোয়াঙ, ইৎ-সিঙ এবং সং-চি’র বিবরণ এবং আস্রফপুর লিপির সাক্ষ্যেই তাহা সুস্পষ্ট। ধৰ্মকৰ্ম-অধ্যায়ে এ বিষয়ে বিস্তৃত আলোচনা পাওয়া যাইবে।

শশাঙ্কের বৌদ্ধ বিদ্বেষ?

বৌদ্ধধর্ম ও অনুষ্ঠান-প্রতিষ্ঠান, বৌদ্ধ সংস্কৃতি সম্বন্ধে রাষ্ট্রের এই নেতিবাচক ঔদাসীন্য কি কখনো কখনো ইতিবাচক বিদ্বেষ ও শক্রতায় রূপান্তরিত হইয়াছিল? কোথাও কি তাহার কোনও ইঙ্গিত আছে? য়ুয়ান-চোয়াঙ কিন্তু ইঙ্গিত শুধু নয়, সুস্পষ্ট অভিযোগই করিয়াছেন শশাঙ্কের বৌদ্ধ-বিদ্বেষ ও শত্ৰুতা সম্বন্ধে। শশাঙ্ক নাকি একবার কুশীনগরে এক বিহারের ভিক্ষুদের বহিষ্কার করিয়া দিয়াছিলেন, পাটলিপুত্রে বুদ্ধপদাঙ্কিত একখণ্ড প্রস্তর গঙ্গাগর্ভে নিক্ষেপ করিয়াছিলেন, বুদ্ধগয়ার বোধিদ্রুম কাটিয়া ফেলিয়া উহার মূল পর্যন্ত ধ্বংস করিয়া পুড়াইয়া দিয়াছিলেন, একটি বুদ্ধমূর্তি সরাইয়া সেখানে শিবমূর্তি প্রতিষ্ঠা করিতে চাহিয়াছিলেন এবং সাধারণভাবে বৌদ্ধধর্মের প্রভূত অনিষ্ট সাধন করিয়াছিলেন। শশাঙ্কের মৃত্যু সম্বন্ধেও যুয়ান-চেয়াঙ একটি অলৌকিক কাহিনী লিপিবদ্ধ করিয়াছেন; সেই প্রসঙ্গেও শশাঙ্কের বৌদ্ধ-বিদ্বেষ এবং তাহার ফলে শশাঙ্কের শাস্তির প্রতি ইঙ্গিত আছে। বোধিদ্রুম ধ্বংস ও এই মৃত্যু-কাহিনীর প্রতিধ্বনি মঞ্জুশ্ৰীমূলকল্প গ্রন্থেও আছে। যুয়ান-চায়াঙ বৌদ্ধ শ্রমণ, আংশিকত হর্ষবর্ধনের প্রসাদ প্রার্থী এবং সেই হেতু শশাঙ্কের প্রতি বিদ্বিষ্ট হইয়া থাকিতে পারেন। মঞ্জুশ্ৰীমূলকল্পও বৌদ্ধ লেখকের রচনা এবং বৌদ্ধসমাজে প্রচলিত গ্রন্থ। কাজেই এ বিষয়ে ইহাদের সাক্ষ্য প্রামাণিক বলিয়া স্বীকার করা একটু কঠিন, বিশেষত য়ুয়ান-চোয়াঙের সাক্ষ্য। শশাঙ্ক-হৰ্ষবর্ধন বা শশাঙ্ক-বৌদ্ধধর্ম ব্যাপারে এই বিদেশী শ্ৰমণ সর্বত্র হয়তো অপক্ষপাত দৃষ্টির পরিচয় দিতে পারেন নাই। তবু, একটু আগেই ষষ্ঠ-সপ্তম শতকের রাজবংশের ও বৌদ্ধধর্মের প্রতি রাষ্ট্রের ঔদাসীন্য এবং সঙ্গে সঙ্গে ব্ৰাহ্মণ্যধর্ম ও সংস্কৃতির প্রতি ঐকাস্তিক শ্রদ্ধা ও অনুরাগের যে সংক্ষিপ্ত যুক্তি আমি উপস্থিত করিয়াছি তাহার পটভূমিকায় শশাঙ্কের বৌদ্ধ বিদ্বেষ কাহিনী একেবারে নিছক অনৈতিহাসিক কল্পনা, এমন মনে হয় না। য়ুয়ান-চোয়াঙ যে সব ঘটনার উল্লেখ করিয়াছেন তাহার মধ্যে অত্যুক্তি প্রচুর, সন্দেহ নাই; কিন্তু মোটামুটিভাবে এ কথা উড়াইয়া দেওয়া যায় না যে, শশাঙ্ক বৌদ্ধবিদ্বেষী ছিলেন এবং বৌদ্ধধর্মের প্রভূত ক্ষতিও করিয়াছিলেন। কিছুটা সত্য কোথাও না থাকিলে য়ুয়ান-চোয়াঙ বারবার একই তথ্যের পুনরাবৃত্তি করিয়া গিয়াছেন, একথা মনে করা একটু কঠিন। এমন কি, তিনি যখন বলিয়াছেন, কর্ণসুবর্ণরাজ কর্তৃক বৌদ্ধধর্মের ক্ষতির খানিকটা পূরণ এবং ধর্মের পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্যই হৰ্ষবর্ধনের সিংহাসনারোহণ প্রয়োজন, বোধিসত্ত্ব হর্ষকে তাহাই বুঝাইয়াছিলেন, তখন মনে হয়, খুব জোর দিয়াই য়ুয়ান-চোয়াঙ শশাঙ্কের বৌদ্ধ-বিদ্বেয্যের কথা বলিতেছেন। মঞ্জুশ্ৰীমূলকল্পের লেখকও এক জায়গায় শশাঙ্ককে দুষ্কর্মকারী এবং চরিত্রহীন বলিয়াছেন; বৌদ্ধলেখক বৌদ্ধধর্মবিদ্বেষীর সম্বন্ধে খুব সংযত ভাষা ব্যবহার করিতে পারেন নাই, একথা অনস্বীকার্য; কিন্তু কোথাও সত্যের বীজ একটু সুপ্ত না থাকিলে শতাব্দীর লোকস্মৃতিই – বা এই ইঙ্গিত ধরিয়া রাখিবে কেন?

শশাঙ্কের বৌদ্ধ-বিদ্বেষের কারণ অনুমান সহজেই করা যায়। প্রথমত, এই যুগে ব্ৰাহ্মণ্যধর্ম ও সংস্কৃতি ক্রমশ বিস্তার লাভ করিতেছিল বাঙলাও আসামের সর্বত্র; তাস্থার নানা সাক্ষ্য-প্রমাণ আগেই উল্লেখ করিয়াছি। কোনও কোনও রাজবংশ, এই নবধর্ম ও সংস্কৃতির গোড়া পোষক ও ধারক হইবেন, ইহা কিছু অস্বাভাবিক নয়। বিশেষত, যে সব উচ্চকোটি শ্রেণীসমূহের মধ্যে এই ধর্ম ও সংস্কৃতি বিস্তারলাভ করিতেছিল। সেই সব শ্রেণীই তো রাষ্ট্রের প্রধান ধারক ও সমর্থক; কাজেই, তঁহাদের ধর্ম ও সংস্কৃতির ধারক ও সহায়ক হইবে রাষ্ট্র, ইহা আর বিচিত্র কী? এই যুগের সকল রাজবংশই তো ব্ৰাহ্মণ্যধর্ম ও সংস্কারাশ্রয়ী। দ্বিতীয়ত, শশাঙ্কের অন্যতম প্রধান শত্রু হর্ষবর্ধন বৌদ্ধধর্মের অতি বড় পোষক; শত্রুর আশ্রিত ও লালিত ধর্ম নিজের ধর্ম না হইলেও তাহার প্রতি বিদ্বেষ স্বাভাবিক। যুয়ান-চোয়াঙ শশাঙ্কের অপকীর্তি যে সব স্থানের সঙ্গে যুক্ত করিয়াছেন, তাহার প্রত্যেকটির অবস্থিতি বাঙলার বাহিরে। অন্য অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কারণ বিদ্যমান থাকাও অসম্ভব নয়, যথা বাণিজ্যে বৌদ্ধদের প্রতিপত্তি। তৃতীয়ত, বৌদ্ধধর্ম ও সংস্কৃতির সমৃদ্ধ ও বর্ধিষ্ণু অবস্থা হয়তো ব্ৰাহ্মণ্যধর্মাবলম্বী রাজার খুব রুচিকর ছিল না। য়ুয়ান-চোয়াঙের বিবরণী পাঠে মনে হয়, বাঙলার পাচটি বিভাগেই বৌদ্ধধর্ম ও অনুষ্ঠান-প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব, প্রসার ও প্রতিপত্তি যথেষ্টই ছিল শশাঙ্কের সময়ে এবং পরেও } সেই যুগে এবং পারিপার্শ্বিক ধর্ম ও সংস্কৃতির অবস্থা রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক অবস্থার পরিবেশের মধ্যে শশাঙ্কের বৌদ্ধবিদ্বেষী হওয়া খুব বিচিত্র বলিয়া মনে হয় না। ভারতবর্ষের অনেক স্থানে এই সময় বৌদ্ধ-চিন্তা ও সংস্কৃতির প্রতি একটা বিরূপ মনোবৃত্তি গড়িয়া উঠিতেছিল, এরূপ ইঙ্গিত দুর্লভ নয়। তবে, কী উপায়ে এবং কতটুকু অনিষ্ট তিনি করিতে পারিয়াছিলেন এ সম্বন্ধে য়ুয়ান-চোয়াঙ পক্ষপাতশূন্য মত দিয়ে পারিয়াছেন, স্বীকার করা কঠিন। খুব কিছু অনিষ্ট যে করিতে পারেন নাই তাঁহা তো যুয়ান-চোয়াঙ ও ইৎসিঙের বিবরণীতেই সুস্পষ্ট। তাহা হইলে শশাঙ্কের মৃত্যুর অব্যবহিত পরে য়ুয়ান-চোয়াঙ এবং ৫০ বৎসর পরে ইৎসিঙ বাঙলাদেশে বৌদ্ধধর্মের এতটা সমৃদ্ধি দেখিতে পাইতেন না।

ইহার সামাজিক অর্থ

এই প্রসঙ্গের আলোচনার প্রয়োজন হইল। শশাঙ্ক-চরিত্রের কলঞ্চ-মুক্তির চেষ্টায় নয়, ইহার সামাজিক ইঙ্গিত উদঘাটনের জন্য। বাঙালী জনসাধারণের ইতিহাসের দিক হইতে শশাঙ্ক-চরিত্র রাহুমুক্ত হইল কি না হইল, সে প্রশ্ন অবান্তর; সে প্রশ্ন একান্তই ব্যক্তিক। কিন্তু, এই প্রসঙ্গ তাহা নয়। শশাঙ্ক যদি বৌদ্ধ-বিদ্বিষ্ট হইয়া থাকেন তাহা হইলে স্বীকার করিতে হয়, তাহার বা তাহার রাষ্ট্রের সামাজিক সমগ্রতা সম্বন্ধে সচেতনতা ছিল না, ধর্ম ও সংস্কৃতি সম্বন্ধে রাষ্ট্রের পক্ষপাতিত্ব ছিল এবং সমাজের একটা অংশ, যত ক্ষুদ্র বা বৃহৎই হউক, রাষ্ট্রের পোষকতা লাভ করিতে পারে নাই। যদি শশাঙ্ক বৌদ্ধ-বিদ্বিষ্ট না হইয়া থাকেন তাহা হইলে এই স্বীকৃতি মিথ্যা হইয়া যাইবে না, কারণ, এই প্রসঙ্গের সূচনায় আমি দেখাইতে চেষ্টা করিয়াছি, সুদীর্ঘ দেড়শত বৎসর ধরিয়া কোনও রাষ্ট্র বা রাজবংশই সমসাময়িক বৌদ্ধধর্ম ও সংস্কৃতির কোনও পোষকতা করেন নাই; অন্যদিকে ব্রাহ্মণ্যধর্ম ও সংস্কৃতি তাঁহাদের অবারিত কৃপা লাভ করিয়াছে এবং তঁহাদের সকলেরই আশ্রয় ঐ ব্রাহ্মণ্যধর্ম ও সংস্কৃতি।