০৪. বাঙলায় গুপ্তাধিপত্য – আঃ ৩০০-৫৫০ খ্ৰীষ্টাব্দ

বাঙলায় গুপ্তাধিপত্য – আঃ ৩০০-৫৫০ খ্ৰীষ্টাব্দ

খ্ৰীষ্টোত্তর তৃতীয় শতকের শেষ বা চতুর্থ শতকের সূচনা হইতেই প্রাচীন বাঙলাদেশ যে নিঃসংশয়ে কৌম সমাজ ও রাষ্ট্র-ব্যবস্থা অতিক্ৰম করিয়া আসিয়াছে, তাহার কিছু কিছু প্রমাণ পাওয়া যায়। কৌমতন্ত্র আর নাই; রাজতন্ত্র সুপ্রতিষ্ঠিত হইয়াছে; রাষ্ট্রীয় চেতনায় সঞ্চার হইয়াছে; বাহির হইতে আক্রমণের প্রতিরোধ সংঘবদ্ধ হইয়াছে; জনপদগুলির কৌম-নাম জনপদ-নামে বিবর্তিত হইতে আরম্ভ করিয়াছে; পুষ্করণ, সমতট প্রভৃতি নূতন রাজ্যের নাম শুনা যাইতেছে, যদিও বঙ্গ এবং অন্যান্য রাজ্যও, বিদ্যমান।

বঙ্গজনসমূহ

দিল্লীর কুতুব-মিনারের কাছে মেহেরোলি-লৌহস্তম্ভের লিপিতে চন্দ্ৰ নামক এক রাজা বঙ্গজনপদ সমূহে (বঙ্গেযু) তাহার শত্রু নিধনের গৌরব দাবি করিতেছেন। “বঙ্গেযু’ অর্থে বঙ্গ ও তৎসংলগ্ন জনপদগুলি বুঝাইতে পারে, আবার বঙ্গের অন্তর্গত বিভিন্ন ক্ষুদ্রতর জনপদখণ্ডও বুঝাইতে পারে। যে-অর্থেই হউক, মেহেরোলি-লিপিতে একথাও বলা হইয়াছে যে, বঙ্গীয়েরা একত্র সংঘবদ্ধ হইয়া রাজা চন্দ্রের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ রচনা করিয়াছিল। এই চন্দ্ৰ কে, তাহা লইয়া ঐতিহাসিকদের মধ্যে বিচিত্র মত আছে। কাহারও মতে ইনি গুপ্তসম্রাট প্রথম চন্দ্ৰগুপ্ত, কাহারও মতে দ্বিতীয় চন্দ্ৰগুপ্ত; কেহ কেহ আবার মনে করেন ইনি সমুদ্রগুপ্তের এলাহাবাদ –লিপির চন্দ্ৰবৰ্মা, যে-চন্দ্ৰবৰ্মা ছিলেন সিংহবর্মার পুত্র এবং পুষ্করণের অধিপতি (শুশুনিয়া-লিপি)। অথবা, এমনও হইতে পারে, তিনি একেবারে স্বতন্ত্র নরপতি ছিলেন। ইনি যিনিই হউন, এ-তথ্য সুস্পষ্ট যে, বঙ্গাজনেরা চন্দ্রের আক্রমণ পর্যন্ত স্বাধীন ও স্বতন্ত্র এবং চন্দ্রের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ প্রতিরোধ রচনা করা সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত তাহারা পরাভূত হইয়াছিলেন।

পুষ্করণ

বাঁকুড়া জেলার শুশুনিয়া পাহাড়ের একটি লিপিতে সিংহবর্মর পুত্র পুঙ্করণাধিপ চন্দ্ৰবৰ্মা নামক এক রাজার খবর পাওয়া যাইতেছে। শুশুনিয়া পাহাড়ের প্রায় ২৫ মাইল উত্তর-পূর্বদিকে বর্তমান পোখর্ণ গ্রাম প্রাচীন পুষ্করণের স্মৃতি আজও বহন করিতেছে বলিয়া মনে হয়। এই পুষ্করণাধিপই বোধ হয় সমসাময়িক রাঢ়ের অধিপতি। কেহ কেহ মনে করেন, ইনিই এলাহাবাদ-লিপি-কথিত এবং গুপ্তসম্রাট সমুদ্রগুপ্ত কর্তৃক পরাজিত চন্দ্ৰবৰ্মা।

সমতট, ডবাক

সমুদ্রগুপ্ত পুষ্করণাধিপ চন্দ্রবর্মকে পরাজিত করিয়াছিলেন। কিনা, এ-সম্বন্ধে সন্দেহ থাকিলেও তিনি যে সমতট ছাড়া প্রাচীন বাঙলার আর প্রায় সকল জনপদই গুপ্ত-সাম্রাজ্যভুক্ত করিয়াছিলেন, এ-সম্বন্ধে সন্দেহ নাই। তাহার বিস্তীর্ণ সাম্রাজ্যের পূর্বতম প্রত্যন্ত রাজ্য ছিল নেপাল, কর্তৃপুর, কামরূপ, ডবাক এবং সমতট। সমতট নিঃসন্দেহে দক্ষিণ ও পূর্ববঙ্গের কিয়দংশ, ত্রিপুরা অঞ্চল যাহার কেন্দ্র। কিন্তু, প্রত্যন্ত রাজ্য হইলেও সমতটের রাজা সমুদ্রগুপ্তের আদেশ পালন করিতেন এবং তাঁহাকে যথোচিত সম্মান ও করোপহার দান করিতেন। সমুদ্রগুপ্তই বাঙলায় প্রথম গুপ্তাধিকার প্রতিষ্ঠা করেন নাই। সে-অধিকার বোধ হয় প্রথম চন্দ্রগুপ্তেরও আগে কোনও রাজা প্রতিষ্ঠা করিয়া থাকিবেন। চীন পরিব্রাজক ইৎ-সিঙ বলিতেছেন, মহারাজ শ্ৰীগুপ্ত নামে একজন নরপতি চীন দেশীয় বৌদ্ধ ভিক্ষুদের জন্য গঙ্গার তীর ধরিয়া নালন্দা হইতে চল্লিশ যোজন পূর্বে মি-লি-কিয়া- সি-কিয়া-পো-নো নামে একটি ধর্মস্থান নির্মাণ করাইয়া দিয়াছিলেন এবং মন্দিরের ব্যয় নির্বাহের জন্য চব্বিশটি গ্রাম দান করিয়াছিলেন। মহারাজ শ্ৰীগুপ্তের এবং সমুদ্রগুপ্তের প্রপিতামহ মহারাজ গুপ্ত (আনুমানিক তৃতীয় শতকের তৃতীয় বা চতুর্থ পাদ) বোধ হয় একই ব্যক্তি; এবং ইৎ-সিঙ-কথিত মি-লি-কিয়া —সি—কিয়া-পো-নো এবং বরেন্দ্রভূমির মৃগস্থাপন স্তুপ (মি-লি-কিয়া —সি—কিয়া-পো-নো =মৃগস্থাপন) একই ধর্মস্থান। এ-তথ্য যদি সত্য হয়, তাহা হইলে স্বীকার করিতে হয় যে, বরেন্দ্ৰভূমির তৃতীয় শতকের তৃতীয়-চতুর্থ পাদেই গুপ্তাধিপত্য স্বীকার করিয়াছিল। কিছু পরবর্তীকালে বাঙলাদেশে পুণ্ড্রবর্ধন যে গুপ্ত-সাম্রাজ্যের একটি প্রধান কেন্দ্ৰ হইয়া উঠিয়াছিল এবং সেখানকার উপরিক বা উপরিক মহারাজ যে সম্রাট নিজে নিয়োগ করিতেন—কখনো কখনো রাজকুমারদের একজনই নিযুক্ত হইতেন—তাহার ইঙ্গিত একেবারে অকারণ না-ও হইতে পারে। মেহেরোলি-লিপির চন্দ্ৰ যদি প্রথম চন্দ্ৰগুপ্ত হইয়া থাকেন তাহা হইলে তিনি বঙ্গজনদের জয় করিয়াছিলেন, এ-তথ্য স্বীকার করা চলে। প্রথম চন্দ্রগুপ্তের পুত্র সমুদ্রগুপ্ত পুষ্করণাধিপ চন্দ্রবর্মকে পরাজিত করিয়া রাঢ়দেশ অধিকার করিয়াছিলেন, এ-তথ্যের সম্ভাবনাও। অস্বীকার করা যায় না। এলাহাবাদ-লিপির সাক্ষ্য যদি প্রামাণিক হয় তাহা হইলে অস্বীকার করিবার উপায় নাই যে, সমতট ছাড়া বাঙলাদেশের আর সকল অংশেই সমুদ্রগুপ্তের বিস্তৃত সাম্রাজ্যের রাষ্ট্রানুগত্য স্বীকার করিয়াছিল।

গুপ্তাধিকারের কেন্দ্ৰ

দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের পুত্র প্রথম কুমারগুপ্তের আমল হইতে একেবারে প্রায় ষষ্ঠ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত বাঙলার গুপ্ত রাজত্বের প্রধানতম কেন্দ্র ছিল পুণ্ড্রবর্ধন ৷ ৫০৭-৮ খ্ৰীষ্টাব্দের আগে কোনও সময় সমতটেও গুপ্তাধিকার বিস্তৃত হইয়াছিল, এ-সম্বন্ধে লিপি-প্রমাণ বিদ্যমান; এই সময়ে মহারাজ বৈন্যগুপ্ত নামে একজন গুপ্তাস্ত্য নামীয় রাজা ত্রিপুরা জেলায় কিছু ভূমিদান করিয়াছিলেন। সম্ভবত বৈন্যগুপ্ত গুপ্তরাষ্ট্রেই সামন্ত-রাজরূপে পূর্ববাঙলায় রাজত্ব করিতেছিলেন, পরে গুপ্তরাষ্ট্রের দুর্বলতার সুযোগ লইয়া দ্বাদশাদিত্য এবং মহারাজাধিরাজ উপাধি লইয়া স্বাধীন স্বতন্ত্র নরপতিরূপে খ্যাত হইয়াছিলেন। যাহা হউক, নিঃসংশয় ঐতিহাসিক তথ্য এই যে, ষষ্ঠ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত এবং সম্ভবত একেবারে শেষ পর্যন্ত বাঙলাদেশ গুপ্তাধিকারভুক্ত ছিল এবং এই রাজ্যখণ্ডের প্রধান কেন্দ্র ছিল পুণ্ড্রবর্ধন-ভুক্তি। এই রাষ্ট্রবিভাগ এত গুরুত্বপূর্ণ বলিয়া গণ্য হইত যে, সম্রাট স্বয়ং ইহার শাসনকর্তা—উপরিক বা উপরিক-মহারাজ-নিযুক্ত করিতেন, কখনো কখনো স্বয়ং বিষয়াপতিও নিযুক্ত করিতেন। সময়ে সময়ে উপরিক-মহারাজ হইতেন একেবারে রাজকুমারদেরই একজন।

সামাজিক ইঙ্গিত; শিল্প-ব্যাবসা-বাণিজ্যিক সমৃদ্ধি, সওদাগরী ধনতন্ত্র

গুপ্তাধিকারে বাঙলাদেশে সুবর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রার প্রচলন প্রায় সর্বব্যাপী বলিলেই চলে। সুবর্ণমুদ্রা ছিল দিনার এবং রৌপ্য মুদ্রা রূপক। সাধারণ গৃহস্থীরাও ভূমি ক্ৰয়-বিক্রয়ে সুবর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রা ব্যবহার করিতেছেন, প্রত্যেকটি লিপির সাক্ষ্য তাঁহাই। প্রাচীন বাঙলার সর্বোত্তম সমৃদ্ধিও এই যুগেই। রক্তমৃত্তিকা (মুর্শিদাবাদ জেলার রাঙ্গামাটি)-বাসী বণিক বুধগুপ্ত এই সময়েরই লোক; তিনি মালয় অঞ্চলে গিয়াছিলেন ব্যাবসা-বাণিজ্য ব্যপদেশে। সোমদেবের কথাসরিৎসাগর, বিদ্যাপতির পুরুষপরীক্ষা, হাজারিবাগ জেলার দুধপানি পাহাড়ের লিপি, বাৎস্যায়নের কামশাস্ত্ৰ প্রভৃতির ইতস্তত বিক্ষিপ্ত সাক্ষ্য এই যুগেরই অন্তর্দেশি ও বহির্দেশি বাণিজ্যিক সমৃদ্ধির দিকে ইঙ্গিত করে। নিকষোত্তীর্ণ, সুমুদ্রিত এবং যথানির্দিষ্ট ওজনের সুবর্ণমুদ্রার বহুল প্রচলনও দেশের আর্থিক সমৃদ্ধির দ্যোতক। মনে হয়, নিয়মিত এবং সুসংবদ্ধ প্ৰণালীগত রাষ্ট্র শাসন-ব্যবস্থার ফলে দেশের অন্তর্গত ও সমাজগত-ব্যবস্থার, তথা বাণিজ্য-ব্যবস্থার উন্নতি সম্ভব হইয়াছিল এবং তাহারই ফলে দেশের এই সমৃদ্ধি। প্রত্যক্ষ প্রমাণ নাই, কিন্তু পরোক্ষ প্রমাণ বিদ্যমান। এই যুগের প্রায় প্রত্যেকটি লিপিতেই দেখিতেছি, স্থানীয় রাষ্ট্রাধিকরণ (বিষয়াধিকরণ) যে পাচটি লোক লইয়া গঠিত তাহার মধ্যে দুইজন বোধ হয় রাজপুরুষ, বাকী তিনজনই শিল্পী, বণিক ও ব্যবসায়ী সমাজের প্রতিনিধি—নগরশ্রেষ্টী, প্রথম সার্থিবাহ এবং প্রথম কুলিক। ব্যাবসা-বাণিজ্যের সমৃদ্ধি ছিল বলিয়াই রাষ্ট্রে এই সব সম্প্রদায়ের প্রাধান্যও স্বীকৃত হইয়াছিল; অথবা এমনও হইতে পারে এই সমৃদ্ধির পশ্চাতে রাষ্ট্রের সজ্ঞান একটা চেষ্টা ছিল এবং সে-চেষ্টারই কতকটা রূপ আমরা দেখিতেছি। এই রাষ্ট্রাধিকরণগুলিতে। বঙ্গের বাহিরে অন্য রাষ্ট্রবিভাগের সাক্ষ্য যদি পুণ্ড্রবর্ধনের পক্ষেও প্রমাণিক হয়, তাহা হইলে স্বীকার করিতে হয়, শ্ৰেষ্ঠী, সার্থিবাহ ও কুলিক প্রত্যেক সম্প্রদায়েরই নিজ নিজ নিগম বা সংঘ ছিল, নিজেদের স্বার্থ ও অধিকার রক্ষা ও বিস্তারের জন্য এবং প্রত্যেক নিগম বা সংঘের যিনি প্রধান সভাপতি ছিলেন তিনিই স্থানীয় রাষ্ট্রাধিকরণের সভ্য হইতেন, ইহা অসঙ্গত অনুমান নয়। রাষ্ট্রে বণিক, শ্রেষ্ঠী ও ব্যবসায়ী সমাজের এই আধিপত্য, দেশীয় ও বৈদেশিক বাণিজ্যিক সমৃদ্ধি, সুবর্ণমুদ্রার প্রচলন, বাৎস্যায়ন-বর্ণিত নাগর-জীবনের বিলাস-লীলা, এই সমস্তই সওদাগরী ধনতন্ত্রের দিকে নিঃসংশয় ইঙ্গিত দান করে। এই যুগের বাঙলার সামাজিক ধন শ্রেষ্ঠী-বণিক-ব্যবসায়ী সমাজের আয়ত্তে এবং সেই ধনেই রাষ্ট্র পুষ্ট। সামাজিক ধন উৎপাদন ও বণ্টনের সাধারণ নিয়মে রাষ্ট্র যেমন ইহাদের পোষক ও সমর্থক, ইহারাও তেমনই রাষ্ট্রের প্রধান ধারক ও সমর্থক। শুধু ভূমি ক্রয়-বিক্রয়—দানের ব্যাপারে নয়, স্থানীয় সকল ব্যাপারে এই সমাজই অন্যতম কর্তা; এমন কি, লিপি-প্রমাণ দেখিলে মনে হয়, রাজপুরুষকেও বোধ হয়। ইহাদের নির্দেশ মান্য করিয়া চলিতে হইত। এই সব সাক্ষ্য-প্রমাণ ও তথ্য রাষ্ট্র-বিন্যাস অধ্যায়ে বিস্তৃত আলোচিত হইয়াছে; এখানে রাজবৃত্তের আবর্তন-রিবর্তন প্রসঙ্গে সেই ইঙ্গিতগুলির উল্লেখ রাখিয়া যাইতেছি মাত্র। লক্ষণীয় এই যে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে কৃষিসমাজের কোনও স্থান রাষ্ট্রে প্রায় নাই বলিলেই চলে। কৃষি ও সাধারণ গৃহস্থ-সমাজ তো নিশ্চয়ই ছিল; ভূমি মাপ-জোখ, পট্টোলী-রেজেস্ক্রির সাক্ষী ইত্যাদি ব্যাপারে তাহারা স্থানীয় অধিকরণের সাহায্যও করিতেছেন, কিন্তু রাষ্ট্রযন্ত্রে তাহদের প্রাধান্য তো নাই-ই, স্থানও নাই। এই যুগের দুইটি মাত্র লিপিতে (ধনাইদহ লিপি, ৪৩২-৩৩ এবং ৩ নং দামোদরপুর লিপি, ৪৮২-৮৩) ভূমি ক্ৰয়-বিক্রয় ব্যাপারে রাজপ্রতিনিধির (আয়ুক্তক) সঙ্গে রাজকাৰ্য নির্বাহ যাঁহারা করিতেছেন। তঁহাদের মধ্যে বিত্তবান ব্যবসায়ী-সমাজের প্রতিনিধিদের কাহাকেও দেখিতেছি না, পরিবর্তে দেখিতেছি স্থানীয় মহত্তর (প্রধান প্রধান লোক), গ্রামিক। (গ্রাম-প্রধান), কুটুম্বিক (সাধারণ গৃহস্থ) এবং অষ্টকুলাধিকরণদের। ধনাইদহ-পট্টোলী-উল্লিখিত ভূমি খাদ্য (খাটা?) পার-বিষয়ের অন্তর্গত; দামোদরপুর-পট্টোলীর নির্দেশ দেওয়া হইয়াছিল। পলাশবৃন্দকের অধিকরণ হইতে। মনে হয়, এই দুইটি স্থানীয় অধিকরণ-শাসিত জনপদখণ্ডে শিল্প-বাণিজ্য-ব্যবসায়ে প্রসিদ্ধি ছিল না এবং শ্রেষ্ঠী-বণিক-ব্যবসায়ী শিল্পীকুলের কোনও নিগম বা সংঘ ছিল না। বস্তুত, এই সব অধিকরণ গ্রামাধিকরণ; তবে, স্থানীয় সমাজ একান্তভাবে কৃষিসমাজ না-ও হইতে পারে, কারণ মহত্তর, গ্ৰমিক, কুটুম্বিারা সকলেই যে কিছু সম্পূর্ণ কৃষিনির্ভর ছিলেন, এমন কথা নিঃসংশয়ে বলা যায় না। মধ্যবিত্ত সমাজ তো একটা ছিলই, সেই সমাজের লোকেরা ভূমিলব্ধ আয়নির্ভর যেমন ছিলেন, তেমনই কিছুটা পরিমাণে শিল্প-বাণিজ্য-ব্যবসায়নির্ভরও বোধ হয় ছিলেন।

অবসরপুষ্ট নাগর সমাজ

যে শিল্প-ব্যাবসা-বাণিজ্যনির্ভর সমাজের কথা এই মাত্র বলিয়াছি স্বভাবতই তাহার কেন্দ্র ছিল নগরগুলিতে। এই নাগর-সমাজের জীবন-প্ৰণালীর কিছু কিছু ইঙ্গিত পাওয়া যায় বাৎস্যায়নের কামশাস্ত্রে। বাৎস্যায়ন আনুমানিক চতুর্থ-পঞ্চম শতকের লোক, কাজেই আলোচ্য যুগের সমসাময়িক। গ্রাম ও নগর-বিন্যাস অধ্যায়ে প্রাচীন বাঙলার নাগরজীবন সম্বন্ধে বিস্তৃত আলোচনা করা হইয়াছে; এখানে এ-কথা বলিলেই যথেষ্ট যে, সওদাগরী ধনতন্ত্রে পুষ্ট নগর-সমাজে যে অবসর ও বিলাসলীলা, যে কামচাতুৰ্যলীলা রাজান্তঃপুরে এবং ধনী সমাজের গৃহান্তঃপুরে পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বত্র দৃষ্টিগোচর হয়, ভারতবর্ষেও তাহার ব্যতিক্রম হয় নাই। তবে, বাঙলাদেশ চিরকালই উত্তর-ভারতীয় সমাজ ও সংস্কৃতির প্রত্যন্তদেশে অবস্থিত বলিয়া এবং এখানে আর্যপূর্ব গ্রাম্য সমাজ ও সংস্কৃতির প্রভাব বহুদিন সক্রয় ছিল বলিয়া এদেশে নগর ও নাগর-সমাজ কোনদিনই খুব একান্ত ও সমাদৃত হইয়া উঠিতে পারে নাই। তবু সামাজিক আবর্তন-বিবর্তনের নিয়ম এবং উত্তর-ভারতের স্পর্শ এড়াইয়া যাওয়া তাহার পক্ষে সম্ভব হয় নাই। নাগরিকদের বিলাস-অবসরময় দৈনন্দিন জীবনযাত্রা সম্বন্ধে বাৎস্যায়ন যাহা বলিয়াছেন তাহা কতকাংশে বাঙলাদেশের প্রতিও প্রযোজ্য। একাধিক জায়গায় তিনি প্রাচীন বাঙলার (গৌড়ের) পুরুষদের সৌন্দর্যবোধ ও সৌন্দর্যচর্চার উল্লেখ করিয়াছেন; তাঁহারা যে লম্বা লম্বা নখ রাখিয়া আঙুলের সৌন্দর্যচর্চা করিতেন তাহাও উল্লেখ করিতে ভুলেন নাই। বঙ্গ ও গৌড়ের রাজান্তঃপুরে নানাপ্রকার কামচাতুর্যলীলা অভিনীত হইত, একথাও তিনি বলিতেছেন।

পৌরাণিক ব্ৰাহ্মণ্য-ধর্ম ও সংস্কৃতি

আগেকার রাষ্ট্রপর্বে দেখিয়াছি বাঙলায়। জৈন ও বৌদ্ধধর্মের প্রসার এবং এই দুই ধর্মকে আশ্রয় করিয়া আর্যভাষা ও সংস্কৃতির বিস্তার। এই যুগেও এই দুই ধর্মের বিস্তার অব্যাহত এবং রাষ্ট্র ও রাজবংশের সমর্থন ও পোষকতা ইহাদের পশ্চাতে বিদ্যমান। অশ্বমেধযাজী ব্ৰাহ্মণ্যধর্মাবলম্বী হওয়া সত্ত্বেও গুপ্ত-সম্রাটেরা এই দুই ধর্মের, বিশেষত বৌদ্ধধর্মের প্রতি অনুরক্ত ও শ্রদ্ধাবান ছিলেন। নালন্দা-মহাবিহারের গোড়াপত্তন তো তঁহাদের পোষকতায়ই হইয়াছিল বলিয়া মনে হয়; অন্তত য়ুয়ান-চোয়াঙের সাক্ষ্য তাঁহাই। সারনাথ-বিহারের ধর্ম, শিক্ষা ও সংস্কৃতি-সাধনার পিছনেও তাঁহাদের পোষকতা সক্রয় ছিল, এ-সম্বন্ধেও সন্দেহ করিবার কিছু নাই। বাঙলাদেশেও অনুরূপ সাক্ষ্য বিদ্যমান। ইৎ-সিঙের মি-লি-কিয়া -সি-কিয়া-পো –নো যদি ফুসে (Foucher)-কথিত বরেন্দ্ৰদেশান্তর্গত মৃগস্থাপন স্তুপ হইয়া থাকে তাহা হইলে মহারাজা শ্ৰীগুপ্ত বৌদ্ধধর্মের একজন পোষক ছিলেন, স্বীকার করিতে হয়। পাহাড়পুর পট্টোলীর (৪৭৮-৭৯) সাক্ষ্য হইতে মনে হয়, জৈনধর্ম ও সংঘও গুপ্তরাজাদের সমর্থন লাভ করিয়াছিল। মহারাজ বৈন্যগুপ্ত ছিলেন মহাদেবের ভক্ত অর্থাৎ শৈব; তিনি তাহার সামন্ত মহারাজ রুদ্রদত্তের অনুরোধে ত্রিপুরা জেলার গুণাইঘর (গুণিকাগ্রহার) গ্রামে কিছু ভূমি দান করিয়াছিলেন, মহাযানাচার্য শান্তিদেব প্রতিষ্ঠিত মহাযানিক অবৈবর্তিক-ভিক্ষুসংঘের আশ্রম-বিহারের সেবার জন্য। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে ইহাও স্মর্তব্য যে, গুপ্তরাজবংশ ছিল ব্রাহ্মণ্যধর্মাবলম্বী এবং ইহাদের রাজত্বকালেই ভারতবর্ষে পৌরাণিক ব্ৰাহ্মণ্যধৰ্ম—এখন আমরা যাহাকে বলি হিন্দুধর্ম-তোহার অভু্যুত্থান ও প্রসারলাভ ঘটে। মৎস্য, বায়ু, বিষ্ণু প্রভৃতি প্রধান প্রধান পুরাণগুলি এই যুগেই রচিত হয় এবং পৌরাণিক দেবদেবীরা এই সময়ই পূজা ও প্রতিষ্ঠা লাভ করিতে আরম্ভ করেন। জৈন ও বৌদ্ধধর্মের প্রতি রাজকীয় ঔদার্য ও পোষকতা থাকা সত্ত্বেও তাহারা এই ব্ৰাহ্মণ্য ধর্মের সবিশেষ পোষক ও ধারক হইবেন এবং এই ধর্ম ও সংস্কৃতি প্রচারে সচেষ্ট হইবেন, ইহাই তো স্বাভাবিক। বাঙলাদেশের সমসাময়িক লিপিগুলির সাক্ষ্যও তাঁহাই। অধিকাংশ • লিপিতেই ব্ৰাহ্মণদের সাক্ষাৎ তো পাই-ই, ভূমিদান তো তঁহারাই লাভ করিতেছেন, ছান্দোগ্য-ব্রাহ্মণের উল্লেখও একটি লিপিতে আছে (ধনাইদহ লিপি); কিন্তু তাহার চেয়েও লক্ষণীয়, বিবিধ ব্ৰাহ্মণ্য যাগযজ্ঞ এবং পৌরাণিক দেবদেবী পূজার প্রচলন, ব্রাহ্মণদের জন্য নূতন নূতন বসতি স্থাপন, ইত্যাদি। অগ্নিহোত্ৰ যজ্ঞ, পঞ্চম মহাযজ্ঞ, চক্রস্বামী (বিষ্ণু), কোকামুখস্বামী, শ্বেতবরাহস্বামী, নামলিঙ্গ, গোবিন্দস্বামী, অনন্তনারায়ণ মহাদেব প্ৰদ্যুমেশ্বর প্রভৃতি দেবতার পূজা, বলি-চরু-সত্ৰ প্রবর্তন, গাব্য-ধূপ- পুষ্প-মধুপৰ্ক-দীপ ইত্যাদি পূজোপকরণ প্রভৃতির সাক্ষাৎ বাঙলাদেশে এই প্ৰথম পাওয়া যাইতেছে। ব্ৰাহ্মণ ও ব্রাহ্মণ্যধর্মের প্রতি সমাজের অন্তত একটা অংশের-এবং এই অংশই সমাজের প্রতিষ্ঠাবান অংশ-সবিশেষ শ্রদ্ধা ও পোষকতা কিছুতেই দৃষ্টি এড়াইবার কথা নয়। এই যুগে ইহারা যে ক্রমশ প্রতিষ্ঠা লাভ করিতেছেন এবং ব্রাহ্মণ ও ব্রাহ্মণ্যধর্মের আদর্শ বলবত্তর হইতেছে তাহার সবিশেষ প্রমাণ পাই যখন দেখি সাধারণ গৃহস্থ ব্যক্তিরাও নূতন নূতন ব্ৰাহ্মণ বসতি করাইবার জন্য ভূমি ক্রয় করিতেছেন এবং তোহা ব্রাহ্মণদের দান করিতেছেন। ব্রাহ্মণদের ভূমিদান করিবার যে-রীতি পরবর্তীকালে সুপ্রতিষ্ঠিত ও সুপ্রচলিত হইয়াছে তাহার সূত্রপাতও দেখি এই সময় হইতে। অব্যবহিত পরবর্তী যুগে যে এই অভ্যাস আরও বাড়িয়াই গিয়াছে, তাহার প্রমাণ ষষ্ঠ এবং সপ্তম শতকের প্রত্যেকটি লিপিতেই পাওয়া যাইবে। লোকনাথের ত্রিপুরা-পট্টোলীতে দেখিতেছি, রাজা লোকনাথের মহাসামন্ত ব্ৰাহ্মণ প্রদোষশৰ্মা সুৰ্ব্বঙ্গ বিষয়ের অরণ্যময় ভূমিতে অনন্ত-নারায়ণের এক মন্দির প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন এবং তাহারই সন্নিকটে চতুর্বেদবিদ্যবিশারদ (চাতুবিদ্যা) দ্বিশতাধিক ব্ৰাহ্মণের বসতি স্থাপন করিয়া দিয়াছিলেন। ব্রাহ্মণ ও ব্রাহ্মণ্যধর্মের এই যে সবিশেষ পোষকতা ইহার রাষ্ট্ৰীয় ইঙ্গিত লক্ষণীয়; এই পোষকতার ফলেই ব্ৰাহ্মণ ও ব্রাহ্মণ্য-সমাজ রাষ্ট্রের অন্যতম ধারক ও পোষক শ্রেণীরূপে গড়িয়া উঠিতে আরম্ভ করে এবং তোহাৱাই ধৰ্ম, সমাজ ও সংস্কৃতির আদর্শ নির্দেশের নিয়ামক হইয়া উঠেন। উত্তর-ভারতে এই শ্রেণী ও শ্রেণীগত সমাজের ঐতিহাসিক বিবর্তন আগেই দেখা দিয়াছিল। গুপ্তাধিপত্যক আশ্রয় করিয়া বাঙলাদেশে সেই বিবর্তন এই যুগেই, অর্থাৎ চতুর্থ হইতে ষষ্ঠ শতকের মধ্যে সর্বপ্রথম দেখা দিল; এবং ইহাদের অবলম্বন করিয়াই আর্য ভাষা, আর্য ধর্ম ও সংস্কৃতির স্রোত সবেগে বাঙলাদেশে প্রবাহিত হইল। রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণকথা, বিচিত্র লৌকিক গল্প-কাহিনী ইত্যাদি সমস্তই সেই স্রোতের মুখে এদেশে আসিয়া পড়িয়া এদেশের প্রাচীনতম ধর্ম, সংস্কৃতি, ভাষা, লোককাহিনী সমস্ত কিছুকে সবেগে সমাজের একপ্রান্তে অথবা নিম্নস্তরে ঠেলিয়া নামাইয়া দিল। উচ্চতর শ্রেণীগুলির ভাষা হইল। আর্য ভাষা; ধর্ম হইল বৌদ্ধ, জৈন বা পৌরাণিক ব্রাহ্মণ্যধর্ম; সাংস্কৃতিক আদর্শ গড়িয়া উঠিল আর্যাদর্শনুযায়ী। প্রত্যন্তস্থিত বাঙলাদেশ এই যুগে উত্তর-ভারতের বৃহত্তর রাষ্ট্রীয়, অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক ধারার সঙ্গে যুক্ত হইয়া গেল; এবং তাহা সম্ভব হইল বাঙলাদেশ গুপ্ত রাজবংশের প্রায় সর্বভারতীয় সাম্রাজ্যের অংশ হওয়ার ফলে, ব্যাবসা-বাণিজ্য সংক্রান্ত আদান-প্রদানের ফলে, ব্রাহ্মণ্যধর্ম ও সংস্কৃতির প্রসারের ফলে।