• Skip to main content
  • Skip to header right navigation
  • Skip to site footer

Bangla Library

Read Bengali Books Online (বাংলা বই পড়ুন)

  • লেখক
  • My Account
  • লেখক
  • My Account
  • বাংলা ডিকশনারি
  • বাংলা কৌতুক
  • বাংলা লিরিক
  • বাংলা রেসিপি
  • হেলথ টিপস এন্ড নিউজ

বাংলা PDF ডাউনলোড

বাংলা নতুন/পুরাতন বইয়ের পিডিএফ ডাউনলোড/সন্ধান করতে আমাদের বাংলা পিফিএফ সাইটে ক্লিক করুন।

Bangla PDF

০৭. সেন-পর্ব

লাইব্রেরি » নীহাররঞ্জন রায় » বাঙালীর ইতিহাস (আদিপর্ব) » ০৯. রাষ্ট্র-বিন্যাস » ০৭. সেন-পর্ব

সেন-পর্ব

সেন-পর্বে সেন-বৰ্মণ ও অন্যান্য ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের রাষ্ট্রযন্ত্র সম্বন্ধে আর বিশেষ কিছু বলিবার নাই। এই সব রাষ্ট্রযন্ত্রে মোটামুটি পাল-পর্বের রাষ্ট্রযন্ত্রের আদর্শই স্বীকৃতি লাভ করিয়াছিল; রাষ্ট্র-বিন্যাসের আকৃতি-প্রকৃতিও মোটামুটি একই প্রকার। তবে, এই পর্বে আমলাতন্ত্র আরও বিস্তৃত হইয়াছে আরও স্ফীত হইয়াছে। রাজা ও রাজপরিবারের মর্যাদা, মহিমা ও আড়ম্বর আরও বাড়িয়াছে; রাষ্ট্রযন্ত্রের একাংশে ব্ৰাহ্মণ ও পুরোহিততন্ত্ৰ জাকাইয়া বসিয়াছে। রাষ্ট্রযন্ত্রবিভাগ বৃহত্তর গ্রামগুলিকেও বিভক্ত করিয়া একেবারে পাটক বা পাড়া পর্যন্ত বিস্তৃত হইয়াছে, অর্থাৎ রাষ্ট্রযন্ত্রের সুদীর্ঘ বাহু জনপদের ও জনসাধারণের শেষসীমা পর্যন্ত পৌঁছিয়া গিয়াছে; ছোটবড় রাজপদের সংখ্যা বাড়িয়াছে, নূতন নূতন পদের সৃষ্টি হইয়াছে, বড় পদগুলির মহিমা ও মর্যাদা বাড়িয়া গিয়াছে। অথচ, সেন বা বর্মণ বা অন্যান্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের রাজ্য-পরিধি পাল ও চন্দ্রবংশের রাজ্য-পরিধি অপেক্ষা সংকীর্ণতর। ঈশ্বরঘোষের রাজবংশ, দেববংশ, ইহারা তো একান্তই স্থানীয় ক্ষুদ্র জনপদ-স্বামী অথচ ইহাদেরও লিপিগুলিতে আমলাতন্ত্রের যে আকৃতি দৃষ্টিগোচর হয়, রাজতন্ত্রের যে প্রকৃতি ধরা পড়ে তাহা অস্বাভাবিক রূপে স্ফীত ও বিস্তৃত।

সেন রাজারা পাল রাজাদের রাজোপাধিগুলি তো ব্যবহার করিতেনই, উপরন্তু নামের সঙ্গে তঁহাদের নিজ নিজ বিরুদও ব্যবহার করিতেন। বিজয়সেন, বল্লালসেন, লক্ষ্মণসেন, বিশ্বরূপসেন ও কেশবসেনের বিরুদ যথাক্রমে ছিল অরিবৃষভ-শঙ্কর, অরিরাজ নিঃশঙ্ক-শঙ্কর, অরিরাজ মদন-শঙ্কর, অরিরাজ বৃষভাঙ্ক-শঙ্কর এবং অরিরাজ অসহা-শঙ্কর। তাহার উপর, একেবারে শেষ অধ্যায়ের রাজারা আবার এই সব বিরুদের সঙ্গে সঙ্গে আশ্বপতি, গজপতি, নরপতি, রাজত্ৰয়াধিপতি প্রভৃতি উপাধিও ব্যবহার করিতেন এমন কি দেববংশীয় রাজা দশরথদেবও। সেন ও বর্মণ বংশের, ঈশ্বর ঘোষ ও ডোম্মানপালের লিপিগুলিতে রাজ্ঞী ও মহিষীর উল্লেখও পাইতেছি; ভূমিদানক্রিয়া তাহাদেরও বিজ্ঞাপিত হইতেছে। পালবংশের একটি লিপিতেও কিন্তু রাজপুরুষ হিসাবে রাজ্ঞী বা মহিষীর উল্লেখ নাই; চন্দ্র ও কম্বোজ বংশের লিপিতেই ইহাদের প্রথম উল্লেখ দেখা গিয়াছে। ইহারা কী হিসাবে রাজপুরুষ ছিলেন, কী ইহাদের দায় ও অধিকার ছিল, কিছুই বুঝা যাইতেছে না।

জ্যেষ্ঠ রাজকুমার যুবরাজ হইতেন এবং সেই হিসাবে রাষ্ট্রকর্মে, সামরিক ব্যাপারে রাজার সহায়কও ছিলেন। মাধ্যাইনগর লিপিতে দেখিতেছি, যুবরাজ লক্ষ্মণসেন কোনও কোনও বিজয়ী সমারাভিযানে অংশ গ্রহণ করিয়াছিলেন। বিশ্বরূপসেনের সাহিত্য-পরিষৎ-লিপিতে সূর্যসেন এবং পুরুষোত্তমসেন নামে দুই (রাজ) কুমারের উল্লেখ আছে; এই লিপিতেই আর একজন অনুল্লিখিতনামা কুমারের সাক্ষাৎ পাওয়া যাইতেছে। ঈশ্বরঘোষের রামগঞ্জ লিপিতে অন্তত তিনজন রাজপুরুষের উল্লেখ পাইতেছি। যাহারা রাজপ্রাসাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বলিয়া মনে হইতেছে। শিরোরক্ষিক বোধহয় রাজার দেহরক্ষক; অন্তঃপ্ৰতীহার প্রাসাদের অন্দব-মহলের রক্ষাকাবেক্ষক বা প্ৰতীহার এবং আভ্যন্তরিক রাজপ্রাসাদের ব্যবস্থাপক বলিয়াই মনে হইতেছে। ইহাদের ছাড়া অন্তরঙ্গ ঔপধিক রাজবৈদ্যের সাক্ষাৎও পাইতেছি। মহাপাদমূলক নামে আর একজন রাজপুরুষের উল্লেখ এই লিপিতে আছে। ইনি কি ছিলেন রাজার ব্যক্তিগত অনুচর? এই পর্বেও সামন্তরা অত্যপ্ত প্ৰবল এবং সংখ্যায়ও প্রচুর। এক রাণিক শূলপাণি বিজয়সেনের দেওপাড়া-প্রশস্তি খোদিত করিয়াছিলেন; শূলপাণি ছিলেন “বারেন্দ্রকশিল্পীগোষ্ঠীচুড়ামণি”। ত্রিপুরায় রণবঙ্কমল্ল হারিকালদেবের বংশ, চট্টগ্রাম-ঢাকার দেববংশ, ঈশ্বর ঘোষ, ডোম্মনপাল, মুঙ্গেরের গুপ্ত-উপান্ত-নামা এক রাজবংশ-ইহারা সকলেই তো সামন্ত-মহাসামন্ত, মহামাণ্ডলিক বংশ ছিলেন; পরে কেহ কেহ স্বাতন্ত্র্য ঘোষণা করিয়া মহারাজাধিরাজ হইয়াছিলেন। ঢ়েঙ্করীর ঈশ্বর ঘোষ যে মহামাণ্ডলিক ছিলেন তাহা রামগঞ্জ লিপিতেই সপ্রমাণ। ঢেঙ্করীর এক মণ্ডলাধিপতি রামপালের সামন্তরূপে বরেন্দ্রী পুনরুদ্ধারে সহায়তা করিয়াছিলেন। ঈশ্বর ঘোষ, খুব সম্ভব, সেন রাষ্ট্রেরই অন্যতম সামন্ত ছিলেন। রামগঞ্জ লিপি পাঠে স্পষ্টতই মনে হয়, এই সব সামান্তরা প্রকৃতপক্ষে নিজ নিজ জনপদে স্বাধীন রাজার মতই আচরণ করিতেন! দেখিতেছি, পাল ও চন্দ্ৰবংশীয় স্বাধীন মহারাজাধিরাজদের রাজকীয় লিপিতে যেমন ভূমিদানক্রিয়া রাজা, রাজনক, রাজন্যক, রাণিক ইত্যাদি রাজপুরুষকে বিজ্ঞাপিত করা হইতেছে, মহামাণ্ডলিক ঈশ্বরঘোষের লিপিতেও ঠিক তেমনই করা হইয়াছে, অথচ তিনি স্বাধীন রাজা ছিলেন না। বর্মণ ও সেন লিপিতেও যথারীতি রাজা, রাজন্যক, রাণিক প্রভৃতির উল্লেখ বিদ্যমান। মহামাণ্ডলিক ঈশ্বর ঘোষের রামগঞ্জ লিপির তালিকায় এমন – কি মহাসামস্তুেরও উল্লেখ আছে। প্ৰসিদ্ধ কাব্যসংকলনগ্রন্থ সন্দুক্তিকর্ণামৃতের সংকলয়িতা কবি শ্ৰীধরদাস ছিলেন মহামাণ্ডলিক এবং শ্ৰীধরের পিতা, লক্ষ্মণসেনের “অনুপমপ্রেমকপাত্ৰং সখা”, শ্ৰীবটুদাস ছিলেন “প্রতিরাজডস্কৃত মহাসামন্তচূড়ামণি”।

মন্ত্রীবাগের মধ্যে প্রধান মহামন্ত্রীর সাক্ষাৎ এই পর্বেও পাইতেছি। ভট্ট ভবদেবের পিতামহ আদিদেব এক (চন্দ্ৰবংশীয়?)। বঙ্গরাজ্যের মহামন্ত্রী ছিলেন। আদিদেব শুধুই মহামন্ত্রী ছিলেন না, তিনি রাজার বিশ্রাম-সচিব, মহাপাত্র এবং সন্ধিবিগ্রহীও ছিলেন। ভট্ট ভবদেব স্বয়ং বর্মণরাজ হরিবর্মদেবের মন্ত্রশক্তিসচিব ছিলেন এবং ভবদেবের পরামর্শেই হরিবর্মদেব নাগ ও অন্যান্য রাজাদের পরাজিত করিতে পারিয়াছিলেন। মহামন্ত্রী নামে কোনও পদের উল্লেখ সেন লিপিগুলিতে পাওয়া যাইতেছে না। কিন্তু কোনও কোনও লিপিতে যেমন, কেশবসেনের ইদিলপুর লিপিতে, মহামহত্তক বা মহামত্তক নামীয় একজন রাজপুরুষের উল্লেখ পাইতেছি। সেনা-বংশের ভূমিদান লিপিগুলি সাধারণত মহা-সান্ধিবিগ্রহিক দ্বারা অনুমোদিত হইত এবং সান্ধিবিগ্রহিকেরা সাধারণত লিপিগুলির দূতের কাজ করিতেন। কিন্তু ইদিলপুর লিপিটির দৌত্য করিয়াছিলেন শ্ৰীগৌড়মহামহত্তক স্বয়ং এবং লিপিটির এবং লিপিবদ্ধ বিবরণীয় শুদ্ধতা পরীক্ষা করিয়া অনুমোদন করিয়াছিলেন তিনজন করণ বা কেরানী; ইহাদের একজন মহামহত্তকের, একজন মহাসান্ধিবিগ্রহিকের এবং তৃতীয় জন স্বয়ং মহারাজের। মহামহত্তক মনে হইতেছে সেন রাষ্ট্রের ও রাজার অন্যতম প্রধানমন্ত্রী। অন্যান্য মন্ত্রীও ছিলেন। পূর্বোক্ত ইদিলপুর লিপিতেই দেখিতেছি, শতসচিব দ্বারা রাজপাদপদ্ম লালিত হইত (সচিবশতমৌলিলালিতঃ পদাম্বুজ)। ইহাদের মধ্যে মহাসান্ধিবিগ্রহিকই ছিলেন প্রধান, এ সম্বন্ধে সন্দেহ নাই। অন্তত মহারাজাধিরাজের ভূমিদানক্রিয়ার তিনিই যে প্রধান অনুমোদনকর্তা তাহা তো একাধিক লিপিতে সুস্পষ্ট। লক্ষ্মণসেনের আনুলিয়া লিপির দূত ছিলেন সান্ধিবিগ্রহিক নারায়ণদত্ত এবং মহারাজের দানক্রিয়া অনুমোদন করিয়াছিলেন মহাসান্ধিবিগ্রহিক। মহাসান্ধিবিগ্রহিকেরাই অধিকাংশ সেন”ভূমিদানলিপির দূত। বস্তুত, এই পর্বে মহাসান্ধিবিগ্রহিক এবং তাঁহার সহকারী সান্ধিবিগ্রহিকেরাই সেন-কেন্দ্রীয়-রাষ্ট্রের সর্বপ্রধান কর্মচারী এবং রাজার প্রধান সহায়ক বলিয়া মনে হইতেছে। আদিদেব এবং ভট্ট ভবদেব দুইজনই যথাক্রমে বঙ্গ এবং বৰ্মণরাষ্ট্রের সান্ধিবিগ্রহিক; অধিকন্তু আদিদেব ছিলেন মহামন্ত্রী। লক্ষ্মণসেনের ভাওয়াল-লিপি-কথিত শঙ্কর্যধর শুধু গৌড়রাষ্ট্রের মহাসান্ধিবিগ্রহিক ছিলেন না, শতমন্ত্রীর প্রধান প্রভুও ছিলেন। নানা রাষ্ট্রকর্মে নিযুক্ত অন্যান্য প্রধান মন্ত্রীদের মধ্যে বৃহদুপরিক, মহাভোগিক বা মহাভোগপতি, মহাধৰ্মধ্যক্ষ, মহাসেনাপতি, মহাগণস্থ, মহামুদ্রাধিকৃত, মহাবলাধিকরণিক, মহাবলাকোষ্ঠিক, মহাকরণাধ্যক্ষ, মহাপুরোহিত, মহাতন্ত্রাধিকৃত ইত্যাদি রাজপুরুষের সাক্ষাৎ পাইতেছি। ইহারা যে কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রের এক এক বিভাগের সর্বাধ্যক্ষ বা প্ৰধানমন্ত্রী ছিলেন, সন্দেহ নাই ৷ মহাকার্তাকৃতিকের উল্লেখ এই পর্বে পাইতেছি না। ডোম্মানপালের সুন্দরবন লিপিতে সপ্ত—আমাত্যের উল্লেখ পাইতেছি; ইহার অর্থ পরিষ্কার নয়। পাল-পর্বে ভিন্ন ভিন্ন বিভাগের যে সব অধ্যাক্ষের সাক্ষাৎ মিলিয়াছে, এই পর্বেও তাহারা বিদ্যমান। চন্দ্ৰবংশীয় শাসনে যেমন, সেনা-বর্মণ লিপিগুলিতেও তেমনই কৌটিল্যের ‘অধ্যক্ষ-প্রচার-অধ্যায়। কথিত কর্মচারীবর্গের উল্লেখ আছে।

কম্বোজ-বর্মণ-সেন রাষ্ট্রযন্ত্রে পুরোহিততন্ত্রের প্রতিপত্তি লক্ষণীয়। পুরোহিত, মহাপুরোহিত, মহাতন্ত্রাধিকৃত, রাজপণ্ডিত ইহারা সকলেই রাজপুরুষ। এই যুগের লিপিগুলিতে শাস্তিবারিক, শান্ত্যাগারিক, শান্ত্যাগোরাধিকৃত প্রভৃতি পুরোহিতের ছড়াছড়ি; ইহারা রাজপুরুষ ছিলেন। কিনা, – নিঃসংশয়ে বলা যায় না। তবে, রামগঞ্জ লিপির ঠাকুর রাজপুরুষ এবং ঠাকুর হইতেই যে বর্তমান পদোপাধি ঠাকুর উদ্ভূত, এ সম্বন্ধে বিন্দুমাত্র সন্দেহের কারণ নাই। ঠাকুর বাঙলার বাহিরে কোনও কোনও লিপিতে লেখক বা কারণ অর্থেও ব্যবহৃত হইয়াছে; এ ক্ষেত্রেও তাহা হইয়া থাকিতে পারে।

পাল-পর্বের মত এ-পর্বেও রাষ্ট্রের প্রধান জনপদ বিভাগগুলির দেখা মিলিতেছে; ভুক্তিপতির (উপরিকের) শাসনাধীনে ভুক্তি, মণ্ডলপতির শাসনাধীনে মণ্ডল, বিষয়পতির শাসনাধীনে বিষয়। কিন্তু বিষয় বা মণ্ডলের নীচের গ্রাম সংক্রান্ত স্থানীয় বিভাগ-উপবিভাগের সংখ্যা বাড়িয়া গিয়াছে এবং ক্ষুদ্র বৃহৎ একাধিক নূতন বিভাগের সৃষ্টি হইয়াছে। এ-পর্বের লিপিগুলিতে পৌণ্ড বা পুণ্ড্রবর্ধন-ভুক্তি, বর্ধমান-ভূক্তি এবং কঙ্কগ্রাম-ভূক্তির খবর পাওয়া যাইতেছে। সেন রাজাদের আমলে পুণ্ড্রবর্ধন-ভুক্তির সীমা খুব বাড়িয়া গিয়াছিল; উত্তর ও দক্ষিণ বঙ্গের প্রায় সমস্ত জনপদ এবং পূর্ববঙ্গের বৃহৎ একটি অংশ এই ভুক্তি-বিভাগের অন্তৰ্গত ছিল। পাল-পর্বের বর্ধমান-ভুক্তি লক্ষ্মণসেনের সময় খবীকৃত হইয়া দুইটি ভুক্তির সৃষ্টি করিয়াছিল, উত্তরে কঙ্কগ্রাম-ভূক্তি, দক্ষিণে বর্ধমান-ভুক্তি। দণ্ড-ভুক্তির কোনও উল্লেখ এই পর্বে নাই। ভুক্তিপতি বা উপরিকদের একজন উর্ধর্বতন কর্মচারী ছিলেন; তাহার পদােপাধি বৃহদুপরিক এবং তিনি সম্ভবত কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রযন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। মহারাজাধিরাজের অন্তরঙ্গ বা রাজবৈদ্য অনেক সময়ই বৃহদুপরিক কর্তৃক নিযুক্ত হইতেন; সেই জন্যই বোধ হয় কতকগুলি লিপিতে অন্তরঙ্গ-বৃহদুপরিক একসঙ্গে একই রাজপুরুষ বলিয়া উল্লিখিত হইয়াছেন।

ভুক্তির অব্যবহিত নিম্নতর বিভাগ মণ্ডল না বিষয়, এ সম্বন্ধে এই পর্বেও নিশ্চয় করিয়া বলিবার উপায় নাই। ভোজ্যবর্মণের বেলাব-লিপির উপ্যালিকা গ্ৰাম কৌশস্বী অষ্টগচ্ছখণ্ডল সংবদ্ধ অধঃপক্কয়-মণ্ডলের অন্তর্গত এবং এই মণ্ডল পৌণ্ডভুক্তির অন্তর্গত। বিজয়সেনের বারাকপুর-লিপির ঘাসসম্ভোভট্টবড়া গ্রাম খাড়ি-বিষয়ের অন্তৰ্গত এবং খাড়ি-বিষয় পৌণ্ডবর্ধন-ভুক্তির অন্তর্গত। নৈহাটি লিপির বাল্লাহিঠঠা গ্রাম স্বল্পদক্ষিণ-বীথীর অন্তর্গত; এই বীথী বর্ধমান-ভুক্তির উত্তররাঢ়-মণ্ডলান্তঃপাতী। আনুলিয়া-লিপির দত্তভূমির (মাথরণ্ডিয়া গ্রামে) মণ্ডলটি পৌণ্ডবর্ধন-ভুক্তির অন্তর্গত। গোবিন্দপুর-শাসনের বিড়ডােরশাসনগ্রাম বেতড়ড-চতুরকে অবস্থিত, এই চতুরক। বর্ধমান-ভুক্তির পশ্চিম-খাটিকার অন্তর্গত। তপণদীঘি-শাসনের বেলহিষ্টী গ্রাম পৌণ্ডবর্ধন-ভুক্তির বরেন্দ্রী (মণ্ডলের) অন্তৰ্গত। মাধ্যাইনগর লিপির দাপনিয়া-পাটকও বরেন্দ্রী (মণ্ডলের) অন্তর্গত এবং বরেন্দ্রী পৌণ্ডবর্ধন-ভুক্তির অন্তর্গত। সুন্দরবন লিপির মণ্ডলগ্রাম কাতল্লাপুর চতুরকে অবস্থিত, এই চতুরক খাড়ি-মণ্ডলের অন্তৰ্গত, এবং খাড়ি-মণ্ডল পৌণ্ডবর্ধন-ভুক্তির অন্তর্গত। শক্তিপুর-শাসনের কঙ্কগ্রাম-ভূক্তির মধুগিরি-মণ্ডল কয়েকটি বীথীতে বিভক্ত, তন্মধ্যে দক্ষিণ-বীথী একটি। ইদিলপুর-লিপির তিলপাড়া-পাটকের এবং মদনপাড়া লিপির পিঞ্জোকাষ্টি গ্রামের অবস্থিতি বঙ্গে বিক্রমপুর-ভাগে এবং বঙ্গ পৌণ্ডবর্ধন-ভুক্তির অন্তৰ্গত। বিশ্বরূপসেনের সাহিত্য-পরিষৎ লিপির রামসিদ্ধি-পাটক এবং বিজয়তিলক-গ্রাম পৌণ্ডবর্ধন-ভুক্তির অন্তর্গত বঙ্গের নাব্যভাগে অবস্থিত; আজিকুলপাটিক মধুক্ষীরাক-আবৃত্তির নবসংগ্ৰহ-চতুরকে অবস্থিত; দেউলহস্তী (গ্রাম) বঙ্গের অন্তৰ্গত লাউহণ্ডা-চতুরকে অবস্থিত, এবং ঘাঘরকাটি-পাটক চন্দ্ৰদ্বীপের উরা-চতুরকে অবস্থিত। ঈশ্বরঘোষের রামগঞ্জ লিপির দিগঘাসোনিকা গ্রাম গাল্লিটিপ্যাক-বিষয়ের অন্তর্গত, এবং এই বিষয় পিয়োল্ল-মণ্ডলের অন্তঃপাতী।

উপরোক্ত বিস্তৃত সাক্ষ্যের মধ্যে ভুক্তির সঙ্গে বিষয় বা মণ্ডলের এবং বিষয় ও মণ্ডলের পরস্পর সম্বন্ধের সঠিক ইঙ্গিত পাওয়া যাইতেছে না। কোথাও দেখিতেছি, ভুক্তির অব্যবহিত নিম্নবর্তী বিভাগ মণ্ডল, কোথাও দেখিতেছি বিষয়, আবার কোথাও কোথাও দেখিতেছি। একেবারে বীথী। বর্ধমান-ভুক্তির পরেই মণ্ডল, মণ্ডলের পর, বীথী; অন্তত নৈহাটি ও শান্তিপুর-লিপিতে তো তাঁহাই দেখিতেছি, যদিও গোবিন্দপুর শাসনে ভুক্তির পরেই পাইতেছি। পশ্চিম-খাটিকা। পশ্চিম-খাটিকা কি মণ্ডল, না বিষয়, না বীথী বুঝিবার উপায় নাই; তাহার পরেই চতুরক। কঙ্কগ্রাম-ভূক্তিতে ভুক্তির পরই বীথী। বঙ্গ পৌণ্ডবর্ধন-ভুক্তির অন্তর্গত; কিন্তু বঙ্গ বিষয় না মণ্ডল কিছুই বুঝা যাইতেছে না; মনে হয়, ইহাদের উভয়াপেক্ষা বৃহত্তর বিভাগ, কিন্তু এ-বিভাগ রাষ্ট্রীয় বিভাগ নয়, ভৌগোলিক-বিভাগ মাত্র। বঙ্গের দুই ভাগ : বিক্রমপুর-ভাগ ও নাব্য-(ভাগ?)। এই নাব্য-(ভাগের) উল্লেখ বোধ হয় শ্ৰীচন্দ্রের রামপাল-লিপিতেও আছে, নাব্য (নান্য পাঠ অশুদ্ধ বলিয়াই মনে হয়) মণ্ডল রূপে। যাহা হউক, বিক্রমপুর-ভাগের “ভাগও কোনও রাষ্ট্রীয় বিভাগ বলিয়া মনে হইতেছে না, ভৌগোলিক বিভাগ মাত্ৰ। বিক্রমপুর-ভাগ-বিক্রমপুর অঞ্চল, নাব্য (ভাগ?)=নাব্য অঞ্চল। অন্যত্র, বিষয় যেন মণ্ডলের অন্তর্গত বলিয়াই মনে হইতেছে। যেমন, পরণয়ি-বিষয় সমতট-মণ্ডলভুক্ত, গাল্পিটিপাক-বিষয় পিয়োল্ল-মণ্ডলের অন্তঃপাতী ৷ লক্ষণীয়। এই যে, বিষয় বিভাগ সেনারাষ্ট্রে বিশেষ দেখা যাইতেছে না; বিজয়সেনের বারাকপুর লিপিতে পৌণ্ডবর্ধন-ভুক্তির অন্তর্গত খাড়ি-বিষয়ের উল্লেখ পাইতেছি, কিন্তু লক্ষ্মণসেনের আমলে খাড়ি-মণ্ডলে রূপান্তরিত হইয়া গিয়াছে!

অন্তত একটি ক্ষেত্রে মণ্ডলের পরবর্তী বিভাগ দেখিতেছি খণ্ডল; অন্যত্র মণ্ডলের পরেই বীথী যেমন, বর্ধমান-ভুক্তিতে; আর এক ক্ষেত্রে মণ্ডলের পরেই পাইতেছি। চতুরক। যেমন, খাড়ি-মণ্ডলের কাপ্তাল্লাপুর-চতুরক। অন্যত্র চতুরক হইতেছে আবৃত্তির নিম্নতর বিভাগ যেমন, নবসংগ্ৰহ-চতুরক। মধুক্ষীরাক-আবৃত্তির অন্তর্গত। কিন্তু, আবৃত্তি কাহার বিভাগ, সঠিক জানা যাইতেছে না। তবে মণ্ডলের উপবিভাগ হওয়া অসম্ভব নয়। চতুরক। কখনো কখনো সোজাসুজি বৃহত্তর বিভাগের অন্তর্গত, যেমন, বেতড়ড়-চতুরক। বর্ধমান-ভূক্তির অন্তর্গত। চতুরকের নিম্নবর্তী উপবিভাগ গ্রাম এবং কখনো কখনো সোজাসুজি পাটক (হেমচন্দ্রের আভিধানিক অর্থে, পাটক গ্রামের একাৰ্ধ) যেমন, বিড়ডােরশাসন—গ্রাম বেতড়ড-চতুরকে অবস্থিত; অন্যত্র অজিকুল-পাটকের অবস্থিতি নবসংগ্ৰহ-চতুরকে। পাটক বর্তমান কালের পাড়া; চতুরক বর্তমানের চৌকি, চক; বোধ হয় চতুরক গোড়ায় ছিল চারিটি গ্রামের সমষ্টি।

এই সব রাষ্ট্রীয়-বিভাগের শাসন-ব্যবস্থা সম্বন্ধে কোনও তথ্যই লিপিগুলিতে পাওয়া যাইতেছে না; স্থানীয় কোনও অধিকরণের উল্লেখও নাই। পাল-পর্বে গ্রামে শাসন-ব্যবস্থার নিয়ামক গ্রামপতির (গ্রামিকের) সাক্ষাৎ পাওয়া গিয়াছিল; এ-পর্বে তাঁহারও দেখা পাওয়া যাইতেছে না। কুটুম্ব প্রভৃতিরা ছিলেন; এ-পর্বে তাহাদের কোনও উল্লেখ নাই। এই তালিকায় পাইতেছি শুধু ব্ৰাহ্মণ, ব্ৰাহ্মণোত্তম এবং ক্ষেত্রকরদের। মেদ, অন্ধ, চণ্ডাল পর্যন্ত যত লোক তঁহাদের উল্লেখও নাই; অর্থাৎ এক কথায়, স্থানীয় জনসাধারণের জন্য রাষ্ট্রের যোগাযোগ একেবারেই অন্তৰ্হিত হইয়া গিয়াছে। অথচ, অন্যদিকে রাষ্ট্রের বহু পাটক পর্যন্ত বিস্তৃত হইয়া জনপদগুলিকে খণ্ড, চতুরক, আবৃত্তি, গ্রাম, পাটক প্রভৃতিতে খণ্ড খণ্ড করিয়া ক্ষুদ্র হইতে ক্ষুদ্রতর ভাগে বিভক্ত করিয়াছে।

পাল-পর্বের রাষ্ট্রযন্ত্র বিভাগের সব কয়টি বিভাগ এই পর্বেও বিদ্যমান। বিচার-বিভাগে একটি নূতন পদোপাধির উল্লেখ পাওয়া যাইতেছে; এই উপাধিটি মহাধৰ্মধ্যক্ষ। দণ্ডনায়ক এই পর্বেও বিদ্যমান, কিন্তু মহাদণ্ডনায়কের উল্লেখ নাই। বোধ হয়, তাহারই স্থান লইয়াছেন মহাধৰ্মধ্যক্ষ। ঈশ্বরঘোষের রামগঞ্জ-লিপিতে অঙ্গিকরণিক নামে এক রাজপুরুষের দেখা পাইতেছি। বিচারকার্য ব্যাপারে যিনি শপথ বা অঙ্গীকার করাইতেন তিনিই বোধ হয় অঙ্গিকরণিক এবং সেই হিসাবে ইনি হয়তো এই বিভাগের অন্যতম কর্মচারী। এই লিপিতেই দণ্ডপাল নামে যে রাজপুরুষের সাক্ষাৎ পাওয়া যায় তিনিও বিচার-কর্মচারী সন্দেহ নাই। রাজস্ব-বিভাগে নূতন যে রাজপুরুষের উল্লেখ পাইতেছি তাহার পদােপাধি মহাভোগিক। মল্লসরুল-লিপিতে ইহার সাক্ষাৎ পাওয়া গিয়াছিল; ইনি ভোগ-কর আদায়-বিভাগের সর্বময় কর্তা। ষষ্ঠাধিকৃত ঔপধিক রাজপুরুষের উল্লেখ এই পর্বে নাই। তরিক-স্তরপতির উল্লেখও এই পর্বে নাই। তবে, হট্টপতি ঔপধিক এক রাজপুরুষের উল্লেখ রামগঞ্জ-লিপিতে আছে; ইনি হাট-বাজারের কর্তা সন্দেহ নাই এবং সেই হিসাবে রাজস্ব-বিভাগের সঙ্গে যুক্ত থাকা অসম্ভব নয়।

ঠিক রাজস্ব-বিভাগ সম্পূক্ত-নয়, তবে হট্টপতির মতনই আর একজন রাজপুরুষের দেখা পাইতেছি। রামগঞ্জ-লিপিতে; তিনি পানীয়াগারিক। বোধ হয় রাজকীয় বিশ্রামগৃহ, ভোজনশালা, পানীয়াগার প্রভৃতির তত্ত্বাবধান করা ছিল ইহার কাজ। এই লিপিরই বাসাগরিক এবং ঔথিতাসনিক পানীয়াগারিক শ্রেণীরই আর দুই জন রাজপুরুষ। প্রথমোক্ত ব্যক্তিটি বোধ হয় রাষ্ট্রের অতিথিশালা বা রাজকীয় বাসগৃহের তত্ত্বাবধায়ক; দ্বিতীয়টি সম্ভবত রাজসভা ও দরবারের আসনসজা-ব্যবস্থাপক। ভোজ্যবর্মার বেলাব-লিপিতে পীঠিকাবিও নামে আর একজন রাজকর্মচারীর সাক্ষাৎ পাওয়া যাইতেছে; ইনিও বোধ হয় রাজকীয় সভা-সমিতি-দরবারের আসনসজার ব্যবস্থা করিতেছেন।

আয়ব্যয়হিসাব বিভাগে মহাক্ষাপটলিক এই পর্কেও বিদ্যমান। জ্যেষ্ঠ-কায়স্থের উল্লেখ এই পর্বে নাই; কিন্তু রামগঞ্জ লিপিতে মহাকায়স্থের উল্লেখ আছে। ইনি এই বিভাগের অন্যতম উর্ধর্বতন কর্মচারী বলিয়াই তো মনে হয়। এই লিপি-উল্লিখিত মহাকরণাধ্যক্ষ এবং লেখক, এবং বহু সেনলিপি-কথিত করণ একান্তভাবে আয়াবায়হিসাব-বিভাগের কর্মচারী হয়তো নহেন। লেখক ও করণ সকল বিভাগেই প্রয়োজন হইত; উচ্চতর রাজপুরুষদের সকলেরই নিজস্ব করণ থাকিতেন। রাষ্ট্রযন্ত্রের সকল করণের সর্বময় কর্তা যিনি তঁহারই পদোপাধি মহাকরণাধ্যক্ষ। পূর্ব-পর্কের ভূমি ও কৃষি-বিভাগের ক্ষেত্রপ বা প্ৰমাতৃ কাহারো সাক্ষাৎ এ পর্বে পাইতেছি না। কর্মকর ঔপধিক এক রাজপুরুষের উল্লেখ রামগঞ্জ-লিপিতে পাইতেছি; ইনি কি শ্রমিক-বিভাগের নিয়ামক কর্তা ছিলেন?

অন্তঃরাষ্ট্র বিভাগের প্রধান ছিলেন মহামন্ত্রী বা মহামহত্তক। তাহদের সহায়ক সচিব ও মন্ত্রী তো অনেকেই ছিলেন। পররাষ্ট্র-বিভাগের প্রধান ছিলেন মহাসান্ধিবিগ্রহিক; তাহার সহায়ক সান্ধিবিগ্রহিক। দূতও এই বিভাগের অস্থায়ী উচ্চ রাজপুরুষ; সান্ধিবিগ্রহিকেরাই সাধারণত দূতের কাজ করিতেন। মন্ত্রপাল বা গূঢ়পুরুষ বর্গের উল্লেখ এই পর্বে দেখিতেছি না।

শান্তিরক্ষা-বিভাগ এই পর্কেও খুব সক্রয়। পূর্ব পর্বের মহাপ্ৰতীহার, চৌরোদ্ধরণিক, দণ্ডপাশিক, চাটভাট প্রভৃতি এই পর্বেও আছেন। অধিকন্তু, রামগঞ্জ-লিপিতে পাইতেছি। দণ্ডপশিক ঔপধিক এক রাজপুরুষের উল্লেখ; ইনিও এই বিভাগের কর্মচারী, সন্দেহ নাই। এই লিপিরই শিরোরক্ষক এবং খড়গগ্রাহ উভয়ই বোধ হয় একশ্রেণীর দেহরক্ষক এবং সেই হিসাবে উভয়েই শান্তিরক্ষা-বিভাগের কর্মচারী; আরোহক অশ্বারোহী-প্রহরী ও দেহরক্ষক ১ ইনিও এই বিভাগের সঙ্গে যুক্ত।

সৈন্য-বিভাগে মহাসেনাপতি এই পর্বেও সর্বময় কর্তা। কোট্টাপালও আছেন; রামগঞ্জ-লিপিতে তাহাকে বলা হইয়াছে কোষ্ট্রপতি। মহাবৃহপতি, নৌবলাধ্যক্ষ, বলাধ্যক্ষ, হস্তী-অশ্ব-গো— মহিষ-অজবিকাধ্যক্ষরাও আছেন। কিন্তু সর্বাপেক্ষ লক্ষণীয় এই যে, এই পর্বে এই বিভাগে অনেক নূতন নূতন পদোপাধির সাক্ষাৎ পাওয়া যাইতেছে; যেমন, মহাপিলুপতি, মহাগণস্থ, মহাবলাধিকরণিক, মহাবলাকোষ্ঠিক এবং বৃদ্ধধানুষ্ক। মহাপিলুপতি হস্তীসৈন্যচালনাশিক্ষক, হস্তীসৈন্যের অধ্যক্ষ। মহাগণস্থাও সামরিক কর্মচারী; ২৭ রথ, ২৭ হস্তী, ৮১ ঘোড়া এবং ১৩৫টি পদাতিক সৈন্য লইয়া এক এক গণ। এই সৈন্য-গণের তিনি সর্বময় কর্তা যিনি মহাগণস্থ। গ্রাম বা নগরসংঘ অর্থে ‘গণ’ শব্দের ব্যবহার আছে সন্দেহ নাই; কিন্তু মহাগণস্থ শব্দে ‘গণ’ উক্ত অর্থে ব্যবহৃত হয় নাই বলিয়াই মনে হইতেছে। মহাবলাধিকরণিক খুব সম্ভব সৈন্যসংক্রান্ত-অধিকরণের প্রধান কর্তা। মহাবলাকোষ্ঠিক এবং বৃদ্ধধানুষ্কের দায় ও কর্তব্য বুঝা যাইতেছে না, তবে ইহারাও যে সামরিক কর্মচারী, সন্দেহ নাই। প্ৰান্তপালের উল্লেখ এই পর্বে নাই; দৃত-প্ৰৈষণিক এবং খোল বিদ্যমান।

পাল ও সেনা-রাজাদের নৌবলের কথা নানাপ্রসঙ্গে একাধিকবার উল্লেখ করিয়াছি। কালিদাসের রঘুবংশ কাব্যে “নৌসাধনোদ্যতান” সামরিক বাঙালীর বর্ণনা আছে। নদীমাতৃক সমুদ্রাশ্রয়ী বাঙালীর রাষ্ট্র নৌবলনির্ভর হইবে, ইহা কিছুই বিচিত্র নয়। নৌবাটি, নৌবিতান, নেদণ্ডক ইত্যাদি শব্দের উল্লেখ বাঙলার লিপিগুলিতে বারবার দেখা যায়। বৈদ্যদেবের কমৌলি-লিপিতে কুমারপালের রাজত্বকালে দক্ষিণবঙ্গে এক নৌযুদ্ধের সুন্দর অথচ সংক্ষিপ্ত কাব্যময় বর্ণনা আছে :

যস্যানুত্তরবঙ্গ-সংগরাজয়ে নৌবাট হীহীরব
ত্রস্তৈর্দ্দিককরিভিশ্চ বন্নচিলিতং চেন্নাস্তি তদগমাভূঃ।
কিঞ্চোৎপাতুক-কেনিপাত-পতন-প্রোত্সপিতৈঃ শীকরৈ-
রাকাশে স্থিরতা কৃতা যদি ভবেৎ স্যান্নিষ্কলঙ্কঃ শশী।

বিজয়সেনও একবার গঙ্গার উপরে এক বিজয়ী নৌযুদ্ধে অবতীর্ণ হইয়াছিলেন। চর্যাগীতির একটি পদে সেকালের নৌকায় নদীপারাপারের খুব সুন্দর বর্ণনা আছে (১৪ নং–ডোম্বীপাদ)। পাল ও সেনারাষ্ট্রের সৈন্যবাহিনীর অশ্ব আসিত কম্বোজ দেশ হইতে, দেবপালের মুঙ্গোর-লিপিতে এই সংবাদ জানা যায়। কিছু অশ্ব বোধ হয় আসিত ভূটান-তিব্বত অঞ্চল হইতেও; মিনহাজ-উদ-দীন বখতি-ইয়ারের তিব্বত অভিযানের যে-বিবরণ দিতেছেন এবং সেই প্রসঙ্গে করমবতনের হাটের যে বর্ণনা পৃইতেছি তাহাতে এই অনুমান একেবারে মিথ্যা বলিয়া মনে হয় না। আর্তিাহরী-পুত্র সর্বানন্দের টীকাসর্বস্ব গ্রন্থে (১১৬০) ঘোড়ার বিভিন্ন রকম দৌড়ের বর্ণনা ও বাঙলাদেশে ব্যবহৃত নামের উল্লেখ পাওয়া যায়। বীরব দৌড় (বিষ্টব্ধা সমা চ গতিঃ), পুলিন দৌড় (ঋজুদূরগমনং), হেডু দৌড় (মণ্ডলিকালয়েন গমনং) এবং মার্জা দৌড় (বেগেন বিক্ষিপ্তেপরিচরণং)। সর্বানন্দ যুদ্ধসংক্রাস্ত আর একটি খবর দিতেছেন-শারদীয়া পূজায় মহানবমীর দিনে রাজ্য ও প্রজারা শাস্তিজল গ্রহণ করিতেন! হস্ট্রিসৈন্যের কথা তো প্রাচ্য ও গঙ্গারাষ্ট্রের বর্ণনা দিতে গিয়া গ্ৰীক ঐতিহাসিক হইতে আরম্ভ করিয়া অনেক ভারতীয় ও বাঙালী কবি ও লেখকরাই বলিয়া গিয়াছেন।

এই পর্যন্ত সেনা-পর্বের রাষ্ট্র-বিন্যাসপ্রসঙ্গে যে-সব রাজপুরুষদের উল্লেখ করিয়াছি তাহারা ছাড়া সমসাময়িক লিপিতে আরও কয়েকটি রাজপদোপাধির সাক্ষাৎ মিলিতেছে। দৌঃসাধনিক-দৌঃসাধ্যসাধনিক-মহাদুঃসাধিক ইহাদের একজন। ইহার দায় ও কর্তব্যের স্বরূপ ঠিক বুঝা যাইতেছে না, তবে কাজটা খুব কঠিন দুঃসাধ্য রকমের ছিল তাহা বুঝা যাইতেছে। মহামুদ্রাধিকৃত আর একজন। রাজকীয় মুদ্রা বা শীলমোহর ইহার কাছে থাকিত; যেসব দলিলপত্রে রাজকীয় শীলমোহর প্রয়োজন হইত। তাহা ইনিই অনুমোদন করিয়া মুদ্রায় মুদ্রিত করিয়া দিতেন। কেহ কেহ মনে করেন, কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রের মুদ্রাধ্যক্ষ এবং মহামুদ্রাধিকৃত একই ব্যক্তি। মহাসর্বাধিকৃতের কর্তব্যের স্বরূপ বুঝা যাইতেছে না। বাকটিক-রাজবংশের লিপিতে সর্বাধ্যক্ষ নামে এক রাজপুরুষের উল্লেখ দেখা যাইতেছে; সর্বাধিকৃত-মহাসর্বাধিকৃত-সর্বাধ্যক্ষ মূলত সকলেরই কর্তব্য বোধ হয় ছিল একই ধরনের। একসরক, মহকটুক, শাস্তকিক, তদানিয়ুক্তক এবং খণ্ডপাল পদোপাধিক কয়েকজন রাজপুরুষের উল্লেখ রামগঞ্জ-লিপিতে দেখা যাইতেছে। প্রথম তিনজনের দায় ও কর্তব্য সম্বন্ধে কোনও ধারণাই আপাতত করা যাইতেছে না। তদানিয়ুক্তক ঔপধিক রাজপুরুষটির সঙ্গে পাল-পর্বের তদায়ুক্তক-বিনিয়ুক্তক রাজপুরুষদের সম্বন্ধ ঘনিষ্ঠ, এমন অনুমান করা যাইতে পারে। খণ্ডপালও পাল-পর্বের খণ্ডরক্ষ একই ব্যক্তি, সন্দেহ নাই!

মোটামুটি ইহাই সেনা-পর্বের রাষ্ট্র-বিন্যাসের পরিচয়। এই রাষ্ট্র-বিন্যাসের প্রকৃতি সম্বন্ধে দুই একটি ইঙ্গিত আগেই করিয়াছি। বর্তমান প্রসঙ্গে এবং যে সাক্ষ্যপ্রমাণ বিদ্যমান তাহার উপর নির্ভর করিয়া আর কিছু বলার প্রয়োজন নাই, উপায়ও নাই।

Share on FacebookShare on TwitterShare on WhatsAppShare on TelegramShare on SMS
Category: ০৯. রাষ্ট্র-বিন্যাস
পূর্ববর্তী:
« ০৬. পাল-পর্ব
পরবর্তী:
০৮. মন্তব্য ও সংযোজন – রাষ্ট্রবিন্যাস »

Reader Interactions

Leave a Reply Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

বাংলা লাইব্রেরি : উল্লেখযোগ্য বিভাগসমূহ

লেখক ও রচনা

অনুবাদ সাহিত্য

সেবা প্রকাশনী

ডিকশনারি

কৌতু্ক / জোকস

লিরিক

রেসিপি

কোরআন

হাদিস

ত্রিপিটক

মহাভারত

রামায়ণ

পুরাণ

গীতা

বাইবেল

বিবিধ রচনা

বাংলা ওসিআর

Download Bangla PDF

হেলথ

লাইব্রেরি – ফেসবুক – PDF

top↑