০৬. পাল-পর্ব

পাল-পর্ব

অষ্টম শতকের মাঝামাঝি পালবংশের প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে বাঙলাদেশের নবযুগের সূচনা দেখা গেল। কিঞ্চিয়ুন চারিশত বৎসর ধরিয়া এই রাজবংশ বাঙলাদেশে প্রতিষ্ঠিত ছিল; এই বংশের প্রভাবশালী রাজারা বাঙলাদেশের বাহিরে কামরূপে এবং উত্তর-ভারতের সুবিস্তৃত দেশাংশ জুড়িয়া সাম্রাজ্য বিস্তার করিয়াছিলেন, অসংখ্য ক্ষুদ্র বৃহৎ সংগ্রামে লিপ্ত হইয়াছিলেন, উত্তর ও দক্ষিণ-ভারতে ধর্ম, শিক্ষা ও সংস্কৃতি ব্যাপারে বাঙলাদেশকে ইহারা আন্তর্ভারতীয় ও আন্তর্জাতিক বৌদ্ধজগতে একটা বিশিষ্ট স্থানে উন্নীত ও মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করিয়াছিলেন। এই সব সুবৃহৎ সুবিস্তৃত প্রচেষ্টার পশ্চাতে যে রাষ্ট্রের সচেতন কর্ম-কল্পনা সক্রয় ছিল সেই রাষ্ট্রের সর্বতোমুখী বিস্তার ও জটিলতা সহজেই অনুমেয়। তাহা ছাড়া, যে রাষ্ট্রযন্ত্র গুপ্ত আমলে প্রবর্তিত হইয়া স্বাধীন বঙ্গরাজাদের, শশাঙ্ক ও অন্যান্য রাজাদের আমলে সুদীর্ঘ কাল ধরিয়া অভ্যস্ত ও আচরিত হইয়াছে, তাহা পালবংশের সুদীর্ঘ কালের সুবিস্তৃত রাজ্য ও সুবিপুল দায়িত্বের ক্রমবর্ধমান প্রসারে আরও প্রসারিত, আরও গভীর মূল, আরও দৃঢ়সংবদ্ধ হইবে, স্পষ্টতর রূপ গ্রহণ করিবে তাহাও কিছু বিচিত্র নয়। রাষ্ট্রযন্ত্রের নূতন কোনও বৈশিষ্ট্য পালরাষ্ট্র বা চন্দ্র-কম্বোজরাষ্ট্রে সূচিত হইয়াছিল এমন নয়, বরং বলা যায় উত্তর-ভারতের সঙ্গে ক্রমবর্ধমান ঘনিষ্ঠতার সূত্রে সমসাময়িক উত্তর-ভারতীয় রাষ্ট্রসমূহের রাষ্ট্র-বিন্যাসগত অনেক অভ্যাস, অনেক বৈশিষ্ট্য এই যুগের আঞ্চলিক রাষ্ট্র আত্মসাৎ করিয়াছিল। সপ্তম শতকে দ্বিতীয় জীবিতগুপ্তের দেওবরণার্ক-লিপি, হর্ষবর্ধনের বাঁশখেরা-লিপি প্রভৃতিতে সমসাময়িক রাষ্ট্র ও রাষ্ট্র-বিন্যাসের যে চিত্র পাওয়া যায়, পালরাষ্ট্রের প্রথম পর্বেও রাষ্ট্র-বিন্যাসের চিত্র মোটামুটি সেই একই।

 

রাজতন্ত্র

পূর্ব পূর্ব যুগের মতো এ যুগে এবং পরবর্তী যুগেও রাষ্ট্র-বিন্যাসের গোড়ার কথা রাজতন্ত্র এবং সে রাজতন্ত্র আরও দৃঢ় প্রতিষ্ঠিত, আরও মহিমা ও মর্যাদাসমন্বিত, আরও কীর্তি ও ঐশ্বৰ্য্যসমৃদ্ধ। অব্যবহিত পূৰ্বযুগের স্বাধীন রাজারা ছিলেন মহারাজাধিরাজ অথবা অধিমহারাজ অথবা নৃপধিরাজ; লোকনাথের পট্টোলীতে রাজাকে পরমেশ্বরও বলা হইয়াছে। এই সমস্ত উপাধি বাঙলাদেশে গুপ্ত রাজারাই প্রচলন করিয়াছিলেন। পাল ও চন্দ্রবংশের রাজারা শুধু মহারাজাধিরাজ মাত্র নন, তাহারা সঙ্গে সঙ্গে পরমেশ্বর এবং পরমভট্টারকেও। গুপ্ত সম্রাটেরাও তো ছিলেন পরমদৈবত-পরমভট্টারক-মহারাজাধিরাজ। সাম্রাজ্য, রাজকীয় মর্যাদা ও রাষ্ট্রীয় প্রভাব বিস্তৃতির সঙ্গে সঙ্গে রাজাদের ঔপধিক আড়ম্বর বাড়িবে, তাহা কিছু আশ্চর্যও নয়! বংশানুক্রমিক রাজবংশের সর্বময় প্ৰভুত্ব, রাজকীয় মহিমা, ঐশ্বৰ্য-বিলাস, পারিবারিক মর্যাদা ইত্যাদি পোল আমলের লিপিগুলিতে যে অজস্র অত্যুক্তিময় পল্লবিত স্তুতিবাদ লাভ করিয়াছে তাহাতে মনে হয়, ভারতের অন্যত্র যেমন বাঙলাদেশেও তেমনই এই যুগে রাজাকে দেবতা ও পরমেশ্বরের নররূপী অবতার এবং পরমগুরু বলিয়া প্ৰতিষ্ঠা করা হইয়াছিল।

রাজার জ্যেষ্ঠপুত্র যুবরাজ নামে আখ্যাত হইতেন এবং প্রাপ্তবয়স্ক হইলেই যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত হইতেন। তাহার দায় ও অধিকার সম্বন্ধে বিশেষ কিছু জানা যায় না। এক যুবরাজ ত্ৰিভুবনপাল ধর্মপালের খালিমপুর লিপির দূতকের কার্য করিয়াছিলেন; আর এক যুবরাজ রাজ্যপাল দেবপালের মুঙ্গের লিপির দূতক ছিলেন। বিগ্ৰহপাল তাহার পুত্র যুবরাজ নারায়ণপালের হস্তে রাজ্যভার অর্পণ করিয়া সিংহাসন ত্যাগ করিয়া বানপ্রস্থে গিয়াছিলেন। রাজার পুত্ৰ কুমার নামে অভিহিত হইতেন এবং তঁহাদের কেহ কেহ উচ্চ রাজকার্যে নিযুক্ত হইতেন, যুদ্ধবিগ্রহেও যোগদান করিতেন। রামপাল তাহার পুত্র রাজ্যপালের সঙ্গে রাজকীয় ও সামরিক ব্যাপারে আলোচনা পরামর্শ করিতেন; পরিণত বয়সে পুত্রের হস্তে রাজ্যভার অর্পণ করিয়া তিনিও বানপ্রস্থে গিয়া আত্মবিসর্জন করেন। রাজারা রাষ্ট্রকার্যে ভ্রাতাদেরও সহায়তা এবং পরামর্শ গ্ৰহণ করিতেন। ধর্মপাল ভ্রাতা বাকপাল এবং দেবপাল কর্তৃক সামরিক ব্যাপারে বহুল উপকৃত হইয়াছিলেন। ভ্রাতা ও রাজপরিবারের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়দের মধ্যে সিংহাসন ও উত্তরাধিকার লইয়া বিবাদ হইত না, এমন নয়; একবার এই ধরনের এক বিবাদ রাষ্ট্রবিপ্লবের অন্যতম কারণ হইয়াছিল। দ্বিতীয় মহীপালের সময়ে কৈবর্ত বিদ্রোহের অন্যতম কারণ বোধ হয় ভ্ৰাতৃবিরোধ এবং মহীপাল কর্তৃক ভ্রাতা রামপাল ও শূরপালের কারাবরোধ। তৃতীয় গোপালের মৃত্যুর মূলে খুল্লতাত মদনপালের দায়িত্ব একেবারে ছিল না, এ কথা জোর করিয়া বলা যায় না। পাল-লিপিমালার রাজপাদাপোজীবীদের তালিকায়ও রাজপুত্রের উল্লেখ আছে। চন্দ্ৰবংশীয় লিপির এই তালিকায় রাজার এবং কম্বোজ বংশের ইর্দা-পট্টোলীতে মহিষীর উল্লেখও দেখিতে পাওয়া যায়। রাজকীয় মহিমা ও মর্যাদার সীমার ভিতরে মহিষীরও একটা স্থান ছিল, সন্দেহ নাই।

 

সামন্ততন্ত্র

পাল আমলে সামন্ততন্ত্র আরও দৃঢ়প্রতিষ্ঠ ও দৃঢ়সংবদ্ধ হয়। সুবিস্তৃত সাম্রাজ্যের ইতস্তত বিক্ষিপ্ত সামন্তদের সংখ্যাও ছিল অনেক। অনুমান করা কঠিন নয়, হঁহাদের অনেকেই বিজিত রাজ্য ও রাষ্ট্রের প্রভু ছিলেন; বিজিত হইবার পর মহাসামন্ত-সামন্তরূপে স্বীকৃত হইয়াছিলেন। মহারাজাধিরাজ সম্রাটের সঙ্গে ইহাদের সম্বন্ধের স্বরূপ নিৰ্ণয় করা কঠিন; তবে, খালিমপুর লিপি পাঠে মনে হয়, পাল সম্রাটেরা সময় সময় মহতী রাজকীয় সভা আহ্বান করিতেন বিশেষ অনুষ্ঠান উপলক্ষে এবং তখন এই সব মহারাজা-মহাসামন্ত হইতে আরম্ভ করিয়া সাধারণ সামন্ত ও মাণ্ডলিক পর্যন্ত সকলেই সেই সভায় উপস্থিত হইয়া মহারাজাধিরাজ সম্রাটকে বিনীত প্ৰণতি জ্ঞাপন করিয়া নিজেদের অধীনতার স্বীকৃতি জানাইতেন। পাল ও চন্দ্র লিপিমালায় রাজপুরুষদের যে ক্ষুদ্র বৃহৎ তালিকার উল্লেখ দেখিতে পাওয়া যায়, তাহাতে রাজন, রাজনক, রাজন্যক, রাণক, সামন্ত, মহাসামন্ত প্রভৃতি ঔপধিক রাজপাদোপজীবীদের সাক্ষাৎ মেলে। ইহারা সকলেই যে নানা স্তরের সামন্ত নরপতি, এ সম্বন্ধে সন্দেহের অবকাশ কম বা ধর্মপালের খালিমপুর-লিপিতে জনৈক মহাসামন্তাধিপতি শ্ৰীনারায়ণবর্মার খবর পাওয়া যাইতেছে; তিনি কোন জনপদের মহাসামন্তাধিপতি তাহা জানা যাইতেছে না। এই লিপিতেই উত্তরাপথের যে সব নরপতিদের কনৌজের রাজদরবারে আসিয়া রাজরাজেশ্বরের সেবার্থ সমবেত হইবার ইঙ্গিত আছে, ভোজ-মৎস্য-মন্দ্র-কুরু- যদু-যবন-অবস্তি-গন্ধাের- কীর-পঞ্চাল প্রভৃতি মিত্র রাজন্যবর্গের যে উল্লেখ আছে তাহারাও এক হিসাবে সামন্তরাজা, সন্দেহ নাই। দ্বিতীয় মহীপালের রাজত্বকালে যাহারা পালরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করিয়াছিলেন তাহারাও ‘অনন্ত সামস্তচক্ৰ’। আবার রামপাল যাহাদের সহায়তায় পিতৃরাজ্য বরেন্দ্রী পুনরুদ্ধার করিয়াছিলেন। তাহাদেরও সন্ধ্যাকর নন্দী রামচরিতে “সামন্ত’ আখ্যায়ই পরিচয় দিয়াছেন, অথচ তাহারা সকলেই স্ব স্ব জনপদে প্রায় স্বাধীন নরপতি। অপর-মন্দারের অধিপতি লক্ষ্মীশূর তো নিজেও ছিলেন সামন্ত এবং “আটবিক সামন্ত-চক্র-চুড়ামণি”। রামপালের মাতুল রাষ্ট্রকূট মহনের দুই পুত্র, মহামাণ্ডলিক কাহ্নরদেব এবং সুবৰ্ণদেবও রামপালের পক্ষে যোগ দিয়েছিলেন। তাহার পর, পালরাষ্ট্রের দুদিনে যাঁহারা বিদ্রোহপরায়ণ হইয়া সেই রাষ্ট্রকে ধ্বংসের পথে আগাইয়া দিয়াছিলেন, তাহারাও সামন্ত। এক বর্মণরাজ রামপালের শরণাগত হইয়াছিলেন এবং ইহা অসম্ভব নয় যে, বর্মণ বংশ সামন্ত-বংশ রূপেই বাঙলাদেশে প্রতিষ্ঠালাভ করেন এবং পরে স্বাধীন রাজবংশের প্রতিষ্ঠা করেন। কামরূপের বিদ্রোহী নরপতি তিঙ্গ্যদেবও পালরাষ্ট্রের সামন্তই ছিলেন।

 

মন্ত্রী

পাল-চন্দ্র পর্বের রাষ্ট্রেই আমরা সর্বপ্রথম একজন প্রধান রাজপুরুষের সাক্ষাৎ পাইতেছি। যাহার পদোপাধি মন্ত্রী বা সচিব এবং যিনি রাজা ও সম্রাটদের সকল কর্মের প্রধান সহায়ক, কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রযন্ত্রের সর্বপ্রধান কর্মচারী। ভট্ট গুরবমিশ্রের বাদল-প্রশস্তিতে দেখা যাইতেছে, একটি সন্ত্রাস্ত, শাস্ত্রবিদ, সমসাময়িক পণ্ডিতকুলাগ্রগণ্য ব্রাহ্মণ পরিবার চারিপুরুষ ধরিয়া পালসম্রাটদের মন্ত্রীত্ব করিয়াছেন। মন্ত্রী গৰ্গ ধর্মপালকে অখিল রাজ্যের স্বামিত্বপদে প্রতিষ্ঠিত করিয়াছিলেন বলিয়া দাবি করা হইয়াছে; তাহার পুত্ৰ দৰ্ভপাণির নীতি কৌশলে দেবপাল হিমালয় হইতে বিন্ধ্য পর্যন্ত সমস্ত ভূভাগ করতলগত করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন। শুধু তাঁহাই নয়, “দেবপাল-উপদেশ গ্রহণের জন্য দৰ্ভপাণির অবসর অপেক্ষায় তাহার দ্বারদেশে দণ্ডায়মান থাকিতেন’ এবং “তিনি আগে সেই মন্ত্রীবরকে আসন প্ৰদান করিয়া স্বয়ং সচকিতভাবেই সিংহাসনে উপবেশন করিতেন।” দর্ভপাণির পুত্ৰ সোমেশ্বর পরমেশ্বর-বল্লভ বা মহারাজাধিরাজের প্রিয়পাত্ৰ বলিয়া আখ্যাত হইয়াছেন। সোমেশ্বরপুত্র কেদারমিশ্রেীর ‘বুদ্ধিবলের উপাসনা করিয়া” দেবপাল উৎকল, গুণ, দ্রাবিড় ও গুর্জরনাথকে পরাজিত করিয়াছিলেন। তাহার যজ্ঞস্থলে শুরপাল নামক নরপাল স্বয়ং উপস্থিত থাকিয়া অনেকবার শ্রদ্ধাসলিলাঞ্ছত হৃদয়ে নতশিরে পবিত্ৰ শান্তিবারিক গ্ৰহণ করিয়াছিলেন। কেদারমিশ্রেীর পুত্ৰ শ্ৰীগুরবমিশ্রকে ‘শ্ৰীনারায়ণপাল যখন মাননীয় মনে করিতেন, তখন আর তাহার অন্য প্রশংসা-বাক্য কী হইতে পারে?” এই সব বর্ণনার মধ্যে অতিশয়োক্তি যথেষ্ট, সন্দেহ নাই; তবে, মন্ত্রীরা সকলেই যে খুব প্রতাপবান ছিলেন, রাজা ও রাষ্ট্রের উপর র্তাহাদের আধিপত্য যে খুব প্রবল ছিল, এ সম্বন্ধেও সন্দেহ করা চলে না। আর একটি ব্ৰাহ্মণ পরিবারও বংশানুক্ৰমে কয়েক পুরুষ ধরিয়া পালরাজাদের মন্ত্রীত্ব করিয়াছিলেন। শাস্ত্রবিদশ্রেষ্ঠ যোগদেব বংশানুক্ৰমে (বংশানুক্রমেণাভুৎ সচিবঃ) তৃতীয় বিগ্রহপালের সচিব নিযুক্ত হইয়াছিলেন; যোগদেবের পর “তত্ত্ববোধভু” বোধিদেব রামপালের সচিব ছিলেন; বোধিদেবের পুত্র কুমারপালের ‘চিত্তানুরূপ সচিব’ হইয়াছিলেন। এই দুইটি বংশানুক্রমিক দৃষ্টান্ত হইতে মনে হয়, বংশানুক্ৰমিক মন্ত্রীত্বপদী পালরাষ্ট্রে প্রচলিত ছিল; সম্ভবত এ ক্ষেত্রেও তাঁহারা গুপ্তবংশীয় প্ৰথাই অনুসরণ করিয়াছিলেন। শুধু মন্ত্রী নিয়োগের ক্ষেত্রেই নয়, অন্যান্য অনেক পদনিয়োগের ক্ষেত্রে পাল, বৰ্মণ ও সেনবংশীয় রাজারা এই বংশানুক্রমিক নিয়োগপ্রথা মানিয়া চলিতেন। গুপ্তরাষ্ট্রের আমলেই এই প্রথা বহুল প্রচলিত হইয়াছিল। আল মাসুদি তো পরিষ্কার বলিয়াছেন, ভারতবর্ষে অনেক রাজকীয় পদই ছিল বংশানুক্রমিক। অন্যান্য দুই একটি লিপিতেও পালরাষ্ট্রের মন্ত্রপদের উল্লেখ আছে, যেমন, প্রথম মহীপালের বাণগড় লিপির দূতক ছিলেন ভট্টবামন মন্ত্রী; তৃতীয় বিগ্রহপালের আমগাছি লিপির দূতকও ছিলেন একজন মন্ত্রী।

প্রধানমন্ত্রী (বানগড় লিপির মহামন্ত্রী দ্রষ্টব্য) বা সচিব ছাড়াও রাজার এবং কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রের কার্যে সহায়তা করিবার জন্য আরও কয়েকজন মন্ত্রী থাকিতেন; ইহাদের কাহারও কাহারও পদোপাধি পাল ও চন্দ্ৰবংশের লিপিগুলিতে উল্লিখিত হইয়াছে, যেমন, মহাসান্ধি-বিগ্রহিক, রাজামাত্য, মহাকুমারামাত্য, দূত বাদূতক, মহাসেনাপতি, মহাপ্ৰতীহার, মহাদণ্ডনায়ক, মহাদেীঃসাধসাধনিক, মহাকর্তকৃতিক, মহাক্ষপটলিক, মহাসর্বাধিকৃত, রাজস্থানীয় এবং অমাত্য। অমাত্য সাধারণভাবে উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারী; রাজপুত্রের পরই রাজামাত্যের উল্লেখ হইতে মনে হয়, মন্ত্রী বা সচিবের পরই ছিল ইহাদের স্থান। কুমারামোত্য সাধারণত বিষয়পতির সমার্থক, বিষয়ের সর্বময় কর্তা; মহাকুমারামাত্য হয়তো বিষয়পতি বা কুমারামোত্যদের সর্বাধ্যক্ষ। দূর কোনও স্থায়ী রাজপদ না-ও হইতে পারে; অস্তুত তিনটি লিপিতে দেখিতেছি, মন্ত্রীরা এবং সান্ধিবিগ্রহিকেরাও দূত নিযুক্ত হইতেছেন। (বাণগড়, আমগাছি ও মনহলি লিপি)। মহাসান্ধিবিগ্রহিক পররাষ্ট্র সম্পৃক্ত যুদ্ধ ও শান্তি ব্যবস্থা বিষয়ক উচ্চতম রাজকর্মচারী। মহাসেনাপতি যুদ্ধবিগ্রহ সম্পর্কিত উচ্চতম রাজপুরুষ। মহাপ্ৰতীহার পদোপাধি রাজপুরুষ ও সামন্ত উভয়েরই দেখা যায় এবং সামরিক ও অসামরিক উভয় বিভাগেই এই পদোপাধি প্রচলিত ছিল। প্ৰতীহার অর্থ দ্বাররক্ষক; রাষ্ট্রের কর্মচারী মহাপ্ৰতীহার বোধ হয় রাজ্যের প্রত্যন্ত সীমারক্ষক ঊর্ধর্বতন রাজকর্মচারী। অথবা, ইহাকে রাজপ্রাসাদের রক্ষাকাবেক্ষক অর্থাৎ শাপ্তিরক্ষা বিভাগের কর্মচারীও বলা যায়! ইহাকে অবশ্য যথাৰ্থত মন্ত্রী বলা চলে না। মহাদণ্ডনায়ক প্রধান ধর্মাধ্যক্ষ বা বিচারক, বিচার-বিভাগের সর্বময় কর্তা। মহাদেীঃসাধসাধানিক ও মহাকর্তাকৃতিকের দায় ও কর্তব্য কী নিশ্চয় করিয়া তাহা বলা যায় না। মহাক্ষপটলিক আয়ব্যয়হিসাব বিভাগের কর্তা। মহাসর্বাধিকৃত কী কাজ করিতেন এবং কোন বিভাগের কর্তা ছিলেন বলা কঠিন; তবে, মধ্যযুগের এবং সাম্প্রতিক কালের সর্বাধিকারী পদবীটি এই রাজপদের স্মৃতি বহন করে। রাজস্থানীয় স্বয়ং রাজাধিরাজ নিযুক্ত উচ্চ রাজকর্মচারী, রাজপ্রতিনিধি। ইহারা সকলেই রাষ্ট্রযন্ত্রে এক একটি প্রধান বিভাগের সর্বময় কর্তা, রাজা এবং রাষ্ট্রের এক এক বিভাগীয় মন্ত্রী বা সাধারণভাবে কোনও কোনও বিশেষ বিশেষ কাজের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী। রাজধানীতে কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রের প্রধান কেন্দ্ৰে বসিয়া সেখান হইতে ইহারা রাষ্ট্রের বিভিন্ন কর্ম-বিভাগের এবং জনপদ-বিভাগের কার্য পরিচালনা করিতেন।

ইহাদের ছাড়া কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রযন্ত্রের আরও কয়েকজন পরিচালক থাকিতেন; তাহাদের উপাধি ছিল অধ্যক্ষ এবং কাজ ছিল রাজকীয় অসামরিক বিভাগের হস্তী, অশ্ব, গর্দভ, খচ্চর, গরু, মহিষ, ভেড়া, ছাগল প্রভৃতি পশুর রক্ষণাবেক্ষণ করা। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্ৰে হন্তী, অশ্ব প্রভৃতির অধ্যাক্ষের উল্লেখ আছে। এই সব অধ্যক্ষদের দায় ও কর্তব্যের বিবৃতি কৌটিল্য। কথিত বিবৃতিরই অনুরূপ ছিল, সন্দেহ নাই! অধ্যক্ষদের মধ্যে নৌকান্ধ্যক্ষ বা নাবাধ্যক্ষ এবং বলাধ্যক্ষ নামীয় দুইজন রাজকর্মচারীও ছিলেন; নৌকাধ্যক্ষ রাজকীয় নৌবাহিনীর এবং বলাধ্যক্ষ রাজকীয় পদাতিক সৈন্যবাহিনীর অধ্যক্ষ।

ধর্ম ও ধর্মানুষ্ঠান সংক্রান্ত ব্যাপারেও রাষ্ট্রযন্ত্রের বাহু ক্রমশ বিস্তৃত হইতেছিল! পাল ও চন্দ্র রাষ্ট্রেও তাহার ব্যতিক্রম হয় নাই। বর্ণ ব্যবস্থা ও লোকচারিত বর্ণ-বিন্যাস বৌদ্ধ পাল নরপতিরাও যে অব্যাহত রাখিতে চেষ্টা করিয়াছিলেন, তাহা অন্যত্ৰ বলিয়াছি। ধর্ম ও ধর্মানুষ্ঠান ব্যাপার সুনিয়ন্ত্রিত করিবার জন্য পাল এবং চন্দ্র রাষ্ট্রযন্ত্রে কয়েকজন উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারী নিযুক্ত হইতেন; সম্ভবত ইহারা কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রযন্ত্রের সঙ্গেই যুক্ত ছিলেন। নরপতিদের ব্যক্তিগত ও বংশগত ধর্ম যাহাই হউক না কেন, পাল ও চন্দ্র রাজারা তাঁহাদের ব্যক্তিগত ধর্মমত দ্বারা রাষ্ট্রকে প্রভাবান্বিত হইতে দেন নাই। তাহা হইলে বংশানুক্রমিকভাবে দুই দুইটি গোড়া ব্রাহ্মণ পরিবার বহুকাল ধরিয়া পালরাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর কাজ করিতে পারিতেন না। তাহারা যে বৌদ্ধ ও ব্রাহ্মণ্য উভয় ধর্মেরই পোষকতা করিতেন এ সম্বন্ধে সুপ্রচুর লিপি প্রমাণ এবং তিব্বতী গ্রন্থের সাক্ষ্য বিদ্যমান। এই যুগে বৌদ্ধ ও ব্রাহ্মণা ধর্মে সামাজিক পার্থক্য বিশেষ কিছু ছিলও না। দেবপাল বীরদেবকে নালন্দা মহাবিহারের প্রধান আচার্য নিযুক্ত করিয়াছিলেন; এই সাক্ষ্য হইতে এবং বিভিন্ন মহাবিহার সংক্রান্ত বিচিত্র ও বিস্তৃত তিব্বতী সাক্ষ্য হইতে মনে হয়, ধর্ম ও শিক্ষা ব্যাপারেও পাল রাষ্ট্রযন্ত্র সক্রয় ছিল। চন্দ্র রাজাদের লিপিতে শান্তিবারিক ঔপধিক এক শ্রেণীর ব্রাহ্মণ-পুরোহিতের উল্লেখ দেখিতে পাওয়া যায়; কিন্তু ইহারা বোধহয় তখনও রাজকর্মচারী হইয়া উঠেন নাই। কম্বোজরাজ জয়পালের ইর্দা-পট্টোলীতেই সর্বপ্রথম ঋত্বিক, ধর্মজ্ঞ ও পুরোহিতের সাক্ষাৎ পাইতেছি। রাজকর্মচারীরূপে।

পাল ও চন্দ্ৰ লিপিমালায় রাজপুরুষদের সুদীর্ঘ তালিকা দেওয়া আছে। এই রাজপুরুষেরা কেন্দ্রীয় এবং প্রাদেশিক রাষ্ট্রযন্ত্রের নানা বিভাগের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, সন্দেহ নাই। কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, কতকটা নিঃসংশয় ভাবে এমন যাঁহাদের কথা বলা চলে তঁহাদের কথা ইতিপূর্বে উল্লেখ করিয়াছি। অন্য আরও অনেকে ছিলেন যাঁহাদের সম্বন্ধে নিশ্চয় করিয়া কিছু বলা যায় না; ইহারা অনেকেই কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রযন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, সন্দেহ নাই; কিন্তু, কেহ। কেহ স্থানীয় রাষ্ট্রযন্ত্রের কর্মচারী ছিলেন, তাহাও সমান নিঃসন্দেহ। ইহাদের সকলের কথা বলিবার আগে পাল ও চন্দ্র রাষ্ট্রের রাষ্ট্ৰীয় জনপদ-বিভাগের কথা বলিয়া লইতে হয়।

 

বিভিন্ন রাষ্ট্র-বিভাগ

পূর্বতন রাষ্ট্রযন্ত্রের যেমন, এই পর্বেও রাষ্ট্রের প্রধান বিভাগের নাম ভুক্তি। বাঙলাদেশে পালরাষ্ট্রের তিনটি ভুক্তি-বিভাগের খবর লিপিমালা হইতে জানা যায়। বৃহত্তম ভুক্তি, পুণ্ড্রবর্ধন-ভুক্তি এবং তাহার পরই বর্ধমান-ভুক্তি ও দণ্ড-ভুক্তি; বর্তমান বিহারে দুইটি, তীর-ভূক্তি (তিরহুত) এবং শ্ৰীনগর-ভুক্তি; বর্তমান আসামে একটি, প্ৰাগজ্যোতিষ-ভুক্তি। ভুক্তির শাসনকর্তার নাম উপরিক। এই উপরিক কখনো কখনো রাজস্থানীয়-উপরিক অর্থাৎ তিনি শুধু ভুক্তির শাসনকর্তা নহেন, রাজপ্রতিনিধিও বটে। পূর্ব পর্বে কোটালিপাড়ার একটি লিপিতে দেখিয়াছি, অন্তরঙ্গ বা রাজবৈদ্য কখনও কখনও ভুক্তির উপরিক নিযুক্ত হইতেন। ঈশ্বরঘোষের রামগঞ্জ লিপিতে ভুক্তির শাসনকর্তকে বলা হইয়াছে ভুক্তিপতি।

ভূক্তির নিম্নতর বিভাগ মণ্ডল না বিষয় তাহা লইয়া পণ্ডিতদের মধ্যে মতবিরোধ দেখা যায়; সাক্ষ্যও পরস্পর বিরোধী। খালিমপুর লিপির মহান্তপ্রকাশ-বিষয় ব্যাস্ত্ৰতটী মণ্ডলভুক্ত; এই লিপিরই আম্রষণ্ডিকা-মণ্ডল (উড়গ্রাম-মণ্ডলের সীমাবতী) পালীঙ্কট-বিষয়ের অন্তর্গত; মুঙ্গের লিপির ক্রিমিল-বিষয় শ্ৰীনগর-ভুক্তির অন্তর্গত; বাণগড় লিপির গোকালকা-মণ্ডল কোটীবৰ্ষ-বিষয়ের অন্তৰ্গত; বাণগড়, মনহলি ও আমগাছি লিপির কোটীবর্ষ-বিষয় পুণ্ড্রবর্ধন-ভুক্তির অন্তর্গত (দ্বিতীয় লিপিটিতে মণ্ডলের উল্লেখই নাই); কমৌলি লিপির কামরূপ-মণ্ডল প্ৰাগজ্যোতিষ-ভুক্তির অন্তৰ্গত, মন্দার গ্রাম বড়া-বিষয়ের অন্তর্গত; মনহলি লিপির হলাবর্ত-মণ্ডল কোটীবর্ষ-বিষয়ের অন্তর্গত; ভাগলপুর লিপির কক্ষ-বিষয় তীর-ভূক্তির অন্তর্গত এবং সেই বিষয়েরই অন্তৰ্গত মুকুতিগ্রাম ইত্যাদি। এই সাক্ষ্যে দেখা যাইতেছে, ভুক্তির নিম্নতর বিভাগ কোথাও মণ্ডল, কোথাও, বিষয়। চন্দ্র রাষ্ট্রে কিন্তু বিষয়ই বৃহত্তর বিভাগ এবং মণ্ডল বিষয়ের অন্তর্গত বলিয়া মনে হইতেছে। শ্ৰীচন্দ্রের রামপাল লিপির নাব্য-মণ্ডল সোজাসুজি পুণ্ড্রবর্ধন-ভুক্তির অন্তর্গত, কিন্তু ঐ রাজারই ধুল্লা-লিপির বল্লীমুণ্ডী-মণ্ডল খেদিরবল্লী-বিষয়ের এবং যোলামণ্ডল ইক্কড়াসী বিষয়ের অন্তর্গত এবং উভয় বিষয়ই পৌণ্ড-ভুক্তির অন্তর্গত। ইদিলপুর লিপিতেও দেখিতেছি, কুমারতািলক-মণ্ডল সতটপদ্মাবতী-বিষয়ের অন্তর্গত। জয়পালের ইর্দা লিপির দণ্ডভুক্তি-মণ্ডল বর্ধমান-ভুক্তির অন্তর্গত। দণ্ডভুক্তি বোধ হয় ভুক্তি-বিভাগই ছিল। কিন্তু কম্বোজবংশের অধিকারের পর মণ্ডল-বিভাগে রূপান্তরিত হইয়াছিল। এই প্রসঙ্গে শশাঙ্কের মেদিনীপুরের একটি লিপিতে দণ্ডভুক্তি-দেশ নামে জনপদের উল্লেখ স্মর্তব্য। মনে হয়, ব্যতিক্রম যাহাই থাকুক, বিষয়ই ছিল। ভুক্তির অব্যবহিত নিম্নবর্তী রাষ্ট্র-বিভাগ, এবং মণ্ডল-বিষয়ের নিম্নবর্তী বিভাগ। বিষয়ের শাসনকর্তার পদোপাধি ছিল বিষয়পতি। গুপ্ত আমলের কোনও কোনও লিপিতে বিষয়ের শাসনকর্তাকে আয়ুক্তক বলা হইয়াছে; অন্য দুই একটি লিপিতে কিন্তু আয়ুক্তক বলিতে ভুক্তি বা বিষয়ের উচ্চ কর্মচারী বলিয়া মনে হয়। পাল আমলের লিপিগুলিতে তদায়ুক্তক এবং ধিনিয়ুক্তক পদোপাধিবিশিষ্ট দুইটি রাজকর্মচারীর খবর পাওয়া যায়। ইহারা বোধ হয় ভুক্তি ও বিষয় শাসন সম্পূক্ত উচ্চ রাজকর্মচারী। মণ্ডলের শাসনকর্তার নাম খুব সম্ভব ছিল মণ্ডলাধিপতি (বা মাণ্ডলিক); নালন্দা লিপিতে আছে, ব্যাঘ্রতটী-মণ্ডলাধিপতি বলবৰ্মণ দেবপালের দক্ষিণহস্ত স্বরূপ ছিলেন। শ্ৰীচন্দ্রের রামপাল-লিপিতেও মণ্ডল-শাসনকর্তার পদোপাধি মণ্ডলপতি।

বাঙলার কোনও পাল লিপিতে কিংবা চন্দ্ৰদের কোনও লিপিতে বীথী-বিভাগের কোনও উল্লেখ নাই, কিন্তু বিহারে প্রাপ্ত অন্তত দুইটি লিপিতে আছে। ধর্মপালের নালন্দা লিপির জম্বুনদী-বীথী ছিল গয়া-বিষয়ের অন্তর্গত। বীথীর শাসনকর্তার পদোপাধি কিছু জানা যাইতেছে না। কম্বোজ-বর্মণ-সেন আমলে বাঙলাদেশে বীথী-রাষ্ট্রবিভাগের সাক্ষাৎ মেলে; পাল-পূর্বযুগেও বীথী-বিভাগের প্রমাণ বিদ্যমান; এই জন্য মনে হয়, পাল এবং চন্দ্র রাষ্ট্রেও বীথী-রাষ্ট্রবিভাগ প্রচলিত ছিল, লিপিগুলিতে উল্লেখ পাইতেছি না মাত্ৰ।

এই সব ভুক্তি, বিষয়, মণ্ডল বা বীথীর অধিকরণ ছিল। কিনা, থাকিলে তাহাদের গঠনই বা কিরূপ ছিল, তাহা জানিবার কোনও উপায়ই লিপিগুলিতে বা অন্যত্র কোথাও নাই। ভূক্তি, বিষয়, মণ্ডল, বীথি প্রভৃতি রাষ্ট্রযন্ত্রের শাসনকার্য কী ভাবে পরিচালিত হইত, পূর্ব যুগের মতো জনসাধারণের কোনো দায় ও অধিকার এ ব্যাপারে ছিল কিনা, তাহাও জানা যাইতেছে না। তবে, খালিমপুর লিপিতে একটু ইঙ্গিত যাহা পাওয়া যাইতেছে তাহা এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যাইতে পারে। এই লিপিতে জ্যেষ্ঠ-কায়স্থ, মহা-মহত্তর, মহত্তর এবং দাশগ্রামিক-ইহাদের বলা ছিলেন। জ্যেষ্ঠ-কায়স্থ, মহা-মহত্তর, মহত্তর তো পূর্ব পর্বেও বিষয়াধিকরণের সঙ্গে যুক্ত থাকিতেন দাশগ্রামিক দশটি গ্রামের কর্তা; পদাধিকারীর উল্লেখ হইতে মনে হয়, বিষয়ের অধীনে দশ দশটি গ্রামের এক একটি উপবিভাগ থাকিত এবং দাশগ্রামিক ছিলেন এক একটি উপরিভাগের শাসনকর্ম-পৰ্যবেক্ষক।

রাষ্ট্রের নিম্নতম বিভাগ এই পর্বে গ্রাম এবং গ্রামের স্থানীয় শাসনকার্যের ভারপ্রাপ্ত কর্মচারীর নাম গ্রামপতি; তিনিও অন্যতম রাজপুরুষ। ভূমি—দানের বিজ্ঞপ্তি-তালিকায় গ্রামের অধিবাসীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ পাইতেছি করণ, প্রতিবাসী, ক্ষেত্রকর, কুটুম্ব, ব্রাহ্মণ ইত্যাদি হইতে আরম্ভ করিয়া মেদ, অন্ধ ও চণ্ডাল পর্যাপ্ত সমস্ত লোকদের। কম্বোজ-রাজ জয়পাল ইর্দা-পট্টোলীতে ইহাদের সঙ্গে স্থানীয় ব্যবহারী (ব্যবসায়ী-ব্যাপারী)দের উল্লেখও পাইতেছি।

ইর্দা-পট্টোলীতে প্রদেষ্ট নামে এক শ্রেণীর রাজপুরুষের উল্লেখ আছে। এই রাজপুরুষটির উল্লেখ বাঙলাদেশের আর কোনও লিপিতেই দেখা যায় না। অথচ কোটিল্যের অর্থশাস্ত্রের মতে ইনি কর-সংগ্ৰহ, শান্তিরক্ষা ইত্যাদি সম্পূক্ত শাসনব্যাপারের নিয়ামক উচ্চ রাজকর্মচারী। ইর্দা-পট্টোলীতে মহিষী, যুবরাজ, মন্ত্রী, পুরোহিত ইত্যাদির সঙ্গে প্রদেষ্টর উল্লেখ হইতে মনে হয়, কম্বোজ রাষ্ট্রেও এই পদাধিকারী উচ্চ রাজকর্মচারী বলিয়া বিবেচিত হইতেন। ইর্দা-পট্টোলীর রাষ্ট্রযন্ত্রী-সংবাদ অন্যদিক হইতেও উল্লেখযোগ্য। এই লিপির রাজপুরুষদের তালিকায় দেখিতেছি, করণসহ অধ্যক্ষবর্গের উল্লেখ্য, সৈনিক-সংঘমুখ্যসহ সেনাপতির উল্লেখ্য, গূঢ়পুরুষ এবং মন্ত্রপালসহ দূতের উল্লেখ { এই সব উল্লেখ হইতে স্পষ্ট বুঝা যায়, কম্বোজ রাষ্ট্রযন্ত্রের বহু বিভাগ বিদ্যমান ছিল এবং প্রত্যেক বিভাগের একজন বলিয়া অধ্যক্ষ থাকিতেন। প্রত্যেক অধ্যাক্ষের অধীনে বহু করণ (=কেরানী, কর্মচারী) থাকিতেন। যুদ্ধবিগ্রহ-বিভাগ ছিল সেনাপতির অধীনে এবং তাহার অধীনে ছিলেন সৈনিক-সংঘের প্রধান কর্মচারীরা। পররাষ্ট্র-বিভাগের কর্তা ছিলেন দূতী; এই বিভাগের বোধ হয় দুই উপবিভাগ। একটি উপবিভাগে মন্ত্রপালেরা আর একটিতে গূঢ়পুরুষেরা। মন্ত্রপালেরা সাধারণভাবে পররাষ্ট্র ব্যাপারে দূতকে মন্ত্রণা দান করিতেন; গূঢ়পুরুষেরা গোপনীয় সংবাদ সরবরাহ করিতেন। এই সব বিভাগীয় বর্ণনা কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রের রাষ্ট্রযন্ত্র বিভাগ বর্ণনার সঙ্গে প্রায় স্পষ্ট মিলিয়া যাইতেছে। পাল লিপিতে নৌকান্ধ্যক্ষ, গো, মহিষ, উষ্ট, অজ, অশ্ব, হস্তী, গৰ্দভ ইত্যাদির অসামরিক অধ্যক্ষদের কথা উল্লেখের আগেই বলিয়াছি! চন্দ্ৰ বংশীয় লিপিতেও কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রের “অধ্যক্ষ-প্রচার’ অধ্যায়ের উল্লেখ দেখিতেছি। বাঙলার সমসাময়িক রাষ্ট্র-বিন্যাসে কৌটিল্য রাষ্ট্রনীতির প্রভাব অনস্বীকার্য। ইহা হইতে এই অনুমানও করা চলে, পাল ও চন্দ্র রাষ্ট্রযন্ত্র কম্বোজ রাষ্ট্রযন্ত্রের মতনই বিভিন্ন বিভাগ ও উপবিভাগে বিভক্ত ছিল। এই দুই রাজবংশের লিপিমালায় যে সব রাজপুরুষদের উল্লেখ পাওয়া যাইতেছে, তাহাতেও এই অনুমান সমর্থিত হয়। সুনির্দিষ্ট ভাবে বলিবার উপায় নাই, তবে, মোটামুটি ভাবে নিম্নলিখিত বিভাগগুলি কতকটা সুস্পষ্ট।

ক. বিচার-বিভাগ।। এই বিভাগের উর্ধর্বতন কর্মচারী মহাদণ্ডনায়ক। বৈদ্যদেবের কমৌলি লিপিতে জনৈক কোবিদ (পণ্ডিত) গোবিন্দকে বলা হইয়াছে ধর্মাধিকার (ধর্মধিকারাপিত)। দেবপালের নালন্দা লিপিটিই উল্লিখিত হইয়াছে ধর্মাধিকার বলিয়া; কী অর্থে এই শব্দটি ব্যবহৃত হইয়াছে, বলা কঠিন। তবে, কমৌলি-লিপি-কথিত গোবিন্দ যে বিচার-বিভাগেরই উচ্চ রাজকর্মচারী, এ সম্বন্ধে সন্দেহের অবকাশ কম। মহাদণ্ডনায়কের পরেই দণ্ডনায়ক। দাশাপরাধিকও এই বিভাগের কর্মচারী বলিয়া মনে হইতেছে; স্মৃতিশাস্ত্ৰ কথিত দশ প্রকার অপরাধের বিচার ইনি করিতেন এবং অপরাধ প্রমাণিত হইলে অর্থদণ্ড আদায় করিতেন।

খ, রাজস্ব-বিভাগ।। আয়বিভাগের সর্বাধ্যক্ষ কে ছিলেন বলা কঠিন; কোনও পদোপাধিতে তাহার পরিচয় পাওয়া যাইতেছে না। রাষ্ট্রের অর্থাগমের নানা উপায় ছিল। প্রথম এবং প্রধান উপায় কর। কার ছিল নানা প্রকারের; প্রধানত পাঁচ প্রকার কারের উল্লেখ লিপিগুলিতে পাওয়া যায়- ভাগ, ভোগ, কর, হিরণ্য এবং উপরিকর। অন্যত্র এই সব করের উল্লেখ ও ব্যাখ্যা করিয়াছি। উপরিক, বিষয়পতি, মণ্ডলপতি, দাশগ্রামিক এবং গ্রামপতির রাষ্ট্রযন্ত্রের সাহায্যে এই সব কর আদায় করা হইত। ভোগ-কর আদায়-বিভাগের যিনি সর্বময় কর্তা ছিলেন তাহার পদোপাধি ছিল ভোগপতি। পূর্ব পর্বের মল্লসরুল লিপিতে মহাভোগিক নামে এক রাজপুরুষের উল্লেখ আমরা দেখিয়াছি; তিনি ভোগ-কর আদায়-বিভাগের উচ্চতম কর্তা, সন্দেহ নাই। ষষ্ঠাধিকৃত নামে একটি রাজপুরুষের উল্লেখ পাল লিপিতে দেখা যায়। রাজা ছিলেন ষষ্ঠাধিকারী অর্থাৎ প্রজার শস্যের বা শস্যলব্ধ আয়ের একষষ্ঠ অংশের প্রাপক। এই একষষ্ঠ অংশ আদায়-বিভাগের যিনি কর্তা তিনিই ষষ্ঠাধিকৃত। খেয়া পারাপার ঘাট হইতে রাষ্ট্রের একটি আয় হইত; এই আয়-সংগ্রহের যিনি কর্তা তিনি তরিক। দেবপালের লিপিতে তরিক ও তারপতি দুয়েরই উল্লেখ আছে। তারপতি বা তারপতিক বোধ হয় পারাপার ঘাটের পর্যবেক্ষক। ব্যাবসা-বাণিজ্য সম্পৃক্ত শুল্ক আদায়-বিভাগের কর্তার পদোপাধি ছিল শৌস্কিক। দশ প্রকার অপরাধের বিচার ও অর্থদণ্ড আদায়-বিভাগের কর্তা হইতেছেন দাশাপরাধিক। চোর-ডাকাতদের হাত হইতে প্রজাদের রক্ষার দায়িত্ব ছিল রাষ্ট্রের; সেই জন্য রাষ্ট্র প্রজাদের নিকট হইতে একটা করা আদায় করিতেন। যে বিভাগের উপর এই কর আদায়ের ভার তাহার কর্তার পদোপাধি চৌরোদ্ধরণিক। কৌটিল্যের মতে বনজঙ্গল ছিল রাষ্ট্রের সম্পত্তি; সুতরাং আয়ের এই অন্যতম উপায় যে বিভাগ হইতে সংগৃহীত হইত। সেই বিভাগীয় কর্তার নাম গৌলিক। অথবা, গৌলিক সৈন্যর্ঘাটিতে বা শান্তি-রক্ষকদের ঘাটিতে দেয় শুষ্ক-কর আদায়-বিভাগের কর্তাও হইতে পারেন। পিণ্ডক নামেও এক প্রকার করের উল্লেখ অন্তত একটি পাল লিপিতে দেখা যায় (খালিমপুর-লিপি)।

গ, আয়ব্যয়-হিসাব-বিভাগ।। এই বিভাগের সর্বময় কর্তা বোধ হয় ছিলেন মহাক্ষপটলিক। জ্যেষ্ঠ-কায়স্থ বোধ হয় একজন উচ্চ রাজকর্মচারী। এই পর্বে পুস্তপালের উল্লেখ দেখিতেছি। না। রাজকীয় দলিলপত্ৰ বোধ হয় জ্যেষ্ঠ-কায়ন্থের তত্ত্বাবধানেই থাকিত। ভূমি-সম্পূক্ত দলিলপত্ৰ থাকিত কৃষি-বিভাগের দপ্তরে।

ঘ- ভূমি ও কৃষি-বিভাগ ৷ এই বিভাগের কয়েকজন কর্মচারীর নাম লিপিগুলিতে পাওয়া যায়। ক্ষেত্রপ ছিলেন কৃষ্ট ও কৃষিযোগ্য ভূমির সর্বোচ্চ হিসাবরক্ষক ও পর্যবেক্ষক। প্রমাতৃ ভূমির মাপজোখ, ভূমি জরিপ ইত্যাদির বিভাগীয় কর্তা। কেহ কেহ অবশ্য মনে করেন, প্ৰমাতৃ বিচার-বিভাগীয় কর্মচারী; তিনি বিচারকার্যে সাক্ষ্য লিপিবদ্ধ করিতেন। পাল ও সেন লিপিগুলিতে, বিশেষভাবে সেন লিপিগুলিতে, ভূমির মাপ ও সীমা নির্ধারণে, আয়োৎপত্তি নির্ধারণে যে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম হিসাবের উল্লেখ আছে, তাহাতে এ তথ্য অনস্বীকার্য যে, ভূমি মাপজোখ-জরিপ সংক্রান্ত একটি সুবিস্তৃত ও সুপরিচালিত বিভাগ বর্তমান ছিল। গুপ্ত আমলের পুস্তপাল-বিভাগ হইতেও এই অনুমান কতকটা করা চলে।

ঙ• পররাষ্ট্র-বিভাগ ।৷ এই বিভাগের আভাসোল্লেখ কম্বোজরাজ নয়পালের ইর্দা লিপিতে পাওয়া যায় এবং তাহার ব্যাখ্যা আগেই করা হইয়াছে। এই বিভাগের উর্ধর্বতম। কর্মচারী ছিলেন

দূত; তাহার অধীনে মন্ত্রপাল ও গূঢ়পুরুষবর্গ। সর্বোচ্চ ভারপ্রাপ্ত রাজপুরুষ বোধ হয় ছিলেন মহাসান্ধিবিগ্রহিক।

চ. শান্তিরক্ষা-বিভাগ। ৷ এই বিভাগের অনেক রাজপুরুষের উল্লেখ লিপিগুলিতে পাওয়া যাইতেছে। মহাপ্ৰতীহার সম্ভবত রাজপ্রাসাদের এবং রাজধানীর রক্ষাকাবেক্ষক। দাণ্ডিক, দাণ্ডপশিক (দণ্ড এবং পাশ-রজু), দণ্ডশক্তি, সকলেই এই বিভাগের কর্মচারী। খোল খুব সম্ভব এই বিভাগের গুপ্তচর (খোল শব্দের আভিধানিক অর্থ খোড়া; অর্ধমাগধী অভিধান মতে গুপ্তচর)। কাহারো কাহারো মতে চৌরোদ্ধারণিকও এই বিভাগেরই উচ্চ কর্মচারী। অঙ্গরক্ষ (দেহরক্ষক)কেও এই বিভাগের কর্মচারী বলা যাইতে পারে। চট্টভট্ট বা চাটভাটরাও এই

ছ. সৈন্য-বিভাগ ৷। এই বিভাগের ঊর্ধর্বতম রাজপুরুষের পদোপাধি মহাসেনাপতি এবং তাঁহার নীচেই সেনাপতি। হস্তী, অশ্ব, রথ ও পদাতিক এই চতুরঙ্গ বলা ছাড়া পাল রাষ্ট্রের বোধ হয় নৌবলও ছিল এবং এই পাঁচটি বলের প্রত্যেকটির একজন ভারপ্রাপ্ত ব্যাপৃতক বা অধ্যক্ষ থাকিতেন। পদাতিক সেনার কর্তা বলাধ্যক্ষ; নৌবলের কর্তা নৌকাধ্যক্ষ বা নাবাধ্যক্ষ। উষ্ট্রবলও ছিল এবং তাহারও একজন ব্যাপৃতক ছিলেন। সৈন্যবাহিনীতে বোধ হয়। ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রদেশের লোকেরাও যোগদান করিতেন। গৌড়-সৈন্যেরা তো ছিলেনই; তাহা ছাড়া লিপিগুলিতে মালব-খস-তুণ-কৃলিক-কর্ণাট-লাট-চোড় প্রভৃতি যে-সব ভিনদেশি কোমের লোকদের উল্লেখ আছে তাহারা যে রাষ্ট্রের সৈন্যবাহিনীর বেতনভুক সেনা, এ সম্বন্ধে সন্দেহের অবকাশ কম। কোট্টাপাল দুৰ্গাধিকারী-দুৰ্গরক্ষক; প্রান্তপাল রাজ্যসীমা রক্ষক; মহাবৃহপতি যুদ্ধকালে বৃহ-রচনার কর্তা। ইহাদের সকলেরই সাক্ষাৎ মিলিতেছে এবং ইহারা সকলেই যে সৈন্য-বিভাগের উচ্চ রাজকর্মচারী এ সম্বন্ধে সন্দেহ নাই।

 

এ পর্যন্ত যে সব রাজপুরুষদের উল্লেখ করা হইয়াছে তাহারা ছাড়া পাল, চন্দ্র ও কম্বোজবংশীয় লিপিগুলিতে আরও কয়েকজন রাজপুরুষের পদোপাধির পরিচয় পাওয়া যায়; যেমন অভিত্বরমান, গমাগামিক দৃত-প্ৰৈষণিক, খণ্ডরক্ষ, স(শ)রভঙ্গ, ইত্যাদি। বুৎপত্তিগত অর্থে অভিত্বরমান যে দ্রুত যাতায়াত করে; গামাগামিক অর্থও যাতায়াতকারী। ইহারা উভয়েই যে এক শ্রেণীর সংবাদবাহী বা রাজকীয় দলিলপত্রবাহী দূত এই অনুমান মিথ্যা না-ও হইতে পারে। শান্তিরক্ষণ, পররাষ্ট্র অথবা সৈন্য বিভাগের সঙ্গে হয়তো ইহারা যুক্ত ছিলেন অথবা সাধারণ রাষ্ট্রকর্মেও হয়তো ইহাদের প্রয়োজন হইত। তবে, খুব সম্ভব ইহারা উচ্চশ্রেণীর রাজকর্মচারী ছিলেন না। দূত-প্রেষণিক দুইটি পৃথক শব্দ হইতে পারে, আবার এক শব্দও হইতে পারে। প্ৰৈষণিক অর্থ যিনি প্রেরণ করেন; দূত-প্রেষণিক অর্থ যিনি দূত প্রেরণ করেন অথবা দূতের সংবাদবাহী। ইনি যিনিই ইউন, কেন্দ্রীয় রাষ্ট্র বা পররাষ্ট্র বিভাগের সঙ্গেই ইহার যোগ। খণ্ডরক্ষ অর্ধমাগধী অভিধান মতে শান্তিরক্ষা-বিভাগের অধ্যক্ষ বা শুল্ক্যু-পরীক্ষক; কাহারো কাহারো মতে ইনি সৈন্য-বিভাগের কর্মচারী। আবার, কেহ কেহ মনে করেন, ইনি পূর্তি-বিভাগের কর্মচারী, সংস্কারকার্যাদির পরীক্ষক (খণ্ড-ফুট্ট-সংস্কার)। পরবর্তী পর্বের ঈশ্বরঘোষের রামগঞ্জ লিপিতে খণ্ডপাল নামে এক রাজপুরুষের উল্লেখ আছে; খণ্ডপাল ও খণ্ডরক্ষক সমর্থক বলিয়াই তো মনে হইতেছে। স(শ)রভঙ্গ বলিতে কোনও কোনও পণ্ডিত মনে করেন, তীরধনুকধারী সৈন্যবর্গের অধ্যক্ষ; আবার কেহ কেহ বলেন শরভঙ্গ ছিলেন রাজার মৃগয়ার সঙ্গী, যিনি রাজার তীরন্ধনু ইত্যাদি রক্ষণাবেক্ষণ করিতেন। ইহারা কেহই উচ্চ রাজকর্মচারী নহেন, এমন অনুমান কতকটা করা যায়।

পাল ও সমসাময়িক অন্যান্য রাষ্ট্রযন্ত্রের যে সংক্ষিপ্ত কাঠামোর মোটামুটি পরিচয় দেওয়া হইল তাহা হইতেই বুঝা যাইবে, এই যুগে রাষ্ট্রের আমলাতন্ত্র পূর্ব পূর্বাপেক্ষা অনেক বেশি বিস্তার ও স্ফীতি লাভ করিয়াছে। স্বাধীন স্বতন্ত্র রাষ্ট্রের সচেতন মর্যাদা ও প্রয়োজনবোধে এই বিস্তার ও স্ফীতি ব্যাখ্যা করা যায়; তাহা ছাড়া, পাল-পর্বে যে সুবিস্তৃত সাম্রাজ্য গড়িয়া উঠিয়াছিল তাহার প্রয়োজনেও কোনও কোনও বিভাগের আমলাতন্ত্রের বিস্তৃতির প্রয়োজন হইয়াছিল, সন্দেহ নাই। কিন্তু আমলাতন্ত্রের বিস্তৃতি, রাষ্ট্রযন্ত্রের স্ফীতি ও সূক্ষ্মতর বিভাগ সৃষ্টির অর্থই হইতেছে, রাষ্ট্রের বাহু সমাজের সর্বদেহে বিস্তুত করা। পাল-পর্বে তাহারই সূচনা দেখা দিয়াছে এবং সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রযন্ত্রের পরিচালনায় জনসাধারণের প্রতিনিধিদের দায় ও অধিকার খবীকৃত হইয়াছে। গ্রাম্য স্থানীয় শাসনকার্য ছাড়া আর যে কোথাও এই সব প্রতিনিধিদের কোনও প্রভাব ছিল, মনে হইতেছে না। বিষয়-শাসনের ব্যাপারে জ্যেষ্ঠ-কায়স্থ, মহা-মহত্তর, মহত্তর এবং দাশগ্রামিক প্রভৃতি বিষয়-ব্যবহারীর উল্লেখ পাইতেছি, সন্দেহ নাই; কিন্তু ইহাদের মধ্যে জ্যেষ্ঠ-কায়স্থ ও দাশগ্রামিক উভয়েই রাজপুরুষ। পূর্ব পর্বে যে ভাবে স্থানীয় রাষ্ট্রযন্ত্রের সঙ্গে স্থানীয় জন-প্রতিনিধিদের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ লক্ষ্য করা যায়, এ পর্বে তাহা নাই বলিলেই চলে। বস্তুত, সমাজ-বিন্যাসের বৃহৎ একটা অংশের দায়িত্ব ও অধিকার এই পর্বে রাষ্ট্রের কুক্ষিগত হইয়া পড়িয়াছে। আমলাতন্ত্রের বাহু-বিস্তৃতিই তাহার কারণ; জনসাধারণও সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রযন্ত্রের সঙ্গে সম্বন্ধ বিচ্যুত হইয়া পড়িতে আরম্ভ করিয়াছে। গ্রামবাসী মহত্তর, ব্ৰাহ্মণ, কুটুম্ব, ক্ষেত্রকর, মেদ, অন্ধ, চণ্ডাল পর্যন্ত ভূমিদানের বিজ্ঞপ্তি প্রাপ্তিতেই ইহাদের রাষ্ট্ৰীয় অধিকারের পরিসমাপ্তি; আর কোনও অধিকারের উল্লেখ নাই।