০৫. গুপ্তোত্তর যুগ। আনুমানিক ৫০০-৭৫০ খ্ৰীষ্টীয় শতক

গুপ্তোত্তর যুগ। আনুমানিক ৫০০-৭৫০ খ্ৰীষ্টীয় শতক

ষষ্ঠ শতকে বঙ্গ স্বাধীন স্বতন্ত্র রাষ্ট্ররূপে আত্মপ্রতিষ্ঠিত হয় এবং সঙ্গে সঙ্গে নিজস্ব রাষ্ট্রযন্ত্রও গড়িয়া তোলে। তখন উত্তর ও পশ্চিমবঙ্গে গুপ্ত-বংশের আধিপত্য বিলীয়মান; ছোটখাট বংশধরেরা কোনো প্রকারে তঁহাদের স্থানীয় আধিপত্য বজায় রাখিতেছেন মাত্র। স্বাধীন স্বতন্ত্র রাজবংশ প্রতিষ্ঠিত হইবার সঙ্গে সঙ্গে বঙ্গে (অর্থাৎ পূর্ববঙ্গে) নূতন রাষ্ট্রযন্ত্রেরও পত্তন হইল; কিন্তু সে-রাষ্ট্র-বিন্যাস গুপ্ত—আমলের প্রাদেশিক রাষ্ট্ররূপের আদৰ্শই স্বীকার করিয়া লইল। বস্তুত, বঙ্গের স্বাধীন রাজাদের রাষ্ট্রযন্ত্র গুপ্ত-রাষ্ট্রযন্ত্রের অনুকরণ বলিলেই চলে। রাষ্ট্রবিভাগ, শাসন-পদ্ধতি, রাজপাদোপজীবীদের উপাধি, দায় ও অধিকার, শাসনক্রম, ইত্যাদি সমস্তই একপ্রকার। কাজেই এ-পর্বে নূতন কথা বলিবার বিশেষ কিছু নাই।

রাষ্ট্রযন্ত্রের চূড়ায় বসিয়া আছেন মহারাজাধিরাজ স্বয়ং, তবে এই মহারাজাধিরাজ স্বাধীন স্বতন্ত্র হইলেও স্থানীয় নরপতি মাত্র। ফরিদপুরে কোটালিপাড়ায় প্রাপ্ত পট্টোলীগুলিতে যে কয়জন নরপতির উল্লেখ পাইতেছি। তাহারা সকলেই ঐ উপাধিটি ব্যবহার করিতেছেন। যে-ক্ষেত্রে মহারাজাধিরাজের উল্লেখ নাই, সে-ক্ষেত্রে তিনি শুধু ভট্টারক বলিয়া উল্লিখিত হইয়াছেন। বপ্লঘোষবাট-লিপিতে জয়নাগ এবং শশাঙ্কের একাধিক লিপিতে গৌড়-কর্ণসুবর্ণরাজ শশাঙ্কও মহারাজাধিরাজ উপাধিতেই আখ্যাত হইয়াছেন। খড়গ বংশের প্রতিষ্ঠাতা খড়েগাদ্যম নৃপধিরাজ এবং ত্রিপুরার লোকনাথ-পট্টোলীর সামন্ত শিবনাথের পিতা, লোকনাথের বংশের প্রতিষ্ঠাতা, অধিমহারাজা আখ্যায় পরিচিত হইয়াছেন। ইহারা সকলেই স্বাধীন নরপতি সন্দেহ নাই এবং সেই হিসাবেই মহারাজাধিরাজ, নৃপধিরাজ, অধিমহারাজ প্রভৃতি উপাধি ব্যবহৃত হইয়াছে। বঙ্গ মহারাজাধিরাজদের অধীনে, শশাঙ্কের অধীনে এবং জয়নাগের অধীনে সামন্ত নরপতির অস্তিত্ব ইহার অন্যতম প্ৰধান।

 

সামন্ততন্ত্র

গুপ্ত-আমলেই দেখিয়াছি, এই রাজতন্ত্র ছিল সামন্ততন্ত্র-নির্ভর। এই আমলেও দেখিতেছি তাহার ব্যতিক্রম নাই বরং সামন্ততন্ত্রের প্রসােরই দেখা যাইতেছে। সমাজের ভূমিনির্ভরতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এইরূপ হওয়া কিছু বিচিত্র নয়। গোপচন্দ্রের মল্লসরুল-লিপি-কথিত দূতক মহারাজ মহাসামন্ত বিজয়সেনের কথা আগেই বলিয়াছি; অনুমান হয়, ইনি আগে মহারাজাধিরাজ বৈন্যগুপ্তের মহাসামন্ত ছিলেন, তারপর বর্ধমান-ভুক্তি গোপচন্দ্রের করায়ত্ত হইলে তিনি গোপচন্দ্রের মহাসামন্ত হন। বপ্লঘোষবাট-লিপিতে দেখিতেছি, সামন্ত নারায়ণভদ্র ঔদুম্বরিক বিষয়ে মহারাজাধিরাজ জয়নাগের সামন্ত ছিলেন। লোকনাথ-পট্টোলী-কথিত ব্ৰাহ্মণ প্রদোষশৰ্মা মহারাজ লোকনাথের মহাসামন্ত ছিলেন। আস্রফপুর-লিপিতে জনৈক সামন্ত বনটিয়োকের সাক্ষাৎ পাইতেছি। শশাঙ্ক তো তাহার রাষ্ট্ৰীয় জীবন আরম্ভই করিয়াছিলেন মহাসামন্তরূপে; তারপর যখন তিনি স্বাধীন পরাক্রান্ত নরপতিরূপে প্রতিষ্ঠিত হন, তখন তাহার নিজেরও মহাসামন্ত ছিল। বিজিত রাজ্যের রাজারাই বিজেতা মহারাজাধিরাজগণ কর্তৃক মহাসামন্ত রূপে স্বীকৃত হইতেন, এইরূপ অনুমান অসঙ্গত নয়। শৈলোদ্ভববংশীয় কঙ্গোদাধিপতি দ্বিতীয় মাধবরাজ এবং দণ্ডভুক্তির শাসনকর্তা সোমদও এই দুইজনই যথাক্রমে শশাঙ্কের মহারাজা-মহাসামন্ত এবং সামন্ত-মহারাজ ছিলেন। সামন্তরা সকলে যে একই পর্যায় ও মর্যাদাভুক্ত ছিলেন না, তাহা তঁহাদের উপাধি হইতেই সুপ্রমাণিত। কেহ ছিলেন মহাসামন্ত-মহারাজ, কেহ মহাসামন্ত, কেহ বা শুধু সামন্ত। ভূম্যধিপত্যের বিস্তৃতি, রাষ্ট্রীয় পদমর্যাদা ও অধিকার, রাজসভায় ব্যক্তিগত প্রতিপত্তি প্রভৃতির উপর এই স্তরবিভাগ নির্ভর করিত, সন্দেহ নাই।

 

ভুক্তি

বঙ্গরাষ্ট্রের বৃহত্তম রাষ্ট্রবিভাগের নাম এই পর্বে কী ছিল নিশ্চয় করিয়া বলা যায় না। বর্ধমান-ভুক্তি (মল্লসরুল-লিপি) ও নব্যাবকাশিকা (ফরিদপুর-লিপি), এই দুইটি যে বৃহত্তম বিভাগ সমূহের দুইটি বিভাগ, এ-সম্বন্ধে সন্দেহ নাই। বর্ধমান-ভুক্তির উল্লেখ হইতে মনে হয়, নব্যাবকাশিকাও ভুক্তি-পর্যায়েরই রাষ্ট্রবিভাগ। ফরিদপুর-লিপি-কথিত সর্বোচ্চ শাসনকর্তা উপরিক নাগদেব, উপরিক জীবদত্ত প্রভৃতির উপাধি হইতে প্রায় নিঃসংশয়ে অনুমান করা চলে যে, নব্যাবকাশিকা ভুক্তি বলিয়া উল্লখিত না হইলেও ইহার বিভাগীয় রাষ্ট্রমর্যাদা ভুক্তি-পর্যায়ের। ভুক্তির শাসনকর্তারা এ-ক্ষেত্রেও উপরিক উপাধিতেই আখ্যাত হইতেছেন, যদিও স্থানুদত্তকে উপরিক বলা হয় নাই, শুধু মহারাজ বলা হইয়াছে। নাগদেব শুধু উপরিক নহেন, মহাপ্ৰতীহারও বটে; জীবদত্ত উপরিক এবং অন্তরঙ্গ। অন্তরঙ্গ রাজার নিজস্ব চিকিৎসক, রাজবৈদ্য। চক্রদত্তের এক টীকাকার শিবদাস সেনের পিতা অনন্তসেন বরবক শাহের অন্তরঙ্গ ছিলেন; শ্ৰীচৈতন্যের পার্ষদবর্গের অন্যতম শ্ৰীখণ্ডবাসী মুকুন্দ সরকার ছিলেন হোসেন শাহের অন্তরঙ্গ। মনে হয়, উপরিক জীবদত্ত মহারাজাধিরাজ সমাচার দেবের রাজবৈদ্যও ছিলেন। ইহারা নিযুক্ত হইতেন স্বয়ং মহারাজাধিরাজ কর্তৃক (তদনুমোদনলব্ধাস্পদস্য, তৎপ্রসাদলব্ধাস্পদে, চরণকমলযুগলারাধনোপাত্ত, ইত্যাদি পদ দ্রষ্টব্য)। শশাঙ্কের সময় দণ্ডভুক্তি বা দণ্ডভুক্তিদেশও বোধ হয় ছিল একটি ভুক্তি-বিভাগ এবং তাহার শাসনকর্তার পদোপাধি ছিল উপরিক। সোমদত্ত ছিলেন উপরিক এবং সামন্ত-মহারাজ; শুভকীর্তি ছিলেন উপরিক এবং মহাপ্ৰতীহার।

গুপ্তরাষ্ট্রে যেমন, বঙ্গরাষ্ট্রে এবং শশাঙ্কের গৌড়রাষ্ট্ৰেও তেমনই ভুক্তি-অধিষ্ঠানের একটি অধিকরণ নিশ্চয়ই ছিল। ফরিদপুরের পট্টোলীগুলিতে এই অধিকরণের উল্লেখ পাইতেছি না; কারণ, উল্লেখের প্রয়োজন হয় নাই। কিন্তু শশাঙ্কের মেদিনীপুর-লিপি দুইটিতে যে তাবীর-অধিকরণের উল্লেখ আছে এবং যে অধিকরণ হইতে শাসন দুইটি নির্গত হইয়াছিল। সেই অধিকরণটি তো ভুক্তির অধিকরণ বলিয়াই মনে হইতেছে।

 

বিষয়

ভুক্তির নিম্নবর্তী রাষ্ট্রবিভাগ বিষয়ের খবর এই পর্বেও পাওয়া যাইতেছে। বঙ্গের নব্যাককাশিকা (-ভুক্তির?) প্রধান একটি বিষয় ছিল বারকমণ্ডল বিষয়। বারকমণ্ডলের মণ্ডল এখানেও কোনও রাষ্ট্রবিভাগ বলিয়া মনে হইতেছে না; বিষয়টিরই নাম বারকমণ্ডল। বিষয়ের বিষয়পতি কখনও মহারাজাধিরাজ স্বয়ং নিযুক্ত করিতেন, যেমন, বিপ্লঘোষবাট-লিপিতে ঔদুম্বরিক বিষয়ের বিষয়পতিকে বলা হইয়াছে “তৎপাদানুধ্যাত সামন্ত নারায়ণভদ্র বিষয়সম্ভোগকালে”, কিন্তু সাধারণত উপরিকেরাই বিষয়পতি নিযুক্ত করিতেন, যেমন, বারকমণ্ডল বিষয়ে। বিষয়পতি জজাবকে নিযুক্ত করিয়াছিলেন (উপরিক)-মহারাজ স্থাণুদত্ত; গোপালস্বামী এবং বৎসপালকে নিযুক্ত করিয়াছিলেন উপরিক জীবদত্ত। ত্রিপুরার লোকনাথ-পট্টোলীতেও এক সুকবুঙ্গ বিষয়ের উল্লেখ পাইতেছি।

বিষয়পতিদের অধিকরণের খবর ফরিদপুর-পট্টোলীগুলিতে তো আছেই। লোকনাথের ত্রিপুরা-পট্টোলীতেও “বিষয়াপতীন সাধিকরণানীদের উল্লেখ দেখা যায়। শেষোক্ত লিপিটিতে দেখিতেছি, বিষয়পতি ও তাহার অধিকরণ স্থানীয় শাসনকার্য নির্বাহ করিতেন “সপ্রধান-ব্যবহারি-জনপাদান’দের সাহায্যে। ফরিদপুর-কেটালিপাড়ার লিপিগুলিতে যে অধিকরণের উল্লেখ দেখিতেছি, তাহার গঠন ঠিক গুপ্ত—আমলের পুণ্ড্রবর্ধন-ভুক্তির বিষয়াধিকরণের মতন নয়। ধর্মাদিত্যের দ্বিতীয় পট্টোলীতে বিষয়পতি এবং বিষয়াধিকরণ ছাড়া আরও ষোলো-সতেরো জন বিষয়-মহত্তর, ব্যাপারী-ব্যবসায়ী এবং অনুল্লিখিত-সংখ্যক প্রকৃতিপুঞ্জের খবর পাওয়া যাইতেছে। স্পষ্টতই দেখা যাইতেছে, কোটীবর্ষের বিষয়াধিকরণে নগরশ্ৰেষ্ঠী, প্রথম কুলিক, প্রথম সার্থিবাহের যে স্থান, এখানে তাঁহাদের সেই স্থান নাই; বিষয়-মহত্তরেরাও বারকমণ্ডল বিষয়াধিকরণের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ নহেন বলিয়াই মনে হইতেছে। এতগুলি বিষয়-মহত্তর, ব্যাপারী-ব্যবহারী এবং প্রকৃতিপুঞ্জ লইয়া বিষয়াধিকরণ গঠিত হইত। বলিয়া মনে হয় না; ইহারা সম্ভবত জনসাধারণের প্রতিনিধি হিসাবে অধিকরণের অধিবেশনে উপস্থিত থাকিয়া শাসনকার্যের আলোচনা ও কর্তব্য নির্ধারণে সহায়তা করিতেন। ইহা ছাড়া বারকমণ্ডল বিষয়ের আরও একটু বৈশিষ্ট্য দেখিতেছি। ঘুগ্রহাটি-লিপি এবং অন্য আরও দুইটি কোটালিপাড়া-লিপিতে বিষয়পতির অধিকরণের প্রধান হিসাবে একজন জ্যেষ্ঠ-কায়স্থ বা জ্যেষ্ঠাধিকরণিকের সাক্ষাৎ পাইতেছি। এই তিনটি লিপিতে অধিকরণ-ব্যাপারে বিষয়পতির উল্লেখ নাই; কিন্তু তাই বলিয়া এ অনুমান করা চলে না যে, বিষয়পতির সঙ্গে বিষয়াধিকরণের কোনও সম্বন্ধ ছিল না, বা জ্যেষ্ঠাধিকরণিকই অধিকরণের সভাপতি ছিলেন। বরং এ অনুমানই সঙ্গত যে, বিষয়পতিই ছিলেন সর্বময় কর্তা, অধিকরণের সভাপতি; জ্যেষ্ঠ-কায়স্থ বা জ্যেষ্ঠাধিকরণিক ছিলেন অধিকরণের অন্যান্য সভ্যদের মুখ্যতম প্রতিনিধি। এই অন্যান্য সভ্যরা কাহারা, নিশ্চয় করিয়া বলা কঠিন; অনুমান করিয়াও লাভ নাই। এই অধিকরণেই সহযোগী উপদেষ্ট হিসাবে থাকিতেন বিষয়-মহত্তরেরা (ধর্মাদিত্যের একটি পট্টোলী-কথিত “বিষয়িণঃ” দ্রষ্টব্য), মহত্তরেরা, প্রধান ব্যাপারী বা প্রধান ব্যবহারীরা। মহত্তর ও বিষয়-মহত্তর এই দুয়ের পৃথক উল্লেখ হইতে স্বতঃই মনে হওয়া উচিত যে, ইহারা দুই স্তর বা পর্যায়ের লোক এবং বিষয়-মহত্তরের উচ্চতর পর্যায়ের। মহত্তরেরা তো স্থানীয় সম্রান্ত বিত্তবান ও ভূমিবান লোক বলিয়াই মনে হয়। ব্যাপারী ও ব্যবহারীরা নিঃসন্দেহে শিল্পী-বণিক-ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের লোক।

ভূমি ক্রয়-দানবিক্রয় ব্যাপারে বঙ্গরাষ্ট্রের বিষয়াধিকরণগত সংবাদ গুপ্তরাষ্ট্রযন্ত্রেরই অনুরূপ; খুঁটিনাটি ব্যাপারে যাহা কিছু পার্থক্য তাহা তেমন উল্লেখযোগ্য নয়। মল্লসরুল-লিপিতে বীথী-অধিকরণ সম্পর্কে কুলবারকৃত আখ্যাত এক শ্রেণীর রাজকর্মচারীর উল্লেখ আগেই করা হইয়াছে; বঙ্গরাষ্ট্রের কোনও কোনও লিপিতেও কুলবোর নামে রাজপুরুষের সাক্ষাৎ পাইতেছি। সমাচার দেবের ঘুগ্রহাটি-লিপিতে দেখিতেছি, বারকমণ্ডল-বিষয়ের অধিকরণ বিক্রিত ভূমি মাপিয়া পৃথক করিয়া দিবার জন্য করণিক নয়নাগ, কেশব এবং আরও কয়েকজনকে কুলবোর নিযুক্ত করিয়াছিলেন। কোটালিপাড়ার একটি লিপিতেও কুলবারের উল্লেখ আছে এবং সেখানেও ইহাদের দায়িত্বের ইঙ্গিত ভূমি ক্ৰয়-বিক্রয়ের শেষ পর্বে। ইহারা বোধহয় স্থায়ী অধিকরণ-কর্মচারী ছিলেন না, সর্বত্রই সকল সময় ইহাদের প্রয়োজনও হইত না; প্রয়োজনানুযায়ী অধিকরণ কর্তৃক ইহারা নিযুক্ত হইতেন; ভূমি-আইন সংক্রান্ত ব্যাপারে বোধ হয় তাহারা দক্ষ ছিলেন। যাহা হউক, দেখা যাইতেছে, গুপ্তরাষ্ট্রের অধিকরণগুলিতে যেমন, বঙ্গরাষ্ট্রের অধিকরণেও জনসাধারণের মতামত ইত্যাদি জ্ঞাপন ও কার্যকরী করিবার সুযোগ ও উপায় ছিল; বিষয়-মহত্তর, মহাওর, ব্যাপারী-ব্যবহারী ও প্রকৃতিপুঞ্জের সম্মিলনই তাহার প্রমাণ। বঙ্গরাষ্ট্রের কোনও বীথী ও বীথী-অধিকরণ বা গ্রামাধিকরণের সংবাদ পাওয়া যাইতেছে না; তবে পূর্ববতী পর্বের এবং মল্লসরুল-লিপি-কথিত বর্ধমান-ভুক্তির বঙ্কট্টক-বীথির অধিকরণের উল্লেখ ও বিবরণ হইতে মনে হয়, পূর্ববঙ্গের রাষ্ট্রবিভাগ ও রাষ্ট্রযন্ত্রে ইহাদের স্থান ছিল; সাক্ষ্য প্রমাণ আমাদের সম্মুখে উপস্থিত নাই মাত্র। বঙ্কট্টক-বীথী ও তাহার অধিকরণের কথা আগেই বলা হইয়াছে; এবং তোহা যে মহারাজাধিরাজ গোপচন্দ্রেরই অধিকারভুক্ত ছিল সে ইঙ্গিতও করা হইয়াছে। মল্লসরুল লিপির সাক্ষ্য এই প্রসঙ্গে অন্যদিক দিয়াও উল্লেখযোগ্য। গুপ্ত আমলের প্রাদেশিক রাষ্ট্রযন্ত্রের এবং স্বাধীন স্বতন্ত্র বঙ্গরাষ্ট্রের কর্মধারা বা আমলাতন্ত্র একই জাতীয় না। হওয়াই স্বাভাবিক। স্বাধীন স্বতন্ত্র রাষ্ট্রের আমলাতন্ত্র বিস্তৃততর হইবে এবং কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রের আমলাতন্ত্রের রূপ লাইবে, ইহা কিছু বিচিত্র নয়। বঙ্গরাষ্ট্রের আমলে তাহাই হইয়াছিল এবং মল্লসরুল লিপিতে সেই বর্ধিত বিস্তৃত আমলাতন্ত্রের প্রতিফলন দেখা যাইতেছে। এই লিপির কর্মচারী-তালিকা আগেই বিবৃত করা হইয়াছে, এখানে পুনরুল্লেখের প্রয়োজন নাই! এই আমলাতন্ত্র এখন হইতে ক্রমশ বিস্তারলাভ করিয়া সেন আমলে অস্বাভাবিক স্ফীতি লাভ করিবে,-ক্ৰমে আমরা তাহা দেখিব। ইতিমধ্যে (সপ্তম শতক) লোকনাথে ত্রিপুরা-পট্টোলীতে সান্ধিবিগ্রহিক ঔপধিক এক কেন্দ্রীয় রাষ্ট্র কর্মচারীর উল্লেখ দেখা যাইতেছে। সান্ধি-বিগ্রহিক পররাষ্ট্র ব্যাপারে যুদ্ধ ও সন্ধি-শান্তিসম্পর্কিত উচ্চতম রাজকর্মচারী, বর্তমান ইংরাজি পরিভাষায় minister of peace and war। প্রাদেশিক রাষ্ট্রযন্ত্রে সান্ধিবিগ্রহিক থাকার কোনো প্রয়োজন হয় নাই; কিন্তু স্বাধীন স্বতন্ত্র কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রযন্ত্রের সে প্রয়োজন হইয়াছিল।