০৪. গুপ্তপর্ব। আনুমানিক ৩০০-৫০০ খ্ৰীষ্টীয় শতক

গুপ্তপর্ব। আনুমানিক ৩০০-৫০০ খ্ৰীষ্টীয় শতক

গুপ্ত আমলে প্রাচীন বাঙলার অধিকাংশ গুপ্ত-সাম্রাজ্যভুক্ত হইয়া পড়িয়াছিল এবং গুপ্ত-রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রাদেশিক রূপ এ-দেশে পুরাপুরি প্রবর্তিত হইয়াছিল। স্থানীয় পরিবেশ ও প্রয়োজন অনুযায়ী এই প্রাদেশিক রূপের কিছু কিছু বৈশিষ্ট্য এ-দেশে দেখা দিয়াছিল, এ-সম্বন্ধেও সন্দেহ করা চলে না।

রাজা

মহারাজাধিরাজ পরমভট্টারক পরমদৈবত গুপ্ত সম্রাটদের রাজকীয় মর্যাদা ও রাজতন্ত্রের প্রধান পুরুষ হিসাবে তাঁহাদের ঔপধিক আড়ম্বর ও সমারোহ সহজেই অনুমেয়। তাহারা যে নররূপী দেবতা এবং দেবতা-নির্দিষ্ট অধিকারেই রাজা তাহাও “পরমদৈবত” পদটির ইঙ্গিতেই অনুমেয়। এ-তথ্যও সুবিদিত যে, গুপ্ত সম্রাটেরা বিজিত রাজ্যসমূহ সমস্তই তঁহাদের সাক্ষাৎ রাষ্ট্রযন্ত্রভুক্ত করিতেন না, সমগ্র সাম্রাজ্য তাহারা বা তঁহাদের রাষ্ট্ৰীয় প্রতিনিধিরা নিজেরা শাসন করিতেন না। অনেক অংশ থাকিত সামন্ত নরপতিদের শাসনাধীনে এবং এই সব সামন্ত নরপতিরা নিজ নিজ রাজ্যে প্রায় স্বাধীন স্বতন্ত্র রাজা রূপেই রাজত্ব করিতেন; তঁহাদের নিজেদের পৃথক রাষ্ট্রযন্ত্রও ছিল এবং সেই রাষ্ট্রযন্ত্রের রূপ” ছিল কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রযন্ত্রেরই ক্ষুদ্রতর সংস্করণ মাত্র। কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রের সঙ্গে এই সব সামন্ত রাজা ও রাষ্ট্রের সম্বন্ধ সাধারণত মহারাজাধিরাজের সর্বাধিপত্য স্বীকৃতিতেই আবদ্ধ ছিল। তবে যুদ্ধ-বিগ্রহের সময় তাহারা সৈন্যবল সংগ্ৰহ করিতেন, নিজেরা মহারাজাধিরাজের যুদ্ধে যোগদান করিতেন, এই অনুমান সহজেই করা যাইতে পারে; পরবর্তী কালে তাহার সুস্পষ্ট প্রমাণও আছে। বাঙলাদেশে এই সামন্ত নরপতিদের দায় ও অধিকার কিরূপ ছিল তাহার কিছু কিছু পরিচয় এই পর্বের লিপিমালা হইতে জানা যায়।

 

সামান্ত-মহাসামন্ত

গুপ্ত আমলে বাঙলাদেশে আমরা অন্তত দুইজন সামন্ত নরপতির সংবাদ পাইতেছি এবং এই দুইজনই মহারাজ বৈন্যগুপ্তের (৫০৭-৮) সামন্ত; ইহাদের একজন বৈন্যগুপ্তের পাদদাস মহারাজ রুদ্রদত্ত এবং আর একজন ছিলেন বৈন্যগুপ্তের গুণাইঘর পট্ট-কথিত মহারাজ মহাসামন্ত বিজয়সেন। মল্লসরুল-লিপিতে বিজয়সেন শুধু “মহারাজ বলিয়াই আখ্যাত হইয়াছেন। স্পষ্টতই দেখা যাইতেছে, এই সব সামন্ত-মহাসামন্তরা কখনো কখনো মহারাজ বলিয়াই আখ্যাত ও ভূষিত হইতেন। গুণাইঘর পট্টে মহারাজ মহাসামন্ত বিজয়সেনকে বলা হইয়াছে দূতক, মহাপ্ৰতীহার, মহাপিলুপতি, পঞ্চাধিকরণোপরিক, পূরপালো পরিক এবং পাটু্যুপরিক। কোনও বিশেষ রাষ্ট্ৰীয় অথবা রাজকীয় কর্মের জন্য যে রাষ্ট্রপ্রতিনিধি নিযুক্ত হইতেন তাহাকে বলা হইত দূতক। প্ৰতীহারের সহজ অর্থ দ্বাররক্ষক; মহাপ্ৰতীহার শান্তিরক্ষা বা যুদ্ধবিগ্রহ ব্যাপারে নিযুক্ত শান্তিরক্ষক বা উচ্চ সামরিক কর্মচারী অথবা তিনি রাজপ্রাসাদের রক্ষকও হইতে পারেন। মহাপিলুপতি রাজকীয় হন্তীসৈন্যের অধ্যক্ষ বা রাজকীয় হন্তীবাহিনীর প্রধান শিক্ষাদান-কর্তা। পাচটি অধিকরণ (শাসন কর্মকেন্দ্র; এক্ষেত্রে বোধ হয় বিষয়াধিকরণের কথাই বলা হইয়াছে) মিলিয়া পঞ্চাধিকরণ; এই পঞ্চাধিকরণের যিনি প্রধান কর্মকর্তা তিনিই পঞ্চাধিকরণোপরিক। পুর বা নগরের অধ্যক্ষদের বলা হইত। পুরপাল; এই পুরপালদের যিনি ছিলেন কর্তা তিনি পুরপালো পরিক , পাটু্যপরিক বলিতে কি বুঝাইতেছে, বলা কঠিন। যাহা হউক, মহাসামন্ত মহারাজ বিজয়সেন যে সমসাময়িক রাষ্ট্রের এক প্রধান ও করিৎকর্ম ব্যক্তি ছিলেন, সন্দেহ নাই; নহিলে এতগুলি বৃহৎ কর্মের কর্তৃত্ব ভার, এতগুলি উপাধি তাহার আয়ত্তে আসিবার কথা নয়। অথচ তাঁহার প্রভু বৈন্যগুপ্ত শুধু “মহারাজা” আখ্যাতেই রাজকীয় দলিলে আখ্যাত হইয়াছেন। পট্ট-সাক্ষ্যে মনে হয়, সামন্ত নরপতিরা তাহাদের শাসিত জনপদে নিজেরা ভূমিদান করিতে পারিতেন না; মহারাজের কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রে ভূমিদানের অনুরোধ তাহারা জানাইতেন এবং সেই অনুযায়ী মহারাজের নামে সেই ভূমি দত্ত বা বিক্ৰীত এবং পট্টীকৃত হইত। কিন্তু মল্লসরুল-লিপিতে দেখিতেছি, বিজয়সেন নিজেই ভূমিদান করিতেছেন। হয়তো তখন তিনি স্বাধীন নরপতি অথবা গোপচন্দ্রের সামন্ত হইলেও তাহার সর্বময় আধিপত্য বিজয়সেন সৰ্ব্বথা স্বীকার করিতেন না।

সামন্ত নরপতি শাসিত জনপদ ছাড়া বাকী দেশখণ্ড ছিল খাস রাষ্ট্রের অধিকারে। কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রের বৃহত্তম রাজ্য-বিভাগের নাম ছিল ভুক্তি; প্রত্যেক ভুক্তি বিভক্ত হইত। কয়েকটি বিষয়ে, প্রত্যেক বিষয় কয়েকটি মণ্ডলে, প্রত্যেক মণ্ডল কয়েকটি বীথীতে এবং প্রত্যেক বীথী কয়েকটি গ্রামে এবং গ্রামেই ছিল সর্বনিম্ন দেশবিভাগ। প্রত্যেক বিভাগ-উপবিভাগ ছিল সুনির্দিষ্ট সীমায় সীমিত এবং অধস্তন গ্রাম হইতে আরম্ভ করিয়া উর্ধর্বতম ভুক্তি পর্যন্ত একটি সূত্রে গ্রথিত।

গুপ্ত আমলে বাঙলাদেশে অন্তত দুইটি ভুক্তি-বিভাগের খবর পাওয়া যায়; বৃহত্তর ভুক্তি-বিভাগ পুণ্ড্রবর্ধনভূক্তি, বর্ধমানভুক্তি ক্ষুদ্রতর। প্রথমটির খবর প্রত্যক্ষভাবে পাইতেছি। দামোদরপুর-পট্টোলী পাঁচটি হইতে, পরোক্ষভাবে পাহাড়পুর-পট্টোলী হইতে। বর্ধমান-ভুক্তির খবর পাইতেছি মহারাজ গোপচন্দ্রের মল্লসরুল-লিপি হইতে। অনুমান হয়, শেষোক্ত ভুক্তি-বিভাগটি গোপচন্দ্রের আগে বৈন্যগুপ্তের সময়েও বিদ্যমান ছিল। পুণ্ড্রবর্ধন-ভুক্তি অন্তত তিনটি বিষয়ে বিভক্ত-ছিল। কোটীবর্ষ নামে একটি বিষয়ের খবর পাইতেছি ১, ২, ৪ ও ৫ নং দামোদরপুর-পট্টোলীতে; ধনাইদহ-পট্টোলীতে খোটাপারা বা খাদ্যপারা (নন্দপুর-লিপির খটাপুরাণ দ্রষ্টব্য) নামে একটি বিষয়ের উল্লেখ দেখা যাইতেছে; এবং বৈগ্রাম-পট্টোলীতে পঞ্চনগরী নামে তৃতীয় আর একটি বিষয়ের। শেষোক্ত দুইটি বিষয় পুণ্ড্রবর্ধন-ভুক্তির অন্তর্গত, এ-কথা লিপিতে পরিষ্কারভাবে উল্লেখ নাই সত্য, কিন্তু লিপি-প্ৰসঙ্গ এবং স্থানের ইঙ্গিতে এ-তথ্য সুস্পষ্ট। মণ্ডল-বিভাগের একটিমাত্র উল্লেখ এই আমলের লিপিতে পাইতেছি, যদিও বাঙলার বাহিরে গুপ্ত সাম্রাজ্যের অন্যত্র এই বিভাগের বিদ্যমানতার সাক্ষ্য সুপ্রচুর। পাহাড়পুর-পট্টোলীতে দক্ষিণাংশক-বীথী ও নাগিরট্ট-মণ্ডলের উল্লেখ পর পর দেখিতে পাওয়া যায়, কিন্তু মণ্ডল কোন বিষয়ের অন্তর্গত, কোনও বিষয়েরই অন্তর্গত কিনা, না সরাসরি পুণ্ড্রবর্ধন-ভুক্তির অন্তর্গত, তাহা নিশ্চয় করিয়া বলিবার উপায় নাই; লিপিতে কোনো ইঙ্গিতই পাওয়া যাইতেছে না। অথবা, দক্ষিণাংশক-বীথী এই মণ্ডলেরই একটি বিভাগ। কিনা তাহাও নিঃসংশয়ে বলা যাইতেছে না। শুধু এইটুকু বলা যায় যে, মণ্ডল নামে একটি রাষ্ট্র-বিভাগ ছিল এবং বাঙলার বাহিরে গুপ্ত সাম্রাজ্যে অন্যত্র যে রীতি প্রচলিত ছিল তাহা হইতে এই অনুমান করা যায় যে, মণ্ডল বিষয়ের ক্ষুদ্রতর বিভাগ। দক্ষিণাংশক-বীথী ছাড়া আরও দুই একটি বীথী-বিভাগের পরিচয় পাওয়া যাইতেছে। মুঙ্গের জেলার রঙ্গপুর গ্রামে প্রাপ্ত নন্দপুর-পট্টোলীতে (৪৮৯ খ্ৰীঃ) নন্দ-বীথী নামে এক বীথীর উল্লেখ আছে; এই বীথী অম্বিল গ্রামাগ্রহারের অন্তর্ভুক্ত এবং লিপি-সাক্ষ্যের ইঙ্গিতে মনে হয়, এই অগ্রহারেই ছিল বিষয়পতি ছত্ৰমহের অধিকরণ বা বিষয়কর্মকেন্দ্র। এই অনুমান বোধ হয় সঙ্গত যে, অম্বিল গ্রামগ্রহার যে-বিষয়ের রাষ্ট্রকেন্দ্র, সেই বিষয়েরই অন্তৰ্গত ছিল নন্দ-বীথী। বঙ্কট্টক নামে আর একটি বীথী-বিভাগের উল্লেখ পাইতেছি। গোপচন্দ্রের মল্লসরুল-লিপিতে এবং এই বীথী বর্ধমান-ভুক্তির অন্তর্গত। সর্বনিম্ন রাষ্ট্রবিভাগ গ্রাম। কোনও কোনও ধর্মদেয় বা ব্ৰহ্মদেয় গ্রাম অগ্রহার নামে অভিহিত হইত, যেমন নন্দপুর-লিপির অম্বিল গ্রামগ্রহার, গুণাইঘর লিপির গুণেকাগ্রহারগ্রাম। অনুমান হয়, ব্যাবসা-বাণিজ্য উপলক্ষে বা রাষ্ট্রকর্মকেন্দ্র হিসাবে কোনও কোনও অগ্রহার গ্রাম বাড়িয়া উঠিয়া বড় হইত এবং অন্যান্য গ্রামাপেক্ষা অধিকতর প্রাধান্য লাভ করিত,। ছোট ছোট একাধিক গ্রাম বা পাড়া (পরবর্তী লিপি সমূহের পাটক, পুণ্ড্রক ইত্যাদি) লইয়া একটি বৃহৎ গ্রামও গড়িয়া উঠিত, যেমন বৈগ্রাম-পট্টোলীর বায়িগ্রাম। বায়িগ্রামের অন্তত দুইটি অংশের নাম লিপিতে পাইতেছি, একটি ত্ৰিবৃতা আর একটি শ্ৰীগোহালী (পাহাড়পুর-পট্টোলীর বন্ধ-গোহালী=বর্তমান গোয়ালভিটা, এবং ত্ৰিগোহালী দ্রষ্টব্য)।

 

ভুক্তিপতি ও তাঁহার শাসনযন্ত্র

মহারাজাধিরাজ স্বয়ং ভুক্তির শাসনকর্তা নিযুক্ত করিতেন; ভুক্তিপতিরা সকলেই মহারাজাধিরাজ সম্পর্কে “তৎপাদপরিগৃহীত”। কখনো কখনো রাজকুমার বা রাজপরিবারের লোকেরাও ভুক্তিপতি নিযুক্ত হইতেন; ৫৪৫ খ্ৰীষ্টাব্দে পুণ্ড্রবর্ধন-ভূক্তির উপরিক-মহারাজ ছিলেন জনৈক রাজপুত্র দেবভট্টারক। প্রথম কুমারগুপ্তের রাজত্বকালে ভুক্তিপতিদের বলা হইত উপরিক, কিন্তু বুধগুপ্তের রাজত্বকালে দেখিতেছি, তাহদের বলা হইতেছে, উপরিক মহারাজ বা মহারাজ। মল্লসরুল-লিপিতেও দেখিতেছি, বর্ধমান-ভুক্তির শাসনকর্তাকে বলা হইতেছে উপরিক। ভুক্তির শাসনযন্ত্রের স্বরূপ কী ছিল, বলা কঠিন; লিপিগুলিতে তাহার কোনও ইঙ্গিত পাওয়া যাইতেছে না। বসারে প্রাপ্ত একটি শীলমোহরে দেখা যাইতেছে, উপরিকের অধিষ্ঠানে বা শাসনকেন্দ্ৰে একটি অধিকরণ বা কর্মকেন্দ্ৰ থাকিত; কিন্তু এই কর্মকেন্দ্ৰ কাহাদের লইয়া গঠিত হইত। তাহার আভাস পাওয়া যাইতেছে না। বুধগুপ্তের পাহাড়পুর-লিপি পাঠে মনে হয়, উপরিক-মহারাজের সঙ্গে পুন্ড্রবর্ধনের স্থানীয় অধিকরণের সাক্ষাৎভাবে কোনও সম্বন্ধ ছিল না, অন্তত ভূমি দান-বিক্রয়ের ব্যাপারে। এই ক্ষেত্রে ভূমি-বিক্রয়ের প্রস্তাবটি আসিয়াছিল প্রথম আয়ুক্তক নামে বর্ণিত কর্মচারী এবং স্থানীয় অধিকরণের সম্মুখে; তাহার প্রস্তাবটি পরীক্ষার জন্য পাঠাইয়া দিয়াছিলেন পুস্তপালদের নিকট। আয়ুক্তক নাম হইতে মনে হয়, এই স্থানীয় অধিকরণ বিষয়াধিকরণ, অর্থাৎ পুণ্ড্রবর্ধন-ভুক্তির অন্তর্গত পুণ্ড্রবর্ধন-বিষয়ের অধিকরণ এবং আয়ুক্তক হইতেছেন বিষয়পতি। যেমন ভুক্তিপতির, তেমনই বিষয়পতিরও অধিকরণের অধিষ্ঠান পুণ্ড্রবর্ধনে। সেইজন্যই এই ভূমি-বিক্রয়ের ব্যাপারে স্থানীয় অধিকরণের সঙ্গে উপরিক-মহারাজের কোনো প্রত্যক্ষ সম্বন্ধ দেখা যাইতেছে না। মল্লসরুল-লিপিতে বর্ধমান-ভূক্তির উপরিকের অধিকরণ-সম্পূক্ত কয়েকজন রাজকর্মচারীর খবর পাইতেছি; ইহাদের পদোপাধি ভোগপতিক, পত্তলিক, চৌরোদ্ধরণিক, আবসথিক, হিরণ্যসমুদায়িক, ঔদ্রঙ্গিক, ঔর্ণস্থানিক, কার্তাকৃতিক, দেবদ্রোণীসম্বন্ধ, কুমারমাতা, আগ্ৰহারিক, তদায়ুক্তক, বাহনায়ক এবং বিষয়পতি। উপরিক হইতেছেন ভুক্তির সর্বোচ্চ রাজকর্মচারী; বিষয়পতি বিষয় বিভাগের সর্বোচ্চ রাজকর্মচারী; তদায়ুক্তক বোধহয় উপরিক নিযুক্ত কর্মচারী এবং আয়ুক্তক বা বিষয়পতির সমার্থক। কার্তাকৃতিক শিল্পকর্মের অধ্যক্ষ অথবা রাজকীয় পূর্ববিভাগের কর্মকর্তা হইলেও হইতে পারেন; নিশ্চয় করিয়া বলা যায় না। ভোগপতিক এবং পত্তলিকের কর্ম সম্বন্ধে কিছু ধারণা। আপাতত করা যাইতেছে না। ভোগ একপ্রকারের সুপরিচিত করা; ভোগপতিকরা বোধহয় সেই করের সংগ্ৰহকর্তা। চৌরোদ্ধরণিক উচ্চপদস্থ শান্তিরক্ষক কৰ্মচারী। আবািসথিক হইতেছেন রাজপ্রাসাদ, রাজকীয় ঘরবাড়ি, বিশ্রামস্থান ইত্যাদির অধ্যক্ষ। হিরণ্যসমুদায়িক মুদ্রায় দেয় কর সংগ্রহকর্মের অধ্যক্ষ। ঔদ্রঙ্গিক স্থায়ী প্রজাদের নিকট হইতে উদ্রাঙ্গ নামক করের সংগ্ৰহকর্তা। ঔর্ণস্থানিক বোধহয় রেশম জাতীয় বস্ত্ৰশিল্পকর্মের নিয়ামক-কর্তা। দেবদ্রোণীসম্বন্ধ হইতেছেন মন্দির, তীর্থ-ঘাট ইত্যাদির রক্ষক ও পর্যবেক্ষক। কুমারমাতা এক শ্রেণীর রাজকর্মচারী; ইহারা বোধহয় বংশানুক্রমে প্রত্যক্ষভাবে রাজা বা রাজকুমার কর্তৃক নিযুক্ত এবং তাহাদের অধীনস্থ কর্মচারী। অগ্রহার হইতেছে। ধর্মদেয়, ব্ৰহ্মদেয় ভূমি; এই ভূমির রক্ষক-পর্যবেক্ষকের নাম বোধহয় ছিল আগ্ৰহারিক। বাহনায়ক যানবাহন যাতায়াত প্রভৃতির নিয়ামক-কর্তা।

বিষয়পতি সাধারণত নিযুক্ত হইতেন উপরিক কর্তৃক; কিন্তু কোনও কোনও ক্ষেত্রে বোধ হয় মহারাজাধিরাজ স্বয়ংই ছিলেন নিয়োগকর্তা, যেমন বৈগ্রাম-পট্টোলী-কথিত পঞ্চনগরী বিষয়ের বিষয়পাত ছিলেন “ভট্টারকপািদানুধ্যাত”। বিষয়ের শাসনকর্তকে কোনও কোনও লিপিতে বলা হইয়াছে আয়ুক্তক, যেমন পাহাড়পুর-লিপিতে; কোনও লিপিতে কুমারামোত্য, যেমন বৈগ্রাম-পট্টোলীতে। কিন্তু পরবর্তী গুপ্ত-রাজাদের আমলে সর্বত্রই তাহার পদোপাধি বিষয়পতি।

 

বিষয়পতি ও বিষয়াধিকরণ

বিষয়পতি বিষয়াধিকরণের সর্বোচ্চ কর্মচারী এবং বিষয়পতির অধিষ্ঠানস্থানেই বিষয়াধিকরূর্ণের শাসনকেন্দ্র। শূদ্রকের মৃচ্ছকটিক নাটকের নবম অঙ্কে এক অধিকরণের বর্ণনা আছে। অধিকরণের কর্মনির্বাহের জন্য একটি মণ্ডপ বা সভাগৃহ ছিল। সেই মণ্ডপে অধিকরণ বসিত। মৃচ্ছকটিকের বিচারাধিকরণের বর্ণনা হইতে স্পষ্টই বুঝা যায়, অধিকরণিক, অধিকরণ-ভোজক, শ্ৰেষ্ঠী এবং কায়স্থদের লইয়া অধিকরণ গঠিত হইত এবং এই সব অধিকরণের উপর ভূমি দান-বিক্রয় কর্ম শুধু নহে, বিষয় শাসন-সংক্রান্ত সর্বপ্রকার রাষ্ট্রকর্মের দায়িত্বও ন্যস্ত ছিল এবং, তাহার মধ্যে ন্যায়-অন্যায় বিচার, দণ্ড-পুরস্কার, দানকর্মও বাদ পড়িত না। অধিকরণ-গঠনের যেইঙ্গিত মৃচ্ছকটিক নাটকে পাওয়া যায়, প্রায় অনুরূপ ইঙ্গিত গুপ্ত—আমলের লিপিগুলিতেও পাওয়া যাইতেছে; তবে লিপিগুলি সমস্তই ভূমি দান বিক্রয় সম্পৃক্ত বলিয়া তাহা ছাড়া অন্য কোনও শাসন-সম্পৃক্ত সংবাদ ইহাদের মধ্যে পাওয়া যায় না। কোনও কোনও বিষয়ের বোধহয় কোনও অধিকরণ থাকিত না, বিষয়পতি তৃহার কর্মচারীদের লইয়া শাসনকার্য নির্বাহ করতেন। বৈগ্রাম-পট্টোলীতে দেখিতেছি পঞ্চনগরী বিষয়ের কোনও বিষয়াধিকরণের উল্লেখ নাই; কুমারামান্ত কুলবৃদ্ধি (বিষয়পতি) সংব্যবস্থার ও পুস্তপালদের সাহায্যে শাসনকার্য চালাইতেন। প্রধান দায়িত্ব যে সর্বত্রই বিষয়পতির উপরই ছিল সন্দেহ নাই। তবে, ১, ২, ৪ ও ৫ নং দামোদরপুর-পট্টোলী-কথিত (৪৪২-৪৪-৫৪৩-৪৪ খ্ৰীঃ) কোটীবর্ষ বিষয়ের অধিকরণের যে-খবর পাওয়া যাইতেছে তাহাতে দেখিতেছি, বিষয়পতির সহায়করূপে অধিকরণ গঠন করিতেছেন নগরশ্ৰেষ্ঠী, প্রথম কুলিক, প্রথম কায়স্থ এবং প্রথম সার্থিবহ। প্রথম কায়স্থ খুব সম্ভব বিষয়পতির কর্মসচিব এবং সেই হেতু রাজকর্মচারী। কিন্তু বাকী তিনজন অর্থাৎ নগরশ্রেষ্ঠী, প্রথম কুলিক এবং প্রথম সার্থিবাহ। প্রথম কায়স্থ খুব সম্ভব বিষয়পতির কর্মসচিব এবং সেই হেতু রাজকর্মচারী। কিন্তু বাকী তিনজন অর্থাৎ নগরশ্রেষ্ঠী, প্রথম কুলিক এবং প্রথম সার্থবাহ যথাক্রমে বণিক, শিল্পী এবং ব্যবসায়ী সমাজের প্রতিনিধি, এ-সম্বন্ধে সন্দেহ নাই। প্রাচীন তীরভূক্তি (তিরহুত) অন্তর্গত বর্তমান বসার বা প্রাচীন বৈশালীয় ধ্বংসাবশেষের মধ্যে অনেক মাটির শীলমোহর পাওয়া গিয়াছে; তাহাতে “শ্রেষ্ঠী-সার্থবাহ-কুলিকনিগম” বা “শ্রেষ্ঠীনিগম” এইরূপ পদ উৎকীর্ণ আছে। এলাহাবাদ জেলায় ভিটার ধ্বংসাবশেষ হইতেও “কুলিকনিগম” পদ উৎকীর্ণ কয়েকটি শীলমোহর পাওয়া গিয়াছে। অনুমান হয়, কোটীবর্ষ বিষয়েও শ্ৰেষ্ঠী, কুলিক এবং সার্থবাহদের নিজস্ব নিগম ছিল এবং বিষয়াধিকরণের নগরশ্ৰেষ্ঠী, প্রথম কুলিক এবং প্রথম-সার্থবাহ তাঁহাদের নিজস্ব নিগমের সভাপতি এবং সেই হিসাবে বিষয়াধিকরণে ইহাদের প্রতিনিধি ছিলেন। ইহারা কি স্ব স্ব নিগম কর্তৃক নির্বাচিত হইতেন, না রাষ্ট্র বা রাজা দ্বারা নিযুক্ত হইতেন? এ-প্রশ্নের নিঃসংশয় উত্তর দেওয়া কঠিন। তবে, প্রায় সমসাময়িক নারদ ও বৃহস্পতির ধর্মসূত্রের সাক্ষ্য যদি প্রামাণিক হয়। তবে তাহা হইলে স্বীকার করিতে হয়, এই সব নিগম-সভাপতিরা স্ব স্ব নিগম কর্তৃক নির্বাচিত হইতেন। দ্বিতীয়ত, অধিকরণের এই সব সভ্যদের সঙ্গে বিষয়াপতির সম্বন্ধ কী ছিল? কেহ কেহ মনে করেন, শাসন-ব্যাপারে ইহাদের সাক্ষাৎ দায়িত্ব কিছু ছিল না, অধিকরণের অধিবেশনে ইঁহারা উপস্থিত থাকিতেন মাত্র (রাষ্ট্রকর্ম ইঁহাদের ‘পুরোগে’ অর্থাৎ উপস্থিতিতে নির্বাহ হইত)। আবার কেহ কেহ বলেন, সর্বময় দায়িত্ব ছিল বিষয়পতির, আর ইহারা ছিলেন উপদেষ্টা মাত্ৰ। নগরশ্ৰেষ্ঠী, প্রথম কুলিক, প্রথম সার্থিবাহ এবং প্রথম কায়স্থকে লইয়া একটি উপদেষ্ট-মণ্ডলী ছিল, তাহারা বিষয়পতিকে উপদেশ-পরামর্শ ইত্যাদি দিতেন। কিন্তু লিপিগুলির প্রসঙ্গ-সাক্ষ্য এবং মৃচ্ছকটিকের বিবরণ একত্র করিলে মনে হয়, ইহারা শুধু সহায়ক বা উপদেষ্ট মাত্র ছিলেন না, বিষয়াপতির সঙ্গে ইহারাও সমভাবে শাসনকার্যের দায়িত্ব নির্বাহ করিতেন এবং অধিকরণের ইহারা অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিলেন।

 

পুস্তপাল-দপ্তর

বিষয়াধিকরণের সভ্যদের প্রয়োজনমতে সাহায্য করিবার জন্য একটি পুস্তপালের দপ্তরও থাকিত; বিশেষত, ভূমি দান-বিক্রয় ব্যাপারে ইহাদের সাহায্য সর্বদাই প্রয়োজন হইত, কারণ ভূমির মাপজোখ, সীমা-নিৰ্দেশ, ভূমির স্বত্বাধিকার, ইত্যাদি সব কিছুর দলিলপত্র ইহাদের দপ্তরেই রক্ষিত হইত। ভূমি দান-বিক্রয়ের ক্রমের যে-বিবরণ এই যুগের লিপিগুলিতে পাওয়া যাইতেছে তাহার বিস্তৃত আলোচনা অন্যত্র করিয়াছি; এখানে সংক্ষেপে সারমর্ম উদ্ধার করা যাইতে পারে। ভূমি ক্রয়েছু ব্যক্তি বা ব্যক্তিরা সর্বপ্রথম নির্দিষ্ট ভূমি-ক্রয়ের ইচ্ছা ও সঙ্গে সঙ্গে ক্রয়ের উদ্দেশ্য (প্রায় সকল ক্ষেত্রেই ধর্মোদ্দেশে দান) এবং স্থানীয় প্রচলিত মূল্যানুযায়ী মূল্যদানের স্বীকৃতি স্থানীয় অধিকরণের আবেদনরূপে উপস্থিত করিতেন; অধিকরণ তখন প্রস্তাবিত আবেদনটি পরীক্ষা করিবার জন্য পুস্তপালের দপ্তরে পাঠাইয়া দিতেন। পুস্তপালের দপ্তর কখনও তিনজন (যেমন, ১, ২, ৪ ও ৫নং দামোদরপুর-পট্টোলীতে), কখনও দুইজন পুস্তপাল (যেমন, বৈগ্রাম-লিপিতে) লইয়া গঠিত হইত। যাহাই হউক, পুস্তপালের দপ্তর বিক্রয় অনুমোদন করিলে এবং মূল্য রাজসরকারে জমা হলি ভূমি-ক্রয়েচ্ছু ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের ভূমির অধিকার দেওয়া হইত। অর্থাৎ বিক্রয়কার্য নিষ্পন্ন হইত। এই বিক্রয়কাৰ্য্য-সম্পাদনা পট্টীকৃত হইত। তাম্রশাসনে এবং বিক্ৰীত ভূমির উপর অধিকারের দলিল-প্রমাণস্বরূপ তাম্রশাসনখানি ক্রেতার হস্তে অপিত হইত। ভূমির মাপজোখ কাহারা করিতেন, এ সম্বন্ধে লিপিতে সুনির্দিষ্ট কোনও উল্লেখ নাই, তবে পুস্তপালেরাই তাহা করিতেন, এমন অনুমান করা যাইতে পারে। কিন্তু সাক্ষাৎভাবে যে সব ভূমির অবস্থিতি অধিকার-শাসনসীমার বাহিরে, দূর গ্রামে, সে ক্ষেত্রে বিষয়াধিকরণ তাঁহাদের নিকট উপস্থাপিত প্রস্তাব ও তাঁহাদের নির্দেশ স্থানীয় শাসন-প্রতিনিধিদের নিকট পাঠাইয়া দিতেন। এবং স্থানীয় অধিকরণের কর্মচারীরা ভূমি নির্বাচন ও মাপজোখ ইত্যাদি সম্পাদনা করিয়া মূলা গ্রহণ করিয়া বিঞািয়কার্য পট্টীকৃত করিয়া দিতেন। গ্রামের শাসনযন্ত্র আলোচনা কালে এই কার্যক্রম আরও পরিষ্কার হইবে।

 

বীথীর শাসনযন্ত্র

বীথী-বিভাগেরও যে একটি নিজস্ব অধিকরণ থাকিস্ত তাহার প্রমাণ মল্লসরুল-লিপির সাক্ষ্যেই জানা যাইতেছে, তবে এই অধিকরণ কী ভাবে গঠিত হইত, বলা যাইতেছে না। মহত্তর, খাড়াগী ও অন্তত একজন বাহনায়ক বক্কটুক বীথী-অধিকরণের শাসনকার্যের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, এ-সম্বন্ধে সন্দেহ নাই এবং ভূমি দান-বিক্রয়ের ব্যাপারে এই অধিকরণের ক্ষমতা বিষয়াধিকরণেরই অনুরূপ, এ-তথ্যও লিপি-সাক্ষ্যেই প্রমাণ। এই লিপিতে কুলবারকৃত নামে একাধিক বীথী-অধিকরণ-কর্মচারীর উল্লেখ পাইতেছি; বিক্ৰীত ভূমির বীথীকোষস্থ অর্থ অধিকরণের নির্দেশানুযায়ী বিলি-বন্দোবস্ত করিবার ভার এই কুলবারকৃতদের উপর দেওয়া হইয়াছিল। স্থানীয় অধিকরণ-সম্পূক্ত ব্যক্তিদের মধ্যে অন্তত দুইজন মহত্তর, তিনজন খাড় গী এবং একজন বাহনায়কের সাক্ষাৎ পাইতেছি; তবে শাসনকার্যে ইহাদের দায়িত্ব কতখানি ছিল বলা কঠিন। বাহনায়কের কথা আগে বলিয়াছি। খাড় গী এবং পরবর্তী কালের রামগঞ্জ-লিপির খড়গাগ্রাহ সমার্থক হওয়া অসম্ভব নয়; খাড় গী=খড় গধারী প্রহরী, অর্থাৎ শান্তিরক্ষা-বিভাগের রাজকর্মচারী হওয়া বিচিত্র নয়।

 

গ্রামের শাসনযন্ত্র

গ্রামের শাসনযন্ত্রের সর্বোচ্চ দায়িত্ব কাহার উপর ছিল অর্থাৎ গ্রামে প্রধান রাজপুরুষ কে ছিলেন তাহা নিশ্চয় করিয়া বলা যাইতেছে না, তবে গ্রামিক নামে জনৈক রাজপুরুষের (?) সাক্ষাৎ কোনও কোনও লিপিতে পাওয়া যাইতেছে (যেমন, ৩ নং দামোদরপুর-লিপিতে); বোধ হয় তাঁহারাই ছিলেন গ্ৰাম্য শাসনযন্ত্রের কর্তা। অধিকাংশ গ্রামে গ্রামের প্রধান প্রধান লোকেরাই—ব্রাহ্মণ, মহত্তর, কুটুম্ব ইত্যাদি-বোধ হয় শাসনকার্য নির্বাহ করিতেন। অন্তত ভূমি দান-বিক্রয় ব্যাপারে। ইহারা যে স্থানীয় শাসনকার্যের উপদেষ্ট ও সহায়ক ছিলেন, এ-সম্বন্ধে সন্দেহ নাই (দামোদরপুর-লিপি, পাহাড়পুর-লিপি দ্রষ্টব্য)। মনে হয় রাষ্ট্রের নির্দেশ কার্যে পরিণত করার ভার। ইহাদের উপরই দেওয়া হইত। কিন্তু কোনও কোনও গ্রামে একটু বিস্তৃততর শাসনযন্ত্রও বিদ্যমান ছিল; সে-সব ক্ষেত্রে ব্ৰাহ্মণ, মহত্তর, কুটুম্ব, ‘অক্ষুদ্র প্রকৃতয়ঃ প্রভৃতিরা তো সহায়ক ও উপদেষ্ট হিসাবে থাকিতেনই; তাহা ছাড়া, গ্রামিক এবং অষ্টকুলাধিকরণ নামে একটি অধিকরণও যে থাকিত, তাহারও প্রমাণ আছে (৩নং দামোদরপুর পট্টোলী এবং ধনাইদহ পট্টোলী দ্রষ্টব্য)। অষ্টকুলাধিকরণের গঠন লইয়া পণ্ডিতদের মধ্যে নানা মত দেখিতে পাওয়া যায়। পঞ্চকুলের উল্লেখ অনেক লিপিতেই দেখা যায়, এবং স্থানীয় রাষ্ট্রকার্যে, বিশেষত ভূমি ও অর্থ সংক্রাস্ত ব্যাপারে পঞ্চকুলের দায়িত্ব যে অনেকখানি ছিল তাহা আমরা একাধিক স্বতন্ত্র সাক্ষ্যে জানিতে পাই। পঞ্চকুল যে কৌমতান্ত্রিক পঞ্চায়েত প্রথার সমগোত্রীয় সন্দেহ নাই। অষ্টকুল বোধ হয় পঞ্চকুলের মতই কোনও জনসংঘ, আট জন প্রধান ব্যক্তি লইয়া গঠিত সমিতি। অবশ্য কুল শব্দের বিশেষ আভিধানিক অর্থ আছে। ছয়টি বলদ ও দুইটি লাঙ্গলে যে পরিমাণ ভূমি চাষ করা যায় তাহাই এক কুল; এই রকম আটটি কুলের শাসন-কর্তৃত্ব র্যাহার বা যাঁহাদের উপর দেওয়া হয়, তিনি বা তাহারাই অষ্ট-কুলাধিকরণ। কিন্তু এই আভিধানিক অর্থ এক্ষেত্রে প্রযোজ্য বলিয়া মনে হইতেছে না। এই ধরনের বিস্তৃততর গ্রাম্য শাসনযন্ত্রের কাজের সাহায্যের জন্য পুপ্তপালের দপ্তরও একটি থাকিত ৷৷ ৩নং দামোদপুর-পট্টোলীতে পলাশবৃন্দকের শাসনযন্ত্রে মহাওর, কুটুম্ব, ব্ৰাহ্মণ, “অক্ষুদ্র প্রকৃতয়ঃ”, গ্রামিক, অষ্টকুলাধিকরণ প্রভৃতির সঙ্গে পত্রদাস নামে একজন পুস্তপালের সাক্ষাৎও পাইতেছি।

বিষয় ও বীথি-অধিকরণের মতো ভূমি দান-বিক্রয়ের ব্যাপারে গ্রামা-অধিকরণেরও একই অধিকার ছিল বলিয়া মনে হইতেছে। ৩ নং দামোদরপুর-পট্টোলীতে দেখিতেছি, গ্রামিক নাভিক পলাশবৃন্দকের শাসন-কর্তৃপক্ষের নিকট চণ্ডীগ্রাম পলাশবৃন্দকের সীমার বাহিরে অবস্থিত থাকায় কর্তৃপক্ষ চণ্ড গ্রামের ব্রাহ্মণ, কুটুম্ব ও মহত্তরদের উপর এই বিক্রয়-ব্যাপার সম্পাদনার ভার অর্পণ করিয়াছিলেন। ধনাইদহ-লিপিতেও দেখিতেছি, গ্ৰাম্য অষ্টকুলাধিকরণ এবং তৎসম্পৃক্ত শাসনযন্ত্রের নিকটই ক্রয়েছু ব্যক্তি ভূমিক্রয়ের প্রার্থনা জানাইতেছেন। পাহাড়পুর-লিপিতে দেখা যাইতেছে, নগরশ্ৰেষ্ঠীর উপস্থিতিতে পুণ্ড্রবর্ধনের ভুক্তি-অধিকরণের সমক্ষে এক ভূমিক্রয়ের প্রার্থনা উপস্থিত করা হইয়াছিল; কিন্তু প্রস্তাবিত ভূমি অধিকরণাধিষ্ঠানের সীমার বাহিরে অবস্থিত থাকায় ভুক্তি-অধিকরণ স্থানীয় ব্রাহ্মণ, কুটুম্ব ও মহত্তরদিগকে এ-কার্যে সহায়তা করিতে আহ্বান ও নির্দেশ করিয়াছিলেন। বৈগ্রাম-লিপির সাক্ষ্যও অনুরূপ; পঞ্চনগরীর বিষয়াধিকরণের সমক্ষে উপস্থাপিত একটি প্রার্থনা প্রস্তাবিত ভূমির স্থানীয় সংব্যবহারীপ্রমুখের—ব্রাহ্মণ, কুটুম্ব ইত্যাদির—নিকট পঠাইয়া দেওয়া হইয়াছিল। উর্ধর্বতন অধিকরণের নির্দেশানুযায়ী এইসব স্থানীয় কর্তৃপক্ষই ভূমি নির্বাচন করিয়া, মাপজোখ করিয়া, মূল্য লইয়া বিক্রয়-কার্য সম্পাদন করিতেন এবং তাহা পট্টীকৃতও করিতেন।

ভুক্তি অধিকরণ হইতে আরম্ভ করিয়া গ্ৰাম্য স্থানীয় অধিকরণ পর্যন্ত সর্বত্রই দেখিতেছি, রাষ্ট্রযন্ত্রে জনসাধারণের ইচ্ছা, মতামত, দায় ও অধিকার কার্যকরী করিবার একটা সুযোগ ছিল। শিল্প ও ব্যাবসা-বাণিজ্যবহুল জনপদের অধিকরণগুলিতে শিল্পী, বণিক ও ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিরা স্থান পাইতেন; কৃষিবহুল ভূমি নির্ভর জনপদের স্থানীয় বীথী ও গ্রাম্য অধিকরণগুলিতে গ্রামিক, অষ্টকুলাধিকরণ, কুটুম্ব, মহত্তর, ব্রাহ্মণ ইত্যাদির শাসনকার্যের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন, অন্তত সহায়ক ও উপদেষ্টা রূপে। ইহাদের দায় ও অধিকারের তারতম্য সম্বন্ধে নিশ্চয় করিয়া কিছু বলা হয়তো কঠিন, মতভেদও আছে, সন্দেহ নাই; কিন্তু মোটামুটি ভাবে এই যুগের রাষ্ট্রযন্ত্র জনসাধারণকে একেবারে অবজ্ঞা করিয়া চলিতে পারে নাই, এ-তথ্য স্বীকার করিতে হয়। তবে, জনসাধারণ বলিতে ভূমি ও অর্থবান সমৃদ্ধ শ্রেণী এবং ব্ৰাহ্মণদেরই বুঝাইতেছে, সন্দেহ নাই; ক্ষুদ্র-প্রকৃতিপুঞ্জের কোনো দায় বা অধিকার রাষ্ট্র স্বীকার করিত, এমন প্রমাণ নাই।