০৩. প্রাথমিক রাজতন্ত্র

প্রাথমিক রাজতন্ত্র

রাজতন্ত্রের নিঃসংশয় প্রমাণ ও পরিচয় পাওয়া যায়। খ্ৰীষ্টপূর্ব চতুর্থ শতকে গ্ৰীক ইতিহাস-কথিত গঙ্গারাষ্ট্রের বিবরণের মধ্যে। গঙ্গাহৃদি-গঙ্গারাষ্ট্রের সামরিক শক্তির এবং সেনাবিন্যাসের যে সংবাদ গ্ৰীক ঐতিহাসিকদের বিবরণীতে পাওয়া যায়, তাহা হইতে স্বভাবতই অনুমান করা চলে যে, দৃঢ়সম্বন্ধ সুবিন্যস্ত রাষ্ট্রশৃঙ্খলা ছাড়া সামরিক শক্তির এইরূপ বিন্যাস কিছুতেই সম্ভব হইত না। কিন্তু গঙ্গারাষ্ট্রের বাহিরে সমসাময়িক বাঙলার আর যে-সব রাজা ও রাষ্ট্র বিদ্যমান ছিল তাহাদের সঙ্গে গঙ্গারাষ্ট্রের কী সম্বন্ধ ছিল তাহা জানিবার কোনও উপায় নাই। তবে, মহাভারত ও সিংহলী পুরাণের কাহিনী হইতে মনে হয়, এই রাজ্যগুলিতেও রাষ্ট্ৰীয় সচেতনতার অভাব ছিল না। প্রয়োজন হইলে এই সব রাষ্ট্র সাধারণ শত্রুর বিরুদ্ধে সন্ধিসূত্রে আবদ্ধ হইত, পররাষ্ট্রের সঙ্গে রাষ্ট্ৰীয় সম্বন্ধের আদান-প্রদান করিতে এবং সময় সময় প্রয়োজন মতো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্য ও রাষ্ট্র বৃহত্তর রাজ্য ও রাষ্ট্রের সঙ্গে একত্র গ্রথিতও হইত। পৌণ্ডক-বাসুদেব কাহিনীই তাহার প্রমাণ। অব্যবহিত পরবর্তী কালে (আনুমানিক খ্ৰীষ্টীয় ততীয়-দ্বিতীয় শতকে) বাঙলার অন্তত একাংশের রাষ্ট্র-বিন্যাসের একটু আভাস পাওয়া যায় মহাস্থানের শিলাখণ্ড লিপিটিতে। মৌৰ্য-আমলে উত্তর-বঙ্গ মৌর্য-রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত হইয়াছিল; উত্তর-বঙ্গে মৌর্য-শাসনের কেন্দ্র ছিল পুডিনগল বা পুণ্ড্রনগর, বর্তমান বগুড়া জেলার পাচ মাইল দূরে, মহাস্থানে। লিপিটিতে মহামাত্রের উল্লেখ দেখিয়া মনে হয়, জনৈক রাজপ্রতিনিধির নেতৃত্বে বাঙলায় তখন মৌর্য-শাসনযন্ত্র পরিচালিত হইত এবং জটিল ও সুসম্বন্ধ মৌর্য-রাষ্ট্রের প্রাদেশিক শাসনযন্ত্রের সুবিদিত রূপ তদানীন্তন বাঙলা দেশেও প্রবর্তিত হইয়াছিল। দেবপ্রিয়, প্রিয়াদশী রাজা অশোকের সুশাসন ও জন-কল্যাণাগ্রহের কথা সুবিদিত। দুর্ভিক্ষে বা এই জাতীয় কোনও প্রাকৃতিক অত্যায়িক কালে প্রজাদের বিপন্মুক্তির জন্য রাষ্ট্রের কোষ্ঠাগারাধক্ষ্য রাজকীয় শস্যভাণ্ডারের অর্ধেক শস্য পৃথক করিয়া রাখিবেন, রাজা শস্যবীজ ও খাদ্য দিয়া প্রজাদের অনুগ্রহ করিবেন; বিনিময়ে রাষ্ট্র প্রজাদের দিয়া দুৰ্গনির্মাণ বা সেতুনির্মাণ ইত্যাদি কাজ করাইয়া লইবেন অথবা শ্রম-বিনিময় না লইয়া এমনই দান করিবেন, কৌটিল্য তাহার অর্থশাস্ত্রে এইরূপ বিধান দিয়াছেন। ঠিক এই জাতীয় না হইলেও মহাস্থান লিপিটিতে অনুরূপ রাষ্ট্ৰ-নির্দেশেরই পরিচয় পাওয়া যাইতেছে এবং তাহা হইতে রাষ্ট্রযন্ত্র পরিচালনার কিছুটা ইঙ্গিত ধরা যায়। পুণ্ড্রনগরে একবার কোনও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ফলে নিদারুণ দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়াছিল। এই উপলক্ষে প্রধান রাষ্ট্রকেন্দ্ৰ হইতে পুণ্ড্রনগরে অধিষ্ঠিত মহামাত্রকে দুইটি আদেশ দেওয়া হইয়াছিল, এই আকস্মিক বিপদ হইতে আশু মুক্তির জন্য। প্রথম আদেশটির স্বরূপ বলা কঠিন; লিপির প্রথম লাইনটি ভাঙিয়া যাওয়াতে এই অংশে কী ছিল জানা যায় না। দ্বিতীয়টিতে বিপদপীড়িত প্রজাদের (একমতে সংবঙ্গীয়দের; অন্যমতে ছবিগগীয় ভিক্ষুদের; ইহারা যাহারাই হউন, ইহাদের নেতার নাম ছিল গলদান) ধান্য এবং সম্ভবত সঙ্গে সঙ্গে গণ্ডক ও কাকনিক মুদ্রায় অর্থ সাহায্য করিবার আদেশও দেওয়া হইয়াছে। এই সাহায্য ঠিক দান নয়, ধার মাত্র; কারণ, রাষ্ট্র বা রাজা আশা ও ইচ্ছা প্রকাশ করিতেছেন, এই সাময়িক সাহায্যের ফলে প্রজারা বিপদ কাটাইয়া উঠিতে পরিবে এবং তাহার পর সুদিন ফিরিয়া আসিলে, দেশ শস্যসমৃদ্ধ হইলে প্রজারা আবার রাজকোষে অর্থ আর রাজকোষ্ঠীগারে ধান্য প্রত্যুপণ করিবে। এই ব্যবস্থা একটি সুনিয়ন্ত্রিত সুসংবদ্ধ শাসন-ব্যবস্থার দিকে ইঙ্গিত করে এ-সম্বন্ধে সন্দেহ নাই।

ইহার পর বহুদিন পর্যন্ত বাঙলার রাষ্ট্রযন্ত্র ও রাষ্ট্র-বিন্যাসের কোনও পরিচয় পাওয়া যায় না। তবে, খ্ৰীষ্টীয় তৃতীয়-চতুর্থ শতকে গৌড়-বঙ্গের রাজান্তঃপুর ও নগর সমাজের যে-পরিচয় বাৎস্যায়নের কামসূত্রে পাওয়া যায়, তাহারও আগে খ্ৰীষ্টীয় প্রথম ও দ্বিতীয় শতকে পেরিপ্লাস-গ্রন্থ ও টলেমির বিবরণে, মিলিন্দপঞহ-গ্রন্থে যে সুসমৃদ্ধ সুবিস্তৃত ব্যাবসা-বাণিজ্যের খবর জানা যায়, নাগাৰ্জনকোণ্ডার শিলালিপিতে বৌদ্ধধর্ম প্রচারসূত্রে সিংহল ও পূর্ব-দক্ষিণ ভারতের সঙ্গে বঙ্গের যে ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধের আভাস পাওয়া যায়, তাহা হইতে স্পষ্টতই মনে হয়, রাষ্ট্র ও সমাজগত শাসন-শৃঙ্খলা বর্তমান না থাকিলে এই ধরনের বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক যোগাযোগ, বিশেষ ভাবে সুসমৃদ্ধ সুদূর প্রসারী অন্তঃ ও বহির্বাণিজ্য কিছুতেই সম্ভব হইতে না। সুবর্ণমুদ্রার প্রচলনও এই অনুমানের অন্যতম ইঙ্গিত। চতুর্থ শতকের রাঢ় দেশে অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গে একটি রাজা ও রাষ্ট্রের খবর পাওয়া যাইতেছে; এই রাষ্ট্র পুষ্করণাধিপ মহারাজ সিংহবৰ্মণ ও তাঁহার পুত্র চন্দ্ৰবৰ্মণের; কিন্তু ইহাদের রাষ্ট্রযন্ত্রের বিন্যাস ও পরিচালনা সম্বন্ধে কোনও তথ্যই জানা যাইতেছে না; ইহারা স্বতন্ত্র রাজা ছিলেন। কিনা তাহাও জোর করিয়া বলা যাইতেছে না। তবে রাজতন্ত্র যে তাহার সমস্ত মর্যাদা ও সমারোহ লইয়া এই যুগে সুপ্রতিষ্ঠিত হইয়া গিয়াছে, এ-সম্বন্ধে সন্দেহের আর অবকাশ নাই।