০৬. গ্রাম ও নগর সম্বন্ধে দুই একটি সাধারণ মন্তব্য

গ্রাম ও নগর সম্বন্ধে দুই একটি সাধারণ মন্তব্য

প্রাচীন বাঙলার গ্রাম ও নণর সম্বন্ধে এইবার দুই একটি সাধারণ মন্তব্য করা যাইতে পারে। আয়তনে বা আকৃতি-প্রকৃতিতে এক গ্রামের সঙ্গে আর এক গ্রামের যত পার্থক্যই থাকুক, ঐতিহাসিক কালে অর্থাৎ চতুর্থ-পঞ্চম শতক হইতে একেবারে আদি-পর্বের শেষ পর্যন্ত সমগ্রভাবে বাঙলার গ্রামের চেহারা ও প্রকৃতি একই থাকিয়া গিয়াছে। বস্তুত, মোটামুটিভাবে অষ্টাদশ শতকের শেষ পর্যন্ত সে-চেহারা ও প্রকৃতির বিশেষ কোনও পরিবর্তন হয় নাই বলিলেই চলে। ইহার কারণ একাধিক। প্রথম ও প্রধান কারণ, এই সুদীর্ঘ শতাব্দী পর শতাব্দীর মধ্যে গ্রাম্য উৎপাদন-ব্যবস্থার, অর্থাৎ কৃষি ও ক্ষুদ্রশিল্পের উৎপাদনোপায়ের কোনও পরিবর্তন হয় নাই। একদিকে গরু ও লাঙ্গল, আখামাড়াই যন্ত্র, অন্যদিকে তকালী ও তোতই প্রধান উৎপাদন-যন্ত্র। দ্বিতীয় কারণ, এই সুদীর্ঘ কালের মধ্যে ভূমি-ব্যবস্থারও কোনও মূলগত পরিবর্তন হয় নাই এবং ভূমি-নির্ভর কৃষক-সমাজের মধ্যে যে শ্রেণীবিভাগ তাহাও মোটামুটি একই থাকিয়া গিয়াছে। কোনও গ্রাম হয়ত কখনো ব্যাবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্ৰ হইবার ফলে বা শাসনকার্যের অধিষ্ঠান নির্বাচিত হইবার ফলে বা দুয়েরই ফলে, পৃথক একটা গুরুত্ব ও মর্যাদা লাভ করিয়াছে এবং গ্রাম্য সমাজের আকৃতি-প্রকৃতিতে স্থানীয় একটা পরিবর্তনও ঘটিয়াছে, কিন্তু তাহা সাধারণ নিয়মের ব্যতিক্রম। কোনও কোনও গ্রাম শেষোক্ত কারণে গুরুত্বে স্ফীত ও সমৃদ্ধ হইয়া নগর মর্যাদায় উন্নীতও হইয়াছে, কিন্তু তাহাও ব্যতিক্ৰম। ছোট ছোট গ্রামগুলি একাই একক; বড় গ্রামগুলি দেখিতেছি বিভিন্ন পাড়ায় বিভক্ত। আয়তনাযায়ী প্রত্যেক গ্রামে গ্রামীয় মহত্তর, কুটম্ব, গৃহস্থ, ভূমিবান ও ভূমিহীন কৃষক, কয়েকঘর শিল্পী, সমাজ-সেবক রাজক, নাপিত ইত্যাদি এবং সমাজ-শ্রমিক চণ্ডাল, হাড়ি, ডোম ইত্যাদির বিভিন্ন আয়তন ও মর্যাদার বাস্তুগৃহাদি। এইসব বাস্তু পরস্পর দূরবিচ্ছিন্ন নয়; তবে চণ্ডাল প্রভৃতি অন্ত্যজ বর্ণের লোকেরা যে-অংশে বাস করে তাহা প্রধান গ্রামাংশ হইতে একটু বিচ্ছিন্ন। বাস্তুগৃহাদির সংলগ্ন গুবাক, নারিকেল, আম্র, মহুয়া, উচ্চনীচভূমি ইত্যাদি। বাস্তু হইতে অদূরে গ্রামের কৃষিক্ষেত্র; সেই সুবিস্তৃত কৃষিক্ষেত্রে প্রত্যেকের ক্ষেত্রভূমিসীমা আলিদ্বারা সুনির্দিষ্ট; গ্রামে সমগ্র কৃষিভূমি সেই জন্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র খণ্ডে বিভক্ত। ক্ষেত্রভূমির পাশ দিয়া মাঝে মাঝে বৃহৎ খাল নালা ইত্যাদি; এই খাল নালাগুলি শুধু চাষের জল সরবরাহ করে না, পয়ঃপ্রণালীর কাজও করে। ক্ষেত্রভূমির মধ্যে অথবা শেষ সীমায় গোবাট ও তৃণাচ্ছাদিত গোচরীভূমি। গ্রামের পাশ দিয়া নদী বা গঙ্গিনিকা বা খাল বা অন্য কোনও জলপ্রবাহ এবং গ্রাম্য লোকজন চলাচলের পথ। কোনও কোনও গ্রামের বাহিরে গ্রাম্য হাট, হট্টিয়গুহ ইত্যাদি। যে-সব গ্রাম সমুদ্র বা সমুদ্র জোয়ারবাহী নদীর তীরে সেখানে সমুদ্র বা নদীর। তীরে তীরে গ্রামেব লোকদের লবণের গর্ত। যে-সব গ্রাম বর্ষায় জল-প্লাবিত হয় অথবা নদী ও সমুদ্রের জলোচ্ছাসদ্বারা আক্রান্ত হয়, সে-সব গ্রামের নিম্নতর ভূমিতে ক্ষুদ্র বৃহৎ বাধ বা জঙ্গল। নদী বা বৃহৎ খাল পারাপারের জন্য গ্ৰাম্য খেয়াঘাট। প্রত্যেক গ্রামেই ক্ষুদ্র বৃহৎ ২/১টি মন্দির; কোনও কোনও গ্রামে ক্ষুদ্র বৃহৎ বৌদ্ধবিহার; পণ্ডিত ব্ৰাহ্মণদের গৃহে চতুষ্পাঠী! যে-সব গ্রাম ব্যাবসা-বাণিজ্যের যাতায়াত পথের কেন্দ্র বা সীমায় অবস্থিত। সেখানে গঞ্জ, বৃহৎ হাট; জলবাণিজ্যের কেন্দ্ৰ হইলে নদীর ঘাট বা সমুদ্রের খাড়ীতে অসংখ্য নৌকার সমাবেশ, যেমন ফরিদপুর-কোটালিপাড়া অঞ্চলের গ্রামগুলিতে। এই সব গ্রাম অপেক্ষাকৃত সমৃদ্ধ সন্দেহ নাই। এই তো মোটামুটি বাঙলার গ্রামের চিত্র এবং এ-চিত্র সমসাময়িক বাঙলার লিপিগুলিতে সুস্পষ্ট। মোটামুটি এই চিত্র অষ্টাদশ শতকের শেষ, এমন কি উনবিংশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত বাঙলার গ্রামগুলিতে দেখা যাইতেছে। সমসাময়িক সাহিত্যে, যেমন রামচরিত এবং সদুক্তিকর্ণামৃতের দুই একটি বিচ্ছিন্ন শ্লোকে প্রাচীন বাঙলার গ্রামগুলির মনোরম কাব্যময় ছবি আঁকা হইয়াছে। রামচরিতে বরেন্দ্রীর গ্রাম বৰ্ণনাপ্রসঙ্গে বলা হইতেছে (৩।৫।২৮);

‘বরেন্দ্রীতে জগদ্দল মহাবিহার, এই দেশেই বোধিসত্ত্ব লোকেশ ও তারার মন্দির। ইহার স্কন্দনগর এবং বহুমন্দির শোভিত শোণিতপুর (বাণগড়-কোটীবর্ষ) নগরে অসংখ্য ব্ৰাহ্মণের বাস। এই ভূমির দুই প্রান্তে গঙ্গা ও করতোয়া, আর পুনর্ভবার তীরে প্রসিদ্ধ তীর্থঘাট। বরেন্দ্রীতে প্রচুর বৃহৎ বৃহৎ জলাশয় (বিল?); সেই জলাশয় হইতে বলভী ও ক্ষীণতেীয়া কালিনদীর উদ্ভব। স্থানে স্থানে কোকিল কৃজিত, কন্দ-লকুচ-শ্ৰীফল-লবলী-করুণা-প্রিয়ালা শোভিত উদ্যান; মাঠে মাঠে নানা প্রকারের ধানের ক্ষেত, এলার ক্ষেত, প্রিয়ঙ্গুলতা এবং ইক্ষু ও বাঁশের ঝাড়, অগণিত মহুয়া, সুপারী ও নারিকেল গাছ। জলাশয়ে জলাশয়ে নীল ও লাল পদ্ম, গৃহপ্রাঙ্গণে কনক (চম্পক) ও কেতক ফুলের গাছ; আকাশে বিস্তৃত ও দ্রুতসঞ্চারমান প্রচুর বারিবর্ষ মেঘ।‘

লক্ষ্মণসেনের আনুলিয়া-লিপিতে শালিধান্যভারাবনত শস্যক্ষেত্র এবং রমণীয় উদ্যান শোভিত। গ্রামের উল্লেখ আছে; অন্যান্য ২/১টি লিপিতেও ধান্যভারাবনত শস্যসমৃদ্ধ গ্রাম্য শোভার ইঙ্গিত আছে। দুই একটি গ্রামে হর্ম্যাবলীর কথাও আছে।

বর্ষায় ও হেমন্তে বাঙলার গ্রাম-বর্ণনা, গ্রাম্য কৃষকের চিত্র প্রভৃতি সদুক্তিকর্ণামৃত-গ্ৰন্থ হইতে অন্যত্র উদ্ধার করিয়াছি (দেশ-পরিচয় প্রসঙ্গে জলবায়ু-বৰ্ণনা দ্রষ্টব্য)। শালিধান্য ও ইক্ষুশস্য সমৃদ্ধ এবং ইক্ষুযন্ত্রধ্বনিমুখরিত বাঙলার টুকরা টুকরা চিত্র লিপিমালায় এবং সমসাময়িক সাহিত্যে অন্যত্রও পাওয়া যায়।

গ্রামগুলি মোটামুটি অপরিবর্তিত, কিন্তু প্রাচীন বাঙলার নগরগুলি সম্বন্ধে তাহা বলা চলে না। বলিয়াই মনে হইতেছে। খ্ৰীষ্টপূর্ব শতক হইতে আরম্ভ করিয়া ষষ্ঠ-সপ্তম শতক পর্যন্ত যতগুলি নগরের খবর পাওয়া যাইতেছে, তাহার অধিকাংশই যেন প্রধানত ব্যাবসা-বাণিজ্য নির্ভর। তাম্রলিপ্তিতে তো বটেই, এমন কি পুণ্ড্রনগর, বর্ধমান, গঙ্গাবিন্দর-নগর, নব্যাবকাশিকা-নগর, বারকমণ্ডল-বিষয়ের-নগর প্রভৃতি সমস্ত নগরই সুপ্ৰশস্ত ব্যাবসা-বাণিজ্য পথের উপর অবস্থিত। তাম্রলিপ্ত, গঙ্গাবিন্দর ও পুণ্ড্রনগর সম্বন্ধে যে-সমস্ত বিবরণ প্রাচীন সাহিত্যগ্রন্থ, চীনপরিব্রাজকদের বিবরণ, পাশ্চাত্য বণিক ও ভৌগোলিকদের বিবরণ ইত্যাদির মধ্যে পাইতেছি, তাহাতে এ-সম্বন্ধে কোনও সংশয় থাকে না। নব্যাবকাশিকা-বারকমণ্ডল-পুণ্ড্রভুনগর-বর্ধমানে শাসনকেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত ছিল সন্দেহ নাই; কিন্তু ইহাদের গুরুত্ব ও মর্যাদা যেন বাণিজ্য-সমৃদ্ধির উপরই নির্ভর করিত; পুণ্ড্রনগরের ক্ষেত্রে তীর্থমহিমাও অবশ্যই কার্যকরী ছিল। এই উভয় কারণের জন্যই হয়তো মৌর্য ও গুপ্তরাজারা এইখানেই শাসনকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন। গঙ্গা-বন্দর ও তাম্রলিপ্তির গুরুত্ব নিরঙ্কুশ ব্যাবসা-বাণিজ্যের উপর। কোটীবর্ষ, পঞ্চনগরী, পুষ্করণ, প্রভৃতি নগর প্রধানত রাষ্ট্ৰীয় ও সামরিক প্রয়োজনে হয়তো গড়িয়া উঠিয়াছিল, কিন্তু কোটীবর্ষের অবস্থান এবং প্রাচীন সাহিত্যের উল্লেখ-ইঙ্গিতে মনে হয়, এই নগরের কিছু কিছু বাণিজ্য এবং তীর্থমহিমাও ছিল। বস্তুত, অন্তত ষষ্ঠ-সপ্তম শতক পর্যন্ত প্রাচীন বাঙলার সব কয়টি নগরেরই অবস্থিতি ও বিবরণ যতটুকু জানা যায়, তাহাতে মনে হয়, ব্যাবসা-বাণিজ্য বিবেচনার উপরই ইহাদের অস্তিত্ব ও মর্যাদা প্রধানত নির্ভর করিত। বাৎস্যায়নের কামসূত্রে বাঙলার নগর-সভ্যতার যে সমসাময়িক চিত্র দৃষ্টিগোচর হয়, তাহাতেও সদাগরী ধনতন্ত্রের লক্ষণ সুস্পষ্ট। কিন্তু সপ্তম শতক ও তাহার পর হইতে ব্যাবসা-বাণিজ্য, বিশেষত সামুদ্রিক বহির্বাণিজ্যের অবনতির সঙ্গে সঙ্গে প্রাচীন বাঙলার নগরগুলির আকৃতি ও প্রকৃতি ধীরে ধীরে বদলাইতে আরম্ভ করে। সপ্তম শতকে য়ুয়ান-চোয়াঙ বাঙলার যে-কয়টি নগরের বিবরণ দিতেছেন, তাহাদের মধ্যে এক তাম্রলিপ্তি ছাড়া আর একটিরও বাণিজ্য-প্রাধান্যের ইঙ্গিত নাই, বরং রাষ্ট্ৰীয় প্রয়োজন-প্রেরণার ইঙ্গিত আছে। কর্ণসুবর্ণ, ঔদুম্বর নগর, ক্যঙ্গল-নগর, সমতট-নগর, এমন কি পুণ্ড্রনগর সম্বন্ধেও য়ুয়ান-চোয়াঙের বর্ণনার ইঙ্গিত লক্ষণীয়। অষ্টম-নবম শতক হইতে আরম্ভ করিয়া হিন্দু আমলের শেষ পর্যন্ত যে-কয়টি নগরের বর্ণনা উপরে কবা হইয়াছে, তাহাদের ভৌগোলিক অবস্থিতি, নগর-বিন্যাস এবং সমসাময়িক উল্লেখের ইঙ্গিত একটু সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ করিয়া দেখিলে মনে হওয়া স্বাভাবিক যে, অধিকাংশ নগরের পশ্চাতে রাষ্ট্রীয়, বিশেষভাবে সামরিক প্রয়োজন-বিবেচনা সক্রয় ছিল। মুদগগিরি, বিলাসপুর, হরধাম, রামাবতী, লক্ষ্মণাবতী, বিজয়পুর, সপ্তগ্রাম, বিক্রমপুর, সুবর্ণ গ্রাম, পট্টিকেরা প্রভৃতি সমস্ত নগর সম্বন্ধেই এই উক্তি প্রযোজ্য। দুই একটি নগর, যেমন ত্ৰিবেণী, নবদ্বীপ, সোমপুর এবং অন্যান্য বৌদ্ধ বিহার-নগর প্রভৃতির পশ্চাতে হয়তো ধর্ম, শিক্ষা ও সংস্কৃতির প্রয়োজন-প্রেরণাই প্রধান বিবেচনার বিষয় ছিল। অন্যত্র সর্বত্রই এই প্রয়োজন-বিবেচনা গৌণ।

 

 

রামাবতী ও বিজয়পুরের যে বর্ণনা যথাক্রমে রামচরিত ও পবনদূতে পাইতেছি, মহাস্থান-বাণগড়-রামপাল-পট্টিকেরা প্রভৃতি নগরের ধ্বংসাবশেষের মধ্যে নগর-বিন্যাসের যে-চিত্র উদঘাটিত হইতেছে তাহা সমস্তই অষ্টম শতক পরবর্তী। বলা বাহুল্য, যে ভাবে নগরগুলি অবস্থিত ও বিন্যস্ত তাহাতে সামরিক ও রাষ্ট্রীয় প্রয়োজন, রাজকীয় প্রয়োজন এবং ধন ও বংশাভিমান-সমৃদ্ধ অভিজাত শ্রেণীসমূহের প্রয়োজনকেই গুরুত্ব দেওয়া হইয়াছে বেশি। রামাবতী-লক্ষ্মণাবতী দুইই গঙ্গা-মহানন্দার সঙ্গমে রাজমহল গিরিবর্ক্সের প্রবেশ মুখের প্রহরী; পুণ্ড্রনগর করতোয়ার উপর; কোটীবর্ষ পূনর্ভবার তীরে; রামপাল ইচ্ছামতী-ব্ৰহ্মপুত্রের সঙ্গমে; পট্টিকেরা গোমতী নদী ও ময়নামতী পাহাড়ের ক্রেগড়ে; বিজয়পুর ভাগীরথী-যমুনা-সরস্বতী এই ত্ৰিবেণী সঙ্গমের অদূরে। মহাস্থান-বাণগড়- রামপালের ধ্বংসাবশেষ বিশ্লেষণে দেখা যাইতেছে, প্রত্যেকটি নগরই প্রাকার-বেষ্টিত এবং প্রাকারের পরেই পরিখা। নগর হইতে, নগরোপকণ্ঠে বা নদীর ঘাটে ঘাইবার জন্য প্রাকারের প্রত্যেক দিকেই এক বা একাধিক নগরদ্বার এবং পরিখার উপর দিয়া সেতু। পরিখার অপর পারে নগরোপকণ্ঠে সমাজ-সেবক, সমাজ-শ্রমিক এবং নগর-নির্ভর কুটুম্ব-গৃহস্থদের বাস; কোথাও কোথাও মন্দির, সংঘ, বিহার প্রভৃতিও আছে। নগরাভ্যন্তরে উচ্চতর ভূমির উপর প্রাচীর-বেষ্টিত রাজপ্রাসাদ। রাজপ্রাসাদের সংলগ্ন রাজকীয় এবং শাসনকাৰ্যসংক্রান্ত অট্টালিকাদি। সোজা সরল রেখায় পূর্ব-পশ্চিম ও উত্তর-দক্ষিণে লম্ববান রাজপথদ্বারা সমস্ত নগরভূমি পৃথক পৃথক চতুর্ভুজে বিভক্ত; রাজপথের দুইধারে সমান্তরালে প্রাসাদোপম আবাস-সৌধশ্রেণী, আপণি-বিপণি প্রভৃতি: তাহা ছাড়া, হাট-বাজার, মন্দির, প্রমোদোদ্যান, দীঘি, পুষ্করিণী, বিহার প্রভৃতি তো ছিলই; য়ুয়ান-চেয়াঙের বর্ণনায়ও তাহার আভাস পাওয়া যাইতেছে। রামাবতী ও বিজয়পুরের কাব্যময় বর্ণনাতেও পাইতেছি, সুপ্ৰশস্ত রাজপথের দুইধারে সমান্তরালবতী সুউচ্চ সুরম্য প্রাসাদোপম অট্টালিকাশ্রেণী, প্রত্যেক অট্টালিকার চূড়ায় সুবৰ্ণকলস; মন্দির, বিহার, প্রমোদোদ্যান; বৃহৎ দীঘির চারিধার তালবৃক্ষ ও সুসজ্জিত প্রস্তরখণ্ডদ্বারা শোভিত ও অলঙ্কত।

সকল নগরই যে এইরূপ সমৃদ্ধ ও ঐশ্বর্যবান ছিল, এমন বলা যায় না। অনেক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নগরও ছিল যাহাদের সামরিক বা রাষ্ট্রীয় বা অন্য কোনও গুরুত্ব যথেষ্ট ছিল না, প্রধানত স্থানীয় শাসনাধিষ্ঠানের কেন্দ্ররূপেই। যাহাদের পত্তন হইয়াছিল। বিষয়াধিষ্ঠান, মণ্ডল্যাধিষ্ঠান, বীথী-অধিষ্ঠান প্রভৃতি জাতীয় নগর সর্বত্র উপরোক্ত নগরগুলির মতো সমৃদ্ধ নিশ্চয়ই ছিল না। ছোট ছোট তীর্থ বা শিক্ষাকেন্দ্রগুলিও তোহা ছিল না। এগুলি বরং অনেকটা বৃহৎ সমৃদ্ধ গ্রামের মতনই ছিল বলিয়া অনুমান হয়। ছোট ছোট বাণিজ্যকেন্দ্রগুলিও তাঁহাই ছিল। বিষয়, মণ্ডল বা বীথীর অধিষ্ঠানগুলি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রাজস্ব সংগ্রহের, স্থানীয় বিচার-ব্যবস্থর, ভূমি-ব্যবস্থার, শান্তিরক্ষা-ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ-কেন্দ্র। কিছু কিছু স্থানীয় বাণিজ্যকর্যও এই সব কেন্দ্রে নির্বাহিত হইত। এইসব উপলক্ষে কিছু কিছু রাজকর্মচারী, শিল্পী, বণিক প্রভৃতির এ-জাতীয় অধিষ্ঠানগুলিতে বাসও করিতেন; কিন্তু তৎসত্ত্বেও গ্রামের সঙ্গে এই জাতীয় নগরের বিশেষ কিছু পার্থক্য ছিল না। অধিকাংশ লিপির সাক্ষ্যেই দেখা যায়, এই জাতীয় ছোট ছোট নগরের সঙ্গে গ্রামগুলি একেবারে সংলগ্ন; নগরের পথ গ্রামে গিয়া মিশিয়াছে, অথবা গ্রামের পথ নগর পর্যন্ত বিস্তৃত হইয়াছে। নিকটস্থ গ্রামের উৎপাদিত কৃষি ও শিল্পবস্তু লইয়াই এই সব ছোট ছোট নগরের স্থানীয় ব্যাবসা-বাণিজ্য। অবশ্য, কোটীবর্ষ-বিষয়ের অধিষ্ঠান কোটীবর্ষ-নগর সম্বন্ধে একথা বলা চলে না, কারণ এই নগরের গুরুত্ব ও মর্যাদা শুধু বিষয়াধিষ্ঠান বলিয়া নয়, তীর্থ এবং ধর্মকেন্দ্র ও আন্তর্দেশিক ব্যাবসা-বাণিজ্যের অন্যতম কেন্দ্র হিসাবেও ইহার অন্যতর গুরুত্ব এবং মর্যাদা ছিল।