০৫. কয়েকটি প্রধান প্রধান নগরের বিবরণ

কয়েকটি প্রধান প্রধান নগরের বিবরণ

প্রাচীন লিপিমালা ও সমসাময়িক সাহিত্যে অনেক নগরের উল্লেখ ও বিবরণ পাইতেছি। সকল নগর গুরুত্বে, মর্যাদায়, আয়তনে বা অর্থসম্পদে সমান ছিল না, একথা বলাই বাহুল্য। তবু, ক্ষুদ্র বৃহৎ কয়েকটি নগরের সংক্ষিপ্ত বিবরণ জানিতে পারিলে প্রাচীন বাঙলার নগর-বিন্যাস সম্বন্ধে ধারণা একটু স্পষ্ট হইতে পারে।

পশ্চিমবঙ্গ : তাম্রলিপ্তি

বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের প্রাচীনতম নগর তাম্রলিপ্তির বাণিজ্যসমৃদ্ধির কথা সুপরিচিত। বহুপ্রসঙ্গে বারবার তাহা আলোচিত হইয়াছে। মহাভারত, পুরাণ হইতে আরম্ভ করিয়া টোডরমল্ল পর্যন্ত নানাগ্রন্থে নানা নামে ইহার উল্লেখ পাওয়া যায়-তাম্রলিপ্তি, তাম্রলিপ্ত, তামলিপ্তি, তাম্রলিপ্তক, তমালিনী, বিষ্ণুগৃহ, স্তম্বপুর, তামালিকা, বেলাকুল, তামোলিত্তি, দামলিপ্ত, টামালিটেস (Tamalites), টালকটেই (Taluctae), তম্বুলক ইত্যাদি। সপ্তম-অষ্টম শতক পর্যন্ত এই সামুদ্রিক বন্দরের খ্যাতি অক্ষুণ্ণ ছিল, একথা অন্যত্র আলোচনা করিয়াছি। টলেমি এই সামুদ্রিক বন্দর-নগরটির অবস্থিতি নির্দেশ করিতেছেন। গঙ্গার উপরেই; কথাসরিৎসাগরের একটি গল্পে দেখিতেছি, তাম্রলিপ্তিকা পূর্বঘুধির অদূরস্থ নগরী; দশকুমার চরিতের মতে দামলিপ্ত সমৃদ্ধ ব্যাবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্র ও সামুদ্রিক বন্দর, গঙ্গার তীরে, সমুদ্রের অদূরে; য়ুয়ান-চোয়াঙও বলিতেছেন তাম্রলিপ্ত সমুদ্রের একটি খাড়ীর উপর অবস্থিত, যেখানে স্থলপথ ও জলপথ একত্র মিশিয়াছে। সমুদ্রমুখস্থিত এই বন্দর হইতেই ফাহিয়ান সিংহল এবং ইৎসিঙ শ্ৰীভোজ বা শ্ৰীবিজয়রাজ্যে (সুমাত্রা-যবদ্বীপ) যাইবার জন্য জাহাজে উঠিয়াছিলেন। রূপনারায়ণ-তীরবর্তী বর্তমান তমলুক শহর এই সুসমৃদ্ধ বাণিজ্য নগরীর স্মৃতিমাত্র বহন করিতেছে। অন্যত্র আমি দেখাইতে চেষ্টা করিয়াছি, পুরাতন সরস্বতী বা গঙ্গার অন্য কোনও শাখানদীর উপর প্রাচীন তাম্রলিপ্তির অবস্থিতি ছিল, সেই নদীর খাত শুকাইয়া যাওয়ার ফলে তাম্রলিপ্তির বাণিজ্য-সমৃদ্ধি নষ্ট হইয়া যায় এবং নগর হিসাবেও তাহার প্রাধান্য আর থাকে নাই। কিন্তু তাম্রলিপ্তি শুধু দুই জলপথের সঙ্গমেই অবস্থিত ছিল না; স্থলপথেও রাজগৃহ-শ্রাবস্তি-গয়া-বারাণসীর সঙ্গেও এই নগরীর যোগ ছিল; জাতকের গল্পগুলিতে তাহার কিছু কিছু প্রমাণ পাওয়া যায়। সিংহলী মহাবংশ গ্রন্থের একটি গল্পে দেখিতেছি, সম্রাট অশোক সিংহলী কয়েকজন দূতকে বিদায়-সংবর্ধনা জানাইবার জন্য নিজে তাম্রলিপ্ত পর্যন্ত আসিয়া সেই বন্দরে তাহাদিগকে জাহাজে তুলিয়া দিয়াছিলেন। গয়া হইতে স্থলপথে বিন্ধ্যপর্বত (ছোটনাগপুরের পাহাড়?) অতিক্রম করিয়া তাম্রলিপ্তি আসিতে তাহার ঠিক সাতদিন লাগিয়াছিল। বৃহৎ ব্যাবসা-বাণিজ্যকেন্দ্র ছাড়া তাম্রলিপ্তি শিক্ষা ও সংস্কৃতিরও একটি বড় কেন্দ্র ছিল। পঞ্চম শতকে ফাহিয়ান এই নগরে দুই বৎসর ধরিয়া বৌদ্ধসূত্রের পাণ্ডুলিপি অধ্যয়ন ও পুনর্লিখন করিয়াছিলেন, কিছু কিছু বৌদ্ধ দেবদেবীর ছবিও আঁকিয়াছিলেন। সপ্তম শতকের শেষার্ধে ইৎসিঙ এই কেন্দ্ৰে বসিয়াই শব্দবিদ্যা অধ্যয়ন এবং সংস্কৃত শিক্ষা করিয়াছিলেন। বর্তমান তমলুক শহরের অদূরে কয়েকটি ধ্বংসস্তৃপ ছাড়া এই নগরের আর কিছুই এখন বর্তমান নাই। মাঝে মাঝে ভূমি চাষ করিতে গিয়া কিংবা গর্ত খুঁড়িতে গিয়া অথবা আকস্মিকভাবে কিছু কিছু প্রাচীনমুদ্রা, পোড়ামাটির মূর্তি ও ফলক ইতস্তত পাওয়া গিয়াছে; কোনও কোনও মুদ্রা ও মূর্তির তারিখ প্রায় খ্ৰীষ্টপূর্ব প্রথম ও দ্বিতীয় শতকের। সমৃদ্ধ ঐশ্বর্যশালী ব্যাবসা-বাণিজ্যপ্রধান তাম্রলিপ্তিতে যাতায়াতের পথঘাট দস্য তস্কর-বিরহিত ছিল না, এমন অনুমান স্বভাবতই করা চলে। বণিক, সাৰ্থবাহ, তীর্থযাত্রী, পর্যটক প্রভৃতিরা দল বাধিয়াই যাতায়াত করিতেন; কিন্তু তৎসত্ত্বেও ইৎসিঙ নালন্দার নিকট হইতে তাম্রলিপ্তি যাইবার সময় একবার পথে দাসুন্দল দ্বারা আক্রান্ত হইয়াছিলেন এবং অত্যন্ত আয়াসে কোনও প্রকারে তাহাদের হাত থেকে পরিত্ৰাণ লাভ করিয়াছিলেন।

 

পুষ্করণ, বর্ধমান

খ্ৰীষ্টীয় চতুর্থ শতকে পুষ্করণ নামে একটি নগরের উল্লেখ পাওয়া যাইতেছে মহারাজ চন্দ্ৰবৰ্মার শুশুনিয়া লিপিতে। এই নগর বাঁকুড়া জেলায় দামোদরের দক্ষিণ-তীরবর্তী বর্তমান পোখরণা গ্রামের স্মৃতির মধ্যে আজও বঁচিয়া আছে। শুঙ্গ আমলের একটি ব্যক্ষিণী মূর্তির পোড়ামাটির ফলক এবং আরও কয়েকটি প্রত্নবস্তু পোখারণা গ্রামে পাওয়া গিয়াছে।

বর্ধমানও অতি প্রাচীন নগর। জৈন কল্পসূত্র, সোমদেবের কথাসরিৎসাগর, বরাহমিহিরের বৃহৎসংহিতা প্রভৃতি গ্রন্থে এই নগরের উল্লেখ দেখিতে পাওয়া যায়। কথাসরিৎসাগরে বর্ধমান বসুধার অলঙ্কার বলিয়া বর্ণিত হইয়াছে। জৈন কল্পসূত্রের মতে মহাবীর একবার অস্থিাকগ্রামে কিছুদিন বাস করিয়াছিলেন; চীকাকার বলিতেছেন পূর্বে এই স্থানের নাম ছিল বর্ধমান। তিনি এই নাম-পরিবর্তনের একটা কারণও উল্লেখ করিয়াছেন। খ্ৰীষ্টীয় ষষ্ঠ শতকের মল্লসরুল লিপিতে, দশম শতকের ইর্দা লিপিতে এবং দ্বাদশ শতকের নৈহাটি ও গোবিন্দপুর লিপিতে দেখিতেছি। এই নগর ভুক্তি-বিভাগের শাসনাধিষ্ঠান ছিল। অনুমান হয়, এই নগর দামোদরের তীরেই অবস্থিত ছিল, যদিও বর্তমান বর্ধমান শহর ও দামোদরের বাবধান অনেক। বর্ধমান প্রাচীনকালের অতি জনপ্রিয় নাম; বাঙলার বাহিরেও স্থান নাম হিসাবে ইহার প্রচলন দেখা যায়। হর্ষবর্ধনের বাঁশখেরা লিপিতে এক বর্ধমানকোটির উল্লেখ আছে; আর্যমঞ্জুশ্ৰীমূলকল্পগ্রন্থে কামরূপদেশে এক বর্ধমানপুরের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়; কান্তিদেবের চট্টগ্রাম লিপিতে (নবম শতক) হরিকেল-মণ্ডলান্তৰ্গত। আর এক বর্ধমানপুরের দেখা মিলিতেছে; এই বর্ধমানপুরেই কান্তিদেবের রাজধানী ছিল। হরিকেল যে ব্ৰহ্মপুত্র-পূর্ব পূর্ববঙ্গের অন্তর্ভুক্ত তাহা তো অন্যত্র বলিয়াছি।

 

সিংহপুর

সিংহলী পুরাণে বিজয়সিংহ-কাহিনী প্রসঙ্গে লাল (রাঢ়) দেশান্তর্গত সিংহপুর নামে একটি নগরের উল্লেখ আছে; কেহ কেহ মনে করেন সিংহপুর বর্তমান হুগলী-জেলার শ্ৰীীরামপুর মহকুমার সিঙ্গুর। এ-সম্বন্ধে নিশ্চয় করিয়া কিছু বলা কঠিন।

 

প্রিয়ঙ্গু

দশম ও একাদশ শতকে দণ্ডভুক্তির কম্বোজরাজদের রাজধানী ছিল প্রিয়ঙ্গু নামক নগরে। এই নগরের অবস্থিতি বা অন্য কোনও প্রকার গুরুত্ব সম্বন্ধে কিছুই জানা যায় না, তবে মেদিনীপুর বা হুগলী জেলার কোথাও ইহার অবস্থিতি হওয়া বিচিত্র নয়।

কর্ণসুবর্ণ

কর্ণসুবর্ণ প্রাচীন পশ্চিম-বাঙলার অন্যতম সুপ্ৰসিদ্ধ নগর। সপ্তম শতকে এই নগর গৌড়রাজ শশাঙ্কের রাজধানী, এবং শশাঙ্কের মৃত্যুর পর স্বল্প কিছুদিনের জন্য কামরূপরাজ ভাস্করবর্মার জয়স্কন্ধাবার ছিল। এই শতকের দ্বিতীয় ও তৃতীয় পাদে মহারাজ জয়নাগের রাজধানীও ছিল এই নগরে। যুয়ান-চোয়াঙ বলিতেছেন, এই নগরের পরিধি ছিল ২০ লি। বাঙলায় ভ্ৰমণকালে যুয়ান-চোয়াঙ, কর্ণসুবৰ্ণে আসিয়াছিলেন। সপ্তম শতকের কর্ণসুবর্ণ শুধু রাজধানী হিসাবেই খ্যাতি লাভ করে নাই; সমসাময়িক শিক্ষা ও সংস্কৃতিরও প্রধান একটি কেন্দ্র ছিল এই নগর। নগরের বাহিরে অনতিদূরে রক্তমৃত্তিকা নামে একটি বৃহৎ বৌদ্ধ বিহার ছিল। মুর্শিদাবাদ জেলার রাঙ্গামাটি এবং কানসোনা গ্রাম যথাক্রমে আজও রক্তমৃত্তিকা বিহার এবং কর্ণসুবর্ণের স্মৃতি বহন করিতেছে। দুইই বহরমপুরের নিকটবর্তী গঙ্গাপ্রবাহের তীরে অবস্থিত ছিল, এরূপ অনুমান অযৌক্তিক নয়। জয়নাগের কালে ঔদুম্বরিক বিষয় নামে কর্ণসুবর্ণের একটি বিষয়-বিভাগ ছিল এবং এই বিষয়ের শাসনাধিষ্ঠান বোধ হয় ছিল ঔদুম্বর নামক নগর। ঔদুম্বরিক বিষয় যে আইন-ই-আকবরীর ঔদম্বর পরগণা তাহা তো আগেই বলিয়াছি; বীরভূমের অধিকাংশ এবং মুর্শিদাবাদের কিয়দংশ জুড়িয়া ছিল এই বিষয়ের বিস্তৃতি। রক্তমৃত্তিকা-রাঙ্গামাটির রক্তিম ধূসর ধ্বংসস্তুপে কিছু কিছু খনন কার্য হইয়াছে; এই স্তৃপ সমতল ভূমি হইতে প্রায় ৪০/৫০ ফুট উচু, কিন্তু ইহার অনেকাংশ ভাগীরথী প্রবাহে ভাঙিয়া ধুইয়া গিয়াছে। ভাগীরথীর পশ্চিমতীরে প্রায় দুই মাইল জুড়িয়া ছিল রাজধানীর বিস্তৃতি; নদীপ্রবাহের ধ্বংসাবশেষের অনেক ভাঙিয়া ধুইয়া যাওয়া সত্ত্বেও ইহা বুঝিতে কিছু কষ্ট হয় না। রাক্ষসীডাঙার ধ্বংসস্তৃপ খননে আনুমানিক সপ্তম শতকীয় একটি বৌদ্ধ বিহারের ভিত্তিচিহ্নের সন্ধান পাওয়া গিয়াছে। রাজা কর্ণের স্তৃপ নামে খ্যাত যে-ধ্বংসাবশেষ এখনও বিদ্যমান, তাহাই বোধ হয় ছিল প্রাচীন রাজপ্রাসাদ।

অষ্টম শতকের শেষার্ধে অনৰ্ঘারাঘবের গ্রন্থকার মুরারী চম্পকে গৌড়ের রাজধানী বলিয়া বৰ্ণনা করিয়াছেন। এই চম্পা গঙ্গাতীরবর্তী এবং বর্তমান ভাগলপুরের নিকটবর্তী চম্পানগরী-চম্পাপুরী হওয়াই স্বাভাবিক; তবে, আইন-ই-আকবরী গ্রন্থের মন্দারণ-সরকারের (হুগলী-মেদিনীপুর) অন্তৰ্গত চম্পানগরী হওয়াও একেবারে অসম্ভব নয়।

 

বিজয়পুর

ধোয়ী কবির পবনদূতের সাক্ষ্য প্রমাণিক হইলে স্বীকার করিতে হয়, সেন-রাজাদের (অন্তত লক্ষ্মণসেনের) প্রধান রাজধানী ছিল বিজয়পুর (স্কন্ধাবারং বিজয়পুরিমতুন্নতাম রাজধানীম)। ধোয়ীর বিবরণীর আক্ষরিক অনুসরণ করিলে বিজয়পুর যে তপন-তনয়া যমুনা ও ভাগীরথী সঙ্গমের অদূরে অবস্থিত ছিল (ভাগীরথ্যািস্তপনতনয়া যত নির্যাতি দেবী), তাহা অস্বীকার করিবার উপায় থাকে না। কেহ কেহ বিজয়পুরকে নবদ্বীপ নদীয়া বা রাজশাহী জেলার বিজয়নগরের সঙ্গে এক এবং অভিন্ন বলিয়া মনে করিয়াছেন। ধোয়ীর পবনদূত কখনও গঙ্গা অতিক্রম করিয়াছিল বলিয়া উল্লেখ নাই; কাজেই বিজয়পুর উত্তর বঙ্গে অবস্থিত হওয়া অসম্ভব। নবদ্বীপ-নদীয়া ত্ৰিবেণীর কিছুটা দূরে; পবনদূতের বর্ণনা অনুসারে বিজয়পুর ত্ৰিবেণী হইতে এতদূরে হইতে পারে না। বিজয়পুরের যে বর্ণনা ধোয়ী দিতেছেন তাহাতে উচ্ছসময় অত্যুক্তি আছে, সন্দেহ নাই; তবু, রাজধানীর নাগরিক ঐশ্বর্যাড়ম্বরের খানিকটা পরিচয় পাওয়া যায়।

 

দণ্ডভুক্তি

পশ্চিম-দক্ষিণবঙ্গের আর একটি সুপ্ৰসিদ্ধ নগর দণ্ডভুক্তি। এই নগর দণ্ডভুক্তির এবং পরে দণ্ডিভুক্তি-মণ্ডলের শাসনাধিষ্ঠানরূপে খ্যাতিলাভ করিয়াছিল। মেদিনীপুর জেলার দাঁতন থানা ও দাঁতন শহর প্রাচীন দণ্ডভুক্তির স্মৃতি বহন করিতেছে।

 

ত্ৰিবেণী

যমুনা-সরস্বতী-ভাগীরথীর তিন ‘মুক্তবেণী’র সঙ্গমে অবস্থিত ত্ৰিবেণী প্রাচীন বাঙলার অন্যতম প্রধান তীর্থনগরী। অন্তত সেন-রাজাদের আমল হইতে আরম্ভ করিয়া তুকী আমল পর্যন্ত তীর্থ ও ব্যাবসা-বাণিজ্যের অন্যতম প্রসিদ্ধ কেন্দ্র হিসাবে ত্ৰিবেণীর খ্যাতি অক্ষুন্ন ছিল। আজ সরস্বতী-প্রবাহ শুষ্ক, যমুনা প্রবাহের চিহ্নও অনুসন্ধানের বস্তু, কিন্তু ত্রিবেণীর তীর্থস্মৃতি আজও বিদ্যমান, যদিও আজ তাহা গণ্ডগ্ৰাম মাত্র। ত্ৰিবেণীর অবস্থান ছিল সেই দেশে যে দেশকে ধোয়ী বলিয়াছেন, “গঙ্গাবীচিপ্লুতপরিসরঃ সৌধমালাবতংসো যাস্যতুচ্চৈস্তুয়ি রসময়ো বিস্ময়ং সুহ্মদেশঃ।”

 

সপ্তগ্রাম

ত্ৰয়োদশ শতকের মধ্যভাগে বা শেষার্ধে ত্ৰিবেণীর দুই মাইল দূরে, ভাগীরথী সঙ্গমের সন্নিকটে সরস্বতীর তীরে সপ্তগ্রামে এক সুবৃহৎ বন্দর-নগর গড়িয়া উঠে এবং সেন-রাজাদের রাজধানী বিজয়পুরের মর্যাদা অবলুপ্ত করিয়া দেয়। ষোড়শ শতক পর্যন্ত সপ্তগ্রাম শুধু বৃহত্তম বাণিজ্যকেন্দ্র নয়, দক্ষিণ-পশ্চিম বাঙলার রাজধানী, মুসলমান রাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান রাষ্ট্ৰকেন্দ্র। বিপ্রদাসের মনসামঙ্গলে সপ্তগ্রামের সুন্দর ও বিস্তৃত বর্ণনা আছে।

সেন-রাজাদের অন্যতম রাজধানী বোধ হয় ছিল নবদ্বীপ বা মিনহাজ-উদ-দীন কথিত নুর্দীয়া নগর। নদীয়া-নবদ্বীপ যে সেন-রাজাদের অন্যতম রাজধানী ছিল তাহা কুলজী গ্রন্থমালাদ্বারাও সমর্থিত। সম্বন্ধনির্ণয় ও বল্লাল-চরিত গ্রন্থের মতে বল্লালসেন বৃদ্ধ বয়সে নবদ্বীপ রাজধানীতেই বাস করিতেন।

গোরক্ষাবিজয়, মীনচেতন ও পদ্মপুরাণ গ্রন্থে এক বিজয়নগরের উল্লেখ পাওয়া যায়; এই বিজয়নগর দামোদর নদের উত্তর তীরে অবস্থিত বলিয়া বর্ণিত হইয়াছে। রাঢ়দেশের সঙ্গেই স্কুলের প্রথম ঘনিষ্ঠ পরিচয়; অসম্ভব নয় যে, এই বিজয়নগর বিজয়সেনের নামের সঙ্গে জড়িত।

 

উত্তরবঙ্গ, পুণ্ড্রনগর মহাস্থান

পুণ্ড্র-পুণ্ড্রবর্ধন নগর উত্তর বাঙলার সর্বপ্রধান ও সর্বপ্রাচীন নগর। দিব্যাবদান; রাজতরঙ্গিণী, বৃহৎকথামঞ্জরী প্রভৃতি গ্রন্থে এই নগরের উল্লেখ আছে। অন্যান্য অনেক সাহিত্যগ্রন্থে এবং লিপিমালায় পুণ্ড্র-পুণ্ড্রবর্ধনের প্রধান নগর পুণ্ড্রনগর বা পুণ্ড্রবর্ধনপুরের অল্পবিস্তর উল্লেখ হইতে এবং বর্তমান বগুড়া জেলার মহাস্থান-ধ্বংসাবশেষের প্রত্নতাত্ত্বিক বর্ণনা হইতে সুপ্রাচীন এবং শতাব্দীর পর শতাব্দী অধূষিত এই নগরটি সম্বন্ধে অপেক্ষাকৃত বিস্তৃত সংবাদ আহরণ করা যায়। এই সব সংবাদের সাহায্যে অন্যান্য নগরগুলি সম্বন্ধে ধারণা স্পষ্টতর হইতে পারে, এই অনুমানে পুণ্ড্রনগর-বর্ণনা একটু বিস্তৃতভাবেই করা যাইতে পারে।

বৌদ্ধপুরাণ মতে বুদ্ধদেব স্বয়ং কিছুদিন পুণ্ড্রবর্ধন নগরে কাটাইয়াছিলেন এবং নিজের ধর্মমত প্রচার করিয়াছিলেন। মৌর্যরাজত্বকালে পুন্দনগল (পুণ্ড্রনগর) জনৈক মহামাত্রের শাসনাধিষ্ঠান ছিল। গুপ্ত আমলে এই নগর পুণ্ড্রবর্ধনভূক্তির ভুক্তিকেন্দ্র ছিল এবং সেই সময় হইতে আরম্ভ করিয়া ত্রয়োদশ শতকে হিন্দু আমলের শেষ পর্যন্ত পুণ্ড্র বা পৌণ্ডনগর কখনও তাহার এই মর্যাদার আসন হইতে বিচ্যুত হয় নাই। শুধু শাসনাধিষ্ঠানরূপেই নয়, ধর্ম, শিক্ষা ও সংস্কৃতির কেন্দ্ররূপে এবং আন্তর্ভারতীয় ও আন্তর্জাতিক স্থলপথ-বাণিজ্যের অন্যতম কেন্দ্ররূপেও এই নগরের বিশেষ খ্যাতি ও মর্যাদা বহু শতাব্দী ধরিয়া সুপ্রতিষ্ঠিত ছিল। সপ্তম শতকে যুয়ান-চোয়াঙ যখন বাঙলাদেশ পর্যটনে আসিয়াছিলেন তখন এই নগরের পরিধি ৩০ লি’রও (অর্থাৎ ৬ মাইল) অধিক ছিল; পুষ্করিণী, পুষ্প ও ফলোদ্যান, বিহারকানন প্রভৃতিতে এই নগর সুশোভিত ছিল। পরবর্তী পাল ও সেন আমলে প্রধান ভুক্তির শাসনকেন্দ্র হিসাবে ইহার মর্যাদা ও আয়তন বাড়িয়াই গিয়াছিল, এমন অনুমান অযৌক্তিক নয়। সন্ধ্যাকর নদীর রামচরিতে বলা হইয়াছে, পুণ্ড্রবর্ধনপুর বরেন্দ্রীর মুকুটমণি, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম স্থান (বসুধাশিরো বরেন্দ্রী-মণ্ডল চূড়ামণৈঃ কুলস্থানম)। আনুমানিক দ্বাদশ শতকের করতোয়া-মাহাত্ম্য গ্রন্থে পুণ্ড্রবর্ধনপুরকে পৃথিবীর আদিভবন বলিয়া বৰ্ণনা করা হইয়াছে (আদ্যম ভুবোভবনম)। এই গ্রন্থেই পবিত্র করতোয়া-তীরবর্তী মহাস্থানকে পুণ্য পৌণ্ড্যুক্ষেত্র বা পৌণ্ডনগর বলিয়া উল্লেখও করা হইয়াছে। বগুড়া হইতে ৭ মাইল দূরবতী করতোয়াতীরে মহাস্থান; এখনও এখানে প্রতি বৎসর স্নানপুণ্যদিবসে সহস্ৰ সহস্ৰ লোক করতোয় স্নান করিতে আসেন। পৌণ্ড্যুক্ষেত্রে করতোয়ার এই তীৰ্থমহিমার কথা করতোয়া-মোহাস্ত্ৰ্যে সবিস্তারে উল্লিখিত হইয়াছে। মহাস্থানের সুবিস্তৃত প্রাচীন ধ্বংসাবশেষ, সেই ধ্বংসাবশেষের মধ্যে মৌর্য-ব্রাহ্মী লিপিখণ্ডের আবিষ্কার এবং লিপিখণ্ডে পুন্দনগলের উল্লেখ এবং করতোয়া-মাহান্ত্র্যের উক্তি পুণ্ড্রনগর ও মহাস্থান যে এক এবং অভিন্ন তাহা নিঃসংশয়ে সুপ্রতিষ্ঠিত করিয়াছে।

করতোয়ার বাম তীরে ৩০ বর্গমাইল জুড়িয়া মহাস্থানের ধ্বংসাবশেষ বিস্তৃত। নগর-প্রাকার, প্রাসাদ, অট্টালিকা, মূর্তি, মন্দির, পরিখা, নগরোপকণ্ঠের বিহার, মন্দির, ঘরবাড়ি প্রভৃতির আবিষ্কৃত ধ্বংসাবশেষ হইতে প্রাচীন নগরটির যে-চিত্ৰ ফুটিয়া উঠে তাহা কোনও অংশেই প্রাচীন বৈশালী-শ্রাবস্তি-কৌশাস্বীর নগরসমৃদ্ধির তুলনায় খর্ব বলিয়া মনে হয় না। অসংখ্য পোড়ামাটির ফলক, মাটি-পাথর-ধাতব মূর্তি, প্রাসাদের ভগ্নাবশেষ, মুদ্রা, লিপি ইত্যাদি প্রচুর এই সুবিস্তৃত ধ্বংসাবশেষের ভিতর হইতে আবিষ্কৃত হইয়াছে।

নগরটির দুই অংশ। একটি অংশ পরিখাচিহ্নিত ও প্রাকার বেষ্টিত; এই অংশই যথার্থতি নগর। অন্য অংশ প্রাকারের বাহিরে; এই অংশ নগরোপকণ্ঠ। নগরটি চারিধারের সমতল ভূমি হইতে প্রায় ১৫ ফুট উচু, চারিদিকে সুপ্রশস্ত সুউচ্চ প্রাকার; চারিকোণে চারিটি উচ্চতর প্রাকারমঞ্চ; প্রাকারের বাহিরেই উত্তর, দক্ষিণ ও পশ্চিমদিকে পরিখা; পূর্বদিকে করতোয়া প্রবহমানা। নগরটি দৈর্ঘ্যে উত্তর-দক্ষিণে আনুমানিক ৫,০০০ ফুট, প্রস্থে ৪,২০০ ফুট; সমস্ত নগরটি ক্ষুদ্র বৃহৎ মাটি-ইট-পাথরের স্তুপ এবং ভগ্ন মৃৎপাত্রের টুকরায় আকীর্ণ। নগর হইতে নগরোপকণ্ঠ এবং বাহিরে যাতায়াতের জন্য উত্তর ও দক্ষিণদিকে দুইটি করিয়া সুপ্ৰশস্ত নগরদ্বার। পশ্চিমদিকে উত্তর কোণের কাছে প্রধান নগরদ্বার; এখনও এই দ্বার তাম্র-দরওয়াজা নামে খ্যাত। পূর্বদিকে ঠিক ইহার বিপরীত কোণে শিলাদেবীর ঘাটে যাইবার জন্য আর একটি দ্বার; এই শিলাদেবীর ঘােটই করতোয়া স্থানের প্রধান তীর্থকেন্দ্র। একটি প্রশস্ত লম্ববান সোজা পথ একদ্বার হইতে আর একদ্বারে বিলম্বিত; এখনও সেই পথ দূরাপসৃত করতোয়ায় গিয়া নামিয়াছে। নগরাভ্যন্তরের বৈরাগীর ভিটা ও নগরোপকণ্ঠের গোবিন্দ ভিটায় যতটুকু খনন কার্য হইয়াছে তাহার ফলে দুই জায়গায় মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হইয়াছে। পূর্বদিকে শিলাদেবীর  ঘাটের কাছে নগর-প্রাকারের কিয়দংশের খননে দেখা গিয়াছে, করতোয়ার জলস্রোতের গতি পরিবর্তনের জন্য ঐ স্থানে প্রাকার দৃঢ়তর করিয়া দুইস্তরে গাথা হইয়াছিল। খনন-বিশারদ প্রত্নতাত্ত্বিকেরা মনে করেন এই সব ধ্বংসাবশেষ ও নগরপ্রাকার, পরিখা প্রভৃতি সমস্তই পাল আমলের।

নগরাভ্যন্তরে ছিল রাজকীয় প্রাসাদ, রাষ্ট্রের অধিকরণ-গৃহ এবং অন্যান্য রাজকীয় প্রাসাদ ইত্যাদি, সার্থবাহ-বণিক-নাগরিকদের বাসগৃহ, হাট, মন্দির, সভাগৃহ, সৈন্যসামন্তদের আবাসস্থান ইত্যাদি। রামচরিতে দেখিতেছি, পুণ্ড্রনগরের সারি সারি বিপণি গৃহের বর্ণনা। নগরের সমাজসেবক ও শ্রমিকেরা, কুটুম্ব-গৃহস্থেরা বাস করিতেন নগরোপকণ্ঠে; সেখানেও ঘরবাড়ি, মন্দির প্রভৃতির ধ্বংসাবশেষ ইতস্তত বিক্ষিপ্ত। শুধু পুণ্ড্রনগরেই নয়, কোটীবর্ষ, রামপাল সর্বত্রই নগর-বিন্যাস একই প্রকারের।

 

কোটীবর্ষ বাণগড়

পুণ্ড্রনগর-পৌণ্ড্রক্ষেত্রের পরেই বলিতে হয় কোটীবর্ষ নগরের কথা। হেমচন্দ্রের অভিধানচিন্তামণি, পুরুষোত্তমের ত্রিকাণ্ডশেষ প্রভৃতি গ্রন্থের মতে দেবীকেট, ব্যাণপুর, উমাবন, শোণিতপুর প্রভৃতি কোটীবর্ষেরই বিভিন্ন নাম। অভিধানকারদের মতে কোটীবর্ষের খ্যাতি ও মর্যাদা কৌশাস্বী, প্রয়াগ, মথুরা, উজ্জয়িনী, কান্যকুব্জ, পাটলীপুত্র প্রভৃতি নগরের চেয়ে কম নয়। বায়ুপুরাণে “কোটীবর্ষম নগরম”-এর উল্লেখ আছে। জৈন কল্পসূত্রে বলা হইয়াছে, মৌর্য সম্রাট চন্দ্রগুপ্তের গুরু, ভদ্রবাহুর এক শিষ্য গোদান প্রাচ্য-ভারতের জৈনদিগকে চারিটি শাখায় শ্রেণীবদ্ধ করিয়াছিলেন; তাহার মধ্যে তিনটি শাখার নাম তাম্রলিপ্তি, পুণ্ড্রবর্ধন এবং কোটীবর্ষের সঙ্গে যুক্ত। পঞ্চম শতক হইতে আরম্ভ করিয়া অন্তত পোল আমলের শেষ পর্যন্ত কোটীবর্ষ নগরেই পুণ্ড্রবর্ধনভূক্তির সর্বপ্রধান বিষয় কোটীবর্ষ-বিষয়ের শাসনাধিষ্ঠান অবস্থিত ছিল। মুসলমান অধিকারের পর পুরাতন কোটীবর্ষ নগরেই দেবীকোট-দীবকোট-দীওকেট নামে নূতন নগরের পত্তন হয়। একাদশ শতকের শেষে বা দ্বাদশ শতকের প্রথমে সন্ধ্যাকর নন্দী কোটীবর্ষ নগরের প্রশস্তি উচ্চারণ করিয়া এই নগরের অসংখ্য পূজারী-পূজক-মুখরিত মন্দির ও প্রস্ফুটিত পদ্মহসিত দীঘির দীর্ঘ বর্ণনা রাখিয়া গিয়াছেন। ষোড়শ শতক পর্যন্ত মুসলমান ঐতিহাসিকদের রচনায়। দীবকোট-দীওকোটের বর্ণনা পাঠ করা যায়।

হেমচন্দ্রের পুনর্ভবতীরস্থ কোটীবর্ষ এবং বলিরাজপুত্র বাণাসুরের ও উষা-অনিরুদ্ধের পুরাণ-স্মৃতি বিজড়িত, বাণপুর বর্তমান দিনাজপুর জেলার বাণগড়, এ-সম্বন্ধে সন্দেহের অবকাশ নাই। সমস্ত বাণগড় ও পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলি জুড়িয়া এক বৃহৎ সমৃদ্ধ নগরের ধ্বংসাবশেষ এখনও বিস্তৃত। কম্বোজ-রাজবংশের একটি এবং পালবংশের একটি লিপি, অসংখ্য মূর্তি, মন্দির ও প্রাসাদের ভগ্ন প্রস্তর ও ইষ্টকখণ্ড, ভিত্তিস্তর, স্তম্ভখণ্ড, ক্ষুদ্র বৃহৎ মন্দির-নিদর্শন প্রভৃতি এই সুবিস্তৃত ধ্বংসাবশেষের ভিতর হইতে আবিষ্কৃত হইয়াছে। কম্বোজ-রাজবংশের লিপিখােদিত যে ক্ষুদ্র মন্দির-নিদর্শনটি পাওয়া গিয়াছে তেমন মন্দিরকে যে সমসাময়িক সাহিত্যে “ভূ-ভূষণ” বলা হইয়াছে তাহা কিছু মিথ্যা অত্যুক্তি বলিয়া মনে হয় না।

ধ্বংসাবশেষ হইতে অনুমান হয়, এই নগর দৈর্ঘ্যে প্রায় ১,৮০০ এবং প্রস্থে ১,৫০০ ফুট বিস্তৃত ছিল, নগরটি চারিদিকে প্রাকার দ্বারা বেষ্টিত এবং প্রকারের পরেই পূর্বে, উত্তর ও দক্ষিণে পরিখা এবং পশ্চিমে পুনর্ভবা নদী। পূর্বদিকে প্রধান নগরদ্বার এবং নগর হইতে নগরোপকণ্ঠে যাইবার জন্য পরিখার উপরে সেতুর ধ্বংসাবশেষ এখনও বিদ্যমান। নগরের ঠিক কেন্দ্ৰস্থলে এখনও একটি সুউচ্চ স্তুপ বর্তমান এবং জনসাধারণের স্মৃতিতে এখনও এই স্তুপ রাজবাড়ি নামে জাগ্ৰত; বোধহয় এইখানেই ছিল রাজপ্রাসাদ। নগরাভ্যন্তরে এবং প্রাচীরের বাহিরে নগরোপকণ্ঠে এখনও অসংখ্য ক্ষুদ্র বৃহৎ স্তুপ ইতস্তত বিক্ষিপ্ত।

 

পঞ্চনগরী ও সোমপুর

পঞ্চম শতকে পুণ্ড্রবর্ধন-ভুক্তির অন্যতম বিষয় ছিল পঞ্চনগরী এবং পঞ্চনগরীতেই বিষয়ের শাসনাধিকরণ অধিষ্ঠিত ছিল। পঞ্চনগরী দিনাজপুর জেলায় সন্দেহ নাই, কিন্তু কোন স্থান তাহা নির্ণীত হয় নাই। রাজশাহী জেলার পাহাড়পুরও খুব পুরাতন তীর্থনগর বলিয়া মনে হয়; খ্ৰীষ্টীয় পঞ্চম শতকে এই স্থানের অন্তত একাংশের নাম ছিল বটগোহালী (বর্তমান গোয়ালভিটা) এবং সেখানে জৈন শ্রমণাচার্য গুহনদীর একটি বিহার ছিল। ধৰ্মপালের আমলে এই স্থান সোমপুর নামে খ্যাতি লাভ করে এবং এইখানেই সোমপুর মহাবিহার (বর্তমান পাহাড়পুর) গড়িয়া উঠে। পাহাড়পুরের সন্নিকটবর্তী ওমপুর আজও পুরাতন সোমপুর নামের স্মৃতি বহন করিতেছে। সোমপুর মহাবিহার সমসাময়িক বৌদ্ধধর্ম, শিক্ষা ও সংস্কৃতির অন্যতম শ্রেষ্ঠ তীর্থনগর ছিল, এ-সম্বন্ধে সন্দেহ করিবার অবকাশ নাই। একাদশ শতকে (বর্মণ-রাষ্ট্রের?)। বঙ্গাল সৈন্যেরা এই মহাবিহারের একাংশ আগুন লাগাইয়া পুড়াইয়া দিয়াছিল।

 

জয়স্কন্ধাবার, রামাবতী

পালরাজাদের রাজধানী কোথায় ছিল তাহা নিঃসংশয়ে জানিবার উপায় নাই; তবে তাহারা রাজ্যের সর্বত্র-বোধহয় সামরিক গুরুত্ব এবং শাসনকার্যের সুবিধানুযায়ী-অনেকগুলি বিজয়স্কন্ধাবার স্থাপন করিয়াছিলেন। এগুলি যে অন্তত নগরোপম। এ-সম্বন্ধে সন্দেহ কি? রাজারা যখন সদলবলে এই সব স্থানে আসিয়া বাস করিতেন এবং শাসনকাৰ্যও সেখানে নিম্পন্ন হইত, তখন সেগুলি অস্থায়ী ছত্রাবাস মাত্র ছিল, এ কথা কিছুতেই কল্পনা করা যায় না। রাজপ্রাসাদ, রাজকীয় ঘরবাড়ি, সৈন্যসামন্তবাস, হাটবাজার, মন্দির, পথঘাট, উদ্যান প্রভৃতি সমস্তই এই সব দুৰ্গজাতীয় স্কন্ধাবারে থাকিত, এমন অনুমান করিতে কল্পনার আশ্রয় লইতে হয় না। ষষ্ঠ-সপ্তম শতক হইতে একেবারে ত্রয়োদশ শতক পর্যন্ত এই ধরনের জয়স্কন্ধাবারের উল্লেখ লিপিগুলিতে পাওয়া যাইতেছে; চন্দ্র-বর্মণ-সেন আমলের অনেক লিপিই তো “বিক্রমপুরসমাবাসিত বিজয়স্কন্ধাবার’ হইতে নিৰ্গত। যাহা হউক, পাল লিপিগুলিতে মুদগগিরি, বাটপর্বতিকা, বিলাসপুর, হরধাম, রামাবতীনগর, হংসাকোঞ্চি এবং পাটলীপুত্র জয়স্কন্ধাবারের উল্লেখ আছে। এইসব জয়স্কন্ধাবারের মধ্যে রামাবতী স্পষ্টতই নগর বলিয়া উল্লিখিত হইয়াছে। পাটলীপুত্র তো বহুদিনের প্রাচীন নগর। অন্য জয়স্কন্ধাবারগুলিও নগর না হইলেও নগরোপম ছিল, সন্দেহ নাই। মুদগগিরি বর্তমান মুঙ্গের নগর; গঙ্গার তীরেই ছিল তাহার অবস্থিতি। বিলাসপুর এবং হরধাম দুই অবস্থিত ছিল গঙ্গার উপরে; কারণ গঙ্গায় তীর্থস্নান করিয়াই প্রথম মহীপাল এবং তৃতীয় বিগ্রহপাল যথাক্রমে বাণগড় ও আমগাছি লিপি-কথিত ভূমি দান করিয়াছিলেন, বিলাসপুর এবং হরধাম জয়স্কন্ধাবার হইতে। বটপৰ্বতিকার অবস্থিতি-নির্ণয় কঠিন; পর্বতিকার উল্লেখ হইতে অনুমান হয় রাজমহল পর্বতের সংলগ্ন গঙ্গার তীরেই কোথাও এই জয়স্কন্ধাবার প্রতিষ্ঠিত ছিল। পাটলীপুত্ৰও গঙ্গার তীরে। হংসাকোকী মহারাজ বৈদ্যদেবের কামরূপস্থ জয়স্কন্ধাবার বলিয়া মনে হয়। রামাবতী নগর প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন তৃতীয় বিগ্রহপালের পুত্র রামপাল; মদনপালের মনহলি লিপি এবং সন্ধ্যাকর নন্দীর রামচরিতে এই নগরের উল্লেখ ও বর্ণনা আছে। রামাবতী এবং আইন-ই-আকবরী কথিত রামাউতি যে এক এবং অভিন্ন নগর, এ-সম্বন্ধে সন্দেহের এতটুকু অবকাশ নাই। পরবর্তী সেন-আমলের গৌড় বা লক্ষ্মণাবতী নগরের অদূরে গঙ্গা-মহানন্দার সঙ্গমস্থলের সন্নিকটে ছিল রামাবতীর অবস্থিতি। আজ রামাবতীর পরিত্যক্ত ধ্বংসাবশেষ লক্ষ্মণাবতীর প্রাচীন কীর্তি হর্ম্যাদির অদূরে মাটির ধূলায় সুপ্রিশ্ন দেিয়ছে। অথচ সন্ধকারের বর্ণনা হইতে মনে হয়, সমসাময়িককালে বামাবতী সমৃদ্ধ নগর ছিল।

পাল আমলে জয়স্কন্ধাবারগুলির সামরিক গুরুত্ব লক্ষণীয়; অনুমান হয়, এই সামরিক গুরুত্ব বিবেচনা করিয়াই জয়স্কন্ধাবারগুলি প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল। পাটলীপুত্র, মুদগগিরি, বিলাসপুর, হরধাম, রামাবতী এবং বোধহয় বাটপর্বতিকাও, প্রত্যেকটিই গঙ্গার তীরে তীরে। এই গঙ্গা বাহিয়া রাজমহলের তেলিগঢ়ি ও সিক্রিগলির সংকীর্ণ গিরিবর্ক্সের ভিতর দিয়াই বাঙলায় প্রবেশের পথ, পাল-রাজ্যের হৃদয়স্থলে প্রবেশের পথ এবং পাটলীপুত্ৰ হইতে আরম্ভ করিয়া রামাবতী পর্যন্ত সমস্ত পথটিই সুরক্ষিত রাখা প্রয়োজন ছিল। পাল-রাষ্ট্র তাহাই করিয়াছিল। এই অনুমান আরও সমর্থিত হয়। পরবর্তীকালে লক্ষ্মণাবতী-গৌড়, পাণ্ডুয়া, টাণ্ডা ও রাজমহলের পর পর বিভিন্ন রাষ্ট্রের প্রধান শাসনকেন্দ্রের অবস্থিতি হইতে। যাহা হউক, সে কথা পরে বলিতেছি।

 

লক্ষ্মণাবতী

সেন আমলের প্রায় শেষাশেষি লক্ষ্মণসেন রামাবতীর অদূরে লক্ষ্মণাবতী (মুসলমান ঐতিহাসিকদের গৌড়-লখ্‌নৌতি) নামে এক সুবিস্তৃত নগর প্রতিষ্ঠা করেন। রাজমহল হইতে ২৫ মাইল ভাটীতে গঙ্গা-মহানন্দার সঙ্গমস্থলের এই নগর গঙ্গার তীর ধরিয়া প্রায় ১৪/১৫ মাইল জুড়িয়া বিস্তৃত ছিল। সেন-আমলের লক্ষণাবতীকে আশ্রয় করিয়া তুর্কী সুলতানদের গৌড়-লখ্‌নৌতি নগর গড়িয়া উঠে। গঙ্গা আজ খাত পরিবর্তন করিয়া বহুদূরে সরিয়া গিয়াছে, মহানন্দাও তাঁহাই। কিন্তু গৌড়-লখনৌতির ধ্বংসাবশেষ আজও বিদ্যমান এবং তাহা হইতে প্রাচীনতর লক্ষ্মণাবতীর বিস্তৃতি ও সমৃদ্ধির খানিকটা অনুমান করা চলে। গৌড়-লখনৌতি হইতে রাজধানী কিছুদিন পর পাণ্ডুয়ায় স্থানান্তরিত হয়; তবু লখনৌতির খ্যাতি ও মর্যাদা হুমায়ুন-আকবরের আমল পর্যন্ত অক্ষুন্ন ছিল। মুঘলেরা ইহার নামকরণ করিয়াছিলেন জন্নতাবাদ। গঙ্গা ও মহানন্দার খাত পরিবর্তনের ফলে লখনৌতি অস্বাস্থ্যকর জলাভূমিতে পরিণত এবং ষোড়শ শতকের শেষাশেষি নাগাদ পরিত্যক্ত হয়। পররর্তী কালে বাঙলার রাজধানী টাণ্ডায় এবং সর্বশেষে রাজমহলে স্থানান্তরিত হয়।

 

বিজয়নগর

বর্তমান রাজশাহী শহরের ৭ মাইল পশ্চিমে গোদাগারী থানার অন্তর্গত দেওপাড়া বা দেবপাড়া নামে একটি গ্রাম আছে; দেওপাড়ার উত্তরে অদূরে চব্বিশনগর এবং দক্ষিণে কিঞ্চিৎ দূরে বিজয়নগর নামে আর দুইটি গ্রাম। দেওপাড়া গ্রাম জুড়িয়া প্রাচীন অট্টালিকা, প্রাসাদ, মন্দির, মূর্তি ও দীর্ঘিকার বিস্তৃত ধ্বংসাবশেষ ইতস্তত আকীর্ণ। বিজয়সেনের দেওপাড়া প্রশস্তিলিপিটি পাওয়া গিয়াছে দেওপাড়া গ্রাম হইতে; এই লিপিটিতে প্ৰদ্যুন্নেশ্বরের একটি সুবৃহৎ মন্দির এবং তৎসংলগ্ন একটি বৃহৎ দীঘির উল্লেখ আছে। আজ মন্দিরটির কয়েকটি ভগ্ন স্থাপত্যখণ্ড ছাড়া আর কিছুই নাই; তবে দীঘিটি পদুমসর (প্ৰদ্যুম্নশ্বর বা প্ৰদ্যুম্নসর=প্ৰদ্যুম্ন সরোবর) নামে আজও বাঁচিয়া আছে। মনে হয়, প্রাচীন দেওপাড়া গ্রাম বিজয়সেন-প্রতিষ্ঠিত বিজয়নগরের একটি অংশ ছিল; বিজয়নগর, চব্বিশনগর নাম দুইটি এবং দেওপাড়া প্রশস্তির ইঙ্গিত একান্ত অর্থহীন বলিয়া মনে হয় না। দেওপাড়ার উত্তরে-দক্ষিণে প্রায় ৭/৮ মাইল জুড়িয়া প্রাচীন ধ্বংসাবশেষের কিছু কিছু চিহ্ন ইতস্তত এখনও বিদ্যমান। এই স্থান পদ্মাতীর হইতে খুব দূরেও নয়।

 

পূর্ব ও দক্ষিণ বঙ্গ, গঙ্গাবিন্দর, বঙ্গনগর

পূর্ব ও দক্ষিণ-বাঙলার সর্বপ্রাচীন নগর সিংহলী পুরাণ-কথিত বঙ্গনগর ও টলেমি-কথিত গঙ্গা-বন্দর (Gange)। গঙ্গা-বন্দর গঙ্গর পঞ্চমুখের একটি মুখে অবস্থিত ছিল; সম্ভবত দ্বিতীয় মুখের তীরে, কিন্তু নিঃসশংয়ে তাহা বলা যায় না। পেরিপ্লাসগ্রন্থের বিবরণ অনুসারে গঙ্গাবিন্দর সমসাময়িককালের সুপ্রসিদ্ধ সামুদ্রিক বাণিজ্যের কেন্দ্র এবং টলেমির মতে গঙ্গারাষ্ট্রের রাজধানী ও প্রধান নগর। সিংহলী পুরাণ-কথিত বঙ্গনগরে অবস্থিতি সম্বন্ধে কিছুই বলিবার উপায় নাই।

 

নব্যাবকাশিকা; বারকমণ্ডল-বিষয়; সুবর্ণবীথী

ফরিদপুর কোটালিপাড়ার পট্টোলীগুলিতে নব্যাবকাশিকা, বারকমণ্ডল-বিষয় এবং সুবর্ণবীথী নামে যথাক্রমে একটি ভুক্তি (?)-বিভাগ, একটি বিষয়-বিভাগ এবং একটি বীথী-বিভাগের উল্লেখ পাওয়া যায়। ইহাদের প্রত্যেকেরই এক একটি শাসনাধিষ্ঠান ছিল সন্দেহ নাই, কিন্তু কাহার অবস্থিতি কোথায় ছিল নিশ্চয় করিয়া কিছু বলা যায় না, তবে বর্তমান ফরিদপুর ও ঢাকা জেলায়, মোটামুটি এরূপ অনুমান করা যাইতে পারে। একটি লিপিতে চূড়ামণি-নৌযোগ নামে একটি নৌ-বাণিজ্যের কেন্দ্রেরও উল্লেখ পাওয়া যায়।

 

জয়কর্মান্তবাসক; সমতট-নগর

দেবখড়গের আস্রফপুর লিপি দুইটিতে জয়কর্মন্তবাসক নামে একটি নগরের সাক্ষাৎ পাওয়া যাইতেছে; এই নগরটিই বোধ হয় খড়গরাজাদের রাজধানী অথবা অন্তত জয়স্কন্ধাবার ছিল। কেহ কেহ মনে করেন, কর্মন্তবাসক বা প্রাচীন কর্মান্ত এবং বর্তমান ত্রিপুরা জেলার বড়কামতা গ্রাম এক এবং অভিন্ন। যুয়ান-চোয়াঙ সমসাময়িক সমতটের রাজধানীটির নামোল্লেখ করেন নাই, কিন্তু তাহার একটি বর্ণনা দিয়াছেন।

 

পট্টিকেরা

বর্তমান ত্রিপুরা অঞ্চলে পট্টিকেরা রাজ্যের উল্লেখ একাদশ শতক হইতেই পাওয়া যায়। এই রাজ্যের রাজধানীর ইঙ্গিত ব্ৰহ্মদেশীয় রাজবৃত্ত-কাহিনীতেও জানা যায়। তবে, পট্টিকেরা-নগরের সবিশেষ এবং সুস্পষ্ট সাক্ষাৎ পাইতেছি। ত্ৰয়োদশ-শতকে রণবঙ্কমল্ল হারিকালদেবের একটি লিপিতে। ত্রিপুরা জেলার মধ্যযুগীয় পাটিকেরা বা পাইটকেরা এবং বর্তমান পাটিকারা বা পাইটকরা পরগণা প্রাচীন পট্টিকের রাজ্যের নাম ও স্মৃতি বহন করিতেছে। প্রাচীন পট্টিকেরা-নগর এবং বর্তমান পাইটকারা পরগণাস্থিত ময়নামতী পাহাড়ের ময়নামতী গ্রাম খুব সম্ভবত এক এবং অভিন্ন। এই গ্রাম এবং আশপাশের গ্রাম হইতে অনেক প্রত্নবস্তু-লিপি, মূর্তি ও মূর্তির অংশ, ভগ্ন প্রস্তর খণ্ড, পোড়ামাটির ফলক ইট-পাথরের টুকরা ইত্যাদি-বহুদিন হইতেই সময় সময় পাওয়া যাইতেছিল। খুব সম্প্রতি আকস্মিক খননের ফলে ময়নামতীর ইতস্তত বিক্ষিপ্ত ধ্বংসস্তুপের ভিতর হইতে এক সুপ্রাচীন নগরের ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হইয়াছে এবং সঙ্গে সঙ্গে অনেক লিপিখণ্ড, পোড়ামাটির ফলক, মূর্তি, মৃৎপাত্র ইত্যাদি পাওয়া গিয়াছে। গোমতীর তীর এবং ময়নামতী পাহাড়ের ক্রোড়স্থিত এই সুবিস্তৃত ধ্বংসাবশেষই প্রাচীন পট্টিকেরার ধ্বংসাবশেষ, এমন মনে করিবার সঙ্গত কারণ বিদ্যমান। হরিকালদেবের লিপি হইতে জানা যায়, পট্টিকেরা-নগরে দুর্গোেত্তারা নামে এক বৌদ্ধ দেবীর একটি মন্দির ছিল।

 

মেহারকুল

দামোদর দেবের মোহার লিপিতে (১১৫৬ শক) মেহারকুল বা মৃকুল নামে একটি নগরের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। বর্তমান চট্টগ্রাম জেলার মোহার গ্রাম এই নগরের স্মৃতি আজও বহন করিতেছে।

পূর্ব-বাঙলার বৃহত্তম প্রাচীন নগর শ্ৰীবিক্রমপুর। বিক্রমপুর চন্দ্ৰ, বৰ্মণ, সেন ও দেববংশীয় রাজাদের অন্যতম প্রধান জয়স্কন্ধাবার। পাল রাজাদের মতো সেন রাজাদেরও কয়েকটি রাজধানী বা জয়স্কন্ধাবার ছিল, তন্মধ্যে বিক্রমপুরই সর্বপ্রধান ছিল বলিয়া মনে হয়। এই “শ্ৰীবিক্রমপুরসমাবাসিত শ্ৰীমজ্জয়স্কন্ধাবারাৎ” বিজয়সেনের একটি বল্লালসেনের একটি, এবং লক্ষ্মণসেনের রাজত্বের প্রথম ছয় বৎসরের মধ্যে অন্তত পাচটি শাসনলিপি নিৰ্গত হইয়াছিল। এই বিক্রমপুর জয়স্কন্ধাবারেই বিজয়সেন-মহিষী বিরাট তুলাপুরুষ মহাদানযজ্ঞ সম্পাদন করাইয়াছিলেন। সুতরাং জয়স্কন্ধাবার অস্থায়ী ছত্রাবাস মাত্র, একথা কিছুতেই সত্য হইতে পারে না। লক্ষ্মণসেনের দুইটি লিপি এবং বিশ্বরূপ ও কেশবসেনের লিপিগুলি কিন্তু বিক্রমপুর হইতে নিৰ্গত নয়। বিক্রমপুর-জয়স্কন্ধাবার কি পরিত্যক্ত হইয়াছিল; না এই পরিবর্তন আকস্মিক? যে ধার্যগ্রাম ও ফলগুগ্রাম হইতে এই লিপিগুলি উৎসারিত, সে-গ্রাম দুইটিই বা কোথায়?

বিক্রমপুর নামে একটি সুবিস্তৃত পরগণা এখনও ঢাকা জেলার মুন্সীগঞ্জ মহকুমা ও ফরিদপুর জেলার কিছু অংশ জুড়িয়া বিস্তৃত। বিক্রমপুর নামে একটি গ্রাম প্রাচীন দলিলপত্ৰেও উল্লিখিত দেখিতে পাওয়া যায়, কিন্তু ঢাকা-ফরিদপুরে আজ আর কোনও গ্রামই বিক্রমপুর নামে পরিচিত নয়।

মুন্সীগঞ্জ মহকুমার মুন্সীগঞ্জ শহরের অদূরে সুপ্রসিদ্ধ বজ্রযোগিনী (অতীশ দীপঙ্করের জন্মভূমি) এবং পাইকপাড়া গ্রামের অদূরে রামপাল নামক স্থানে সুপ্রাচীন একটি নগরের ধ্বংসাবশেষ প্রায় পনেরো বর্গমাইল জুড়িয়া বিস্তৃত। প্রায় ১৭/১৮টি গ্রাম এই সুবিস্তৃত ধ্বংসাবশেষের উপর দাঁড়াইয়া আছে; সমস্ত স্থানটি জুড়িয়া ভগ্ন মৃৎপাত্রের অংশ, পুরাতন ইট-পাথরের টুকরা, মূর্তির ভগ্ন অংশ প্রভৃতি নানা পুরাবস্তু ইতস্তত বিক্ষিপ্ত। সমগ্র স্থানটির ভৌগোলিক সংস্থান উল্লেখযোগ্য। রামপালের উত্তরে ছিল ইচ্ছামতী নদী; এই নদীর নিম্নপ্রবাহ আজ ধলেশ্বরীর প্রবাহের সঙ্গে মিশিয়া গিয়াছে। ইছামতীর প্রাচীন খাতের সমান্তরালে পূর্ব-পশ্চিমে লম্ববান একটি সুউচ্চ প্রাকারের ধ্বংসাবশেষ এখনও বর্তমান। পূর্বদিকে প্রাচীন ব্ৰহ্মপুত্র প্রবাহের খাত; ব্ৰহ্মপুত্র যে একসময় এই নগরের পূর্ব সীমা স্পর্শ করিয়া প্রবাহিত হইত এই খাত তাহারই অন্যতম প্রমাণ। পশ্চিমে ও দক্ষিণে দুইটি বিস্তৃত পরিখা; এই দুইটি পরিখা বর্তমানে যথাক্রমে মিরকাদিম খাল ও মকুহাটি খাল নামে পরিচিত। সমগ্র স্থানটি ছিল বোধ হয়। নিম্নভূমি; বোধ হয় সেই জন্যই অসংখ্য ছোট বড় দীঘি কাটিয়া নগরভূমিকে সমতল উচ্চভূমিতে পরিণত করা হইয়াছিল। সদ্যোক্ত চতুঃসীমাবেষ্টিত বিস্তৃত৷ নগরের মধ্যে উচ্চতর ভূমিতে রাজপ্রাসাদের বিরাট ধ্বংসস্তুপ এখনও সুস্পষ্ট; জনস্মৃতিতে এই স্তুপ আজও বল্লালবাড়ী নামে খ্যাত। এই নামের মধ্যে বল্লালসেনের স্মৃতি বিজড়িত, সন্দেহ নাই। কিন্তু রামপাল নাম তো পালরাজ রামপালের এবং খুব সম্ভব রামপোলই এই নগর পত্তন না করিলেও ইহার খ্যাতিকে প্রতিষ্ঠা দান করিয়াছিলেন। যাহাই হউক, রাজপ্রাসাদের ধ্বংসাবশেষের চারিদিকে প্রাকার ও পরিখা ভগ্নাবস্থায় আজও দৃষ্টিগোচর হয়। ইচ্ছামতীর প্রাচীন খাত হইতে একটি সুপ্ৰশস্ত রাজপথ নগরটিকে দুইভাগে বিভক্ত করিয়া একেবারে সোজা দক্ষিণ-সীমা পর্যন্ত চলিয়া গিয়াছে; উত্তরতম প্রান্তে এবং দক্ষিণতম প্রান্তে দুইটি সুবৃহৎ নগরদ্বারা আজও যথাক্রমে কপালদুয়ার ও কচুকিদুয়ার নামে খ্যাত। এই প্রধান রাজপথ হইতে পূর্ব ও পশ্চিমে অনেকগুলি পথ বাহির হইয়া একেবারে সোজা পূর্ব ও পশ্চিম সীমান্ত পর্যন্ত চলিয়া গিয়াছে; এই পথগুলির চিহ্ন এখনও বর্তমান।

এই রামপোলই চন্দ্র-বর্মণ-সেন-দেববংশের লিপিগুলির “শ্ৰীবিক্রমপুর জয়স্কন্ধাবার” বলিয়া মনে হইতেছে। সমগ্ৰ বিক্রমপুর পরগণায় এমন সুপ্ৰশস্ত এবং ভৌগোলিক দিক হইতে এমন সুবিন্যস্ত ও সুরক্ষিত প্রাচীন নগরের ধ্বংসাবশেষ আর কোথাও আবিষ্কৃত হয় নাই। রামপালের (একাদশ শতকের শেষার্ধ) নাম ও স্মৃতির সঙ্গে জড়িত বলিয়া এই অনুমান আরও গ্রাহ্য বলিয়া মনে হয়। চন্দ্ৰবংশীয় রাজাদের আমলেই প্রথম বিক্রমপুর জয়স্কন্ধাবারের কথা জানা যাইতেছে (একাদশ শতকের প্রথমার্ধ); ইহারাই হয়তো এই নগর প্রতিষ্ঠা করিয়া থাকিবেন, কিন্তু রামপোলই প্রকৃতপক্ষে ইহার খ্যাতি ও মর্যাদার যথার্থ প্রতিষ্ঠাতা! হয়তো তিনিই ইহাকে বিস্তৃত ও সংস্কৃত করিয়া নিজের নামের সঙ্গে জড়িতও করিয়া থাকিবেন।

 

সুবৰ্ণগ্রাম

অরিরাজ দনুজমাধব দশরথদেবের আদাবাড়ীর লিপির কাল পর্যন্তও বিক্রমপুর নগর সুপ্রতিষ্ঠিত ছিল। এই দনুজমাধব দশরথ, হরিমিশ্রের কারিকা-কথিত দনুজমাধব এবং জিয়াউদদীন বারণি কথিত সুবর্ণগ্রাম বা সোনারগা-র রাজা দনুজ রায় যদি একই ব্যক্তি হইয়া থাকেন এবং তাহা হইবার সঙ্গত কারণও বিদ্যমান, তাহা হইলে স্বীকার করিতে হয়, ১২৮৩ খ্ৰীষ্টাব্দে বা তাহার আগে কোনও সময় দনুজমাধব দশরথ বিক্রমপুর হইতে তাহার রাজধানী সুবর্ণগ্রামে স্থানান্তরিত করিয়াছিলেন। এই সময়ের আগে সুবর্ণগ্রামের কোনও উল্লেখ প্রাচীনতর সাক্ষ্যে কোথাও নাই। হইতে পারে, সুবর্ণগ্রাম পূর্বে বিক্রমপুর-ভাগের অন্তর্গত ছিল, কিন্তু বিক্রমপুর জয়স্কন্ধাবার ও বিক্রমপুর ভাগ এক নহে। বিক্রমপুর জয়স্কন্ধাবার বিক্রমপুর-ভাগের শাসন কেন্দ্ৰ; দনুজরায়-দনুজমাধব শাসনকেন্দ্ৰ বিক্রমপুর হইতে উঠাইয়া সুবর্ণগ্রামে লইয়া গিয়া থাকিবেন। সুবর্ণগ্রাম আজও ঢাকা জেলায় মুন্সীগঞ্জের বিপরীত দিকে ধলেশ্বরী-তীরের একটি সমৃদ্ধ গ্রাম; এবং কিছু কিছু পুরাবস্তু এখানেও আবিষ্কৃত হইয়াছে। মুঘল-পূর্ব মুসলমান রাজাদের আমলে সুবর্ণগ্রামই ছিল পূর্ব-বাঙলার রাজধানী। লক্ষ্যা-সঙ্গমের অদূরবতী সুবর্ণগ্রামের অবস্থিতি যে সামরিক দিক হইতে গুরুত্বময়, তাহা স্বীকার করিতেই হয়।