০১. যুক্তি – গ্রাম ও নগর-বিন্যাস

যুক্তিগ্রাম ও নগর-বিন্যাস

প্রাচীন বাঙলার সমাজ-বিন্যাসের বাস্তব উপাদান-বিবৃতি প্রসঙ্গে আমাদের বাস্তব সভ্যতার প্রাক-আর্য ভিত্তির কথা বলিয়াছি। কৃষিজীবী অস্ট্রিক ভাষাভাষী কৌমগুলির সভ্যতা ও সমাজ-ব্যবস্থা ছিল একান্তই গ্রামীণ; গ্রামকে কেন্দ্ৰ করিয়াই ইহাদের জীবনযাত্রা রূপায়িত হইত; অন্তত অস্ট্রিক ভাষাতত্ত্ব আলোচনায় এই সিদ্ধান্তই যুক্তিসঙ্গত বলিয়া মনে হয়। তাহা ছাড়া, সমাজতত্ত্বেরও আলোচনায় দেখা যায়, একান্ত কৃষিনির্ভর এবং ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কুটীরশিল্পনির্ভর সমাজে গ্রামগুলি সাধারণত খুব বড় হয় না, এবং সংখ্যায়ও বেশি থাকে না। কৃষিক্ষেত্র ও কৃষিকর্ম চালনার জন্য ঘরবাড়ি তৈরি ও দেহাবরণ রচনার জন্য যে-সব শিল্প একান্ত প্রয়োজন তাহার জন্য প্রচুর আসবাব বা উপাদানের প্রয়োজন হয় না, বহুসংখ্যক লোকেরও প্রয়োজন হয় না। উপরন্তু কৃষিযোগ্য ভূমি কোথাও এত সুপ্রচুর থাকে না যে নগরের মতো সীমাবদ্ধ স্বল্পস্থানে বহুসংখ্যক লোককে পালন করিতে পারে। সেইজন্যই গ্রাম যত বৃহৎই হউক-না কেন আয়তনে বা লোকসংখ্যায় কিছুতেই নগরের সঙ্গে সমকক্ষতা করিতে পারিত না, আজও পারে না। অধিকন্তু, নগরের প্রয়োজন মিটাইবার মতো কোথাও সুবিস্তৃত কৃষিক্ষেত্র থাকে না, থাকিতে পারে না; নগরের বাহিরে দেশের জনপদ জুড়িয়া সেই কৃষিক্ষেত্র বিস্তৃত থাকে, এবং সেই বিস্তৃত কৃষিক্ষেত্রে কৃষিকর্ম যাঁহাদের চালাইতে হয় তাহাদিগকে কৃষিক্ষেত্র আশ্রয় করিয়া নিকটেই বাস করিতে হয়। তাঁহাদের বসতিস্থানগুলিই গ্রাম। কৃষিনির্ভর সভ্যতা সেইজন্য গ্রামকেন্দ্ৰিক হইতে বাধ্য। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গৃহশিল্পগুলিও গ্রামকেন্দ্ৰিক, কারণ সেগুলি কৃষিকর্মেরই আনুষঙ্গিক এবং কৃষিজীবনের সঙ্গে অচ্ছেদ্যভাবে যুক্ত। কৃষিকর্ম পরিচালনার জন্য প্রধান ও প্রথম প্রয়োজন জল; জল যেখানে সহজলভ্য কৃষিকৰ্মও সেখানে সমৃদ্ধ। প্রাচীন বাঙলায় তাহাই দেখিতেছি। গ্রামগুলির পত্তনও সেইজন্যই সর্বত্র নদী, নালা, খাটিকা, খাল, বিল ইত্যাদির তীরে তীরে ৷ খাদ্য ও পানীয় যেখানে সহজলভ্য সেইখানেই তো মানুষের বসতি; কাজেই সেই বসতি জলপ্রবাহকে আশ্রয় করিয়া গড়িয়া উঠিবে, ইহা কিছু বিচিত্র নয়। গ্রাম্য কৃষিসভ্যতার বিকাশও সেইজন্য নদী, খাল, বিল, খাটিকার তীরে তীরে। প্রাচীন বাঙলায়ও ইহার ব্যতিক্রম হয় নাই।

নগরসভ্যতা সম্বন্ধেও একথা সত্য; কিন্তু তাহা অন্য প্রয়োজনে ৷ পানীয় জলের প্রয়োজন একটা নগরেও থাকে, কিন্তু সে পানীয় নদনদীর জলপ্রবাহ ছাড়া অন্য উপায়েও মিটানো যায়; যেমন, কূপের সাহায্যে খুব সুপ্রাচীন কালেও হইয়াছে। তবু, যেখানে স্বল্পমাত্র স্থান আশ্রয় করিয়া বহুলোক বাস করে সেখানে জলপ্রবাহের একটা প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। কিন্তু, ইহা ছাড়াও নগরসভ্যতা নদী ও প্রশস্ত যাতায়াত পথকে আশ্রয় করিবার অন্য একাধিক কারণ প্রাচীন কালে ছিল। নগর এক প্রকারের নয়, কিংবা একই প্রয়োজনে গড়িয়া উঠে নাই। রাষ্ট্রীয় শাসনকার্য পরিচালনার জন্য দেশের নানা জায়গায় কতকগুলি কেন্দ্র রচনার প্রয়োজন হইত; রাজকর্মচারীরা সেইখানে বাস করিতেন, রাজকর্মের জন্য সেখানে লোকেদের যাওয়া-আসা প্রয়োজন-হাইত, এবং এইসব বসতি ও যাতায়াত-পথ আশ্রয় করিয়া শাসনাধিষ্ঠানের সঙ্গে সঙ্গে হাট-বাজার ইত্যাদিও গড়িয়া উঠিত। প্রধানত যাতায়াতের সুবিধার জন্যই এই সব শাসনাধিষ্ঠানের কেন্দ্রগুলি গড়িয়া উঠিয়াছিল হয় নদীর তীরে, অথবা সুপ্রশস্ত রাজপথের পার্শ্বে অথবা দুইয়েরই আশ্রয়ে। রাজামহারাজদের রাজধানী ও জয়স্কন্ধাবারগুলি সম্বন্ধেও একই যুক্তি প্রযোজ্য; এবং এগুলিও গড়িয়া উঠিয়াছিল নদী বা রাজপথ বা উভয়েরই আশ্রয়ে। সৈন্যচালনা এবং সামরিক প্রয়োজনেও রাজধানী ও জয়স্কন্ধাবারগুলি সম্বন্ধেও একই যুক্তি প্রযোজ্য; এবং এগুলিও গড়িয়া উঠিয়াছিল নদী বা রাজপথ বা উভয়েরই আশ্রয়ে। সৈন্যচালনা এবং সামরিক প্রয়োজনেও রাজধানী ও জয়স্কন্ধাবারগুলি নদী এবং প্রশস্ত রাজপথ আশ্রয় করিত আর-এক শ্রেণীর নগর গড়িয়া উঠিত একান্তই ব্যাবসা-বাণিজ্য এবং বৃহত্তর শিল্পের প্রয়োজনে, যে-সব শিল্প প্রধানত বৃহত্তর ব্যাবসা-বাণিজ্যের সঙ্গে অচ্ছেদ্যভাবে যুক্ত অন্তত সেই সব শিল্পের প্রয়োজনে, যেমন নৌশিল্প, সমৃদ্ধ বস্ত্ৰশিল্প ইত্যাদি। এই সব ব্যাবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্র প্রশস্ত স্থলপথ বা জলপথ বা উভয়ই আশ্রয় না করিয়া গড়িয়া উঠিতে পারে না; এবং শুধু তাঁহাই নয়, সাধারণত দুইপথের সঙ্গম স্থলেই এই সব ব্যাবসা-বাণিজ্যকেন্দ্রের অবস্থিতি দেখা যায়। দুই পথ উভয়ই স্থলপথ বা উভয়ই জলপথ হইতে পারে, একটি স্থলপথ। অপরটি জলপথ হইতে পারে; আবার সামুদ্রিক ব্যাবসা-বাণিজ্যকেন্দ্ৰ হইলে একটি স্থল বা জলপথ, অপরটি সমুদ্রপথ হইতে পারে। তবে, সব নগরই যে একটি পৃথক পৃথক কারণে গড়িয়া উঠে তাহা নয়; বরং প্রাচীন বাঙলায় দেখা যায়, একাধিক কারণে এক-একটি নগরের পত্তন হইয়াছিল। শাসনাধিষ্ঠান বা রাজধানী বা বিজয়স্কন্ধাবার একই সঙ্গে ব্যাবসা-বাণিজ্যকেন্দ্র হওয়াও বিচিত্র নয়। প্রাচীন বাঙলায়ও তাহা হইয়াছিল। সদ্যকথিত প্রয়োজন ছাড়া অন্য প্রয়োজনেও কোনও কোনও নগর গড়িয়া উঠে; যেমন, এক-একটি স্থানের এক-একটি বিশেষ তীর্থমহিমা থাকে, এবং শুধু বিশেষ তিথি-পর্ব উপলক্ষে নয়, সম্বৎসর ধরিয়াই তীর্থপুণ্য কামনায় বহুলোক সেখানে যাতায়াত করে। এই সব তীর্থস্থানকে কেন্দ্ৰ করিয়া বহু লোকের বসতি প্রতিষ্ঠিত হয়, শিল্প ব্যাবসাকর্ম বিস্তৃতি লাভ করে এবং ধীরে ধীরে নগর গড়িয়া উঠে, এবং পরে হয়তো প্রয়োজন হইলে শাসনাধিষ্ঠানও প্রতিষ্ঠিত হয়। এই সব তীর্থকেন্দ্ৰে বৃহৎ শিক্ষাকেন্দ্ৰও সময় সময় গড়িয়া উঠিতে দেখা যায়, বিশেষভাবে ব্ৰাহ্মণ্য শিক্ষা ও সংস্কৃতির কেন্দ্র। বৃহৎ বৌদ্ধ শিক্ষাকেন্দ্রগুলির পত্তন হইত গ্রাম ও নগর হইতে একটু দূরে, বিহার ও সংঘগুলি আশ্রয় করিয়া। এগুলি ঠিক নগর নয়, কিন্তু নগরোপম। প্রাচীন বাঙলার এই রকম নগরোপম বৌদ্ধ-মহাবিহারের কিছু কিছু বিবরণও পাওয়া যায়। কিন্তু শিক্ষাকেন্দ্ৰই হউক আর তীর্থকেন্দ্ৰই হউক, এগুলিরও আশ্রয় ছিল নদনদী প্রভৃতি জলপ্রবাহ এবং প্রশস্ত যাতায়াত পথ। সমাজতত্ত্বের আলোচনায় দেখা যায়, যে-প্রয়োজনেই নগর গড়িয়া উঠুক-না কেন, প্রধানত তাঁহাদের অর্থনৈতিক নির্ভর বৃহৎশিল্প ও ব্যাবসা-বাণিজ্য; এবং শিল্প ও ব্যাবসা-বাণিজ্যের উন্নতির উপরই নগর-সভ্যতার উন্নতি-অবনতি অনেকাংশে নির্ভর করে, যেমন কৃষির উন্নতি-অবনতির উপর নির্ভর করে গ্রামের উন্নতি-অবনতি।

প্রধানত কৃষিনির্ভর গ্রাম সভ্যতা এবং প্রধানত ব্যাবসা-বাণিজ্যনির্ভর নগর-সভ্যতা এ দুইয়ের আকৃতি শুধু নয়, প্রকৃতিও বিভিন্ন। গ্রামের যাঁহাদের বাস করিতে হইত, তাহারা সাধারণত কৃষিনির্ভর ভূম্যধিকারী, মহত্তর, কুটুম্ব, কৃষক বা ক্ষেত্রকর, সমাজ-শ্রমিক, ভূমিহীন কৃষি-শ্রমিক, এবং কিছু কিছু কৃষি ও গৃহস্থ কর্মসম্পূক্ত শিল্পী। ইহাদের জীবনের কামনা-বাসনা, ভাবনা-কল্পনা, ধ্যান-ধারণা ইত্যাদি সমস্তই কৃষিকর্ম এবং গ্রাম্য গাৰ্হস্থ্য ধর্মকে আশ্রয় করিয়াই গড়িয়া উঠিত। নগরে যাঁহারা বাস করিতেন, তাহারা ক্ষুদ্র বৃহৎ সামন্ত, ক্ষুদ্র বৃহৎ রাজকর্মচারী শ্রেষ্ঠী, সার্থিবাহ, শিল্পী, বণিক ইত্যাদি, এবং ইহাদেরই অনুষ্ঠান-প্রতিষ্ঠান ইত্যাদিকে আশ্রয় করিয়া, উপলক্ষ করিয়া স্থায়ী-অস্থায়ী অন্যান্য বহুতর লোক। শুধু ইহারাই নন, ইহাদের দৈনন্দিন গাৰ্হস্থ্য প্রয়োজন এবং অন্যান্য আরও বহুতর প্রয়োজন মিটাইবার জন্য বহুতর সমাজ-শ্রমিকও। গ্রামে যে-সব কৃষি ও শিল্পদ্রব্য ইত্যাদি উৎপন্ন হইত। তাহাদের ক্ৰয়-বিক্রয়কেন্দ্র গ্রাম হইতে দূরে, নগরে-বন্দরে; কাজেই উৎপাদিত ধনের বণ্টনকেন্দ্র গ্রামে নয়। শাসনকেন্দ্র ও নগরে, বাণিজ্যকেন্দ্রও তাঁহাই। কাজেই সামাজিক ধনের বৃহত্তর গতি-কেন্দ্রই হইতেছে নগর; বণ্টন-ব্যবস্থাও প্রায় সবটাই নগরে। এই ব্যবস্থায় জাগতিক সুখ-সুবিধা যাহা কিছু, তাহাও বেশি ভোগ করিত নগরগুলিই; বিশেষত শিল্প-ব্যাবসা-বাণিজ্য যতদিন ধনগমের প্রথম ও প্রধান। উপায় ততদিন তো নগরগুলিই দেশের সর্বপ্রকার প্রচেষ্টার কেন্দ্ৰস্থল। অবশ্য, সমাজ যে পরিমাণে কৃষিনির্ভর সেই পরিমাণে গ্রামগুলিও প্রাধান্য লাভ করে। প্রাচীন বাঙলায়ও বোধ হয় তাহা হইয়াছিল; যে-সব প্রমাণ বিদ্যমান তাহা হইতে এই অনুমান করা চলে। তাহা ছাড়া, ইহাই সমাজ-বিবর্তনের গতি-প্রকৃতির ধারা।

এই সব কারণেই প্রাচীন বাঙলার সমাজ-বিন্যাসের পূর্ণতর পরিচয় পাইতে হইলে গ্রাম ও নগর-বিন্যাস সম্বন্ধে যতদূর সম্ভব সমস্ত তথ্যই জানা প্রয়োজন। দুঃখের বিষয়, অন্যান্য অনেক বিষয়ের মতন এ-বিষয়েও যথেষ্ট তথ্য-সাক্ষ্য আমাদের সম্মুখে উপস্থিত নাই। যাহা আছে তাহার মধ্যে লিপিগুলিই প্রধান এবং প্রামাণিক; কিছু কিছু সাক্ষ্য প্রমাণ সমসাময়িক সাহিত্যগ্রন্থাদি হইতেও পাওয়া যায়। তাহা ছাড়া, ধনসম্বল অধ্যায়ে ও সমাজ-বিন্যাস খণ্ডের বিভিন্ন অধ্যায়ে যে-সব তথ্যের আলোচনা করা হইয়াছে তাহা হইতে যুক্তিসিদ্ধ কিছু কিছু অনুমানও করা চলে। গ্রাম ও নগর সম্বন্ধে অনেক কথাই প্রসঙ্গক্রমে এই সব অধ্যায়ে বলা হইয়াছে; এই অধ্যায়ে সে-সবের পুনরাবৃত্তি না করিয়া মোটামুটি ভাবে গ্রাম ও নগরের সংস্থান, কিছু কিছু গ্রাম-নগরের বিবরণ, গ্রাম ও নগরের সম্বন্ধ, গ্ৰাম্য ও নগর সভ্যতা ও সংস্কৃতির পার্থক্য ইত্যাদি সম্বন্ধে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা যাইতে পারে।(১)

—————-
(১) এই অধ্যায়ে বাঙলার লিপি-সাক্ষ্যের এবং ইতিপূর্বে উল্লিখিত অন্যান্য সংক্ষ্যেরও পাঠনিৰ্দেশ দেওয়া হইতেছে না।