১০. সাতবাহন যুগ

সাতবাহন যুগ

রাষ্ট্র

মৌর্য যুগের পর পরপর শুঙ্গ ও কাণ্বরা রাজত্ব করে। মধ্যভারত ও দাক্ষিণাত্যে মৌর্য প্রভাব খুব কমই ছিল। মৌর্যরাজত্বের শ’খানেক বছর পরে মধ্যভারত ও দাক্ষিণাত্যে অন্ধ্র বা সাতবাহন রাজবংশ ক্ষমতায় আসে। এদের আগে এ অঞ্চলে যে সভ্যতা ছিল। তার পরিচয় রক্তাভ, লালকালো এবং মরা লাল রঙের মাটির পাত্র থেকে পাওয়া যায়। এরা লোহার ব্যবহার জানত, বড় পাথরের চাঁই দিয়ে স্থাপত্য তৈরি করত; আর্যাবর্তের মানুষের সংস্পর্শে এসে এরা লোহার ফলা-ওয়ালা লাঙল দিয়ে চাষ করতে ও ফসল রোওয়ার কাজ করতে শিখল। তা ছাড়া মাটি পুড়িয়ে ইঁট তৈরি করে সেই ইঁটের ঘাট-ওয়ালা কুয়ো, পোড়া মাটির চ্যাপটা টালি, মাটির নীচে ওপরে টালির ঢাকা দেওয়া নর্দমা তৈরি করাও আর্যাবর্তের প্রভাবে এ সময়ে দাক্ষিণাত্য শিখে নিয়েছিল। এ ধরনের উন্নতমানের স্বাস্থ্যসম্মত পরিকল্পনায় তৈরি ত্রিশটি শহর এ অঞ্চলে ছিল— এ কথা প্লিনির ভ্রমণ কাহিনিতে পাওয়া যায়। শহর গড়ে ওঠার পরে লেখার চল হল, সব মিলে একটা রাষ্ট্র তৈরি হওয়ার আয়োজন যেন সম্পূর্ণ হল— এই হল সাতবাহন রাজ্য, যে রাজবংশ শ’তিনেক বছর রাজত্ব করে। শুঙ্গদের পরে যে কাণ্ব বংশ সিংহাসনে আসে তাদের হারিয়ে দিয়ে এরা সে কথা যে শিলালিপিতে লিখে রাখে খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতকে সেইটিই প্রথম সাতবাহন শিলালিপি। মহারাষ্ট্রেই সাতবাহনরা তাদের ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করে। সেইখানেই তাদের বেশির ভাগ শিলালিপি পাওয়া যায়। গোদাবরীর উত্তরে উপত্যকা খুব উর্বর ছিল, ধান ছাড়াও নানা রকম ফসল ফলত। এখানেই সাতবাহনদের প্রথম অধিষ্ঠান। এখান থেকে ক্রমে কর্ণাটক ও অন্ধ্রে এরা ক্ষমতা বিস্তার করে। এরা আগে উত্তর দাক্ষিণাত্য ও পশ্চিম ভারতে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিল, ফলে এদের সঙ্গেই সংঘাত বাধে সাতবাহনদের। সাতবাহনরা জেতে এবং তাদের রাজা গৌতমীপুত্র সাতকর্ণী (১০৬-১৩০] খ্রিস্টাব্দ) বংশের প্রভাব পুনরুদ্ধার করেন। ইনি নিজেকে ‘একমাত্র ব্রাহ্মণ’ বলে অভিহিত করতেন। শুধু শকদের নয়, অন্যান্য নানা ক্ষত্রিয় বংশকেও ইনি ধ্বংস করেন। যে ক্ষহরাত বংশে এঁর শত্রু নহপান জন্মান, সাতকর্ণী সেই বংশকেই সমূলে উৎখাত করেন বলে দাবি করেন। তিনি সত্যিই তা করেছিলেন, কারণ নাসিকে নহপানের যে আট হাজার সোনার টাকা পাওয়া যায় সেগুলির ওপরে সাতবাহনদের ছাপ দেওয়া আছে। শকরাজ্যের এক বৃহৎ অংশ এই প্রভাবশালী রাজবংশের অধীনে চলে আসে, উত্তরে মালব থেকে দক্ষিণে কর্ণাটক পর্যন্ত সম্ভবত অন্ধ্রও এদের অধিকারভুক্ত ছিল।

খ্রিস্টিয় ২২০] সাল পর্যন্ত গৌতমীপুত্রের বংশধররা রাজত্ব করেন। এঁর ঠিক পরের রাজা বশিষ্ঠীপুত্র পুলুমায়ি (১৩০-১৫৪] খ্রিস্টাব্দ)-এর শিলালিপি ও মুদ্রা যা অন্ধ্রে পাওয়া গেছে, তার থেকে মনে হয় এ অঞ্চল সাতবাহনদের বিস্তৃত রাজ্যেরই অংশ ছিল। রাজধানী ছিল প্রতিষ্ঠান বা পৈঠান, গোদাবরী নদীর ধারে ঔরঙ্গাবাদ জেলায়। কোস্কান ও মালব অঞ্চল খুব সমৃদ্ধ ছিল বলে শকরা সেগুলো ফিরে পাওয়ার জন্যে সাতবাহনদের সঙ্গে আবার যুদ্ধ করে। সৌরাষ্ট্রের শক রাজা প্রথম রুদ্রদামা (১৩০-১৫০] খ্রিস্টাব্দ) দু’ বার যুদ্ধে সাতবাহনদের হারিয়ে দেন; কিন্তু দুই রাজবংশের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক ছিল বলে একেবারে ধ্বংস করেননি। সাতবাহনদের শেষ দিকের এক রাজা যজ্ঞশ্রী সাতকর্ণী (১৬৫-১৯৪) উত্তর কোস্কন ও মালব শকদের কাছ থেকে যুদ্ধে জিতে নেন। অন্ধ্র, মহারাষ্ট্র, মধ্যপ্রদেশ ও গুজরাটে এঁর মুদ্রা পাওয়া যায়; সে সব মুদ্রায় জাহাজের ছবি থেকে এঁদের নৌযাত্রা ও নৌবাণিজ্যে আগ্রহ বোঝা যায়।

সমাজ

আদিতে সাতবাহনরা দাক্ষিণাত্যের একটি জনগোষ্ঠী ছিল, পরে কোনও উপায়ে এরা ব্রাহ্মণ হয়ে যায়। এরা এতটাই বর্ণসচেতন ছিল যে রাজা গৌতমীপুত্র সাতকর্ণী তাঁর রাজ্যে চারটি বর্ণে বিভাজন আবার দৃঢ় ভাবে প্রতিষ্ঠিত করেন, কারণ, সেটা নাকি তাঁর আগে শিথিল হয়ে গিয়েছিল। কঠোর নিয়ম চালু করে বর্ণগুলির মধ্যে অন্তর্বিবাহ একেবারে বন্ধ করে দেওয় হয়; মনে হয় শকদের প্রভাবে এ ধরনের অন্তর্বিবাহ চালু হয়েছিল। বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের জমি দিয়ে সাতবাহনরা রাজ্যে তাঁদের বসতি করান। প্রথম দিকের বৌদ্ধগুহাগুলি বাণিজ্যপথের ওপরেই তৈরি হয়েছিল বলে মনে হয়; সে বণিকরাও বৌদ্ধদের পৃষ্ঠপোষক ছিল। সাতবাহনরা বৌদ্ধদের অনেক বেশি জমি দিলেও ব্রাহ্মণদেরও বেশ কিছু জমি দেন।

নিজেরা ব্রাহ্মণ বলে গর্ব করলেও সাতবাহনদের আর্যাবর্তের লোকেরা নিচু চোখে দেখত। রাজারা ব্রাহ্মণ হলেও সাতবাহন রাজ্যে বণিকদের যথেষ্ট প্রাধান্য ছিল, বিশেষত গন্ধবণিকদের (গন্ধিক, ‘গান্ধী’ শব্দটি এর থেকে এসেছে); তখন সব বণিককেই সাধারণ ভাবে গন্ধিক বলা হত, এরা বৌদ্ধদের দান করত এবং ছোট ছোট পাথরে সে-দানের কথা খোদাই করে রাখত।

সাতবাহনদের পরিবারে সম্ভবত নারীর স্থান খানিকটা উঁচুতেই ছিল, ‘গৌতমীপুত্ৰ’ ‘বাশিষ্ঠীপুত্র’ এ সব মায়ের নামে ছেলের নাম দেখে তাই মনে হয়। ওই বংশের কিছু কিছু রানিরা নিজেরাই দান করত এমন নজির আছে। তথাপি সাধারণ ভাবে এদের পরিবার পুরুষতান্ত্রিকই ছিল এবং ব্রাহ্মণ্যপ্রভাব সেখানে বেশ লক্ষণীয়। হয়তো ব্রাহ্মণ হওয়ার আগে গোষ্ঠীজীবনে মায়ের পরিচয়ে ছেলে পরিচিত হত, সেই চিহ্নই রয়ে গেছে ওই নামগুলিতে।

রাজার অপ্রতিহত প্রতাপ ছিল এবং রাজাকে দেবতার প্রতিনিধি মনে করা হত। মৌর্য আমলের মতো অমাত্য মহামাত্রদের হাতে শাসনের ভার ছিল। সেনাবাহিনীরও বিশেষ প্ৰতাপ ছিল, সেনাপতিই ছিল প্রদেশের শাসনকর্তা। দাক্ষিণাত্যের সমস্ত অঞ্চলই তো হিন্দু হয়ে যায়নি, অহিন্দু অধিবাসীদের শাসনের অধীনে রাখবার জন্যে হয়তো সেনাবাহিনীকে প্রধান্য দেওয়ার দরকারও ছিল। ‘কটক’, ‘স্কন্ধাবার’ (সেনানিবাস), ‘গৌল্মিক’ (একটি মাঝারি সেনাদলের নেতা), এ সব শব্দে সাতবাহন রাজ্যে সৈন্যদলের প্রাধান্য বোঝা যায়।

বৌদ্ধ শ্রমণ ও ব্রাহ্মণরা খাজনা থেকে ছাড় পেতেন; রাজার দানে পাওয়া গ্রামগুলির পুরো স্বত্ব এঁরা ভোগ করতেন। ‘রাজা’, ‘মহাভোজ’ ও ‘সেনাপতি’— শাসনকর্তাদের এই তিনটি ভাগ ছিল। ব্রাহ্মণত্বের গর্বে সাতবাহনরা সাড়ম্বরে অশ্বমেধ, বাজপেয় এ সব বড় বড় যজ্ঞও করেছিলেন ও পুরোহিতদের প্রচুর দক্ষিণাও দিয়েছিলেন। ধর্মমতে এঁরা কৃষ্ণ-বাসুদেবের ভক্ত বৈষ্ণব ছিলেন। তা সত্ত্বেও এঁদের সময়ে যে-মহাযান বৌদ্ধধর্মের অভ্যুত্থান হয়, সেই মতের অনুগামী শ্রমণদের এবং মঠ চৈত্য বিহারেও এঁরা প্রচুর দান করতেন। অন্ধ্রে নাগার্জুনকোণ্ডা, অমরাবতী এবং মহারাষ্ট্রে জুনাগড় ও নাসিকেও বৌদ্ধ প্রতিষ্ঠান ছিল, সেগুলিতে সম্ভবত বণিকদের প্রচুর অনুদান ছিল।

ধর্মীয় চৈত্যবিহার নির্মাণেও রাজা ও ধনী বণিকদের অনুদান ছিল। বুদ্ধের নামে যে ধর্মমন্দির তৈরি হত তার নাম চৈত্য। দাক্ষিণাত্যের উত্তর পশ্চিম দিকে ও মহারাষ্ট্রে খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতক থেকে যে সব চৈত্যনির্মাণ শুরু হয়, সাতবাহন আমলে সেগুলি সংখ্যায় বাড়তে থাকে। পশ্চিম দাক্ষিণাত্যে কার্লের চৈত্যটি আকারেও যেমন বড় এর পাথরের ভাস্কর্যও তেমনই উন্নতমানের। বিহার হল চৈত্যমন্দিরের কাছাকাছি শ্রমণদের বাসস্থান। নাসিকের তিনটি বিহারে সাতবাহন রাজা নহপান ও গৌতমীপুত্রের শিলালিপি পাওয়া যায়; এগুলি খ্রিস্টিয় দ্বিতীয় শতকের। স্তূপ হল পাথরের একটি উঁচু গোলাকৃতি গঠন, বুদ্ধের দেহাবশেষের কোনও অংশ ভেতরে রেখে এটি গাঁথা হয়। সাতবাহন আমলে বেশ কয়েকটি স্তূপ পাওয়া যায়, তার মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত অমরাবতীরটি। খ্রিস্টিয় দ্বিতীয় শতকে নির্মিত হওয়ার কিছুকাল পরে এটি ভেঙে পড়ে ও পরে এটিকে নতুন করে নির্মাণ করা হয়। আকারে এটি প্রকাণ্ড এবং গায়ের পাথরে ভাস্কর্যগুলি খুবই সুন্দর। নাগার্জুনকোণ্ডার নির্মাণ খ্রিস্টিয় দ্বিতীয়-তৃতীয় শতকে এবং এতে শুধু বৌদ্ধ নয়, প্রথম দিকের কিছু কিছু ব্রাহ্মণ্য মন্দিরও আছে। এগুলি পোড়া ইঁটের তৈরি। চব্বিশটির মতো বৌদ্ধ মঠ, একটি মহাচৈত্য ও বিহার ছাড়াও ভাস্কর্যে স্থাপত্যে এটি বোধহয় খ্রিস্টিয় প্রথম দু-তিন শতকের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য শিল্প নিদর্শন।

সাতবাহনের শিলালিপিগুলি সবই ব্রাহ্মীলিপিতে ও প্রাকৃত ভাষায় রচনা— অশোকের শিলালিপির মতোই। এ সময়কার হাল নামে এক রাজার লেখা খণ্ডকাব্য গাহাসত্তসঈ (গাথাসপ্তশতী) সাতশো প্রাকৃত শ্লোকে রচিত। এর অনেকগুলি শ্লোকই ভাল কাব্য!

সাতবাহনরা হিন্দু হলেও এক সময়ে দাক্ষিণাত্যের প্রজাদের মধ্যে বৌদ্ধ ও হিন্দু দুই-ই ছিল। সাধারণ গৃহস্থ মানুষ যজ্ঞ করতে পারত না। রাজা বা ধনী বণিকরা যজ্ঞ করত। সাধারণ লোক গৃহ্যকর্ম (অন্নপ্রাশন, শ্রাদ্ধ, ইত্যাদি দশকর্ম) করত, কিন্তু সম্ভবত অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আর্যাবর্তে ব্রাহ্মণ্য প্রভাব আসবার আগে তাদের সমাজে যে ধরনের লৌকিক অনুষ্ঠানের চল ছিল তাই মেনে চলত। যারা বৌদ্ধ বা জৈন ধর্ম গ্রহণ করেছিল তারাও গার্হস্থ্য জীবনে পুরোনো অনুষ্ঠানই করত, ধর্মাচরণে চৈত্য-মঠ-স্তূপ-বিহারে ফুল, ধূপ-দীপ দিয়ে বুদ্ধমূর্তির পূজা করত। ততদিনে মহাযান মত সমাজে এসে গেছে, বুদ্ধ শুধু পথপ্রদর্শক নন, স্বয়ং ভগবান; তাই আগের পন্থায় (পরে লোকে যার নাম দিয়েছিল হীনযান) যেমন শুধু পদচিহ্ন প্রতীকী ছত্র, পাদপদ্ম, চক্র, ইত্যাদির পূজা হত এখন তেমন নয়। মহাযান মতাবলম্বীরা বুদ্ধের মূর্তি প্রতিষ্ঠা করে রীতিমত ব্রাহ্মণ্য রীতিতে পূজা করত। এই সময়ে আর্যাবর্তে ও দাক্ষিণাত্যে মহাযান বৌদ্ধধর্মের নজিরের জোরে প্রাগার্য সমাজে মূর্তিপূজা যেমন প্রচলতি ছিল, তেমনই অন্যান্য পুরোনো নানা দেবতা আবার দেখা দিল, ক্রমে ধর্মাচরণের পদ্ধতিতে অন্য সব কিছুকে ছাপিয়ে উঠল পূজা।

দাক্ষিণাত্যে কৃষ্ণ নদীর দক্ষিণে প্রাচীনকালে তিনটি বিখ্যাত রাজ্য ছিল, চের (কেরল), চোল (তামিলনাড়ু) ও পাণ্ড্য (তামিলনাড়ুর দক্ষিণ থেকে কন্যাকুমারিকা পর্যন্ত)। খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকে চোল রাজ্যের প্রতাপ এত বেড়েছিল যে তখন এরা তাম্রপর্ণী (শ্রীলঙ্কা) জয় করে পঞ্চাশ বছর সেখানে রাজত্ব করেছিল। খ্রিস্টিয় দ্বিতীয় শতকে রাজা কারিকলের আমলে এদের শক্তি আরও বাড়ে। পুহার (কাবেরীপত্তনম) ছিল চোল রাজধানী; শিল্প বাণিজ্য থেকে চোলদের সমৃদ্ধি খুবই বেড়েছিল। কারিকলের পরে চোল প্রতাপ কমে যায়, চের ও পাণ্ড্যের প্রভাব তখন বাড়ে। খ্রিস্টিয় প্রথম কয়েকটি শতকের ঐশ্বর্য ও প্রতিপত্তিতে কেরল রোমের সমকক্ষ ছিল; সুদূর মিশর ও আরবদেশ ও রোমের সঙ্গে এদের বাণিজ্য সম্পর্ক ছিল। চের ও চোলের মধ্যে দ্বন্দ্ব লেগেই থাকত, যুদ্ধ হত প্রায়ই এবং খ্রিস্টিয় দ্বিতীয় শতকের পর থেকে চের রাজশক্তি ক্রমে ক্ষীণ হতে থাকে। তা সত্ত্বেও সে কয়েক শতক কোনও রকমে টিকে থাকে, অষ্টম শতকের পর এর আর বিশেষ কিছু শক্তি অবশিষ্ট রইল না। দক্ষিণপূর্বের পাণ্ড্যরাজ্যের রাজধানী ছিল মাদুরাই। প্রথম শতক থেকে এ অঞ্চলে যে-সাহিত্য গড়ে ওঠে তা ‘সঙ্গম’ সাহিত্য বলে পরিচিত; এতে পাণ্ড্য রাজশক্তিই বেশি করে প্রতিফলিত।

তিনটি রাজ্যের সঙ্গেই বহির্বাণিজ্য ছিল মধ্যপ্রাচ্য হয়ে ইয়োরোপ এবং চিন, মালয়েশিয়া ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার। এদের নিজস্ব সমৃদ্ধি খুব উঁচুমানের ছিল; কৃষি ও শিল্পের উদ্বৃত্ত নিয়ে বাণিজ্যের যথেষ্ট রমরমা ছিল। বিশেষত হাতি, চন্দনকাঠ, চাল, রেশমি কাপড়, হাতির দাঁতের তৈরি শিল্পবস্তু, সোনা, মুক্তা, দামি পাথর ও মশলা প্রচুর পরিমাণে রপ্তানি হত। শিল্পের উন্নতি খুব বেশি ছিল, সুতোর কাপড় এরা এত মিহি বুনতে পারত যে সাপের খোলসের মতো দেখতে হত। চাল ও মশলা রফতানিতে এত প্রতিপত্তি ছিল যে চাল, আদা, দারচিনি, ইত্যাদি কয়েকটি বস্তুর গ্রিক নাম তামিল থেকেই নেওয়া। খ্রিস্টিয় প্রথম শতকে যখন মৌসুমি বাতাস সম্বন্ধে মানুষ যথার্থ বৈজ্ঞানিক জ্ঞান অর্জন করল তখন নৌবাণিজ্য অনেক নিরাপদ হল এবং জাহাজগুলি ঘনঘন যাতায়াত করতে পারল। ফলে এ দেশি বণিকরা ক্রমেই ধনী হয়ে উঠতে লাগল, রাজারা বেশি রাজস্ব পেতে লাগল।

সমৃদ্ধি যখন বাড়ল তখন রাজকোষে যে অর্থ যেত তা ছাড়া বাকিটা জমত মুষ্টিমেয় ধনীর হাতে, গরিব গরিবই থেকে গেল। এই মুষ্টিমেয় ধনীরা কড়া হাতে শাসন করত গরিবদের, শ্রেণিভেদ ক্রমেই কঠোর হচ্ছিল। উদ্বৃত্ত ঐশ্বর্যের অনেকটাই যেত ব্রাহ্মণ পুরোহিত ও শাস্ত্রকারদের হাতে, রাজার দেওয়া দান ও দক্ষিণা হিসেবে। অতএব শাস্ত্রকার ও পুরোহিতরা রাজা ও বণিকের ঐশ্বর্য বৃদ্ধির জন্যে সর্বদা সচেষ্ট থাকত। গরিবের কোনও স্পর্ধা বা প্রতিবাদ সহ্য করা হত না বলাই বাহুল্য। তথাকথিত নিম্নশ্রেণির মানুষ, বিশেষত, চাষিদের বলা হত ‘পারিয়ার’, যে শব্দটা আজও নিচু বর্গের মানুষের প্রতি উচ্চবর্গের মানুষের তাচ্ছিল্য ও ঘৃণা বোঝায়। এরা জীবনযাত্রার মান, জাতি ও অবস্থায় সমাজের নিচুতলায় থাকত, কোনও রকম রাজপ্রসাদই এই খেটে-খাওয়া দুঃখী মানুষগুলির কাছে পৌঁছত না। রাজার সঞ্চিত ধনের আর এক অংশ যেত গুণী, শিল্পী, কবিদের কাছে, রাজার দেওয়া শিরোপা বা ইনাম হিসেবে। সমাজ তো শুধু শ্রেণিবিভক্তই ছিল না বহুবর্ণেও বিভক্ত ছিল। কাজেই রাজার কাছে যারা পুরস্কার বা বৃত্তি পেতেন তাঁরাও চাইতেন রাজারা বর্ণবিভাগ ও শ্রেণিবিভাগ যেন ঠিকঠাক মেনে চলেন।

পাকা বাড়িতে থাকত ধনীরা, গরিবরা কুঁড়েঘরে। পরের যুগে বর্ণবিভেদ যত কট্টর হয়েছিল এখন ততটা না হলেও ব্রাহ্মণ্য প্রভাবে নিচু জাতের মানুষের কোনও মানবিক মর্যাদা ছিল না। রাজরাজড়া ও ধনী বণিকরাই যাগযজ্ঞ করাতেন। কিন্তু পার্বত্য অঞ্চলের পুরোনো দেবতা মুরুগান সাধারণ মানুষের পুজো পেতেন, পরে এঁর ব্রাহ্মণ্য নাম হয় সুব্রহ্মণ্য। বিষ্ণুর উপাসনা সম্ভবত কিছু দেরিতে আসে। শবের অন্ত্যেষ্টি সম্বন্ধে লোকে পুরনো রীতিই মেনে চলত; অর্থাৎ জিনিসপত্র সুদ্ধ শবের সমাধি দিত। পরে অবশ্য ব্রাহ্মণ্যরীতিতে শবদাহ চলিত হয়, যদিও পাশাপাশি সমাধিও চলতে থাকে।

শিল্প সাহিত্য

তামিলনাড়ুতে লেখার প্রচলন অন্তত খ্রিস্টিয় প্রথম শতকের আগে থেকেই ছিল। মাদুরাইয়ের এক গুহায় ব্রাহ্মীলিপিতে পঁচাত্তরটির মতো শিলালেখ পাওয়া যায়। তামিল ও প্রাকৃতের মিশ্র সংস্করণ ‘মণিপ্রবাল’ ভাষার আদিমতম নিদর্শন এগুলি, এর সূত্রপাত খুব সম্ভব খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয়-প্রথম শতক থেকে; ওই সময়েই জৈন ও বৌদ্ধ ধর্মপ্রচারকরা দাক্ষিণাত্যে আসেন। মাটির খাপরাতে কিছু লেখা সম্প্রতি প্রত্নখননে পাওয়া গেছে, কাজেই তামিল লিখিত সাহিত্য খ্রিস্টিয় প্রথম শতকের কিছু আগে থেকেই সম্ভবত ছিল। মাদুরাইয়ে রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতায় সঙ্গম সাহিত্য পুষ্টি ও প্রসার লাভ করে, খ্রিস্টিয় ষষ্ঠ শতকের পর এ সাহিত্য আর রচিত হয়নি। এর থেকেই আমরা প্রাচীন তামিল জীবনযাত্রার খবর পাই। এখন যে সঙ্গমসাহিত্য পাওয়া যায় তার সম্পাদনা হয় খ্রিস্টিয় তৃতীয় থেকে ষষ্ঠ শতকের শেষের মধ্যে। এতে আঠারোটি ‘মহারচনা’ (মেলকন্নকু), তার মধ্যে আটটি কাব্য সংকলন ও দশটি কল্পকাহিনি। অধিকাংশ রচয়িতা প্রাকৃত ও সংস্কৃত পণ্ডিত ছিলেন। এ রচনাগুলিতে রাজা ও প্রজার আচরণবিধি সম্বন্ধে নির্দেশ দেওয়া আছে। এ সাহিত্য থেকে সমাজে শ্রেণিবৈষম্য, সামাজিক মূল্যবোধ, ধর্মবিশ্বাস, ধর্মাচরণ, শিল্পকর্ম ও সাহিত্যরচনার কথাও জানতে পারি; নগরপত্তন, নগরশাসন ও গ্রামজীবনের কথাও পাই। সূর্য-চন্দ্র বংশ থেকে রাজাদের উৎপত্তি, ধর্মযাজক ও শাস্ত্রকার ব্রাহ্মণদের উদ্দেশে মুক্তহস্তে রাজার দান, এ সবই বিবৃত আছে সঙ্গমসাহিত্যে। এর বিখ্যাত বই হল তালকাপ্রিয়ম, এটিতে পাই ব্যাকরণ ও অলংকার শাস্ত্রের বিধি। মহাকাব্যগুলির মধ্যে বিখ্যাত তিরুক্কুরাল, শাস্ত্রীয় বিধিনিষেধের সংকলন। শিলল্পদিক্রম ও মণিমেকলাই— দুটিই কাব্যগুণে সমৃদ্ধ, হৃদয়স্পর্শী বিরহমিলনের কাহিনি, সাহিত্যমূল্যে মূল্যবান। শিলল্পদিকরম এ মাধবী ও কোবলম নামের নায়ক-নায়িকার কাহিনি, তাদেরই কন্যা মণিমেকলাই-এর নায়িকা, এতে আবেগ ভক্তির স্তরে পৌঁছেছে।

মৌর্যযুগের পর থেকে সাতবাহনের যুগ পর্যন্ত এবং দাক্ষিণাত্যে চের, চোল ও পাণ্ড্য রাজ্যের বিকাশের কালে ভারতবর্ষের কৃষি, শিল্প ও বাণিজ্যের যে বিকাশ হয় তা তার আগে বা পরে বহুদিন হয়নি, এর মধ্যেও শ্রেষ্ঠ অবশ্য কুষাণ যুগ। দীর্ঘনিকায়-তে অনেক পেশার নাম আছে; পরবর্তী কালের মিলিন্দপঞহ-তে প্রায় তিনগুণ বেশি পেশার উল্লেখ আছে। দৈনন্দিন প্রয়োজনের খাদ্যবস্ত্র, মন্দির, বাসস্থান, যানবাহন, তৈজসপত্র, আসবাব বাদেও বিস্তর শৌখিন জিনিস তৈরির কথা আছে। সোনারুপো ও মণিমুক্তোর গহনা, বিলাসের ছোট ছোট সুন্দর উপকরণ, গন্ধদ্রব্য, হাতির দাঁতের শিল্পদ্রব্য, চন্দনকাঠের, পুঁতির ও হাড়ের কাজ, রেশমি কাপড়, নানা ধরনের খোদাই, মুদ্রানির্মাণ, ইত্যাদির উল্লেখ আছে।

এ সব সম্ভব হয়েছিল কারণ, জনপদের বিস্তার ঘটছিল, শহর বাড়ছিল। গ্রামে ছিল খাদ্যবস্ত্র উৎপাদন ও ছোট ছোট শিল্পদ্রব্য উৎপাদনের কারখানা। শহরে প্রশাসন ছাড়াও কিছু কিছু শিল্পচর্চার অবকাশ ছিল। কাজেই বোঝা যায়, বহু প্রকারের পণ্য উৎপাদনের জন্যে যে ধরনের বিজ্ঞান প্রযুক্তিজ্ঞানের দরকার ছিল তা তখন ভারতবর্ষীয় বিজ্ঞানী ও প্রযুক্তিবিদদের অধিগত ছিল। এ ধরনের পণ্যের চাহিদা বেড়েছিল, কারণ ফসল, মশলা, পশু, পশুজাত দ্রব্য থেকে নির্মিত শিল্পবস্তু, বিভিন্ন ধাতু ও দামি পাথরের অলংকার, রেশমি কাপড়, ইত্যাদির জন্যে গ্রিস, রোম, চিন, মিশর, সিরিয়া, আরব, পারস্য এবং দূরপ্রাচ্যের ব্রহ্মদেশ, মালয়েশিয়া, যবদ্বীপ পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলের সঙ্গে বর্ধিষ্ণু এক বহির্বাণিজ্যের দীর্ঘ ইতিহাস ছিল। দুটি রেশমপথের একটি চিন থেকে উত্তর পশ্চিম ভারতবর্ষে তক্ষশিলা পেরিয়ে ভৃগুকচ্ছে, অন্যটি ইয়োরোপ, মধ্যপ্রাচ্য হয়ে মধ্যভারতে পৌঁছত। মথুরা ও উজ্জয়িনী ছিল দুটি উন্নত শহর। গুপ্তযুগে কালিদাস ও শূদ্রক উজ্জয়িনীর ঐশ্বর্য, শিল্পচর্চা ও বিলাসবহুল জীবনের বর্ণনা দিয়েছেন। উজ্জয়িনী থেকে বহুমূল্য রত্ন রফতানি হত দূর বিদেশে, বিনিময়ে আসত বিলাসের নানা উপকরণ। পশ্চিমে ভৃগুকচ্ছ ও সোপর এবং পূর্বে তাম্রলিপ্ত ও আরিকামেডুতে বিদেশগামী বণিকদের জাহাজ এসে ভিড়ত।

অর্থনীতি

এই ধরনের নগরকেন্দ্রিক সভ্যতার ঐশ্বর্যের ইতিহাস একটানা চলে খ্রিস্টিয় তৃতীয় শতক পর্যন্ত। ওই সময়ে রোম সাম্রাজ্য ভারতবর্ষের সঙ্গে বাণিজ্য বন্ধ করে। ফলে নগরগুলি আর করিগর ও বণিকদের আর্থিক দায়িত্ব বহন করতে পারল না। শহরের শ্রীবৃদ্ধি কমে গেল: শুধু আর্যাবর্তে নয়, দাক্ষিণাত্যেও একটা পর্বের নাগরিক ঐশ্বর্য ক্রমে ক্ষীণ হতে লাগল।

পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো এ দেশেও প্রথমে বিনিময় প্রথা চালু ছিল, গরুর বদলে গম বা কাপড়। পরে ষোড়শ মহাজনপদের যুগে কড়ি, স্বর্ণরেণু ও মুদ্রার চল হয়। তবে বেশির ভাগ আদানপ্রদান হত বণিকদের মধ্যে, সাধারণ মানুষের বিনিময়প্রথা ও কড়ি দিয়েই কাজ চলে যেত। শক-পহ্লব-কুষাণ যুগেই প্রথম মুদ্রার চল বাড়ে। তখনকার বহু গ্রাম ও শহরে বড় বড় মুদ্রার সঞ্চয় বেরিয়েছে; মনে হয়, রাজা বা বড় বণিক ছাড়াও গ্রামীণ শিল্পীদের যে ‘পূগ’ বা ‘শ্রেণি’ (যারা শিল্পীদের স্বার্থ দেখত), তাদের হাতেও বেশ বেশি পরিমাণে মুদ্রা জমত। দেশের বেশ বড় একটা অংশের কেনার ক্ষমতা যে বেড়েছিল তাও খানিকটা বোঝা যায়। তবে এ অংশটা আগের তুলনায় বড় হলেও সারা দেশের তুলনায় ছোটই। এ সময়কার অধিকাংশ চাষি বা কারিগর বা ছোটখাট পেশায় নিযুক্ত কর্মীরা খুবই গরিব ছিল। ব্রাহ্মণ্য ও বৌদ্ধ দুই সাহিত্যেই তার প্রচুর নিদর্শন আছে। দাসদাসীদের নির্যাতন, সাধারণ মানুষের অভাব, রোগব্যাধি, হতাশা নেহাৎ ছোটখাট প্রয়োজন অপূর্ণ থাকা, খেতে, পরতে না পাওয়া ক্রীতদাসপ্রথা, অত্যাচার, ধর্মীয় অধিকর্তাদের নিপীড়ন সব মিলে অধিকাংশ লোকের কাছেই দুর্বহ বোধ হত।

বৌদ্ধধর্ম শেখাচ্ছিল সৎ ভাবে জীবনযাপন করলে, সাধ্যমতো দান ধ্যান ও মুখ বুজে উচ্চবর্ণের ধনীদের সেবা করলে অর্হৎ থেকে নির্বাণ পর্যন্ত একটা বড় রাস্তা খোলা আছে। ব্রাহ্মণ্য ধর্ম বলেছিল ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয়, বৈশ্যের যথাবিধি দাসত্ব ও সেবা করলে শূদ্র বহুজন্ম পরে মোক্ষে পৌঁছতে পারে। দুই ধর্মই শেখাচ্ছিল দুঃখী দরিদ্রের দুঃখ, এ জন্মের কোনও কাজের ফল নয়, বিগত কোনও এক জন্মের পাপের ফল। এবং এ ফল আরও কিছু জন্ম ধরে তাকে পীড়ন করতে পারে। তবে পুরোহিতদের নির্দেশ মেনে চললে কোনও সুদূর ভবিষ্যতে জন্মান্তরের ভয়াবহ চক্র থেকে তারা মুক্তি পেতে পারে। অর্থাৎ দৈনন্দিন জীবনে নানা রকম কষ্ট, আতঙ্ক, পীড়ন এবং মনের জগতে অতীত ও ভবিষ্যৎ জন্ম সম্বন্ধে অনির্দেশ্য আতঙ্ক— এই ছিল সাধারণ মানুষের জীবন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *