০৫. বেদবিরোধী ধর্মধারা : জৈন ও বৌদ্ধধর্ম

বেদবিরোধী ধর্মধারা: জৈন ও বৌদ্ধধর্ম

নানা ব্যাপার উপনিষদের ধারাকে প্রভাবিত করেছিল। সম্ভবত ঋগ্বেদের সময় থেকেই, হয়তো বা প্রাগার্য সমাজের অংশবিশেষেই, কিছু মানুষ সন্ন্যাস সাধন করত। মনে পড়ে, সিন্ধুসভ্যতার উৎখননে পাওয়া যোগী মূর্তি, মনে পড়ে ঋগ্বেদ-এর ‘ইন্দ্র’ ‘যতি’দের ছেড়ে দিচ্ছেন শলাবৃক (হিংস্র প্রাণী) দের কাছে। অথবা, ‘রুদ্র মুনির সঙ্গে বিষপান করছেন।’ আবার খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে বুদ্ধ তাঁর সাধনার পথে আরাড় কালাম, রুদ্রক রামপুত্র, নির্গ্রন্থ জ্ঞাতপুত্র, অজিত কেশকম্বলী, পূরণ কাশ্যপ, মস্করী গোশাল, প্রভৃতি নানা সন্ন্যাসীর দেখা পেয়েছিলেন। তাঁদের প্রত্যেকেরই বেশ কিছু শিষ্য ছিল। অর্থাৎ, ভারতবর্ষে অন্তত খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম-সপ্তম শতক থেকেই নানা সন্ন্যাসী সম্প্রদায় ছিল। এরা কেউ বেদ বা যজ্ঞে বিশ্বাস করত না, কেউ কেউ জন্মান্তরে বিশ্বাস করত।

সাধারণ মানুষ দেখত, এরা দুরাচার নয়, যজ্ঞ ও বেদচর্চা না করেও এরা দিব্যি খেয়ে পরে বেঁচে আছে, কাজেই বেদ না মেনেও সৎ ও সুখী জীবনযাপন করা যায়। মানুষ এও দেখত যে, যে-উদ্দেশ্যে যজ্ঞ করা হত তা সব সময়ে পাওয়া যায় না। তা ছাড়া যারা নিজেরা দরিদ্র বলে যজ্ঞ করাতে পারে না, পুরোহিত নয় বলে নিজেরা যজ্ঞ করতে পারছে না, ব্রাহ্মণ নয় বলে যাদের উপনয়ন হয়নি, অতএব প্রত্যক্ষ ভাবে যারা বৈদিক যজ্ঞধর্মে অনধিকারী, তারা দেখল একটা বিকল্প জীবনের ধারা আছে, বিকল্প ধর্মাচরণেরও। এরা বিভিন্ন বেদবিরোধী দলে যোগ দিল।

বেদবিরোধী প্রস্থানের মধ্যে প্রধান হল জৈন, বৌদ্ধ ও আজীবিক। এদের মধ্যে জৈনধর্ম বৌদ্ধধর্মের আগেকার। মহাবীর সিদ্ধার্থের কিছু আগে থেকেই তাঁর ধর্ম প্রচার শুরু করেন। জৈনধর্মই প্রথম বর্ণবিভেদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায়। এ ধর্মে কয়েকটি নীতি আছে: অহিংসা, চুরি না করা, মিথ্যা না বলা, সম্পত্তি অর্জন না করা ও ব্রহ্মচর্য পালন করা। প্রথম চারটি আগে থেকেই ছিল, পঞ্চমটি মহাবীর যোগ করেন। জৈনধর্মে দেবতাদের স্থান জিন এর নিচে, ধর্মে যে সিদ্ধি লাভ করেছে সেই জিন। এ ধর্মে অনুষ্ঠান নেই বললেই চলে, নিজের সাধনায় চিত্তকে বন্ধনমুক্ত করাই এর লক্ষ্য; এটা ঘটে জ্ঞান, বিশ্বাস ও নীতিসঙ্গত কর্মের দ্বারা। এই তিনটিকে বলে ত্রিরত্ন।

জৈনধর্ম

জৈনরা শিক্ষিত লোকের ভাষা সংস্কৃতের বদলে শাস্ত্র ও কাব্য রচনায় অধর্মাগধী প্রাকৃত ব্যবহার করেন। এতে সাধারণ লোকের বুঝতে সুবিধে হত, কারণ এ ভাষা তাদের কথ্য ভাষার কাছাকাছি। এঁরা বেশ বড় একটি সাহিত্যসম্ভার রচনা করেন এবং ভারতবর্ষের বহু জায়গায় উল্লেখযোগ্য ভাস্কর্য ও স্থাপত্য সৃষ্টি করেন। অহিংসা নীতির জন্যে এঁরা যুদ্ধবিরোধী, এমনকী কীটপতঙ্গ মেরে ফেলার ভয়ে এঁরা মাটি কুপিয়ে চাষও করেন না; ফলে ব্যবসাবাণিজ্যেই এঁরা প্রতিষ্ঠিত। জৈনধর্ম উত্তর ভারতে নানা জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে; দক্ষিণে কলিঙ্গ, অন্ধ্র ও কর্ণাটকেও।

বৌদ্ধধর্ম

বৌদ্ধধর্মের মূল কথা হল, মানুষের পাপ ও দুঃখের মূলে তৃষ্ণা; অন্তর থেকে বাসনাকে উপড়ে ফেলতে পারলেই আর পুনর্জন্ম হবে না, নির্বাণ লাভ করা যাবে। এর জন্যে অষ্টাঙ্গ মার্গ বা আটটি নীতি হল: সত্য দর্শন, সত্য সংকল্প, সত্য বাক্য, সত্য ক্রিয়া, সত্য জীবিকা, সত্য অনুশীলন, সত্য স্মৃতি ও সত্য ধ্যান। বুদ্ধের নির্দেশ প্রধানত সন্ন্যাসী সম্প্রদায়ের জন্যেই, তবে নীতিগুলি গৃহীরাও মেনে চলতে পারে। বিস্তর মঠ, স্তূপ, চৈত্য ও সঙ্ঘারামে বৌদ্ধ শিল্পের নিদর্শন আছে। এ ধর্ম একদা ভারতবর্ষের বাইরে শ্রীলঙ্কা, ব্রহ্মদেশ, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, কোরিয়া, জাপান, চিনে ও তুরস্কে প্রচুর বিস্তারলাভ করে। এখনও ভারতবর্ষে বৌদ্ধদের সংখ্যা সামান্যই, ওই সব দেশেই বেশি। ফলে আড়াই হাজার বছর ধরে বহু বিভিন্ন ভাষায় বৃহৎ এক বৌদ্ধ সাহিত্যসম্ভার রচিত হয়েছে। বুদ্ধের অনেক পরে এ ধর্মের দুটি ভাগ হয়, পরবর্তীরা আগের পন্থাকে হীনযান ও নিজেদের মহাযান বলে। মহাযানের সাহিত্য বিপুল। এশিয়ার বিস্তৃত এক অঞ্চলে বৃহৎ এক বৌদ্ধ সাহিত্যসম্ভার রচিত হয় এবং বৌদ্ধ স্থাপত্য ও ভাস্কর্যের প্রচুর নিদর্শন মেলে। সহিংস ব্রাহ্মণ্য ধর্মে বৌদ্ধ ও জৈন ধর্ম প্রবল এক অহিংসার প্লাবন আনে এবং যজ্ঞ ও জাতিভেদের মূলে কুঠার হানে। এর প্রভাব স্থানে ও কালে বহু বিস্তৃত।

সংখ্যায় বৌদ্ধ ও জৈনরা যতই বাড়ছিল, মূল ব্রাহ্মণ্য ধর্মধারার আতঙ্কও ততই বাড়ছিল। ব্রাহ্মণ্যধর্ম বেদবিরোধীদের নিজেদের গণ্ডির মধ্যে ধরে রাখবার একটা উপায় বের করল। বলল, আগে যেমন বাল্য-কৈশোরের জন্যে ব্রহ্মচর্য, যৌবন-প্রৌঢ়ত্বের জন্যে গার্হস্থ্যের বিধান ছিল, এখন তেমনই প্রৌঢ়ত্বের জন্যে বানপ্রস্থ ও বার্ধক্যের জন্যে যতি বা সন্ন্যাস বলে অন্য দুটি আশ্রম স্বীকার করা হল। বয়স অনুসারে ধর্মাচরণের ব্যবস্থা হল। বানপ্রস্থে বনে থাকবার সময়ে খুব সাধারণ অগ্নিহোত্র ইত্যাদি যাগের বিধান রইল, যা নেহাৎ স্বল্প উপকরণে এবং অল্প সময়ে সেরে ফেলা যায়। সন্ন্যাস বা যতিতে তাও নেই, সন্ন্যাসী যেমন ইচ্ছা ঘুরে বেড়াতে পারে। বলা বাহুল্য, ওই সময়কার সন্ন্যাসী সম্প্রদায়গুলি যজ্ঞ করার অনিচ্ছা ও বনে বনে ঘুরে বেড়াবার স্বাধীনতা এখন ব্রাহ্মণসমাজ গৃহীর জীবনে শেষ দৃটি আশ্রম হিসেবে মেনে নিল, এতে ওই সব সম্প্রদায়ের সঙ্গে বিরোধ খানিকটা খাদে নেমে এল।

যজ্ঞে অনাস্থার আর এক প্রকাশ ব্রাহ্মণ্যধর্মও এখন কর্মকাণ্ড বা যজ্ঞ থেকে সরে এসে জ্ঞানমার্গ আশ্রয় করল, এই ভাবে যজ্ঞে অনীহা সমাজে স্বীকৃতি পেল, যদিও ধনী প্রভাবশালী লোকেরা এর পরেও বহুকাল ধরেই যজ্ঞ করে চলেছিল। উপনিষদ, বৌদ্ধ, জৈন ও আজীবিক কালটা অর্থাৎ খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম থেকে পঞ্চম শতক পর্যন্ত, সারা পৃথিবীতেই— গ্রিস, রোম, চিন, মিশর, ইরান, সর্বত্রই— ব্যাপক ও গভীর ভাবে ধর্ম-আন্দোলনের যুগ ছিল। ভারতবর্ষেও এর অভিঘাত প্রবল হয়ে দেখা দিয়েছিল। বুদ্ধের সময়েই সমাজে বেশ কিছু পরিবর্তন ঘটতে থাকে। গোষ্ঠীবদ্ধ সমাজ ভেঙে ‘কুল’ বা বৃহৎ যৌথ পরিবার এখন সমাজের ন্যূনতম একক হয়ে উঠেছে। বৈশ্য প্রাধান্য পাচ্ছে, কারণ অন্তর্বাণিজ্য ও বহির্বাণিজ্য তখন তাদেরই হাতে এবং জৈন ও বৌদ্ধদের প্রতি তাদের বিশেষ আনুকূল্য। ভাস্কর্যে বৌদ্ধ, জৈন ও ব্রাহ্মণ্য প্রভাব লক্ষ্য করা যায় এ সময়ে। বুদ্ধের জীবনী ও অন্যান্য সামাজিক কাহিনির চিত্রণ বেশ উঁচু মানে পৌঁছয়। জৈন বৌদ্ধ স্তূপ, বিহার, চৈত্য, সঙ্ঘারাম বণিকদের অর্থসাহায্য পেত। সমাজে বৈশ্য বণিক বিত্ত-কৌলীন্যে যেন ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয়কে অতিক্রম করে যাচ্ছিল। ষষ্ঠ শতকেই মুদ্রা ও লিপির (খরোষ্টি ও ব্রাহ্মীর) প্রবর্তন হয়। কোশল ও মগধে ছাপচিহ্নিত রুপোর মুদ্রা পাওয়া যায়। প্রধানত শ্রেষ্ঠীদের বাণিজ্যেই এর ব্যবহার। রাজস্ব, বেতন, জরিমানা এতেও ব্যবহার হত। ব্রহ্মত্র এবং দেবত্র সম্পত্তির পরিমাণ বাড়ছিল, এগুলি নিষ্কর ছিল। ব্রাহ্মণ ও যোদ্ধা ক্ষত্রিয়কে রাজকর দিতে হত না, ফলে বৈশ্যের ওপরে করের বোঝা বাড়ছিল। বৈশ্য ধীরে ধীরে চাষ ও পশুপালন ছেড়ে বাণিজ্যে আসে; চাষ, পশুপালন চলে যায় শূদ্রের হাতে। এ ছাড়া সমস্ত কুটিরশিল্প গোষ্ঠীবিভক্ত শূদ্রদের হাতে আসে; তাঁতি, কামার, কুমোর, রথকার, রাজমিস্ত্রি, নানা ধাতুশিল্পী, প্রভৃতিদের পেশা শূদ্রেরই একচেটিয়া হয়ে গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *