যজুর্বেদ-এ আর্য-প্রাগার্য সংমিশ্রণের ফলে যে সমাজ তৈরি হয় তারই বিবর্তন ঘটতে থাকে আরণ্যক উপনিষদ যুগে। যজ্ঞের বিস্তার, দীর্ঘস্থায়িতা, প্রকারভেদ ও জটিলতা এবং নানা নতুন যজ্ঞের উদ্ভাবনের ফলে সমাজে পুরোহিতের প্রাধান্য বাড়ে এবং সাধারণ ভাবে ব্রাহ্মণের প্রতিপত্তিও বাড়ে। যজ্ঞের বৃদ্ধি ও বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে পুরোহিতের দক্ষিণার পরিমাণও বাড়ছিল। ক্ষত্রিয় রাজা ও ব্রাহ্মণ পুরোহিতের মধ্যে প্রাধান্য নিয়ে সংঘাতের কিছু প্রমাণ শাস্ত্রে আছে।
আরণ্যক ও উপনিষদকে জ্ঞানকাণ্ড বলা হয়। আরণ্যক সংখ্যায় দু-তিনটি। প্রধান উপনিষদ চোদ্দটি: ঈশ, কেন, কঠ, প্রশ্ন, মুণ্ড, মাণ্ডুক্য, তৈত্তিরীয়, ঐতরেয়, ছান্দোগ্য ও বৃহদারণ্যক এ দশটিই বেশি পরিচিত। এ ছাড়া অন্য প্রধান উপনিষদ হল, মহান রায়ণীয়, মৈত্রায়ণীয়, শ্বেতাশ্বতর ও কৌষীতক। আরণ্যকে যজ্ঞ থেকে জ্ঞানের দিকে সরে খাচ্ছে শাস্ত্র; যজ্ঞকে রূপক হিসেবে ব্যাখ্যা করছে। উপনিষদে গুরুশিষ্য সংলাপে, কাহিনিতে এবং নানা আলোচনায় সৃষ্টি ও জীবন সম্বন্ধে কতকগুলি আলোচনা আছে। প্রথম দিকের উপনিষদ গদ্যে রচনা, পরে ছন্দে কিংবা ছন্দ-গদ্য মিশিয়ে। উপনিষদ মানে এমন বিদ্যা, যা আচার্যের কাছে (উপ বসে (নি+সদ=বসা) শিখতে হয়। অনেকগুলি উপনিষদই রচিত হয়েছে গুরুশিষ্য সংলাপের ভঙ্গিতে। যেন শিষ্য প্রশ্ন করছে, আচার্য উত্তর দিচ্ছেন। এ ছাড়াও উপনিষদে মাঝেমাঝে উপাখ্যান, তত্ত্ব-আলোচনা, বংশাবলী, ইত্যাদি আছে।
উপনিষদের প্রধান প্রবক্তা যাজ্ঞবল্ক্য এবং তাঁর প্রধান বক্তব্য হল, মানুষের মধ্যে যে আত্মা তাই ব্রহ্ম এবং সৃষ্টির মধ্যে ব্রহ্মই একমাত্র সত্য পদার্থ। বাকি যা তা যথার্থ সত্য নয়। অবশ্য সব উপনিষদে ঠিক এ কথা বলা নেই, এমন ভাবেও নয়। যেহেতু উপনিষদগুলি ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ভিন্ন অঞ্চলে নানা দ্রষ্টার দেখার বা উপলব্ধির বিবরণ, তাই এগুলি এক ছাঁচে ঢালা নয়। অন্ধের হাতি দেখার মতো শুঁড় দাঁত পা পিঠ সবই সত্য, অথচ কোনওটাই পুরো সত্য নয়। উপনিষদে বিভিন্ন ঋষির দৃষ্টিতে দেখা জীবনের তত্ত্ব পাই। সৃষ্টি সম্বন্ধে কেউ বলেন, ‘তিনি তপস্যা করলেন, পরে সৃষ্টি করলেন, আবার কেউ বা বললেন, ‘প্রথমে জল সৃষ্টি করলেন, পরে জল থেকেই বিশ্বচরাচরের সৃষ্টি।’ এর মধ্যে সমতা খুঁজতে যাওয়া বৃথা। যার যা মনে হয়েছে অসংকোচে বলেছেন। ‘আত্মাই ব্ৰহ্ম’ এই কথা ছাড়াও উপনিষদে আরও অনেক কথা আছে, সেগুলির মধ্যে প্রধান হল জন্মান্তরবাদ, অর্থাৎ মানুষ মৃত্যুতে শেষ হয় না, নানা রূপে বারেবারে জন্মায়। জন্মান্তর ঘটবেই। তখনকার দুঃখী মানুষের কাছে জীবন এত দুর্বহ মনে হত যে, আবার পরের জন্মে দারিদ্র, রোগব্যাধি, ঋণ, ঋণশোধ অক্ষমতা তার দরুন শাস্তি, প্রবলের নানা উৎপীড়ন, ইত্যাদির মধ্যে ফিরে ফিরে জন্মাবার সম্ভাবনা সাধারণ মানুষের কাছে বুঝি-বা একটুও আকর্ষণীয় মনে হত না। সমাজপতি ও শাস্ত্রকাররা উপনিষদে প্রচার করলেন যে, কেউ যদি ‘আত্মা-ই ব্ৰহ্ম’ এই কথাটা বুঝে উপলব্ধি করতে পারে, তা হলে তার মোক্ষ হয়, অর্থাৎ আর জন্মাতে হয় না। এখানে দেখি সংহিতা আমলের প্রার্থনা, দীর্ঘকাল পৃথিবীতে বাস করে জীবনকে উপভোগ করার আশা থেকে মানুষ কতটাই সরে এসেছে। মোক্ষ পাওয়ার উপায় কী? জ্ঞান, আত্মাই ব্ৰহ্ম এই কথাটা জানা পৃথিবীকে সত্য মনে না করা। জীবনের লক্ষ্য ও তার উপায়, দুই-ই পুরোপুরি বদলে গেছে। লক্ষ্য এখন আর পৃথিবীতে দীর্ঘকাল সুখী জীবনযাপন করা নয় বরং পৃথিবীতে ফিরে ফিরে আসার সম্ভাবনাটাকেই নষ্ট করা। উপায়ও এখন আর কর্ম অর্থাৎ যজ্ঞ নয়। যজ্ঞে যা পাওয়া যায়, তা হল সব রকম দৈহিক সুখ; কোনও কোনও জায়গায় স্বর্গের উল্লেখও আছে। কিন্তু নতুন পর্বে জ্ঞান যা দেয় তা হল ব্রহ্মজ্ঞানের মধ্যে দিয়ে মোক্ষ। বলা বাহুল্য, অশিক্ষিত জনসাধারণের কাছে জ্ঞানের মাধ্যমে ‘আমিই ব্ৰহ্ম’ এ বোধে পৌঁছনো সহজ ছিল না। ফলে তারা যে তিমিরে ছিল সেখানেই রয়ে গেল। না পারল খরচ করে যজ্ঞ করে ঐহিক সুখ অর্জন করতে, না পারল আত্ম-ব্রহ্ম চেতনা অর্জন করে দুঃখময় জীবনের পুনরাবৃত্তির সম্ভাবনা থেকে পালিয়ে বাঁচবার চেষ্টা করতে।
সামাজিক বিন্যাস এ যুগে ব্রাহ্মণসাহিত্যের যুগের মতোই ছিল। অর্থনীতি, রাষ্ট্রনীতিও উপনিষদের যুগে ক্ষত্রিয় জ্ঞানের জগতে অন্য এক ধরনের প্রাধান্য পাচ্ছে। ক্ষত্রিয় রাজা প্রবাহণ জৈবলি ব্রাহ্মণ আরুণির কাছে যেমন জ্ঞানলাভের জন্যে যাচ্ছেন তেমনই ক্ষত্রিয় রাজা অশ্বপতির কাছে পাঁচজন ব্রাহ্মণ যাচ্ছেন এমন কথাও শুনি। জন্মান্তরতত্ত্ব এ সময়ে নতুন, এ সম্বন্ধে ক্ষত্রিয় রাজা জনক ব্রাহ্মণ যাজ্ঞবল্ক্যকে বলছেন, ‘এর আগে এ জ্ঞান (জন্মান্তরবাদ) কখনওই ব্রাহ্মণে বাস করেনি।’ তার মানে, ক্ষত্রিয়ই প্রথম ব্রহ্মজ্ঞানের অধিকারী ছিল, ব্রাহ্মণ তার কাছ থেকেই তা পায় ও পরে এ জ্ঞানের একাধিপত্য লাভ করে। উপনিষদে যে ব্রহ্মজ্ঞানচর্চার কথা পড়ি তার জন্যে পণ্ডিত চিন্তাশীল মানুষের দার্শনিক বিষয়ে তর্কসভা হত, তার নাম ব্রহ্মোদ্য অর্থাৎ ব্রহ্মবিষয়ে আলোচনাসভা। প্রায়ই সভা বসত কোনও রাজদরবারে এবং বেশ কিছু রাজা এ সব সভায় যোগ দিতেন এমন উল্লেখ আছে। কর্মকাণ্ডে যেমন প্রধান অধিকারী ছিল ব্রাহ্মণ, পুরোহিত ও ধনী যজমান পুরুষ, উপনিষদে সেটা আমূল পালটে গেল। তখনও ব্রাহ্মণের একটা মুখ্য ভূমিকা ছিল, কিন্তু বেশ কয়েকজন ক্ষত্রিয় রাজা ব্রহ্মবিষয় আলোচনা করেছেন। ক্ষত্রিয় পুরুষ ছাড়াও মৈত্রেয়ী ও গার্গী — এ দুজন নারীও ব্রহ্ম সম্পর্কে আলোচনায় অংশগ্রহণ করেছেন, যদিও যাজ্ঞবল্ক্য প্রকাশ্য সভায় গার্গীকে অপমান করেছেন, যেমন জনক রাজা সুলভাকে অসম্মান করে কথা বলেছেন। বোঝা যায় নারীর ব্রহ্ম সম্বন্ধে আলোচনা পণ্ডিত সমাজ ভাল চোখে দেখত না।