• Skip to main content
  • Skip to header right navigation
  • Skip to site footer

Bangla Library

Read Bengali Books Online (বাংলা বই পড়ুন)

  • নতুন সব বই
  • লেখক
  • সিরিজ
  • বইয়ের ধরণ
  • পুরানো সব ক্যাটাগরি
  • My Account →
  • নতুন সব বই
  • লেখক
  • সিরিজ
  • বইয়ের ধরণ
  • পুরানো সব ক্যাটাগরি
  • My Account →
  • বাংলা ডিকশনারি
  • বাংলা কৌতুক
  • বাংলা লিরিক
  • বাংলা রেসিপি
  • হেলথ টিপস এন্ড নিউজ

বাংলা নতুন/পুরাতন বইয়ের পিডিএফ ডাউনলোড/সন্ধান করতে আমাদের বাংলা পিফিএফ সাইটে ক্লিক করুন।

Bangla PDF

০৩. ‘ব্রাহ্মণ’ সাহিত্যে সমাজ ও ধর্ম

লাইব্রেরি » সুকুমারী ভট্টাচার্য » প্রাচীন ভারত » ০৩. ‘ব্রাহ্মণ’ সাহিত্যে সমাজ ও ধর্ম

‘ব্রাহ্মণ’ সাহিত্যে সমাজ ও ধর্ম

মোটামুটি খ্রিস্টপূর্ব নবম শতকের শেষ থেকে ষষ্ঠ শতকের মধ্যে প্রধান ব্রাহ্মণগুলির রচনা। ঋগ্বেদ-এর দুটি, যজুৰ্বেদ ও সামবেদ-এর অনেক ও অথর্ববেদ-এর একটি ব্রাহ্মণ। এগুলিতে আছে যজ্ঞ করার প্রণালী, কোন যজ্ঞে কখন কোন মন্ত্রী কী ভাবে আবৃত্তি করতে হবে, যজ্ঞ করলে লাভ কী, না করলে ক্ষতি কী–এরই সংক্ষিপ্ত বিবরণ। ব্ৰাহ্মণসাহিত্য খুব সংক্ষিপ্ত গদ্যে রচনা। তখনো লেখার প্রচলন হয়নি। সবই মুখে মুখে রচনা এবং সংহিতা ছন্দে রচনা বলে তা কণ্ঠস্থ করা সহজ ছিল। কিন্তু গদ্যে রচিত ব্রাহ্মণ কণ্ঠস্থ করা অসুবিধেজনক ছিল, তাই এই সংক্ষিপ্ত রচনার পদ্ধতি। ব্ৰাহ্মাণের দুটি অংশ: বিধি ও অর্থবাদ; যজ্ঞ সম্বন্ধে নির্দেশকে বলে বিধি। আর যজ্ঞ করলে কী ফল, না করলে কী ক্ষতি তা নিয়ে নানা কাহিনিকে বলে। অর্থবাদ’। দেবতারা কী রকম বিপদে পড়ে কী কী যজ্ঞ উদ্ভাবন করে’ অসুরদের পরাজিত করেন, তারই নানা গল্প এ অংশে। এর ফলে নানা নতুন নতুন যজ্ঞের উদ্ভাবনের ইতিহাস এতে ধরা আছে।

সাধারণ ভাবে সমাজে ব্রাহ্মণ বর্ণের আধিপত্য ছিল, বর্ণগুলির মধ্যে তখনও কিছু সঞ্চরণশীলতা ছিল। এক জায়গায় পড়ি শ্যাপর্ণ সত্যকমের কয়েকটি ছেলে ব্রাহ্মণ, কয়েকটি ক্ষত্রিয়, কয়েকটি বৈশ্য। তখনও ব্রাহ্মাণের ছেলে জন্মসূত্রে ব্রাহ্মণ হত না এবং ব্রাহ্মণ ছেলের অন্য বর্ণে যেতে সংকোচ ছিল না। যোগ্যতা, রুচি ও ক্ষমতা অনুসারে এক বর্ণের লোক অন্য বর্ণে যেতে পারত। ব্রাহ্মণ তিনটি ঋণ নিয়ে জন্মাত; বেদপাঠ করে সে পিতৃকুলের ঋণ শোধ করত, ব্ৰহ্মচর্যের দ্বারা ঋষিদের এবং সন্তান ও পরিবার উৎপাদন করে দেবতাদের ঋণ শোধ করত। আচার্যের সম্মান খুব উচুতে ছিল। এ সময়ে জাতিভেদ প্রথা ধীরে ধীরে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছিল। তবু এমন কথাও শুনি যে, পণ্ডিতের জাতনিয়ে মাথা ঘামানো উচিত নয়। অভিজ্ঞতায় বর্ধিষ্ঠ ‘তুথ’ জ্ঞানী ছিলেন, দেবতাদের অংশ তিনিই ভাগ করে নিতেন। ব্রাহ্মণত্ব জ্যেষ্ঠত্ব ও জ্ঞানের পাশাপাশি আর এক রকম আভিজাত্যের কথা যজুৰ্বেদ-এই শুনি: ‘অতিথিদের মধ্যে যার শকট বা রথ আছে সেই শ্রেষ্ঠ।’ গুণ যে সব সময়ে খাতির পেত তা নয়, যেমন গায়ককে দান করতে নিষেধ করা হয়েছে; দেবতাদের মধ্যে অশ্বিনদের সোমরসের ভাগ দেওয়া নিয়ে আপত্তি ছিল, যদিও সংহিতায় তাদের সোমপানের উল্লেখ আছে।

সমাজের অর্থনৈতিক ভিত্তি ছিল পশুপালন ও চাষ। খাদ্য উৎপাদনের কাজে খুব বড় একটা অংশ নিযুক্ত থাকত। অন্নের প্রশংসা অথর্ববেদ থেকেই শোনা যায়। উষ্ণ, সোনালি, পুষ্টিকর, অন্ন, সে-অন্নের প্রতীকী পাত্ৰ সূৰ্য, প্রাণ অন্নে প্রতিষ্ঠিত।’ চাষের প্রসঙ্গে বিভিন্ন কথা শুনি: বৃষ্টির জন্যে প্রার্থনা, ক্ষেতে হাল-চালানো যেন ভাল ভাবে হয়, জল যেন শুদ্ধ হয়, বীজ বোনা ও রোওয়া যেন ঠিক ভাবে হয়। বীজ পড়া, অনাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টি, ফসলের মড়ক থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যে প্রার্থনা ও কবচের কথা আছে।

গ্রিস, রোম, মিশর ও মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে ভারতবর্ষের যে বহির্বাণিজ্য আর্যরা এ দেশে আসবার পরই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, ব্ৰাহ্মাণের যুগেই তা আবার চালু হয়। লোহার ফলার লাঙলের সাহায্যে সহজে বেশি চাষ করা সম্ভব হয়েছিল। আফগানিস্তান, সিন্ধু, পঞ্জাব থেকে উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্ৰদেশ, রাজস্থান ও উত্তর-পশ্চিম বিহারে আর্যরা ছড়িয়ে পড়ে। বিহার ও ছোটনাগপুরে লোহা ও অন্যান্য ধাতুর খনি থাকায় ধাতুশিল্পের উৎপাদনও বাড়ছিল। বনভূমি পুড়িয়ে ফেলে চাষের জমি হাসিল করা চলছিল। উদ্ধৃত্তি ফসল ও কুটিরশিল্প উৎপন্ন পণ্য বস্তুর বাণিজ্য দেশের ভেতরে ও বাইরে বাড়বার ফলে সমাজের ওপরের দিকে কিছু লোকের হাতে সম্পত্তি জমা হতে লাগল, আর অধিকাংশ চাষি মজুর সামান্য মজুরি বা পেটভাতায় কাজ করে অতি গরিব অবস্থায় দিন কাটাত।

যজুর্বেদ-এর সময়ে বহুল ভাবে আর্য-প্ৰাগাৰ্য সংমিশ্রণের ফলে যে সমাজের উদ্ভব হয়। তারই বিবর্তন ঘটতে থাকে ব্রাহ্মণ-আরণ্যক-উপনিষদ যুগে। যজ্ঞের বিস্তার, দীর্ঘস্থায়িতা, প্রকারভেদ, নতুন নতুন যজ্ঞের উদ্ভাবন, এ সবের ফলে সমাজে পুরোহিতের প্রাধান্য বাড়ে এবং সাধারণ ভাবে ব্ৰাহ্মণদের প্রতিপত্তিও বাড়ে। ব্ৰাহ্মণের কর্তব্য বলে নির্ধারিত হল শিক্ষাদানের দ্বারা অন্য বর্ণের ‘পরিপাক’, মানে জ্ঞানের পরিণতি ঘটানো ও ব্রাহ্মাণের নিজের জন্য যশ অর্জন করা। মানুষ এ-ও বিশ্বাস করত যে ব্রাহ্মণরা জাদুবিদ্যা জানত। তাই, বেদ জানে, যজ্ঞ করে, জাদু জানে যে পুরোহিতরা, সাধারণ মানুষ সহজেই তার বশ্যতা স্বীকার করত। এমন কথাও বলা আছে যে ‘বেদ ও ব্রাহ্মণ হল মানুষের মধ্যে দেবতা।’ যজ্ঞে উৎসর্গ করা হাব্য গ্রহণ করে শুধু ব্রাহ্মণ; ক্ষত্ৰিয়,বৈশ্য ও শূদ্রের কাছ থেকে হাব্য পালিয়ে যায়।’ ব্ৰাহ্মণ দক্ষিণায় তুষ্ট হলে যজ্ঞ স্বয়ং তুষ্ট হয়। আবার শুনি, ব্রাহ্মণ পুরোহিত হল শ্রেষ্ঠ, অগ্নির প্রতীক; যদিও অন্যত্র এমন কথাও আছে যে ক্ষত্রিয় হল ইন্দ্র ও অগ্নি। ক্ষত্ৰিয়, যোদ্ধা, তেজস্বী, তাই তাকে বিজয়ী সেনাপতি ইন্দ্রের প্রতীক ভাবা যেতে পারে, তেজ ও শক্তির জন্য অগ্নিকে।

উত্তর পশ্চিম দিক থেকে গঙ্গা যমুনার অববাহিকা হয়ে দক্ষিণ পশ্চিম বিহার পর্যন্ত পৌঁছে যখন আর্যরা প্রাগার্যদের হটিয়ে পুড়িয়ে জঙ্গল সাফ করে ক্রমে ছোট ছোট রাজ্য স্থাপন করে এবং লোহার লাঙলের ফলার ব্যবহার করে খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ-পঞ্চম শতক থেকে যখন চাষের উৎপাদন বাড়াল, তখন সেই সব ছোটখাট রাজ্যের রাজারা ব্ৰাহ্মণদের ধনরত্ন, পশু, দাসদাসীর সঙ্গে জমিও দান করে নতুন নতুন জনপদ প্রতিষ্ঠা করে আর্যসংস্কৃতির বিস্তার ঘটাচ্ছিল। এ সব জনপদে বিভিন্ন গোষ্ঠীর বসতি তৈরি হচ্ছিল। এদের মধ্যে সর্বদা সুসম্পর্ক থাকতে না, মাঝেমাঝে রেষারেধিও থাকত। বিশ্বস্তর সীেসদ্মন শ্যাপর্ণকে দেখতে পারত না। রজ্ঞে তাকে বাদ দেয়। শ্যাপর্ণ যজ্ঞভূমিতে এসে জোর করে বসে; তখন দুজনের মধ্যে রাগারগি গালাগালি চলতে থাকে।’ এমন উদাহরণ আরও আছে। কাজেই তখনকার সমাজেও এখনকার মতোই হিংসা ঝগড়া সবই ছিল। সমাজে ‘ভাল বামুন, খারাপ বামুন’ তখন থেকেই ছিল। কিছু পুরোহিত ব্ৰাহ্মণের সমৃদ্ধি ও সমাজে প্রতিষ্ঠা বাড়ছিল। যজ্ঞের দক্ষিণা ব্ৰাহ্মণসাহিত্যের যুগে দ্রুত বেড়ে উঠছিল। হয়তো দক্ষিণা নেওয়া নিয়ে একটা সংকোচও ছিল; এক জায়গায় বলা আছে। পিছন ফিরে দক্ষিণা নেবে।’ যজ্ঞের সংখ্যা ও প্রকারভেদ বাড়ছিল, দক্ষিণও। শাস্ত্র বলছে, দক্ষিণ যজমানকে (যে যজ্ঞ করায়, তাকে) শুচি করে,’ এতে যজমান বেশি বেশি দক্ষিণা দিতে উৎসুক হবে। আর সে কী সব দক্ষিণা! অশ্বমেধ যজ্ঞে চারশো গাভী, চার হাজার সোনার টুকরো (মুদ্রা), চারটি বিবাহিতা নারী, একটি কুমারী, চারশো দাসী ও প্রচুর খাবার জিনিস। এত পেতে পেতে পুরোহিতের লোভ সহজেই বেড়ে যাচ্ছিল, বহু ব্রাহ্মণ লোভী হয়ে উঠছিল। তাই ব্ৰাহ্মাণের শেষাংশের একটি উপনিষদের (ঈশোপনিষদ) শুরুই হচ্ছে, কারও ধনে লোভ কোরো না।’ নির্লোেভ ব্রাহ্মণও নিশ্চয়ই ছিল, কিন্তু লোভী ব্ৰাহ্মণ সমাজে উপদ্রবের আকারে দেখা দিয়েছিল বলে বোঝা যায়। ফলে, পরবর্তী শাস্ত্ৰে ‘অকামিহত শ্রোত্ৰিয়র (নির্লেভ বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ’) কথা প্রায়ই শোনা যায়। সম্ভবত সেই জন্যেই উপনিষদে দান, দয়া ও সংযমের মাহাত্ম্য ঘোষণা করা হয়েছে।

 

সমাজ

ধর্মাচরণ তখনও প্রধানত যজ্ঞ; যজ্ঞের উদ্দেশ্য ঐহিক সুখ, স্বাস্থ্য, আয়ু, বিজয়, পশু, ফসল, শত্ৰুনাশ, ইত্যাদি। আর যথেষ্ট অন্ন উৎপাদন। ‘অশনায়পিপাসে’(ক্ষুধা, তৃষ্ণা) বিষয়ে বারবার নানা কথা বলা আছে। যজ্ঞের উদ্দেশ্য সম্বন্ধে এক জায়গায় পড়ি, যখন খাবার মাংস না ফুরোয়।’ অন্যত্ৰ শুনি, ‘যেন পাঁচ পুরুষ পর্যন্ত অন্নভোজী হই’ ‘কেউ যদি জিজ্ঞেস করেযজমান কী করছে?’ তা হলে যেন বলতে পারা যায় সে অন্ন আহার করছে।’ ‘গৃহিণী যেন পুত্রপৌত্রের জন্যে সুস্বাদু অন্ন পাক করেন।’

উপনিষদে আছে স্রষ্টা প্রজাপতি মানুষ সৃষ্টির পরেই খাদ্য সৃষ্টি করলেন। সাধারণ মানুষের জীবনে অন্নাভাব একটা নিত্যকর ব্যাপার ছিল। যথেষ্ট খেটেও সকলে খেতে পেত না বলে ধনীরা মাঝেমাঝে অন্নসত্র করতেন। জনশ্রুতি পৌত্ৰায়ণের এমন একটি অন্নসত্রের কথা ছন্দোগ্য উপনিষদ-এ পড়ি। অন্নদান এ দেশে চিরদিনই পুণ্যকাজ। দুর্ভিক্ষের দিনে বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ চণ্ডালের কাছে চেয়ে তার এটো মাষকলাই খেয়ে খিদে মেটাচ্ছেন–এমন ঘটনার উল্লেখ আছে। দুর্ভিক্ষ ছাড়া অন্য সময়েও প্রয়োজনের তুলনায় খাদ্য কমই ছিল। ছান্দোগ্য-র শৌব উপনিষদে পড়ি ক্ষুধার্ত মানুষের দেখাদেখি কুকুরেরা যজ্ঞের নকল করে বলছে, যেন অন্নভোজী হই। বাড়িতে প্রচুর খাদ্য থাকলে সমাজে একটা প্রতিষ্ঠা পাওয়া যায়, এ কথাও বলা আছে। ঐতরেয় ব্ৰাহ্মণ-এ শুনি, গরিব ব্রাহ্মণ অজীগর্ত নিজের ছেলে শুনঃশেপকে বিক্রি করতে রাজি, এবং আরও কিছুটাকার বিনিময়ে নিজে হাতে তাকে হত্যা করতেও রাজি। পরে বাবা ছেলের সঙ্গে মিটিয়ে নিতে চাইলে ছেলে রাজি হয় না, বলে, ‘তুমি শূদ্রের মতো আচরণ করেছ।’ এর থেকে মনে হয় অভাবে পড়ে শূদ্ররা কখনও কখনও ছেলেমেয়ে বেচিতে বাধ্য হত। গোমাংস তখন যজ্ঞে হব্য হিসেবে দেওয়া হত, খাওয়াও হত। যজ্ঞে বেশি সংখ্যায় বলদ বলিদান হচ্ছিল বলে হালের বলদে টান পড়ছিল, তখন মাংস খাওয়ার ওপরে নিষেধ জারি করলেন যাজ্ঞবল্ক্য, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে এও বললেন, ‘আমি কিন্তু (গোমাংস) খাব যদি রান্নাটা ভাল হয়।’ সুরাপানও প্রচলতি ছিল এবং কোনও কোনও যজ্ঞে সুরাও দেওয়া হত। ধনীরা দামি সুরা পান করতেন; সেটা ঐশ্বর্যের চিহ্ন বলে ধরা হত। এক জায়গায় পড়ি, জনমেজয়ের বাড়িতে সুরাকলস ভরা আছে।’ইন্দ্রকে ত্রিশ কলস সুরা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে যজ্ঞে আহ্বান করা হয়েছে; অন্যত্র ইন্দ্রকে সুরা ও মহিষমাংস দেওয়ার কথা আছে। সহজেই অনুমান করা যায়, সাধারণ মানুষও পরিশ্রমের ক্লান্তি ঘোচাতে সস্তার মদ চোলাই করে খেত, নেশাও করত; কিন্তু ব্রাহ্মণ সাহিত্যে এই গরিবদের কথা নেই।

আতিথ্য সম্বন্ধে অনেক কথা আছে। অতিথি খুব সম্মানিত ব্যক্তি। তার খাওয়ার আগে যে খায় তার যজ্ঞ ও পুণ্য নষ্ট হয়ে যায়। অতিথিকে দান করতে হবে চাদর, তোশক, বালিশ, তেল, খাবার, শিলনোড়া, ছাকনি, হাতা, কলসি, ভাঁড় ও অন্যান্য তৈজসপত্র। অন্য জায়গায় পড়ি ব্রাত্যদের (এঁরা সম্ভবত বৈদিক আর্যদের আগে-আসা কোনও আর্যগোষ্ঠী) দিতে হবে জামা, ছাতা, বাসন ও অন্যান্য দরকারি জিনিস। অতিথির বিশ্বাস রক্ষা করতে হবে; আশ্রিতের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা মহাপাপ।

যজুৰ্বেদ-এর সময় থেকেই দেখি, পুরুষ বহুপত্নীক। একে শাস্ত্রীয় সমর্থন দিয়ে বলা হয়েছে, ‘একটি যজ্ঞে যেমন একটা লাঠির গায়ে দু খণ্ড কাপড় জড়ানো থাকে তেমনই একটি পুরুষকে দুটি নারী অবলম্বন করে থাকবে, কিন্তু কোনও নারী দুজন পুরুষকে অবলম্বন করতে পারবে না। অন্য একটি যাগে কিছু যজ্ঞপাত্রকে তুলে ধরা হয়, আর কিছু পাত্ৰকে নামিয়ে রাখা হয়। ‘তেমনই সদ্যোজাত পুত্ৰ সন্তানকে তুলে ধরা হবে। আর কন্যাসন্তানকে মাটিতে নামিয়ে রাখা হবে।’ একটি যজ্ঞে লাঠি দিয়ে ঘিকে মারা হয়। ‘নারীকেও তেমনই লাঠি দিয়ে মেরে বশীভূত রাখতে হবে, যাতে নিজের দেহ বা সম্পত্তিতে নারীর কোনও অধিকার না থাকে।’ ‘পুত্ৰ জীবনে আশীৰ্বাদ, কন্যা অভিশাপ।’ নারী ও শূদ্রের নাম এক নিঃশ্বাসে উচ্চারিত হয়েছে বারবারা; আসলে এ দুজনই ভরণপোষণের জন্যে গৃহস্বামীর ওপরে নির্ভর করে, তাই স্ত্রী হল ‘ভার্যা, আর শূদ্র দাস হল ‘ভৃত্য’ অর্থাৎ ‘যাদের ভরণ করতে হয়।’ সমাজ নারীর জন্যে স্বাধীন কোনও জীবিকার পথ খোলা রাখেনি; স্বামী, সন্তান ও শ্বশুরবাড়ির সেবাই তার একমাত্র কাজ। শূদ্র গৃহকর্মকরত, ব্ৰাহ্মণ ক্ষত্ৰিয় বৈশ্যের সব রকম সেবা করাই তার একমাত্র কর্তব্য ছিল। সভা’, ‘সমিতি’, যেখানে গোষ্ঠীর ভাগ ভবিষ্যৎ নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হত সেখানে নারীর প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল। যজ্ঞে যজমানকে স্ত্রীকে যজ্ঞের পশ্চাতের অর্ধ বলা হয়েছে। যাজমানপত্নীকে যজ্ঞকালে স্বামীর পাশে বসতে হত; কিন্তু ওই পর্যন্তই, কোনও মন্ত্র সে উচ্চারণ করতে পারত না। খেটে খুটে যজ্ঞের যা সাহায্য করা তা সে করতে পারত। গৃহ্য যাগে তার সম্বন্ধে কোনও মন্ত্র বা কোনও যাগ নেই। সন্তানসম্ভাবনার পরে প্রথম তাকে কেন্দ্র করে যে সীমাস্তোন্নয়ন বা পুংসবন যাগ হয় তাতে ভাবী সন্তানেরই কল্যাণকামনা, এবং সন্তানটি যেন পুরুষ সন্তান হয় এমন প্রার্থনা থাকে। ওই নারীটির মঙ্গলকামনায় কোনও মন্ত্র নেই। বিবাহের সময় থেকেই তাই, সব মন্ত্রেই বরের পরমায়ু, সমৃদ্ধি, দাস কামনা করা হচ্ছে, এমনকী সদ্যোবিবাহিতা বধূর সামনে তার সঙ্গে উচ্চারণ করা হয়, ‘যেন স্বামীর বহু পত্নী হয়।’ বধু স্বামীর বশীভূত হোক, শ্বশুরবাড়ির কল্যাণ করুক এ সব কথা থাকলেও তার নিজের স্বাস্থ্য, কল্যাণ, পরমায়ু বা সুখের জন্যে কোনও প্রার্থনাই নেই। ‘স্ত্রীলাভের আগে সন্তান আসে না, তাই স্ত্রী দরকার।’ মন্ত্র উচ্চারণের সময়ে শেষের অংশ ধীরে ধীরে উচ্চারণ করতে হবে যাতে স্ত্রীর মন না। উন্নত হয়, এ কথা কৌষীতকি ব্রাহ্মণ-এ আছে; অর্থাৎ স্ত্রীর মানসিক উন্নতি সমাজ চায়নি। বহু স্ত্রীর পক্ষে এক স্বামীই যথেষ্ট’, হরিশ্চন্দ্রের একশোটি স্ত্রী ছিল। শতপথ ব্ৰাহ্মণ বলে ‘সমৃদ্ধ লোকের চারটি স্ত্রী থাকবে।’ রাজারও তাই থাকত, মহিষী, বাবাতা, পরিবৃত্তি ও পালাগলী–এ ছাড়াও একটি কুমারী ও চারশোটি দাসীও থাকবে। ঐতরেয় ব্রাহ্মণ-এ পড়ি অঙ্গরাজ তীর পুরোহিত আত্ৰেয়কে দশ হাজার দাসী দিয়েছিলেন। স্বভাবতই প্রশ্ন আসে, যজ্ঞ-করা পুরোহিত অত দাসী নিয়ে কী করতেন? কোনও উত্তরই পুরোহিতের সম্বন্ধে শ্রদ্ধা জাগায় না। যে স্ত্রী পুত্রসস্তানের জন্ম দিতে পারল না শাস্ত্র তাকে ত্যাগ করার নির্দেশ দিয়েছে, কাজেই সমাজে নারীর স্থান পুত্রের জননী হিসেবেই। তার নিজের কোনও মূল্য নেই। এই কারণে বিধবার স্থানও সম্মানের ছিল না মনে হয়, তাই প্রার্থনা আছে, ‘যেন ইন্দ্রাণীর মতো অবিধবা হই।’ ‘নারী, শূদ্র, কালো পাখি ও কুকুর মিথ্যা। এদের দেখা উচিত নয়।’ ছুঁচো, বেজি, নারী, শূদ্র ও কালসাপ মারলে একই প্ৰায়শ্চিত্ত৷’ এ সবের মধ্যে প্রকাশ পায় সমাজে নারীর স্থান কোথায় ছিল।

শূদ্র সম্বন্ধেও তাই। গৃহ্যসূত্র বলে, ‘কোনও দেবতা থেকেই শূদ্রের উৎপত্তি হয়নি, যদিও ঋগ্বেদ-এ ব্ৰহ্মার পা থেকে তার সৃষ্টি, এমন কথা শুনি। শূদ্রের কোনও গৃহত্যাগ (দশকর্ম) নেই; তার উপনয়ন নেই, অর্থাৎ বেদপাঠ নেই। বেদ যদি সে কানেও শোনে তাহলে সীসে গলিয়ে তার কানে ঢেলে দিতে হবে, বেদ উচ্চারণ করলে তার জিভ টেনে ছিড়ে ফেলতে হবে। শাস্ত্ৰ বহুবার বলে, শূদ্রের একমাত্র কাজ ব্রাহ্মণ ক্ষত্ৰিয় বৈশ্যের সেবা করা। একটি জায়গায় পড়ি, কেউ যদি বেশি খরচের যজ্ঞ শুরু করার পর দেখে তার অর্থে কুলোচ্ছে না তখন সে অনায়াসে শূদ্রের ধন কেড়ে নিতে পারে, এতে কোনও পাপ হয় না। অন্য এক জায়গায় শুনি, শূদ্রের স্ত্রীকে অন্য বর্গের পুরুষ যথেচ্ছ ভোগ করতে পারে।’ এই সব শাস্ত্রই তখনকার আইন এবং এ আইনে শূদ্র ও নারীকে মানবিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। এর প্রথম পরিণতি কুষাণ যুগের রচনা মনুসংহিতা-য়, সেখানে শূদ্র ঊনমানব। অথচ ব্রাহ্মণ মণীষিরা যেমন সমাজকে শাস্ত্র, বিজ্ঞান, জ্যোতিষ, আয়ুর্বেদ, গণিত, ইত্যাদি দিয়েছে, তেমনই দৈনন্দিন জীবনের অত্যন্ত প্রয়োজনীয় প্রাথমিক জ্ঞান, প্ৰযুক্তিবিদ্যায় অনেক কিছুই নিশ্চয়ই শূদ্রেরই উদ্ভাবন। গাড়ির চাকা, কুমোরের চাক, তাঁতির তীত, রাজমিস্ত্রির মাপজোকের নকসা ও যন্ত্র, চাষের সেচপদ্ধতি, ঘর ছাওয়ার কৌশল, মাছ ধরার নানা ধরনের জাল, শিকারির ফাঁদ-গুলতি, তীর-ধনুক, ধাতু গলানোর কৌশল, পাথর কাটা ঘষা, অস্ত্রশস্ত্র তৈরি, প্রাসাদ, বাগান, বিহার, গুহা তৈরি–এ সব নিশ্চয়ই শূদ্রেরই উদ্ভাবন ও সৃষ্টি। তার নিজস্ব রচনা নাচগানও নিশ্চয়ই ঘুরপথে সমাজে পৌঁছে উচ্চবর্ণের সংস্কৃতির ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করেছে। কিন্তু শাস্ত্ৰ, পুরোহিত ও উচ্চবর্ণের কাছে নারী বা শূদ্র কেউ পুরোপুরি মানুষ নয়।

এই সময়ে তখনকার আর্য-প্ৰাগাৰ্য মিশ্র গোষ্ঠীতে প্রথম শ্রেণিবিভাজন দেখা দেয় খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম ষষ্ঠ শতকে। এর ফলে সমাজে দেখা দিল মুষ্টিমেয় ধনী ও অসংখ্য দরিদ্র। কিছু ক্ষমতাশালী ব্রাহ্মণ, রাজন্য ক্ষত্ৰিয়, নব্যধনী বৈশ্যরা সমাজে বিত্তকৌলীন্য ভোগ করত। এই সময়ে ব্ৰাহ্মাণের পেশা ছিল অধ্যাপনা, ধর্মশাস্ত্র রচনা ও যজ্ঞ করা। রাজন্য ক্ষত্রিয় রাজকর্যে ও দেশের সুরক্ষার দায়িত্বে ছিল। এরা ক্ষমতাশালী রাজপরিষদ। মানুষের কাম্য বস্তু পাওয়ার জন্যে যজ্ঞ করত ব্রাহ্মণ এবং এইটেই ছিল তার ক্ষমতার উৎস। ক্ষত্ৰিয় ছিল রাজার প্রসাদপুষ্ট, তার জোর এখানেই। এই দুই শ্রেণিই উৎপাদনের পরিশ্রম থেকে রেহাই পেয়েছিল এবং যারা গায়ে গাঁতরে খাটত তাদের নিচু চোখে দেখত। শ্রমের বিভাজনই সমাজে উঁচু নিচু বিভেদ সৃষ্টি করল; চাষি মজুর কুটিরশিল্পী কারিগর ও দাস সমাজের নিচুতলায় নেমে এল।

Category: প্রাচীন ভারত
পূর্ববর্তী:
« ০২. আর্যরা: সংহিতাযুগ
পরবর্তী:
০৪. আরণ্যক উপনিষদ যুগ »

Reader Interactions

Leave a Reply Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

বাংলা লাইব্রেরি : উল্লেখযোগ্য বিভাগসমূহ

লেখক ও রচনা

অনুবাদ সাহিত্য

সেবা প্রকাশনী

ডিকশনারি

কৌতু্ক / জোকস

লিরিক

রেসিপি

কোরআন

হাদিস

ত্রিপিটক

মহাভারত

রামায়ণ

পুরাণ

গীতা

বাইবেল

বিবিধ রচনা

বাংলা ওসিআর

Download Bangla PDF

হেলথ

লাইব্রেরি – ফেসবুক – PDF

top↑