০২. আর্যরা: সংহিতাযুগ

আর্যরা: সংহিতাযুগ

তথ্যসূত্র

সম্ভবত খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চদশ শতকে আর্যরা মধ্যপ্রাচ্য থেকে দু-তিনবার দু-তিন দলে ভারতবর্ষে আসে। যারা বেদ নিয়ে এসেছিল তারা হয়তো খ্রিস্টপূর্ব দ্বাদশ শতকের কাছাকাছি কোনও সময়ে এখানে পৌঁছয়, তবে তাদের আগেও এখানে অন্য আর্য দল এসেছিল। আর্যরা যখন মধ্যপ্রাচ্য বা ইরান থেকে আসে তখন চাষের সঙ্গে তাদের সাক্ষাৎ পরিচয় থাকলেও ওই দীর্ঘ পথ তারা পশুচারী যাযাবর হিসেবেই আসে। ওই পথে বহু মানুষ গুরু-মোষ ভেড়া-ছাগল নিয়ে আসছিল। তখন তাদের খাদ্য ছিল মাংস, দুধ, দই, ঘি, ছানা, ছাতু, মধু, ইত্যাদি। ভারতবর্ষে পৌঁছতে তাদের অনেক সময় লেগেছিল এবং সে সময়টা কাটে যাযাবার ভাবেই। পথের মধ্যে কোথাও কোথাও কিছু দিন ধরে বাস করলেও স্থায়ী জীবনযাত্রার সুযোগ তো ছিল না, ফলে বীজ বুনে ফসল তোলবার মতো সময় তাদের হাতে থাকত না।

আর্যদের সম্বন্ধে জানবার প্রধান ও প্রায় একমাত্র সূত্র হল বেদ: আধুনিক প্রত্নতাত্ত্বিক, যাঁরা মাটি খুঁড়ে পুরনো সভ্যতার অবশেষ বের করেন, তাঁদের পাওয়া বস্তুগুলি থেকেও খানিকটা জানা যায়। বেদের সময়কার উৎখননে প্রায় তেমন কিছুই পাওয়া যায়নি। ফলে আর্যদের প্রথম দিকের জীবন সম্বন্ধে খবর বৈদিক সাহিত্যই আমাদের কাছে খুব বড় উৎস।

বেদ চারটি: ঋক্, সাম, যজুঃও অথর্ব। এগুলির প্রত্যেকটির আবার চারটি অংশ: সংহিতা, ব্রাহ্মণ, আরণ্যক ও উপনিষদ। ঋকসংহিতা ছন্দে রচিত, এর সূক্ত অর্থাৎ পুরো কবিতাগুলি আবৃত্তি ও গান করা হত (সু+উক্ত=সূক্ত, ভাল করে বলা কথা)। সূক্তগুলি অনেক ঋক বা মন্ত্র দিয়ে রচিত। যজুর্বেদ সংহিতায় মন্ত্র ছাড়াও কিছু কিছু গদ্য অংশ আছে। সামবেদ গান করা হত এবং এর মন্ত্রগুলি সবই ঋকসংহিতা থেকে নেওয়া; অথর্ববেদ-এ অনেক অংশ ঋকসংহিতা থেকে, তা ছাড়াও এতে অন্যান্য বহু মন্ত্র ও কিছু কিছু গদ্য মন্ত্ৰ আছে।

ব্রাহ্মণ সাহিত্য সম্পূর্ণ ভাবেই গদ্যে রচনা, যজ্ঞ কেন ও কী ভাবে করতে হবে তাই এতে বলা আছে। ব্রাহ্মণগুলি খুব সংক্ষিপ্ত গদ্যে রচনা। আরণ্যক উপনিষদ-এর অনেকটাই প্রশ্ন-উত্তর আকারে রচিত, আবার গদ্যে বা ছন্দে একটানা কিছু কিছু রচনাও আছে। অথর্বসংহিতা-য় ঋগ্বেদ-এর সূক্ত ছাড়াও বেশ কিছু লোকায়ত বিশ্বাসের ও ধর্মাচরণের কথাও আছে, যেমন কবচ, মাদুলি, ঝাড়ফুঁক। একটি বড় অংশ হল রোগ (যেমন তক্সন অর্থাৎ ম্যালেরিয়া, যক্ষ্মা, কৃমি, শোথ, গলগণ্ড, গর্ভস্রাব, ন্যাবা, দৃষ্টিহীনতা, ইত্যাদি) সারানো, আয়ুবৃদ্ধি, সমৃদ্ধি ও স্বাস্থ্যের জন্য প্রার্থনা, শত্রু ও সতীনের ক্ষতির জন্যে প্রার্থনা। রোগ সারানোর সঙ্গে উদ্ভিদ ও ধাতুর মাদুলি ও কবচের কথা শুনি। এর সবটাই জাদুমন্ত্র নয়, অনেকটাই প্রাথমিক বিজ্ঞান ভারতবর্ষের চিকিৎসাবিজ্ঞানের প্রথম সূচনা অথর্ববেদ-এই। অথর্ববেদ-এর শেষ পর্যায়ের সূক্তগুলি যখন রচনা হচ্ছিন তখন আর্যরা বিহারের দক্ষিণপূর্ব অঞ্চল পেরিয়ে বাংলার উত্তরপূর্ব অঞ্চলে পৌঁছেছিল। তাই, এখানকার জলাজমিতে সহজেই হয় এমন সব রোগের নাম পাওয়া যায়। সে দিক থেকে অথর্ববেদ সংহিতা সাহিত্যের শেষতম অংশের ভূগোল, সমাজ, ধর্মবোধ ও আচরণের একটি দামি সামাজিক দলিলও বটে, সে দিক থেকে এর বিশেষ একটি তাৎপর্য ও মূল্য আছে। অথর্ববেদ সংকলনের কিছু আগে থেকেই ছোট ছোট স্বয়ংসম্পূর্ণ রাজ্যের উদ্ভব হয়; তাই এখানে রাজা ও সৈন্যদের সম্বন্ধে অনেক মন্ত্র আছে। বিষাক্ত বাণ থেকে, অস্ত্রক্ষত থেকে রক্ষার জন্য প্রার্থনা আছে; যুদ্ধ জয়ের জন্যেও রাজপুরোহিতকে অথর্ববেদ-এ পণ্ডিত হতে হত।

যজ্ঞ ছাড়া অথর্ববেদ-এ তপস্যার কথাও শুনি, মুনি, ঋষি তো ঋগ্বেদ-এও ছিল; অথর্ববেদ-এ তপস্যার উল্লেখ সমাজের এই অংশটির ওপরে আলো ফেলে। বেদ যখন রচনা হয় তখন আর্যরা লিখতে পড়তে জানত না, তাই সম্ভবত একেবারে শেষের দিকের সামান্য কিছু আগে পর্যন্ত সবটাই মুখে মুখে রচনা; লোকেরা গুরু শিষ্যপরম্পরায় শুনে মুখস্থ করে রাখত।

ধর্মাচরণ

ঋগ্বেদ-এর অধিকাংশ মণ্ডলই এক একটি ঋষিবংশের কবিরা রচনা করেছিলেন। ঋগ্বেদ-এর দশটি অধ্যায় মণ্ডল নামে বিখ্যাত; প্রত্যেক মণ্ডলেই অনেকগুলি করে সূক্ত যা আবৃত্তি বা গান করা যেত, এই সূক্তগুলি অনেক ‘ঋক’ বা পদের সমাহার। সূক্তগুলিকে মোটামুটি চারটি রচনাংশে ভাগ করা যায়: ১. স্তব, যাতে দেবতার আকৃতি, বেশবাস, অলংকার, অস্ত্রশস্ত্র, রথ ও অশ্বের বর্ণনা; ২. দেবতার কাছে ভক্তদের প্রার্থনা— আয়ু, যশ, সন্তান, পশুপাল, যুদ্ধ জয়, শত্রুনাশ, স্বাস্থ্য, ধন, অন্ন ইত্যাদির জন্য; ৩. ওই দেবতা আগে কোন ভক্তকে কী কী দিয়েছেন তারও বর্ণনা আছে কোথাও কোথাও; ৪. (ক) দেবতার বরের বিনিময়ে ভক্ত তাঁকে যা যা দিচ্ছেন, যেমন পুরোডাশ (যবের রুটি), গো-মহিষের মাংস, দুধ, দই, ছানা চরু (ক্ষীর), ঘোল, মধু, সুরা ও সোমরস, ইত্যাদি; এ ছাড়া (খ) দেবতাকে প্রীত করবার জন্যে নতুন করে রচিত কোনও স্তোত্র, অথবা যে স্তোত্র আগে শুনে দেবতা প্রীত হয়ে বরদান করেছেন এমন পুরোনো পরীক্ষিত শক্তিমান স্তোত্র। লক্ষ্য করলে দেখা যায় কবিবংশগুলির মধ্যে একটি প্রতিযোগিতার ভাব আছে; যার গান বেশি ভাল বলে প্রমাণিত, তার ভাগ্যে যশ ও পুরস্কার জুটত। দেবতা ও ভক্তের সম্পর্কটা মোটা দাগে আঁকলে সেটা একটা দেনাপাওনার সম্পর্কেই দাঁড়ায়: দেবতা যাতে খুশি হন এমন খাদ্যপানীয় স্তব আপ্যায়ন ভক্ত তাঁকে দেয়, আর ভক্ত যা চায়— ইহজীবনকে সুখী সমৃদ্ধ, বিজয়ী ও দীর্ঘায়ত করে তোলার জন্য যা যা প্রয়োজন তারই তালিকা এই সব প্রার্থনায়।

জীবনযাত্রা

সংহিতা-ব্রাহ্মণযুগের কর্মকাণ্ডে জীবনযাত্রার যে দিকটা চোখে পড়ে তাতে পশুপালের বৃদ্ধি, নিরাপত্তা, মানুষের পরমায়ু, স্বাস্থ্য, খাদ্য এবং পশুপাল ও সন্তানের সংখ্যাবৃদ্ধির জন্যে বহু প্রার্থনা। এর থেকে বোঝা যায় যে, পশুপালনই তাদের দৈনন্দিন প্রয়োজন মেটাবার একটা বড় উপায় ছিল; বহু সন্তান থাকলে শত্রুর সামনে লোকবলের জোর হত। তাই পশুর বৃদ্ধি, স্বাস্থ্য, ইত্যাদির জন্যে বিভিন্ন দেবতার দ্বারস্থ হত ভক্তরা। এ ছাড়া ভূমিকম্প, খরা, বন্যা, সংক্রামক ব্যাধি, ইত্যাদিতে আকস্মিক ভাবে পশুকুলের এবং মানুষের বিপদ যাতে না আসে তার জন্যে বিস্তর প্রার্থনা আছে। সংহিতার প্রার্থনার মূল কথা হল নীরোগ, স্বাস্থ্যবান ধনবান বিজয়ী ও পশুমান হয়ে যাতে মানুষ দীর্ঘকাল পৃথিবীতে বেঁচে থাকে।

আর্যরা এ দেশে আসবার পরে তাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা ও সমাজগঠন কী রকম ছিল তা জানবার মতো উপাদান আমাদের হাতে বেশি নেই। সিন্ধুসভ্যতার জনপদগুলি থেকে প্রাগার্য অধিবাসীদের যুদ্ধে হারিয়ে বা হটিয়ে দিয়ে আর্যরা যখন উত্তরপশ্চিম সীমান্ত অঞ্চলে প্রথম বসবাস করতে শুরু করল, তখনও তাদের জীবনযাত্রা প্রধানত পশুচারণের ওপরে নির্ভর করত। প্রাগার্যদের কাছে হয়তো তারা চাষের কাজ অল্প সময়েই শিখে নিয়েছিল। কিংবা জুলুম করে প্রাগার্যদের ফসল কেড়ে নিয়ে ভোগ করত। মাংস, দুধ, দুই, ছানা, ঘোল, ঘি, মধু, রুটি, সুরা, এগুলিই নিত্য খাদ্য ছিল এ সবের সঙ্গে তারা সোমরস যজ্ঞে দেবতাকে হব্য হিসেবে নিবেদন করত।

যজ্ঞ

যজ্ঞ হত বেদিতে, বেদি হল পরিষ্কার করা কতকটা জমি। কোনও মন্দির বা মূর্তি ছিল না; বেদির ওপরে হব্য দিয়ে আগুনে ঘি ও নৈবেদ্য উৎসর্গ করে দেবতাদের উদ্দেশে মন্ত্ৰ পাঠ বা গান করা হত। বেদি তিন রকমের হত: আহবনীয়, গার্হপত্য ও দক্ষিণা। মোটের ওপর এই ছিল যজ্ঞ। যজ্ঞ ছিল প্রধানত দু রকমের: নিত্য ও নৈমিত্তিক। অগ্নিহোত্র, ইত্যাদি কয়েকটি ছোটখাটো দৈনন্দিন যজ্ঞ ছিল নিত্য, নেহাৎ সংক্ষিপ্ত রকমের। আগুন জ্বেলে মন্ত্র পড়ে তাতে দুধ ঢেলে দিলেই হয়ে যেত অগ্নিহোত্র। বিশেষ বিশেষ ঋতুতে বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে যে যজ্ঞ অনুষ্ঠিত হত তা হল নৈমিত্তিক। প্রথম দিকের যজ্ঞে আড়ম্বর বিশেষ ছিল না, থাকা সম্ভবও ছিল না, কারণ পশুচারী যাযাবর আর্যরা পশুচারণের মধ্যেই একটা সময়ে সংক্ষেপে যজ্ঞ করত। ভারতবর্ষে পৌঁছেও প্রথম দিকে যুদ্ধ করে পায়ের নীচের মাটিতে অধিকার প্রতিষ্ঠা করা ও তার পরে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক ধরনের জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত একটি জনগোষ্ঠী ও সংস্কৃতির পাশাপাশি বাস করে ক্রমে তাদের তরুণ-তরুণীদের বিয়ে করে মিশ্র একটি জনগোষ্ঠী ও সংস্কৃতির প্রতিষ্ঠা করা— এ সবে আর্যদের বিস্তর সময় লেগেছিল। নিজেদের দুধ-মাংস প্রধান খাদ্যভোগের সঙ্গে প্রাগার্যদের মাছ সবজি রুটির অভ্যাস মিলল। তেমনই এখানকার হাতি ও নিজেদের ঘোড়া, এখানকার দ্রাবিড় অস্ট্রিক ভাষার সঙ্গে ইন্দো-ইয়োরোপীয় ভাষা, এদের ধর্মাচরণ ও নিজেদের যজ্ঞ, ইত্যাদি দিয়ে জীবনযাত্রার নতুন প্রণালী রচনা করা সময় সাপেক্ষ হয়ে থাকবে।

সংস্কৃতি

আর্যদের সমাজ মূলত পুরুষতান্ত্রিক ছিল, পুরুষ দেবতারা সংখ্যায় বেশি ও প্রধান ছিল এবং সমাজেও পুরুষেরই প্রাধান্য ছিল। পশুপালন, শিকার, এ সবে পুরুষের কাজই বেশি ছিল। চাষ শিখবার পরে মেয়েরা ক্ষেত-পাহারা দেওয়া, কাপড় বোনা, রান্না, শিশু, বৃদ্ধ ও পুরুষদের সেবায় দিন কাটাত; হয়তো কিছু সবজি ও ফসলের চাষও করত। খুব অল্পকালের মধ্যেই আর্যরা দক্ষিণপূর্ব দিকে এগোতে লাগল, নতুন নতুন অঞ্চলের লোকের সংস্পর্শে এসে তাদের জীবনযাত্রা, ধর্মবিশ্বাস, ধর্মাচরণ, সামাজিক রীতিনীতিতে কিছু কিছু পরিবর্তন দেখা দিল; যজুর্বেদ-এর যুগ থেকেই এই পরিবর্তন চোখে পড়ে। বীজ বোনা থেকে ফসল তোলার মধ্যে সময়টাতে কিছু শিল্পকর্ম— ধাতুর, মাটির, কাঠের, চামড়ার, পুঁতির কাজ, চালু হল। পেশার সংখ্যা বাড়তে লাগল, বেশবাসে পরিবর্তন এল, ক্রমে নারীর স্বাধীনতা কমতে লাগল। পরাজিত আদিবাসীরা দাসে পরিণত হল; তার জন্যে ভারী কাজের বোঝা এবং যজবেদ-এর যুগে ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয় বৈশ্যের দাসত্ব নির্দিষ্ট হয়ে গেল। যেমন নারীর কাজ ঠিক হয়ে গেল স্বামী সন্তান ও শ্বশুরবাড়ির লোকদের সেবা এবং বাড়ির কাজ।

এরই মধ্যে ছিল লৌকিক উৎসব, নাচ, গান, হয়তো বা খুব প্রাথমিক রকমের নাটকও। ঘরের বাইরে মেয়েরা খানিকটা স্বাধীনতা পেলেও ঘরের মধ্যে দাদাশ্বশুর বা শ্বশুর যিনিই বয়োজ্যেষ্ঠ হতেন, তাঁরই প্রতিপত্তি ছিল বেশি; তারপরে হয়তো শাশুড়ির, হয়তো বা অন্য বয়স্ক পুরুষের। পারিবারিক বন্ধন মোটের ওপর দৃঢ় ছিল— বহু মন্ত্রে মা-বাবার সন্তানবাৎসল্যের, ভাইদের সৌভ্রাত্র্যের সন্ধান পাই। আবার পরিবারের ভেতরে বাইরে তথাকথিত অবৈধ প্রণয়েরও বেশ কিছু নিদর্শন আছে; ভাই-বোন, বাপ-মেয়ের মধ্যে দু-একটি ব্যতিক্রমী হলেও অবৈধ সম্পর্কের কথা শোনা যায়। জারো ন’ অর্থাৎ ‘অবৈধ প্রেমিকের মতো’ এ উপমা বারে বারে ব্যবহার করা হয়েছে। তা ছাড়া ঋগ্বেদ-এই গণিকার বহু প্রতিশব্দ পাওয়া যায়। কাজেই সমাজে গণিকাবৃত্তি তখনই বেশ পরিচিত ছিল। সব দেশে সব কালে যে সব অপরাধ চলে এসেছে তার অনেকগুলিরই ঋগ্বেদ-এ উল্লেখ করা হয়েছে। হিংসা, স্বার্থপরতা, প্রতিহিংসাপরায়ণতা, শঠতা, আতিথ্যের ও আশ্রিতবাৎসল্যের অভাব, চুরি, ডাকাতি, খুন সবই তখনও ছিল। স্তবের মধ্যেই দেবতাকে বারবার বলা হয়েছে, ‘আমাদের শত্রুদের ছেলেপিলে ও গরুবাছুরগুলো ফেল।’ ‘কীকট দেশের ওরা যে যজ্ঞ করে না, কী করবে ওরা গাভী নিয়ে? ওগুলো কেড়ে আমাদের জন্যে এনে দাও।’ কিংবা ‘রাত্রে অমুকের বাড়ির মেয়েটিকে হরণ করতে যাচ্ছি, দেখো, ওর ভাইরা যেন না জেগে ওঠে, বাড়ির কুকুরগুলো যেন না চেঁচায়।’ এ ছাড়াও শুনি, বুড়ো বাপের সম্পত্তি ছেলেরা কেড়ে নিচ্ছে, অযোগ্য বর কন্যাপণ দিয়ে বিয়ে করছে। গায়ে লোম থাকায় যে-মেয়েটির বিয়ে হচ্ছে না তার বিলাপ, দুঃখী দরিদ্রের করুণ অবস্থা, দু-দলের মধ্যে রেষারেষি, মারামারি, হিংসে করে শত্রুকে কুয়োয় ফেলে দেওয়া— বহু ধরনের অপরাধ, মানবিক দুর্বলতা ও দুর্নীতির নজির পাওয়া যায়। আমাদের প্রথমতম সাহিত্য ঋগ্বেদ-এই বহুপত্নীকতা থাকার ফলে সতীনকে মেরে ফেলার প্রার্থনাও বেশ কিছু আছে এবং সহজেই অনুমান করা যায় এ ব্যাপারে প্রার্থনার সঙ্গে সক্রিয় প্রয়াসও ছিল। কাজেই ঋগ্বেদ-এর সমাজে যেমন সাধারণ হৃদয়বৃত্তি, মহানুভবতা ছিল, তেমনই হৃদয়হীনতা, নীচতা, শঠতা সবই ছিল। অর্থাৎ মানুষের সমাজ যেমন ভালমন্দ দুই নিয়েই হয় ঠিক তেমনটিই ছিল।

বৈদিক যুগের মাঝামাঝি সময়েই সমাজে অল্প কিছু ধনী ও বিস্তর গরিব ছিল। গরুই ছিল প্রধান সম্পত্তি এবং গরু চুরি করে নিয়ে যাওয়ার কথা প্রায়ই পাওয়া যায়। গরুর বদলে মানুষ অন্য জিনিসও সংগ্রহ করত, তাই যার অনেক গরু সেই ধনী। ধনীরা সংখ্যায় কম ছিল বলে সাধারণ লোক তাদের ঈর্ষা করত। দেবতার কাছে ধনের জন্য প্রার্থনা তাই সংখ্যায় এত বেশি। দেবতাদের প্রশংসা করে বলা হয়েছে ‘আগে তোমার অমুক ভক্তকে এত ধন-সম্পত্তি দিয়েছ, তা এখন আমাদেরও দাও।’ সূক্তগুলির এই অংশকে বলে দানস্তুতি।

নতুন দেশ দখল করে আর্যরা যখন দেখল যে পশুপালন এবং চাষ করলেই সংসার ভাল ভাবে চলে যায়, তখন অন্তত ঋষিরা (যাঁরা সূক্ত রচনা করতেন) জীবনে খুশি হয়েছিলেন এবং এই পৃথিবীতে দীর্ঘকাল বেঁচে থেকে যেন প্রত্যহ নতুন করে সূর্যোদয় দেখবার সৌভাগ্য লাভ করেন, সে কথা বারবার নানা সূক্তে বলেছেন। ঋগ্বেদ-এ ব্রাহ্মণে স্বর্গ, নরক, পরলোকের কথা নেই বললেই চলে। জীবন সুখেরই; যে হতভাগ্যের মৃত্যু হল সে এক অন্ধকারময় দেশে গেল, তার জন্যে রইল সমবেদনা। মৃত্যু নিয়ে কোনও বাড়াবাড়ি রকমের দুশ্চিন্তা ছিল না, কিন্তু মৃত্যুর পরে অজানা দেশে গিয়ে মানুষটার কী দশা হবে সে নিয়ে যথেষ্ট উদ্বেগ ছিল। তাই যমকে মৃতদের দেবতা বলে কল্পনা করা হল (মৃত্যুর দেবতা একেবারেই নয়) এবং তাঁকে উদ্দেশ করে, একগুচ্ছ প্রার্থনা নিবেদন হল: ‘যম যেন ওই অজানা দেশে প্রয়াত প্রিয়জনটিকে সেখানকার পথঘাট সব চিনিয়ে দেন, তার দেখাশোনা করেন, তার সঙ্গে খাওয়াদাওয়া করে তাকে আনন্দে রাখেন।’ এ সব সূক্তগুলি ঋগ্বেদ-এর শেষতম সংযোজন যে দশম মণ্ডল, তাতেই পাওয়া যায়।

মৃতের সঙ্গে তার স্ত্রীর সহমরণের রীতি ছিল না, বরং সদ্যোবিধবাকে এক জায়গায় বলা হচ্ছে যেন সে জীবিতদের মধ্যে অন্য একজনকে বিবাহ করে সন্তান উৎপাদন করে। মৃতের অন্ত্যেষ্টি ছিল শবদাহ, কোথাও কোথাও সমাধিও চালু ছিল। শ্রাদ্ধের কথা সংহিতা সাহিত্যে নেই, যদিও হয়তো তেমন কোনও অনুষ্ঠান ছিল। খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম শতকের পরের সাহিত্যে শ্রাদ্ধ দেখা দেয় এবং দু-তিনশো বছরের মধ্যে বেশ প্রাধান্য পায়। যারা মারা গেছে সেই পিতৃপুরুষদের বলা হত ‘পিতরঃ’, এঁদের জন্যেও কিছু কিছু অনুষ্ঠান হত। এখন যেমন বিবাহ, ইত্যাদি শুভকাজের আগে পিতৃশ্রাদ্ধ অনুষ্ঠানে পিতৃপুরুষদের প্রথমে প্রসন্ন করা হয়, তখনও তেমনই হত। ‘পিতরঃ’ ক্রমে ক্রমে দেবতা হয়ে ওঠেন, পিতৃক্রিয়াও বেশ প্রয়োজনীয় একটি অনুষ্ঠান। বৈদিক সমাজে সবচেয়ে ওপরে দেবতারা, তার ঠিক নিচেই ‘পিতরঃ’, যক্ষ, গন্ধর্ব, কিন্নর ও অপ্সরারা; তার পরে মানুষ। তারও পরে রাক্ষস, অসুর, পিশাচ, দৈত্য দানবরা- এরা মানুষের চেয়ে শক্তিমান, কিন্তু এরা মন্দশক্তি। খুব সম্ভব প্রথম পর্যায়ে আর্যরা যুদ্ধে পরাজিত প্রাগার্য অধিবাসীদের অসুর নাম দিয়ে হীন প্রতিপন্ন করতে চেয়েছিল। পিশাচরাও মন্দশক্তি, মাংসাশী; রাক্ষস হচ্ছে যাদের থেকে রক্ষা পেতে হবে। দনু আর দিতি বলে দুটি অশুভ জননীকে কল্পনা করা হয়েছিল। তাদেরই সন্তান দানব ও দৈত্য।

পরবর্তী সাহিত্যে দেখা দিল প্রেতাত্মা, এরা অতৃপ্ত মৃতের আত্মা, মানুষের ক্ষতি করাই এদের কাজ; কত তাদের নাম, কত রকম বিপদের আশঙ্কা তাদের কাছ থেকে। অথর্ববেদ-এ দেখি বহু রোগব্যাধি প্রেতাত্মা বা মন্দ আত্মার দ্বারাই ঘটে; তবে এ সবের জন্যে নানা প্রতিকারও বলে দেওয়া আছে— কবচ, মাদুলি, মন্ত্র অনুষ্ঠান। এ সবের সঙ্গে এমন সব শেকড়বাকড় ও ধাতুর যোগ আছে যার সত্যকার ভেষজ গুণও আছে। মনে রাখতে হবে যে, পুরোহিতরা যেমন গোষ্ঠীর সামূহিক বিপদ কাটানোর জন্যে যজ্ঞ করতেন, সুখশান্তি পাওয়ার জন্যে ঠিক তেমনই তার পাশাপাশি ছিল ওঝারা (যেমন আজও আছে)। ঝাড়ফুঁক, কবচ, মাদুলি, শান্তি স্বস্ত্যয়ন নিয়েই ছিল তাদের কারবার। মানুষের ইতিহাসে ওঝারাই হয়তো পুরোহিতের চেয়ে বেশি প্রাচীন। ওঝার সঙ্গে পুরোহিতের তফাৎ হল, পুরোহিত দেবতাকে আহ্বান করে সমাজের বিপদ উদ্ধারের বা সুখশান্তি বিধানের জন্যে প্রার্থনা করেন, আর ওঝারা কোনও দেবতার মধ্যস্থতা ছাড়াই অর্থহীন কিছু শব্দ উচ্চারণ করে সরাসরি অতিপ্রাকৃত শক্তির সাহায্যে ওই একই চেষ্টা করে। সমাজে মাঝেমাঝেই দেখা দিত নানা উৎপাত ও বিপদ: মহামারী, বন্যা, খরা, ভূমিকম্প, শত্রুর আক্রমণ; বিপদের কি আর লেখাজোখা আছে? কাজেই দেবতার সংখ্যা বাড়তেই থাকে, সঙ্গে সঙ্গে দীর্ঘস্থায়ী ও জটিল হতে থাকে যজ্ঞ, আর সেই অনুপাতে চক্রবৃদ্ধিহারে বাড়তে থাকে যজ্ঞের দক্ষিণা। দক্ষিণায় দেওয়ার সামগ্রীর ফদও ক্রমে দীর্ঘতর হয়, পরিমাণ ও সংখ্যাও সমানে বেড়ে চলে; ফলে পুরোহিতের লোভ এমন দুর্বার হয়ে উঠল যে যজ্ঞ সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছিল।

এই ছিল বৈদিক সংহিতা যুগের সমাজের ছবি। শীর্ষে ছিলেন দেবতারা, তার নিচে ‘পিতরঃ’, তার নিচে উপদেবতা (যক্ষ, গন্ধর্ব, ইত্যাদি), তার পরে মানুষ, এবং সব নিচে অপদেবতা (প্রেতাত্মা, রাক্ষস, অসুর, ইত্যাদি)। এই ছকে মানুষের বস্তুজগতের ও কল্পনাজগতের যা কিছু প্রার্থিত তা পাওয়ার বিধান ছিল এবং যা কিছু অবাঞ্ছিত তাকে ঠেকাবার প্রণালীরও হদিশ মেলে। ধর্ম মানেই ছিল যজ্ঞ বা ঝাড়ফুঁক। ধর্মের একটি উৎস হল ভয়- রোগব্যাধি, মৃত্যু, প্রিয়জনবিনাশ, শত্রুর আক্রমণ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, ইত্যাদি সম্বন্ধে আতঙ্ক, পৃথিবী ও জীবনের অজানা দিকগুলি নিয়ে একটা আতঙ্ক থেকে নিরাপত্তার জন্য আকুলতা। ধর্মের অন্য উৎস ছিল বিস্ময়: প্রকৃতির প্রাচুর্য, সৌন্দর্য, সূর্যচন্দ্রগ্রহমণ্ডলীর অবস্থান, ঋতুর নিয়মিত আবর্তন, দিনরাত্রির আনাগোনা, মানুষের জীবনে নানা পরিবর্তন, প্রাণিজ ও উদ্ভিজ জগতের নানা বিস্ময়কর বস্তুর সমাবেশ, যার কার্যকারণ সম্পূর্ণ অজ্ঞাত সে সব নিয়ে অপার বিস্ময়। সৃষ্টি, জীবন, মৃত্যু সবই তো রহস্যে আবৃত, তাই সে সবই মানুষকে অভিভূত করত। বহু সূত্রে এই ভয় ও বিস্ময়ের প্রকাশ দেখা যায়। পৃথিবীর সব দেশেই ধর্মের আদিমতম উৎস এই দুটি অনুভূতিতে। দেবতা কল্পনা করে বেদের যুগের মানুষ তার ভয় ও বিস্ময় দুই-ই নিবেদন করেছে দেবতার কাছে; নিজে দায়িত্ব নিয়েছে নিয়মিত যাগযজ্ঞ করে দেবতাদের প্রসন্ন রাখার, যাতে তাঁরা তাদের মঙ্গল বিধান করেন।

ঋগ্বেদ-এর আর্যদের সম্পত্তি ছিল পশু, অর্থাৎ ঘোড়া, গরু, মোষ, ভেড়া, ছাগল; পেশা ছিল প্রধানত পশু পালন। খাদ্যের জন্য শিকারও করত তারা, পরাজিত শত্রুর সম্পত্তি লুঠতরাজ করত। ছোটখাট কুটিরশিল্পের মধ্যে গেরস্থালির দরকারি বাসনপত্র ছাড়াও ছিল রথ তৈরি, মোটামুটি রকমের ছুতোরের কাজ, চামড়ার কাজ, কাপড় বোনা, পশম বোনা আর কিছু গয়না ও খেলনা তৈরি। আর্যরা প্রথম দিকে রোদে শুকনো ইঁটের বাড়িতে থাকত, পোড়া ইঁট তৈরি করতে শিখেছিল অনেক পরে।

ঋগ্বেদ-যজুর্বেদ-এর যুগে সেনাপতি, দলপতি, গোষ্ঠীপতিই শাসন চালাত; গোষ্ঠীগুলি ছোট ছোট কৌমে বিভক্ত ছিল। শাসনকাজের জন্যে ছিল সভা ও সমিতি, এগুলি কেবলমাত্র পুরুষের সমাবেশ, এখানে নারীর প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল, গোষ্ঠীর সমস্ত পুরুষ আসত সমিতিতে আর সভা ছিল গোষ্ঠীর মধ্যে বয়স্ক, অভিজ্ঞ, প্রতিষ্ঠিত পুরুষদের সমাবেশ। গোষ্ঠীর ভাগ্য-ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে সিদ্ধান্ত নেওয়াই এ দুটির দায়িত্ব ছিল। ঠিক কী ভাবে কী কাজ কোনটিতে হত তার কিছু জানা যায় না।

যজুর্বেদ-এর আমলে সমাজে যে-চারটি বর্ণের উল্লেখ পাই— ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র— প্রথম যুগে এগুলি জন্মগত ছিল না, বরং এদের মধ্যে সম্পর্ক বেশ খানিকটা সঞ্চারী ছিল, অর্থাৎ নিজের রুচিপ্রবৃত্তি ও ক্ষমতা অনুসারে এক বর্ণ থেকে অন্য বর্ণে যাওয়া যেত। এর কিছু কিছু নিদর্শন বেদে আছে। পরে অবশ্য ক্রমশই বর্ণগুলি জন্মগত, বংশগত হয়ে ওঠে।

সমাজ

বড় পরিবারকে বলা হত কুল, সেখানে একই বাড়িতে তিন-চার প্রজন্মের পুরো যৌথ পরিবার বাস করত। গ্রামে বাড়িগুলি কাছাকাছি থাকত, তার পরে পরিবার পিছু কতকটা নির্দিষ্ট জমি পরিবারের পশুগুলির চারণভূমি, তার ওপারে সারা গ্রামের জন্যে নির্দিষ্ট সমবেত চারণভূমি এবং তারও ও-পারে জঙ্গল। পাশে অন্য গ্রাম। জমির ব্যক্তিগত মালিকানা ছিল না, বাসের অধিকারই ছিল একমাত্র অধিকার। পরিবারের জ্যেষ্ঠ পুরুষই গৃহস্বামী, যদিও বাড়ির কর্তৃত্ব একেবারেই প্রথম যুগে ছিল স্বামী-স্ত্রী দু’জনের। তখন মেয়েদের খানিকটা স্বাধীনতা ছিল, কন্যা নিজে বর পছন্দ করে বিয়ে করত। হয়তো-বা পরিবারের মধ্যেও নারী-পুরুষের এক ধরনের সাম্য ছিল। অন্য এক ধরনের স্বাধীনতারও কিছু কিছু নজির পাওয়া যায়। বুদ্ধিমতী নারী হয়েও যুদ্ধে নেতৃত্ব দিচ্ছেন এমন কথা শুনি। যুদ্ধে বিপলার একটি পা কাটা গেছে, দেবতা অশ্বিনরা তাকে কাঠের পা গড়ে দিছেন তাও বলা আছে। যখন প্রাগার্য ও অন্যান্য গোষ্ঠীর সঙ্গে যুদ্ধ চলছে তখন নারী হয়তো সমাজে কতকটা সমান অধিকার পেত, পুরুষের পাশাপাশি যুদ্ধও কত। যে কুমারীরা বাপের বাড়িতেই বুড়ো হয়ে যেত তাদের ‘কুলপা’ কন্যা, ‘অমাজু’ বা ‘অমাজুরা’ (অমা=বাড়ি, সেখানে যে জীর্ণ হচ্ছে) বলা হত। সমাজে হয়তো পুরো সম্মান তারা পেত না, কিন্তু বিয়ে যে বাধ্যতামূলক হয়ে যায়নি তখনও, যেমনটা পরবর্তীকালে হয়েছিল, তার প্রমাণ রয়ে গেছে। সম্ভবত, বেশ অল্পকালের মধ্যেই নারীর এই স্বাধীনতা চলে যায়। প্রথমদিকের আর্যদের দেবমণ্ডলীর মধ্যে কিছু দেবী ছিল— ঊষা, ইলা, ভারতী, সরস্বতী, বাক্, ইত্যাদি পরে ক্রমে পুরুষ দেবতাদের সংখ্যাই বাড়তে থাকে। অর্থাৎ সমাজে তখন পুরুষ প্রধান হয়ে উঠেছে।

এখনও যেমন তখনও তেমনই সমাজে বিবাহের বাইরেও নারীপুরুষের সম্পর্ক ঘটত; বেদে তার বিস্তর নজির মেলে এবং এ নিয়ে সমাজ মোটেই শুচিবায়ুগ্রস্ত ছিল না। বিধবা বিবাহ হয়তো খানিকটা প্রচলিত ছিল, সতী প্রথা অর্থাৎ সহমরণ ছিল না। শত্রুর ক্ষতি করার জন্যে বহু প্রার্থনা আছে, প্রার্থনাগুলিতে পরাজিত শত্রু ও ভিন্ন গোষ্ঠীর সম্বন্ধে হিংসার বহু নজির পাওয়া যায়।

সাধারণ ভাবে মানুষ দীর্ঘজীবন কামনা করত এবং প্রথম পর্যায়ে লোকে জীবন সুখের বলেই মনে করত। মৃত্যুর পরে স্বর্গনরকের কল্পনা তখনও নেই, মৃত্যুকে অন্ধকারময় দুঃখের অবস্থা মনে করা হত। দীর্ঘকাল ধরে সূর্য দেখবার প্রার্থনা বারেবারেই শোনা যায়। জীবনটা দুঃখের, তার থেকে বেরিয়ে পড়াই ভাল, এমন কথা ব্রাহ্মণসাহিত্যেও শোনা যায় না।

‘সূর্যের স্ত্রী ঊষা যাচ্ছে’— লক্ষ করি যে ঊষা সূর্যের আগে আগে যায়, কাজেই স্ত্রী সর্বদাই স্বামীর পিছনে থাকত না। ‘ঊষা নিজের সৌন্দর্য সকলের সামনে প্রকাশ করছে’, ‘মা যাকে স্নান করিয়ে সাজিয়ে দিয়েছে তেমনই সুন্দরী কন্যা ঊষা।’ অগ্নি কেমন শুচি? ‘স্বামীর আদরের বধূর মতো।’ লক্ষ করি, দেবতার শুচিতার উপমান মর্ত বরবধূর প্রেমে। ‘স্বামীকে কামনা করে যে বধূ তার মতো স্মিত হাসি ঊষার।’ নরনারীর সম্পর্কের বর্ণনায় একটা সতেজ সৌন্দর্য বারেবারেই চোখে পড়ে।

দেবকুল

দেবতারা সংখ্যায় অনেক। এঁদের মধ্যে প্রথম দিকের দেবতারা প্রাকৃতিক শক্তি দেবরূপে কল্পিত, যেমন সূর্য, চন্দ্র, অগ্নি, বায়ু, নদী, অপঃ (জল), পর্জন্য (ঝড়), ইত্যাদি। দ্বিতীয় এক গোষ্ঠীর দেবতা ছিলেন যাঁদের নিয়ে বহুকাল আগে আর্যরা যাত্রা শুরু করেছিলেন এবং যাদের যথার্থ পরিচয় ঋগ্বেদের যুগেই লোকে ভুলে গেছে; কারও কারও সম্বন্ধে আবছা একটা স্মৃতিমাত্র আছে, যেমন, ভগ, অংশ, দক্ষ, অযমন, বিবস্বৎ, ইলা, ভারতী, ইত্যাদি। তৃতীয় ছোট একটি গোষ্ঠীর মধ্যে সেই সব দেবতারা যাঁরা পূর্বে মানুষ ছিলেন, বিশেষ কীর্তি বা যোগ্যতার জন্যে দেবতায় পরিণত হয়েছেন; যেমন, ঋভুরা, অশ্বিনরা ও ইন্দ্র। একেবারে শেষ পর্যায়ে কিছু বিমূর্ত বা প্রায়-বিমূর্ত শক্তিকে দেবতারূপে বর্ণনা করা হয়েছে; যেমন, প্রজাপতি, পুরুষ, ব্রহ্মণ, কাল, হিরণ্যগর্ভ, বৃহস্পতি, ব্রহ্মণস্পতি, ইত্যাদি।

পশুপালন থেকে আর্যরা যখন চাষ শিখল, তখন বীজ বোনা থেকে ফসল তোলার মধ্যেকার সময়টায় অবসর ছিল এবং চাষের জন্যে জমির কাছাকাছি স্থায়ী ভাবে বাস করতে হত। ওই অবসরে পুরোহিতরা যজ্ঞ ব্যাপারটাকে বিস্তৃত ও জটিল করে তুলতে লাগল। পুরোহিতের সংখ্যা বাড়তে লাগল; তাদের কাজেও ভাগ হতে লাগল, তাদের সহকারীর সংখ্যাও বাড়ল, অতএব দক্ষিণার পরিমাণও চক্রবৃদ্ধিহারে বাড়তে লাগল। এটা ঘটেছিল সংহিতার শেষ যুগে।

আর্থিক অবস্থা

যজুর্বেদ-এর আমল থেকেই সমাজের চারটি বর্ণ মোটামুটি কর্মভিত্তিক ছিল। ব্ৰাহ্মণ অধ্যাপনা ও শাস্ত্রচর্চা করত, ক্ষত্রিয় যুদ্ধ করত। তা ছাড়া যে সব ক্ষত্রিয়রা রাজার কাছাকাছি থাকত তাদের বলত রাজন্য; প্রধানত এদের সঙ্গে ব্রাহ্মণদের সমাজে প্রতিপত্তি নিয়ে একটা রেষারেষি ছিল। বৈশ্য চাষবাস ও পশুপালন করত; শূদ্র ছিল উচ্চ তিন বর্ণের দাস। এ যুগের মাঝামাঝি বৈশ্যের আর্থিক উন্নতি হতে লাগল; পশুপালন ও চাষ ছাড়াও সে বাণিজ্য করে ধনী হয়ে উঠল।

ব্যবসা চলত বিনিময় প্রথায়, যেমন গরুর বদলে কাপড় বা রথ, গরুই ছিল ধনের আদিম একক, তাই ধরে, অর্থাৎ জিনিসের দাম ঠিক হত ‘এক গরু’ বা ‘দু গরু’হিসেবে। যার যে উৎপন্ন দ্রব্যটা বেশি সে তার বাড়তির বদলে দরকারি জিনিস কিনত। এ ভাবে সমাজে নানা বস্তুর উৎপাদকরা দরকার অনুসারে নিজেদের বাড়তি দিয়ে কেনাবেচা করত। সারা পৃথিবীতেই প্রথম অর্থনৈতিক লেনদেন এ ভাবে বস্তুর আদানপ্রদানেই ঘটত। এ দেশে এটা দীর্ঘকাল ধরে চলেছিল, কারণ, গ্রামকেন্দ্রিক জীবনযাত্রায় এইটিই সবচেয়ে সুবিধাজনক ব্যবস্থা। এই বিনিময়-ভিত্তিক ব্যবসাতেই শ্রেণি-বিভাজনের বীজ আছে; কেউ যদি প্রয়োজনের অতিরিক্ত অনেকটা উৎপাদন হয়, বিশেষত এমন জিনিস যার চাহিদা খুব বেশি, তা হলে সে চড়া দামে চাহিদার জোগান দিতে পারে। ফলে ধনী দরিদ্র বিভেদ হবেই। তবে আদিম উৎপাদনব্যবস্থা স্বভাবতই এত অনুন্নত ছিল যে, অবস্থার মধ্যে ফারাক খুব বেশি হওয়ার সম্ভাবনা ছিল না। দুঃখী মজুরের কথা ঋগ্বেদেই পাই: ‘পাথর-কাটার মজুর অনেকক্ষণ পরিশ্রমের পরে মাঝেমাঝে যেমন হাই তুলে পিঠটা টানটান করে নেয়, তেমনই, হে দেবতা আমরা ঘাড় তুলে তোমার দিকে চাইছি।’ এখানে ক্লান্ত গরিব মজুরের ছবিটি রয়ে গেছে বহু মজুরের প্রতিনিধি হয়ে।

স্তবের মধ্যে মাঝেমাঝে ধনী বলে আলাদা উল্লেখ থেকে বুঝতে পারি যে, সমাজে প্রাথমিক এক রকম শ্রেণিভেদ ছিল। ‘মরুরা (বিদ্যুতে) সাজছে যেমন ধনী বর সোনার গয়নায় সাজে।’ ‘অশ্বিরা রেভকে কুয়ো থেকে উদ্ধার করেছেন, যেমন করে মানুষ (কুয়ো থেকে) সোনার কলসি তোলে।’ অযোগ্য বর কনের বাড়িতে দামি উপহার দেয়। ‘দেবতা পূষা জানেন কোথায় গুপ্তধন, যেমন ডাকাতরা জানে।’ এ সব থেকে ধনীর সঞ্চিত ধনের, লুকোনো সোনার কলসির, গুপ্তধনের খবর জানতে পারি; ঠিক তেমনই কিছু কিছু মন্ত্রে দারিদ্র্যের খবরও পাই: ‘অভাবে কুকুরের নাড়িভুঁড়ি রান্না করে খাচ্ছে গরিব বামদেব, এমন কথাও আছে। সে কী অভাব! কুকুরের মাংসও নয়, নাড়িভুঁড়ি রান্না করছে। অন্য কোনও মাংস জোগাড় করতে পারত না বলে সমাজের সবচেয়ে নিচুতলার মানুষ কুকুরের মাংস খেত, তাই তাদের বলা হত ‘শ্বপচ’ বা শ্বপাক’ (চণ্ডাল, যারা শ্বন অর্থাৎ কুকুর পাক করে)— অন্য মাংস কেনার সংগতি তাদের দেয়নি যে সমাজ, সেই সমাজই তাচ্ছিল্য করে তাদের ‘শ্বপাক’ বলেছে।

অভাব থাকলে, ধনী দরিদ্রের মধ্যে পার্থক্য থাকলে চোর থাকবেই। ঋগ্বেদ-এ বেশ কয়েকবার চোরের উল্লেখ আছে। ‘যে গরু চোর গরুদের নিয়ে গুহায় ঢুকেছে তাকে ধরবার জন্যে যেমন তার পায়ের ছাপ ধরে ধরে লোক খোঁজে।’ অর্থাৎ গরু চুরি একটি পরিচিত ঘটনা ছিল। অন্যান্য জায়গাতেও চোরের উল্লেখ আছে। ঠকানোর একটা করুণ উল্লেখ দেখি, বুড়ো বাপের সম্পত্তি যেমন ছেলেরা কেড়ে নেয়।’ নিষ্ঠুর প্রতারণাও তা হলে সমাজে বিরল ছিল না। রাজারা তো সর্বদাই শত্রু দমন করে থাকে; এক জায়গায় পড়ি, ‘রাজা যেমন দুর্বল শত্রুকে দমন করেন যক্ষ্মা তেমনই (দমন) করে সুস্থ মানুষকে।’ শত্রু সম্বন্ধে ঈর্ষার বহু বর্ণনা আছে, শত্রুপীড়নেরও। সমাজ তখন গ্রামপ্রধান, গ্রাম গোষ্ঠীকেন্দ্রিক। প্রত্যেক গ্রামেই মানুষের জীবনধারণের জন্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় বস্তু উৎপাদনের জন্যে যে সব পেশার দরকার ছিল তার সবই থাকত।

যৌথ পরিবার বা কুলে সবচেয়ে বয়স্ক পুরুষটিই ছিল প্রধান, তারপরে অন্যান্য পুরুষ সদস্যরা বয়স এবং সম্পর্ক অনুক্রমে; তারপরে মেয়েরা, সে-ও বয়সের ক্রম অনুসারে। যদিও বিয়ের কনেকে আশীর্বাদ করে বলা হত: ‘শ্বশুর শাশুড়ি, ননদ, দেওরদের ওপরে সাম্রাজ্ঞী হয়ো’, তবু সেটা নেহাৎ ইচ্ছাপ্রকাশ মাত্র। বাস্তবের ছবি অন্য রকম। অথর্ববেদ-এ পড়ি, ‘সূর্যোদয়ে প্রেতরা যেমন ছুটে পালায়, তেমনই শ্বশুরের সামনে থেকে ছুটে পালায় পুত্রবধূ।’ এটাতে আর যাই হোক, সাম্রাজ্ঞী আর প্রজার সম্পর্ক বোঝায় না। অথর্ববেদে আছে, যে বধূ স্বামীর গৃহে ছেড়ে গেছে তাকে ফিরিয়ে এনে বাড়িতে প্রতিষ্ঠিত করার জন্যে মন্ত্র। এক নারীর দুটি এবং দশটি বিবাহের উল্লেখও পাই। এগুলি বহুলপ্রচলিত না হলেও কদাচিৎ নিশ্চয়ই ঘটত। অথর্ববেদ-এ সতীদাহের দুটি উল্লেখ আছে, ‘এই জীবিত মেয়েটিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে মৃতের বধূ হতে’ আর ‘এ নারী (সহমরণে) প্রাচীন রীতির অনুসরণ করছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *