১০. ভূপাল চৌকিদার

ভূপাল চৌকিদার ইউনিয়ন বোর্ডের মোহর-দেওয়া একখানা নোটিশ হাতে করিয়া চলিয়াছিল, আগে আগে ড়ুগড়ুগ শব্দে ঢোল বাজাইয়া চলিতেছিল পাতু।

এক সপ্তাহের মধ্যে আষাঢ় আশ্বিন-দুই কিস্তির বাকি ট্যাক্স আদায় না দিলে জরিমানাসমেত দেড়গুণ ট্যাক্স অস্থাবর ক্রোক করিয়া আদায় করা হইবেক।

জগন ডাক্তার একেবারে আগুনের মত জ্বলিয়া উঠিল।

–কি? কি? কি করা হইবেক?

ভূপাল সভয়ে হাতের নোটিশখানি আগাইয়া দিয়া বলিল—আজ্ঞে, এই দেখেন কেনে।

জগন কঠিন দৃষ্টিতে ভূপালের দিকে চাহিয়া বলিল,—সরকারি উর্দি গায়ে দিয়ে মাথা নোয়াতেও ভুলে গেলি যে!

অপ্রস্তুত হইয়া ভূপাল তাড়াতাড়ি ডাক্তারের পায়ের ধুলা কপালে মুখে লইয়া বলিল, আজ্ঞে দেখেন দেখি, তাই ভোলে! আপনকারাই আমাদের মা-বাপ।

পাতু বলিল—লিচ্চয়!

জগন নোটিশখানা দেখিয়া একেবারে গর্জন করিয়া উঠিল—এয়ার্কি নাকি? এ সব কি পৈতৃক জমিদারি পেয়েছে সব! লোকের মাঠের ধান মাঠে রইল, বাবুরা একেবারে অস্থাবরের নোটিশ বার করে দিলেন! মানুষকে উৎখাত করে ট্যাক্স আদায় করতে বলেছে গবর্নমেন্ট? আজই দরখাস্ত করব আমি।

ভূপাল হাত জোড় করিয়া বলিল-আজ্ঞে, আমরা চাকর, আমাদিগে যেমন বলেছে। তেমনি–

—তোদের দোষ কি? তোরা কি করব? তেরা ঢোল দিয়ে যা।

পাতু ঢোলটায় গোটাকয়েক কাঠির আঘাত করিয়া বলিল-আজ্ঞে ডাক্তারবাবু, লবান্ন হবে বাইশে তারিখ।

–নবান্ন? বাইশে?

–আজ্ঞে হ্যাঁ।

—আর সব লোককে বল গিয়ে। গায়ের লাকের সঙ্গে আমার কোনো সম্বন্ধ নাই। আমি নবান্ন করব আমার যেদিন খুশি।

পাতু আর কোনো উত্তর না দিয়া পথে অগ্রসর হইল। ডাক্তার ক্রুদ্ধ গাম্ভীর্যে থমথমে মুখে তাহার দিকে চাহিয়া বলিল—এই পেতো শোন।

আজ্ঞে? পাতু ঘুরিয়া পাঁড়াইল। জগন বলিল চলে যাচ্ছিস যে? পাতু আবার বলিল-আজ্ঞে?

ডাক্তার এবার কথা খুঁজিয়া না পাইয়া বলিল—সেদিন দরখাস্তে টিপসই দিতে এলি না যে বড়? খুব বড়লোক হয়েছিস, না? শহরে গিয়ে বাড়ি করবি, এ গায়েই আর থাকবি না শুনছি!

বিরক্তিতে পিতুর ভ্রূ কুঁচকাইয়া উঠিল। কিন্তু কোনো উত্তর দিল না। ডাক্তার ঘরে ঢুকিয়া দরখাস্তখানা বাহির করিয়া আনিয়া সস্নেহে শাসনের সুরে বলিল—দে, টিপছাপ দে। তোর জন্যেই আমি ছাড়ি নাই দরখাস্ত।

পাতু এবার বিনা আপত্তিতেই টিপছাপ দিল। সেদিন যে সে আসে নাই, সমস্ত দিনটাই গ্রামত্যাগের সঙ্কল্প লইয়া জংশন শহর পর্যন্ত ঘুরিয়া আসিয়াছে—সে সমস্তই সাময়িক একটা উত্তেজনার বশে। আজও যে সে মুহূর্ত-পূর্বে ডাক্তারের কথায় কুঞ্চিত করিয়াছে—সেও ডাক্তারের কথার কটুত্বের জন্য। নতুবা সাহায্য বা ভিক্ষা লইতে তাহার আপত্তি নাই। গভীর কৃতজ্ঞতার সহিতই সে টিপছাপ দিল। টিপছাপ দিয়া বুড়া আঙুলের কালি মাথায় মুছিতে মুছিতে কৃতজ্ঞভাবে আবার হাসিয়া বলিল,—ডাক্তারবাবুর মত গরিবগুর্বোর উপকার কেউ করে না।

ডাক্তারের জুতার ধুলা আঙুলের ডগায় লইয়া তাহা ঠোঁটে ও মাথায় বুলাইয়া লইল। ভূপাল চৌকিদারও তাহার অনুসরণ করিল।

ডাক্তার ইহার মধ্যে কিছু চিন্তা করিতেছিল, চিন্তা-শেষে বার দুই ঘাড় নাড়িয়া বলিল–দাঁড়া। আরও একটা টিপছাপ দিয়ে যা।

–আজ্ঞে? পাতু সভয়ে প্রশ্ন করিল। অর্থাৎ, আবার কেন? টিপছাপকে ইহাদের বড় ভয়!

–এই ট্যাক্স আদায়ের বিরুদ্ধে একটা দরখাস্ত দোব। তোদের ঘর পুড়ে গিয়েছে, চাষীদের ধান এখনও মাঠে, এই অসময় অস্থাবরের নোটিশ, এ কি মগের মুলুক নাকি?

এবার ভয়ে পাতুর মুখ শুকাইয়া গেল। ইউনিয়ন বোর্ডের হাকিমের বিরুদ্ধে দরখাস্ত! সে ভূপাল চৌকিদারের দিকে চাহিল ভূপালও বিব্রত হইয়া উঠিয়াছে। ডাক্তার তাগিদ দিয়া বলিল—দে, টিপছাপ দে!

-আজ্ঞে না মশায়। উ আমি দিতে পারব। পাতু এবার হনহন করিয়া পথ চলিতে আরম্ভ করিল। পিছনে পিছনে ভূপাল পলাইয়া হাঁফ ছাড়িয়া বাঁচিল। ভূপাল ভাবিতেছিল—খবরটা আবার পেসিডেন বাবুকে দিয়া দিতে হইবে। নহিলে হয়ত সন্দেহ আসিবে তাহারও ইহার সহিত যোগসাজশ আছে।

ডাক্তার ভীষণ ক্রুদ্ধ হইয়া পলায়নপর পাতু ও ভূপালের দিকে চাহিয়া দাঁড়াইয়া রহিল। কয়েক মুহূর্ত পরেই সে ফাটিয়া পড়িল-হারামজাদার জাত, তোদের উপকার যে করে সে গাধা!

বলিয়াই সে দরখাস্তখানা ছিঁড়িয়া ফেলিবার উপক্রম করিল।

—ছিঁড়ো না, ডাক্তার ছিড়ড়া না।-বাধা দিল পাঠশালার পণ্ডিত দেবু ঘোষ। সে কিছুদূরে দাঁড়াইয়া সবই দেখিয়াছিল। এসব ব্যাপারে তাহারও আন্তরিক সহানুভূতি আছে।

দেবু ঘোষ একটু বিচিত্র ধরনের মানুষ। এ গ্রামের পাঁচজনের একজন হইয়াও সে যেন সকল হইতে একটু পৃথক। তাহার মতামতগুলিও সাধারণ মানুষ হইতে পৃথক। আপনাদের দুর্দশার প্রতিকারের জন্য কাহারও সাহায্যভিক্ষা করিতে চায় না। অনিরুদ্ধকে, হিরুকে শাসন করিতে জমিদারের দ্বারস্থ হইতে সে নারাজ। কিন্তু পঞ্চায়েতী মজলিসের আয়োজনে সে-ই প্রধান উদ্যোক্তা। তবু আজ সে জগন ডাক্তারকে দরখাস্ত ছিঁড়িতে বাধা দিল।

ডাক্তার দেবনাথের মুখের দিকে চাহিয়া বলিল—ছিড়তে বারণ করছ? ওই বেটাদের উপকার করতে বলছ? দেখলে তো সব!

দেবু হাসিয়া বলিলতা দেখলাম! ওদের ওপর রাগ করে কি করবে বল! দাও, তোমার ট্যাক্সের দরখাস্ত, আমি সই করছি, আর দশজনার সইও যোগাড় করে দিচ্ছি।

ডাক্তার একটা বিড়ি ও দেশলাই পণ্ডিতকে দিয়া বলিল—বস। তারপর বাড়ির দিকে মুখ ফিরাইয়া চিৎকার করিয়া বলিল—মিনু, দুকাপ চা!

মিনু ডাক্তারের মেয়ে।

ডাক্তার আবার আরম্ভ করিল—লোকে ভাবে কি জান, পণ্ডিতঃ ভাবে এ সবের মধ্যে আমার বুঝি কোনো স্বাৰ্থ আছে। অন্যায় অত্যাচারের প্রতিকার হলে বাঁচবে সবাই, কিন্তু রাজা হয়ে যাব আমি!

দেবু বিড়ি ধরাইয়া দেশলাইটা ডাক্তারের হাতে দিয়া একটু হাসিয়া বলিল,—তা স্বাৰ্থ আছে বৈকি ডাক্তার।

–স্বাৰ্থ? ডাক্তার রুক্ষ অথচ বিস্মিত দৃষ্টিতে পণ্ডিতের দিকে চাহিল।

পণ্ডিত হাতের বিড়িটার আগুনের দিকে চাহিয়া হাসিতে হাসিতেই সহজভাবেই বলিল–স্বাৰ্থ আছে বৈকি! দশজনের কাছে গণ্যমান্য হবে তুমি, দুদিন বাদে ইউনিয়ন বোর্ডের মেম্বারও হতে পার। স্বাৰ্থ নেই? আমার মনে হয় সংসারে স্বার্থ-চিন্তা ছাড়া মানুষ টিকতেই পারে না।

ডাক্তারের কপাল কুঞ্চিত হইয়া উঠিল, বলিল-ওটাও যদি স্বার্থ হয়, তবে তো সাধুসন্ন্যাসীদের ভগবানের তপস্যা করার মধ্যেও স্বাৰ্থ আছে হে। তাহলে বশিষ্ঠ বুদ্ধদেবও স্বার্থপর!

—স্বার্থ কথাকে ছোট করে না দেখলে ও কথা নিশ্চয় সত্য। পরমার্থও তা অর্থ ছাড়া নয়। দেবু তেমনি হাসিয়াই বলিল।

ডাক্তার বলিল-ইউনিয়ন বোর্ডের মেম্বার আমি হতে চাই, আলবৎ হতে চাই। সে হতে চাই দশজনের সেবা করবার জন্যে। পরলোক-ফরলোক জপতঙ্গ ও-সবে আমার বিশ্বাস নাই। ওই ছিরু পাল—চুরি করবে-ব্যভিচার করবে, আর ঘরে বসে জপতপ করবে—ঘটা করে কালীপুজো, অন্নপূর্ণা পুজো করবে, ওরকম ধর্মের মাথায় মারি আমি পাঁচ ঝাড়ু।

অতঃপর ডাক্তার আরম্ভ করিল এক সুদীর্ঘ বক্তৃতা। মনুষ্য-জীবন ধন্য করিতে কে না চায় এ সংসারে! কেউ মানুষের সেবা করিয়া ধন্য হইতে চায়, ইত্যাদি ইত্যাদি।

বক্তৃতার উত্তরে দেবু ঘোষও বক্তৃতা দিতে পারি, কিন্তু সে তাহা দিল না, কেবল বলিল–দশজনের ভাল করতে চাও, খুব ভাল কথা, ডাক্তার। কিন্তু গায়ের লোককে কেন ছোট ভাব তুমি? আজ বললে—গাঁয়ের লোকের সঙ্গে নবান্ন করবে না তুমি! কদিন আগে দু-দুটো মজলিস হল গায়ে তুমি তো গেলেই না, উলটে কামারকে তুমি উস্কে দিলে।

–কখনও না। গাঁয়ের লোকের বিরুদ্ধে আমি কাউকে উস্কে দিই নাই। অনিরুদ্ধের জমির ধান কেটে নিলে—আমি তাকে ছিরের নামে ডাইরি করতে বলেছি এই পর্যন্ত।

–বেশ কথা! মজলিসে গেলে না কেন?

—মজলিস? যে মজলিসে ছিরু পাল টাকার জোরে মাতব্বর—সেখানে আমি যাই না।

—তার মাতব্বরি ভেঙে দাও তুমি। মজলিসে গিয়ে আপনার জোরে ভাঙ। ঘরে বসে থাকলে তার মাতব্বরি আরও বেড়ে যাবে!

জগন এবার চুপ করিয়া রহিল।

–ভাল। গাঁয়ের লোকের সঙ্গে নবান্ন করবে না কেন তুমি?

এবার ডাক্তার কাবু হইয়া পড়িল। কিছুক্ষণ পরে বলিল—করব না এমন প্রতিজ্ঞা আমি করি নাই।

দেবু ঘোষ এবার খুশি হইয়া বলিল হাঁ! দশে মিলে করি কাজ হারিজিতি নাহি লাজ। যা করবে, দশজনে এক হয় করো। দেখ না, তিন দিনে সব ঢিট হয়ে যাবে। অনিরুদ্ধ কামার, গিরিশ ছুতোর, তারা নাপিত, পেতো মুচি—এমনকি তোমার ছিরেকেও নাকে-কানে খৎ দিয়েই ছাড়ব। তা না করে হাজারখানা দরখাস্ত করেও কিছু হবে না ডাক্তার। সংসারে একলা থাকে বাঘ সিংহ। মানুষে নয়।

ডাক্তার বলিল—বেশ। কোনো আপত্তি নাই আমার। তবে এক হতে হলে সব কাজেই এক হতে হবে। গাঁয়ের গরজের সময় জগন ডাক্তার আর দেবু পণ্ডিত; আর ইউনিয়ন বোর্ডের ভোটের সময় কঙ্কণার বাবুরা, ছিরে পাল–

বাধা দিয়ে দেবু ঘোষ বলিল—এবার তিন নম্বর ওয়ার্ড থেকে তুমি আর আমি দাঁড়াব। তা হলে হবে তো?

দেবনাথ ঘোষ দেবু পণ্ডিত একটু স্বতন্ত্র মানুষ। আপনার বুদ্ধি-বিদ্যার উপর তাহার প্রগাঢ় বিশ্বাস। তাঁহার এই বুদ্ধি সম্বন্ধে চেতনার সহিত খানিকটা কল্পনা—খানিকটা স্বার্থপরতা আছে। বিদ্যা অবশ্য বেশি নয়, কিন্তু দেবু সেইটুকুকেই লইয়া অহরহ চর্চা করে। খুঁজিয়া পাতিয়া বই যোগাড় করিয়া পড়ে; খবরের কাগজের খবরগুলো রাখে; এ ছাড়াও মহাগ্রামের ন্যায়রত্ন। মহাশয়ের পৌত্র বিশ্বনাথ এমএ ক্লাসের ছাত্র, সে তাহার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তাহাকে সে অনেক বই আনিয়া দেয়। এবং মুখে মুখেও অনেক কিছু সে তাহার কাছে শিখিয়াছে। এইসব কারণে সে বেশ একটু অহঙ্কৃতও বটে। এ গ্রামে তাহার সমকক্ষ বিদ্বান ব্যক্তি কাহাকেও দেখিতে পায় না। জগন ডাক্তার পর্যন্ত তাহার তুলনায় কম শিক্ষিত। কঙ্কণার হাই স্কুলে জগন ফোর্থ ক্লাস পর্যন্ত পড়িয়া পড়া ছাড়িয়াছে; বাপের কাছে ডাক্তারি শিখিয়াছে। দেবু পড়িয়াছে ফার্স্ট ক্লাস পর্যন্ত। পড়াশুনাতে সে ভালই ছিল, পড়িলে সে যে ম্যাট্রিক পাস করিত ভালভাবেই পাস করিত এ-কথা আজও কঙ্কণার মাস্টারেরা স্বীকার করে। দেবু নিজে জানে—পড়িতে পাইলেই সে বৃত্তি লইয়া পাস করিত। তার পর আই-এ, বি-এ-দেবনাথের সে কল্পনা ছিল সুদূরপ্রসারী। ম্যাজিস্ট্রেট হইতে পারিত সে। অন্তত তাই মনে করে। সঙ্গে সঙ্গে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে আপনার দুর্ভাগ্যের জন্য।

হঠাৎ তাহার বাপ মারা গেল। চাষবাস, সংসার দেখিবার দ্বিতীয় পুরুষ বাড়িতে ছিল না। তাহার মা অন্য গ্রাম্য মেয়েদের মত মাঠে মাঠে ঘুরিয়া পাঁচজনের সঙ্গে পুরুষের মত ঝগড়া করিয়া ফিরিবে—এও দেবুর কল্পনায় অসহ্য মনে হইয়াছিল। এবং বাবা যখন মারা গেল তখন। সংসার একেবারে ভরাড়ুবির মুখে। এক পয়সার সঞ্চয় নাই ধান নাই। ধারও কিছু হইয়াছে। অগত্যা সে পড়াশুনা ছাড়িয়া চাষ ও সংসারের কাজে আত্মনিয়োগ করিয়াছিল। কিন্তু সন্তুষ্টচিত্তে নয়। একটা অসন্তোষ অহরহই তাহার জাগিয়া থাকি, তাহা আজও আছে। কয়েক বৎসর পূর্বে, স্বায়ত্তশাসন আইনে গ্রাম্য পাঠশালার ভার ডিস্ট্রিক বোর্ড ও ইউনিয়ন বোর্ড গ্রহণ করিবার পর হইতে চাষবাস ছাড়িয়া ওই স্কুলে পণ্ডিত হইয়া বসিয়াছে। বেতন মাসে বার টাকা; চাষবাস ভাগেঠিকায় বন্দোবস্ত করিয়া দিয়াছে। লোকে এইবার তাহাকে বলিলপণ্ডিত; খানিকটা সম্মানও করিল। কিন্তু তাহাতেও তাহার পরিতৃপ্তি হইল না।

তাহার ধারণা, গ্রামের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি হইল সে। শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্বের সম্মান তাহারই প্রাপ্য। অরণ্যানীর শিশু-শাল যেমন বন্য লতার দুর্ভেদ্য জাল ভেদ করিয়া সকলের উপরে মাথা তুলিতে চায়, তেমনি উদ্ধত বিক্ৰমে সে এতদিন গ্রামের সকলের সঙ্গে যুদ্ধ করিয়া আসিয়াছে। তবে সে একা অখণ্ড আলোক ভোগের জন্যেই উৰ্ব্বলোকে উঠিতে চায় না; নিচের লতাগুলি তাহাকেই অবলম্বন করিয়া তাহারই সঙ্গে আলোক-রাজ্যের অভিযানে আকাশলোকে চলুক এই আকাঙ্ক্ষা! ছিঃ পালের অর্থসম্পদ এবং বর্বর পশুত্বকে সে অন্তরের সঙ্গে ঘূ করে। জগনের নকল দেশপ্রীতি ও আভিজাত্যের আস্ফালন তাহার নিকট যেমন হাস্যকর তেমনি অসহ্য। বংশানুক্রমিক দাবিতে হরিশ মণ্ডলের গ্রামের মণ্ডলত্ব-দাবিকেও সে স্বীকার করিতে চায় না। ভবেশ ও মুকুন্দ বয়সের প্রাচীনত্ব লইয়া বিজ্ঞতার ভানে কথা কয়,তাহাও সে সহ্য করিতে পারে না।

দেবুর উপেক্ষা অবশ্য অহেতুক নয় অথবা একমাত্র আত্মপ্রাধান্যের আকাঙ্ক্ষা হইতে উদ্ভূত নয়। আপনার গ্রামখানিকে সে প্রাণের সহিত ভালবাসে। সে যে চোখের উপর গ্রামখানিকে দিন দিন অবনতির পথে গড়াইয়া যাইতে দেখিতেছে! অর্থবলে এবং দৈহিক শক্তিতে ছিরু যথেচ্ছাচার করিতেছে। শুধু ছিরু কেন গ্রামের কেহই কাহাকেও মানে না, সামাজিক আচার-ব্যবহার সব লোপ পাইতে বসিয়াছে। মানুষ মরিলে সহজে মড়া বাহির হয় না, সামাজিক ভোজনে—একই পঙক্তিতে ধনী-দরিদ্রের ভেদ দেখা দিয়াছে। সম্প্রতি কামার ছুতার বায়েন কাজ ছাড়িল; দাই, নাপিত চিরকেলে বিধান লঙ্নে উদ্যত হইল। যাহার মাসে পাঁচ টাকা আয় সে দশ টাকা খরচ করিয়া বাবু সাজিয়া বসিয়াছে। ঋণের দায়ে জমি বিকাইয়া যাইতেছে, ঘটি-বাটি বেচিতেছে, তবু জামা চাই, শৌখিন-পাড় কাপড় চাই, ঘরে ঘরে হারিকেন লণ্ঠন চাই। ছোকরাদের পকেটে বিড়ি-দেশলাই ঢুকিয়াছে, জংশন শহরে গেলেই সবাই দু-এক পয়সার সিগারেট না কিনিয়া ছাড়ে না,তামাক-চকমকি একেবারে বাতিল হইয়া গেল। এসবের প্রতিকার করিবার সাধ্য যাহাদের নাই, তাহারা প্রধান হইতে চায় কেন? কিসের জোরে? এ প্রশ্ন যাদের অকারণে মাথা ধরাইয়া তোলে দেবু পণ্ডিত সেই তাহাদেরই একজন।

দেবু পণ্ডিত পাঠশালার ছেলেদের পড়াইতে পড়াইতে এইসব ভাবনার অনেক কিছু ভাবে। গ্রামের সকল জন হইতে নিজেকে কতকটা পৃথক রাখিয়া—আপনার চিন্তাকে বিকীর্ণ করে এবং সঙ্গে সঙ্গে আপন ব্যক্তিত্বকেও প্রতিষ্ঠিত করিবার চেষ্টা করিয়া যায়–অক্লান্তভাবে, সামান্য সুযোগও সে কখনও ছাড়িয়া দেয় না।

তাই জগন ডাক্তার যখন ইউনিয়ন বোর্ডের কর্তৃপক্ষের অন্যায়ের বিরুদ্ধে মাথা তুলিয়া দাঁড়াইল—তখন ডাক্তারের আভিজাত্যের আস্ফালনের প্রতি ঘৃণা সত্ত্বেও তাহার সহিত মিলিত হইতে সে দ্বিধাবোধ করিল না।

দেবনাথ ও জগন ডাক্তার দুই জনে মিলিত উৎসাহে কাজ আরম্ভ করিয়া দিল। দরখাস্ত পাঠানো হইয়া গিয়াছে। নবান্নের দিনে দুই জনে পরামর্শ করিয়া একটা উৎসবেরও ব্যবস্থা করিল। সন্ধ্যায় চণ্ডীমণ্ডপে মনসার ভাসান গান হইবে। ভাসান গানের দলকে এখানে বেহুলার দল বলিয়া থাকে। বাউরিদের একটি বেহুলার দল আছে; সেই দলের গান হইবে। চাঁদা করিয়া চাল তুলিয়া উহাদের মদের ব্যবস্থা করা হইয়াছে তাহাতেই দলের লোকের মহা আনন্দ এই ভাসান গানের ব্যবস্থার মধ্যে আরও একটি উদ্দেশ্য আছে। নবান্নের দিন ছিরু পালের বাড়িতে অন্নপূর্ণা পূজা হইয়া থাকে; সেই উপলক্ষে সন্ধ্যায় গ্রামের সমস্ত লোকই গিয়া জমায়েত হয় ছিরু র বাড়িতে। তামাক খায়, গালগল্প করে, খোল বাজাইয়া অল্প অল্প কীর্তন গানও হয়। এবার আবার ছি নাকি বিশেষ সমারোহের আয়োজন করিয়াছে। রাত্রে লোকজন খাওয়াইবে এবং একদল কৃষ্ণযাত্রাও নাকি বায়না করিয়াছে। শ্ৰীহরির মায়ের নিত্যকার গালিগালাজ ও আস্ফালনের মধ্যে হইতে অন্তত ওই দুইটি সংবাদ পাওয়া গিয়াছে। গ্রামের লোক যাহাতে ছিরুর বাড়ি না যায়জগন ডাক্তার এবং দেবনাথ তাহার জন্য ব্যবস্থাগুলি করিয়াছে। গ্রামকে সঞ্জাবদ্ধ করিবার প্রচেষ্টায় জগন ও দেবনাথের এইটি প্রথম আয়োজন বা ভূমিকা।

চাষীর গ্রামের নবান্নের সমারোহ কিছু বেশি, এইটিই সত্যকারের সার্বজনীন উৎসব। চাষের প্রধান শস্য হৈমন্তী ধান মাঠে পাকিয়া উঠিয়াছে; এইবার সেই ধান কাটিয়া ঘরে তোলা হইবে। কার্তিক সংক্রান্তির দিনে কল্যাণ করিয়া আড়াই মুঠা ধান কাটিয়া আনিয়া লক্ষ্মীপূজা হইয়া গিয়াছে। এইবার আজ লঘু ধানের চাল হইতে নানা উপকরণ তৈরি করিয়া পিতৃলোক এবং দেবলোকের ভোগ দেওয়া হইবে। তাহার সঙ্গে ঘরে ঘরে হইবে ধান্যলক্ষ্মীর পূজা। ছেলেমেয়েরা সকালবেলাতেই সব স্নান সারিয়া ফেলিয়াছে। অগ্রহায়ণের তৃতীয় সপ্তাহে শীতও পড়িয়াছে; তবুও নবান্নের উৎসাহে ছেলেরা পুকুরে জল ঘোলা করিয়া তবে উঠিয়াছে। তাহারা সব এখনও চণ্ডীমণ্ডপের আঙিনায় রোদে দাঁড়াইয়া ঘোড়া পুরোহিতের কঙ্কালসার ঘোড়াটাক লইয়া কলরব করিতেছে। বুড়ো শিব এবং ভাঙা কালীর মন্দিরে ভোগ না হইলে নবান্ন আরম্ভ হইবে না। কুমারী কিশোরী মেয়েরা ভিজা চুল পিঠে এলাইয়া দিয়া নতুন বাটিতে নতুন ধানের আতপ চাল, চিনি, মণ্ডা, দুধ, কলা, আখের টিকলি, আদাকুচি, মুলাকুচি সাজাইয়া দক্ষিণাসহ মন্দিরের বারান্দায় নামাইয়া দিতেছে। অধিকাংশই চার পয়সা, কেহ দু পয়সা, কেহ এক পয়সা, দু-চারজনে দিয়াছে দু আনা। যাহাদের বাড়িতে কুমারী মেয়ে নাই, তাহাদের ভভাগসামগ্ৰী প্ৰবীণারা লইয়া আসিতেছে। গ্রামের পুরোহিত-খোঁড়া চক্রবর্তী বসিয়া সামগ্রীগুলি লইয়া দেবতার সম্মুখে রাখিয়া দক্ষিণাগুলি ট্যাকে পুরিতেছে এবং মধ্যে মধ্যে ধমক দিতেছে ওই ছেলেগুলিকে এাই এ্যাঁই! এ্যাঁই ছেলেগুলো, এ তো ভারি বদ! যাস না কাছে, চাঁট ছেড়ে তো পিলে ফাটিয়ে দেবে।

অর্থাৎ ওই ঘোড়াটা। ঘোড়াটা পিছনের পা ঘঁড়িলে প্লীহা ফাটিয়া যাইবে। খোঁড়া চক্রবর্তী গ্রাম-গ্রামান্তরে ওই ঘোড়ার সওয়ার হইয়া যজমান সাধিয়া ফেরে। ফিরিবার সময় ঘোড়ার উপর থাকে সেতাহার মাথায় থাকে চাল-কলা ইত্যাদির বোঝা। ঘোড়া খুব শিক্ষিত, চক্রবর্তী প্রায়ই লাগাম না ধরিয়া দুই হাতে বোঝা ধরিয়া অনায়াসে চলে, অবশ্য ইচ্ছা করিলে চক্রবর্তী মাটিতে পা নামাইয়া দিতে পারে। মাটি হইতে বড়জোর ফুটখানেক উপরে তাহার পা দুইটা ঝুলিতে ঝুলিতে যায়।

ছেলেদের কতকগুলো দূর হইতে ঢেলা ছুড়িয়া ঘোড়াটাকে ক্রমাগত মারিতেছিল। কতকগুলো অতিসাহসী গাছের ডাল লইয়া পিছন দিক হইতে পিটিতেছিল। পুরোহিত ভয়ানক চটিয়া উঠিয়াছিল। কিন্তু কোনো উপায় সে খুঁজিয়া পাইতেছিল না। ছেলেগুলো যেন তাহার কথা কানেই তুলিবে না বলিয়াই একজোট হইয়াছে। একটি প্রৌঢ়া বিধবা ভোগের সামগ্রী লইয়া আসিয়াছিল—সেই পুরোহিতের উপায় করিয়া দিল; সে বলিল—এ্যাঁ, তোরা ওই ঘোড়াটাকে ছুঁলি? বলি-ওরে ও মেলেচ্ছার দল! যা, আবার সব চান করগে যা।

পুরোহিত বলিল দেখ বাছা দেখ, বজ্জাত ছেলেদের কাণ্ড দেখ। চাঁট ছেড়ে তো পিলে ফাটিয়ে দেবে। তখন নাম-দোষ হবে আমার!

বিধবা কিন্তু এ কথাটা মানিল না, সে বলিল,-ও-কথা আর বোলোনা ঠাকুর। ওই ছাগলের মত ঘোড়াও নাকি পিলে ফাটিয়ে দেবে? তুমিও যেমন। ছেলেদের বলছি কেন, তোমারও তো বাপু আচার-বিচার কিছু নাই। সামনের দুটো পায়ে বেঁধে ছেড়ে দাও, রাজ্যের অ্যাঁস্তাকুড়, পাতা, ময়লা মাড়িয়ে চলে বেড়ায়। সেদিন আমাদের গায়ে এসে নতুন পুকুরের পাড়ে-মা-গোঃ, মনে করলেও বমি আসে-চান করতে হয়—সেইখানে দেখি ঘাস খাচ্ছে। আর তুমি ওই ঘোড়াতে চেপে এসে দেবতার পুজো কর?

পুরোহিত বলিল,-গঙ্গাজল দি মোড়ল পিসি, রোজ সন্ধ্যাবেলা বাড়ি ফিরলে গঙ্গাজল দিয়ে তবে ওরে ঘরে বাধি। আমি তো গঙ্গাজল-স্পৰ্শ করিই।

—ও সব মিছে কথা।

—ঈশ্বরের দিব্যি। পৈতে ছুঁয়ে বলছি আমি। গঙ্গাজল না দিলে ও বাড়ি ঢোকে না। বাইরে দাঁড়িয়ে মাটিতে পা ঠুকবে আর চিহি চিঁহি করে চেঁচাবে।

মোড়ল পিসি কি বলিতে গিয়া শশব্যস্ত হইয়া সম্মুখের দিকে খানিকটা সরিয়া গিয়া ফিরিয়া দাঁড়াইল—কে লা? হনহন করে আসছে দেখা—পিছন দিক হইতে কোনো আগন্তুকের দীর্ঘস্থায় মাথাটা তাহার পায়ের উপর পড়িতেই মোড়ল পিসি সংস্পর্শের ভয়ে সরিয়া গিয়া প্রশ্ন করিল কে?

একটি বধূ দীর্ঘাঙ্গী,অবগুণ্ঠনাবৃত মুখ; সে উত্তর করিল না, নীরবে ভোগসামগ্রীর পাত্ৰখানি পুরোহিতের হাতের সম্মুখে নামাইয়া দিল।

—অ! কামার-বউ! আমি বলি কে-না-কে!

এই মুহূর্তেই ডাক্তার ও পণ্ডিত আসিয়া চণ্ডীমণ্ডপে প্রবেশ করিল। দেবনাথ বিনা ভূমিকায় বলিল—ঠাকুর, কামারের পুজো গাঁয়ের শামিলে আপনি করবেন না, সে হতে আমরা দেব না।

জগন ও দেবু এই সুযোগটিরই প্রতীক্ষা করিয়া নিকটেই কোথাও দাঁড়াইয়া ছিল, পদ্মকে চণ্ডীমণ্ডপে প্রবেশ করিতে দেখিয়া সঙ্গে সঙ্গে তাহারাও আসিয়া হাজির হইয়াছে।

ঠাকুর কিছুক্ষণ পণ্ডিতের মুখের দিকে চাহিয়া থাকিয়া প্রশ্ন করিল—সে আবার কি রকম? গাঁ-শামিলে পুজো না হলে কি করে পুজো হবে?

—সে আমরা জানি না, কর্মকার বুঝে করবে। সে যখন গাঁয়ের নিয়ম লঙ্ঘন করেছে, তখন আমরাই বা গাঁয়ের শামিলে ক্রিয়াকর্মে নোব কেন?

পদ্ম তেমনি অবগুণ্ঠনে মুখ ঢাকিয়া স্থির হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল, এতটুকু চাঞ্চল্য দেখা গেল না। ঠাকুর তাহার দিকে চাহিয়া নিতান্ত নিরুপায়ভাবে বলিলতা হলে আর আমি কি করব মা!

দেবনাথ পদ্মকে লক্ষ্য করিয়া বলিল-পুজো তুমি ফিরিয়ে নিয়ে যাও, বল গে কর্মকারকে, পুজো দিতে দিলে না গায়ের লোক।

পদ্ম এবার ধীরে ধীরে চলিয়া গেল, কিন্তু পুজোর পাত্ৰ তুলিয়া লইয়া গেল না, সেটা এবং দক্ষিণার পয়সা সেখানেই পড়িয়া রহিল।

পুরোহিত বিব্রত হইয়া বলিল–ওগো ও বাছা, পুজোর ঠাঁইটা নিয়ে যাও! ও বাছা, ও কামার-বউ।

দেবু আবার বলিল—থাক না। কামার এখুনি তো আসবেই। যা হোক একটা মীমাংসা আজ হবেই।দেবু ঘোষের গোপনতম অন্তরে কর্মকারের উপর একটু সহানুভূতি এখনও আছে; অনিরুদ্ধ তাহার সহপাঠী, তা ছাড়া, অন্যায় অনিরুদ্ধেরই একার নয় এবং অনিরুদ্ধই প্রথমে অন্যায় করে নাই। গ্রামের লোকই অন্যায় করিয়াছে প্রথম। সে কথাটাও তাহার মনে কাটার মত বিধিতেছিল।

পুরোহিত ব্যাপারটা ভাল বুঝিতে পারে নাই, বুঝিবার ব্যগ্রতাও তাহার ছিল না। উপস্থিত এক বাড়ির আতপতঙ্গুল দুধ-মণ্ডা প্রভৃতি পুজোর সামগ্রী বাদ পড়িয়া যাইতেছে—সেই চিন্তাটাই তাহার বড়। ভ্রূ কুঞ্চিত হইয়া উঠিল। বলিল,—বলি ওহে ডাক্তার, ও পণ্ডিত

জগন বাধা দিয়া দৃঢ় আদেশের ভঙ্গিতে তাহাকে বলিল—গিরিশ ছুতোর তারা নাপিত এদের পুজোও হবে না ঠাকুর, বলে রাখছি আপনাকে। আমরা অবিশ্যি একজন-না-একজন শেষ পর্যন্ত থাকব, তবে যদি না থাকিসেজন্যে আগে থেকে বলে রাখছি আপনাকে।

ঠিক এই সময়ে ছিরু পাল আসিয়া ডাকিল—ঠাকুর!—ছিরুর পরনে আজ গরদের কাপড়, গায়ে একখানি রেশমি চাদর; ভাবে-ভঙ্গিতে ছিরু পাল আজ একটি স্বতন্ত্র মানুষ।

পুরোহিত চক্রবর্তী ব্যস্ত হইয়া বলিল—এই যাই বাবা। আর বড়জোর আধ ঘণ্টা। ও পণ্ডিত, ও ডাক্তার, কই হে সব আসছে না কেন?

গম্ভীরভাবে জগন ডাক্তার বলিল—এত তাড়াতাড়ি করলে তো হবে না ঠাকুর। আসছে সব, একে একে আসছে। একঘর যজমানের জন্য দশজনকে ব্যতিব্যস্ত করতে গেলে তো চলবে না।

ছি বলিল, বেশ বেশ! দশের কাজ সেরেই আসুন। ঠাকুর! আমি একবার তাগাদা দিয়ে গেলাম। তারপর ছিরু  তাহার প্রকাণ্ড বিশ্রী মুখখানাকে যথাসাধ্য কোমল এবং বিনীত করিয়া বলিল,ডাক্তার, একবার যাবেন গো দয়া করে। দেবু খুড়ো দেখেশুনে দিয়ে এস বাবা–

কথাটা তাহার শেষ হইল না, অনিরুদ্ধের প্রচণ্ড ক্রুদ্ধ চিৎকারে চণ্ডীমণ্ডপটা যেন অতর্কিতে চমকিয়া উঠিল।

–কে? কে? কার ঘাড়ে দশটা মাথা? কোন্ নবাব-বাদশা আমার পুজো বন্ধ করেছে শুনি? অনিরুদ্ধের সে মূৰ্তি যেন রুদ্ৰ-মূর্তি।

চক্রবর্তী হতভম্ব হইয়া গেল, দেবনাথ সোজা হইয়া পাঁড়াইল, জগন ডাক্তার বিজ্ঞ সান্ত্বনাদাতার মত একটু আগাইয়া আসিল; ছিরু পাল যথাস্থানে অচঞ্চল স্থিরভাবেই দাঁড়াইয়া রহিল।

ডাক্তার বলিলথাম, খাম, চিৎকার করিস না অনিরুদ্ধ!

ব্যঙ্গভরা ঘৃণিত দৃষ্টিতে চকিতে একবার ছিরু পাল হইতে ডাক্তার পর্যন্ত সকলের দিকে চাহিয়া অনিরুদ্ধ মন্দিরের দাওয়া হইতে পদ্মের পরিত্যক্ত পূজার পাত্রটা তুলিয়া লইল। পাত্রটা দুই হাতে খানিকটা উপরে তুলিয়া যেন দেবতাকে দেখাইয়া বলিল, হে বাবা শিব, হে মা কালী—খাও বাবা, খাও মা খাও! আর বিচার কর, তোমরা বিচার কর, তোমরা বিচার কর। বলিয়াই সে ফিরিল।

ডাক্তারের চোখ দিয়া যেন আগুন বাহির হইতেছিল, কিন্তু অনিরুদ্ধকে ধরিয়া নির্যাতন করিবার কোনো উপায় ছিল না।

অনিরুদ্ধ খানিকটা গিয়াই কিন্তু ফিরিল, এবং দক্ষিণার পয়সা কয়টা ট্যাকে গুঁজিয়া দেখিল দেবু ঘোষ ও জগন ডাক্তারের অল্প দূরে তখনও দাঁড়াইয়া আছে ছিরু পাল। তাহার ক্রোধ মুহূর্তে যেন উন্মত্ততায় পরিণত হইয়া গেল। সে চিৎকার করিয়া উঠিল, বড়লোকের মাথায় আমি ঝাড়ু মারি, আমি কোনো শালাকে মানি না, গ্ৰাহ্য করি না। দেখিকোন্ শালা আমার কি করতে পারে!

মুহূর্তের জন্য সে ছিরুর দিকে ফিরিয়া যেন তাহাকে দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহ্বান করিয়া বুক ফুলাইয়া দাঁড়াইল।

খোঁড়া পুরোহিত ও মোড়ল পিসি একটা বিপর্যয় আশঙ্কা করিয়া শিহরিয়া উঠিল। ইহার পরই অনিরুদ্ধের উপর ছিরু পালের বাঘের মত লাফাইয়া পড়ার কথা; কিন্তু আশ্চর্য, ছিরু পাল। আজ হাসিয়া অনিরুদ্ধকে বলিল—আমাকে মিছিমিছি জড়াচ্ছ, কর্মকার, আমি এসবের মধ্যে নাই। আমি এসেছিলাম পুরুত ডাকতে।

অনিরুদ্ধ আর দাঁড়াইল না, যেমন হনহন করিয়া আসিয়াছিল, তেমনি হনহন করিয়া চলিয়া গেল। যাইতে যাইতেও সে বলিতেছিল—সব শালাকে আমি জানি। ধার্মিক রাতারাতি সব ধার্মিক হয়ে উঠেছে।

ছিরু অবিচলিত ধৈর্যে স্থির প্রশান্তভাবেই চণ্ডীমণ্ডপ হইতে নামিয়া বাড়ির পথ ধরিল। ছিরু র চরিত্রের এই একটি বৈশিষ্ট্য। যখন সে ইষ্ট স্মরণ করে, কোনো ধর্ম-কর্ম বা পূজ-পার্বণে রত থাকে—সে তখন স্বতন্ত্র মানুষ হইয়া যায়। সেদিন সে কাহারও সহিত বিরোধ করে না, কাহারও অনিষ্ট করে না, পৃথিবী ও বস্তুবিষয়ক সমস্ত কিছুর সহিত সংস্রবহীন হইয়া এক ভিন্ন জগতের মানুষ হইয়া ওঠে। অবশ্য সমগ্র হিন্দুসমাজের জীবনই আজ এমনি দুই ভাগে বিভক্ত হইয়া গিয়াছে; কর্মজীবন এবং ধর্মজীবন একেবারে স্বতন্ত্র-দুইটার মধ্যে যেন কোনো সম্বন্ধ নাই। ইষ্ট স্মরণ করিতে করিতে যাহার চোখে অকপট অশ্রু উপাত হয়, সেই মানুষই ইষ্ট-স্মরণ-শেষে চোখের জল মুছিতে মুছিতে বিষয়ের আসনে বসিয়া জাল-জালিয়াতি শুরু করে। শুধু হিন্দু সমাজই বা কেন? পৃথিবীর সকল দেশে—সকল সমাজেই জীবন-ধারা অল্পবিস্তর এমনই দুই ভাগে বিভক্ত হইয়া গিয়াছে। পৃথিবীর কথা থাকুক, ছিরু র জীবনে এই বিভাগটা বড় প্রকট অতি মাত্রায় পরিস্ফুট। আজিকার ছিরু স্বতন্ত্র, এই ছিকু যে কেমন করিয়া ব্যভিচারী পাষণ্ড ছিরুর প্রচণ্ড ভার ঠেলিয়া দেবপূজাকে উপলক্ষ করিয়া বাহির হইয়া আসে–সে অতি বিচিত্র সংঘটন। পাষণ্ড ছিরু র অন্যায় বা পাপে কোনো ভয় নাই, দেবসেবক ছিরও সে পাপ খণ্ডনের জন্য কোনো ব্যগ্রতা নাই। আছে কেবল পরমলোক-প্রাপ্তির জন্য একটি নিষ্ঠাভরা তপস্যা এবং অকপট বিশ্বাস। দিন ও রাত্রির মত পরস্পরের সঙ্গে এই দুই বিরোধী ছিরুর কখনও মুখোমুখি দেখা হয় না, কিন্তু কোনো বিরোধও নাই। তবে ছিরু র দিবাভাগগুলি অর্থাৎ জীবনের আলোকিত অংশটুকু শীতমণ্ডলের শীতের দিনের মত–অতি সংক্ষিপ্ত তাহার আয়ু।

আজ কিন্তু আরও একটু নূতনত্ব ছিল ছিরু র ব্যবহারে। আজিকার কথাগুলি শুধু মিষ্টই নয়–খানিকটা অভিজাতজনোচিত, ভদ্র এবং সাধু। বিগত কালের দেবসেবক ছিরু হইতেও আজিকার দেবসেবক ছিরু আরও স্বতন্ত্র, আরও নূতন। উত্তেজনার মুখে সেটা কেহ লক্ষ্য করিল না।

কিছুক্ষণ পরই চণ্ডীমণ্ডপের সামনের রাস্তা দিয়া বাউরি, ডোম, মুচিদের একপাল ছেলেমেয়েরা সারি বাঁধিয়া কোথাও যাইতেছিল। কাহারও হাতে থালা, কাহারও হাতে গেলাস, কাহারও হাতে কোনো রকমের একটা পাত্র। জগন ডাক্তার প্রশ্ন করিল—কোথায় যাবি রে সব দল বেঁধে?

–আজ্ঞে, ঘোষ মহাশয়ের বাড়ি গো, অন্নপুন্নোর পেসাদ নিতে ডেকেছেন।

–কে? ঘোষটা আবার কে? ছিঃ ছিরে পাল সে আবার ঘোষ হল কবে থেকে?

অশালীন ভাষায় হিরুকে কয়টা গাল দিয়া ডাক্তার বলিলওঃ, বেজায় সাধু মাতর হয়ে উঠল দেখছি।

দেবু স্তব্ধ হইয়া ভাবিতেছিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *