০১. প্রাগার্য সভ্যতা

প্রাগার্য সভ্যতা

পৃথিবীর সভ্যতার বয়স অনেক। সাড়ে ছ’লক্ষ বছর আগেকার আগ্নেয়গিরির ছাইয়ের মধ্যেও মানুষের তৈরি জিনিস পাওয়া গেছে। খ্রিস্টপূর্ব উনিশ হাজার বছর আগে মানুষ আগুন ব্যবহার করতে শিখেছে; মানুষের সভ্যতার ইতিহাসে এটি একটি বিশেষ ধাপ। ভারতবর্ষের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা কী রকম ছিল?

মেহেরগড়ের প্রত্নখননে (মাটি খুঁড়ে ইতিহাসের সন্ধানে) ৭৫০০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে নব্য প্রস্তুর যুগের মাটির জিনিস পাওয়া গেছে, চাষেরও কিছু কিছু প্রমাণ মিলেছে। এবং বহু দূর দেশের সঙ্গে ভারতবর্ষের যে বাণিজ্যসম্পর্ক ছিল তা-ও জানা যায় (সে সময়ে রাশিয়ার তুর্কমেনিস্তান ছাড়া অন্য কোথাও টার্কয়েজ পাথর পাওয়া যেত না, সে পাথর মেহেরগড়ে পাওয়া যাওয়াতে বোঝা যায় যে, তখনকার ভারতবর্ষের বাণিজ্য অন্তত তুর্কমেনিস্তান পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল)।

অধিকাংশ পণ্ডিতই এখন স্বীকার করেন যে, আর্যরা এখনকার ভারতবর্ষের যে ভৌগোলিক সীমা তার বাইরে থেকেই এ দেশে এসেছিলেন। তবে এর মধ্যে অনেক কথা আছে: আজকের ভারতবর্ষের ভৌগোলিক সীমা বা ১৯৪৭-এ দেশ ‘স্বাধীন’ হওয়ার আগে যে সীমা ছিল, তার বহু পূর্বে ভারতবর্ষের সীমা মধ্যপ্রাচ্যের দিকে অনেক বেশি বিস্তৃত ছিল। শুধু বাণিজ্য সীমায় নয়, সাংস্কৃতিক আদানপ্রদানের ভিত্তিতে জাতিগোষ্ঠী বা জনগোষ্ঠী হিসেবে এক না হলেও অনেক বিস্তৃত এক ভূখণ্ডে উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ ছাড়িয়েও ছিল এর বিস্তৃতি। এ অঞ্চলটা হয়তো কেন্দ্রীয় কোনও শাসনের অন্তর্ভুক্ত ছিল না, কিংবা বলা যায়, শতাব্দীর পর শতাব্দীতে, এমনকী সহস্রাব্দেরও ওপারে, ওই অঞ্চলের শাসনব্যবস্থাগুলোর বারেবারে হাতবদল হয়েছে। কিন্তু ওই অঞ্চলের মানুষের মনে ভারতবর্ষ বলতে অনেক বিস্তৃত, অনেক বহুজাতিক বহুভাষিক এক জনগোষ্ঠীর ধারণা ছিল। এটা কোনও নিশ্চিত বা স্থায়ী বা বরাবরের জন্য স্থিরীকৃত কোনও অঞ্চলের কথা নয়; এর মধ্যে দিয়ে মিশর, ভূমধ্যসাগরের প্রান্তের দেশগুলি, মধ্যপ্রাচ্যের নানা দেশ, দক্ষিণ ইয়োরোপ ও চিনের কিছু অঞ্চলের মানুষের আনাগোনা বেশ কয়েক হাজার বছর ধরে অব্যাহত ছিল। এই অঞ্চলে অন্যান্য জাতি ও ভাষাগোষ্ঠী ছাড়াও অস্ট্রিক ও দ্রাবিড়ভাষী লোকেরাও বাস করত। কাজেই সে কালে বহুদূর পর্যন্ত ও স্থানে বহু দেশের সীমানা ছাড়িয়ে যে একটি সংস্কৃতি বর্তমান ছিল, তার মধ্যে বহু ভাষা ও জাতিগোষ্ঠী ছিল।

এখনকার ভারতবর্ষের উত্তর পশ্চিম অঞ্চল থেকে মধ্যভারতের উত্তরভাগ পর্যন্ত যে জনগোষ্ঠীর বাস ছিল সেই প্রাগার্যরা সিন্ধু সভ্যতা সৃষ্টি করেছিল। এ সভ্যতা খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় সহস্রাব্দ থেকে দ্বিতীয় সহস্রাব্দের মাঝামাঝি পর্যন্ত বেলুচিস্তান, আফগানিস্তান, সিন্ধু, পঞ্জাব, গুজরাট ও রাজস্থানের কিছু অংশে বিস্তৃত ছিল। মহেঞ্জোদরো, হরপ্পা, কালিবাঙ্গান, লোঠাল— এগুলি ছিল এই সভ্যতার বড় বড় শহর। প্রাগার্য এই সভ্যতাটি বেশ উঁচুমানের ছিল: চওড়া রাস্তা, দুর্গ, প্রাচীরঘেরা শহর, বড় দোতলা বাস্তুবাড়ি, দোকান, কারখানা, জলাধার, মজুরদের এক কামরার বস্তি— মাটি খুঁড়ে এ সব পাওয়া গেছে। শহরের ঠিক মাঝখানে বড় বড় বাড়িগুলি সম্ভবত প্রশাসনের কাজের জন্যই ছিল। বন্যা ঠেকাবার জন্যে নদীর পাড়ে উঁচু বাঁধ দেওয়া ছিল। আর ছিল সাধারণের স্নানের জায়গা, বাড়িতে উঠোনের কোণে রান্নাঘর, নিজস্ব কুয়ো, বারান্দা, রাস্তার পাশে বড় বড় পাথরের ঢাকা দেওয়া জলনিকাশের নর্দমা যার ওপরের পাথরগুলো তুলে নিয়ে নালী পরিষ্কার করা যেত। ফলে নাগরিকদের স্বাস্থ্যরক্ষার প্রাথমিক ব্যবস্থা ভাল ছিল। একটি বাড়িতে শস্যভাণ্ডার পাওয়া গেছে। অস্ত্রশস্ত্র পাওয়া যায়নি, তাই মনে হয় শান্তিপূর্ণ কেন্দ্রীয় শাসন ছিল, হয়তো বা পুরোহিত শাসিত ব্যবস্থা। মধ্যপ্রাচ্য ও মিশরের সঙ্গে এদের বাণিজ্য সম্পর্ক ছিল; এখানকার সীলমোহর, মৃৎশিল্পের নিদর্শন, যেমন মাটির গাড়ি, খেলনা, ইত্যাদি ওই সব অঞ্চলে মাটির নীচে পাওয়া গেছে। সিন্ধু সভ্যতা অঞ্চলে যে মাটির ভাঁড়, জালা, গামলা পাওয়া গেছে, সেগুলির গায়ে রঙিন চিত্র করা। এ ছাড়া একটি যোগী মূর্তি পাওয়া গেছে, তার চার দিকে হাতি, গণ্ডার, বাঘ ও ষাঁড়। একটি দাড়িওয়ালা মানুষের মূর্তি ও একটি নর্তকীর মূর্তিও বেরিয়েছে। যোগী মূর্তিটিকে পণ্ডিতেরা পশুপতি শিবের মূর্তি বলে মনে করেন; যা যা পাওয়া গেছে তা থেকে সিন্ধুসভ্যতার ধর্মবিশ্বাস ও ধর্মাচরণ সম্বন্ধে নিশ্চিত ভাবে কিছুই জানা যায় না। সিন্ধুসভ্যতার মানুষ লিখতে পড়তে জানত, সীলামোহরের ওপরের লেখায় তার প্রমাণ আছে। কিন্তু সে লিপি এখনও পড়া যায়নি, এবং পড়া গেলেও সম্ভবত এদের জীবন, বিশ্বাস, ধর্ম সম্বন্ধে বিশেষ কিছু জানা যেত না, কারণ মনে হয়, সীলমোহরগুলি বাণিজ্যে ব্যবহারের কাজেই লাগত। এদের মধ্যে মৃতদেহের দাহ ও সমাধি দুয়েরই প্রমাণ মেলে। সমাজটি মনে হয় শ্রেণিবিভক্ত ছিল এবং হয়তো দু শ্রেণির জন্যে দু রকমের অন্ত্যেষ্টি হত। এ সমাজ অত্যন্ত স্থিতিশীল ছিল। অন্তত এক হাজার বছর ধরে সমাজব্যবস্থা একই রকম ছিল। কেন্দ্রীয় শাসন সম্ভবত খুব শক্তিশালী ছিল। এই বিস্তৃত এলাকায় শুধু নগর পরিকল্পনা যে একই রকমের ছিল তাই নয়, ওজনের বাটখারাগুলো পর্যন্ত একই ওজনের ছিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *