০৩. বুদ্ধি দিয়ে, তর্ক করে, ভাববাদকে খণ্ডন করা যায় না

বুদ্ধি দিয়ে, তর্ক করে, ভাববাদকে খণ্ডন করা যায় না

বুদ্ধি দিয়ে, তর্ক করে, ভাববাদকে খণ্ডন করা যায় না; এ প্রচেষ্টা স্বয়ংবিরুদ্ধ, আত্মঘাতী। কেননা, এই পথে এগুতে গেলে বুদ্ধির দাবিকে, চেতনার দাবিকেই চরম দাবি বলে মেনে নিতে হয়,–আর সেটিকুই তো ভাববাদের আসল কথা। তাই, দিকপাল দার্শনিকও ভাববাদকেই খণ্ডন করতে এগিয়ে শেষ পর্যন্ত ভাববাদের জালেই জড়িয়ে পড়েছেন-দর্শনের ইতিহাসে এ যেন এক গোলকধাঁধাই। যুগে যুগে বারবার মানুষের চরম বুদ্ধি, চরম মনন-মনীষা ভাববাদকে অসম্ভব বলে চিনতে চেয়েছে, তবুও মুক্তি পায়নি তার সম্মোহিনী দাসত্ব থেকে। যেন মৃত্যুর পরই পৌরাণিক দেবতার পুনরুজ্জীবন, আর দর্শনের মন্দিরে আপাত তেত্রিশকোটি দেব-দেবীর মধ্যে এই দেবতার উদ্দেশ্যেই প্ৰায় তৈলধারার মতো অবিচ্ছিন্ন উপাসনা।

ভাববাদী তো উল্লাস করে বলবেনই; ভাববাদ খণ্ডনের সমস্ত প্ৰচেষ্টাই বৃথা। এ যেন ভাইয়ে-ভাইয়ে মামলাবাজি (কেয়ার্ড), কেননা দর্শন আর ভাববাদ নেহাতই তো সহোদর। কিংবা, যা একই কথা, যা কিছু বুদ্ধিসহ, তাকেই যথাৰ্থ বলে মানতে হবে, আবার যা কিছু যথার্থ, তাকেই বুদ্ধিসহ বলতে হবে (হেগেল)। সত্তা আর চেতনা যেন একই কাচের উত্তল আর অবতল দুটো দিক, যেন একই চুম্বকের দুই মেরুকেন্দ্র। একটিকে বাদ দিয়ে আর একটির কথা ভাবাই যায় না, যেমন ভাবা যায় না। একটা ছড়ির কথা, যে-ছড়ির মাত্র একটি প্রান্ত! দর্শন যদি সত্তা-সন্ধানী হয়, এবং সত্তার রূপ যদি আনিবাৰ্যভাবেই চেতন-নির্ভর হয়, তাহলে ভাববাদ ছাড়া দর্শনের পক্ষে আর কী গতি হতে পারে? ভাববাদ সমস্ত দর্শনেরই যে আনিবাৰ্য পরিণাম শুধু তাই নয়, দার্শনিক প্রচেষ্টারই নামান্তরমাত্র।

হেগেল-কেয়ার্ড-এর এই যে কথা, একদিক থেকে দর্শনের অতীত ইতিহাসের এমন নিখুঁত বর্ণনা একান্তই বিরল। আবার অন্যদিক থেকে, অসত্যের এমন চূড়ান্ত দৃষ্টান্তও দুর্লভ কম নয়।

দর্শনের অতীত ইতিহাসটুকুর আশ্চৰ্য নিখুঁত বৰ্ণনা। কেননা যাকে আমরা এতদিন ধরে দর্শন বলে জেনেছি, তার চূড়ান্ত আবেদন শেষ পৰ্যন্ত বিশুদ্ধ চেতনার কাছেই–তৰ্কশাস্ত্রের হাজার রকম জটিল আলিগলি ঘুরে বিশুদ্ধ বুদ্ধির আর বিচারের দাবি অনুসারেই দার্শনিক আলোচনার শেষ সিদ্ধান্ত সন্ধান করা হয়েছে। এক কথায়, চেতনাকেই মেনে নেওয়া হয়েছে দর্শনের চরম কষ্টিপাথর বলে।

অবশ্য তাই বলে বিপরীত মতবাদ–অচেতনকারণবাদ বা বস্তুবাদ—মাঝে মাঝে মাথা তোলবার চেষ্টা যে করেনি, তা নয়। কিন্তু এতদিন পর্যন্ত–অর্থাৎ আধুনিক যুগে আধুনিক বস্তুবাদের প্রতিষ্ঠা হবার আগে পর্যন্ত–তার পরমায়ু নেহাতই ক্ষীণ, তার পদক্ষেপ দ্বিধাবিড়ম্বিত, আত্মনিশ্চয়তার অভাবে সে এগিয়েছে আত্মঘাতের পথে, এমন-কী বিরুদ্ধ আবহাওয়ায় পড়ে সে অনেক সময় একটা রফা করে নিতে চেয়েছে বিরুদ্ধ মতবাদের সঙ্গেই-চেতনকারণবাদের সঙ্গেই। এই বস্তুবাদ সম্বন্ধে সাধারণ দার্শনিক সমাজের ভঙ্গিটাও লক্ষ করবার মতো; সাদর সম্ভাষণ তার কপালে কোনোদিনই জোটেনি, বরং জুটেছে শুধু প্ৰতিবন্ধ আর বিড়ম্বনা। যখন সে দুঃসাহসীর মতো বড় বেশি দুবিনীত হইচই শুরু করেছে, তখন তাকে দর্শনের আঙিনার এক কোনায় বড়জোর একটুখানি আসন করে দেওয়া হয়েছে অম্পশ্যের মতো, কিন্তু সেই সঙ্গেই চক্রান্ত-পরামর্শ চলেছে, কেমন করে তাকে একেবারে একঘরে করে তার ভিটেমাটি পর্যন্ত উচ্ছেদ করা যায়। কখনো বা তাকে খোলাখুলি গালাগালি করে একেবারে উচ্ছন্নে পাঠাবার ব্যবস্থা, কখনো বা তাকে সংস্কার করে জাতে তুলে নেবার অজুহাতে একেবারে সর্বস্বাস্ত করে দেবার কৌশল। খোলাখুলি গালাগালি করবার দৃষ্টান্ত সংখ্যায় বহুলতর, এমন-কী অনেকসময় ‘বস্তুবাদ’ শব্দটি দার্শনিক অপচেষ্টার নামান্তর হিসেবে ব্যবহৃত। কিন্তু এ জাতীয় দৃষ্টান্ত অনেক স্থূল, অনেক ভোতা। এর মধ্যে চিত্তাকর্ষণ কম। বরং, সংস্কার করবার নামে সর্বস্বাস্ত করবার উদ্যম দৃষ্টান্ত হিসেবে অনেক বেশি চিত্তাকর্ষক। এ-উদ্যমের উদাহরণ সর্বদেশে, সর্বযুগে; অতীতের ভারতবর্ষে, প্ৰাচীন গ্রীসে, আধুনিক ও সাম্প্রতিক য়ুরোপে-প্ৰায় সর্বত্রই। আমাদের দেশে চার্বাকের দেহাত্মবাদ দেবগুরু বৃহস্পতির কৃটি অভিসন্ধি বলে প্রচারিত; সাংখ্য দর্শনের মধ্যে প্ৰধানকারণবাদের রেশটুকুকে সংস্কার করতে করতে শেষ পর্যন্ত বিজ্ঞানভিক্ষু এর মধ্যে এমন-কী ঈশ্বরের জন্যও জায়গা করে ফেললেন; বুদ্ধদেবের দেহত্যাগের পর বৈভাসিক ও সৌত্ৰিাস্তিকদের মধ্যে বস্তুবাদের যতটুকু ভগ্নাংশ পড়েছিল, সেটুকুকে উপহাস করে মাধ্যমিক আর যোগাচাররা প্রচার করলেন-তথ্যাগতের পক্ষে ওটুকু নেহাতই মন্দবুদ্ধির মানুষকে প্ৰবোধ দেবার প্ৰচেষ্টা। বিদেশের দর্শনেও একই কথা। গ্ৰীক যুগে ডিমক্রিটাস-কে সংস্কার করলেন এ্যানেক্সাগোরাস, আবার এ্যানেক্সাগোরাস-কে সোফিস্ট, আর সোফিস্টদের সংস্কার করলেন সক্রেটস-দুৰ্জয় বস্তুবাদ থেকে চেতনকারণবাদে পৌছবার যেন সোজা-সড়ক বেরিয়ে গেল। আধুনিক ইংলণ্ডেও এ উদাহরণের ব্যতিক্রম নেই।–বেকনা-হবাস-এর বস্তুবাদকে শুধরে নিলেন লক, আবার লককে শুধরে নিলেন বার্কলি-হিউম, শোধরানোর মানে দাড়ালো বস্তুবাদের শবদেহের উপর ভাববাদী প্রেতসাধনা। আবার এদিকে দেকার্ত, বস্তুবাদের সঙ্গে তিনি আপাস করেছেন। দ্বিধাভারা ভাববাদের। দেকার্ত-এর পর পিনোজা, দি তবুও পরমার্থিক ভাববাদের মধ্যে ব্যবহারিক বস্তুবাদকে ঠাই দিয়েছেন। (“পিটারের মন পিটারের দেহ” ইত্যাদি); আর তারপর লাইবনিৎস, বস্তুবাদের ক্ষীণতম স্বাক্ষরটুকুও তিনি লোপ করে দিলেন, জড় হল চিৎপরমাণুর প্ৰতিভাস-মাত্রে।

এতদিন পর্যন্ত সবদেশে সব যুগে এই একই কথা; বস্তুবাদের কপালে যদিই বা কখনো সাময়িক সাফল্য জুটেছে (যেমনটা দেখা যায় ফরাসী বিপ্লবের অগ্রদূত ফরাসী বস্তুবাদের বেলায়), তবুও সেই সাফল্যের পরই বিদগ্ধ সমাজ হয় একে একেবারে সোজাসুজি উড়িয়ে দিতে চেয়েছে, আর না হয়। তো সংস্কার কয়ে নেবার নামে একেবারে সর্বস্বাস্ত করে ছেড়েছে। যে-সৰ দিকপাল দার্শনিক ভাববাদের অসম্ভবে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন, তাঁরাও কেউ বিপরীত মতবাদ–বস্তুবাদের–দিকে অগ্রসর হতে পারেননি, ভাববাদকে ছেড়ে আর এক অভিনব দার্শনিক মতবাদ সন্ধান করতে বেরিয়েছেন, আর শেষ পর্যন্ত এই অভিনব মতবাদের দোহাই দিয়ে প্রচ্ছন্ন ভাববাদের আঙিনাতেই ক্লান্ত দার্শনিক চেতনা এলিয়ে দিয়েছেন। ফলে দর্শনের ইতিহাসে চেতন-কারণবাদেরই অবিচ্ছিন্ন প্ৰতিপত্তি, দর্শন আর ভাববাদ যেন একই কাচের উত্তল আর অবতল দুটো দিকমাত্ৰ!

প্রশ্ন হলো : দর্শনের ইতিহাসে এমন ঘটনা ঘটল কেন? দর্শন কেন মুক্তি পায়নি ভাববাদের প্রায় একচ্ছত্র আধিপত্য থেকে? চেতনকারণবাদেই কেন তার একান্ত পরিণতি? তথাকথিত বিশুদ্ধ দর্শনের গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ থাকতে চাইলে এ-প্রশ্নের জবাব খোজা বিফল হবে। বড় জোর, শুধু এইটুকু বলা চলবে যে, এতদিন পর্যন্ত বুদ্ধির দাবিকে বা চেতনার দাবিকে (তথাকথিত বুদ্ধিবিতৃষ্ণ দার্শনিকরাও বুদ্ধিকে বাদ দিয়ে চেতনারই অপর কোন অঙ্গকে আশ্রয় করতে চেয়েছেন)। চরম দার্শনিক পদ্ধতি বলে মেনে নেবার দরুন দর্শনে এমনটা না হয়ে আর উপায় ছিল না! অথচ, পদ্ধতির দিক থেকে চেতনার উপর নির্ভর করা, আর পরিণামের দিক থেকে ভাববাদ-এ তো একই কথার ভিন্ন প্ৰকাশভঙ্গিমাত্র। কেন এমন হয়েছে? তাই আসল সমস্যাটা আরো অনেকখানি গোড়ার সমস্যা। সে-সমস্যা হলো : যুগ যুগ ধরে দার্শনিকেরা কেন চেতনার দাবিকে চূড়ান্ত দাবি বলে প্রচার করেছেন, কিংবা, যা একই কথা, পরমসত্তাকে চেতননির্ভর না বলে কেন শেষ পর্যন্ত শান্তি পাননি?

“বিশুদ্ধ” দর্শন এই “কেন’-র জবাব জোগাতে পারে না। অথচ মানবসমাজের ক্রমবিকাশের সঙ্গে মানব-চেতনায় দার্শনিক মতবাদের ক্রমবিকাশের কথাটা যদি মিলিয়ে ভাববার চেষ্টা করা যায়, তাহলে সেদিক থেকে এই প্রশ্নের জবাবটা স্পষ্ট : এতদিন ধরে এমনিতরো ঘটনা না ঘটে যেন উপায়ই ছিল না!  কেননা যাকে আমরা “দর্শন” বলে মেনেছি, তার জন্ম শ্রেণীবিভক্ত সমাজের গর্ভে, সে লালিত হয়েছে শ্রেণীবিভক্ত সমাজের ক্ৰোড়ে, তার দেহ থেকে শ্ৰেণীবিভাগের চিহ্ন মোছা যাবে কেমন করে? ভাববাদ বা চেতন-কারণবাদ–সেই শ্রেণীবিভাগের চিহ্ন! সমাজে শ্রেণীবিভাগকে উচ্ছেদ না করলে তাই ভাববাদের হাত থেকে প্রকৃত মুক্তি পাবার প্রশ্ন ওঠে না; মার্কস বলছেন, দার্শনিকেরা এতদিন দুনিয়ার শুধু ব্যাখ্যাই খুঁজেছে, কিন্তু আসল কথা হলো দুনিয়াকে বদল করবার কথা। দুনিয়াকে বদল করা-পৃথিবীতে নতুন পৃথিবী, নবীন নিঃশ্ৰেণীক সমাজ। তখন মানুষের সঙ্গে সংগ্রামে মানুষ আর নিজেকে অপচয় করবে না, তখন থেকেই যেন মানুষের আসল ইতিহাস শুরু। প্ৰাক্‌-ইতিহাস শেষ, শুরু ইতিহাস। আর শেষ ভাববাদের। সোভিয়েট দেশে এই নবীন নিঃশ্ৰেণীক সমাজের প্রথম অঙ্কুর, তাই ভাববাদের হাত থেকে মুক্তি, বস্তুবাদের প্রথম বলিষ্ঠ প্ৰতিষ্ঠা।

বিশুদ্ধ দার্শনিক প্ৰত্যেকটি কথাতেই বিরূপ হবেন। না-হলেই বরং অবাক হবার কথা, কেননা তার চেতনাও যে এই শ্রেণীবিভক্ত সমাজেরই পরিণাম, তাই শ্রেণীবিভক্ত সমাজেরই মুখপাত্র দার্শনিক বিচার যদি সমাজ-বিপ্লবের প্ৰসঙ্গ তোলে, তাহলে তাঁর পক্ষে বিরূপবোধই স্বাভাবিক বইকী! মার্কসীয় দর্শনের বিরুদ্ধে আজকের দিনে কেন যে এত রকম অভিনব প্ৰতিবন্ধ, তার ব্যাখ্যাও এদিক থেকে খুঁজে পাওয়া যাবে।

আপাতত দেখা যাক, সমাজে শ্রেণীবিভাগের সঙ্গে দর্শনের ক্ষেত্রে ভাববাদের সম্বন্ধটা কী-রকম।

 

শ্ৰেণীবিভক্ত সমাজের গর্ভে দর্শনের জন্ম, শ্রেণীবিভক্ত সমাজের ক্ৰোড়ে। দর্শন লালিত, দর্শনের দেহে তাই শ্রেণীবিভাগের চিহ্ন। কিন্তু তার আগে? তার আগে মানবসমাজ শ্রেণীবিভক্ত ছিল না, আর তাই মানুষের চেতনা ভাববাদের আশ্রয় খুজতে বাধ্য হয়নি। আর এর পর? এর পর এক নবীন নিয়শ্রেণীক সমাজে-সে-সমাজে ভাববাদের বীজও বিলুপ্ত-এই বীজ থেকে উৎপন্ন বিষবৃক্ষ শুধু জীৰ্ণ শুষ্ক কাষ্ঠের মতো সংস্কৃতির জাদুঘরে গবেষকের কাছে ঐতিহাসিক বিস্ময়ের বিষয়মাত্র। পরমায়ুর দিক থেকে তাই শ্রেণী:সমাজ আর ভাববাদ সমব্যাপ্ত-কিংবা যেন একই কাচের উত্তল আর অবতল দুটো দিক।

আগে ছিল আদিম-সাম্যাবস্থা। মানুষের সংস্কৃতির সবটুকুকে তখন জুড়ে ছিল তার নাচ আর তার ইন্দ্রজাল,–কিংবা নাচে-ইন্দ্ৰজালে মেশা এক প্ৰাগবিভক্তি সাংস্কৃতিক সত্তা। এই যে প্ৰাথমিক প্ৰাগবিভক্তি সংস্কৃতি, এর স্বরূপ নিয়ে আলোচনা করলে দেখা যাবে, এর মূল দাবি ভাববাদের বিপরীত দাবি। আলোচনা করতে হবে, কেমন করে আদিম সাম্যাবস্থা-বিচ্যুতির পর –মানবসমাজে শ্রেণীবিভাগ দেখা দেবার পর -এই প্ৰাথমিক প্ৰাগবিভক্ত ভাববাদ-বিরুদ্ধ সংস্কৃতি থেকে ভাববাদী দর্শন (প্ৰথমে ধর্ম, আর তারপর ধর্মেরই পরিচ্ছন্ন সংস্করণ দর্শন বা অধিবিদ্যা) তত্ত্বান্বেষণের সমস্তটুকুকে জুড়ে বসতে লাগল। অবশ্যই শ্রেণীবিভক্ত সমাজেরও ইতিহাস আছে, শ্রেণীবিভাগের কাঠামোর মধ্যেও অনেক রকম পরিবর্তন ঘটেছে; তাই দর্শনের বা ভাববাদের চেহারাও যুগে যুগে এক নয়। আরো দেখতে হবে, শ্রেণীবিভাগের এই কাঠামো সত্ত্বেও মাঝে মাঝে বস্তুবাদ কেমন করে মাথা তুলে দাড়াবার চেষ্টা করছে। যেমন ধরা যায়, ফরাসী বস্তুবাদ, বা আধুনিক ইংরেজী বস্তুবাদ। তার আবির্ভাব তো শ্রেণীসমাজের যুগেই। শ্রেণীসমাজের মূলেই যদি ভাববাদী দর্শনের অনিবাৰ্য তাগিদ থাকে, তাহলে এমন ঘটনা সম্ভব হয় কেমন করে? অবশ্যই, ও-জাতীয় বস্তুবাদের দুর্বলতা ছিল। সেই দুর্বলতার দরুনই এই বস্তুবাদ বাধ্য হলো ভাববাদের জন্যে জায়গা ছেড়ে দিতে। তারপর আধুনিক যুগে সমাজতান্ত্রিক পরিকল্পনার আবহাওয়ায়, সোভিয়েট সমাজে মানবইতিহাসে প্রথম পবিপূর্ণভাবে ভাববাদ অগ্ৰাহ করবার-সচেতন আর সমবেতভাবে অগ্রাহ করবার-উৎসাহ দেখা দিল। এ-উৎসাহের উৎসই বা কোথায়? এ সব প্রশ্নের জবাব থেকে ভাববাদ খণ্ডনের মূল রহস্য আবিষ্কার করবার আশা আছে।

 

আদিম সাম্যাবস্থার প্রাগবিভক্তি সংস্কৃতির প্রধান অভিব্যক্তি ইন্দ্ৰজাল। ইন্দ্ৰজালের প্রধান বিকাশ নাচের মধ্যে। নাচ, কিন্তু আমরা যে অবসর-বিনোদনকে নাচ বলতে অভ্যন্ত, তা নয়। নাচ বলতে চোদ্দ আনাই ইন্দ্ৰজাল। এই ইন্দ্ৰজাল সম্বন্ধে সভ্য মানুষের ভ্ৰান্তির অন্ত নেই। নাচ, কিন্তু আজকালকার অবসর-বিনোদন নয়। আদিম মানুষের কাছে বিনোদিত হবার মতো অবসর কোথায়? চার পা ছেড়ে সবে সে দু’পায়ে উঠে দাড়াতে শিখছে, আর শিখেছে আগেকার দুটো ফালতু পা-কে দু হাত হিসেবে ব্যবহার করতে। হাতিয়ার তৈরি করতে শিখল, তাই হাত। দুনিয়ার আর কোনো জানোয়ার হাতিয়ার বানাতে শেখেনি, ‘হাত” নেই। আর কারুর। হাতের সঙ্গে মগজের যোগাযোগ, তাই হাতিয়ার ব্যবহারের মাধ্যমেই বুদ্ধিরও ক্ৰমবিকাশ। কিন্তু আদিম মানুষের প্রথম সেই হাতিয়ার বড় স্থূল, প্ৰকৃতিকে জয় করবার কাজে প্ৰায় অকৰ্মণ্যের চেয়ে মাত্র একটুখানি বেশি। সামনে প্ৰকৃতি, বিরাট বিপুল প্ৰকৃতি -থুল আর প্রাকৃত ওই হাতিয়ার নিয়ে মানুষ এই প্ৰকৃতিকে যতটুকু জয় করতে পেরেছে, ততটুকুই তার দুঃখ-মুক্তি। প্ৰকৃতির সঙ্গে লড়াই, হাতে মাত্র সামান্য হাতিয়ার। কতটুকুই বা পেরে ওঠা যায়? তবু যেটা সবচেয়ে জরুরি কথা, হাতিয়ার হাতে প্ৰকৃতিকে জয় করতে নেমেছিল বলেই মানুষ প্ৰকৃতিকে চিনতে শুরু করল, আর চিনতে শিখাল যত ভালো করে, ততই ভালো করে। পারল জয় করতে। জ্ঞান এসেছে সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে, আবার জ্ঞান হয়েছে সংগ্রামের অন্ত্র, তাই সংগ্রামকে বাদ দিয়ে নিছক তত্ত্বজিজ্ঞাসার কথা আদিম মানুষের বেলায় ওঠেই না। কেবল মনে রাখতে হবে, এ সংগ্রাম মানুষের সঙ্গে প্ৰকৃতির, মানুষের সঙ্গে মানুষের নয়। কেননা, তখন ছিল আদিম সাম্যাবস্থা, মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কটা সমাজ-সহজ সম্পর্ক। শোষণ নেই, তাই শাসনও নেই। শোষণ থাকবে কেমন করে? হাতিয়ার তখন অতি স্থূল বলেই দলের সবাই মিলে প্ৰাণপাত পরিশ্রম করে পৃথিবীর কাছ থেকে যেটুকু জিনিস সংগ্ৰহ করতে পারে, তার সাহায্যে কোনমতে দলের সবাইকার মাত্র জীবনধারণটুকু সম্ভব। তাই কারুর পক্ষেই অপরের শ্রম দিয়ে গড়া জিনিস আত্মসাৎ করতে পারা সম্ভব নয়। অর্থাৎ কিনা সম্ভব নয় শোষণ। আর শোষণ সম্ভব নয় বলেই সম্পর্কটা হলো সমানে সমান। সাম্যসমাজ। যদিও কিনা আদিম। সকলেই সমান, কেননা সকলেই সমান গরিব হতে বাধ্য। তবুও, এই সাম্যজীবনে একের সঙ্গে দশের সম্পৰ্কটা যেন অঙ্গাঙ্গী। সমাজ তখন বিশিষ্ট মানুষের সমষ্টিমাত্র নয়, যেন এক অখণ্ড সমগ্ৰতা; একের সঙ্গে দশের সম্পর্ক সংখ্যাগণিতের সম্পর্ক নয়, অঙ্গাঙ্গী সম্পর্ক। তাই, মানুষের সংগ্ৰাম আর জান, কিংবা সংগ্রাম-জ্ঞানের সেই প্ৰাগবিভক্ত সত্তায়, সমগ্রতার চেতনা প্ৰতিফলিত-ব্যষ্টির চেতনা নয়, শ্রেণীর চেতনা নয়, সমগ্ৰ সমাজের প্রাগবিভক্ত চেতনা। এই চেতনা আদিম মানুষের গোষ্ঠী নৃত্যে, — গোষ্ঠী-নৃত্য গোষ্ঠী-জীবনের অঙ্গমাত্র। সে-নাচের মধ্যেই আদিম মানুষের সাংস্কৃতিক জীবন, কিন্তু সে সংস্কৃতিতে অবসর বিনোদনের উৎসাহ নেই, নেই বিশুদ্ধ তত্ত্ব অন্বেষণের তাগিদ। তার বদলে সোজাসুজি প্ৰকৃতিকে জয় করবারই তাগিদ। কিন্তু জয়োৎসাহের বাস্তব সম্ভাবনাটা নেহাতই সংকীর্ণহাতিয়ার যে তখন নেহাতই স্থূল ধরনের। তাই প্ৰকৃতিকে জয় করবার বাস্তব বিফলতাকে কল্পনার জয় দিয়ে, বা জয়ের কল্পনা দিয়ে পূরণ করে নেবার চেষ্টা। তারই নাম ইন্দ্ৰজাল। ইন্দ্ৰজাল মানে হলো, প্ৰকৃতিকে যে-কাজ করবার জন্যে বাধ্য করতে চাই, নিজেরাই সে-কাজের একটা নকল করা, আর মনে মনে কল্পনা করা যে, প্ৰকৃতি এই নকলটাকেই নকল কয়তে বাধ্য হবে।–অর্থাৎ কিনা আসল ঘটনাটা ঘটতে বাধ্য হবে প্ৰকৃতিতে। আকাশে হয়তো বৃষ্টির নকল তুললাম আর ভাবলাম সত্যিই বৃষ্টি হবে।

শ্ৰীমতী হারিসন দেখাচ্ছেন :
অসভ্য মানুষ হলো কাজের মানুষ। তার নিজের মনে যে-কাজ করবার ইচ্ছে, সে-কাজ করবার জন্যে কোনো দেবতাকে অনুরোধ করবার বদলে সে নিজেই কাজটা সারবার চেষ্টা করে। প্ৰাৰ্থনার বদলে সে উচ্চারণ করে মন্ত্র। এক কথায়, সে ইন্দ্ৰজাল ব্যবহার করে, আর প্রায়ই সে মেতে ওঠে। ঐন্দ্ৰজালিক নাচে। রোদ বা হাওয়া বা বৃষ্টি চাইলে সে গির্জায় গিয়ে কোনো অলীক দেবতার সামনে নুয়ে পড়ে না, নিজের গোষ্ঠীকে আহবান জানায়-আর তারপর সকলে মিলে একসঙ্গে রোদের নাচ বা হাওয়ার নাচ বা বৃষ্টির নাচ নাচতে শুরু করে। ভালুক শিকার বা ভালুক ধরবার আগে সে ভালুককে বশ করবার মতো শক্তি পাবার আশায় তার দেবতার পায়ে মাথা কোটে না, শিকারের মহড়া দেয় ভালুক-নাচ নেচে। আবার :
গ্রীকরা বুঝেছিল, আপনি যদি মন্ত্রাচরণ করতে চান, তাহলে কিছু কাজ করা দরকার; অর্থাৎ ‘আপনার মধ্যে শুধু কিছু ভাবাবেগ জাগলে চলবে না, তাকে কাজের রূপে প্ৰকাশ করতে হবে।’ তাছাড়া ‘মন্ত্রাচরণের একটি অঙ্গকে আমরা আগেই পরীক্ষা করেছি, সেই অঙ্গ হলো মন্ত্রাচরণ সমবেতভাবে করা দরকার, অনেকগুলি মানুষের পক্ষে এক সঙ্গে একই আবেগ অনুভব করা দরকার।’ ইত্যাদি ইত্যাদি।
এই তো গেল আদিম মানুষের নাচের কথা। ইন্দ্ৰজাল-এর আসল ব্যাপারটুকু লক্ষ করতে হবে। স্যার ফ্রেজার দেখাচ্ছেন :
বিশুদ্ধ ও অবিমিশ্র রূপে যেখানেই…ইন্দ্ৰজাল দেখা দিয়েছে, সেখানেই ধরে নেওয়া হয়েছে যে, প্ৰকৃতিতে কোনো রকম আধ্যাত্মিক বা ব্যক্তিগত কিছুর হস্তক্ষেপ নেই, একটি ঘটনা আর এক একটি ঘটনার অনিবাৰ্য ও নিয়ত অনুগামী। অতএব এর মূল ধারণা এবং আধুনিক বিজ্ঞানের মূল ধারণা অভিন্ন। ঐন্দ্রজালিক ভাবধারার মূলে রয়েছে একটি অব্যক্ত, কিন্তু বলিষ্ঠ ও বাস্তব, বিশ্বাস, সে বিশ্বাস হলো প্ৰকৃতির নিয়মানুবতিতায় বিশ্বাস।…তাই ঐন্দ্রজালিক ও বৈজ্ঞানিক ধারণায় ঘনিষ্ঠ সাদৃশ্য! উভয় ক্ষেত্রেই ঘটনাপরম্পরা নিখুঁত ও সুনিশ্চিত ভাবে নিয়ম মানে, সেই নিযমের ক্রিয়া নিখুঁতভাবে হিসেব করা যায়, আগে থাকতে ঠাহর করা যায়। প্রকৃতি থেকে খামখেয়াল, দৈবাৎ আর অকারণকে বর্জন করা… … …। ধর্ম যেহেতু মেনে নেয় যে, এই পৃথিবী চেতন শক্তির দাস–যে-শক্তিকে তোয়াজ করলে তার উদ্দেশ্য বদলে যেতে পারে,–সেইহেতু বিজ্ঞান এবং ইন্দ্ৰজাল উভয়ই ধর্মের একেবারে বিরুদ্ধ। কেননা উভয় ক্ষেত্রেই ধরে নেওয়া হয়েছে যে, প্ৰকৃতির পথ কোনো ব্যক্তিগত মন-মেজাজের খেয়ালখুশির উপর নির্ভর করে না, তার বদল নির্ভর করে যন্ত্রের মতো চালিত অলঙ্ঘনীয় নিয়মের উপর। ইন্দ্ৰজালের বেলায় এই স্বীকৃতিটা অব্যক্ত, বিজ্ঞানের বেলায় ব্যক্ত।

উভয় উদ্ধৃতিকে দীর্ঘতর করবার প্রলোভন সংবরণ করতে হয়; তবু এটুকু থেকেই আদিম মানুষের নাচে-ইন্দ্ৰজালে মেশা প্ৰাগ্‌বিভক্ত সংস্কৃতি সম্বন্ধে কয়েকটা মূলসূত্র আবিষ্কার করা যাবে।

প্রথম এ-সংস্কৃতি একের নয়, দশের; ব্যষ্টির নয়, গোষ্ঠীর। বিদগ্ধ ব্যক্তি বা বিদগ্ধ সমাজ বলে আলাদা কিছু নেই, সংস্কৃতি যতটুকু তাতে সকলেই সমান অংশীদার। দ্বিতীয়ত, এ-সংস্কৃতির প্রধান উদ্দেশ্য প্রয়োগ, কর্ম, প্ৰকৃতিকে জয় করা। বিশুদ্ধ জ্ঞান চর্চা বা অবসর বিনোদনের তাগিদ নয়, তাগিদ যেটুকু, সেটুকু কাজের তাগিদ। প্রয়োগের খাতিরেই জ্ঞান, আবার জ্ঞানের দরুন প্রয়োগের উন্নতি-জ্ঞান আর কর্ম পৃথক হয়ে পড়েনি, জ্ঞান আর কর্মের প্রাগ বিভক্ত সমন্বয়। তৃতীয়ত, চেতনকারণবাদের দিকে, ধর্মের দিকে, ভাববাদের দিকে ঝোক নেই। ঝোকটা বহিঃপ্রকৃতিকে বশ করবার দিকে, বহিঃপ্রকৃতির অমোঘ নিয়মকে আবিষ্কার করবার দিকে, এক কথায় বস্তুবাদের দিকেই। তাই বলে সচেতন জড়বাদের উপর ইন্দ্ৰজালের প্রতিষ্ঠা সত্যিই নয়; তা হবার কথাও নয়। আদিম অসভ্য মানুষ দল বেঁধে প্রকৃতিকে জয় করবার চেষ্টা করত, কিন্তু তখন তার সামর্থ্য অতি ক্ষীণ, তার সার্থকতা নেহাতই সংকীর্ণ। বৃষ্টির নাচ নাচলে সত্যিই এমন কিছু বৃষ্টি পড়ার বাস্তব সম্ভাবনা নেই, শিকারের নাচ নাচলেই এমন কিছু মৃগয়া সমাধা হবার কথা নয়। বাস্তব সাফল্যের সংকীর্ণতাকে কাল্পনিক সাফল্য দিয়ে পুরণ করা। ইন্দ্ৰজালের তাই অনেকখানিই ইচ্ছাপুরণ। তবুও তখন এই ইচ্ছাপূরণটুকুও জীবনসংগ্রামের অঙ্গ। এ ইচ্ছাপুরাণ বাস্তব সংগ্রামে উদ্দীপনা জুগিয়েছে। অনেক মানুষ দল বেঁধে একসঙ্গে নাচছে। বৃষ্টির নাচ, কিংবা ভালুক শিকারের নাচ। নাচছে আর ভাবছে, বৃষ্টিকে জয় করা গিয়েছে, জয় করা গিয়েছে শিকার। বৃষ্টি এবার পড়বেই পড়বে, শিকার এবার জুটবেই জুটবে। তারপর দল বেঁধে একসঙ্গে বেরিয়ে পড়া-মনের সামনে দুলছে কামনা সফল হবার ছবি, আর সেই ছবির কাছ থেকে পাওয়া প্রেরণার ফসল জোগাড় করা, শিকার সমাধা করা অনেক বেশি সহজ! এই প্রেরণাটুকু বাদ দিলে তখনকার ওই ভোঁতা হাতিয়ার হাতে পৃথিবীর সঙ্গে সংগ্রাম অনেক দুরূহ হয়ে দাঁড়াত। তাই ইন্দ্ৰজাল তখন প্ৰকৃতিকে জয় করবার পথে মানুষকে এগিয়ে নিয়ে গেছে অনেক বেশি করে, অনেক ভালো করে।

তারপর প্রকৃতির সঙ্গে দিনের পর দিন একটানা সংগ্রামের চেষ্টায় উন্নত হলো মানুষের হাতিয়ার, আর তাই উৎপাদনশক্তি। মানুষ উৎপাদনা করতে শিখল নিছক বেঁচে থাকবার জন্যে যেটুকু জিনিস দরকার, তার চেয়ে অনেক বেশি জিনিস প্রকৃতির কাছ থেকে সংগ্ৰহ করতে, আর তখন থেকেই সম্ভব হলো অনেকের শ্রমের উপর নির্ভর করে কয়েক জনের পক্ষে শ্রমজীবনে অংশ গ্ৰহণ না করেও বেঁচে থাকা। ফলে, সেই আদিম সাম্যাবস্থা-বিচ্যুতি। শ্ৰেণীহীন সমাজ ভেঙে দেখা দিল নতুন সমাজ; সে সমাজে শ্রেণীবিভাগ, অতএব শ্রেণীসংগ্রামও। আর দেখা দিল ভাববাদ। ইন্দ্ৰজালের বদলে ধর্ম, আর ধর্মেরই সংস্কৃত সংস্করণ ভাববাদ। প্রয়োগের পরিবর্তে নিছক তত্ত্বজিজ্ঞাসার উৎসাহ। অব্যক্ত বস্তুবাদ বা জড়বাদের দিকে ঝোঁক ছেড়ে চেতনকারণবাদের বা ভাববাদের দিকে ঝোঁক।

শ্রেণীবিভাগের পাশাপাশি ভাববাদের উদয়। একে নিছক ঐতিহাসিক আপতন বলে উড়িয়ে দেওয়া চলে না। শ্রেণীবিভক্ত সমাজকে বদল করার মধ্যেও ভাববাদের চরম অসম্ভবের হাত থেকে প্ৰকৃত মুক্তি। একে রাজনৈতিক দল-বিশেষের প্রচারমাত্র বলে ব্যঙ্গ করাও অসম্ভব।

 

আদিম শ্রেণীহীন সমাজ ভেঙে দেখা দিল নতুন সমাজ-শ্রেণীবিভক্ত সমাজ।। একদিকে ব্ৰাহ্মণ-ক্ষত্ৰিয়, অপর দিকে শূদ্র; একদিকে ইসাক-ফেয়ারোপুরোহিত, অপর দিকে বঞ্চিত লাঞ্ছিত ক্রীতদাস; একদিকে শোষক-শাসকের দল, অপরদিকে শোষিত শ্রমিকের দল। দল বেঁধে সবাই মিলে প্ৰকৃতিকে জয় করবার চেষ্টা নয়-প্ৰকৃতির সঙ্গে সংগ্রামের ভার পড়ল শুধু একদল লোকের উপর; তারাই গতার খাটাবে, মাটি চাষবে, প্রাসাদ গড়বে, মন্দির গাথবে। শ্রমের ভার, কিন্তু শ্ৰমের ফলভোগের অধিকার নয়। সে-অধিকার অন্য শ্রেণীর, শাসক শ্রেণীর। পরান্নজীবী এই যে নতুন শ্রেণীর মানুষ, এদের পক্ষে গতির খাটাবার তাগিদ নেই একটুও; তাই গতর খাটানোটা নেহাতই ইতরের লক্ষণ–“শূকর-যোনি, শ্বা-যোনি চণ্ডাল-যোনি বা” (ছন্দোগ্য উপনিষদ)। চণ্ডাল হলো শুয়োর আর কুকুরের সমগোত্র। গতির খাটাবার তাগিদ এতটুকুও নেই বলেই মাথা খাটাবার দেদার অবসর। চিন্তা বা বুদ্ধি বা জ্ঞানবা যে কোনো নাম দিয়েই এই মাথা খাটানো ব্যাপারটাকে ব্যক্ত করা যাক না কেন-চরম উৎকর্ষ বলে ঘোষিত হলো। এই জ্ঞান-এর উপর শাসক শ্রেণীর একেবারে একচেটিয়া অধিকার, কেননা শোষিত জনগণের উপর গতির খাটাবার ভার, এবং তখন হাতিয়ারের এমন উন্নতি হয়নি যে, জনগণ অল্পমাত্ৰ গতির খাটিয়ে মানবসমাজের মোট অভাব দূর করে বাকি সময়টুকু সংস্কৃতির চর্চা করবে। তাই যাদের উপর গতির খাটানোর দায়, মাথা খাটাবার মতো অবসর তাদের কাছে কল্পনার অতীত। প্ৰাচীন মিশরী প্যাপিরসে লেখা থেকে এখানে কিছুটা উদ্ধৃত করবার প্রলোভন হয়। তখন গতির খাটাবার দায়টা যে আজকের শ্রমিকের দায়ের চেয়ে কিছুমাত্র কম নয়, তার প্রমাণ পাওয়া যাবে :

কামারকে দেখেছি কামারশালে কাজ করতে। আগুনের মুখে হাপর নিয়ে সে দিনরাত বসে রয়েছে; ওইরকমভাবে একটানা বসে থাকতে থাকতে তার গায়ে পচা আর আঁশটে গন্ধ হয়ে গিয়েছে, … …। খোদাইকর সমস্ত দিন একটানাভাবে কঠিন পাথর কেটে চলেছে, তারপর দিনের শেষে হাত দুটো যখন তার নেহাতই চলতে আর চায় না, তখন হয়তো সারা দিনের মজুরি বাবদ দুমুঠে খাবার জুটল; কিন্তু পরের দিন সুৰ্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে যদি সে আবার কাজে না লাগে, তাহলে তার পিঠের দিকে হাত দুটো শক্ত করে বেঁধে … …। রাজমিস্ত্রির কথা বলব? পরনের কাপড় বলতে তার কোমরে শুধু একটা নেংটি, কাজ করতে করতে তার আঙুলগুলো ক্ষয়ে গিয়েছে, কিন্তু তার যদি খিদে অসহ্য হয়, তাহলে নিজের হাত কামড়ানো ছাড়া আর কোন উপায় নেই।… …হাঁটু দুটো বুকে দুমড়ে চেপে তাঁতি সমস্ত দিন ধরে তাঁত বুনছে, তাই সমস্ত দিন সে ঘরের মধ্যে বন্দি,–“সুর্যের আলো দেখবার জন্যে প্ৰাণটা যদি কখনও একান্ত ব্যাকুল হয়, তাহলে দোরের পাহারাদারকে নিজের রুটিটুকু ঘুষ না দিয়ে উপায় নেই। … … -মুচি যেন সারাটা দিন ধরে কাতরাচ্ছে, তার শরীর পচে গিয়ে পচা মাছের গন্ধ, আর যখন তার পেটের জ্বালা একেবারে অসহ্য হয়ে: ওঠে, তখন তার পক্ষে চামড়ায় দাত ফোটানো ছাড়া আর কোনো গতি নেই……

নীল নদের ধারে মানুষের যে সভ্যতা গড়ে উঠেছিল, এই তার অন্দর মহলের আসল চেহারা। কিন্তু শুধু মিশরই বা কেন? এর পাশাপাশি তুলনা করে দেখুন, আমাদের দেশে শ্রেণীসমাজে শূদ্র সম্বন্ধে মনোভাব “মানব” ধর্মে কীভাবে প্ৰকাশ পেয়েছে; তুলনা করলেই বোঝা যাবে, বিভিন্ন প্রাচীন সভ্যতার খোলসগুলোয় যতই তফাত থাক না কেন, সে-সব খোলস ছাড়ালে সবগুলিরই চেহারা মোটামুটি এক :

উচ্ছিষ্টমন্নং দাতব্যং জীর্ণানি বসনানি চ।
পুলকাশ্চৈব ধান্যানাং জীর্ণাশ্চৈব পরিচ্ছদা:।
–শূদ্রের জন্যে ছেঁড়া মাদুর, জীর্ণ বসন, উচ্ছিষ্ট অন্ন।

নোঙর ছবি সন্দেহ নেই। কিন্তু কোনো আধুনিক রাজনীতিকের কল্পিত প্রচার-পত্র নয়।

এ-হেন যে জনগণ, এদের পক্ষে মাথা খাটিয়ে বিশুদ্ধ জ্ঞান চর্চার কথা নিশ্চয়ই ওঠে না। ভগবান কী রকমের সুতো দিয়ে স্বৰ্গ থেকে পৃথিবীকে বুলিয়ে রেখেছেন? তিনি কেন সৃষ্টি করলেন মানুষকে, আর মানুষের মধ্যে সেরা মানুষ ফেয়ারোকে? পশ্চিমের কোন পাহাড়ের পিছন দিকে মৃত আত্মার জমায়েত? –এ সব প্রশ্ন জনগণের মাথায় ওঠে নি। মানুষকে এই জনগণ অমৃতের পুত্র বলে কল্পনা করবে। কেমন করে? কখন এরা বসে ভাববো : ওঁ উষা বা অশ্বস্য মেধ্যস্য শিরঃ। ‘সোহং ব্ৰহ্ম’ বা ‘তত্ত্বমসি শ্বেতকেতু’, কিংবা ওই ধরনের কোনো মহাবাক্যও এদের কারুর ঠোঁটে ফুটে ওঠবার কথা নয়। শ্রেণীবিভক্ত সমাজ। প্ৰকৃতির সঙ্গে সমবেত সংগ্ৰাম নয়। আর। আসলে সংগ্রাম বেটুকু, সেটুকুর দায় লুষ্ঠিত শোষিত জনগণের উপর; জীবন তাদের কাছে বোঝামাত্র, চিন্তার জাল বোনা দূরে থাকুক, মরবার ফুরন্থতটুকুও তাদের যেন নেই। গতির খাটিয়ে শরীর ক্ষয় করার পথই যেন তাদের সামনে একমাত্র পথ।

আর অপরদিকে মুষ্টিমেয় শোষকের দল। প্ৰকৃতির সঙ্গে লড়াই করবার হাতিয়ার তখন যতই অনুন্নত আর স্থূল হোক না কেন, শোষণের পদ্ধতি এত নির্লজ আর অকুণ্ঠ যে, শোষকের ঘরে বিলাসের প্রাচুর্য। তাই তাদের কাছে প্রয়োগের তাগিদ, প্ৰকৃতির সঙ্গে সংগ্রামের তাগিদ এতটুকুও নেই; নিছক চিন্তার জাল বোনাই সহজ আদর্শ। যারা খেতি চষে, কাপড় বোনে, পাথর কাটে, প্ৰাসাদ গড়ে, তারা নেহাতই ছোটোলোকের দল; গতির খাটানোটা ইতরের লক্ষণ, মাথা খাটানোর মধ্যেই মানবাত্মার চরম উৎকর্ষ।

 

মিসমার হয়ে গেল মেহনতের মর্যাদা। কেননা, সভ্যতার যেটা সদর মহল, যেখানে মালিকদলের জমকালো দরবার, সেখানে আর মেহনতকারী মানুষের ঠাই রইল না। মালিকদের পক্ষে দায় নেই মেহনত করবার, গতর খাটাবার। মাথা খাটিয়েই তারা ঠিক করে দেবে, কোনখানে কারা কেমনভাবে মেহনত করবে,-ফসল ফলাবে, কাপড় বুনবে, কাটবে। পাথর, গড়বে ইমারত। কিন্তু যে ক্রীতদাসের দল এই মেহনত করবে, তারা রইল চোখের আড়ালেই, পাইক-পেয়াদার চাবুক দিয়ে ঘেরা ছোট গণ্ডিটুকুর মধ্যে। তাই শ্রেণীবিভাগ দেখা দেবার পর থেকে যে-মন দিয়ে, যে-বুদ্ধি দিয়ে মেহনতের পরিকল্পনা, সেই মনের সঙ্গে, সেই বুদ্ধির সঙ্গে মেহনতকারী হাতের সম্পর্ক গেল ঘুচে। রাজদরবারে বসে মিশরের রাজা আর সভাসদেরা মিলে হয়তো পরিকল্পনা করল, মরুভূমির বুকে পাথর দিয়ে গাথা হােক বিশাল, বিরাট, পিরামিড। কিন্তু শুধু মাথা ঘামিয়ে এই পরিকল্পনাটুকু করেই তো সত্যিকারের পিরামিড গড়া হয় না। তার জন্যে আসলে দরকার লক্ষ মানুষের রক্ত-জাল-করা মেহনত, দীর্ঘ মেহনত। কিন্তু এই মেহনতটা সমাজের সদর মহলের আড়ালে, তাই চোখে পড়ে না। এই মেহনতের দায় ক্রীতদাসের উপর, শূদ্রদের উপর, ছোটলোকদের উপর। তাই এর মৰ্যাদা নেই। দিনের পর দিন মানুষ সভ্যতার কত আশ্চৰ্য চিহ্নই না গড়ে তুলতে লাগল। কিন্তু সভ্যতার এত আশ্চর্য কীর্তির মূলে আসল অবদান যে মেহনন্তের, সেই কথাটা আর মনে রইল না। মানুষ মনে করল, এত সব কীর্তির আসল যে-গৌরব, তা হলো মানুষের মনের, বুদ্ধির, চেতনার। অথচ, চেতনা বা মন বা বুদ্ধি – সব কিছুই যে শেষ পৰ্যন্ত মানুষের মেহনতের কাছে ঋণী, এই কথাটুকু ভুলে গেল মানুষ।

মাথা খাটানো আর গতির খাটানো, পৃথিবীকে চেনা আর পৃথিবীকে বদল করা, কর্ম আর জ্ঞান – শ্রেণীবিভাগ দেখা দেবার পর থেকে যেন চিড় খেয়ে দুভাগে ভাগ হয়ে গেল। যতদিন দল বেঁধে সমানে সমান হয়ে বাচ, ততদিন মেহনতের উলটো পিঠেই চেতনা, কর্মের উলটো পিঠেই জ্ঞান, দুয়ের মধ্যে সম্পর্ক বড় নিবিড়। অবশ্যই একথায় কোনো সন্দেহ নেই যে, তখন পর্যন্ত মানুষের হাতিয়ার অনেক স্থূল, তাই মেহনতটাও নেহাতই অনুন্নত, পৃথিবীকে বদল করবার চেষ্টায় বাস্তব সাফল্য নেহাতই সংকীর্ণ। তাই তার উলটো পিঠে যে-চেতনা, সেই চেতনাও অনেকখানি স্থূল, অনেকখানিই ভ্ৰান্ত কল্পনা দিয়ে ভরা। তবু চেতনায় মেহনতে আত্মীয়তা, যে-আত্মীয়তা ঘুচল শ্রেণীসমাজ দেখা দেবার সময় থেকে।

 

যাকে আমরা দর্শনশাস্ত্ৰ বলি, কিংবা আরো নিখুঁতভাবে বললে, যাকে বলা উচিত অধিবিদ্যা বা metaphysics, তার জন্ম-ইতিহাসের আসল রহস্যটা বুঝতে গেলে মূলসূত্র অনুসন্ধান করতে হবে এইখান থেকেই, সমাজের এই শ্ৰেণীবিভাগ থেকেই। তার মানে এই নয় যে, সমাজে শ্রেণীবিভাগ দেখা দেবার সঙ্গে সঙ্গেই জন্ম হয়েছে অধিবিদ্যা বা দর্শনশাস্ত্রের। এইভাবে বুঝতে যাওয়াটা যন্ত্রকে বুঝতে যাওয়ার মতো হবে–অর্থাৎ ভুল হবে। তার মানে, হঠাৎ কোনো এক মুহুর্তে ভূমিকম্প হওয়ার মতো সমাজ-জীবনে শ্রেণীবিভাগ ফুটে ওঠেনি। আর কল টিপলেই যে-রকম জল পড়ে, সেইরকমভাবে শ্রেণীবিভাগ দেখা দেবার সঙ্গে সঙ্গে কিন্তু জন্ম হয়নি। অধিবিদ্যার আর ভাববাদের। তবু একথাতেও কোনো সন্দেহ নেই যে, যাকে আমরা দর্শনশাস্ত্র বা অধিবিদ্যা বলতে অভ্যস্ত, তার বীজ এই সামাজিক শ্রেণীবিভাগের মধ্যেই; সে বীজ ফলে-ফুলে শোভিত। হয়ে মহীরূহের রূপ নিতে ঐতিহাসিকভাবে অনেক দিন সময় নিয়েছিল নিশ্চয়ই! তবু, সামাজিক শ্রেণীবিভাগের কথাটা ভুলে গেলে দর্শনশাস্ত্রের আসল রহস্যটুকু বুঝতে পারা যাবে না। কেননা, এই অধিবিদ্যা বা দর্শনশাস্ত্রের আসল কথা হলো, বিশ্বের আসল রহস্যকে জানতে চাওয়া-শুধু জানা, শুধু নির্মল, নির্লিপ্ত জ্ঞান। অন্তত, দর্শনশাস্ত্রের যারা ডাকসাইটে পণ্ডিত, তেঁারা মোটের উপর এই কথাটাই মেনে নিয়েছেন। দুনিয়া নিয়ে মাথা ঘামানো, বিশুদ্ধ বুদ্ধি দিয়ে পরম সত্যের একটা বৰ্ণনা খোজা,-দুনিয়াকে বদল করবার কথা নয়।

মেহনত পড়ল চোখের আড়ালে, মেহনতের দাবিটা আর আসলে বড় দাবি হয়ে রইল না। সমাজের সদর মহলে শেষ পৰ্যন্ত চেতনার দাবিটাই চূড়ান্ত দাবি হয়ে দাঁড়াল। এ-চেতনা কিন্তু বিশুদ্ধ চেতনা, মেহনতের সঙ্গে তার সম্পর্ক নেই,- আর মেহনতের সঙ্গে সম্পর্ক নেই বলেই মাটির পৃথিবীর সঙ্গেও সম্পর্ক নেই! কেননা, একমাত্র কাজের মানুষই মাটির পৃথিবীর মুখোমুখি। মেহনতের সময় যখন যুঝতে হয় পৃথিবীর সঙ্গে, তখন না বুঝে উপায় নেই, এই পৃথিবীটা কী নিৰ্ঘাত এক বাস্তব। লাঙল দিয়ে মাটি চাষবার সময় এ-প্ৰশ্ন আর মাথায় আসে না যে, লাঙলটা বাস্তবিকই সত্যি, না মনের একটা ভুল মাত্র, যেমন মনের ভুল হলো অন্ধকার জায়গায়দাঁড়িতে-দেখা সাপ। মাথায় আসে না, খেতটা বাস্তব জিনিস কি-না, তাই নিয়ে মাথা ঘামাবার কথা। কাস্তে হাতে ফসল ফলাবার সময় এ-কথা না-মেনে উপায় নেই যে, কাস্তে আর ফসল দুই-ই হলো অবধারিত সত্য; কামারশালে হাতুড়ি পেটবার সময় টের পাওয়া যায়, হাতুড়ি আর লোহা দুই-ই কী রকম সত্যি জিনিস। কাজের মানুষ বাস্তব দুনিয়ার মুখোমুখি; তার যে চেতনা, সেই চেতনা এই বাস্তব দুনিয়ার প্রতিবিম্ব ছাড়া আর কিছুই নয়।

কিন্তু সমাজে শ্রেণীবিভাগ দেখা দেবার সময় থেকে মেহনতের দায় আর চেতনার দায়,-গতর খাটাবার দায় আর মাথা খাটাবার দায়- দুয়ের মধ্যে সম্পর্ক ভেঙে গেল। যাদের উপর গতরা খাটাবার দায়, তাদের উপর শুধুই গতির খাটাবারই দায়; বাদের উপর মাথা খাটাবার দায়, তাদের উপর শুধুই মাথা খাটাবারই দায়। শুধু তাই নয়। সামাজিক ভাবে মেহনত থেকে বাদ পড়ল মৰ্যাদা। মেহনতকারীর দল হলো নেহাতই অস্পৃশ্য; ওদের মুখ দেখলে পাপ, ওদের ছায়া মাড়ালে পাপ। তাই যারা মাথা খাটায়, তাদের চোখের  আড়ালে পড়তে চাইল। এই পৃথিবীটা, যে পৃথিবীর সঙ্গে অস্পৃশ্য মেহনতকারীদের অমন নাড়ির সম্পর্ক। ওরা মশগুল হয়ে উঠল শুধু চেতনাকে নিয়ে–সে-চেতনা বুঝি বাস্তব দুনিয়ার চেতনা নয়–নিছক চেতনা, স্বাধিকারপ্ৰমত্ত স্বয়ত্ত্ব, সর্বশক্তিমান। ফলে এই বিশুদ্ধ চেতনাটাই হয়ে দাঁড়াল আসল সত্য, চরম সত্য। চেতনার দাবিই হলো চরম দাবি, যে জিনিস চেতনার দাবি চোকাতে পারবে না, সে-জিনিস সত্যি হতে পারে না।

এ-কথা অবশ্যই শাসকরাও বুঝেছিল যে, অন্নের উৎপাদন না হলে শেষ পৰ্যন্ত কিছুই টেকে না; কিন্তু তাই বলে অন্নের এই উৎপাদনকেই ধ্রুব আদর্শ বলে মনে করা নেহাতই স্থূল দৃষ্টির পরিচয়! উপনিষদের ভৃগুবরণ সংবাদ-এ এই মনোবৃত্তিরই স্বাক্ষর। বরুণের ছেলে ভূগু-র ইচ্ছে হলো সবচেয়ে চরম সত্যকে জানিবার, তাই বাবার কাছে গিয়ে ভূণ্ড বললেন : ব্ৰহ্ম কী, সে-বিষয়ে আমাকে উপদেশ দিন। বরুণ বললেন : ব্ৰহ্ম সম্বন্ধে একটা বৰ্ণনা শুনলেই ব্ৰহ্মকে তুমি যে জানতে পারবে, এমন আশা নেই; তুমি তপস্যা করো, তপস্যা করলেই ব্ৰহ্মকে জানতে পারবে। (‘তপস্যা’ -দৈনন্দিন প্রয়োগ থেকে অনেক দূরের কথা, বিশুদ্ধ চেতনায় আশ্রয় নেবার কথাই)। তবে একটা মূলসূত্র পেলে তপস্যা করবার সুবিধে হয়। বরুণ তাই মূলসূত্র হিসেবে ছেলেকে বলে দিলেন—‘যতো বা ইমানি ভূতানি জায়ন্তে’, ইত্যাদি। অর্থাৎ, যার থেকে এই সমস্ত জিনিস জন্মেছে, জন্মাবার পর যার উপর নির্ভর করেছে এবং শেষ পর্যন্ত যার মধ্যেই তা বিলীন হয়ে যাবে, তাই হলো ব্ৰহ্ম। এই মূলসূত্রকে অবলম্বন করে ভৃগু তপস্যায় বসলেন, আর তপস্যা করে এসে বললেন; বাবা বুঝেছি, অন্নই হল ব্ৰহ্ম। কেননা অন্ন থেকেই এই সমস্ত উৎপন্ন, ইত্যাদি। বরুণ বললেন : হলো না। কেননা, এ যে নেহাতই স্থূল দৃষ্টির কথা। ভৃগু আবার তপস্যা করতে গেলেন, আর তারপর ফিরে এসে বলেন : বুঝেছি বাবা, অন্ন নয় প্রাণ। বরুণ বললেন : হলো না, আবার তপস্যা করো। তৃতীয়বারের তপস্যায় ভূণ্ড বললেন : মনই হলো ব্ৰহ্ম। চতুর্থবারের তপস্যায় তার মনে হলো : বিজ্ঞানই ব্ৰহ্ম। কিন্তু বরুণ, বললেন; এখনো হয় নি, আরো তপস্যা করতে হবে। শেষবার চরম তপস্যা করে ভৃগু বুঝতে পারলেন, আসলে অন্ন নয়, প্ৰাণ নয়, মন নয়, বিজ্ঞান নয়, –আনন্দই হল ব্ৰহ্ম। আনন্দ থেকেই সব কিছুর জন্ম, ইত্যাদি। শ্রেণীবিভক্ত সমাজে শাসক-শ্রেণীর ভঙ্গি এই উপাখ্যানের ব্যঞ্জনা হয়ে রয়েছে। শুরুতে অন্ন, অন্ন না হলে সমাজের ভিতই যে গাথা হয় না। কিন্তু তাই বলে অন্নকে চরম সত্য হিসেবে স্বীকার করা নেহাতই ছোটলোকমির পরিচয়! স্থূলদুষ্টর অল্পবুদ্ধি মানুষ অন্নকে স্বীকার করুক, নুয়ে পড়ুক অন্ন উৎপাদনের দায়িত্ব কঁাধে নিয়ে। অবশ্যই, শুধু অন্ন উৎপাদনের দায়িত্বই, শুধু কর্মের দায়িত্বই; তাই বলে কর্মফলে অধিকার তো নয়। যারা উচ্চস্তরের মানুষ, কর্মফলের অধিকার তাদের বলেই কর্মজীবনের দায়িত্ব থেকে তারা মুক্ত। তাই তারা ওই ছোটলোকদের মতো অন্ন উৎপাদনের দায় নেবে কেন? তারা এগিয়ে চলুক ধাপে ধাপে অধ্যাত্ম সত্য আবিষ্কারের পথে। ক্রমশ সূক্ষ্ম থেকে সুক্ষ্মতর সত্যের আবিস্কার-শেষ ধাপে আনন্দ, শুধু বিশুদ্ধ চৈতন্যের আনন্দ, আনন্দই ব্ৰহ্ম।

সমাজের এক-প্ৰান্তে একদল নিৰ্বোধ মানুষ। শুধু অন্নের উৎপাদনে নিজেদের শরীর-মন ক্ষয় করে ফেলুক। সমাজের আর-এক-প্ৰান্তে বিশুদ্ধ নিষ্কলুষ চিন্তায় মগ্ন আর একদল মানুষ সূক্ষ্মতম আধ্যাত্মিক সত্য আবিষ্কারই তাদের জীবনে পরম পুরুষাৰ্থ হয়ে থাকুক, আধ্যাত্মিক চেতনার চরমে পৌঁছে তারা হৃদয়ঙ্গম করুক, আনন্দই ব্ৰহ্ম। বিশুদ্ধ আনন্দই হলো বিশ্বরহস্যের চাবিকাঠি।

তাই মার্কস বলেছেন : আধ্যাত্মিক কাজ আর বাস্তব কাজ, এই দুয়ের মধ্যে বিভাগ দেখা দেবার আগে পৰ্যন্ত শ্রমবিভাগ প্ৰকৃত বিভাগে পরিণত হয়নি। সেই সময় থেকে মনে হতে পারে যে, চেতনাটা বাস্তব জগতের চেতনা ছাড়া বুঝি অন্য কিছু। চেতনা যখন থেকে সত্যিই এমন একটা কিছুকে বোঝাতে চায়, যা বাস্তব কিছু নয়, তখন থেকেই আমরা দেখতে পাই সর্ব-সম্পর্ক বিরহিত হয়ে এই চেতনা বিশুদ্ধ মতবাদ, ঈশ্বরতত্ত্ব, দর্শন, নীতিশাস্ত্ৰ প্ৰভৃতি নিয়ে একটা ধর্মমত-জাতীয় কিছুতে পরিণত হয়।

অবশ্য এ কথা ঠিক যে, ইন্দ্ৰজাল ছেড়ে মানুষের তত্ত্বজিজ্ঞাসা একেবারে এক ধাপে বিশুদ্ধ দার্শনিক ভাববাদে পৌঁছোয়নি; ইন্দ্ৰজালের পর ধর্ম, ধর্মেরই বিদগ্ধতম সংস্করণ ভাববাদ। যতদিন শ্রেণীবিভক্ত সমাজ, ততদিনই এই কথা,–ঘুরে ফিরে নানানভাবে নানান পথ দিয়ে যুগে যুগে ভাববাদেই তত্ত্বজিজ্ঞাসার পরিসমাপ্তি। তাই, শ্রেণীবিভক্ত সমাজের উচ্ছেদের মধ্যেই ভাববাদ খণ্ডনের মূলসূত্র। তাই মার্কস বলছেন : এতদিন ধরে দার্শনিকেরা নানানভাবে দুনিয়াকে শুধু ব্যাখ্যা করবারই চেষ্টা করেছেন, কিন্তু আসল কথা হলো একে বদল করা!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *