১১. সংযোজন – ভূমি-বিন্যাস

সংযোজন – ভূমি-বিন্যাস

গত পচিশ-ত্রিশ বছরের ভেতর ভূমি বিন্যাস সংক্রান্ত যত নূতন লিপি-প্রমাণ আবিষ্কৃত হয়েছে, প্রধানত বাঙলাদেশে, তবে পশ্চিমবঙ্গেও, তা থেকে এমন কোনও তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না যাকে বলা যায় একান্ত অভিনব, যার ফলে এই গ্রন্থের পূর্ববতী সংস্করণের বিবৃতি, বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যার কোনও সংশোধন বা পরিবর্তন প্রয়োজন আছে। নূতন লিপিগুলির এতৎসংক্রান্ত তথ্যাদির প্রকৃতি, ভূমি ক্রয়বিক্রয় ও দামের রীতি ও ক্রম, ভূমির প্রকারভেদ, মাপ ও মূল্য, চাহিদা, সীমা-নিৰ্দেশ, উপস্বত্ব, কর-উপরিকর প্রভৃতি সম্বন্ধে যা-কিছু তথ্য পাওয়া যাচ্ছে তা সমস্তই অতিরিক্ত, যথার্থ নূতন কিছু নয়। তবু, দু-একটি দৃষ্টান্ত, যা অংশত নূতন, তা উল্লেখ করা য়েতে পারে, যদিও তথ্যগুলি তেমন অর্থবহ নয়।

১২৮ গুপ্ত সংবতে (৪৪৭ খ্ৰীষ্টাব্দে) বর্তমান বগুড়া জেলার অন্তর্গত প্রাচীন শৃঙ্গবেরবীথির পূর্ণকৌশিকা অধিকরণে কিছু ভূমি ক্রয়বিক্রয় ও দানক্রিয়া হয়েছিল; ক্রয়বিক্রয়ের ব্যাপারটা পটীকৃত করেছিলেন আয়ুক্তক অচ্যুত। পট্টোলীটি অধুনা জগদীশপুর পট্টোলী বলে খ্যাত এবং রক্ষিত আছে রাজশাহীর বরেন্দ্ৰ অনুসন্ধান সমিতিতে। যাই হোক, ঐ সময়ে শৃঙ্গবেরবীথিতে ভূমির দাম ছিল প্রতি কুল্যবাপে দুই দীনার। প্রায় সমসাময়িক কালে বর্তমান বগুড়া-দিনাজপুর সীমাসঙ্গমে পঞ্চনগরী বিষয়েও ভূমির দাম একই ছিল, অথচ কোটিবর্ষ বিষয়ে ছিল তিন দীনার, ফরিদপুরে চার দীনার। মনে হয়, প্রায় পঞ্চম শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে শুরু করে মোটামুটি দুশ বছর উত্তরবঙ্গে ভূমির দাম প্রতি কুলবাপে দুই থেকে তিন দীনার, পূর্ববাঙলায় চার দীনার।

ভূমির মাপ সম্বন্ধে প্রায় তুচ্ছ করবার মতো হলেও একটু নৃতন খবর আছে লড়হচন্দ্র ও গোবিন্দচন্দ্রের (আঃ ১০০০-২০ ও আ- ১০২০-৪৫ খ্ৰীষ্টাব্দ) তিনটি ময়নামতী তাম্রপট্টোলীতে। এখানে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে, ভূমি পরিমাণ দেওয়া হচ্ছে পর পর ক্রমহ্রস্বায়মান পাচটি মাপে; পটক, দ্রোণ, যষ্টি, কাক এবং বিন্দু। পাটক ও দ্রোণ (৪০ দ্ৰোণে এক পাটক) সুপরিজ্ঞাত; কােকও তাই। কিন্তু যষ্টি, যার অর্থ লাঠি, এই যষ্টি মাপটি কী? দ্রোণের সঙ্গে তার সম্পর্ক কী? সেনবংশীয় রাজাদের লিপিমালায় ‘নল’ বলে একটি ভূমি-মাপের উল্লেখ আছে; এই নল’ মোপ পূর্ববাঙলায় কোনও কোনও জায়গায় কিছুদিন আগে পর্যন্তও প্রচলিত ছিল। যষ্টি কি “নল; দু’য়ে কি কোনও সম্বন্ধ ছিল? বিন্দু মাপটিই বা কী? কাকের সঙ্গে বিন্দুর সম্বন্ধ কি? এ-সব প্রশ্নের কোনও উত্তর পাওয়া যাচ্ছে না।

গোবিন্দচন্দ্রের ঊর্ধর্বতন তৃতীয় পূর্বপুরুষ রাজা শ্ৰীচন্দ্রের পশ্চিমভাগ লিপিতেও একটু নূতন সংবাদ পাওয়া যাচ্ছে। এখানে দেখছি, শ্ৰীহট্ট জেলার মৌলবীবাজার অঞ্চলে দশম শতকে ১০ দ্ৰোণে। ১ পাটক ভূমি গণনা করা হতো, অথচ ষষ্ঠ শতাব্দীর গোড়ার দিকে (৫০৭ খ্ৰীষ্টাব্দ) গুণাইঘর পট্টোলীর সাক্ষ্যে দেখেছিলাম, ত্রিপুরা অঞ্চলে ৪০ দ্রোণবাপে ১ পাটক ধরা হত। তা হলে এই দাঁড়াচ্ছে যে, ষষ্ঠ শতাব্দীর ত্রিপুরার ১ পাটক জমি দশম শতাব্দীর শ্ৰীহট্টের ১ পাটক জমির চারগুণ, অবশ্যই যদি ধরে নেওয়া যায়, দ্রোণ বলতে দুই কালে দুই জায়গায়ই একই পরিমাণ ভূমি বুঝাতো!! আর তা না হলে বলতে হয়, চার শতাব্দীর ভেতর দ্রোণের ভূমি পরিমাণ বেড়ে গিয়েছিল, অথবা বিভিন্ন স্থানে ভূমিপরিমাণ বিভিন্ন ছিল বরাবরই।