০৫. ভূমির মাপ ও মূল্য

ভূমির মাপ ও মূল্য

পঞ্চম হইতে সপ্তম শতক পর্যন্ত প্রাচীন বাঙলায় লিপিগুলিতে ভূমির মাপের ক্রম খুব সহজেই ধরিতে পারা যায়। সর্বোচ্চ ভূমিমান হইতেছে কুল্য অথবা কুল্যবাপ, তারপর দ্রোণ বা দ্রোণবাপ এবং সর্বনিম্ন মাপ আঢ়বাপ। কুল্য, দ্রোণ এবং আঢ় (পরবর্তী লিপিগুলির আঢ়ক, বর্তমান পূর্ববাঙলার আঢ়া) সমস্তই শস্যমান; এই শস্যমান দ্বারাই ভূমিমান নিরূপিত হইয়াছিল, ইহা কিছু অস্বাভাবিক নয়।

কুল্য বা কুল্যবাপ।। যে ভূমিতে বপন করা হয়, তাহা বাপক্ষেত্র; “উপ্যতেহস্মিন ইতি বাপঃক্ষেত্রম”। যে পরিমাণ বাপক্ষেত্রে এক কুল্য বীজ শস্য বপন করা যায়, সেই পরিমাণ ভূমি এক কুল্যবাপ ভূমি। দ্রোণবাপ এবং আঢ়বোপও যথাক্রমে এক দ্রোণ ও এক আঢ় বা আঢক শস্যবাপনযোগ্য ভূমি। কাহারও কাহারও মতে কুল্য পূর্ববাঙলার কুলা; এক কুল্য শস্য অর্থাৎ একটি কুলায় যত ধান বা শস্য ধরে তাহার বীজ যতটা পরিমাণ ভূমিতে বপন করা হয় তাহাই কুল্যবাপ। মৈমনসিংহ-শ্ৰীহট্ট-কাছাড় অঞ্চলে এখনও কুলুবায় কথা প্রচলিত, তাহাও কুল্যবাপ কথারই ভগ্ন রূপ।

দ্রোণবাপ ও আড়বাপ ৷। দ্রোণ (== কলস) বর্তমানে বাঙলার বহু জেলার পল্লীগ্রামে দোনে বা ডোনে রূপান্তরিত হইয়াছে। আঢ় এখনও আঢ়া নামে প্রচলিত। প্রাচীন আর্য ও কোষকারদের মতে এক কুল্যবাপ ভূমি আট দ্রোণবাপের সমান, এক দ্রোণবাপ চার আঢ়বাপের সমান, এক আঢ়বাপ চার প্রস্থের সমান। এক কুল্যবাপ যে আট দ্রোণের সমান, তাহা লিপিপ্রমাণ দ্বারাও সমর্থিত হয়। পাহাড়পুর-লিপিতে ১২ দ্ৰোণবাপ যে ১ ১/২ (দেড়) কুল্যবাপের সমান, তাহা পরিষ্কার ধরা যায়। বৈগ্রাম-লিপির ইঙ্গিতও তাহাই।

এই ইঙ্গিত প্রাচীন সাহিত্য-ঐতিহ্য দ্বারাও সমর্থিত হয়। কুল্যই হোক আর দ্রোণই হোক, এ-সমস্তই ধান্যের আধার, যেহেতু ধান্যই বাঙলার প্রধানতম শস্য। মনুসংহিতায় দ্রোণ বলিতেই ধান্যদ্রোণের উল্লেখ, এবং এই ধান্যদ্রোণেরই ব্যাখ্যা করিয়াছেন বাঙালী কুলুকভট্ট। এই কুলুকভট্ট, রঘুনন্দন এবং শব্দকল্পদ্রুম কোষ-সংকলয়িতার মতে :

৮ মুষ্টি = ১ কুঞ্চি
৮ কুঞ্চি = ১ পুস্কল
৪ পুস্কলে = ১ আঢ়ক (আঢ়)
৪ আঢ়কে = ১ দ্রোণ

এবং মেদিনীকোষের মতে ৭ দ্রোণ = ১ কুল্য। শব্দকল্পদ্রুমে বলা হইয়াছে, এক আঢ়কে সাধারণত ১৬ হইতে ২০ সের ধান ধরে, অর্থাৎ এক দ্রোণে ৬৪ হইতে ৮০ সের, এক কুল্যে ৫১২ হইতে ৬৪০ সে অর্থাৎ ১২ মন ৩২ সের হইতে ১৮ মন। এই পরিমাণ ধানের বীজ যে পরিমাণ ভূমিতে বপন করা হইত। সেই পরিমাণ ভূমি হয়তো এক কুল্যবাপ। কিন্তু এ সম্বন্ধে স্থির নিশ্চয় করিয়া কিছু বলিবার উপায় নাই।

কুল্যবাপাই হোক, আর দ্রোণবাপ বা আঢ়বাপ যাহাই হোক, মাপা হইত। নলের সাহায্যে; এই নলই হইতেছে প্রাচীন উত্তর ও পূর্ববাঙলার প্রচলিত মানদণ্ড। বৈগ্রাম, পাহাড়পুর এবং ফরিদপুরের তিনটি পট্টোলীতেই বলা হইতেছে ৮, ৯ নলে (অষ্টক নব-নল্যাভ্যাম) এক মান। কিন্তু এই মান কি প্রস্থ × দৈর্ঘ্যের মান, ৮ এবং ৯ দুই প্রকার নলের মান, কুল্যবাপের মান, দ্রোণবাপ না আঢ়বাপের মান, তাহা সঠিক বলিবার উপায় নাই। এই নলেরও দৈর্ঘ্য নির্ভর করিত ব্যক্তিবিশেষের হস্তের দৈর্ঘ্যের উপর। বৈগ্রাম-লিপি অনুসারে দরকবীকৰ্ম নামক জনৈক ব্যক্তির হাতের মাপে, ফরিদপুর-লিপিত্ৰয় অনুসারে শিবচন্দ্ৰ নামক কোনও ব্যক্তির হাতের দৈর্ঘ্য অনুযায়ী। অবশ্য ইহাদের হাতের মাপ গড়পড়তা সাধারণ হাতের দৈর্ঘ্যের মাপ কিংবা তার চেয়ে একটু বেশি বলিয়া মনে করিলে কিছু অন্যায় করা হইবে না। এই ধরনের ব্যক্তিবিশেষের হাতের মাপের মান অষ্টাদশ শতকের মধ্যপাদেও বাঙলাদেশে প্রচলিত ছিল। রাজশাহীর নাটোর অঞ্চলে রামজীবনী হাতের মান তো সেদিনকার স্মৃতি।

ষষ্ঠ শতক ও অষ্টম শতকের দুইটি লিপিতে ভূমি-মাপের একটি নূতন মানের সংবাদ জানা যাইতেছে। বৈন্যগুপ্তের গুণাইঘরপট্টোলী এবং দেবখড়গের ১নং আস্রফপুৱা-পট্টোলীতে পাটক নামে একটি মানের উল্লেখ আছে, এবং তাহার পরের ক্রমেই যে মানের নাম উল্লেখ আছে তাহা দ্রোণবাপ। দ্রোণের সঙ্গে পাটকের সম্বন্ধের ইঙ্গিত এই দুইটি পট্টোলীর দত্ত ভূমির পরিমাণ বিশ্লেষণ করিলে হয়তো পাওয়া যাইতে পারে। আস্রফপুর-পট্টোলীটি বিশ্লেষণ করিলে দেখা যায়, ৫০ দ্রোণে এক পাটক হয়। কিন্তু আস্রফপুর-পট্টোলীর পাঠের নির্ধারণ সন্দেহাতীত নয়। তাহা ছাড়া, সন্দেহ করিবার আরও কারণ গুণাইঘর লিপির সাক্ষ্য। এই পট্টোলী দ্বারা মহারাজ রুদ্রদত্ত পাচটি পৃথক ভূখণ্ডে সর্বশুদ্ধ ১১ পাটক ভূমি দান করিয়াছিলেন; এই পাঁচটি ভূখণ্ডের পরিমাপ তালিকাগত করিলে এইরূপ দাঁড়ায় :

১ম ভূখণ্ড – ৭ পাটক ৯ দ্রোণবাপ
২য় ভূখণ্ড – ০ পাটক ২৮ দ্রোণবাপ
৩য় ভূখণ্ড – ০ পাটক ২৩ দ্রোণবাপ
৪র্থ ভূখণ্ড – ০ পাটক ৩০ দ্রোণবাপ
৫ম ভূখণ্ড – ১ ৩/৪ পাটক ০ দ্রোণবাপ
———————————————
মোট – ৮ ৩/৪ পাটক ৯০ দ্রোণবাপ

আগেই বলিয়াছি, দত্ত ভূমির মোট পরিমাণ ১১ পাটক। তাহা হইলে ৯০ দ্রোণে হইতেছে ২৪ পাটক, অর্থাৎ ৪০ দ্ৰোণে এক পাটক, এ কথা সহজেই বলা চলে। আগে দেখিয়াছি, ৮ দ্ৰোণে এক কুল্যবাপ, তাহা হইলে ৫ কুল্যবাপ = ১ পাটক।

পাটক এখানে নিঃসন্দেহে ভূমি মাপের মান। কিন্তু আম্রফপুর-লিপি দুটিতেই প্রমাণ পাওয়া যাইবে, পাটক কথাটি গ্রাম বা গ্ৰামাংশ অর্থেও ব্যবহৃত হইত। তালপোটক, মৰ্কটাসী পাটক, বৎসনাগ পাটক, দীর পাটক এবং এইজাতীয় পাটকান্ত যত নাম, সমস্তই গ্রাম বা গ্রামাংশের নাম। বস্তুত বাঙলা পাড়া কথাটি পাটক হইতে উদ্ভূত বলিয়াই মনে হয়, অথবা দেশজ পাড়া হইতে পাটক। তলপাটক = তলপাড়া, ভট্টপাটক = ভাটপাড়া, মধ্যপাটক = মধ্যপাড়া, ইত্যাদি পাটকান্ত নাম তো এখনও বাঙলাদেশের সর্বত্র সুপরিচিত। এ জাতীয় নাম প্রাচীন বাঙলার লিপিগুলি হইতেও জানা যায়। বাঙলার বাহিরেও এই জাতীয় নামের অভাব নাই, যেমনমূলবর্মপাটক গ্রাম, বিশালপোটক গ্রাম ইত্যাদি। গ্রাম বা গ্রামাংশ (= পাড়া) অর্থে পাট, পাটক কথা উত্তর ও পশ্চিম-ভারতে পড় বা পড্রকরূপে ব্যবহৃত হইয়াছে, যথা- বড়পড্রকাভিধান গ্রাম, শমীপড্রক গ্রাম, শিরীষপড্র গ্রাম ইত্যাদি। পাট=পড্র=গ্রাম; ক্ষুদ্র গ্রামার্থেক প্রত্যয় যোগে নিম্পন্ন হয়। পাটক= পড্রক = পাড়া বা গ্রামাংশ বা ছোট গ্রাম।

পাল-সম্রাটদের আমলে ভূমি পরিমাপের মান কী ছিল তাহা জানিবার উপায় নাই। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দানের বস্তু হইতেছে একটি বা একাধিক সম্পূর্ণ গ্রাম; বোধ হয় ইহা অন্যতম কারণ। একাদশ শতকে শ্ৰীচন্দ্রের রামপাল তাম্রপট্টে দেখিতেছি, সর্বোচ্চ ভূমি-মান হইতেছে পাটক। অষ্টম শতকে এই মান ফরিদপুরে প্রচলিত ছিল; একাদশ শতকে বিক্রমপুরেও দেখিলাম। মোটামুটি এই শতকেই শ্ৰীহট্টে দেখি, উচ্চতম মান হইতেছে হল। কেহ কেহ মনে করেন। কুলুবায়েরই অপর নাম হল বা হাল। যাহাই হউক, গোবিন্দকেশবের ভাটেরা তাম্রপট্টে ২৮ টি গ্রামে ২৯৬ টি বাস্তুভিটা এবং ৩৭৫ হল জমি ছিল; নিম্নতম মান ছিল ক্ৰান্তি। শ্ৰীহট্টে ভূমি-পরিমাপের বর্তমান ক্রম এইরূপ :

৩ ক্রান্তি = ১ কড়া
৪ কড়া =  ১ গণ্ডা
২০ গণ্ডা = ১ পণি
৪ পণ =  ১ রেখা
৪ রেখা = ১ ষষ্ঠী
৭ ষষ্ঠী = ১ পোয়া
৪ পোয়া = ১ কেদার বা কেয়ার
১২ কেয়ার = ১ হল ( = ১০ ১/২ (সাড়ে দশ) বিঘা = ৩ ১/৪ (শোয়া তিন) একর)

শ্ৰীচন্দ্রের রামপাল শাসনে উচ্চতম ভূমিমান দেখিয়াছি পাটক, কিন্তু এই রাজারই ধুল্লা-শাসনে উচ্চতম মান দেখিতেছি হল, এবং দত্ত ভূমিগুলি তো বিক্রমপুরে বলিয়াই অনুমান হয়। একাদশ শতকে বিক্রমপুরে কি পাটক ও হল, এই দুই মানই প্রচলিত ছিল? যদি তাঁহাই হয়, তাহা হইলে পাটকের সঙ্গে হলের সম্বন্ধ কি? যাহাই হউক, ধুল্লা-শাসন হইতে এই খবরটুকু পাওয়া যাইতেছে যে, হলের নিম্নতর ক্রম হইতেছে দ্ৰোণ; কিন্তু দ্রোণের সঙ্গে হলের সম্বন্ধ নির্ণয় করা যাইতেছে না। দ্বাদশ শতকে ভোজ্যবর্মার বেলব লিপিতে উচ্চতম ভূমিমান পাটক এবং নিম্নতর মান দ্ৰোণ; এ দুয়ের সম্বন্ধ যে কী, তাহা আগেই দেখিয়াছি। সেন-রাজাদের লিপিগুলিতেও উচ্চতম মান পাটক অথবা ভূপাটক। এই লিপিগুলি বিশ্লেষণ করিয়া ভূমিমানের যে ক্রম পাওয়া যায় তাহা এইরূপ : ১. পাটক বা ভূপাটক, ২০ দ্রোণ বা ভূদ্রোণ, ৩. আঢ্যক বা আঢ়াবাপ, ৪- উন্মান বা উদান বা উয়ান, ৫- কাক বা কাকিণী বা কাকিণিকা। পাটকের সঙ্গে দ্রোণের এবং দ্রোণের সঙ্গে আঢ়ক বা আঢ়াবাপের সম্বন্ধ ইতিপূর্বেই আমরা জানিয়াছি, কিন্তু আঢকের সঙ্গে উন্মানের বা উন্মানের সঙ্গে কাকের সম্বন্ধের কোনও ইঙ্গিত লিপিগুলিতে পাওয়া যাইতেছে না ৷ লক্ষ্মণসেনের সুন্দরবন পট্টোলীতে উপরোক্ত ক্রমের একটু ব্যতিক্রম পাওয়া যায়; দ্রোণের নিম্নতর ক্রম দেওয়া হইয়াছে খড়িক (?), এবং তাহার পর যথারীতি উন্মান ও কাকিণী। খড়িকা মান যে ছিল তাহার প্রমাণ এই রাজারই মাধ্যাইনগর পট্টোলীতেও আছে; সেখানে উচ্চতর মান ভুখাড়ী এবং তাহার পরেই খাড়ীকা। কিন্তু খাড়ীকার সঙ্গে দ্রোণের অথবা ভুখাড়ীর সঙ্গে খাড়ীকার সম্বন্ধ নির্ণয়ের কোন ইঙ্গিত লিপিগুলিতে নাই। তবে লক্ষ্মণসেনের সুন্দরবন লিপিতে একটু ইঙ্গিত যাহা আছে তাহা উল্লেখ করা যাইতে পারে।

১২ অঙ্গুলি = ১ হাত
৩২ হাত = ১ উন্মান (উয়ান)।

এই সম্বন্ধ নির্ণয় এবং এ পর্যন্ত যে-সমস্ত ভূমিমানের উল্লেখ করিয়াছি, তাহার যথাযথ মর্ম গ্ৰহণ করিতে হইলে প্রাচীন আর্যাশ্লোক এবং প্রচলিত ভূমি-পরিমাপ রীতির একটু পরিচয় লওয়া প্রয়োজন।

এ ইঙ্গিত আমি আগেই করিয়াছি যে, শস্যভাণ্ডমানের সাহায্যেই প্রাচীন কালে ভূমিমান নির্ধারিত হইয়াছিল। কুল্যবাপ, দ্ৰোণবাপ, আঢ়বাপ ইত্যাদি নামই তাহার প্রমাণ। পাটক বোধহয় গোড়াতেই ছিল ভূমিমান। হলও তাহাই। খাড়ী (শুদ্ধ, খারী) কিন্তু শস্যভাণ্ডমান বলিয়াই মনে হয়, খাড়ী উচ্চতর মান, খাড়ীকা (ক-প্রত্যয় যোগে নিষ্পন্ন, ক্ষুদ্রার্থে) বোধহয় নিম্নতর মান। খারী যে শস্যমান, তাহার প্রমাণ আমরকোষে আছে :

দ্ৰোণাঢ়কদিব্যাপাদৌ দ্ৰৌণিকাঢ়কিকাদয়ঃ।
খারাবাপন্তু খারাকঃ।

কাক বা কাকিণী গোড়ায় বোধ হয় ছিল মুদ্রামান। শ্ৰীধরের ত্ৰিশতিকায় একটি আর্যা আছে :

ষোড়শপণঃ পুরাণঃ পণ্যো ভবেৎ কাকিণীচতুষ্কেণ।
পঞ্চাহতৈশ্চতুর্ভ্যির্বরাটকৈঃ কাকিণী হ্যেক ৷।

উন্মান অর্থই বোধ হয় তুলামান। কিন্তু গোড়ায় এইসব মান মুদ্রামান, ভাণ্ডমান, তুলামান বা ভূমিমান যাহাই থাকুক, উত্তর কালে ইহারা ভূমিমান নির্দেশে ব্যবহৃত হইত। উন্মান এবং কাকিণী। ছাড়া আর সমস্ত মানই হয় ভূমিমান, না হয় শস্যভাণ্ডমান। সেন আমলের লিপিগুলিতেই প্রথম দেখিতেছি, এই ভূমিমান ও শস্যমানের সঙ্গে তুল্যমান ও মুদ্রামান সম্পর্কিত করা হইয়াছে। ইহা হইতে একটা অনুমান বোধ হয় সহজেই করা যায়। প্রাচীনতর কালে ভূমি যখন সুলভ ছিল, চাহিদা যখন খুব বেশি ছিল না, তখন ভূমির মাপের এত চুলচেরা বিচারও ছিল না। পাটকের অর্থাৎ গ্রামাংশের মোটামুটি আয়তন একটা সকলেরই জানা ছিল, দুই-চার বিঘা। এদিক-ওদিক হইলে বিশেষ কিছু আসিয়া যাইত না। পরবর্তী কালে ভূমির চাহিদা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে অবশ্য পাটকের মাপজোখও নিশ্চয়ই সুনির্দিষ্ট হইয়াছিল। কুল্যবাপ, দ্রোণবাপ, আঢ়বাপ, হল ইত্যাদি সম্বন্ধেও একই কথা বলা চলে। সুলভ ভূমির যুগে কতখানি ভূমিতে মোটামুটি কত বীজ ধান লাগে, কত লাঙ্গল লাগে, এই দিয়াই মোটামুটি জমির পরিমাণ নির্ণীত হইত। ক্ৰমে চাহিদা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মাপজোখ নির্দিষ্টতর হইতে থাকে, এবং ক্রমশ আরও নিম্নতর মান নির্দেশের প্রয়োজন হয়। এই নিম্নতর মান যে তুলামান বা মুদ্রামান দ্বারা নির্ণীত হইয়াছিল, তাহাও জমির ক্রমবর্ধমান চাহিদার দিকে ইঙ্গিত করে।

পাটকের সঙ্গে কুল্যবাপের ও দ্রোণের, কুল্যবাপের সঙ্গে দ্রোণের, দ্রোণের সঙ্গে আঢ়ক বা আঢ়বাপের সম্বন্ধ আমরা আগেই জানিয়াছি। এইবার আঢ্যক বা আঢ়বাপের সঙ্গে উন্মানের এবং উন্মানের সঙ্গে কাকিণীর সম্বন্ধ কী, তাহা জানিবার চেষ্টা করা যাইতে পারে। কোনও আর্যশ্লোকের মধ্যে এই সম্বন্ধের পরিচয় পাওয়া যাইতেছে না। শ্ৰীযুক্ত যোগেশচন্দ্র রায় বাকুড়ার প্রচলিত রীতি সম্বন্ধের প্রয়োজনীয় খবর দিতেছেন। মল্লভূমের রাজা চৈতন্যসিংহদেবের তিনখানি দানপত্র তাহার হস্তগত হইয়াছিল; একটি পত্রে তিনি জানকীরাম হাজরাকে দুই দ্রোণ দুই আড়ি তিরিশ উয়ান এক কান ভূমি দেবোত্তর দান করিয়াছিলেন। সমসাময়িক অন্যান্য দানপত্র হইতে জানা যায়,

৪ কাক বা কাকিণী (পূর্ববাঙলায়, চট্টগ্রামে কানি, রাঢ়ে কান)= ১ উয়ান
৫০ উয়ান = ১ – আড়ি ৪
আড়ি = ১ দ্রোণ
৪ আড়ি = ১ দ্রোণ

বাঙলা ১২৩০ সালে লিখিত “সেবক শ্ৰীসনাতন মণ্ডল দাসস্য” একটি শুভঙ্করী বইয়ে যে আর্য পাওয়া যায়, তাহাও উপরোক্ত সংবাদ সমর্থন করে।

“খেতে মাঠে রশি না পাই।
সাল ছেষে কাহিন বলাই ৷।
চারি কানে লয়ান হয়
পঞ্চাশ উয়ানে আডি।।
চারি আড়িতে ডোন হয়
আঠাস হাত দডি।।”

আড়ি, আডি নিঃসন্দেহে আঢ়বাপ, আঢ্যক বা আঢ়কবাপ; ডোন দ্রোণ বা দ্রোণবাপ। তা হইলে এইবার আমরা আঢ়বাপের সঙ্গে উন্মানের সঙ্গে কাকিণী সম্বন্ধ জানিলাম।

আর-একটি ভূমি-মাপের উল্লেখ শুভঙ্কর করিয়াছেন, এবং মাপটি কিছুদিন পূর্ব পর্যন্ত বাঙলাদেশেও প্রচলিত ছিল, এই মাপটির নাম কুড়িব। কেহ কেহ মনে করেন, এই কুড়িব ও কুল্যবাপ সমানার্থক। আমার মনে হয়, এই অনুমান সন্দেহজনক, কারণ, লীলাবতীর আর্যায় আছে–

8 কুড়ব = ১ প্রস্থ
৪ প্রস্থ = ১ আঢ়া (আঢ়ক, আঢ়বাপ)
8 আঢ়া = ১ দ্রোণ

অর্থাৎ ৬৪ কুড়বে ১ দ্ৰোণ, এবং যেহেতু ৮ দ্রোণে এক কুল্যবাপ, সেইহেতু এক কুল্যবাপ ৫১২ কুড়িব বা কুড়বার সমান। অন্তত লীলাবতীর মতে তাহাই হওয়া উচিত। কুড়িব এবং বর্তমান কালে প্রচলিত বিঘা সমপরিমাণ ভূমি নির্দেশ করে কি না বলা কঠিন। যাহাই হউক, এই কুড়বার উল্লেখ বাঙলার প্রাচীন লিপিগুলিতে দেখা যায় না।

এই কুল্যবাপ ভূমির পরিমাণ কতটুকু ছিল তাহা জানিবার কৌতুহল স্বাভাবিক। সে-দিকে চেষ্টাও কিছু কিছু হইয়াছে, কতকটা অনুমানের এবং অনুমানোপম সাক্ষ্যের উপর নির্ভর করিয়া। কুল্যবাপের পরিমাণ যে বর্তমান কালের বিঘা হইতে অনেক বেশি ছিল, এ কথা নলিনীকান্ত ভট্টশালী মহাশয় বহুদিন আগেই বলিয়াছিলেন। কাছাড়ের ইতিবৃত্ত-লেখক উপেন্দ্ৰচন্দ্র গুহ মহাশয় বলেন যে, ঐ জেলায় এক কুল্যবাপ ১৪ বিঘার সমান। দীনেশচন্দ্র সরকার মহাশয় অনেক অনুমানসিদ্ধ প্রমাণের সাহায্যে দেখাইতে চেষ্টা করিয়াছেন যে, এক কুল্যবাপ ভূমি পরিমাণ “অন্তত পক্ষে ৪০-৪২ একর অর্থাৎ প্রায় ১২৫ বিঘার কম ছিল না।” এ সম্বন্ধে নিশ্চয় করিয়া কিছুই বলিবার উপায় নাই; তবে লীলাবতীর আর্যার সাক্ষ্য যদি প্রামাণিক হয় এবং কুড়বা যদি বিঘার সমার্থক হয় তাহা হইলে এক কুল্যবাপে ৫১২ বিঘা হওয়া উচিত। কিন্তু কুড়বা ও বিঘা সমার্থক কি না, এ বিষুয়ে সন্দেহ আছে।

অষ্টমশতকপূর্ব লিপিগুলিতে দেখিয়াছি, ভূমি পরিমাপের মানদণ্ড ছিল নল; পরবর্তী যুগের মানদণ্ডও ইহাই। লক্ষ্মণসেনের আনুলিয়া-শাসনে প্রদত্ত ভূমি যে নল-মানদণ্ডে মাপা হইয়াছিল, তাহার নাম বৃষভশংকর নল। বৃষভশংকর ছিল রাজা বিজয়সেনের বিরুদ বা অন্যতম উপাধি। মনে হয়, বিজয়সেনের হাতের মাপে যে নলের দৈর্ঘ্য নিরূপিত তাহারই নাম হইয়াছিল। বৃষভশংকর নল। আনুলিয়া-শাসন হইতে প্রমাণ হয়, অন্তত লক্ষ্মণসেনের কাল পর্যন্ত এই বৃষভশংকর নলের ব্যবহার প্রচলিত ছিল। অথচ, বিজয়সেন নিজে কিন্তু ভূমি দান করিয়াছিলেন “সমতটনলেন।” অর্থাৎ সমতটমণ্ডলে প্রচলিত মানদণ্ডের পরিমাপে। সমতটীয় নল পুণ্ড্রবর্ধন-ভুক্তির খাড়ি-বিষয়েও প্রচলিত ছিল (বারাকপুর শাসন)। এই সমতট নলই পরে বৃষভশংকর নল নামে পরিচিত হইয়াছিল কি না, বলা কঠিন। বর্ধমান-ভুক্তির উত্তর-রাঢ় অঞ্চলে এবং পুণ্ড্রবর্ধন-ভুক্তির ব্যাঘ্রতটী অঞ্চলে এই বৃষভশংকর নল প্রচলিত ছিল। লক্ষ্মণসেনের তপণদীঘি-শাসনের সাক্ষ্য হইতে মনে হয়, বাঙলাদেশের বিভিন্ন স্থানের নল-মানদণ্ড বিভিন্ন প্রকারের ছিল। বরেন্দ্রীমণ্ডলে প্রদত্ত ভূমি মাপা হইয়াছিল “তত্ৰত্যদেশব্যবহারনলেন।” অর্থাৎ সেই সেই দেশে প্রচলিত নলের সাহায্যে! সেনা-আমলের লিপিগুলি বিশ্লেষণ করিলে দেখা যায়, ব্যাখ্রতটীমণ্ডলে অর্থাৎ পশ্চিম-নিম্নবঙ্গে বৃষভশংকর নল প্রচলিত ছিল, কিন্তু বরেন্দ্রীমণ্ডলে অর্থাৎ উত্তরবঙ্গে প্রচলিত ছিল অন্য প্রকারের নলমানদণ্ড। গোবিন্দরপুর-তাম্রশাসনের সাক্ষ্য যদি প্রামাণিক হয়, তাহা হইলে বর্ধমান-ভুক্তির পশ্চিম-খাটিকা অঞ্চল বেতড চতুরকে (বেতড়, হাওড়া) প্রচলিত নলের মাপ ছিল ৫৬ হাত। লক্ষ্মণসেনের ভাওয়াল লিপিতে দেখি ২২ হাতের আর-এক নলের উল্লেখ। ঢাকা জেলার উত্তর-পূর্ব অঞ্চলে এই নলের প্রচলন ছিল বলিয়া মনে হয়। বাঙলার বাহিরেও নলমানদণ্ডের প্রচলন যে ছিল তাহার প্রমাণ পাওয়া যায়। দ্বিতীয় তৈলের নীলগুণ্ড লিপিতে ভূমি-পরিমাপের নির্দেশ দেওয়া হইয়াছে “রাজমানেন দণ্ডেন” উড়িষ্যার নৃসিংহদেবের একটি পট্টোলীতে দেখিতেছি, রাজকর্মচারীদের হাতের মাপেও নলমান নির্ধারিত হইত। এই লিপিতে ভূমি-পরিমাপের নির্দেশ দেওয়া হইতেছে “চন্দ্ৰদাসকরণস্য নলপ্রমাণেন” এবং “শ্ৰীকরণশিবদাসনামকনলপ্রমাণেন”। কিন্তু এই নলমানদণ্ড কিসের মানপাটকের না কুল্যবাপের, দ্রোণের না। আঢকের, উন্মান না কাকিণীর? এই প্রশ্নের উত্তরের কোনও ইঙ্গিত লিপিগুলিতে নাই।

ভূমির মূল্য কিরূপ ছিল, তাহা এইবার আলোচনা করা যাইতে পারে। কিন্তু এ সম্বন্ধে যাহা-কিছু সংবাদ, তাহা অষ্টমশতকপূর্ব লিপিগুলিতেই শুধু পাওয়া যায়। পরবর্তী লিপিগুলিতে ভূমির মূল্য কোথাও দেওয়া হয় নাই; কারণ, এই যুগের পট্টোলীগুলি দানের পট্টোলী, ক্ৰয়-বিক্রয়ের নয়। সেন-আমলের লিপিগুলিতে ভূমির উৎপত্তির যথাযথ পরিমাণ পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে দেওয়া হইয়াছে, কিন্তু তাহাতে মূল্য নিরূপণের সাহায্য যাহা পাওয়া যায় তাহা পরোক্ষ। দামোদরপুরের ১, ২, ৪ এবং ৫নং শতাধিক বৎসর জুড়িয়া বিস্তৃত। এই চারিটি পট্টোলী বিশ্লেষণ করিলে দেখা যায় পট্টোলী শতাধিক বৎসর ধরিয়া পুণ্ড্রবর্ধন-ভুক্তির কোটিবৰ্ষ-বিষয়ে এক কুল্যবাপ ভূমির মূল্য ছিল তিন দীনার। ফরিদপুরের পট্টোলীগুলি তিনটি রাজার রাজত্বকাল অর্থাৎ মোটামুটি পঞ্চাশ বৎসর ধরিয়া বিস্তৃত। পূর্ববাঙলার এই অঞ্চলে প্রায় পঞ্চাশ বৎসর ধরিয়া ভূমির মূল্য ছিল প্রতি কুল্যবাপে চারি দীনার। বৈগ্রাম-পট্টোলীর দত্তভূমির অবস্থিতি ছিল পঞ্চনগরী-বিষয়ে এবং সেখানে প্রতি কুল্যবাপের মূল্য ছিল দুই দীনার। বৈগ্রাম উত্তরবঙ্গে দিনাজপুর ও বগুড়া জেলার সীমান্তে; দামোদরপুরও দিনাজপুর জেলায়; কিন্তু প্রথমটি কোটিবৰ্ষ-বিষয়ে, দ্বিতীয়টি পঞ্চনগরী-বিষয়ে, এবং দুই স্থানে প্রতি কুল্যবাপের মূল্যের পার্থক্য এক দীনার। ৩নং দামোদরপুর পট্টোলীর চণ্ড গ্রাম কোন বিষয়ে অবস্থিত ছিল, তাহার উল্লেখ নাই; কিন্তু প্রতি কুল্যবাপের মূল্য দুই দীনারা দেখিয়া অনুমান হয় চণ্ড গ্রাম ছিল পঞ্চনগরী-বিষয়ে। এই অনুমানের অন্যতম কারণ, চণ্ডগ্ৰাম বৈগ্রাম বা বায়ীগ্রামের একেবারে পাশাপাশি গ্রাম। পাহাড়পুর পট্টোলীর দত্তভূমিও কোন বিষয়ে অবস্থিত তাহার উল্লেখ নাই; কিন্তু এ ক্ষেত্রেও ভূমির মূল্য দুই দীনার; এবং পাহাড়পুর বৈগ্রাম হইতে মাত্র উনিশ-কুড়ি মাইল। অনুমান করা চলে, পাহাড়পুরও পঞ্চনগরী-বিষয়েই অবস্থিত ছিল। যাহা হউক, একথা সহজেই বুঝা যাইতেছে, এক-এক বিষয়ে ভূমির মূল্য ছিল এক-এক প্রকার- যেমন, পঞ্চনগরী-বিষয়ে দুই দীনার, কোটিবৰ্ষ-বিষয়ে তিন দীনার, ফরিদপুর অঞ্চলে চারি দীনার। ইহার অন্য একটি প্রমাণ দেখিতেছি, প্রায় প্রত্যেকটি পট্টোলীতেই “ইহা বিষয়ে – দীনারিক্যবিগ্রয়োনুবৃত্তাঃ” বা এইজাতীয় কোনও পদের উল্লেখের মধ্যে। ভূমির মূল্যবৃদ্ধির হার কিরূপ ছিল তাহা বলিবার কোনও উপায় নাই, তবে ভূমির চাহিদা যে ভাবে বৃদ্ধি পাইতেছিল, তাহাতে মূল্যও যে ক্রমশ বাড়িতেছিল, এরূপ অনুমান করিলে খুব অন্যায় হয় না। কিন্তু এই শতাধিক বর্ষ ধরিয়া জমির দাম একই ছিল; সে প্রমাণও ধর্মাদিত্য এবং গোপচন্দ্রের পট্টোলী তিনটিতে পাওয়া যায়। বিভিন্ন অঞ্চলে দামের পার্থক্যও আগেই দেখিয়াছি। এই পার্থক্য খানিকটা যে ভূমির উর্বরতা, চাহিদা এবং স্থানীয় জীবিকামান-সমৃদ্ধির উপর নির্ভর করিত এ অনুমান সহজেই করা চলে। পঞ্চনগরী-বিষয়ের তুলনায় কোটিবৰ্ষ-বিষয়ের সমৃদ্ধি নিশ্চয়ই বেশি ছিল, এবং কোটিবর্ষের তুলনায় প্ৰাকসমুদ্রশায়ী দেশগুলি সমৃদ্ধতির ছিল। ধর্মাদিত্য এবং গোপচন্দ্রের পট্টোলী তিনটিতে ভূমির দাম প্রতি কুল্যবাপে চারি দীনার। ১নং পট্টোলীতে স্পষ্ট বলা হইয়াছে, প্রাক সমুদ্রশায়ী দেশগুলির ইহাই ছিল প্রচলিত মূল্য; ২ং এবং ৩নং (Sg পূর্বদেশে ভূমি ক্রয়-বিক্রয়ের (প্রাক-ক্রিয়মাণক এবং ‘প্রাক-প্রবৃত্তি) এই নিয়মের প্রতি সুস্পষ্ট ইঙ্গিত আছে। “প্রাক” বলিতে এই তিন ক্ষেত্রেই পূর্বাঞ্চলের সাগরশায়ী দেশগুলিকে বুঝাইতেছে, নিঃসংশয়ে এই অনুমান করা চলে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হইতেছে, সর্বত্র খিল, ক্ষেত্র এবং বাস্তুভূমির একই মূল্য। বাস্তুভূমি অপেক্ষা ক্ষেত্রভূমি, ক্ষেত্রভূমি অপেক্ষা খিলভূমির মূল্য অপেক্ষাকৃত কম হওয়াই তো স্বাভাবিক, অথচ একটি লিপিতেও তেমন ইঙ্গিত নাই, বরং * সর্বত্র সকল প্রকার ভূমির দাম একই, এই কথারই সুস্পষ্ট ইঙ্গিত আছে।*

অর্থনীতির মূল তত্ত্ব সম্বন্ধে যাঁহাদের কিছুমাত্র পরিচয় আছে তাহারাই জানেন মুদ্রার মূলগত মূল্য নির্ভর করে ক্রয়াশক্তির তারতম্যের উপর। আজিকার দিনে এক টাকায় বা কোনও বস্তু যে পরিমাণ ক্রয় করা যায়, ১০০ বৎসর আগে তাহার অনেক বেশি পাওয়া যাইত, এবং ঐতিহাসিক মোরল্যাণ্ড দেখাইয়াছেন, আকবরের আমলে ১৯১২ খ্ৰীষ্টশতকের চেয়ে অন্তত ছয়গুণ বেশি পাওয়া যাইত। সেই হেতু অনুমান করা চলে, প্রাচীন বাঙলায় একটি রৌপ্যমুদ্রার ক্রয়াশক্তি আকবরের আমল অপেক্ষাও অন্তত কয়েকগুণ বেশি ছিল। প্রাচীন বাঙলায় ১৬টি রৌপ্যকে ছিল ১ দীনার, অর্থাৎ তখনকার ১ দীনার বর্তমান ভারতবর্ষের অন্তত ৯৬ টাকার কম কিছুতেই ছিল না, এ কথা জোর করিয়াই বলা যায়। বর্তমানের মুদ্রায় পঞ্চনগরী-বিষয়ের এক কুল্যবাপ ভূমির মূল্য সেই হেতু অন্তত ১৯২ টাকা, কোটিবৰ্ষ-বিষয়ে অন্তত ২৮৮ টাকা, এবং ফরিদপুর অঞ্চলে অন্তত ৩৮৪ টাকার কম কিছুতেই ছিল না। তখনকার দিনে এই মুদ্রা-পরিমাণ কম নয়। পরবর্তী যুগে অর্থাৎ পাল ও সেন-আমলে ভূমির মূল্য কিরূপ ছিল, তাহা বলিবার উপায়। বিশেষ নাই; তবে বিশ্বরূপসেনের একটি লিপিতে এবং কেশবসেনের ইদিলপুর-লিপিতে এই মূল্যের খানিকটা ইঙ্গিত আছে বলিয়া যেন মনে হয়। রাজা কেশবসেন ইদিলপুর-শাসনদ্বারা জনৈক ব্ৰাহ্মণকে পুণ্ড্রবর্ধন-ভুক্তির অন্তর্গত বঙ্গের বিক্রমপুর ভাগে তালপাড়া-পাটক নামে একটি গ্রাম দান করিয়াছিলেন। এই গ্রামের ভূমির পরিমাণ কত ছিল, তাহার উল্লেখ নাই, তবে চতুঃসীমাবচ্ছিন্ন এই গ্রামটির বার্ষিক আয় (না, মোট মূল্য?) যে দুই শত মুদ্রা ছিল, তাহার উল্লেখ আছে। এই মুদ্রা খুব সম্ভব কপর্দকপুরাণ। বিশ্বরূপসেনের সাহিত্য-পরিষৎ লিপিতে ৩৩৬.৫ উন্মান ভূমি দানের উল্লেখ আছে; ছয়টি গ্রামে এগারোটি ভূখণ্ডে এই পরিমাণ ভূমির মোট বার্ষিক আয় (না, মোট মূল্য?) ছিল পাঁচ শত পুরাণ। সমসাময়িক অন্যান্য লিপির সাক্ষ্য দেখিয়া মনে হয়, সর্বত্রই আমরা যাহা পাইতেছি, তাহা দত্ত ভূমির বার্ষিক আয়, ভূমির মোট মূল্য নয়, এবং এই আয়ের পরিমাণ দেওয়া হইতেছে। পুরাণ অথবা কপর্দকপুরাণ মুদ্রায়। লক্ষ্মণসেনের গোবিন্দপুর তাম্রশাসনে এবং আরও দুই-একটি শাসনে পরিষ্কার বলা হইয়াছে, প্রতি দ্রোণের বার্ষিক আয় মোটামুটি ১৫ পুরাণ হিসাবে ৬০ দ্রোণ ১৭ উন্মান ভূমির বিড্ডারশাসন গ্রামের মোট বার্ষিক আয় ৯০০ পুরাণ (ইত্থং চতুঃসীমাবচ্ছিন্নো তদেশীয়সংব্যবহারষট্ৰপঞ্চাশৎহস্তপরিমিতনলেন সপ্তদশোন্মানধিকষষ্ঠি-ভূ-দ্ৰোণাত্মক প্রতি দ্রোণে পঞ্চদশপুরাণোৎপত্তি-নিয়মে বৎসরেণ নবশতোৎপত্তিকঃ বিড়ারশাসনঃ…)। এই বার্ষিক আয় হইতে ভূমির মোট মূল্য কী হইতে পারে, তাহা অনুমান করা খুব কঠিন হয়তো নয়।

 

——————–

* নারদ ও বৃহস্পতির মতে ১ দীনার = ১২। ধানক, ১ ধানক = ৪ আণ্ডিকা, ১ আণ্ডিকা = ১ কার্যাপণ (তাম্রমুদ্রা)। অমরকোষের মতে—১ দীনার = ১ নিষ্ক। বৃহস্পতির মতে—১ নিষ্ক = ৪। সুবর্ণ।