০৩. ভূমিদানের শর্ত

ভূমিদানের শর্ত

ভূমিদান কী কী শর্তে করা হইত, কী কী দায় ও অধিকার বহন করিত তাহা এইবার আলোচনা করা যাইতে পারে। এ বিষয়ে পূর্বপর্বের লিপিগুলির সংবাদ অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত। যথামূল্যে প্ৰস্তাবিত ভূমি-ক্রয়ের জন্য গৃহস্থ আবেদন যখন জানাইতেছেন, তখন তিনি ভূমি ক্রয় করিতে চাহিতেছেন, সোজাসুজি এ কথা বলিতেছেন না; বলিতেছেন, “আপনি আমার নিকট হইতে যথারীতি যথানির্দিষ্ট হারে মূল্য গ্ৰহণ করিয়া এই ভূমি আমাকে দান করুন।” এই যে ক্রয়ের প্রার্থনার সঙ্গে সঙ্গে দানের প্রার্থনাও করা হইতেছে, ইহার অর্থ কী? যে ভূমির জন্য মূল্য দেওয়া হইতেছে, তাহাই আবার দানের জন্যও প্রার্থনা করা হইতেছে, কেন, এ কথার উত্তর পাইতে হইলে ভূমি কী শর্তে দান-বিক্রয় হইতেছে, তাহা জানা প্রয়োজন। ধনাইদহ লিপিতে আবেদক ভূমি প্রার্থনা করিতেছেন, “নীবীধর্মক্ষয়েণ”; দামোদরপুরের ১ নং লিপিতে আছে, “শাশ্বতচন্দ্রার্কতারকভোজ্যে তয়া নীবীধর্মেণ দাতুমিতি”; ২ নং লিপিতে “অপ্ৰদক্ষিয়নী [বী]-মর্যদয়া দাঁতুমিতি”; ৩ নং লিপিতে “হিরণ্যমুপসংগৃহ্য সমুদয়-বাহ্যাপ্রিদখিলক্ষেত্রানাং প্রসাদং কর্তৃমিতি-”; ৫ নং লিপিতে “অপ্ৰদাধর্মেণ…শাশ্বতকালভোগ্যা”, পাহাড়পুর-পট্টোলীতে আছে, “শাশ্বতকালেলাপভোগ্যক্ষয়নীবী সমুদয়বাহাপ্রতিকর-”; বৈগ্রাম-পট্টোলীতে “সমুদয় বাহ্যাদি-অকিঞ্চিৎ প্রতিকরাণাম শাশ্বতচন্দ্রার্কতাৱকভোজ্য নাম অক্ষয়নী ব্যা—; বিপ্লষোষবাট গ্রামের পট্টোলীতে আছে, “অক্ষয়ানী [বী]-ধর্মণাপ্রদত্তঃ”। অন্যান্য লিপিগুলিতে শুধু ক্ৰয়-বিক্রয়ের কথাই আছে, কোনও শর্তেও উল্লেখ নাই। যাহা হউক, যে-সব লিপিতে শর্তের উল্লেখ পাইতেছি, দেখিতেছি। সেই শর্ত একাধিক প্রকারের : ১. নীবী ধর্মের শর্ত, ২৫ অপ্ৰদা ধর্মের শর্ত, ৩০ অক্ষয়নীবী (ধর্মের) শর্ত এবং ৪- অপ্রদাক্ষয়নীবীর শর্ত। বৈগ্রাম ও পাহাড়পুর-পট্টিলী দুটিতে অক্ষয়নীবী ধর্মের শর্তের সঙ্গে সঙ্গে আরও একটি শর্তের উল্লেখ আছে, সেটি হইতেছে, “সমুদয় বাহ্যাপ্রতিকর” বা “সমুদয়বাহ্যাদি-অকিঞ্চিত প্রতিকর”, অর্থাৎ ভূমি প্রার্থনা করা হইতেছে এবং ভূমি দান করা হইতেছে অক্ষয়নীবীধর্মােনু্যায়ী এবং সকল প্রকার রাজস্ব-বিবর্জিতভাবে। ইহার অর্থ এই যে, ভূমি-গ্ৰহীতা সুচিরকাল, চন্দ্ৰসূৰ্যতারার স্থিতিকাল পর্যন্ত ভূমি ভোগ করিতে পরিবেন, কোনও রাজস্ব না দিয়া। রাজা বা রাষ্ট্র যে সুচিরকালের জন্য রাজস্ব হইতে ক্রেতা ও ক্রেতার বংশধরদের মুক্তি দিতেছেন, এইখানেই হইতেছে দান কথার অন্তর্নিহিত অর্থ। ভূমির প্রচলিত মূল্য গ্রহণ করিয়া রাজা যে ভূমি বিক্রয় করেন; সেই ভূমিই যখন অক্ষয়নীবীধর্মনুযায়ী “সমুদয় বাহ্যাপ্রতিকর” করিয়া দেন, তখন তাহা দানও করেন, এবং তাহা করেন বলিয়াই ভূমি বিক্রয় করিয়াও তিনি “ধৰ্মষড়ভাগের” অর্থাৎ দানপুণ্যের এক-ষষ্ঠ ভাগের অধিকারী হন। রাজা ভূমির আয়ের এক-ষষ্ঠ ভাগের অধিকারী, সেই এক-ষষ্ঠ ভাগের অধিকার যখন তিনি পরিত্যাগ করেন, তখন তিনি দানপুণ্যের এক-ষষ্ঠভাগের অধিকারী হইবেন, ইহাই তো যুক্তিযুক্ত। এই অর্থে ছাড়া পাহাড়পুর-পট্টোলীর “যৎ পরম-ভট্টািরক-পাদানাম অর্থপচয়ো ধৰ্মষড়ভাগোপ্যায়নঞ্চ ভবতি” এ কথার কোনও সংগত যুক্তি খুঁজিয়া পাওয়া কঠিন। বৈগ্রাম-পট্টোলীতে এই কথাই আরও পরিষ্কার করিয়া বলা হইয়াছে। ৩ নং দামোদরপুর-পট্টোলীতেও পরমভট্টারক মহারাজের পুণ্যলাভের যে ইঙ্গিত আছে, তাহাও তিনি “সমুদয়-বাহ্যাপ্রদ” অর্থাৎ সর্বপ্রকারের দেয়-বিবর্জিত করিয়া ভূমি বিক্রয় করিতেছেন বলিয়াই।

এইবার নীবীধর্ম, অক্ষয়নীবীধর্ম বা নীবীধর্মক্ষয় এবং অপ্ৰদাধর্ম কথা কয়টির অর্থ কী, তাহা জানিবার চেষ্টা করা যাইতে পারে। বাঙলাদেশের বাহিরে গুপ্তযুগের যে লিপির খবর আমরা জানি, তাহার মধ্যে অন্তত দুইটিতে অক্ষয়নীবী ধর্মের উল্লেখ আছে। কোষকারদের মতে নীবী কথার অর্থ মূলধন বা মূলদ্রব্য। কোনও ভূমি যখন নীবীধর্মানুযায়ী দান বা বিক্রয় করা হইতেছে, তখন ইহাই বুঝানো হইতেছে যে, দত্ত বা বিক্ৰীত ভূমিই মূলধন বা মূলদ্রব্য; সেই ভূমির আয় বা উৎপাদিত ধন ভোগ বা ব্যবহার করা চলিবে, কিন্তু মূলধনটি কোনও উপায়েই নষ্ট করা চলিবে না। তাহা হইলে নীবীধর্ম কথাটি দ্বারা যাহা সূচিত হইতেছে, অক্ষয়নীবীধর্ম দ্বারা তাহাই আরও সুস্পষ্ট করিয়া বুঝাইয়া দেওয়া হইতেছে, এই অনুমান অতি সহজেই করা চলে। যে ভূমি সম্পর্কে এই শর্তের উল্লেখ আছে, সেই ভূমিই কেবল “শাশ্বতচন্দ্রার্কতারকা” ভোগ করিতে পারা যায়, ইহাও খুবই স্বাভাবিক। লিপিগুলিতেও তাঁহাই দেখিতেছি। বস্তুত যে-সব ক্ষেত্রে নীবী বা অক্ষয়নীবী ধর্মের উল্লেখ আছে, সেই-সব ক্ষেত্রে প্রায় সর্বত্রই সঙ্গে সঙ্গে শাশ্বতচন্দ্রার্কতারকা ভোগের শর্তও আছে; যে-ক্ষেত্রে নাই, যেমন বিপ্লঘোষবাট গ্রামের লিপিটিতে, সে ক্ষেত্রেও তাহা সহজেই অনুমেয়। ধনাইদহ-লিপিতে আছে, নীবীধর্মক্ষয়েণ; এ ক্ষেত্রেও ভূমি বিক্রয় করা হইতেছে মূলধন অক্ষত রাখিবার রীতি অনুযায়ী, অর্থাৎ ভোক্তা স্বেচ্ছায় ঐ ভূমি দান বিক্রয় করিয়া হস্তান্তরিত করিতে পরিবেন না, ইহাই সূচিত হইতেছে। দামোদরপুরের ৩ নং লিপিতে শর্তটি হইতেছে “অপ্ৰদাধর্মেণ”। লক্ষ্য করিবার বিষয় এই যে, এই শর্তের সঙ্গে “শাশ্বতচন্দ্রার্কতারকা” ভোগের শর্ত নাই। যাহা হউক, অনুমান হয়, এই শর্তনুযায়ী যে ভূমি বিক্রয় করা হইতেছে, সেই ভূমিও দান অথবা বিক্রয়ের অধিকার ভোক্তার ছিল না। স্বেচ্ছামত ফিরাইয়া লইবার অধিকার দাতার অথবা রাজার ছিল কি না, তাহা বুঝা যাইতেছে না। যাহা হউক, মোটামুটিভাবে নীবীধর্ম অক্ষয়নীবীধর্মও অপ্রদাধর্ম বলিতে একই শর্ত বুঝা যাইতেছে; অন্তত আমাদের লিপিগুলিতে তাহা অনুমান করিতে বাধা নাই, যদিও মনে হয়, অপ্রদাধর্মের সঙ্গে নীবী বা অক্ষয়নীবী ধর্মের সূক্ষ্ম পার্থক্য হয়তো কিছু ছিল।

একটি জিনিস একটু লক্ষ্য করা যাইতে পারে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যাইতেছে, যে ভূমি কোনও ধর্মপ্রতিষ্ঠানকে দান করা হইতেছে, সেই সম্পর্কেই শুধু অপ্ৰদাধর্ম বা অক্ষয়নীবীধর্মের উল্লেখ পাইতেছি। ইহার কারণ তো খুবই সহজবোধ্য। তাহা ছাড়া, সেই সব ক্ষেত্রেই কেবল রাজা রাজস্বের অধিকার ছাড়িয়া দিতেছেনঃ ইহাও কিছু অস্বাভাবিক নয়। ব্যতিক্রম দু-একটি আছে; কিন্তু সেই সব ক্ষেত্রেও দানের পাত্র কোনও ব্রাহ্মণ এবং তিনি দান গ্রহণ করিতেছেন কোনও ধর্মাচরণোদ্দেশ্যে। কোনও গৃহস্থ যেখানে ব্যক্তিগত ভোগের জন্য ভূমি ক্রয় অথবা দান গ্রহণ করিতেছেন, সে ক্ষেত্রে না আছে। কোনও চিরস্থায়ী শর্তের উল্লেখ, না আছে নিষ্কর করিয়া দিবার উল্লেখ।

এ-পর্যন্ত শুধু সপ্তমশতকপূর্ববতী লিপিগুলির কথাই বলিলাম। এই বিষয়ে পরবর্তী লিপিগুলির সাক্ষ্য জানা প্রয়োজন। অষ্টম হইতে আরম্ভ করিয়া ত্রয়োদশ শতক পর্যন্ত যত রাজকীয় ভূমি-দানলিপির খবর আমরা জানি, তাহার প্রত্যেকটিতেই ভূমিদানের শর্ত মোটামুটি একই প্রকার। শর্তাংশটি যে কোনও লিপি হইতে উদ্ধার করা যাইতে পারে। খালিমপুর লিপিতে আছে, “সদৃশপচারাঃ অকিঞ্চিৎপ্রগ্রাহ্যাঃ পরিহৃতসর্বপীড়াঃ ভূমিচ্ছিন্দ্ৰন্যায়েন আচন্দ্রার্কক্ষিতিসমকালং”; শ্ৰীচন্দ্রের রামপাল-লিপিতে আছে, “সদশ্যপরাধা সচৌরোদ্ধারণা পরিহাতসৰ্বপীড়া আচাটভটপ্রবেশ অকিঞ্চিৎ প্রগ্রাহ্যা। সমস্ত রাজভোগকরহিরণ্যপ্রত্যায়সাহিতা…আচন্দ্রার্কক্ষিতিসমকালং যাবৎ ভূমিচ্ছিন্দ্ৰন্যায়েন ৷” বিজয়সেনের বারাকপুর-লিপিতে আছে, “সহ্যদশাপরাধা পরিহৃতসর্বপীড়া আচট্টভট্টপ্রবেশ অকিঞ্চিৎপ্রাগ্রাহ্যা সমস্তরাজভোগকরহিরণ্যপ্রত্যায়সহিত।–আচন্দ্রার্কক্ষিতিসমকালং যাবৎ ভূমিচ্ছিন্দ্ৰন্যায়েন তাম্রশাসনীকৃত্য প্রদত্তাম্মাভিঃ ”। দেখা যাইতেছে, ধর্মপালের খালিমপুর-লিপিতে যাহা আছে, তাহাই পরবর্তী লিপিগুলিতে বিস্তৃততরভাবে ব্যাখ্যাত হইয়াছে মাত্র।

সদশপচারাঃ বা সহ্যদশাপরাধাঃ আমাদের দণ্ডশ্বাস্ত্ৰে দশ প্রকারের অপচার বা অপরাধের উল্লেখ আছে। তিনটি কায়িক অপরাধ, যথা-চুরি, হত্যা এবং পরস্ত্রীগমন; চারিটি বাচনিক অপরাধ, যথা-কটুভাষণ, অসত্যভাষণ, অপমানজনক ভাষণ এবং বস্তুহীন ভাষণ; তিনটি মানসিক অপরাধ, যথা- পরিধানে লোভ, অধর্ম চিন্তা, এবং অসত্যানুরাগ। এই দশটি অপরাধ রাজকীয় বিচারে দণ্ডনীয় ছিল; এবং সেই অপরাধ প্রমাণিত হইলে অপরাধী ব্যক্তিকে জরিমানা দিতে হইত। রাষ্ট্রের অন্যান্য আয়ের মধ্যে ইহাও অন্যতম। কিন্তু রাজা যখন ভূমি দান করিতেছেন, তখন সেই ভূমির অধিবাসীদের জরিমানা হইতে য়ে আয়, তাহা ভোগ করিবার অধিকারও দান-গ্ৰহীতাকে অৰ্পণ করিতেছেন।

সচৌরোদ্ধারণা ।৷ চোর-ডাকাতের হাত হইতে রক্ষণাবেক্ষণ করিবার দায়িত্ব হইতেছে রাজার; কিন্তু তাহার জন্য জনসাধারণকে একটা কর দিতে হইত। কিন্তু রাজা যখন ভূমি দান করিতেছেন, তখন দানগ্রহীতাকে সেই কর ভোগের অধিকার দিতেছেন।

পরিহৃতসর্বপীড়া ।৷ সৰ্বপ্রকার পীড়া বা অত্যাচার হইতে রাজা দত্ত ভূমির অধিবাসীদের মুক্তি দিতেছেন। কোনও কোনও পণ্ডিত পারিশ্রমিক না দিয়া আবশ্যিক শ্ৰম গ্রহণ করা অর্থে এই শব্দটি অনুবাদ করিয়াছেন। আমার কাছে। এ অর্থ খুব যুক্তিযুক্ত মনে হইতেছে না, যদিও বহু প্রকারের রাজকীয় পীড়া বা অত্যাচারের মধ্যে ইহাও হয়তো একপ্রকার পীড়া বা অত্যাচার ছিল, এ অনুমান করা যাইতে পারে। কিন্তু পরিহাতিসর্বপীড়াঃ বলিতে যথার্থ কী বুঝাইত, তাহার সুস্পষ্ট ও সুবিস্তৃত ব্যাখ্যা প্রতিবাসী কামরূপ রাজ্যের একাধিক লিপিতে আছে। বলবৰ্মার নওগাঁ-লিপিতে অনুরূপ প্রসঙ্গেই উল্লিখিত আছে, “রাজ্ঞীরাজপুত্ররাণকরাজবল্লভমহল্লকপ্ৰৌঢ়িকাহাস্তিবন্ধিকনৌকাবন্ধিকচৌরোদ্ধরণিকদাণ্ডিকদাণ্ডপশিক- ঔপরিকরিক ঔৎখেটিকচ্ছত্রবাসাদুপদ্রবকারিণামপ্রবেশ।”রত্নপালের প্রথম তাম্রশাসনে আছে, “হস্তিবন্ধনৌকাবন্ধচৌরোদ্ধারণদণ্ড পাশে পরিকরনোনানিমিত্তোৎখেটনহস্তাশ্বোষ্ট্রগো- মহিষাজীবিকপ্রচারপ্রভৃতিনাং বিনিবারিতসর্বপীড়া…”। কামরূপের অন্যান্য দু-একটি লিপিতেও অনুরূপ উল্লেখ দেখিতে পাওয়া যায়। তাহা হইলে সর্বপীড়া বলিতে কী কী পীড়া বা অত্যাচার বুঝায়, তাহার ব্যাখ্যা কতকটা সবিস্তারেই পাওয়া যাইতেছে। রাজ্ঞী হইতে আরম্ভ করিয়া রাজপরিবারের লোকেরা, ও রাজপুরুষেরা যখন সফরে বাহির হইতেন, তখন সঙ্গের নৌকা, হাতি, ঘোড়া, উট, গরু, মহিষের রক্ষক যাহারা তাহারা গ্রামবাসীদের ক্ষেত, ঘর-বাড়ি, মাঠ, পথ, ঘাটের উপর নৌকা এবং পশু ইত্যাদি বাধিয়া ও চরাইয়া উৎপাত অত্যাচার ইত্যাদি করিত। অপহৃত দ্রব্যের উদ্ধারকারী যাহারা, তাহারা; দাণ্ডিক ও দাণ্ডপাশিক অর্থাৎ যাহারা চোর ও অন্যান্য অপরাধীদের ধরিয়া বাধিয়া আনিত, যাহারা দণ্ড দিত, তাহারাও সময়ে অসময়ে গ্রামবাসীদের উপর অত্যাচার করিত। যাহারা প্রজাদের নিকট হইতে কর এবং অন্যান্য নানা ছোটখাটো শুল্ক আদায় করিত, তাহারাও প্রজাদের উৎপীড়ন করিতে ক্ৰটি করিত না। ইহার কার্যোপলক্ষে গ্রামে অস্থায়ী ছত্রাবাস (camp) স্থাপন করিয়া বাস করিত বলিয়া অনুমান হয়, এবং শুধু গ্রামবাসীরাই নয়, রাজা নিজেও বোধ হয়, ইহাদের উপদ্রবকারী বলিয়াই মনে করিতেন; বস্তুত রাজকীয় লিপিতেই ইহাদের উপদ্রবকারী বলিয়া উল্লেখ করা হইয়াছে। আমাদের বাঙলাদেশের লিপিগুলিতে এই-সব উপদ্রবের বিস্তারিত উল্লেখ নাই, পরিহাতিসর্বপীড়াঃ বলিয়াই শেষ করা হইয়াছে। তবে, একটি উৎপাতের উল্লেখ দৃষ্টান্তস্বরূপ করা হইয়াছে; যে ভূমি দান করা হইতেছে, বলা হইতেছে সে ভূমি আচাটভােট অথবা অচট্টভট্টপ্রবেশ, চট্টভট্টরা সেই ভূমিতে প্রবেশ করিতে পরিবে না। চাট অথবা চট্ট বলিতে খুব সম্ভব, এক ধরনের অস্থায়ী সৈনিকদের বুঝাইত বলিয়া অনুমান হয়। চাম্বা প্রদেশের কোনও কোনও লিপিতে পরগনা বা চার্যকর্তা অর্থে চাট কথাটির ব্যবহার পাওয়া যায়। ভট্ট বা ভাট কথাটি ভীড় অর্থে কেহ কেহ ব্যবহার করিয়াছেন, কিন্তু রাজার ভূত্য বা সৈনিক অর্থে কথাটি গ্রহণ করাই নিরাপদ। যাহা হউক, চট্টভট্ট দুইই রাজভৃত্য অর্থে গ্রহণ করা চলিতে পারে।

অকিঞ্চিৎপ্রগ্রাহ্য ।৷ দত্ত ভূমি হইতে আয়স্বরূপ কোনও কিছু গ্ৰহণ করিবার অধিকারও রাজা ছাড়িয়া দিতেছেন, এই শর্তটির উল্লেখ লিপিতে আছে। এই-সব অধিকারের ফলভোগী হইতেছেন দানগ্রহীতা; সেইজন্যই ইহার পর বলা হইতেছে”সমস্তরাজভাগভোগকরহিরণ্যপ্রত্যায়সহিতা’, অর্থাৎ সেই ভূমি হইতে ভাগ, ভোগ, কর, হিরণ্য ইত্যাদি যে-সব আয় আইনত রাজার অথবা রাষ্ট্রেরই ভোগ্য, সেই-সব সমেত ভূমি দান করা হইতেছে, এবং বলা হইতেছে, দানগ্রহীতা “আচন্দ্রার্কক্ষিতিসমকালং” অর্থাৎ শাশ্বত কাল পর্যন্ত সেই ভূমি ভোগ করিতে পরিবেন।

সর্বশেষ শর্ত হইতেছে ভূমিচ্ছিদ্রন্যায়েন। ভূমি দান করা হইতেছে ভূমিচ্ছিদ্র ন্যায় বা যুক্তি অনুযায়ী। এই কথাটির নানা জনে নানা ব্যাখ্যা করিয়াছেন। বৈজয়ন্তী’গ্ৰন্ত মতে যে ভূমি কর্ষণের অযোগ্য, সেই ভূমি ভূমিচ্ছিদ্র; এই অর্থে কৌটিল্যও কথাটির ব্যবহার করিয়াছেন। বৈদ্যদেবের কমৌলি-লিপিতে আছে, “ভূমিচ্ছদ্রাঞ্চ অকিঞ্চিৎকরগ্রাহ্যাম” অর্থাৎ কর্ষণের অযোগ্য ভূমির কোনও কর বা রাজস্ব নাই। কর বা রাজস্ব নাই, এই যে রীতি অর্থাৎ রাজস্ব মুক্তির রীতি অনুযায়ী যে ভূমি-দান, তাহাই ভূমিচ্ছিদ্রনায়ানুযায়ী দান, এবং লিপিগুলিতে এই শর্তেই ভূমি দান করা হইয়াছে, সমস্ত করা হইতে ভোক্তাকে মুক্তি দিয়া।

লিপিগুলির স্বরূপ বিস্তৃতভাবে উপরে ব্যাখ্যা করা হইল। সঙ্গে সঙ্গে ভূমি-দান ও ক্রয়-বিক্রয় সম্বন্ধে আমরা অনেক প্রয়োজনীয় তথ্য জানিলাম। এইবার ভূমি-সম্পর্কিত অন্যান্য সংবাদ লওয়া যাইতে পারে। ভূমি-সম্পর্কিত কী কী সংবাদ স্বভাবতই আমাদের জানিবার ঔৎসুক্য হয়, তাহার তালিকা করিয়া লইলে তথ্য নির্ধারণ সহজ হইবে বলিয়া মনে হইতেছে। নিম্নোক্ত কয়েকটি বিষয়ে জ্ঞাতব্য তথ্যের হিসাব লওয়া যাইতে পারে।

১) ভূমির প্রকারভেদ
২) ভূমির মাপ ও মূল্য
৩) ভূমির চাহিদা
৪) ভূমির সীমা-নির্দেশ
৫) ভূমির উপস্বত্ব, কর, উপরিকর ইত্যাদি।
৬) ভূমিস্বত্বাধিকারী কে? রাজার ও প্রজার অধিকার। খাস প্রজা, নিম্ন প্ৰজা ইত্যাদি।