০১. যুক্তি – ভূমি-বিন্যাস

যুক্তি – ভূমি-বিন্যাস

কৃষিপ্রধান সভ্যতায় ভূমি-ব্যবস্থা সমাজ-বিন্যাসের গোড়ার কথা। প্রাচীন বাঙলায় কৃষিই ছিল অন্যতম প্রধান ধনসম্বল। কৃষি ভূমি-নির্ভর; কাজেই ভূমি-ব্যবস্থার উপরই নির্ভর করে গ্রামের সংস্থান, শ্রেণী-বিন্যাস, রাষ্ট্র ও ব্যক্তির অথবা সমাজ ও ব্যক্তির পারস্পরিক সম্বন্ধ, বিভিন্ন প্রকারের ভূমির তারতম্য অনুসারে বিভিন্ন প্রকারের দায় ও অধিকার ইত্যাদি। সেইজন্য কৃষি-নির্ভর সমাজে জনসাধারণের ইতিহাস জানিতে হইলে ভূমি-ব্যবস্থার ইতিহাসের পরিচয় লওয়া প্রয়োজন।

প্রাচীন বাঙলার ভূমি-ব্যবস্থার এই পরিচয় অতি দুর্লভ ব্যাপার; প্রায় দুঃসাধ্য বলিলেও চলে। প্রথমত, ভূমি দান-বিক্রয় ব্যাপার উপলক্ষে যে কয়টি রাজকীয় শাসনের খবর আমাদের জানা আছে, তাহাই এ বিষয়ে আমাদের একমাত্র নির্ভরযোগ্য উপাদান। ইহা ছাড়া পরোক্ষ সংবাদ হয়তো কিছু কিছু পাওয়া যায় প্রাচীন স্মৃতিশাস্ত্র এবং অর্থশাস্ত্ৰ জাতীয় সংস্কৃত গ্রন্থাদি হইতে। কিছু উপকরণ বেদ, রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণ ও পালি জাতিক গ্রন্থাদি হইতেও সংগৃহীত হইয়াছে। কোনো কোনো পণ্ডিত এইসব উপকরণ অবলম্বন করিয়া প্রাচীন ভারতের ভূমি-ব্যবস্থা সম্বন্ধে কিছু কিছু সার্থক গবেষণাও করিয়াছেন। কেহ কেহ আবার সুবিস্তৃত এই দেশের বিস্তৃততর শাসন-লিপিবদ্ধ সংবাদ লইয়া সমগ্ৰ ভারতবর্ষের ভূমি-ব্যবস্থার পরিচয় লইতে চেষ্টা করিয়াছেন। এই উভয় চেষ্টারই মূলে একটু ত্রুটি রহিয়া গিয়াছে বলিয়া মনে হয়। স্মৃতিশাস্ত্র অথবা অর্থশাস্ত্ৰ জাতীয় গ্ৰন্থাদিতে যে সব সংবাদ পাওয়া যায় তাহা বাস্তবক্ষেত্রে কতটা প্রযোজিত হইয়াছিল, কতটা হয় নাই, সে সম্বন্ধে নিশ্চয় করিয়া বলা কঠিন। এ কথা হয়তো সহজেই অনুমান করা চলে, প্রচলিত বিধি ব্যবস্থাগুলিই এই সব গ্রন্থে লিপিবদ্ধ হইয়াছিল, অন্তত চেষ্টাটা সেই দিকেই হইয়াছিল, অথবা, বিধি ব্যবস্থাপকদের আদর্শটাকেই তাহারা রূপ দিতে চাহিয়াছিলেন। কিন্তু তখনই প্রশ্ন উঠিবে, এই সুবিস্তৃত দেশের সর্বত্রই কি একই ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল, অথবা খ্ৰীষ্টপূর্ব চতুর্থ শতকে যাহা ছিল, খ্ৰীষ্ট পরবর্তী দ্বিতীয় অথবা তৃতীয় শতকেও কি তাহাই ছিল? অথবা, যাহা ছিল আদর্শ, সর্বত্র সকল সময়ে বা কোনও কালে কোনও স্থানেই তাহা কর্মের মধ্যে রূপ লাভ করিয়াছিল কি? এই যে একটির পর একটি বিদেশী জাতি ভারতবর্ষে আসিয়া বসবাদ করিয়াছে, রাজত্ব করিয়াছে, তাহারা যদি রাষ্ট্রীয় শাসনযন্ত্রের, রাষ্ট্রাদর্শের অদলবদল করিয়া থাকিতে পারে, এবং তাহা যে করিয়াছে সে প্রমাণের অভাব নাই, তাহা হইলে ভূমি-ব্যবস্থার অদলবদল হয় নাই, সে কথা কেমন করিয়া বলা যাইবে? স্মৃতিশাস্ত্রগুলি সব একই সময়ে রচিত হয় নাই, যদিও মোটামুটি তাঁহাদের কাল আমাদের একেবারে অজ্ঞাত নয়। তাহা সত্ত্বেও ইহা তো অনস্বীকার্য যে, স্মৃতিশাস্ত্রের সমাজ-ব্যবস্থা আদর্শ সমাজ-ব্যবস্থার দিকে যতটা ইঙ্গিত করে, বাস্তব সমাজ-ব্যবস্থার দিকে ততটা নয়। সমসাময়িক সমাজ-ব্যবস্থার বাস্তব চিত্র তাহাতে প্রতিফলিত হইয়াছিল। কিনা, এ বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ আছে। আর, কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র সম্বন্ধে এ সন্দেহ যদি উত্থাপন না-ই করা যায়, তাহা হইলেও এই জিজ্ঞাসা নিশ্চয়ই করা চলে যে, ইহার সাক্ষ্যপ্রমাণ কি পরবর্তী কাল সম্বন্ধেও প্রযোজ্য? অথচ রাষ্ট্রের প্রয়োজন, ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা এবং সামাজিক দাবির প্রয়োজনে ভূমি-ব্যবস্থা যে পরিবর্তিত হয় তাহা তো একেবারে স্বতঃসিদ্ধ। স্মৃতিশাস্ত্ৰ ইত্যাদি সম্বন্ধে যে-সব কথা বলা যায়, রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণ ইত্যাদি সম্বন্ধে সে কথা তো আরও বেশি প্রযোজ্য। তাহা ছাড়া এইজাতীয় গ্রন্থের সাক্ষ্যপ্রমাণ কোনওটিই আমরা প্রাচীন বাঙলাদেশে নিঃসন্দেহে প্রয়োগ করিতে পারি না, কারণ কোনও সাক্ষ্যপ্রমাণই নির্দিষ্টভাবে বাঙলাদেশের দিকে ইঙ্গিত করে না। বাঙলার বাহিরের শাসনলিপির প্রমাণও বাঙলার ভূমি-ব্যবস্থার পরিচয়ে ব্যবহার করা চলে না, যদিও সে চেষ্টা পণ্ডিতদের মধ্যে হইয়াছে। চোখের সম্মুখেই আমরা দেখিতেছি, মান্দ্ৰাজে অথবা ওড়িশায়, আসামে অথবা গুজরাতে যে ভূমি-ব্যবস্থা আজ প্রচলিত, বাঙলাদেশের সঙ্গে তাহার কোনও যোগ নাই। বস্তুত, বর্তমান কালে এক প্রদেশের ভূমি ব্যবস্থা হইতে অন্য প্রদেশের ভূমি ব্যবস্থা বিভিন্ন। প্রাচীনকালেও এই বিভিন্নতা ছিল না, তাহা নিশ্চয় করিয়া বলা যায় কি? ভূমির শ্রেণীবিভাগ নির্ভর করে প্রাকৃতিক পরিবেশের উপর; ভাগ, ভোগ, কর ইত্যাদি নির্ভর করে ভূমিলব্ধ আয়ের উপর, সে আয়ের তারতম্য ভূমির প্রকৃতির উপর নির্ভর করে। তাহা ছাড়া, সবচেয়ে যাহা বড় কথা, ভূমির উপর অধিকার এবং সে অধিকারের স্বরূপ, তাহাও এই সুবিস্তৃত দেশে বিভিন্ন কালে একই প্রকার ছিল, এই অনুমানই বা কী করিয়া করা যায়? যে জাতীয় গ্রন্থের উল্লেখ আগে করা হইয়াছে, এইসব গ্রন্থ প্রায় সমস্তই ব্ৰাহ্মণ্য আদর্শের দ্বারা শাসিত সমাজের সৃষ্টি; কিন্তু এই সমাজের বাহিরে অনার্য, আর্য-পূর্ব সমাজ ও সেই সমাজের অগণিত লোক আমাদের দেশে বাস করিত; “শিষ্টদেশ-বহির্ভূত এই বাঙলাদেশে তাহাদের সংখ্যা ও প্রভাব কম ছিল না। আমাদের ধর্ম, ধ্যান ধারণা, আচার ব্যবহার, সমাজ-ব্যবস্থা ইত্যাদিতে এখনও সেইসব প্রভাব লক্ষ করা যায়। আমাদের ভূমি-ব্যবস্থায় সেই প্রভাব পড়ে নাই, এ কথা কে বলিবে? সেই প্রভাব ভারতবর্ষের সর্বত্র এক ছিল না। আর্য সভ্যতার কেন্দ্ৰস্থল বর্তমান যুক্তপ্রদেশে এই প্রভাবকে ঠেকাইয়া রাখা হয়তো সম্ভব হইয়াছিল, কিন্তু বাঙলাদেশে তাহা হইয়াছিল কি? পিতৃপ্রধান আর্য সমাজসংস্থান এবং মাতৃপ্রধান আর্য-পূর্ব অথবা অনার্য সমাজসংস্থানে ভূমি-ব্যবস্থার তারতম্য থাকিতে বাধা; এবং এই তারতম্য প্রাচীন ভারতের ভূমি-ব্যবস্থাকে বিভিন্ন দেশখণ্ডে বিভিন্নভাবে রূপ দান করে নাই, এ কথা নিশ্চয় করিয়া বলা যায় কি? এইসব কারণে কেবলমাত্র পূর্বোক্ত গ্রন্থগুলি অবলম্বনে ভূমি-ব্যবস্থার ইতিহাস রচনা করা খুব যুক্তিযুক্ত বলিয়া মনে হয় না। বিশেষভাবে, প্রাচীন বাঙলার ভূমি-ব্যবস্থার পরিচয়ে এই জাতীয় উপাদানের উপর কিছুতেই সম্পূর্ণ নির্ভর করা চলে না।

অন্যক্ষেত্রে যেমন এ ক্ষেত্রেও তেমনই, এই ভূমি-ব্যবস্থার পরিচয়ে আমি আমাদের প্রাচীন ভূমিদানি-বিক্রয় সম্বন্ধীয় তাম্র-পট্টোলীগুলিকেই নির্ভরযোগ্য উপাদান বলিয়া মনে করি। প্রথমত, ইহাদের সাক্ষ্যপ্রমাণ সম্বন্ধে অবাস্তবতার আপত্তি তুলিবার উপায় নাই; বস্তুত, যাহা প্রচলিত ছিল, যে রীতি ও পদ্ধতি যখন অনুসৃত হইত, তাহাই যথাযথভাবে এই পট্টোলীগুলিতে লিপিবদ্ধ হইয়াছে। দ্বিতীয়ত, ইহাদের উৎস ও কালনির্দেশ সম্বন্ধে কোনও অনিশ্চয়তা নাই। অবশ্য এ কথা সত্য যে, ভূমি-ব্যবস্থা সম্বন্ধে যে-সব সংবাদ জানা একান্তই প্রয়োজন তাহার সম্পূর্ণ পরিচয় এইসব উপাদানে পাওয়া যায় না। কিন্তু যাহা যতটুকু পাওয়া যায়, যতটুকু বুঝা যায়, ততটুকুই মূল্যবান ও নির্ভরযোগ্য; যাহা পাওয়া যায় না, তাহা লইয়া অভিযোগ করা চলে, কিন্তু কল্পনার হায্যে পূরণ করা যুক্তিযুক্ত বলিয়া মনে হয় না। অবশ্য বুদ্ধিসাধ্য, যুক্তিসাধ্য অনুমানে বাধা নাই, যতক্ষণ সে অনুমান সমাজ-বিবর্তনের সাধারণ ইতিহাস-সম্মত নিয়ম, সমসাময়িক সমাজ-ব্যবস্থার ইঙ্গিত অতিক্রম করিয়া না যায়। তাহা ছাড়া, এইসব প্রত্যক্ষ সাক্ষ্যপ্রমাণের মধ্যে এমন কিছু কিছু ইঙ্গিত আছে, যাহা খুব সুবোধ্য নয়; এমন সব শব্দ ও পদের ব্যবহার আছে যাহা সমসাময়িককালে নিশ্চয়ই খুব সহজবোধ্য ছিল, কিন্তু আমাদের কাছে এখন আর তেমন নয়। এইসব ক্ষেত্রে স্মৃতিশাস্ত্ৰ, অৰ্থশাস্ত্র জাতীয় উপাদানের সাহায্য লওয়া যাইতে পারে, আমিও লইয়াছি; তাহার একমাত্র কারণ, এইসব গ্রন্থে পূর্বোক্ত শব্দ বা পদের বা দুর্বোধ্য ও কষ্টবোধ্য রীতি-পদ্ধতিগুলির সুবোধ্য ও বিস্তৃততর ব্যাখ্যা অনেক সময় পাওয়া যায়।