০৭. সংযোজন – ধন-সম্বল

সংযোজন – ধন-সম্বল

মুদ্রায় সামাজিক ধনের রূপ

প্রাচীন বাঙলায় মুদ্রায় সামাজিক ধনের রূপ কি ভাবে ধরা পড়েছিল, এ-সম্বন্ধে নূতন কিছু তথ্য ইতোমধ্যে জানা গেছে, কিছু প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখনন ও অনুসন্ধানের ফলে, কিছু নূতন আলোচনা-বিশ্লেষণের ফলে। এ বিষয়ে আমাদের জ্ঞান এখন কিছুটা স্পষ্টতর। সংক্ষেপে এই স্পষ্টতর রূপটির একটু পরিচয় নেওয়া প্রয়োজন।

রাষ্ট্রগঠনের অল্পবিস্তর সার্থক প্রয়াস ও ব্যাবসা-বাণিজ্যের অল্পবিস্তর বিস্তার ছাড়া মুদ্রা-প্রচলনের প্রয়োজন সাধারণত হয় না; অন্তত ভারতবর্ষের ইতিহাসে তেমন প্রমাণ নেই, তা শীলমোহর মুদ্রিত (Punch-marked) মুদ্ৰাই হোক আর তঙ্কশালার ঢালাই করা (cast) মুদ্রাই হোক। শুধু স্থানীয় হাটবাজারের কেনা-বেচার ব্যাপারেই নয়, বহির্বাণিজ্যের ব্যাপারেও দ্রব্য-বিনিময়ে (exchange by barter) ব্যাবসা-বাণিজ্য চালানো যায়, ইতিহাসে এমন দৃষ্টান্ত দুর্লভ নয়। তবে, যে-সমাজে ব্যাবসা-বাণিজ্যিক ব্যাপারে রাষ্ট্রের বা বণিক গোষ্ঠীর (guild) অধিকার স্বীকৃত ও প্রতিষ্ঠিত, অন্যার্থে সমাজ ও রাষ্ট্রের দিক থেকে যে-সমাজ অর্থনৈতিক ব্যাপারে যত বেশি সুবিন্যস্ত ও সুনিয়ন্ত্রিত, সে-সমাজে মুদ্রার প্রচলন তত বেশি। অর্থাৎ,

মুদ্রা-বিনিময়-নির্ভর অর্থনৈতিক জীবনকে সভ্যতার অন্যতম দ্যোতক বলে মনে করা হয়। বাঙলাদেশে প্রাচীনতম ধাতুর (তামা) মুদ্রা পাওয়া গেছে। প্রত্নোৎখনন বা প্রত্নানুসন্ধানের ফলে, উত্তরবঙ্গের মহাস্থান (বগুড়া জেলা) ও বাণগড়ে (দিনাজপুর জেলা), আর পাওয়া গেছে নিম্নগাঙ্গেয় দক্ষিণবঙ্গের তমলুক (মেদিনীপুর) ও চন্দ্ৰকেতুগড়ে (২৪ পরগনা)। উভয় অঞ্চলেই শীলমোহর-মুদ্রিত এবং ঢালাই করা, দু’রকমের মুদ্রাই পাওয়া গেছে। প্রত্নখননের সংস্তরের (stratification) সর্বত্র খুব সুস্পষ্ট ও সুনির্ধারিত নয়, তবু মোটামুটি বলা চলে, ঢালাই-মুদ্রা থেকে শীলমোহরিত মুদ্রা প্রাচীনতর এবং এই মুদ্রার প্রচলন বহুদিন অব্যাহত ছিল। গাঙ্গেয় উত্তরভারতে যে-সব জায়গায় এই দুই জাতীয় মুদ্রাই পাওয়া গেছে, সে-সব জায়গায়, যেমন, হস্তিনাপুরে, দিল্লীর পুরানো কেল্লায়, কৌশাম্বীতে, উজ্জয়িনীতে, এই দুই মুদ্রার প্রচলন শুরু হয়। (একমাত্র প্রমাণ, প্রত্ন-সংস্তরের সাক্ষ্য) মোটামুটি খ্ৰীষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দী থেকে। প্রাচীন বাঙলায় তা হয়েছিল বলে মনে হয় না। বস্তুত প্রত্নসংস্তরের সাক্ষ্য থেকে এই দুই জাতীয় মুদ্রারই প্রচলন শুরু খ্ৰীষ্টপূর্ব মোটামুটি ৩২৫-৩০০-র আগে হয়েছিল বলে অনুমান করবার কোনও কারণ নেই। অন্যতর সাক্ষ্যের ইঙ্গিতও একই। মহাস্থানে মৌর্য-ব্রাহ্মী অক্ষরে লেখা যে ভগ্নাংশ-লিপিটি পাওয়া গেছে তাতে দুই মূল্যের দুটি মুদ্রার উল্লেখ আছে, একটি গণ্ডক, আর একটি কাকনিক (= অর্থশাস্ত্রোক্ত কাকনিকা)। এই মুদ্রা দুটির স্বরূপ কী ছিল জানবার উপায় নেই। এ দুটি কি ধাতুমুদ্রা না। আর কিছু, তা-ও নিশ্চয় করে বলবার উপায় নেই। শুধু এইটুকু আমাদের জানা আছে, বাঙলাদেশে কিছুদিন আগেও প্রচলিত ছিল চার কড়িতে এক গণ্ডা, আর কৌটিল্য ও অন্যান্য সাক্ষ্য থেকে বলা যায়, এক কাকনিক ছিল বিশ কড়ির সমান মূল্য। এই একান্ত ঐতিহ্যবাহিত, পরম্পরাগত আর্যগণনা থেকে হয়তো বলা যায়, প্রাচীন বাঙলায় কড়িই ছিল নিম্নতম দ্রব্যমূল্যমান,* এবং সেই মান দ্বারাই নির্ণীত হতো উচ্চতর মুদ্রামান। আমার নিজের ধারণা, গণ্ডক ছিল শীলমোহরিত নিম্নতম মুদ্রা, আর কাকনিক ছিল ঢালাই করা তাঙ্কশালার মুদ্রা। অনুমান করা চলে, মৌর্য আমল থেকে শুরু করে বেশ-কিছুকাল এই দুই মুদ্রারই প্রচলন ছিল বাঙলাদেশে। খ্ৰীষ্টীয় প্রথম শতাব্দীর তৃতীয়পদে অজ্ঞাতনামা গ্ৰীক গ্রন্থকারের লেখা Periplus গ্রন্থে বলা হয়েছে, দক্ষিণতম বঙ্গের গঙ্গা (Ganga) বন্দরে সমসাময়িক কালে Caltis নামে এক সুবৰ্ণমুদ্রার প্রচলন ছিল। এই উক্তির ঐতিহাসিক যাথার্থ কতটুকু, বলা কঠিন। বাঙলাদেশে এই সময়ে সুবর্ণমুদ্রার প্রচলন ব্যাখ্যা করা একটু মুশকিল। তবে, এমন হতে পারে, কেউ কেউ তা বলেওছেন, এই Calitis। কুষাণ সম্রাটদের প্রচলিত সুবর্ণমুদ্রা। কুষাণেরা যে এই সময় বারাণসী পর্যন্ত তাদের সাম্রাজ্য বিস্তার করেছিলেন, এবং তাদের আধিপত্যের প্রভাব যে পূর্বভারতেও বিস্তৃতিলাভ করেছিল, এ-সম্বন্ধে অন্য সাক্ষ্যপ্রমাণও বিদ্যমান।

প্রত্নসাক্ষ্যই হোক বা লিপি বা প্রাচীনগ্রন্থ-সাক্ষ্যই হোক, মুদ্রা প্রচলনের যত প্রমাণ প্রাচীন বাঙলায় পাওয়া যাচ্ছে, তা হয় উত্তরবঙ্গ (বগুড়া, দিনাজপুর) থেকে না-হয় নিম্নগাঙ্গেয় দক্ষিণবঙ্গ থেকে। এতে বিস্মিত হবার কিছু নেই। নানা প্রসঙ্গে এই গ্রন্থের নানা জায়গায় বলা হয়েছে, কী করে ইতিহাসের সূচনা থেকেই বাঙলার ভাগ্য নির্ণীত হয়েছে মধ্য-গাঙ্গেয় উত্তর-ভারতের ইতিহাসদ্বারা, কী করে সেখানকার ঘটনার ঘাত-প্রতিঘাত, অবস্থার ধ্বনি-প্রতিধ্বনি বাঙলা দেশে এসে ঢেউ তুলেছে এবং তার ফলে এ দেশের সভ্যতা ও সংস্কৃতি ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছে। মুদ্রা-প্রসঙ্গে যে-সময়ের কথা বলা হচ্ছে সে-সময়ে এবং তার অনেক পরেও মধ্য-গাঙ্গেয় ভারতের জীবন-প্রবাহের পূর্বর্যাত্রার পথ ছিল প্রধানত দুটি : একটি পাটলিপুত্রে গঙ্গা পার হয়ে উত্তর-বিহারের চম্পা থেকে সোজা উত্তর-বঙ্গের ভেতর দিয়ে ব্ৰহ্মপুত্রের পূর্বতীরবর্তী কামরূপ পর্যন্ত; আর আর-একটি রাজমহলে গঙ্গার সঙ্গে সঙ্গে বাঙলাদেশে ঢুকে নদীর দুই তীর ধরে ধরে একবারে সাগর মোহনা পর্যন্ত। দুটি পথই প্রাচীন ব্যাবসা-বাণিজ্যের পথ, উত্তর-ভারতীয় সংস্কৃতির পূর্বাভিযানের পথ। প্রথম পথের উপর মহাস্থান, কোটিবর্ষ (বাণগড়); দ্বিতীয় পথের শেষ প্রান্তে, সাগরতীরে তাম্রলিপ্ত, গঙ্গাবিন্দর, চন্দ্ৰকেতুগড়। মীের্যবংশ প্রতিষ্ঠার আগেও এই পথ-দুটির অস্তিত্ব ছিল; লোকজনের আসা-যাওয়া, ব্যাবসা-বাণিজ্যও চলত পথ দুটি ধরে। প্রাচীন বৌদ্ধ ও জৈন গ্রন্থে তার আভাস-ইঙ্গিত একেবারে অপ্রতুল নয়। কিন্তু খ্ৰীষ্টপূর্ব ৩০০-র আগে মুদ্রার প্রচলন ছিল এ-সব অঞ্চলে, এমন মনে হয় না; প্রয়োজনও বোধহয় ছিল না। তার প্রধান কারণ বোধহয়, তার আগে ভারতের পূর্বাঞ্চলে রাষ্ট্র গঠনের কোনও সার্থক প্রয়াস দেখা দেয়নি। সে-প্রয়াসের প্রথম ইঙ্গিত, গ্ৰীক ঐতিহাসিককুল-কথিত Prasioi) ও Gangaridae রাষ্ট্র দুটি। দ্বিতীয় ইঙ্গিত, বাঙলাদেশে মৌর্যরাষ্ট্রের বা অন্তত মৌর্য রাষ্ট্ৰীয় প্রভাবের সক্রিয় অনুপ্রবেশ। আমার এ-ব্যাখ্যা যুক্তিসিদ্ধ মনে হলে স্বীকার করতে হয়, শীলমোহরিত মুদ্রা বা তঙ্কশালা-নিৰ্গত ঢালাই মুদ্ৰাই হোক, গণ্ডক বা কাকনিক মুদ্ৰাইহোক, অথবা ক্যালটিস স্বর্ণমুদ্ৰাই হোক, প্রাচীনতম বঙ্গের কোনও মুদ্ৰাই মোটামুটি খ্ৰীষ্টপূর্ব ৩০০-র আগে নয়, এবং সে মুদ্রা মধ্য-গাঙ্গেয় উত্তর-ভারতের প্রতিধ্বনি মাত্র।

মৌর্য আমলের পর থেকে শুরু করে গুপ্তপর্ব সূচনার আগে পর্যন্ত, এই দীর্ঘকালের মধ্যে প্রাচীন বঙ্গে কী ধরনের মুদ্রা প্রচলিত ছিল তা জানিবার কোনও উপায় নেই। তবে দেশের নানা জায়গায় প্রচুর কুষাণ মুদ্রা পাওয়া গেছে; মনে হয়, কুষাণ আমলে, এবং হয়তো তার পরেও উত্তর-ভারতের সঙ্গে ব্যাবসা-বাণিজ্যের সূত্রে এইসব মুদ্রা কিছু কিছু এই অঞ্চলেও প্রচলিত হয়েছিল। উত্তর-ভারতের অন্যান্য মুদ্রাও এই সময়ে অল্পবিস্তর প্রচলিত হয়েছিল, এমন প্রমাণও পাওয়া গেছে। সন্দেহ নেই যে, ব্যাবসা-বাণিজ্য সূত্রেই তা হয়েছিল। কিন্তু কুষাণ মুদ্রাই হোক বা উত্তর-ভারতীয় অন্যান্য মুদ্রাই হোক, এই সব মুদ্রার সঙ্গে স্থানীয় কেনাবেচার জন্য প্রচলিত পূর্বতন কড়ি, গণ্ডক, কাকনিক, শীলমােহরিত ও তঙ্কশালা-নিৰ্গত প্রভৃতি মুদ্রার সম্বন্ধ কী ছিল এবং স্থানীয় দ্রব্যমূল্যের সঙ্গেই বা কী সম্বন্ধ ছিল এ-সম্বন্ধে কিছু বলবার কোনও উপায়ই আজও আমরা জানিনে।

গুপ্ত ও গুপ্ত-পরবর্তী আমলে প্রাচীন বাঙলায় প্রচলিত মুদ্রা সম্বন্ধে মূল গ্রন্থে সবিস্তারে প্রচুর কথা বলা হয়েছে। তারপর গত পঁচিশ বছরের ভেতর বেশ-কিয়েকজন পণ্ডিত এ-সম্বন্ধে বেশকিছু আলোচনা গবেষণা করেছেন, কিন্তু তার ভেতর না তথ্যের দিক থেকে না ব্যাখ্যার দিক থেকে আমি এমন-কিছু পেয়েছি যা এই সংযোজনে উল্লেখ করতে পারি। মুদ্রার সঙ্গে ব্যাবসা-বাণিজ্যের, বিশেষভাবে বৈদেশিক বাণিজ্যের সম্বন্ধের প্রসঙ্গটি বোধহয় আমিই প্রথম উত্থাপন করেছিলাম, এবং সেইসঙ্গে কয়েকটি প্রশ্নেরও উল্লেখ করেছিলাম। সদ্যোক্ত আলোচনা-গবেষণায় সৌভাগ্যত প্রসঙ্গটির স্বীকৃতির অন্তত লক্ষ্য করেছি, কিন্তু প্রশ্নগুলির উত্তরের চেষ্টা লক্ষ্য করি নি। যে-ভাবে আমি প্রশ্নগুলি উত্থাপন করেছিলাম, আমার ইতিহাসগত উত্তর তার মধ্যেই নিহিত আছে, বেশকিছুটা স্পষ্টভাবেই। পঁচিশ বছরের আলোচনা -গবেষণায় এমন-কিছু আমি পাইনি যাতে আমার মতামত পরিবর্তনের প্রয়োজন বোধ করতে পারি। তবে, একটি আবিষ্কার ইতোমধ্যে ঘটেছে যা অর্থবহ এবং যার উল্লেখ ও আলোচনা অপরিহার্য। কুমিল্লা জেলার ময়নামতীর উৎখননের ফলে কয়েকটি স্বর্ণ ও রৌপ্যমুদ্রার মজুত ভাণ্ডার (hoard) আবিষ্কৃত হয়েছে। দুঃখের বিষয়, প্রত্নোৎখননের কোন সংস্তর থেকে কোন ভাণ্ডারটি পাওয়া গেছে, কীভাবে পাওয়া গেছে, প্রকাশিত বিবরণে তা খুব পরিষ্কার নয়; বস্তুত সংস্তরণ ক্রিয়াটিই যেন খুব সুস্পষ্টতায় করা হয় নি। তাছাড়া, এই মুদ্রগুলির বিশদ বিবরণ এবং আলোচনাও এ-যাবৎ প্রকাশিত হয় নি; সংক্ষিপ্তভাবে যা হয়েছে তা থেকে কিছু কিছু মন্তব্য মাত্র করা যেতে পারে। বলা উচিত, মুদ্রগুলি দেখবার সুযোগ আমার হয় নি।

প্রকাশিত বিবরণ থেকে মনে হয়, মুদ্রগুলিকে দু ভাগে ভাগ করা যায়। প্রথম ভাগে পড়ে সুবৰ্ণমুদ্রগুলি যার সঙ্গে গুপ্তোত্তর বাঙলায় প্রচলিত অপেক্ষাকৃত পাতলা ওজনের ‘নকল’ স্বর্ণমুদ্রার কোনও পার্থক্য নেই বললেই চলে; এ-ধরনের মুদ্রা সপ্তম শতকের শেষ পর্যন্তও প্রচলিত ছিল। এই মুদ্রগুলির একদিকের বামপাশে দণ্ডায়মান একটি নারীমূর্তি, আর একদিকে একটি উপবিষ্ট অথবা দণ্ডায়মান নরমূর্তি, খুব সম্ভব, যথাক্রমে রাজা ও রানীর, অথবা রাজা ও শ্ৰী বা লক্ষ্মীর। অনেকগুলি মুদ্রার একদিকে, গুপ্তমুদ্রার অনুকরণে, দণ্ডায়মান মূর্তির বাম হাতের নীচে ছোট এক লাইন একটি লেখ। এই লেখগুলির পাঠোদ্ধার এখনও হয় নি, তবে একটি মুদ্রায় যে “বলভট’ বলে একটি ব্যক্তিনাম লেখা আছে, সে-সম্বন্ধে কোনও সন্দেহ নেই – আর একটিতে যা লেখা আছে তা পড়া হয়েছে “ভঙ্গল মৃগাঙ্কস্য’ বলে; পড়েছেন ময়নামতীর বিবরণ লেখক এফ. এ. খান, প্রধানত দেববংশীয় রাজাদের শীলমোহর ও তাম্রশাসনোৎকীর্ণ “শ্ৰীভঙ্গল মৃগাঙ্ক”-লাঞ্ছনটি অনুসরণ করে। দীনেশচন্দ্র সরকার মশায় মনে করেন, এই পাঠ যথার্থ নয়, শুদ্ধ পাঠ হওয়া উচিত ‘অভিনব মৃগাঙ্কস্য’, যেহেতু দেববংশীয় রাজা ভবদেবের শীলমোহর ও তাম্রশাসনে যা লেখা আছে তার পাঠ “শ্ৰীঅভিনব মৃগাঙ্ক”। যাই হোক, সন্দেহ নেই, দক্ষিণ-পূর্ববাঙলায় এই ‘নিকল, গুপ্তোত্তর সুবর্ণমুদ্রার প্রচলন হয়েছিল দেববংশের রাজত্বের আমলে, অষ্টম শতকে।

আর-এক পর্যায়ের মুদ্রা ময়নামতীতে পাওয়া গেছে, অধিকাংশই রৌপ্যমুদ্রা, সংখ্যায়। সুপ্রচুর ওজনে খুব হালকা, এবং বোধ হয় একাধিক মূল্যমানের। যত মুদ্রা পাওয়া গেছে সবই প্রকৃতিতে এতই একই রকমের যে এর ভেতর কোনও ক্রমবিবর্তন-বিবর্ধন নেই বললেই চলে, অর্থাৎ কালের কোনও চিহ্ন যেন এগুলির উপর মুদ্রিত নেই। এই মুদ্রগুলির একদিকে আছে একটি বিন্দুবলয়চক্ৰ, তার ভেতরে একটি রেখাচক্ৰ; আর বাঁ দিক ঘেষে আছে একটি উপবিষ্ট বৃষমূর্তি। অন্য দিকে আছে দুটি বৃত্ত, বাইরে রেখাবৃত্ত, ভেতরে বিন্দুবৃত্ত। এফ. এ. খান এই রেখা ও বিন্দুবৃত্ত-অলংকৃত লাঞ্ছনটিকে ত্রিরত্ন কেন বলেছেন, বোঝা দুষ্কর। কতকগুলি মুদ্রার একদিকে একটি ছোট লেখ আছে; লেখটিকে কেউ কেউ পড়েছেন ‘পটিকোৰ্য বলে, কেউ কেউ পড়েছেন ‘পট্টিকের বলে। আবার অন্য কতকগুলি মুদ্রায় যে লেখাটি আছে সেটিকে “হরিকেল বলে পড়া চলে। বুঝতে কষ্ট হয় না, মুদ্রগুলি যথাক্রমে পট্টিকের ও হরিকেলের তঙ্কশালায় মুদ্রিত ও সেখান থেকে নিৰ্গত হয়েছিল। কতগুলি মুদ্রার উল্টেপিঠে “ধর্মবিজয়’, কতগুলির উল্টেপিঠে “ললিতকরঃ’ বলে ছোট একটি লেখ আছে; ধর্মবিজয় ও ললিতকর বোধ হয় ব্যক্তিনাম বা উপাধি, হয় স্থানীয় শাসনকর্তার বা তাঙ্কশালার অধিকর্তার। আমার ব্যক্তিগত ধারণা, এই রৌপ্যমুদ্রগুলি প্রায় সবই দক্ষিণ-পূর্ববঙ্গের চন্দ্ৰবংশীয় রাজাদের রাজত্বকালের (দশম-একাদশ শতাব্দী)। পট্টিকের ও হরিকেল দুইই এদের রাজ্যভুক্ত ছিল। মুদ্রগুলিতে যে লেখ আছে তার অক্ষর সাক্ষ্য আমার এ-ধারণার প্রতিকূল নয়। কিন্তু আমার এই ধারণার অন্য কারণও আছে। এ-তথ্য সুবিদিত যে, আরাকানে এক চন্দ্ৰবংশীয় রাজাদের রাজত্ব খ্ৰীষ্টীয় অষ্টম শতাব্দী কি তারও আগে থেকে শুরু করে অন্তত একাদশ শতাব্দীর মধ্যপাদ পর্যন্ত অক্ষুন্ন ছিল। সেই সময় পাগান-রাজ আনাউরহথা (১০৪৪-১০৭৭) উত্তর আরাকান জয় ও অধিকার করেন, যার ফলে র্তার রাজ্যের পশ্চিম সীমা পট্টিকের পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। এই চন্দ্রবংশীয় রাজাদের শঙ্খ, বৃষ, অংকুশ, চামর, শ্ৰীবৎসচিহ্ন প্রভৃতি লাঞ্ছিত এবং রেখা ও বিন্দুচক্রালংকৃত প্রচুর রৌপ্যমুদ্রা পাওয়া গেছে। এই মুদ্রগুলির মধ্যে যেগুলি প্রাচীনতর। সেগুলির সঙ্গে প্রাচীন ফুনান, দ্বারবতী, এবং প্রাচীন পুত্ব ও মোন রাজাদের অন্যান্য রাজধানীতে প্রাপ্ত মুদ্রার আত্মীয়তা অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। কিন্তু যে মুদ্রগুলি পরবতী কালের (সেগুলি সংখ্যায় কিছু কম নয়), সেগুলির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ আত্মীয়তা লালমাই-ময়নামতীতে পাওয়া রৌপ্যমুদ্রগুলির সঙ্গে; বৃষ লাঞ্ছন এবং রেখা ও বিন্দুচক্রালংকার প্রায় একই রকমের। আরাকানের চন্দ্ৰবংশীয় রাজাদের রাজধানী প্রাচীন বৈশালীতে প্রাপ্ত বহু বৌদ্ধ ও ব্রাহ্মণ্য প্রতিমার সঙ্গে ময়নামতীর সাম্প্রতিক উৎখনন থেকে প্রাপ্ত প্রতিমার অনেকগুলির সঙ্গে আশ্চর্য মিল; উভয়ক্ষেত্রেই শৈলসাক্ষ্যের ইঙ্গিতে প্রতিমাগুলির তারিখ মোটামুটি দশম শতাব্দী।

কিন্তু মুদ্রায় সামাজিক ধনের রূপ প্রসঙ্গে আলোচ্য বিষয়ে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হচ্ছে লালমাই-ময়নামতীতে পাওয়া রৌপ্যমুদ্রগুলির রূপা ধাতুটি এল কোথা থেকে।- গুপ্তোত্তর ‘নকল’ ও হালকা ওজনের, খাদ মেশানো সুবর্ণমুদ্রার সোনা নিয়ে বড় কিছু প্রশ্ন নেই; শশাঙ্কের আমল থেকে তো এই প্রকৃতির সুবর্ণমুদ্রাই বাঙলা দেশে অষ্টম শতাব্দী পর্যন্ত প্রচলিত। এই সোনা প্রাচীনতর, ওজনে ভারী, প্রায় নিখাদ সুবর্ণমুদ্রা থেকে অথবা সোনার তাল গলিয়ে পাওয়া সোনা। কিন্তু প্রাচীন বাঙলায় রূপা এত সহজলভ্য ছিল না। এই প্রসঙ্গে মূল গ্রন্থমধ্যেই বলা হয়েছে, কিছু বিস্তৃতভাবেই গুপ্ত আমলে এবং পরে পাল আমলে রৌপ্যমুদ্রা প্রচলনের কথা। সেই প্রসঙ্গেই উল্লেখ করেছিলাম। বৈগ্রাম-পট্টোলী কথিত রূপক মুদ্রার কথা, স্বর্ণ ও রৌপ্যমুদ্রার আপেক্ষিক মূল্য-সম্বন্ধের কথা, রৌপ্যের অপ্রতুলতার কথা, এবং শেষ পর্যন্ত রৌপ্যমুদ্রার একান্ত অনস্তিত্বের কথা। পাল আমলে যে কিছুটা চেষ্টা হয়েছিল রৌপ্যমুদ্রার পুনঃপ্রচলনের এবং সে চেষ্টা যে সার্থক হয়নি, সে কথাও বলেছিলাম। আজও এ কথা সত্য। কিন্তু এতে বিস্মিত হবার কারণ নেই। রৌপ্য বিদেশাগত; যে কারণেই হোক, দেশে রূপার আমদানি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। সুতরাং রৌপ্যমুদ্রাও অপ্রচলিত হয়ে যায়; পাল আমলের রৌপ্যমুদ্রা তো অত্যন্ত নিকৃষ্ট পর্যায়ের। সে রূপা পূর্বতন রৌপ্যমুদ্রা থেকে পাওয়া। আমার ধারণা, গুপ্তপর্বেই রূপার অপ্রতুলতা ঘটতে শুরু হয়; বস্তুত (প্রথম) কুমারগুপ্তের পর রৌপ্যমুদ্রার আর উল্লেখও নেই। বৈদেশিক বাণিজ্যে যে সব ভারতীয় তথা বাঙালী বণিকেরা লিপ্ত হতেন তারা দ্রব্য বিনিময়ে সোনা ছাড়া, সুবর্ণমুদ্রা ছাড়া আর কোনও ধাতু বা ধাতুমুদ্রা নিতে চাইতেন না; দ্বিতীয় শতাব্দীর প্লিনি এবং নবম-একাদশ শতাব্দীর আরব বণিকদের সাক্ষ্য থেকে ভারতীয় বণিকদের এই অপরূপ স্বর্ণপ্ৰিয়তার অল্পবিস্তর ইঙ্গিত পাওয়া যায়। সুতরাং রূপা দুর্লভ বস্তু হবে, আপেক্ষিকতায় সোনার চেয়ে রূপার দাম হবে বেশি, এতে বিস্মিত হবার কিছু নেই।

তাহলে লালমাই-ময়নামতীতে প্রাপ্ত সুপ্রচুর রৌপ্যমুদ্রার, যত হালকা ওজনেরই হোক, রূপা এল কোথা থেকে? আমার উত্তর সংক্ষিপ্ত এ রূপা এসেছে আরাকান থেকে, বৰ্মা ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াজাত রূপা। আরাকানের সঙ্গে ময়নামতীর ঘনিষ্ঠ বাণিজ্য সম্বন্ধ ছিল, এ-অনুমানের যথেষ্ট কারণ বিদ্যমান, এবং সেই বাণিজ্যাশ্রয়েই প্রাচীন আরাকানে বৌদ্ধ ও ব্রাহ্মণ্য ধর্ম ও সংস্কৃতির বিস্তার। লালমাই-ময়নামতীর পট্টিকের নগর ও রাজ্য সেই বাণিজ্য, ধর্ম ও সংস্কৃতির উৎস এবং তা অন্তত সপ্তম-অষ্টম শতাব্দী থেকেই।

——————–

* কড়ি সামুদ্রিক দ্রব্য; উত্তর বঙ্গোপসাগরে এ দ্রব্য কোথাও পাওয়া যায় না। সুতরাং প্রাচীন বঙ্গে কড়ি বাণিজ্যিক দ্রব্য, বাইরে থেকে মূল্য দিয়ে আমদানি করতে হতো। মধ্যযুগীয় বাঙালীর সাহিত্যে, এমন-কি ব্যাবসা-বাণিজ্যে কড়ির স্থান সম্বন্ধে গ্রন্থমধ্যে ইতিপূর্বেই বলা হয়েছে, একাধিক জায়গায়।

[পাঠ-পঞ্জি : Khan, F. A., Mainamati, Karachi, 1963; Chattopadhyaya, B.D., “Currency in Early Bengal”, in Journal of Indian History, December, 1977.]