০৪. শিল্পজাত দ্রব্যাদি : বস্ত্ৰশিল্প

শিল্পজাত দ্রব্যাদি : বস্ত্ৰশিল্প

বাঙলার শিল্পজাত দ্রব্যাদির কথা বলিতে গিয়া প্রথমেই বলিতে হয় বস্ত্রশিল্পের কথা। বাঙলাদেশের বস্ত্রশিল্পের খ্যাতি শ্ৰীস্টের জন্মের বহু পূর্বেই দেশে-বিদেশে ছড়াইয়া পড়িয়াছিল, এবং ইহাই যে এ দেশের প্রধান শিল্প ছিল, তাহার প্রমাণ পাওয়া যায় কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্ৰে, Periplus of Erythrean Sea নামক গ্রন্থে, আরব, চীন, ও ইতালীয় পর্যটক ও ব্যবসায়ীদের বৃত্তান্তের মধ্যে। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রের সাক্ষ্যই প্রথম উদ্ধৃত করা যাক। কৌটিল্য বলিতেছেন, বঙ্গদেশের (বাঙ্গক।) দুকুল খুব নরম ও সাদা; পুণ্ড্রদেশের (পৌণ্ডক) দুকূল শ্যামবর্ণ এবং দেখিতে মণির মতো পেলাব; সুবর্ণকুড্যদেশের (কামরূপ) দুকুলের রং নবেদিত সূর্যের মতন। টীকাকার যোজনা করিতেছেন, দুকুল বস্ত্র খুব সূক্ষ্ম, ক্ষৌম বস্ত্র একটু মোটা। পত্রোর্ণ (জাত) বস্ত্ৰ মগধ (মাগধিকা), সুবর্ণকুড্যক (সীেবর্ণকুড্যকা) অর্থাৎ কামরূপ এবং পুণ্ড্রদেশে (পৌণ্ডিকা) উৎপন্ন হইত। পত্রোর্ণজাত বস্ত্ৰ বোধহয় এণ্ডি ও মুগাজাতীয় বস্ত্ৰ (পত্ৰ হইতে যাহার উর্ণা = পত্রোর্ণ?)। আমরকোষের মতে পত্রোর্ণ সাদা অথবা ধোয়া কৌষেয় বস্ত্ৰ; টীকাকার পরিষ্কার বলিতেছেন, কীটবিশেষের জিহ্বারস কোনও কোনও বৃক্ষপত্রকে এই ধরনের উর্ণায় রূপান্তরিত করে। লক্ষণীয় এই যে, কৌটিল্যোক্ত দেশগুলিতে এখন খুব ভাল এণ্ডি-মুগাজাতীয় বস্ত্ৰ উৎপন্ন হয়, বিশেষভাবে কামরূপে। পুণ্ড্রদেশে যে শুধু দুকুল ও পত্রোর্ণ বস্ত্ৰ উৎপন্ন হইত। তাঁহাই নয়, মোটা ক্ষৌম বস্ত্ৰও উৎপন্ন হইত, কৌটিল্য সেকথাও বলিতেছেন। শ্রেষ্ঠ কার্পাসবস্ত্র উৎপন্ন হইত মধুরা (মাদুরা), অপরান্ত, কলিঙ্গ, কাশী, বঙ্গ, বৎস এবং মহিষ জনপদে। বঙ্গে শ্বেতম্বিন্ধ দুকুল যেমন উৎপন্ন হইত, তেমনই শ্রেষ্ঠ কাপাসাবস্ত্রেরও অন্যতম উৎপত্তিস্থল ছিল এই দেশ ৷ বঙ্গে ও পুণ্ডে প্রাচীনকালে তাহা হইলে চারিপ্রকার বস্ত্ৰশিল্প ছিল—দুকুল, পত্রোর্ণ, ক্ষৌম ও কাপসিক। প্রাচীন বাঙলার এই সম্পদের কথা গ্ৰীক ঐতিহাসিকেরা বারবার উল্লেখ করিয়া গিয়াছেন। ইহার রপ্তানির উল্লেখ পাওয়া যায়। Periplus গ্রন্থে। Schoff-এর ইংরেজী অনুবাদটুকু সমস্তই উদ্ধৃত করিতেছি। এইজন্য যে, এই উপলক্ষে আমাদের দেশের অন্যান্য রপ্তানি দ্রব্যেরও কিছু কিছু খবর পাওয়া যাইবে। হিমালয়ের সানুদেশে পার্বত্য অসভ্য কিরাত জাতিদের উল্লেখের পরেই বলা হইতেছে;

After these- the course turns towards the east again and sailing with the ocean to the right and the shore remaining beyond to the left, the Ganges comes into view, and near it the very last land towards the east, Chryse. There is a river near it called the Ganges…. on its bank is a market-town which has the same name as the river Ganges. Through this place are brought malabathrum and Gangetic spikenard and pearls and muslins of the finest sorts which are called Gangitic. It is said that there are gold-mines near these places and there is a gold coin which is called castis…..

 

কৃষিদ্রব্য : তেজপাতা, পিপ্পলি  মুক্তা ও স্বর্ণের প্রাসঙ্গিক উল্লেখ

এই সমুদ্রতীরবর্তী গঙ্গাবিধৌত দেশ যে বাঙলাদেশ, তাহা সুস্পষ্ট। এই দেশকেই গ্ৰীক ঐতিহাসিকেরা বলিয়াছেন। গঙ্গারাষ্ট্র বা Gangaridae, এই গঙ্গা-বন্দরের (তাম্রলিপ্ত হইতে পৃথক) রপ্তানি দ্রব্যগুলির প্রথমেই পাইতেছি। malabathrum বা তেজপাতা। Ptolemy বলেন, Kirrhadae বা কিরাত দেশেই সবচেয়ে ভাল তেজপাতা উৎপন্ন হইত। উত্তর-বঙ্গের কোনও কোনও স্থানে, শ্ৰীহট্টে এবং আসামের কোনও কোনও জায়গায়, সাধারণভাবে পূর্ব-বিহারের পার্বত্য জনপদগুলিতে এখনও প্রচুর তেজপাতা উৎপন্ন হয়, এবং তাহার ব্যবসাও খুব বিস্তৃত। ইহার পরেই দেখিতেছি, গাঙ্গেয় পিপ্পলির উল্লেখ; ইহারও উৎপত্তিস্থল বোধহয় ছিল বাঙলার উত্তরে পার্বত্য সানুদেশ। রোমদেশীয় বণিকেরা Nelcynda হইতে যে প্রচুর পিপ্পলি পাশ্চাত্ত্য দেশগুলিতে লইয়া যাইতেন, তাহার অধিকাংশই যে এই গঙ্গা বন্দর হইতে যাইত, তাহাতে সন্দেহ নাই। কিছু কিছু মালাবার অঞ্চল হইতেও যাইত, কিন্তু দক্ষিণ-ভারতের পিপ্পলি (গ্ৰীক, পেপেরি = অধুনা pepper) গঙ্গা-বন্দরের পিপ্পলির মতন এত বড় বা ভালো, হইত না। এই পিপ্পলির ব্যবসায়ে দেশে প্রচুর অর্থগম হইত, সে কথা ব্যাবসা-বাণিজ্য আলোচনা প্রসঙ্গে জানা যাইবে। পিপ্পলির পরেই পাইতেছি, মুক্তার উল্লেখ। এই মুক্তা যে গাঙ্গেয় মুক্তা, সে সম্বন্ধে সন্দেহ নাই, এবং খুব ভালো মুক্তা না হইলেও ইহার কিছু কিছু পশ্চিম এশিয়ায়, ইজিপ্ট, গ্ৰীসে, রোমে রপ্তানি হইত। কিন্তু সর্বাপেক্ষা মূল্যবান রপ্তানি দ্রব্য হইতেছে। Gangetic musin অর্থাৎ গাঙ্গেয় সূক্ষ্ম বস্ত্ৰ-সম্ভার। সর্বশেষ উল্লেখ পাইতেছি স্বর্ণখনির। Schoff সাহেব অনুমান করেন, এই স্বর্ণ আসিত. Erannaboas (সংস্কৃত হিরণ্যবাহ) বা বর্তমান সোন নদ বাহিয়া। কিন্তু Herodotus হইতে আরম্ভ করিয়া প্লিনি পর্যন্ত তিব্বতের যে aint-gold-এর কথা বলিতেছেন, Periplus-এ যে তাহার উল্লেখ নাই সে কথা কে বলিবে? কিন্তু এ দুয়ের কোনওটিই বাঙলাদেশের নয়। বহু দিন পরে টেভারনিয়ারের ভ্রমণবৃত্তান্তে কিন্তু পাইতেছি, আসাম ও উত্তরব্রহ্মের নদী বাহিয়া কিছু কিছু সোনা ত্রিপুরাদেশের ভিতর দিয়া বাঙলায় আসিত। এই সোনার পরিমাণ ছিল যথেষ্ট, যদিও স্বরূপ খুব উৎকৃষ্ট ছিল না। ত্রিপুরার যে-সব বণিক ঢাকায় বাণিজ্য করতে আসিতেন, তাঁহারা টুকরা টুকরা সোনার পরিবর্তে লইয়া যাইতেন প্রবাল, অয়স্কান্ত মণি, কুর্মাবরণের এবং সামুদ্রিক শঙ্খের বালা। রাঢ়ের দক্ষিণ-সমুদ্রে যে প্রচুর মুক্তা পাওয়া যাইত তাহার একটু ইঙ্গিত আছে রাজেন্দ্ৰ চোলের তিরুমালয় লিপিতে। তাহা ছাড়া, নিম্ন-বঙ্গের দক্ষিণ-পশ্চিমে সুবর্ণরেখা নদী, ঢাকা ও ফরিদপুর জেলার সোনারং, সোনারগা বা সুবৰ্ণগ্রাম, সুবর্ণবীথি, সোনাপুর প্রভৃতি প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় স্থান-নামগুলিও আমার কাছে একেবারে নিরর্থক মনে হয় না। এইসব জনপদের নদীগুলিতে একসময় dust gold পাওয়া যাইত, তাহারই স্মৃতি হয়তো নামগুলির মধ্য থাকিয়া গিয়াছে।

যাহা হউক, কার্পাসবস্ত্র ও অন্যান্য বস্ত্রশিল্পের উল্লেখ অর্থশাস্ত্র বা Periplus ছাড়াও অন্যত্র অনেক জায়গায় আছে। দৃষ্টান্তস্বরূপ ইবন খুর্দদবা নামক আরব ভৌগোলিকের (দশম শতক) নাম করা যাইতে পারে। ইনি রহমি বা রহমা নামে একটি দেশের নাম করিতেছেন : এই রহনি বা রহুম দেশকে Eliot সাহেব মোটামুটি বঙ্গদেশের সঙ্গে অভিন্ন বলিয়া মনে করেন। আমার মনে হয়, Eliot সাহেবের এই অনুমান যথার্থ নয়; রহ্মি বা রহমা প্রাচীন আরাকান (রহম=রহন-রখন=আরাকান)। ইবন খুর্দদবা বলিতেছেন, “জলপথে জাহাজের সাহায্যে রহমি দেশের রাজা অন্যান্য দেশের রাজাদের সঙ্গে সম্বন্ধ রক্ষা করেন। তাহার। পাচ হাজার হাতি আছে, এবং তাহার দেশে কার্পােসবন্ত্র এবং অগুরু কাঠ উৎপন্ন হয়৷ ” এই রহমি দেশ সম্বন্ধেই আরবদেশীয় সওদাগর সুলেমান (নবম দশক) বলিতেছেন, এ দেশে একপ্রকার সূক্ষ্ম ও সুকোমল বস্ত্ৰ উৎপন্ন হইত, অন্য কোনও দেশে এমন সূক্ষ্ম বস্ত্ৰ উৎপন্ন হইত না; এ বস্ত্র এত সূক্ষ্ম ও কোমল ছিল যে একটা আংটির ভিতর দিয়া তাহাকে চালাইয়া দেওয়া যাইত। সুলেমান আরও বলেন যে, এ বস্ত্র ছিল কাপাসের তৈরি, এবং তেমন বস্ত্ৰ তিনি নিজের চোখে দেখিয়াছেন। ত্রয়োদশ শতকের প্রথম ভাগে চীন-পরিব্রাজক চাও-জু-কুয়া পিং কলো বা বাংলাদেশ সম্বন্ধে বলিতেছেন, এ দেশে খুব ভালো দুমুখো তলোয়ার তৈরি হয়, এবং কার্পাস এবং অন্যান্য বস্ত্ৰ উৎপন্ন হয়। ত্রয়োদশ শতকেরই শেষের দিকে (১২৯০) মার্কো পোলো, গুজরাট, কাম্বে, তেলিঙ্গানা, মালাবার ও বঙ্গদেশে কার্পাস উৎপাদন ও কার্পাস বস্ত্রশিল্পের কথা বলিয়াছেন। বঙ্গদেশ সম্বন্ধে তিনি বলিতেছেন,

‘বাঙলাদেশের লোকেরা প্রচুর কার্পাস উৎপাদন করে, এবং তাহাদের কার্পাসের ব্যবসা ছিল খুব সমৃদ্ধ। পঞ্চদশ শতকে আর একজন চীন-পরিব্রাজক মা-হুয়ান (১৪০৫) বাঙলাদেশে আসিয়াছিলেন; সৈফুদ্দিন হামজা সাহ তখন গৌড়ের রাজা। কার্পাসবাস্ত্রের উল্লেখ ছাড়াও তাহার বিবরণটি অন্যান্য ধনসম্বলের পরিচয়ের দিক হইতে উল্লেখযোগ্য। চেহাটি-গান (চট্টগ্রাম) ও সোনা-উরু-কোঙ (সোনারগাঁ—সুবর্ণগ্রাম) উল্লেখের পর তিনি গৌড় রাজধানীর কথা বলিতেছেন, এই রাজ্যের নগরগুলি প্রাচীরবেষ্টিত; অধিবাসীরা কৃষ্ণবর্ণ এবং মুসলমান। ভাষার নাম বাঙলা, তবে পারস্য ভাষার ব্যবহারও আছে। মুদ্রার নাম টঙ্কা; অল্প মূল্যের জন্য কড়িও ব্যবহার করা হয়। সমস্ত বৎসর ধরিয়া চীনদেশের গ্ৰীষ্মকালের মতন গরম। নানা প্রকার ধান, যব, গম ও সর্ষপ এ দেশের প্রধান শস্য। এই দেশে নারিকেল, ধান, তাল ও কাজঙ্গ হইতে মদ তৈরি করা হয়, এবং সেই মদ প্রকাশ্যভাবে বিক্রয় করা হয়। উৎপন্ন ফলের মধ্যে কলা, কঁাটাল, আম, ডালিম ও ইক্ষু প্রধান। এ দেশে ছয় প্রকারের সূক্ষ কাপািসবন্ত্র প্রস্তুত হয়; এই বস্ত্ৰ সাধারণত প্রস্থে দুই এবং দৈর্ঘ্যে উনিশ হাত। এই দেশে রেশমের কীট পালিত হয় ও রেশমনির্মিত বস্ত্ৰ বয়ন করা হয়।…’

কার্পাস সম্বন্ধে একটু পরোক্ষ প্রমাণ পাওয়া যাইতেছে চর্যাগীতি-গ্ৰন্থ হইতেও। এই গ্ৰন্থ সহজিয়া গুহাসাধনার আনন্দ-সংগীত, ইহার অনেক পদের অর্থ সুস্পষ্ট নয়। তথাপি নানা রাগরাগিণীর এই গানগুলি যে সাধনার আনন্দ প্রকাশ করিতেছে, এ কথা সহজেই বুঝা যায়। এই গ্রন্থে শবরপাদের একটি পদে আছে:–

হেরি সে মেরি তাইলা বাড়ী খসমে সমতুলা।
সুকড় এসে রে কপাসু ফুটিলা ৷
তইলা বাড়ীর পাসেঁর জোহ্না বাড়ী উএলা।
ফিটেলি অন্ধ্যারি রে আকাশ ফুলিআ ৷।

ইহার প্রথম দুই লাইনের তিব্বতী অনুবাদ হইতে প্ৰবোধচন্দ্র বাগচী মহাশয় সংস্কৃত অনুবাদ করিয়াছেন এইরূপ:—“মম উদ্যানবাটিকাং দৃষ্টবা খসম-সমতুল্যাম। কার্পাসপুষ্পম প্রস্ফুটিতম অত্যৰ্থং আনন্দিতঃ ভবতি।” বাড়ির বাগানে কার্পাসফুল ফুটিয়াছে, দেখিয়াই আনন্দ, যেন ঘরের চারপাশ উজ্জ্বল হইল, আকাশের অন্ধকার টুটিল। ইহা হইতেই বুঝা যায়, কার্পাসকে কতখানি মূল্য দেওয়া হইত তদানীন্তন বাঙলাদেশে। শান্তিপাদের একটি পদে আছে:–

তুলা ধুনি আঁসুরে আঁসু।
আঁসু ধুনি ধুনি নিরবীর সোসু ॥
তুলা ধুনি ধুনি সুনে আহারিউ।
পুন লইয়া অপনা চটারিউ ৷

ভাবাৰ্থ এই : তুলা ধূনিয়া ধুনিয়া আঁশ তৈরি করা হইতেছে, আঁশ ধূনিয়া ধুনিয়া আর কিছু বাকি নাই। তুলা ধুনিয়া ধুনিয়া শূন্যে উড়াইতেছি; আবার তাহাই লইয়া ছড়াইয়া দিতেছি। হয়তো ইহার গৃঢ় অর্থ আছে; কিন্তু তুলা ধুনিবার যে ইহা একটি বাস্তব চিত্র, তাহাতে আর সন্দেহ কি? কাহ্নপাদের একটি পদে তাঁতবিক্রয়ের কথাও আছে; সাধারণত ডোমনীরাই বোধ হয় তাত (বাঁশের) তৈরি করিত [তান্তি বিকণঅ ডোম্বী অবর না চাংগেড়া (বাঁশের চাঙাড়ি)]। আর একটি পদের রচয়িতার নাম পাইতেছি। তন্ত্রীপাদ। তন্ত্রীপাদের বুৎপত্তিগত অর্থ হইতেছে, তাত-শিক্ষক অথবা তীতি-গুরু। ইহাই বোধহয় এই পদ-রচয়িতার পূর্বতন বৃত্তি ছিল। পরে তিনি ‘সিদ্ধা হইয়াছিলেন। এই অনুমানের কারণ পদটির ভিতরেই আছে। ইহার মূল বাঙলা পাওয়া যায় নাই; তবে তিব্বতী অনুবাদ হইতে প্ৰবোধচন্দ্র বাগচী মহাশয় যে সংস্কৃত অনুবাদ করিয়াছেন, তাহার কিয়দংশ হইতে বুঝা যাইবে, গীত ও সাধন-সংবদ্ধ সমস্ত রূপকটি গড়িয়া উঠিয়াছে বস্ত্রবয়নকে অবলম্বন করিয়া।

কালপঞ্চকতন্ত্রং নির্মলং বঁস্ক্রিং বয়নং করোতি।
অহং তন্ত্রী আত্মনঃ সূত্রম।
আত্মনঃ সূত্রস্য লক্ষণং ন জ্ঞাতম ৷।
সাৰ্দ্ধত্ৰিহস্তং বয়নগতিঃ প্ৰসরতি ত্ৰিধা।
গগনং পূরণং ভবতি অনেন বস্ত্ৰবয়নেন ৷।

নির্ধন ব্ৰাহ্মণের গৃহে নারীরা যে তুলা ধূনিয়া সূতা কাটিতেন তাহা কবি শুভাঙ্কের (আনুমানিক, একাদশ-দ্বাদশ শতক) একটি প্রশস্তি শ্লোকে জানা যায়।

“কাপাসাস্থিপ্রচয়নিচিন্তা নিধান শ্রোত্ৰিয়াণাং
যেষাং বাত্যাপ্রবিতত কুটীপ্রাঙ্গণান্তা বভুবুঃ ।” (সদুক্তিকর্ণামৃত)।

সমসাময়িক কালেরই আর একজন অজ্ঞাতনামা কবি বঙ্গ-বারাঙ্গনাদের সূক্ষ্ম বসনের (বাসঃ সূক্ষ্মং বপুষি)। উল্লেখ করিয়াছেন (সদুক্তিকর্ণামৃত)। চতুর্দশ শতকে তীরভূক্তিবাসী জ্যোতিরীশ্বর তাহার বর্ণরত্নাকর গ্রন্থে বাঙলাদেশের ‘মেঘ-উদুম্বর’, ‘গঙ্গা-সাগর’, ‘লক্ষ্মীবিলাস’, ‘সিলহটী’ (শ্ৰীহট্ট-জাত), ‘গাঙ্গেরী’ ইত্যাদি পট্ট ও নেতবস্ত্রের উল্লেখ করিয়াছেন।

উপরের এই আলোচনা হইতেই বুঝা যাইবে, কার্পাসের চাষ, গুটিপোকার চাষ, কার্পাস ও অন্যান্য বস্ত্ৰশিল্পই ছিল প্রাচীন বাঙলার সর্বাপেক্ষা প্রশস্ত শিল্প এবং ধনোৎপাদনের অন্যতম উপায়। পট্টবস্ত্ৰ বা পাটের কাপড়ের শিল্পও ছিল, এবং নানা উপলক্ষে, বিশেষভাবে পূজা, ব্ৰত, বিবাহানুষ্ঠান ইত্যাদি ব্যাপারে। পট্টবস্ত্রের ব্যবহারেরও খুব প্রচলন ছিল। মধ্যযুগের বাঙলা সাহিত্যে পট্টবস্ত্রের উল্লেখ সুপ্রচুর। পাটের চাষ এখনকার মতো বিস্তৃত না হইলেও ছিল যে সন্দেহ নাই, এবং পাটের কচিপাতা বা নালিত শাক এখনকার মতো তখনও বাঙালীর প্রিয় খাদ্য ছিল। প্রাকৃত-পৈঙ্গল-গ্রন্থে সে কথার প্রমাণ আছে, অন্যত্র তাহা উল্লেখ করিয়াছি।

 

চিনি, লবণ ও মৎস্য শিল্প

বস্ত্ৰশিল্পের পরেই উল্লেখ করিতে হয় চিনি, লবণ ও মৎস্যের কথা। একটু পরেই এ সম্বন্ধে বিস্তৃত উল্লেখ করা হইয়াছে। চিনি মারফত দেশে প্রচুর অর্থগম হইত বলিয়া মনে হয়। পৌণ্ডক ইক্ষু হইতে যে প্রচুর চিনি উৎপন্ন হয় এ কথা সুশ্রুত বহুদিন আগেই বলিয়াছেন। ত্ৰয়োদশ শতকে বাঙলাদেশ হইতে প্রধান রপ্তানি দ্রব্যের মধ্যে চিনির উল্লেখ করিয়াছেন মার্কে পোলো। ষোড়শ শতকের গোড়ায়ও ভারতের বিভিন্ন দেশে, সিংহলে, আরব ও পারস্য প্রভৃতি দেশে চিনি রপ্তানি লইয়া দক্ষিণ-ভারতের সঙ্গে বাঙলাদেশ প্রতিদ্বন্দ্বিতা করিতেছে, এ সাক্ষ্য দিতেছেন পর্তুগীজ পর্যটক বারবোসা। লবণের ব্যাবসা লইয়া ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কড়াকড়ির কথা সুবিদিত; ইহা হইতেই অনুমান হয়, অষ্টাদশ শতকেও লবণের ব্যাবসা খুব লাভজনকই ছিল। মৎস্যের একটা বিস্তৃত আন্তদেশীক ব্যাবসা নিশ্চয়ই ছিল, কঁচা এবং শুকনা মৎস্য দুয়েরই। বাঙলাদেশ তো চিরকালই মৎসাহারী, এবং বাঙালী স্মৃতিকার ব্ৰাহ্মণ ভবদেব ভট্ট যেমন করিয়া বাঙালীর মৎস্যাহারের সপক্ষে যুক্তি দিয়াছেন তাহাতে মনে হয়, আজিকার মতন তখনও বাঙলার বাহিরে বাঙালীর এই মৎস্যগ্ৰীতি সম্বন্ধে একটা ঘূণার ভাব ছিল। ভবদেব ভট্ট নানাপ্রকার মৎস্যের উল্লেখ করিয়াছেন; শুকনা মাছের কথাও বলিয়াছেন। দুইই ছিল ভক্ষ্য এবং সেই হেতু ব্যাবসা-বাণিজ্যের অন্যতম দ্রব্য। যে-ভাবে দান-বিক্রয়ের পট্টোলীগুলিতে মৎস্যের উল্লেখ করা হইয়াছে তাহাতেই মনে হয়, এই দ্রব্যটির মূল্য ও চাহিদা যথেষ্টই ছিল; পাহাড়পুরের ২/১ টি পোড়ামাটির ফলকে তাহার ইঙ্গিতও আছে।

 

কারুশিল্প : তক্ষণ ও স্থাপত্যশিল্প;
অলংকার শিল্প; লৌহশিল্প; মৃৎশিল্প; কাষ্ঠশিল্পী; দন্তশিল্প; কাংস্যশিল্প

কারুশিল্পও কম ছিল না। তাহার লিপি-প্রমাণ বিশেষ নাই, কিন্তু অনুমান সহজেই করা চলে। তক্ষণ ও স্থাপত্যশিল্প, স্বর্ণ ও রৌপ্যশিল্পের কথা আগেই প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করিয়াছি; এখানে আর বিস্তৃত করিয়া উল্লেখ করিবার বিশেষ কিছু নাই। সোনা, রূপা, মণি, হীরা ও বিচিত্র দ্যুতিময় প্রস্তরসজ্জিত নানা অলংকার বিত্তশালী সমাজে ব্যবহৃত হইত, এ কথা তো সহজেই অনুমেয়। অন্যত্র উল্লিখিত বিচিত্র দেবদেবীর অলংকরণ। ঐশ্বর্য দেখিলে তাহা বুঝিতে বিলম্ব হয় না। তবকত্ব-ই-নাসিৱী গ্রন্থে উল্লেখ আছে, লক্ষ্মণসেন সোনা ও রূপার বাসনে আহার করিতেন। ইহা কিছু অত্যুক্তি নয়। রাজারাজড়া তো করিতেনই, বণিক সাধু-সওদাগরেরাও করিতেন; তাহার কিছু আভাস মধ্যযুগের বাঙলা সাহিত্যেও আছে। রামচরিত কাব্যে মণিময় ঘুঙুর, মুক্তা, হীরা ও নানা বিচিত্ৰবৰ্ণ প্রস্তরখচিত অলংকারের উল্লেখ আছে; বিজয়সেনের দেওপাড়া লিপি, লক্ষ্মণসেনের নৈহাটীলিপি এবং অন্যান্য লিপিতে দেবদাসী, রাজান্তঃপুরের নারী ও পরিচারিকদের নানা মূল্যবান অলংকার-সজ্জার উল্লেখ আছে। এই বিলাস ঐশ্বর্যের প্রদর্শনী সেন আমলেই বেশি আত্মপ্রকাশ করিয়াছিল বলিয়া মনে হয়। লৌহশিল্পও ছিল; দুই-একটি শাসনে কর্মকার তো রাজপাদোপজীবী বলিয়াই উল্লিখিত হইয়াছেন। চাও-জু-কুয়া যে বলিয়াছেন, বাঙলাদেশে দুমুখো খুব ধারালো তলোয়ার তৈরি হয়, তাহার মধ্যে লৌহ ইত্যাদি ধাতুশিল্পে এ দেশের শিল্প-কৃতিত্ব প্রকাশ পাইতেছে। লৌহশিল্পের প্রচলন যে খুবই ছিল তাহা অনুমান করা কঠিন নয়। কর্মকারের সুপ্রাচুর্য না থাকিলে তো কৃষিকর্ম এবং কৃষিসমাজ চলিতেই পারে না। দা, কুড়াল, কোদালি, খন্তা, খুরপি, লাঙ্গল ইত্যাদি ছাড়া লোহার জল-পাত্ৰ (ইদিলপুর লিপি), তীর, বর্শা, তরোয়াল ইত্যাদি যুদ্ধের অস্ত্রশস্ত্ৰও প্রচুর তৈরি হইত। অগ্নিপুরাণের মতে অঙ্গ ও বঙ্গদেশ তরোয়ালের জন্য প্রসিদ্ধ ছিল; বঙ্গদেশীয় তরোয়াল নাকি ছিল খুব শক্ত ও ধারালো। কুম্ভকারের মৃৎশিল্পের প্রচলন ছিল খুব। কুম্ভকারের উল্লেখ ২/১ টি লিপিতে আছে (যথা, বৈদ্যদেবের কমীেলি লিপি), এবং একাধিক লিপিতে কুম্ভকার-গর্তের উল্লেখও আছে (যথা, নিধনপুর লিপি)। এই উল্লেখ-প্রসঙ্গ হইতে মনে হয়, কুম্ভকার-বৃত্তির কেন্দ্র ছিল গ্রাম। পোড়ামাটির নানা প্রকারের থালা, বাটি, জলপাত্র, রন্ধনপাত্র, দোয়াত, প্ৰদীপ ইত্যাদি। পাহাড়পুরের ধ্বংসাবশেষের মধ্যে, বজযোগিনীর সন্নিকটস্থ রামপালে, ত্রিপুরায় ময়নামতীর ধ্বংসাবশেষের মধ্যে পাওয়া গিয়াছে। পাহাড়পুর, মহাস্থান, সাভার ইত্যাদি স্থানে প্রাপ্ত অসংখ্য পোড়ামাটির ফলকও বিস্তৃত মৃৎশিল্পের সাক্ষ্য বহন করিতেছে।

শ্ৰীহট্ট জেলার ভাটেরা গ্রামে প্রাপ্ত গোবিন্দ-কেশবের শাসনে আমরা রাজবিগ নামে জনৈক দন্তকারের উল্লেখ পাইতেছি; মনে হইতেছে, হস্তিদন্ত-শিল্পের প্রচলনও ছিল, কেশবসেনের ইদিলপুর লিপিতে দ্বিপদন্ত-দণ্ড শিবিকার উল্লেখ পাইতেছি। সূত্রধরের উল্লেখও কয়েকটি লিপিতে পাইতেছি। আশ্চর্যের বিষয় এই, ইহাদের উল্লেখ তাম্রপট্টগুলির খোদাইকররূপে; লিখিত শাসন ইহারাই তাম্রপট্টে উৎকীর্ণ করিতেন। এই অর্থে আমরা এখন আর এই শব্দটি ব্যবহার করি না, কিন্তু যে-যুগের কথা আমরা বলিতেছি সেযুগে যে ব্যবহৃত হইত, তাহাতে সন্দেহ নাই। না হইবারও কারণও নাই। সূত্ৰধর যে শুধু কাঠ-মিস্ত্রী, তাহাই নয়; আমাদের প্রাচীন বাস্তু-শাস্ত্ৰে (যেমন, মানসারে) সূত্রধর বলিতে স্থপতি, তক্ষণকার, খোদাইকর, কাঠ-মিস্ত্রী সকলকেই বুঝাইত। কাঠের শিল্পের প্রচলনও কম ছিল না। কাঠের তৈরি ঘরবাড়ি কালের ভ্ৰক্ষেপ উপেক্ষা করিয়া আজ আর বাঁচিয়া নাই, কিন্তু স্তম্ভ, খিলান, খুঁটি ইত্যাদির ২/৪ টি টুকরা আজও যাহা পাওয়া যায় তাহাদের কারু ও শিল্পনৈপুণ্য বিস্ময়কর। ঢাকার চিত্রশালায় তেমন নিদর্শন কয়েকটি আছে। সংসারের আসবাবপত্র, ঘরবাড়ি, মন্দির, পালকি, গোরুর গাড়ি, রথ, বিশেষভাবে নদীগামী নানাপ্রকার নৌকা ও সমুদ্রগামী বৃহদাকৃতি নৌকা বা জাহাজ ইত্যাদি সমস্তই তো ছিল কাঠের। সেই দিক দিয়া দেখিলে কাষ্ঠশিল্পের সমৃদ্ধি সহজেই অনুমেয়, এবং সমাজের মধ্যে এই শিল্পীদের একটা স্থানও ছিল। সাধারণ ভাবে শিল্পী ও শিল্পীগোষ্ঠীর কথার আভাস তো বিজয়সেনের দেওপাড়া লিপির খোদাইকর রাণিক শূলপাণির “বারেন্দ্রক শিল্পীগোষ্ঠীচুড়ামণি” এই বিশেষণটির মধ্যেও আছে। তাহা ছাড়া, পঞ্চম হইতে অষ্টম শতকের তাম্রপট্টোলীগুলিতে ভূমি দান-বিক্রয় ব্যাপারে বিষয়পতি বা অন্য রাজপ্রতিনিধি রাষ্ট্রের পক্ষ হইতে যে-কয়জন প্রধানের মতামত গ্ৰহণ করিতেন, অর্থাৎ যে-কয়জনে মিলিয়া অধিকরণ গঠিত হইত, তাহাদের মধ্যে প্রথম-কুলিক সর্বদাই অন্যতম। কুলিক অর্থ শিল্পী (artisan); এই প্রথম-কুলিক খুব সম্ভবত ছিলেন শিল্পীগোষ্ঠী বা নিগমের প্রধান প্রতিনিধি। নগরের অথবা বিষয়ের শ্রেষ্ঠ গণ্যমান্য শিল্পী যিনি ছিলেন, তিনিই এই জাতীয় অধিকরণে আসন লইবার জন্য আহুত হইতেন। রাজপাদােপজীবীদের মধ্যেও কোথাও কোথাও কুলিক বা শ্রেষ্ঠ শিল্পীর নাম পাওয়া যাইতেছে। পূর্বোল্লিখিত ভাটেরা গ্রামের গোবিন্দ-কেশবদেবের লিপিতে গোবিন্দ নামে এক কাংস্য অর্থাৎ কাংস্যকার বা কাসারীর উল্লেখ পাইতেছি। কঁাসা বা bell-metal এর শিল্পের আভাসও তাহা হইলে কিছু পাওয়া গেল। নানাপ্রকার মিশ্র ধাতুশিল্পের প্রমাণ ও পরিচয় আরও পাওয়া যায় অসংখ্য ব্রোঞ্জ ও অষ্টধাতুর রচিত মূর্তিগুলির মধ্যে।

 

নৌশিল্প

সকল শিল্পের মধ্যে নৌশিল্প বা নদীগামী নৌকা ও সমুদ্রগামী পোত-নির্মাণ শিল্পের একটা বিশেষ স্থান নিশ্চয়ই ছিল; তাহার প্রমাণ শুধু বর্তমান চট্টগ্রামে কিংবা মধ্যযুগীয় বাঙলা সাহিত্যে নয়, প্রাচীন বাঙলার লিপিগুলিতে এবং সংস্কৃত সাহিত্যেও ইতস্তত ছড়াইয়া আছে। মৌখরী-রাজা ঈশানবর্মের হড়াহা লিপিতে (ষষ্ঠ শতকের দ্বিতীয় পাদ) গৌড়দেশবাসীদের (গৌড়ান) “সমুদ্রাশ্রয়ান” বলা হইয়াছে; ইহার অর্থ সমুদ্র-তীরবর্তী গৌড়দেশ হইতে পারে, অথবা সামুদ্রিক বাণিজ্যই যাহার আশ্রয়, সেই গৌড়দেশও বুঝাইতে পারে। কালিদাস রঘুবংশে রঘুর দিগ্বিজয় প্রসঙ্গে বাঙালীকে “নৌসাধনোদ্যতান” বলিয়া পরিচয় দিয়াছেন। পাল ও সেন বংশের লিপিমালায় নৌবাটি, নৌবিতান (fleet of boats) প্রভৃতি শব্দ তো প্রায়শ উল্লিখিত হইয়াছে। এই উভয় রাজবংশের, এবং সমসাময়িক বাঙলাদেশের অন্যান্য রাজবংশেরও, সামরিক শক্তি নৌবলের উপর অনেকটা নির্ভর করিত; ইহার উল্লেখ তো অনেক শিলালিপিতেই আছে। বৈদ্যদেবের কমীেলি লিপিতে নৌযুদ্ধের বর্ণনাও আছে। সাধারণ লোকদের যাতায়াত এবং ব্যাবসা-বাণিজ্যের জন্য নৌযানের প্রয়োজন ছিল যথেষ্ট এই নদীমাতৃক, খাড়িপ্রধান, বারিবহুল, এবং বহুলাংশে নিম্নভূমির দেশে ইহা তো স্বাভাবিক এবং সহজেই অনুমেয়। বৈন্যগুপ্তের গুণাইঘর লিপিতে (৫০৭-৮ খ্ৰী) নৌযোগ অর্থাৎ নৌকাঘাট বা বন্দর বা পোতাশ্রয়ের উল্লেখ আছে; এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য, যে ভূমি-সীমানা সম্পর্কে এই নৌযোগের উল্লেখ, সেই ভূমি ত্রিপুরা জেলার গুণাইঘর গ্রামের নিকটবতী জলপ্লাবিত দেশে। ফরিদপুর জেলায় প্রাপ্ত মহারাজ ধর্মদিত্যের ১ নং তাম্রপট্টোলীতে ভূমির সীমা সম্পর্কে “নাবাত-ক্ষেণী” কথা উল্লেখ আছে। “নাবাত” পাঠ খুব শুদ্ধ বলিয়া মনে হয় না, প্রকাশিত প্ৰতিলিপিতে “ভাবতা” পোঠই সমীচীন মনে হয়; কিন্তু “দ্ভাবতা-ক্ষেণী” কথার কোনও সংগত অর্থ এস্থলে করা যায় না। সেইজন্য পার্জিটার সাহেবের আনুমানিক পাঠ “নাবাত-ক্ষেণী” আপাতত স্বীকার করা যাইতে পারে তিনি ইহার অনুবাদ করিয়াছেন, Ship-building harbour)। ধর্মাদিত্যের ২ নং শাসনে অন্য একটি ভূমির সীমা সম্পর্কে “নৌদণ্ডক” কথার উল্লেখ আছে, বোধ হয় “নৌদণ্ডক” কথার অর্থও নৌকার আশ্রয়, নৌকা যেখানে বাধা হইত সেই স্থা , অর্থাৎ বন্দর, ঘাট। এইসব উল্লেখ হইতে স্পষ্টই বুঝা যায়, নদনদীগামী ছােটবড় নৌকা, সমুদ্রগামী পোত ইত্যাদি নির্মাণ-সংক্রান্ত একটা সমৃদ্ধ শিল্প ও ব্যবসায় প্রাচীন বাঙলায় নিশ্চয়ই ছিল। রক্তমৃত্তিকাবাসী মহানাবিক বুদ্ধগুপ্তের কাহিনী সুপরিচিত। ভাটেরার গোবিন্দকেশবের লিপিতেও জনৈক নাবিক দ্যোজ্যের উল্লেখ পাইতেছি।