০৭. সংযোজন – দেশ-পরিচয়

সংযোজন – দেশ-পরিচয়

এ অধ্যায়ে সংযোজন করবার মতন উল্লেখ্য তথ্য ইতিমধ্যে বিশেষ কিছু আবিষ্কৃত হয়নি। তবে, আগে চোখে পড়েনি এমন দু’চারটি ছোট ছোট তথ্য ইতিমধ্যে গোচরে এসেছে। অবশ্য, সেগুলো এমন কিছু অর্থবহ নয় যার ফলে ইতিহাসে নূতন আলোকপাত ঘটতে পারে। সুতরাং সে সব তথ্য আর বর্ণনার অন্তর্ভুক্ত করছি না; আকারণ গ্রন্থের কলেবর বৃদ্ধি করে লাভ নেই। কিন্তু মূল রচনায় তথ্য-বিশৃঙ্খলা কিছু এখানে-সেখানে ছিল, শিথিল বাক্য বা বাক্যাংশও ছিল; সেগুলো সংশোধন করা হচ্ছে।

 

নদনদী। গঙ্গা-ভাগীরথী, আদিগঙ্গা, সরস্বতী, দামোদর ও রূপনারায়ণ

মূল গ্রন্থে নদনদী প্রসঙ্গে যা বলেছি তাতে নূতন কিছু সংযোজন বা সংশোধনের কিছু আছে বলে মনে হয় না, দু’একটি শিথিল বাক্য বা বাক্যাংশ ছাড়া। তবে, গঙ্গা-ভাগীরথীর নিম্নতম প্রবাহ এবং তার সঙ্গে আদিগঙ্গা, সরস্বতী, দামোদর ও রূপনারায়ণের সম্বন্ধ বিষয়ে আলোচনা ও বিশ্লেষণ ত্ৰিশ বছর আগে যা করেছিলাম তা এখন কেমন যেন একটু অস্পষ্ট ও বিশৃঙ্খল বলে মনে হচ্ছে, যদিও তথ্যের দিক থেকে ভুল কিছু তখন করিনি। তা ছাড়া, এই তৃতীয় সংস্করণের প্রফ পড়া এবং ভারতীয় ভূগোল সমিতির প্রথম নির্মলকুমার বসু স্মারক-বক্তৃতাটি (Chandraketugarh and Tamralipta : two port-towns of ancient Bengal and Connected considerations) রচনা উপলক্ষে প্রসঙ্গটি নূতন করে বিচার বিবেচনা করতে হলো। এ গ্রন্থের প্রথম ও দ্বিতীয় সংস্করণে যা বলেছিলাম প্রায় তাই এখানে বলছি, তবে আরও সংক্ষেপে এবং কিছুটা স্পষ্টতর করে এবং তথ্য ও যুক্তি-শৃঙ্খলায় সাজিয়ে।

 

গঙ্গা-ভাগীরথী

ত্ৰিবেণী-হুগলী থেকে শুরু করে সোজা একেবারে সমুদ্র পর্যন্ত যে প্রবাহকে সাধারণভাবে এখন বলা হয়। হুগলী নদী, রাজমহলের ভেতর দিয়ে বাঙলা দেশে ঢোকার পর ফরাক্কা থেকে সমুদ্র পর্যন্ত যে প্রবাহকে আমরা বলি গঙ্গা, লক্ষ্মণসেনের গোবিন্দপুর লিপিতে (আনুমানিক, ১১৭৫ খ্ৰী) বেতড় চতুরকের (হাওড়া জেলার বেতড় গ্রাম) পাশ দিয়ে দক্ষিণমুখী যে প্রবাহটিকে বলা হয়েছে জাহ্নবী, মৎস্যপুরাণোক্ত যে-প্রবাহটি বিন্ধ্যশৈলগাত্রে প্রতিহত হয়ে, ব্রহ্মোত্তর (উত্তর রাঢ়) দেশ ভেদ করে, (পূর্ব) বঙ্গ ও (পশ্চিম) তাম্রলিপ্ত (সুহ্মদেশের অন্তর্গত) স্পর্শ করে প্রবেশ করেছে গিয়ে সমুদ্রে এবং যে গঙ্গা প্রবাহটিকে বলা হয়েছে ভাগীরথী, সেই গঙ্গা-ভাগীরথী প্রবাহই এই নদীর প্রাচীনতম ও প্রধানতম প্রবাহ। এই প্রবাহ-পথটি সম্বন্ধে সন্ধান-সম্ভাব্য ও বিশ্বাসযোগ্য ঐতিহাসিক তথ্যাদি যতটুকু জানা যায় তাতে খানিকটা দৃঢ়তার সঙ্গেই বলা যায় যে, অন্তত পঞ্চদশ-ষোড়শ শতক অবধি দক্ষিণে কলকাতা-বেতড় পর্যন্ত এই প্রবাহ-পথের অদল-বদল বিশেষ কিছু ঘটেনি। যা ঘটেছে তা কলকাতা-বেতড়ের দক্ষিণে, গঙ্গার নিম্নতম প্রবাহে। এই নিম্নতম প্রবাহ সম্বন্ধে কিছু কিছু ঐতিহাসিক ইঙ্গিত বায়ু ও মৎস্যপুরাণে, মহাভারতে, Periplus-গ্রন্থে ও টলেমির বিবরণীতে জানা যায়। ভগীরথ কর্তৃক গঙ্গাকে মর্তে নামিয়ে আনার গল্পটি মৎস্যপুরাণে আছে, রামায়ণেও আছে, আর যুধিষ্ঠির যে এই ভগীরথী প্রবাহের সাগর-সংগমেই তীর্থস্নান করেছিলেন সে-কথা বলা হয়েছে মহাভারতে। Periplus এ আছে গঙ্গা (Gange) বন্দরের কথা যার অবস্থিতি ছিল গঙ্গানদীর তীরে। টলেমিও বলেছেন এই একই গঙ্গাবিন্দরের কথা; তার অবস্থিতি ছিল গঙ্গারাষ্ট্র দেশে; এ-দেশ নিশ্চয়ই ছিল গঙ্গার তীরেই। টলেমি তাম্রলিপ্তের (Tamalites) কথাও বলেছেন, এবং তার অবস্থিতি ছিল গঙ্গার তীরে, যে-গঙ্গার তীরে (অবশ্যই আরও অনেক উত্তরে) অবস্থিতি ছিল Pallimbothra বা পাটলীপুত্র নগরের। স্বভাবতই প্রশ্ন হবে, Gange বন্দরের গঙ্গা আর তাম্রলিপ্ত বন্দরের গঙ্গা, দুইই কি একই গঙ্গা? লিপি, সাহিত্য ও প্রত্নসাক্ষ্যের ইঙ্গিত থেকে মনে হয়, খ্ৰীষ্টিয় সপ্তম শতকের মধ্যেই তাম্রলিপ্তের, এবং চন্দ্ৰকেতুগড় ও Gange যদি এক হয় তাহলে গঙ্গাবিন্দরেরও, বন্দর হিসেবে অস্তিত্ববিলোপ ঘটেছিল, খুব সম্ভব নদীপ্রবাহ শুকিয়ে যাবার দরুণ। কিন্তু যে এ বা একাধিক নদীপ্রবাহ শুকিয়ে গেল তা কোন এক বা একাধিক নদীর?

এ-প্রশ্নের যথাযথ, নিশ্চিন্দ্র উত্তর দেওয়া খুব সহজ নয়। তবে, কিছুটা নির্ভরযোগ্য ইঙ্গিত পাওয়া একেবারে হয়ত অসম্ভব নয়। সে ইঙ্গিত পেতে হলে সরস্বতী, আদিগঙ্গা, দামোদর ও রূপনারায়ণ, অন্তত এই চারটি নদীর ইতিহাস ও সে-ইতিহাসের সঙ্গে গঙ্গা-ভাগীরথীর নিম্নতম প্রবাহের সম্বন্ধ কী ছিল মোটামুটি তার একটু হিসেব নেওয়া প্রয়োজন। দুঃখের বিষয়, সপ্তম-অষ্টম শতকের পর ও পঞ্চদশ শতকের আগে এ-সম্বন্ধে কোনো তথ্যই আমাদের জানা নেই; যা আছে তা পঞ্চদশ শতকে ও তার পরে।

 

আদিগঙ্গা

এই নদীটির প্রথম বিস্তৃত পরিচয় পাওয়া যাচ্ছে বিপ্রদাস পিপিলাই’র (১৪৯৫ খ্ৰী) “মনসামঙ্গল গ্রন্থে এবং পরে সংক্ষিপ্ততর পরিচয় পাওয়া যায় জাও দ্য ব্যারোস ও ফান ডেন ব্রেকের নকশায় (যথাক্রমে ১৫৫০ ও ১৬৬০ খ্ৰী: ) এ সম্বন্ধে যা বলবার মূলগ্রন্থেই বলা হয়েছে। লক্ষণীয় শুধু এই যে, আদিগঙ্গার উৎপত্তি হচ্ছে কলকাতা-বেতড়ের দক্ষিণে গঙ্গা-ভাগীরথীর বাম দিক থেকে; নদীটি প্রথম পূর্ববাহিনী ও পরে দক্ষিণবাহিনী হয়ে সোজা চলে গেছে সাগর-সংগমে। পথে যে-সব জায়গা পড়ছে তা অনুসরণ করলে সন্দেহ থাকে না যে, এই প্রবাহ একসময় (পঞ্চদশ থেকে সপ্তদশ শতক, আনুমানিক) গঙ্গার অন্যতম প্রধান প্রবাহ ছিল। কয়েকটি প্রশ্ন স্বভাবতই মন অধিকার করে। প্রথমত, এ-প্রবাহটিকে আদিগঙ্গা বলা হয় কেন? কখন থেকে বলা হয়? এ-প্রবাহ কখনও কি গঙ্গার নিম্নতম প্রবাহে আদিমতম, প্রাচীনতম প্রবাহ ছিল? তা তো মনে হয় না। দ্বিতীয়ত, এ-প্রবাহকে কখনও ভাগীরথী বলা হতো কি? হতো বলে তো প্রমাণ নেই। তৃতীয়ত, এ-প্রবাহটির সূচনা কবে থেকে এবং কি কারণে হয়েছিল? গঙ্গা-ভাগীরথীর মূল প্রবাহ কি শুকিয়ে গিয়েছিল? যদি তা হয়ে থাকে, কবে হয়েছিল? তৃতীয় যুগ্ম প্রশ্নটির কোনো উত্তর আমাদের জানা নেই; জানিবার উপায়ও বোধ হয়। আর নেই। যাই হোক, অষ্টাদশ শতকের আগেই এই অর্বাচীন নদীটি হেজে মজে মরে গেল, এবং গঙ্গা তার প্রাচীনতম ভাগীরথী (সরস্বতী) প্রবাহপথেই ফিরে গেল।

 

সরস্বতী

গঙ্গা-ভাগীরথীর পশ্চিমতীরে ত্রিবেণীতে ভাগীরথী-প্রবাহ থেকেই সরস্বতীর উদ্ভব এবং সেই উদ্ভবের অদূরেই সপ্তগ্রাম বন্দর, সরস্বতী-তীরে। সরস্বতী ত্ৰিবেণী থেকে দক্ষিণমুখী হয়ে ডােমজুর, আব্দুল স্পর্শ করে ভাগীরথীতেই আবার ফিরে এসেছে, সাকরাইলের কাছে। যত শুকনোই হোক সে-প্রবাহ, তার এই পথই বর্তমান পথ। কিন্তু ষোড়শ ও সপ্তদশ শতকে (অর্থাৎ, দ্য ব্যারোস ও ফান ডেন ব্রোকের নকশায়) সরস্বতী ত্ৰিবেণী থেকে মুক্ত হয়ে শাহনগর, চৌমহা, সুন্দরী, আমগাছি স্পর্শ করে সেখান থেকে পূর্বমুখী হয়ে বেতড়ে এসে ভাগীরথীতে তার জল ঢেলে দিত। Pistola বা পিছলাদা থেকে সরস্বতীর জল প্রবাহিত হয়। গঙ্গা-ভাগীরথীর প্রাচীন খাতে। পটুগীজরা প্রথম সপ্তগ্রামে (Satgaw = Satgaon) আসে ১৫১৮ ও ১৫৩০ খ্ৰীষ্টাব্দে, চট্টগ্রাম বন্দর থেকে। সরস্বতী বেয়ে জাহাজ চলাচল তখন সুগম ছিল না। ব্যারোস বলছেন,

‘Satgaw (Satgaon) is a great and noble city though less frequented than Chittagong on account of the port not being so convenient for the entrance of ships.’

কিছুদিন পর, ১৫৬৫ খ্ৰীষ্টাব্দে Caesar Fredrich বলছেন, বড় বড় জাহাজগুলো সরস্বতী বেয়ে বেতড়ের উত্তরে আর যেতে পারতো না; ছোট জাহাজগুলোও যে যেতো তা-ও কোনো মতে। বড় জাহাজগুলো সপ্তগ্রাম যেতো গঙ্গা-ভাগীরথী উজান বেয়ে; প্রথম ত্ৰিবেণী, তারপর সরস্বতী তীরে সপ্তগ্রাম।

 

দামোদর

দামোদরের ইতিহাস দীর্ঘ, কিন্তু সে-দীর্ঘ ইতিহাসে আমাদের প্রয়োজন নেই। আমাদের সমসাময়িক কালে গঙ্গা-ভাগীরথীর নিম্নতম প্রবাহে দামোদরের প্রধান প্রবাহটি দক্ষিণবাহী হয়ে হাওড়া জেলায় প্রবেশ করেছে। ভুরসুট (প্রাচীন, ভূরিশ্ৰেষ্ঠী?) গ্রামের কাছে। সেখান থেকে আমতা হয়ে বাগনানের ভেতর দিয়ে এই প্রবাহ এসে পড়েছে ভাগীরথীতে, ফলতার উলটো দিকে। অথচ, ষোড়শ-সপ্তদশ শতকে এ-প্রবাহটি প্রধান প্রবাহ-পথ ছিল না; সে-প্রবাহপথ ছিল যাকে বলা হয় কানা দামোদর বেয়ে। ১৬৯০ খ্ৰীষ্টাব্দের একটি নকশায় এই কানা দামোদর বেশ বড় নদ এবং এই নদ ভগীরথীতে এসে পড়তো উলুবেড়িয়ার উত্তরে। সে-প্রবাহ এখনো আছে, কিন্তু ক্ষীণতর। দ্য ব্যারোস ও ব্লোভের (Blaev) নকশায় (যথাক্রমে ১৫৫০ ও ১৬৫০) দেখছি, দামোদর দুমুখী হয়ে ভাগীরথীতে এসে পড়েছে, একটি মুখ ফলতার উলটো দিকে, মর্নিং পয়েন্ট ফোর্টের কাছে, Pistola বা পিছলদহ গ্রামের একটু উত্তরে। আর একটি মুখ উলুবেড়িয়ার উত্তরে, সিজবেড়িয়া খাল বা কানা দামোদর পথে, ভাগীরথীতে। ফান ডেন ব্রোকের নকশায় (১৬৬০) কিন্তু দামোদর সম্বন্ধে বিচিত্র এবং নূতনতর খবর পাওয়া যাচ্ছে। এ নকশায় দেখছি দামোদরের প্রধান প্রবাহটি সোজা দক্ষিণবাহী হয়ে পড়ছে এসে রূপনারায়ণে, হাওড়া জেলায় বকসী খালের কাছে। ক্ষীণতর দ্বিতীয় একটি শাখা দামোদরের বর্তমান প্রবাহপথ দিয়ে সোজা চলে গেছে। ভাগীরথীতে। আর, তৃতীয় একটি প্রশস্ত প্রবাহ বর্ধমান শহরের পূর্বদিক স্পর্শ করে, বোধ হয় গাঙ্গুর নদীর প্রবাহ পথ বেয়ে, সোজা গিয়ে পড়েছে ভাগীরথীতে, কালনার কাছে। দামোদরের এই প্রবাহটিই কেতকাদাস-ক্ষেমানন্দর বাঁকা দামোদর, যার জল, ক্ষেপানন্দ বলছেন, “গঙ্গার জলে মিলিয়া” গেল।

 

রূপনারায়ণ

দামোদর-প্রসঙ্গে এইমাত্র দেখা গেল, আগে যাই হোক, সপ্তদশ শতকে দামোদরের প্রধান প্রবাহ হাওড়া জেলার বকসী খাল বেয়ে রূপনারায়ণে এসে পড়েছে, এবং রূপনারায়ণের প্রবাহ কোলাঘাট হয়ে (তমলুক শহরের ১৫ মাইল উজানে) গোয়াখালির কাছে এসে ভাগীরথীতে পড়েছে, বর্তমান হুগলী-পয়েন্ট-এর উলটো দিকে। ভাগীরথীর এই সংযোগ-স্থলের ১২ মাইল উজানে বর্তমান তমলুক শহর। তবে প্রাচীন তাম্রলিপ্ত নগর-বন্দরের প্রত্নবস্তু তমলুক শহর থেকে যত না আহৃত হয়েছে তার দশগুণ বেশি আহৃত হয়েছে শহর থেকে বেশ দূরে দূরে, নানা স্থানে, এবং সে-সব কোনো কোনো স্থান ৮/৯ মাইল দূরে। কাজেই, বর্তমান তমলুক শহরই যে প্রাচীন তাম্রলিপ্তের একতম প্রতিনিধি তা খুব জোর করে বলা যায় না। যাই হোক, বর্তমানে তমলুক শহর যে-নদীর উপর বা যে-উপত্যকায় অবস্থিত তার নাম রূপনারায়ণ; অন্তত রেনেল সাহেবের (মধ্য অষ্টাদশ শতাব্দী) সময় থেকে।

যেহেতু বর্তমান তমলুক শহরের অবস্থিতি রূপনারায়ণ-উপত্যকায়, প্রত্নতাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিকরা মেনে নিয়েছেন যে, প্রাচীন তাম্রলিপ্তও এই নদীটির উপর, সমুদ্র-মোহনার অনতিদূরে অবস্থিত ছিল। একটা কারণ ছিল বোধহয় য়ুয়ান চোয়াঙের সাক্ষ্য, “তাম্রলিপ্ত ছিল artif inlet of the sea-5 °is

এ-সম্বন্ধে অন্য যে-সব সাক্ষ্য আমাদের জানা আছে তা একত্র করে আর একবার। এ-প্রসঙ্গটি বিচার-বিবেচনা করে দেখা যেতে পারে। ‘মৎস্যপুরাণের সাক্ষ্যে মনে হয়, তাম্রলিপ্তর অবস্থিতি ছিল (সুহ্ম দেশে) ভাগীরথীর পশ্চিমতীরে, ভাগীরথীর কোনো শাখার তীরে নয়। খ্ৰীষ্টীয় দ্বিতীয় শতকে টলেমি পরিষ্কার, দ্ব্যর্থহীনভাবে বলছেন Tamalites নগর অবস্থিত ছিল main river Ganga-র উপর, যে-নদীর উপর অবস্থিত ছিল অন্যতম সু-প্রসিদ্ধ নগর Pallimbothra বা পাটলীপুত্র। ষষ্ঠ-সপ্তম শতক পর্যন্ত, অর্থাৎ ফা-হিয়েন-য়ুয়ান-চোয়াঙ–ইৎসিঙের কাল পর্যন্ত যে তাহাই ছিল এমন মনে না করবার কোনো কারণ আমি দেখছিনে।

যাই হোক, পরবর্তীকালের সাক্ষ্য কী তা দেখা যেতে পারে। প্রায় হাজার বছর পরও Gastaldi (১৫৬১) ও Jao de Barros (১৫৫০) নদীটির নাম বলছেন। গঙ্গা; একশ’ বছর পরও (১৬৫০) Blaev নামটি লিখছেন গুয়েঙ্গা (Guenga)। সপ্তদশ শতাব্দীর অন্যান্য সাক্ষ্যে এবং ১৭০৩ খ্ৰীষ্টাব্দের একটি নকশায় সর্বত্রই নদীটির নাম দেওয়া হচ্ছে সংলগ্ন শহরটির নামানুসারে : Tamalee, Tomberlee, Tümbolee, Tombolee, Tumberleen ইত্যাদি। ১৬৭০ খ্রীষ্টাব্দেও Valentin নদীটির নাম বলছেন, পত্রিঘাটা, অর্থাৎ পত্রঘাটার পাশ দিয়ে যে-নদীটি বয়ে যেতো। একজনও কেউ কিন্তু রূপনারায়ণ বলছেন না। রেনেলই সর্বপ্রথম বলছেন, নদীটির নাম রূপনারায়ণ, “falsely called the old Ganges”।

‘মৎস্যপুরাণ’, টলেমি থেকে শুরু করে সকলেই ভুল করেছেন, আর রেনেল সাহেবই একমাত্র ব্যক্তি যিনি যথার্থ বলেছেন, এমন আমি মনে করতে পারছিনে। অবশ্যই তার কালে তমলুকের অবস্থিতি রূপনারায়ণের উপর, গঙ্গার উপর নয়, এবং সপ্তদশ থেকেই, হয়ত তার আগে থেকেই, গঙ্গা পূর্বদিকে সরে যেতে শুরু করেছিল, এবং সঙ্গে সঙ্গে দামোদর, রূপনারায়ণ ইত্যাদি ছোটনাগপুর পার্বত্য অঞ্চল-নিঃসৃত অন্যান্য নদনদীগুলিও। কিন্তু ষোড়শ শতকেও তমলুক-তম্বোলি যে একদা গঙ্গার উপরই অবস্থিত ছিল সে-স্মৃতি নিশ্চয়ই বেশ জাগবৃক ছিল, যেহেতু সে-স্মৃতি খুব পূর্বগত কিছু ছিল না। নইলে জাও দ্য ব্যারোস, গ্যাস্টিলডি, ব্ৰেভ্‌ নদীটিকে গঙ্গা কিছুতেই বলতেন না।

কিন্তু যে তাম্রলিপ্তর কথা আমি বলছি সে-তো আরও হাজার বছরের আগেকার কথা। সে-তাম্রলিপ্ত যে গঙ্গা-ভাগীরথীর উপরই ছিল এবং সেই বন্দর-নগর যে সমুদ্র-মোহনা থেকে খুব বেশি দূরে ছিল না, এ-সম্বন্ধে সন্দেহ করবার কোনো কারণ দেখিনে। সে-বন্দর থেকে বেশ বড় একটি সমুদ্রগামী জাহাজে চড়ে ফা-হিয়েন সিংহলে গিয়েছিলেন।

ত্ৰিশ বছর আগে যখন ‘বাঙালীর ইতিহাস’-এর নদনদী প্রসঙ্গ লিখেছিলাম তখন ইঙ্গিত করেছিলাম, গঙ্গা-ভাগীরথী। খুব প্রাচীনকাল থেকেই ক্রমশ খুব ধীরে ধীরে পূর্বদিকে সরে যাচ্ছে, যত দক্ষিণে নুরম মাটিতে নামছে তত বেশি সরে যাচ্ছে, এবং তার সঙ্গে সঙ্গে ছোটনাগপুর সাঁওতালভূমি-মানভূমের পাহাড় থেকে যে সব নদনদী নিঃসৃত হয়ে, সাধারণত পূর্ব-দক্ষিণবাহিনী হয়ে গঙ্গা-ভাগীরথীতে পড়তে, সেগুলো ক্রমশ দীর্ঘািয়ত হচ্ছে। আমার এই ইঙ্গিতে পশ্চাতে যুক্তি বিশেষ কিছু ছিল না, ছিল শুধু মৎস্যপুরাণোক্ত-উক্তি ভাগীরথীর বিন্ধাশৈলশ্রেণী গাত্রে প্রতিহত হবার কথা, আর ছিল ফরাক্কা থেকে শুরু করে দক্ষিণে সমস্ত গঙ্গা-ভাগীরথীর পশ্চিম তীরের ব্যক্তিগত স্থানীয় পর্যবেক্ষণ।

সম্প্রতি আমার সুযোগ হ’লো পশ্চিম বঙ্গ-সরকার কর্তৃক প্রকাশিত তাদের হাওড়া ও হুগলী জেলার ডিস্ট্রিক্‌ট গেজেটিয়ার দুটির প্রথম অধ্যায় (General and Physical Aspects) পড়বার, বিশেষ করে ভূগোল ও ভূগোল বিষয়ক অংশটি। এই অংশটি কে লিখেছেন, জানিনে, কোথাও কিছু উল্লেখ নেই। কিন্তু যে-ই লিখে থাকুন তাকে প্রকাশ্যে সাধুবাদ জানাচ্ছি। পশ্চিম-বাঙলার নদনদীগুলি সম্বন্ধে এমন বিশদ, সুন্দর, সুশৃঙ্খল ভৌগোলিক-ঐতিহাসিক আলোচনা আর কোথাও আমি দেখিনি। রচনাটি পাঠ করে আমি উপকৃত হয়েছি। আমার এখন মনে হচ্ছে, ত্রিশ বছর আগে আমি যা অনুমান করেছিলাম, ভূতত্ত্ব ও ভূগোলের দিক থেকে সে অনুমান হয়তো একান্ত মিথ্যা নাও হতে পারে। ছোটনাগপুর পাহাড়-নিঃসৃত নদনদীগুলির কথা বলতে গিয়ে লেখক বলছেন,

“… ages ago the Damodar used to flow directly into epicontinental sea, an extension of the Bay of Bengal. As the Gangetic delta formed, the main western branch of the Ganges, namely, the Bhagirathi, intercepted the Damodar Group or rivers which were forced to form subsidiary deltas higher up their Courses … its (Damodar’s) deltaic action is not dependent on the tides but starts much higher up at places where it can no longer carry the excess charge of sand that it brings down from the hills, and so drops it on the bed …”

এই উদ্ধৃতিটি হুগলী জেলা গেজেটিয়ারের (১৯৭২) প্রথম অধ্যায় থেকে (৩১ পৃ)। হাওড়া জেলা গেজেটিয়ারের (১৯৭২) প্রথম অধ্যায়ে (১১ পৃ) কথাটা আরও স্পষ্ট করে বলা হয়েছে; নীচে তা উদ্ধার করছি।

“When the epicontinental sea covered the tract now forming the Howrah district, the Bhagirathi joined the various sub-deltas of the Chotanagpur rivers and pushed the Gangetic delta towards the sea and thus intercepted the peninsular streams, which, in their turn, pushed the Bhagirathi to the east by the detritus they carried. The sudden bends of the Bhagirathi below Kalna, of the Damodar below Burdwan, of the DWarakeshar near Arambagh, of the Silai above Ghiatal and of the Haldia near the saline soil limit, seem to justiy this conclusion. This abrupt bends were most probably the debouching points of the Chotanagpur rivers into the ancient channel of the Bhagirathi or the epicontinental sea. As the delta face advanced Southwards the braided Channels of the Bhagirathi Vanished… ”

স্বভাবতই মনে হয়, গঙ্গা-ভাগীরথী বইতো আরও পশ্চিম ঘেঁষে। গাঙ্গেয় ব-দ্বীপ যত রচিত হয়েছে, উপসাগর সরে গেছে, তত, গঙ্গা-ভাগীরথী ও ধীরে ধীরে সরে গেছে, তত পূর্বে। দামোদর-গোষ্ঠীর নদীগুলির ব-দ্বীপে যে স্রোত-তাড়িত পাথুরে বালি ও পলিমাটি জমা হতো তার ঘন, ভাঙা চাপ এই সরে যাওয়ার একটা কারণ হওয়া বিচিত্র নয়। এই পুবে সরে সরে যাওয়া এবং দামোদর-গোষ্ঠীর নদীগুলির দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হওয়া এ খাত-থেকে ও খাতে, ও খাত থেকে আর এক খাতে ধাবমান হওয়া সমস্তই যেন মনে হয়, নিম্নতম প্রবাহে গঙ্গা-ভাগীরথীর ক্রমশ পূর্বশায়ী হওয়ার সঙ্গে জড়িত। উত্তরতর প্রবাহে, অর্থাৎ উত্তর বর্ধমান ও উত্তর মুর্শিদাবাদের উত্তরে তা হয়নি; তার প্রধান কারণ, সে-ভূমি literitic, দৃঢ়, কঠিন, সে মাটি বঙ্গোপসাগর-তাড়িত, গাঙ্গেয় ব-দ্বীপকৃত নরম পলিমাটি নয়।

 

রক্তমৃত্তিকা মহাবিহার

তাম্রলিপ্তি থেকে দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার দ্বীপ-উপদ্বীপ ও দেশগুলিতে যাবার সমুদ্রপথের বর্ণনা-প্রসঙ্গে মালয়-উপদ্বীপে প্রাপ্ত জনৈক মহানাবিক বুদ্ধগুপ্তের নামাঙ্কিত একটি লেখার উল্লেখ করেছিলাম। বুদ্ধগুপ্ত রক্তমৃত্তিকার অধিবাসী ছিলেন; তিনি মালয়ে গিয়েছিলেন বাণিজ্যব্যাপদেশে। যাত্রা করেছিলেন রক্তমৃত্তিকা মহাবিহারের আশীৰ্বাদ নিয়ে, এ-সব সমস্তই ঐতিহাসিক মনন-কল্পনাসিদ্ধ। সেখানে ভুল করিনি। কিন্তু লিখেছিলাম, “এই রক্তমৃত্তিকা মুর্শিদাবাদ জেলার রাঙ্গামাটি (য়ুয়ান-চোয়াঙের লো-টো-মো-চিহ) বা চট্টগ্রাম জেলার রাঙ্গামাটিও হইতে পারে; শেষেরটি হওয়াই অধিকতর সম্ভব।” তখন মনে হয়েছিল, চট্টগ্রামের রাঙ্গামাটি (তারও অর্থ রক্তমৃত্তিকা) মালয়ের কাছাকাছি; সুতরাং রক্তমৃত্তিকা সে-রাঙ্গামাটি হবার সম্ভাবনা বেশি। কিন্তু আমার এ-অনুমান ভুল। এখন আর সন্দেহ করবার কারণ নেই যে, মহানবিক বুদ্ধগুপ্ত লিপিকথিত রক্তমৃত্তিক কর্ণসুবর্ণান্তর্গত, য়ুয়ান-চোয়াঙ-কথিত লো-টো-মো-চিহ্ন। য়ুয়ান-চোয়াঙ বলে গেছেন, এই লো-টো-মো-চিহতে ছিল একটি বৌদ্ধবিহার। এখন আর কোনও সন্দেহ নেই যে, মহানাবিক বুদ্ধগুপ্ত তদানীন্তন গঙ্গা-ভাগীরথী সমীপবর্তী, কর্ণসুবর্ণান্তৰ্গত রক্তমৃত্তিকা মহাবিহারের ভিক্ষুসংঘের আশীৰ্বাদ নিয়ে গিয়েছিলেন বাণিজ্যব্যাপদেশে, জীবনোপায়-সমৃদ্ধির সন্ধানে, অন্য কোনও স্থানের অন্য কোনও মহাবিহার থেকে নয়। য়ুয়ান-চোয়াঙের বিবরণ যে কত বাস্তবানুগ, এই আবিষ্কার তার অন্যতম প্রমাণ।

এই স্থির, ধ্রুব ঐতিহাসিকোক্তি করা সম্ভব হলো কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগে, আমার প্রাক্তন ছাত্র ডাকটর সুধীররঞ্জন দাশের উদ্দীপনা ও নেতৃত্বে মুর্শিদাবাদ জেলার চিরুটি গ্রাম-সন্নিহিত, প্রাচীন কর্ণসুবর্ণের অন্তর্গত রাঙ্গামাটি অঞ্চলের রাজবাড়িডাঙ্গার উৎখননের ফলে। এই উৎখনন থেকে পাওয়া গেছে। ষষ্ঠ-সপ্তম খ্ৰীষ্টীয় শতাব্দীর কিছু কিছু প্রত্নবস্তু, একাধিক বীেদ্ধমন্দির ও বিহারের কিছু প্রত্নাবশেষ এবং একাধিক মৃৎফলক যাতে পরিষ্কার খোদিত আছে রক্তমৃত্তিকা মহাবিহারের নাম। গোল শীলমোহর ফলকটির উপরিভাগে বৌদ্ধ ধৰ্মচক্র; তার দুই পাশে মুখোমুখি উপবিষ্ট দুটি হরিণ; দৃশ্যটি সারনাথ মৃগবিহারে বুদ্ধদেবের ধর্মচক্রপ্রবর্তন মাির প্রতীক। ফলকটির নীচের অংশে দুটি লাইন লেখা জীৱন্তৰ্ভুক্তিকা মহাবস্থা। পিয়ার্থ ভক্ষু সংঘস্য।

 

জনপদ-বিভাগ সম্বন্ধে নূতন তথ্য

নবাবিষ্কৃত তাম্রশাসনগুলির ভেতর শ্ৰীচন্দ্রের পশ্চিমভাগ (শ্ৰীহট্ট) লিপি এবং লড়হচন্দ্র ও গোবিন্দচন্দ্রের ময়নামতী লিপি তিনটিতে জনপদ-বিভাগ সম্বন্ধে কিছু কিছু নূতন তথ্য জানা যাচ্ছে। যেমন, পুণ্ড্রবর্ধনভূক্তির বিস্তৃতি সম্বন্ধে, পট্টিকের বা পট্টিকেরক সম্বন্ধে। পশ্চিমভাগ লিপিটিতে দেখছি, দশম শতাব্দীতে শ্ৰীহট্টও পুণ্ড্রবর্ধন (পৌণ্ড্র) ভুক্তির সমতট মণ্ডলের অন্তৰ্গত। লড়হচন্দ্রের প্রথম পট্টোলীটিতে জানা যাচ্ছে, পট্টিকেরকেরও অবস্থিতি ছিল (একাদশ শতাব্দী) পৌণ্ড্রভুক্তির সমতট মণ্ডলে, এবং এই পট্টিকেরকে লড়হচন্দ্র লড়হমাধব-ভট্টারকের একটি মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

 

দক্ষিণ-রাঢ় ।। ভুরসুট-ভুরিশিট-ভুরসিট = ভূরিসৃষ্টি ভূরিশ্রেষ্ঠিক-ভূরিশ্রেষ্ঠী

এই অধ্যায়ে একাধিক বার এবং অন্য দু’একটি অধ্যায়ে ভুরসুট বা ভূরিশ্রেষ্ঠী গ্রাম বা অঞ্চলের কথা বলেছি, এবং এক জায়গায় বলেছি। এই গ্রাম বা অঞ্চলটির অবস্থান ছিল হাওড়া জেলায়, অন্যত্র বলেছি, হুগলী জেলায়।

কথাটা একটু পরিষ্কার করে বলা দরকার। মধ্যযুগীয় বাঙালীর ইতিহাসে দেখতে পাচ্ছি, ভুরসুট বলে গ্রাম যেমন আছে তেমনই ভুরসুট বলে একটি পরগণাও আছে, এবং সে-পরগণা বর্তমান হাওড়া ও হুগলীর জেলার নানা অঞ্চল জুড়ে বিস্তৃত। এখনও ভুরসুট বা ভুরশুট বলে দুটি গ্রাম আছে, একটি হাওড়া জেলার উদয়পুর থানার অন্তৰ্গত, আর একটি হুগলী জেলার জঙ্গীপুর থানার। এই দুটি গ্রামই প্রাচীন ভূরিশ্রেষ্ঠীর স্মৃতি বহন করছে, এবং সে-স্মৃতি হাওড়া ও হুগলী জেলার এক বিস্তৃত অঞ্চল জুড়ে বিস্তৃত। এই বিস্তৃত অঞ্চলটাই একসময়ে অধূষিত ছিল ভুরি বা অসংখ্য শ্রেষ্ঠীদের দ্বারা, এই কথাটাই ছিল আমার বক্তব্য। সে-বক্তব্য আজও একই আছে।