০২.১৬ প্রাক-আর্য ধ্যান-ধারণা

এখানেই যে প্রাক-আর্য বাঙালী সমাজের ধর্মকর্মানুষ্ঠানের বিবরণ শেষ হইল তাহা বলা চলে না। বরং বলা উচিত, ইহা সূচনা মাত্র। বস্তুত, এ-সম্বন্ধে আলোচনা-গবেষণা এত কম হইয়াছে যে, রেখা রচনা ছাড়া, কিছুটা ইঙ্গিত দেওয়া ছাড়া বিস্তৃত কিছু বলিবার উপায় নাই। তবু, যেটুকু আমরা জানি, এ-কথা নিঃসংশয়ে বলা যায় যে, বাঙালী সমাজে নারীদের মধ্যে এবং সাধারণ আর্য ব্রাহ্মণ্য পূজাচারের মধ্যে যে সব লৌকিক স্থানীয় অনুষ্ঠানাদি প্রচলিত তাহা প্রায় সমস্তই প্রাক-আর্য কোম-সমাজের দান।

 

প্রাক-আর্য ধ্যান-ধারণা

প্রাক-আর্য কৌম বাঙালী সমাজের ধ্যান-ধারণার কথা আগেই কিছু বলিয়াছি, বর্তমান অধ্যায়ে এবং দ্বিতীয় অধ্যায়ে। ভূতপ্রেতিবাদে বিশ্বাস, পুনর্জন্মবাদে বিশ্বাস, প্ৰজনন শক্তি, যাদুশক্তি প্রভৃতি প্রতীকের উপর দেবত্ব আরোপ এবং তাঁহাদের শুভ-অশুভ নিয়ন্ত্রণ-ক্ষমতায় বিশ্বাস প্রভৃতি সমস্তই তাহাদের ধ্যান-ধারণার অন্তর্গত ছিল। আজও সেই সব ধ্যান-ধারণা বাঙালী সমাজের প্রচলিত ধ্যান-ধারণার উপর প্রভাব বিস্তার করিয়া আছে এবং আমাদের ধর্মকর্মানুষ্ঠানের অনেক আচার-ব্যবহারকে নিয়ন্ত্ৰণ করিতেছে। শ্ৰাদ্ধানুষ্ঠান, পিতৃপুরুষের তর্পণ প্রভৃতি ব্যাপারে যে ধ্যান আমাদের মনন-কল্পনায় তাহার মূলে প্রাক-আর্য কৌম সমাজের বিশ্বাস সক্রিয়, এ-সম্বন্ধে সন্দেহের অবকাশ কম। শ্রাদ্ধের সঙ্গে জড়িত বৃষিকাষ্ঠ ও তাহার বিসর্জন, রান্নার পর কাক ডাকিয়া হবিষ্যান্ন খাওয়ানো, পিণ্ডদান প্রভৃতি সমস্তই আমরা আহরণ করিয়াছি আমাদেরই প্রতিবেশী শবর-পুলিন্দ-কিরাত-সঁওতাল-মুণ্ডা-কোল-ভিলদের নিকট হইতে। মঙ্গলানুষ্ঠানের প্রারম্ভে আভ্যুদয়িক অনুষ্ঠানে মৃত পূর্বপুরুষদের স্মরণ ও তাঁহাদের পূজা ইহাদের ধ্যান-ধারণা হইতেই আহৃত। বাঙলাদেশের বিবাহনুষ্ঠানে হােম, সম্প্রদান ও সপ্তপদীগমন ছাড়া যে-সব স্ত্রী-আচার, লোকাচার প্রভৃতি প্রচলিত তাহাও মূলত এই কৌম সমাজেরই দান। এই আদিমতম ধর্মকর্ম ও ধ্যান-ধারণার উপরই বাঙলার বৈদিক ও পৌরাণিক ব্ৰাহ্মণ্য এবং অবৈদিক বৌদ্ধ, জৈন প্রভৃতি ধর্মের প্রতিষ্ঠা ও প্রসার।