০২.০ আর্যপূর্ব ও আর্যেতর ধর্ম

আর্যপূর্ব ও আর্যেতর ধর্ম

বাঙালীর ইতিহাস বলিতে বসিয়া বাঙলার কথাই বিশেষভাবে বলি; সমস্ত ভারতবর্ষে ছড়াইয়া পড়িয়া লাভ নাই। গ্রন্থারম্ভে এক অধ্যায়ে বলিয়াছি, ভারতীয় আদিবাসীরা অন্যান্য দেশের অনেক আদিবাসীদের মতো, বিশেষ বৃক্ষ, পাথর, পাহাড়, ফল, ফুল, পশু, পক্ষী, বিশেষ বিশেষ স্থান ইত্যাদির উপর দেবত্ব আরোপ করিয়া পূজা করিত; এখনও খাসিয়া, মুণ্ডা, সাঁওতাল, রাজবংশী, বুনো, শবর ইত্যাদি কোমের লোকেরা তাঁহাই করিয়া থাকে। বাঙলাদেশে হিন্দু-ব্ৰাহ্মণ্য সমাজের মেয়েদের মধ্যে, বিশেষত পাড়াগাঁয়ে, গাছপূজা এখনো বহুল প্রচলিত, বিশেষভাবে তুলসী গাছ, সেওড়া গাছ ও বট গাছ। অনেক পূজায় ও ব্ৰন্তোৎসবে গাছের একটা ডাল আনিয়া পুঁতিয়া দেওয়া হয়, এবং ব্রাহ্মণ্যধৰ্মস্বীকৃত দেবদেবীর সঙ্গে সেই গাছটিরও পূজা হয়। আমাদের সমস্ত শুভানুষ্ঠানে যে আম্রপল্লবে ঘটের প্রয়োজন হয়, যে কলা-বৌ পূজা হয়, অনেক ব্ৰতে যে ধানের ছড়ার প্রয়োজন হয়, এ-সমস্তই সেই আদিবাসীদের ধর্মকর্মানুষ্ঠানের এবং বিশ্বাস ও ধারণার স্মৃতি বহন করে। একটু লক্ষ্য করিলেই দেখা যায়, এই সব ধারণা, বিশ্বাস ও অনুষ্ঠান আদিম কৃষি ও গ্রামীণ সমাজের গাছ-পাথর পূজা, প্রজনন শক্তির পূজা, পশুপক্ষীর পূজা প্রভৃতির স্মৃতি বহন করে। বিশেষ বিশেষ ফলমূল সম্বন্ধে আমাদের সমাজে যে সব বিধিনিষেধ প্রচলিত, যে সব ফলমূল- যেমন আক, চাল-কুমড়া, কলা ইত্যাদি— আমাদের পূজাৰ্চনায় উৎসর্গ করা হয়, আমাদের মধ্যে যে নবান্ন উৎসব এবং আনুষঙ্গিক অনুষ্ঠান প্রচলিত, আমাদের ঘরের মেয়েরা যে সব ব্ৰতানুষ্ঠান প্রভৃতি করিয়া থাকেন, বস্তুত, আমাদের দৈনন্দিন অনেক আচারানুষ্ঠানই বাঙলার আদিমতম জন ও কোমদের ধর্মবিশ্বাস ও আচারানুষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত। আমাদের নানা আচারানুষ্ঠানে, ধর্ম, সমাজ ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে আজও ধান, ধানের গুচ্ছ, ধানদুর্বার আশীৰ্ব্বাদ, কলা, হলুদ, সুপারি, পান, নারিকেল, সিন্দুর, কলাগাছ, ঘট, ঘটের উপর আঁকা প্রতীক চিহ্ন, নানা প্রকার আলপনা, গোবর, কড়ি প্রভৃতি অনেকখানি স্থান জুড়িয়া আছে। বস্তুত, আমাদের আনুষ্ঠানিক সংস্কৃতিতে যাহা কিছু শিল্প-সুষমাময় তাহার অনেকখানিই এই আদিবাসীদের সংস্কার ও সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িত। বাঙলাদেশে, বিশেষভাবে পূর্ব-বাঙলায়, এক বিবাহ-ব্যাপারেই পানখিলি, গাত্ৰহরিদ্রা, গুটিখেলা, ধান ও কড়ির স্ত্রী আচার, খৈ ছড়ানো, লক্ষ্মীর ঝাপি স্থাপনা, দধিমঙ্গল প্রভৃতি সমস্তই আদিবাসীদের দান বলিয়া অনুমিত। বস্তুত, বিবাহ-ব্যাপারে সম্প্রদান, যজ্ঞ, এবং সপ্তপদী অর্থাৎ মন্ত্র অংশ ছাড়া আর সবটাই অবৈদিক, অস্মার্ত ও অব্রাহ্মণ্য। অন্যান্য অনেক ব্যাপারেও তাই। পূজাৰ্চনার মধ্যে ঘটলক্ষ্মীর পূজা, ষষ্ঠীপূজা, মনসাপূজা, লিঙ্গ-যোনী পূজা, শ্মশান-শিব ও ভৈরবের পূজা, শ্মশান-কালী পূজা প্রভৃতির প্রায় সব বা অধিকাংশই মূলত এই সব আদিবাসীদের ধর্মকর্মানুষ্ঠান হইতেই আমরা গ্রহণ করিয়াছি, অল্পবিস্তর রূপান্তর ও ভাবান্তর ঘটাইয়া। এই সব আচারানুষ্ঠানের প্রত্যেকটির সুবিস্তৃত বিশ্লেষণ এবং ইহাদের রহস্য উদঘাটন আমাদের সাংস্কৃতিক জনতত্ত্বের আলোচনা-গবেষণার বর্তমান অবস্থায় সম্ভব নয়; মাত্র দুই চারিটি আচারানুষ্ঠানের জীবনেতিহাস আমরা জানি, যেমন চড়কপূজা, হােলী, ষষ্ঠীপূজা, চণ্ডী-দু্র্গা-কালী প্রভৃতি মাতৃকাতন্ত্রের পূজা, মনসাপূজা, পৌষপার্বণ, নবান্ন উৎসব ইত্যাদি। আগেও বলিয়াছি, এবং একটু লক্ষ্য করিলেই দেখা যায়, এই সব আচারানুষ্ঠানের অনেকগুলিই মূলত গ্রামীণ কৃষিজীবী সমাজের প্রধানতম ও আদিমতম ভয়-বিস্ময়-বিশ্বাসের উপর প্রতিষ্ঠিত। সকল কথা বলিবার বা আলোচনা-গবেষণার স্থান ও সুযোগ এই গ্রন্থ নয়, উপায়ও নাই; তবু ইঙ্গিতটুকু ধরিয়া না দিলে বাঙালীর ধর্ম-কর্মানুষ্ঠানের গোড়ার কথাটি, তাহার অন্তর্নিহিত অর্থটি বুঝা যাইবেন।

 

এই ইঙ্গিত ধরিবার উপাদান উপকরণ সুপ্রচুর, এবং তাহা বাঙলার সর্বত্র পথে ঘাটে, বাঙালীর জীবনচর্যার নানাক্ষেত্রে ইতস্তত ছড়াইয়া আছে। সাংস্কৃতিক জনতত্ত্ব লইয়া যাহারা আলোচনা-গবেষণা ইত্যাদি করিয়া থাকেন তাহারা এ-সম্বন্ধে কিছুটা সচেতন, কিন্তু অত্যন্ত ক্ষোভ ও দুঃখের বিষয়, আমাদের ঐতিহাসিকেরা ইতিহাসের দিক হইতে এই সব ইঙ্গিত ফুটাইবার প্রয়ােজনীয়তা আজও খুব স্বীকার করেন না। প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণায় জরিপ ও অনুসন্ধান যেভাবে হইয়া থাকে, এ-ক্ষেত্রে আজও তাহার সূত্রপাতই হয় নাই। অথচ, বহুদিন আগে বহুভাবে রবীন্দ্রনাথ এ-সম্বন্ধে আমাদের সজাগ করিতে চেষ্টা করিয়াছিলেন, এবং তঁহারই প্রেরণায় কিছু কিছু কাজও কেহ কেহ করিয়াছিলেন; কিন্তু সে-কাজ জনবিজ্ঞানসম্মত উপায়ে করা হয় নাই বলিয়া তাহা আজও যথার্থ ফলপ্রসূও হয় নাই।

অথচ, আজিকার দিনে কিংবা আদি ও মধ্যযুগে ‘ভদ্র’, উচ্চস্তরের বাঙালী জীবনে যে ধর্মকর্মানুষ্ঠানের প্রচলন আমরা দেখি ও যাহাঁকে আমরা বাঙালীর ধর্মকর্ম জীবনের বিশিষ্টতম ও প্রধানতম রূপ বলিয়া জানি, অর্থাৎ বিষ্ণু, শিব, সূর্য, দেবী, গণেশ, অসংখ্য বৌদ্ধ, জৈন, শৈব ও তান্ত্রিক বিচিত্র দেবদেবী লইয়া আমাদের যে ধর্মকর্মের জীবন, তাহা একান্তই আর্য-ব্রাহ্মণ্য-বৌদ্ধ-জৈন-তান্ত্রিক ধর্মকর্মের চন্দনানুলেপনমাত্র এবং তাহা, সংস্কৃতির গভীরতা ও ব্যাপকতার দিক হইতে, একান্তই মুষ্টিমেয় লোকের মধ্যে সীমাবদ্ধ। যে ধর্মকর্মময় সাংস্কৃতিক জীবন বাঙালীর জীবনের গভীরে বিস্তৃত, যেমজীবন নগরের সীমা অতিক্ৰম করিয়া গ্রামে কুটিরের কোণে, চাষীর মাঠে, গৃহস্থের আঙিনায়, ফসলের ক্ষেতে, গ্রাম্য-সমাজের চণ্ডীমণ্ডপে, বারোয়ারী তলায়, নদীর পাড়ে বটের ছায়ায়, জনহীন শ্মশানে অন্ধকার অরণ্যে, নৃত্য-সংগীত-পূজা-আরাধনার বিচিত্র আনন্দে, দুঃখ-শোক-মৃত্যুর বিচিত্ৰ লীলায় বিস্তৃত, সেই ধৰ্মকৰ্মময় সংস্কৃতি আর্য-মনের, আর্য ব্ৰাহ্মণ্য-বৌদ্ধ-জৈন—তান্ত্রিক ধর্মকর্মের সাধনা ও অনুষ্ঠানের নীচে চাপা পড়িয়া আছে। এই চাপা পড়ার ফলে কোথাও কোথাও তােহা জীবনের কণ্ঠ ও নিশ্বাসরোধে একেবারে মরিয়া গিয়াছে, তাহার নিম্প্রাণ কঙ্কাল শুধু বর্তমান; কোথাও কোথাও উপরের স্তরের চক্ষুর অন্তরালে আত্মগোপন করিয়া এখনও বাঁচিয়া আছে–নিশীথ অন্ধকারে লোকালয় অতিক্রম করিয়া ভয়কম্পিত হৃদয়ে সুদীর্ঘ সঙ্কটময় পথ ধরিয়া নদীর ধারে বা প্রান্তরের সীমান্তে শ্মশানের ধারে গিয়া লোকালয়েরই লোক সেই সংস্কৃতির পাদমূলে একটি প্রদীপ জ্বালাইয়া তেমনই নিভৃতে গোপনে ফিরিয়া আসে। আবার কোথাও কোথাও নিজেরই প্রাণশক্তির জোরে সে তাহার নিজের একটু স্থান করিয়া লইয়াছে আর্য ধর্মকর্মের একটি প্রাস্তে; আবার অন্যত্র হয়তো প্রাণশক্তির প্রাবল্যে আর্য ধর্মকমের ভাব ও রূপ উভয়ই দিয়াছে বদলাইয়া। এই রুদ্ধ ও মৃত, মরণোন্মুখ অথবা চলমান ধর্মকর্ম স্রোতের সকল চিহ্ন তুলিয়া ধরিবার উপায় এখানে নাই; দুই চারিটি ইঙ্গিত তুলিয়া ধরা চলে মাত্র।

বাঙলাদেশে পল্লীগ্রামের কৃষিজীবনের সঙ্গে যাঁহারা পরিচিত তাহারা জানেন, মাঠে হল চালনার প্রথম দিনে, বীজ ছড়াইবার, শালিধান বুনিবার, ফসল কাটিবার বা ঘরে গোলায় তুলিবার আগে নানা প্রকারের আচারানুষ্ঠান বাঙলার নানা জায়গায় আজও প্রচলিত। এই প্রত্যেকটি অনুষ্ঠানই বিচিত্র শিল্পীসুষমায় এবং জীবনের সুষম আনন্দে মণ্ডিত; কিন্তু লক্ষণীয় এই যে, ইহার একটিতেও সাধারণত কোনও ব্রাহ্মণ পুরোহিতের প্রয়োজন হয়না। জাতিবর্ণ নির্বিশেষে সকলেই এই সব পূজানুষ্ঠানের অধিকারী। নবান্ন উৎসব বা নূতন গাছের বা নূতন ঋতুর প্রথম ফল ও ফসলকে কেন্দ্ৰ করিয়া যে সব পূজানুষ্ঠান আমাদের মধ্যে প্রচলিত তাহার মূলেও একই চিত্তধর্মের একই বিশিষ্ট প্রকৃতি সক্রিয়। শুধু কৃষিজীবনকে আশ্রয় করিয়াই নয়, শিল্পজীবনেও দেখা যায়, বিশেষ বিশেষ দিনে কামারের হাঁপর, কুমোরের চাক, তাঁতীর তীত, চাষীর লাঙ্গল, ছুতোর রাজমিস্ত্রীর কারখাস্ত্র প্রভৃতিকে আশ্রয় করিয়া এক ধরনের ধর্মকর্মনিষ্ঠান আজও প্রচলিত; তাহারই কিছুটা আর্যীকৃত সংস্কৃতরূপ আমরা বিশ্বকর্মপূজার মধ্যে প্রত্যক্ষ করি। কিন্তু মূলত এই ধরনের পূজাচারেও ব্রাহ্মণ-পুরোহিতের কোনও প্রয়োজন হয় না। উৎপাদন যন্ত্রের এই পূজাচারের সঙ্গে আদিবাসীদের প্রজনন শক্তির পূজাচারের সম্বন্ধ অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। যাহাই হউক, এই সব গ্রাম্য কৃষি ও কারুজীবনের পূজাচারকে কেন্দ্ৰ করিয়াই বাঙালীর ধর্মকর্মময় জীবনের অনেক সৃষ্টির আনন্দ ও উদ্যোগ, শিল্পময় জীবনের অনেক মাধুর্য ও সৌন্দর্য, এই সব আচারানুষ্ঠানের অনেক আবহ ও উপচার আমাদের “ভদ্র’স্তরের আর্য-ব্রাহ্মণ্য ধর্মকর্মের সঙ্গে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে অনুসৃত হইয়া গিয়াছে।