০১. যুক্তি / সমন্বয় – ধর্মকর্ম: ধ্যান-ধারণা

যুক্তি / সমন্বয় – ধর্মকর্ম: ধ্যান-ধারণা

যুক্তি

প্রাচীন বাঙালীর ধর্মকর্মগত জীবনের সুস্পষ্ট একটি চিত্ররচনা দুরূহ। স্বভাবতই ধৰ্মকৰ্মগত মানস-জীবন ব্যবহারিক জীবন অপেক্ষা অনেক বেশি জটিল। তাহার উপর, বর্ণ, শ্রেণী ও কেমবিন্যস্ত সমাজে সোঁ-জীবন জটিলতর হইতে বাধ্য। ধর্মকর্ম ভাবনা ও সংস্কার বর্ণ, শ্রেণী ও কোমভেদে পৃথক; একই কালে একই বিশ্বাস বা একই পূজা ইত্যাদির রূপ সমাজের সকল স্তরে এক নয়, বিভিন্নকালে বিভিন্ন দেশখণ্ডে তো নয়ই। তা ছাড়া, নূতন কোনও বিশ্বাস বা সংস্কার বা পূজানুষ্ঠান ইত্যাদি সমাজে সহসা প্রচার লাভ করেনা; তাহার প্রত্যেকটির পশ্চাতে বহুদিনের ধ্যান ও ধারণা, অভ্যাস ও সংস্কার লুকানো থাকে, এবং সমাজের ভিতরে ও বাহিরে নানা গোষ্ঠী, নানা স্তর, নানা কোমের ভক্তি-বিশ্বাস-পূজাচার প্রভৃতির যোগাযোগের একটা সুদীর্ঘ ইতিহাসও আত্মগোপন করিয়া থাকে; কালে কালে সেই ইতিহাস বিবর্তিত হইয়া সমসাময়িক কালের রূপ গ্রহণ করে মাত্র, এবং তাহাও একান্তই সমসাময়িক সমাজ-ভাবনা ও চেতনানুযায়ী, সমসাময়িক সামাজিক শ্রেণী ও স্তর বিশেষ অনুযায়ী। কোনও শ্রেণীগত বা কোমগত বিশ্বাস বা সংস্কারই আবার একান্তভাবে সেই শ্রেণী বা কোমের মধ্যে চিরকাল আবদ্ধ হইয়া থাকে না; অন্যান্য শ্রেণী ও কোম, স্তর ও উপস্তরের সঙ্গে পরস্পর যোগাযোগের ফলে এবং সেই যোগাযোগের শক্তি ও পরিমাণ অনুযায়ী এক শ্রেণী ও কোমর, স্তর ও অংশের ধ্যান-ধারণা, বিশ্বাস, অনুষ্ঠান প্রভৃতি অন্য শ্রেণী ও কোমে, স্তর ও অংশে সঞ্চারিত হয়, এবং দ্রুত বা দীর্ঘ মিলন-বিরোধের ভিতর দিয়া অনবরতই নূতন নূতন ধ্যান-ধারণা, ভক্তি-বিশ্বাস অনুষ্ঠান-উপাচার প্রভৃতি সৃষ্টি লাভ করিতে থাকে। যে শ্রেণী বা কোমের আত্মিক ও ব্যবহারিক শক্তি বেশি সেই শ্রেণী বা কোমের ধর্মকর্মগত জীবন অধিকতর সক্রিয়, এবং তাহারা যেমন অন্য শ্রেণী ও কোমের ধর্মকর্মগত জীবনকে বেশি প্রভাবান্বিত করে, তেমনই নিজেরাও সে জীবন দ্বারা বেশি প্রভাবিত হয়। অনেক সময় দেখা যায়, দুইই একই সঙ্গে সমান গতিতেই চলে এবং সমন্বয় চলিতে থাকে স্কুল লোকচক্ষুর আড়ালে একটা জটিল সমন্বয়ের দিকেই সমানেই চলিতে থাকে।

 

সমন্বয়

ভারতবর্ষের ইতিহাসে এই সমন্বয়ের গতি-প্রকৃতি সমাজবিজ্ঞানীর চােখে বহুদিন ধরা পড়িয়াছে এবং ভারতীয় সাংস্কৃতিক জনতত্ত্ব ও সমাজতত্ত্বের আলাপ-আলোচনা যত অগ্রসর হইতেছে ততই আমরা স্পষ্ট জানিতেছি, আজ আমরা যাকে হিন্দু ধর্মকর্মসাধনা বলিয়া দেখি, বা যাহাকে আর্য-ব্রাহ্মণ্য সাধনা বলিয়া জানি তাহা একদিকে আর্য ও অন্যদিকে প্রাক-আর্য বা অনার্য ধর্মকর্মসাধনার সমন্বিত রূপ মাত্র। অরণ্যচারী হিংস্র উলঙ্গ অর্ধমানবের কোম হইতে আরম্ভ করিয়া কত শ্রেণী, কত স্তর, কত দেশখণ্ডের মানুষের ধর্মকর্মসাধনা যে এই চলমান আর্য-ব্রাহ্মণ্য স্রোতপ্রবাহে তাহাদের ক্ষীণ ও বেগবান প্রবাহ মিশাইয়াছে তাহার ইয়াত্তা নাই। বস্তুত, আর্য-ব্রাহ্মণ্য সাধনায় যথার্থ আর্যপ্রবাহ মূলত ক্ষীণ; ক্ৰমে ক্ৰমে কালে কালে নানা বিচিত্র সংস্কৃতি সেপ্রবাহে , সমন্বিত হওয়ার ফলে আজ সে-প্রবাহ প্রশস্ত ও বেগবান। সচেতন সক্রিয়তায় সমন্বয়ের এই কাজটির নেতৃত্ব গ্রহণ করিয়াছিলেন আর্য-ব্রাহ্মণ্য বা বৌদ্ধ নায়কেরা, এ-কথা যেমন সত্য প্রত্যেক ক্ষেত্রে প্রাথমিক বিরোধটাও তাঁহাদের দিক হইতেই দেখা দিয়াছিল, এ-কথাও তেমন সত্য। কিন্তু, প্রাথমিক বিরোধের পর স্বীকৃতি যখন অনিবার্য হইয়া উঠিল তখন সমন্বয়ের গতি ও প্রকৃতি নির্ধারণের নায়কত্ব তাহারা অস্বীকার করেন নাই। অন্য দিকে, প্রাক-আর্য বা অনার্য আদিবাসীরা যে বিনা বাধায় বা বিনা বিরোধে আর্য বৌদ্ধ বা ব্রাহ্মণ্য ধর্মকর্মের আদর্শ বা অনুষ্ঠান ইত্যাদি গ্রহণ করিয়াছিলেন বা চলমান প্রবাহে নিজেদের ধারা মিশাইয়াছিলেন, তাহাও নয়। জৈব প্রকৃতিই হইতেছে সেই জিনিস যাহা নিজের বিশ্বাস ও সংস্কারকে আঁকরাইয়া ধরিয়া রাখে; চলমান আর্যপ্রবাহে স্বীকৃতি লাভের পরও বহু বিশ্বাস বহু সংস্কার বহু আচারানুষ্ঠান এই জৈব প্রকৃতির বশেই নিজেদের বাঁচাইয়া রাখিয়াছিল। কালে কালে ক্ৰমে ক্ৰমে তাহার কিছু কিছু চলমান প্রবাহে স্বীকৃতিলাভ করিয়া তাহার অঙ্গীভূত হইয়া গিয়াছে, হয় অবিকৃত না হয় বিবর্তিত রূপে। অবান্তর হইলেও উল্লেখ করা প্রয়ােজন, আর্য-অনার্যের এই সমন্বয়ংক্রিয়া আজও চলিতেছে, আর্য-ব্রাহ্মণ্য ধর্মকর্ম আজও লোকায়ত অনার্য ধর্মকর্মের অনেক আচারানুষ্ঠান, দেবদেবী ধীরে ধীরে নিজের কুক্ষিগত করিতেছে, কোথাও তাঁহাদের চেহারায় আমূল পরিবর্তন করিয়া, কোথাও একেবারে অবিকৃত রূপে। বাঙলাদেশে মোটামুটি খ্ৰীষ্টোত্তর পঞ্চম-ষষ্ঠ-সপ্তম শতকে, আর্যধর্মের প্রবাহ প্রবলতর হওয়ার সময় হইতেই সদ্যোক্ত সমন্বয় ক্রিয়া চলিতে আরম্ভ করে; মধ্যযুগে এই সমন্বয়-সাধনা সামাজিক চেতনার অন্তর্ভুক্ত হয় এবং আজও তা চলিতেছে লোকচক্ষুর অগোচরে।

বাঙালীর ইতিহাসের আদিপর্বে এই সমন্বয় সাক্ষ্য খুব বেশি উপস্থিত নাই, কিন্তু তখনকার দিনের বাঙালী সমাজে ও বাঙলা সংস্কৃতিতে এর চেয়ে বড় সত্য কমই আছে। বস্তুত, বাঙালীর ধর্মকর্মের গোড়াকার ইতিহাস হইতেছে। রাঢ়-পুণ্ড্র-বঙ্গ প্রভৃতি বিভিন্ন জনপদগুলির অসংখ্য জন ও কোমের, এক কথায় বাঙলার আদিবাসীদেরই পূজা, আচার, অনুষ্ঠান, ভয় বিশ্বাস, সংস্কার প্রভৃতির ইতিহাস। শুধু বাঙালীরই বা বলি কেন, ভারতবর্ষের সকল প্রদেশের লোকদের ধর্মকর্ম সম্বন্ধেই এ-কথা সত্য। এ-তথ্য সর্বজনস্বীকৃত যে, আর্য-ব্রাহ্মণ্য বা বৌদ্ধ, জৈন ইত্যাদি সম্প্রদায়ের ধর্মকর্ম, শ্ৰাদ্ধ, বিবাহ, জন্ম, মৃত্যু প্রভৃতি সংক্রান্ত বিশ্বাস, সংস্কার ও আচারানুষ্ঠান, নানা দেবদেবীর রূপ ও কল্পনা, আহার-বিহারের ছোয়াছুয়ি অনেক কিছুই আমরা সেই আদিবাসীদের নিকট হইতেই আত্মসাৎ করিয়াছি। বিশেষভাবে, হিন্দুর জন্মান্তরবাদ, পরলোক সম্বন্ধে ধারণা, প্রেততত্ত্ব, পিতৃতর্পণ, পিণ্ডদান, শ্ৰাদ্ধাদি সংক্রান্ত অনেক অনুষ্ঠান, আভ্যুদয়িক ইত্যাদি সমস্তই আমাদেরই প্রতিবাসীর এবং আমাদের অনেকেরই রক্তস্রোতে বহমান সেই আদিবাসী রক্তের দান। হিন্দুর ধর্মকর্মের গােড়ায় এ কথাটা না জানিলে অনেকখানিই অজানা থাকিয়া যায়।