১৩. ভাব-দৃষ্টি : বৰ্ণভেদ বিন্যাস

ভাব-দৃষ্টি : বৰ্ণভেদ বিন্যাস

যে বিচিত্ৰ বৰ্ণভেদ-বিন্যাসের কথা এতক্ষণ বলিলাম, পঞ্চম শতকের পর হইতেই এই ভেদ-বিন্যাস ক্রমশ বিস্তৃত হইতে আরম্ভ করে এবং সেন-বৰ্মণ পর্বে তাহা দৃঢ় ও অনমনীয় হইয়া সমাজকে স্তরে-উপস্তরে বিভক্ত করিয়া সমগ্র সমাজ-বিন্যাস গড়িয়া তোলে। কিন্তু তাহা সত্ত্বেও দেশে এমন মানুষ, এমন সাধক ছিলেন যাঁহারা মানুষে মানুষে এই ভেদ-সংঘাত অস্বীকার করিয়া তাহার উর্ধ্বে উঠিতে পারিয়াছিলেন। জাতিভেদ, বৰ্ণভেদের দুর্ভেদ্য প্রাচীর তাঁহাদের উদার সমদৃষ্টিকে আচ্ছন্ন করিতে পারে নাই। সমস্ত জাত বৰ্ণ ভেদ করিয়া, তাহাকে অতিক্রম করিয়া মানুষের মানব-মহিমা ঘোষণাই ছিল তাঁহাদের অধ্যাত্মচিন্তা ও জীবন-সাধনার আদর্শ। এই আদর্শ সব চেয়ে বেশি প্রচার করিয়াছেন ভাগবতধর্মী এবং সহজযানী সাধকেরা। সমাজে তাহাদের আদর্শ কতটা অনুসৃত হইয়াছিল বলা কঠিন, খুব যে হইয়াছিল, এমন প্রমাণ নাই, কিন্তু সে আদর্শ যে অধ্যাত্মচিন্তায় এবং কিছু কিছু লোকের জীবন-সাধনার কাজে লাগিয়াছিল, সে-সম্বন্ধে সন্দেহ করা চলে না। অন্তত বিশেষ বিশেষ ধর্মগোষ্ঠীতে জাতিভেদ বর্ণভেদের কোনও বালাই-ই ছিল না, একথা মানিতেই হয়। ভাগবত তো খুব জোরের সঙ্গেই বলিয়াছেন, ভগবানের কাছে সকলেরই সমান অধিকার, এমন-কি কিরাত, হূণ, অন্ধ্র, পুলিন্দ, পুক্‌কশ, আভীর, সুহ্ম, যবন, খসদেরও। প্রাচীন বাঙলায় এ-কথাটা খুব ভালো করিয়া জোরের সঙ্গে বলিয়াছেন বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যরা এবং ভবিষ্যপুরাণের ব্ৰহ্মপর্ব যদি বাঙলাদেশে রচিত হইয়া থাকে তাহা হইলে ঐ ভাবের ভাবুকেরাও। বজ্রসূচিকোপনিষৎ নামে একটি গ্রন্থ রচিত হইয়াছিল বোধ হয় বাঙলাদেশেই, এবং মনে হয় এই উপনিষদটি বজ্রযানী বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের রচনা। গ্রন্থটি ৯৭৩-৯৮১ খ্ৰীষ্ট তারিখে চীনা ভাষায় অনুদিত হয়। এই গ্রন্থেও প্রচণ্ড যুক্তিতর্কে জাতিভেদের যুক্তি খণ্ডন করা হইয়াছে।

সরহপাদের দোহাকোষের প্রথমেই বলা হইয়াছে, ব্ৰাহ্মণ [সহজধর্মের] রহস্য জানে না। সংস্কৃত টীকাকার বলিতেছেন, দ্বিজবর্ণের সংস্কার পালনেই যদি জাতি হয় তবে সংস্কার পালন তো সকলেরই হইতে পারে, তাহাতে জাতি সিদ্ধ হয় না— তস্মাৎ না সিধ্যতি জাতিঃ। দোহাকোষের টীকার অন্যত্র আছে, শূদ্র বা ব্ৰাহ্মণ বলিয়া বিশেষ কিছু জাতি নাই, সমস্ত লোক একই জাতিতে নিবদ্ধ, ইহাই সহজ ভাব— তয়া ন শূদ্রং ব্রাহ্মণাদি জাতি বিশেষং ভবতি সিদ্ধং। সর্বে লোকা একজাতি নিবদ্ধাশ্চ সহজমেবিতি ভাবঃ ৷ ভবিষ্যপুরাণের ব্ৰহ্মপর্বে জাতিভেদের বিরুদ্ধে সুদীর্ঘ যুক্তি দেওয়া হইয়াছে এবং সর্বশেষে বলা হইয়াছে, চার বর্ণই যখন এক পিতার সন্তান তখন সকলেরই একই জাতি; সব মানুষের পিতা যখন এক তখন এক পিতার সন্তানদের মধ্যে জাতিভেদ থাকিতেই পারে না। বজ্রসূচিকোপনিষদেও খুব জোরের সঙ্গে বর্ণ-ব্রাহ্মণত্বের দাবি অস্বীকার করা হইয়াছে। বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যদের বেশির ভাগ সম্বন্ধই তো শবর-শবরী, ডোম-ডোমিনী, চণ্ডাল-চণ্ডালিনীদের সঙ্গে।

কিন্তু, এই উদার সমাদৃষ্টি ও অধ্যাত্ম-ভাবনা সামাজিকভাবে সমাজে গৃহীত হয় নাই, ব্যক্তিগত অধ্যাত্ম ও ধর্মসাধনার ক্ষেত্রেই যেন সীমাবদ্ধ ছিল। ব্যক্তিজীবনে এই উদার আদর্শের ধ্যান ও স্পর্শ অনেক মানুষকে জীবনসাধনায় অগ্রসর করিয়াছে, প্রাচীন বাঙলায় এমন দৃষ্টান্ত বিরল নয়। পাল-যুগে বৌদ্ধ সহজধর্মের উদার আদর্শ কিছুটা সামাজিক জীবনেও সক্রিয় ছিল, কিন্তু সাধারণভাবে আমাদের দৈনন্দিন সামাজিক আচার, বিচার ও ব্যবহারের ক্ষেত্রে এবং সমাজ-বিন্যাসে এই উদার মানবাদর্শের স্বীকৃতি বিশেষ ছিল বলিয়া মনে হয় না।