২.৫ বিয়ের আনুষঙ্গিক আয়োজন

বিয়ের আনুষঙ্গিক আয়োজন

বিয়ের আনুষঙ্গিক আয়োজনগুলো যত সহজে সারা যাবে বলে মনে করেছিলেন হাসমত আলী, কাজে নেমে দেখলেন সেগুলো তত সহজ নয়। টাকা-পয়সার স্বল্পতা পরিকল্পনাগুলোকে বানচাল করে দেয়। তবু বড় প্রসন্ন হাসমত আলী।

মেয়ের জন্যে এমন পাত্র কোনদিন আশা করেননি তিনি। কল্পনাও ছিলো না। তবে, যেদিন থেকে মনসুর এ বাড়িতে আসা-যাওয়া শুরু করে সেদিন থেকে সালেহা বিবির সঙ্গে এ বিষয়ে মাঝে মাঝে আলোচনা করেছেন তিনি। আশা নিরাশায় দুলেছেন দুজনে। স্বপ্ন দেখেছেন।

অবশেষে স্বপ্ন তাদের সফল হতে চলেছে।

ভয় ছিলো একটি, সে হলো মাহমুদ। তাঁরা ভেবেছিলেন মাহমুদ এ বিয়েতে বিরোধিতা করবে। ঝগড়া বাধাবে। অকারণে হৈ চৈ করবে। বাধা না দিলেও প্রতিবাদ অবশ্য করেছে মাহমুদ। বলেছে–তোমাদের মেয়ের বিয়ে দেবে সে তোমরা জানো, তোমাদের মেয়ে জানে। আমাকে শুধু শুধু জিজ্ঞেস করতে এসেছো কেন মা?

সালেহা বিবি বলেছেন সে কি, তোকে জিজ্ঞেস করবো নাতো কাকে জিজ্ঞেস করবো, তুই হলি বড় ছেলে।

মায়ের কথা শুনে হেসেছে মাহমুদ। হাসি থামিয়ে গম্ভীর গলায় বলেছে, দেখো মা, আমার মতামত যদি চাও তাহলে বলবো, এ বিয়েতে মত নেই আমার। অবশ্য আমার মতামতের ওপর ওটা নাকচ করে দাও, সেটা আমি চাই নে।

এ আবার কেমনতর কথা হলো, সালেহা বিবি অবাক হয়ে বললেন, তোর মত থাকবে না কেন, এর চেয়ে ভালো বর আর কোথায় পাবি ওর জন্যে?

মাহমুদ বললো, মা, কেন মিছামিছি আমার মেজাজটা চড়াচ্ছো। ভালো খারাপের কতটুকু তুমি জানো? যে লোকটার সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দেবে বলে আহ্লাদে আটখানা হচ্ছো তার চরিত্র বলে কোনো পদার্থ আছে কিনা খোঁজ নিয়েছো?

দেখ মুখে যা আসে তা বলে দিস না, একটু ভাবিস। সালেহা বিবি বিরক্তির সাথে বললেন, কে বললো তোকে ওর চরিত্র খারাপ?

মুখ কালো করে অনেকক্ষণ চুপ করে রইলো মাহমুদ। তারপর ধীরে ধীরে বললো, মা, তুমি বুঝবে না, মরিয়মকে ডেকে জিজ্ঞেস করো এ দেশে কটা লোক আছে যে তার চরিত্র ঠিক রেখে বড়লোক হতে পেরেছে? অন্যকে ফাঁকি দিয়ে, ধোঁকাবাজ আর লাম্পট্য করে, শোষণ আর দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে টাকা রোজগার করে বড়লোক হয়েছে সব। তাদের আবার চরিত্র! ও-সব বাজে কথা আমাকে শুনিয়ো না মা।  তোমাদের মেয়ে তোমরা বিয়ে দাওগে, আমার কোন মতামত নেই।

পকেট থেকে একটা বিড়ি বের করে ধরালো মাহমুদ।

উঠে দাঁড়িয়ে চলে যাবার পথে মা আস্তে করে বললেন, তোমার মত থাকুক কি, না থাকুক এ বিয়ে হবে।

মা চলে গেলে, একটা বই খুলে বসে বার কয়েক বিড়িতে জোর টান দিলো মাহমুদ।

ওর মতামতটা মরিয়মের কাছেও অজানা ছিলো না। তাই, পারতপক্ষে মাহমুদের সামনে আসে না সে। যতক্ষণ মাহমুদ ঘরে থাকে ততক্ষণ খুব সাবধানে চলাফেরা করে মরিয়ম। কখনো সামনে পড়ে গেলে, লজ্জায় চোখমুখ লাল হয়ে আসে। পাশ কাটিয়ে একপাশে সরে যায় সে।

 

আরেকটা ব্যাপারে বড় শঙ্কিত হয়ে পড়েছিলো মরিয়ম। আনিসা বেগমকে কি করে মুখ দেখাবে সে। সেলিনাকে মনসুরের কাছে বিয়ে দেবার স্বপ্ন দেখেছেন তিনি। কথা প্রসঙ্গে মনের বাসনাটা জানিয়েও ছিলেন মরিয়মকে। তাকে বড় বিশ্বাস করতেন তিনি। অবশেষে যেদিন মরিয়মের সঙ্গে বিয়ের কথা শুনবেন সেদিন ওর সামনে কি করে গিয়ে দাড়াবে মরিয়ম?

ইদানীং সেলিনাকে পড়াতে যায় সে।

সম্পর্কটা আগের মতই আছে। কিন্তু আর কতদিন এভাবে চলবে সেটা জানে না মরিয়ম। একদিন নিশ্চয় খবরটা যাবে ওদের কানে। যাক, সে নিয়ে বেশি মাথা ঘামায় না সে। তার চেয়ে বিবাহিত জীবনের সুন্দর কল্পনা করতে ভালো লাগে। ভয় আর আনন্দ মেশানো এক অপূর্ব অনুভূতি।

হাসিনা সবচেয়ে খুশি।

বিয়ের পর ওকে একটা ক্যামেরা কিনে দেবে কথা দিয়েছে মনসুর। তসলিমের কাছে ও ছবি তোলা শিখছে। তার সঙ্গে বসে আপার বিয়ের সময় ঘরগুলো কিভাবে সাজাবে তা নিয়ে পরিকল্পনা করে সে। একটা বাঁশের গেট তৈরি করতে হবে বাড়ির সামনে। কিছু পটকা বাজী কিনবে ওরা। আর কয়েক দিস্তা লাল নীল কাগজ। হ্যাঁ, একটা উপহার ছাপাতে হবে সবার নামে। তোমার নামটাও ওখানে থাকবে তসলিম ভাই, তাই, না? তসলিম মাথা নুইয়ে সায় দেয়–হ্যাঁ।

কিন্তু ঐ সবের জন্য টাকার দরকার। বাবার কাছ থেকে কিছু পাওয়া যাবে না জানতো হাসিনা। মাহমুদ শুনলে রাগ করবে। তাই চুপি চুপি মনসুরের কাছ থেকে দশটা টাকা আদায় করে নিয়েছে সে। কাউকে বলে নি, বলেছে শুধু তসলিমকে। ওকে দিয়ে কেনাবে সব। আর জানিয়েছে মাকে। মা বললেন, খবরদার মাহমুদের কানে যেন না যায়। বড় বোনের বিয়ে, একটু আমোদ-ফুর্তি করবি না তো কী?

হাসিনা বলে, আমায় নতুন একটা শাড়ি কিন্তু কিনে দিতে হবে মা।

মা বললেন, বলেছি তো কিনে দেবো।

হাসিনা খুশিতে ঘরময় নেচে বেড়ায়।

মনসুর আজকাল আসা বন্ধ করেছে। মরিয়ম নিষেধ করেছে তাকে। ও এলে মরিয়ম বিব্রত বোধ করে। ওর সামনে আসতে লজ্জা লাগে মরিয়মের। আমার কথা ভেবে, এ কটা দিন আর এসো না তুমি। মনসুরকে বলেছে সে। যদি দেখা করতে হয় বাইরে করো, কিন্তু সেলিনাদের ওখানে নয়।

একদিন রাতে খাওয়া-দাওয়ার পরে মাহমুদকে ডেকে বসলেন হাসমত আলী। সালেহা বিবিও একখানা পাখা হাতে বসলেন তাদের পাশে। বিয়ের তারিখটা ঘনিয়ে আসছে। কাদের নিমন্ত্রণ করতে হবে। কি খাওয়ানো যেতে পারে। কত টাকার প্রয়োজন তার একটা হিসেব করলেন হাসমত আলী।

মাহমুদ বললো, দলসুদ্ধ লোক নিমন্তন করার দরকার নেই। যাদের না করলে নয় তাদের দাওয়াত করো।

সালেহা বিবি বললেন, কাউকে বাদ দিলে তো চলবে না, বড় মেয়ের বিয়ে–।

তাই বলে সবাইকে দাওয়াত করতে হবে নাকি। অত লোক খাওয়াবে কি করে? হাসমত আলী ছেলের পক্ষ নিলেন। টাকার চিন্তা বারবার বিভ্রান্ত করছিলো তাকে। কেরানীর জীবনে সঞ্চয় সম্ভব নয়। হাসমত আলীও কিছু জমাতে পারে নি। অথচ ছেলেমেয়েদের বিয়ে দিতে হলে মোটা অঙ্কের না হোক মোটামুটি একটা অঙ্কের প্রয়োজন।

মাহমুদ বললো, দেখি এ মাসে বেতনটা যদি অগ্রিম পাওয়া যায় তাহলে পুরোটা দিয়ে দেবো আমি।

সালেহা বিবি বললেন, তাহলে তুই চলবি কেমন করে?

সে কথা তোমাকে ভাবতে হবে না মা। মৃদু গলায় জবাব দিলে মাহমুদ। কাদের দাওয়াত করতে হবে একটা তালিকা তৈরি করলেন হাসমত আলী। কি খাওয়ানো হবে সে সম্পর্কেও আলোচনা হলো, ক্রমে রাত বাড়লে মাহমুদ ঘুমোতে চলে গেলো।

ওঁরা স্বামী-স্ত্রী দুজনে শুধু জেগে রইলেন অনেক রাত পর্যন্ত। টাকার কথা ভাবছিলেন ওঁরা।

সালেহা বিবি ফিসফিস করে বললেন, মরিয়মকে দিয়ে মনসুরের কাছ থেকে কিছু টাকা ধার চাইলে ও নিশ্চয় দেবে।

হাসমত আলীও তাই ভাবছিলেন। এমনি হাত পাতা যাবে না। ধার চাইতে হবে। পরে শোধ করতে যে পারবেন না, তা জানেন তিনি। তবু ধার চাওয়া ছাড়া উপায় নেই। কিন্তু মাহমুদ যদি জানতে পারে তাহলে বাড়িশুদ্ধ মাথায় তুলবে।

হাসমত আলী চাপা গলায় বললেন, চাইলে নিশ্চয় দেবে, কিন্তু মাহমুদ কি জানবে না ভেবেছো?

সালেহা বিবি বললেন, জানুক। জানলে কি হবে, ও পারবে অতগুলো টাকা যোগার করে দিতে?

স্ত্রীর কথায় আশ্বস্ত হতে পারলেন না হাসমত আলী। ইতস্তত করে বললেন, এক কাজ করলে হয় না, অন্য কারো কাছ থেকে কর্জ নিলে।

শোধ করবে কেমন করে? পরক্ষণে সালেহা বিবি জবাব দিলেন তাছাড়া দুটো মেয়েকে বিয়ে দিতে হবে সে খেয়াল আছে? হাসিনা আর দুলুর কথা বলছেন সালেহা বিবি।

ওদের বিয়ে দিতে হবে একদিন।

বাতি নিভিয়ে দিয়ে, বিছানায় শুয়ে শুয়ে আরো অনেকক্ষণ আলাপ করলেন ওরা। টাকা সংগ্রহের বহুবিধ উপায় নিয়ে জল্পনা কল্পনা করে অবশেষে দুজনে নীরব হলেন।

রাতে ভাল ঘুম হলো না ওদের।

পরদিন সকালে চা খেতে বসে মাহমুদ বললো, দেখো মা, খাওয়া-দাওয়ার ঝামেলা না করে, নাস্তাপানি খাইয়ে সকলকে বিদায় দেবার বন্দোবস্ত করো। গরিবের অত ভোজ খাওয়াবার চিন্তা না করাই ভালো। মা বললেন, গরিব হয়েছি বলে বুঝি স্বাদ-আহলাদ নেই আমাদের?

মাহমুদ মৃদু হাসলো। তারপর হাসি থামিয়ে বললো, মা, রোজ পাঁচ বেলা যার কাছে মাথা ঠোকো, তাকে ভুলেও কি একবার জিজ্ঞেস করতে পারো না, এত স্বাদ-আহ্লাদ দিয়ে যদি গড়েছেন তোমাদের, সেগুলো পূরণ করার মত সামর্থ্য কেন দেননি?

এ-কথার তাৎপর্য ঠিক ধরতে পারলেন না সালেহা বিবি। তাই চুপ করে রইলেন তিনি।

ও ঠিক বলছে। ছেলেকে সমর্থন জানালেন হাসমত আলী–অত ভোজ দেবার কি দরকার, আমাদের সামথ্য যখন নেই–৷ কথাটা শেষ করলেন না তিনি।

সালেহা বিবি বললেন, সামর্থ্য কজনের থাকে। তাই বলে কি তারা বড় মেয়ের বিয়েতে নাস্তা পানি খাইয়ে মেহমান বিদায় করে? আমার পোড়া কপাল নইলে–দু-চোখে পানি এসে জমা হলো তাঁর। আঁচলে চোখ মুছলেন তিনি।

মায়ের কান্না দেখে আর কোন কথা বলতে সাহস পেলো না মাহমুদ। চা-টা শেষ করে নীরবে উঠে গেল সে। হাসমত আলী বার কয়েক মাথা চুলকালেন তারপর দুহাটুর মধ্যে মুখ গুঁজে চুপচাপ কি যেন ভাবতে লাগলেন তিনি।

 

আজ মরিয়মের বিয়ে। সকাল থেকে পুরো বাড়িটায় উৎসব। মেহমান, অতিথি, গিজগিজ করছে ঘরগুলো, বারান্দা, কুয়োতলা।

ভোরে ভোরে পাকঘরে ঢুকেছে সালেহা বিবি। সেখান থেকে আর বেরোয় নি। পাড়ার কয়েকজন বয়স্ক মহিলা–যাদের ওরা নেমন্তন করেছিলো–কাজের সহায়তা করছে তাঁকে।

হাসিনা, খোকন আর তসলিম আগের রাতে সাদা সুতোয় লাল-নীল কাগজ এঁটে ঘরগুলো সাজিয়েছে। সামনে একটা বাঁশের তোরণ তৈরি করেছে তারা। মাহমুদের ঘরটায় বরযাত্রীদের এনে বসানো হবে।

সকালে ঘুম থেকে উঠে, ওর বইপত্র আর কাগজগুলো মায়ের খাটের নিচে একটা চাটাই বিছিয়ে তার ওপর রেখে এসেছে মাহমুদ। কুয়ো থেকে পানি তুলে এনে নিজ হাতে ঘরটা ধুয়ে-মুছে দিয়েছে সে। লিলি এসেছে। সেলিনাও এসেছে আজ। ওকে নিজে গিয়ে আমন্ত্রণ জানাতে সাহস পায়নি মরিয়ম। চিঠি লিখে জানিয়েছে। আনিসা বেগমের মুখোমুখি হতে ভয় ওর। সেলিনাকে দেখে বেশ খুশি হয়েছে বলে মনে হলো। মনসুর ভাই-এর সঙ্গে মরিয়ম আপার বিয়ে আনন্দ যেন উপছে পড়ছে ওর চোখেমুখে। মা আসতে নিষেধ করেছিলেন। তবু চুপি চুপি চলে এসেছে সেলিনা। ওরা সব মরিয়মের ঘরে, ঘিরে বসেছে ওকে। গল্প করছে, হাসছে, কৌতুকে ফেটে পড়ছে মাঝে মাঝে।

হাসমত আলী পাকঘরে গিয়ে একবার সকলকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে এলেন, দুপুরের মধ্যে সবকিছু তৈরি হওয়া চাই। অপরাহ্নে বর আসবে।

মাহমুদ সব আয়োজন শেষ করে ফরাসের উপর চিৎ হয়ে শুয়ে বিড়ি ধরালো একটা। অন্য ঘরে আত্মীয়-স্বজনেরা এসে ভিড় জমালেও এখানে সকলকে আসতে নিষেধ করেছে। চিৎকারে মাথা ধরে ওর।

লিলি উঁকি মেরে চলে যাচ্ছিলো।

মাহমুদ ডাকলো ওকে, শুনুন।

লিলি ফিরে এসে বললো, আমায় ডেকেছেন? সারা গায়ে ঘাম ঝরছে তার। শাড়ির আঁচল দিযে বার বার মুখ মুছছে।

মাহমুদ বললো, ওখানে হৈ হট্টগোলের মধ্যে যদি আপনাদের ভালো না লাগে, এখানে এসে বসতে পারেন। আমি বাইরে বেরুচ্ছি।

লিলি মৃদু হেসে বললো, ধন্যবাদ।

মরিয়ম আর সেলিনাকে নিয়ে এ ঘরে দরজায় খিল এঁটে দিলো লিলি। বাব্বাঃ গরমে সেদ্ধ হয়ে যাবার অবস্থা। ফরাসের উপর শুয়ে শাড়ির আঁচলে গায়ে বাতাস দিতে লাগলো ওরা।

হাসিনা কড়া নাড়ছিলো।

প্রথমে কেউ সাড়া দিলো না। পরে সে যখন দরজার উপর দুমদাম শব্দে কিল চাপড় দিতে লাগলো তখন উঠে দরজাটা খুলে দিলো সেলিনা।

ভেতরে এসে হাসিনা বললো, এখানে শুয়ে শুয়ে কি করছো তোমরা, আমি খুঁজে-খুঁজে হয়রান। দরজায় খিল এঁটে ওদের পাশে শুয়ে পড়লো সে।

লিলি বললো, বিয়ের পর আমাদের ভুলে যাবে না তো ম্যারি ?

মরিয়ম হাসলো। কিছু বললো না।

সেলিনা ক্ষণকাল পরে জিজ্ঞেস করলো, বিয়ের পর আমাকে আর পড়াতে যাবে না তুমি, তাই না আপা?

মরিয়ম ওর চুলে সিঁথি কেটে দিয়ে বললো, যেতাম, কিন্তু তোমার মা যে আর ও বাড়িতে ঢুকতে দেবে না আমায় সেলিনা।

আপার মুখের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর হয়ে গেলো সেলিনা। তারপর বললো, আচ্ছা আপা, মা তোমার বিয়ের খবর শুনে অমন রেগে গেছেন কেন? বারবার শুধু গালাগাল দিচ্ছিলেন তোমাকে। আমাকেও।

হাসিনা পরক্ষণে বললো, আপনার মায়ের ভীমরতি হয়েছে।

মায়ের সম্পর্কে কটু মন্তব্য শুনে মুখখানা কালো হয়ে গেলো সেলিনার।

মরিয়ম ধমকের সুরে বললো, বাজে বকো না হাসিনা, এখান থেকে যাও।

হাসিনা পাশ ফিরে শুলো।

বাইরে বিয়েবাড়ির হাঁক-ডাক, হৈ-হুল্লোড় আর ধুপধাপ শব্দ এখান থেকেই শোনা যাচ্ছে। পাড়ার প্রবীণেরা বাইরে দাওয়ায় বসে সুখ্যাতি গাইছে বরের–হাসমত আলীর কপাল, নইলে, অমন বড়লোক বর ক’জনের ভাগ্যে জোটে!

লিলি মুখখানা মরিয়মের মুখের কাছে বাড়িয়ে এনে, ওর চিবুকটা নেড়ে দিয়ে ফিসফিস করে বললো, কার কথা ভাবছিস ম্যারি, বরের কথা বুঝি?

ধ্যাৎ। লজ্জায় লাল হয়ে গেলো মরিয়ম। কপট অভিমানে মুখখানা অন্য দিকে সরিয়ে নিলো সে।

দুপুরে, যথা সময়ে বরযাত্রীরা এলো।

গলির মাথায় একসার মোটর থামিয়ে, নোংরা আবর্জনা পেরিয়ে আসতে বেশ কষ্ট হলো ওদের।

ঘরে পাখা নেই, গরমে হাঁসফাঁস করলো তারা। কলকল শব্দে কথা বললো।

খেলো।

পান চিবোল।

বিয়েটা নির্বিঘ্নে হয়ে গেলো মরিয়মের।

কন্যা সম্প্রদানের সময় হু হু করে কেঁদে দিলেন হাসমত আলী। সুখী হও মা, সুখে থেকো।

সালেহা বিবি আঁচলে মুখ মুছলেন, কুয়োতলায় বসে ডুকরে কাদলেন। পাড়ার বয়স্কা মহিলারা সান্তুনা দিলেন তাকে।

এ সময়ে কাঁদতে নেই বউ। সব মেয়ে কি চিরকাল বাপের বাড়ি থাকে?

হাসিনার চোখেও অশ্রু। কান্না লুকোতে গিয়ে দরজার আড়ালে মুখ লুকালো সে।

মাহমুদ নির্বাক। ঘরের এক কোণে দাঁড়িয়ে সে শুধু নীরবে চেয়ে-চেয়ে দেখছিলো, কেমন করে একটি মেয়ের জীবন এক ছেলের জীবনের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য হয়ে গেলো এক মুহূর্তে।

রাতের প্রথম প্রহরে কনে নিয়ে চলে গেলো ওরা।

সঙ্গে খোকন গেলো। তসলিম গেলো। কয়েকজন নিকট ও দূর সম্পর্কের আত্মীয়ও গেলো কন্যাপক্ষ হয়ে।

মাহমুদকে যাবার জন্যে পীড়াপীড়ি করেছিলো সকলে, ও গেলো না। ফরাসের উপর চুপচাপ শুয়ে রইলো সে।

মেহমান অতিথি যারা এসেছিলো তারা বিদায় নিয়ে গেছে অনেক আগে। সেলিনা চলে গেছে। পাড়ার বউ ঝিয়েরাও। লিলিকে যেতে দেয় নি হাসিনা। বলেছে, আজ রাতে তুমি থাক লিলি আপা, নইলে একা ভীষণ ভয় করে আমার।

লিলি বলেছে, পাগল, বাসায় না গেলে বকবে সবাই।

সালেহা বিবি বলেছেন, যাবে আর কি, আরো কিছুক্ষণ থেকে যাও না, রাতে খেয়ে যেয়ো।

লিলি গেলো না। পাকঘরে সবকিছু গোছাবার কাজে মাকে সহায়তা করলো হাসিনা আর লিলি।

একটু আগে যে বাড়িটা গমগম করছিলো মানুষের কোলাহলে, এখন সেখানে কবরের নিস্তব্ধতা। মাঝে মাঝে থালাবাসনগুলো নাড়াচাড়া আর কুয়োতলায় পানি তোলার শব্দ হচ্ছে।

তন্দ্রায় দুচোখ জড়িয়ে এসেছিলো মাহমুদের।

হাসিনার ডাকে তন্দ্রা ছুটে গেলো।

হাসিনা বললো, ভাইয়া খাবে এসো।

মাহমুদ বললো, তুই যা আমি আসছি। পরক্ষণে কি মনে হতে আবার বললো, হ্যারে, সবাই কি চলে গেছে?

হাসিনা বললো, হ্যাঁ, শুধু লিলি আপা আছে।

মায়ের ঘরে এসে মাহমুদ দেখলো বাবা কাত হয়ে শুয়ে আছেন খাটের ওপর। দুলু ঘুমোচ্ছে। খোকন মেঝেতে বসে দুলুর পুতুলগুলো নিয়ে খেলছে। আজ ওর ছুটি। হাসিনা আর লিলি কুয়োর পাড়ে বসে গল্প করছে।

খাওয়া শেষ হলে লিলি বললো, এবার যাই আমি আসি।

সালেহা বিবি বললেন, এত রাতে যাবে তুমি?

লিলি বললো, পারবো খালাম্মা।

মাহমুদকে পেয়ে সালেহা বিবি বললেন, তুই কি বাইরে বেরুবি আজ?

মাহমুদ বললো, হ্যাঁ, এখনি বেরুবো। সারাদিন তো তোমাদের বিয়ের ঝামেলায় কাটলো। এখন সারারাত জেগে প্রুফ দেখতে হবে আমায়। কিন্তু কেন বলতো?

সালেহা বিবি ইতস্তত করে বললেন, লিলি মেয়েটা একা যাচ্ছে, ওকে একটু এগিয়ে দিয়ে–। কথাটা শেষ করলেন না তিনি।

মাহমুদ ওর দিকে এক পলক তাকিয়ে বললো, দিতে পারি ওর যদি আপত্তি না থাকে।

লিলি ঢোক গিললো, কিছু বললো না।

রাতের এই প্রহরে পথঘাটগুলো বড় নির্জন হয়ে আসে। টিমটিমে বাতি-জ্বলা দোকানীরা শেষ খদ্দেরের প্রত্যাশায় তখনো বসে। আশে-পাশে কোন রিক্সা নেই।

লিলি বললো, আপনার যদি কোন অসুবিধা না হয় যেতে পারেন, আমার কোন আপত্তি নেই।

তারপর নীরবে দুজনে হেঁটে চললো ওরা। কখনো আগে-পিছে। কখনো পাশাপাশি। মাহমুদ কি যেন ভাবছিলো। হঠাৎ সে বললো, কি অদ্ভুত! তাই না?

লিলি চমকে তাকালো ওর দিকে–কী?

মাহমুদ বললো, এই বিয়েটা।

লিলির কিছু বোধগম্য হলো না। অবাক হয়ে শুধালো–বিয়েটা মানে?

হ্যাঁ এই বিয়েটার কথা বলছিলাম। মাহমুদ ধীরে ধীরে বললো, কতগুলো লোক এলো, খেলো আর হাত তুলে মোনাজাত করলো, ব্যাস, একটা মেয়ের জীবন আরেকটা ছেলের জীবনের সঙ্গে চিরকালের জন্যে গেঁথে গেলো। এই ফার্সটা না করলেও তো চলে।

লিলি ফিক করে হেসে দিয়ে বললো, বিয়ে বুঝি ফার্স বলে মনে হয় আপনার কাছে?

মাহমুদ মুখ ঘুরিয়ে তাকালো ওর দিকে। একটা তীক্ষ্ণ্ম তীব্র দৃষ্টি। সে দৃষ্টি সব কিছু অস্বীকার করতে চায়। সারা পথ আর একটি কথাও বললো না মাহমুদ। লিলিকে তার বাসা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে যখন প্রেসে এসে পৌঁছলো তখন রাত সোয়া এগারোটা। টেবিলের ওপর স্তুপাকার প্রুফসিটগুলো রাখা আছে। ওগুলো দেখে শেষ করতে রাত দুটাে তিনটে বেজে যাবে। তারপর বাসায় ফিরবে না মাহমুদ। লম্বা টেবিলটার ওপর গুটিসুটি হয়ে শুয়ে রাত কাটিয়ে দেবে।

 

একটা বিড়ি ধরিয়ে চেয়ারটা টেনে বসে পড়লো মাহমুদ। পরদিন ভোরে বিশ্রামাগারে যখন এলো সে, তখন চোখজোড়া ভয়ানক জ্বালা করছে।

রেস্তোরাঁয় আর কোন খদ্দের আসেনি এখনো। খোদাবক্স টেবিল চেয়ারগুলো সাজাচ্ছে আর চাকর ছোড়াটা আগুন দিচ্ছে চুলোয়। ওকে আসতে দেখে খোদাবক্স বললো, ইয়ে হয়েছে মাহমুদ সাহেব, আপনাকে যেন বড় কাহিল কাহিল মনে হচ্ছে আজ?

মাহমুদ একখানা চেয়ারের ওপর ধপ করে বসে পড়লো, ইয়ে হয়েছে এক কাপ কড়া চা বানিয়ে দাও জলদি করে। থাকলে চায়ের সঙ্গে একটা টোষ্ট দিও।

ছেলেটা একটা পাখা এনে জোরে বাতাস করতে লাগলো চুলোয়। কুণ্ডলী পাকিয়ে ধোঁয়া উঠছে উপরে, ধীরে ধীরে আগুনের শিখাগুলো উঁকি মারলো। কালো চায়ের কেটলিটা চুলোর উপর তুলে দিলো সে। টেবিল চেয়ারগুলো ঠিকভাবে সাজানো হয়েছে কি না দেখে নিয়ে খোদাবক্স বললো, আজ বুঝি নাইট ডিউটি ছিলো? খোদাবক্স জানতো না যে মাহমুদ ও-চাকরিটা অনেক আগে ছেড়ে দিযেছে।

মাহমুদ টেবিলের উপর মাথা রেখে বললো, তোমার মাথা, চাকরি আমি কবে ছেড়ে দিয়েছি।

খোদাবক্স অবাক হয়ে বললো, কই কিছু বলেন নি তো আপনি?

তোমাকে সব কিছু বলতে হবে নাকি?

ধমক খেয়ে চুপ করে গেলো খোদাবক্স, তাড়াতাড়ি চা বানিয়ে দেবার জন্যে ছেলেটাকে তাড়া দিলো। তারপর দুঠোঁটে হাসি টেনে আবার বললো, আপনার বন্ধু নঈমের একটা চাকরি হয়েছে, শুনেছেন কি মাহমুদ সাহেব?

শুনি নি, এই শুনলাম। দু-বাহুর আড়ালে মুখ লুকালো মাহমুদ।

ইতিমধ্যে আরো কয়েকজন খদ্দের এসেছিলো, তাদের সঙ্গে কিছুক্ষণ আলাপ করলো খোদাবক্স। খাতাপত্র দেখে কি যেন হিসেব করলো। ড্রয়ারটা খুলে খুচরো পয়সাগুলো নেড়েচেড়ে দেখলো। তারপর আবার বললো, ইয়ে হয়েছে মাহমুদ সাহেব, শুনলাম আপনার বোনের বিয়ে হয়েছে কাল?

এক চুমুক চা খেয়ে মাহমুদ বললো, তুমি জানলে কোথা থেকে?

খোদাবক্স ইতস্তত করে জবাব দিলো, না কাল আপনি আসেন নি কিনা, ওরা সবাই আলোচনা করছিলো।

হুঁ–কাপটা পিরিচের উপর থেকে আবার তুলে নিলো মাহমুদ।

খোদাবক্স মুখে হাসি ফুটিয়ে বললো, ইয়ে হয়েছে মাহমুদ সাহেব, শুনলাম ছেলের নাকি গাড়ি আছে।

হ্যাঁ।

তাহলে তো আপনার আর কোন চিন্তা নেই মাহমুদ সাহেব, এবার একটা চাকরি নিশ্চয় পাবেন। গদগদ গলায় বললো খোদাবক্স।

একটা টোষ্ট আর এক কাপ চা লিখে রাখুন। মাহমুদ উঠে দাঁড়ালো। বেরুতে যাবে এমন সময় হন্তদন্ত হয়ে সামনে এসে দাঁড়ালো রফিক। এই যে মাহমুদ, তোমার কথা ভাবতে ভাবতেই আসছিলাম। তুমি কি চলে যাচ্ছো নাকি? একটু বসো প্লিজ বসো, একটু। তোমার সঙ্গে একটা কথা আছে আমার।

মাহমুদ বললো, পরে বলো এখন ভালো লাগছে না আমার, বাসায় যাবো।

একটু বসে যাও, এই একটু। ওর গলায় করুণ আকুতি। প্রেমে পড়ার পর থেকে দুর্বল হয়ে পড়েছে সে।

মাহমুদ বসলো। ওর মুখের দিকে তাকিয়ে মৃদু মৃদু হাসলো রফিক। তারপর হাসি থামিয়ে বললো, এবার তুমি নিশ্চয় হতাশ করবে না আমায়, মাহমুদ।

মাহমুদ বললো, খোলাসা করে বলো, কিছু বুঝতে পারলাম না।

তোমার বোনের বিয়ের খবর আমরা পেয়েছি মাহমুদ। যদিও তুমি কিছুই জানাও নি।

মাহমুদ জবাব দিলো, আমার বোনের বিয়েটেত তোমাদের কিছু জানাবার ছিলো বলে মতো মনে হয় না।

না না, আমি সে কথা বলছি না। লজ্জা পেয়ে রফিক পরক্ষণে বললো, তুমি অল্পতেই সেন্টিমেন্টাল হয়ে পড়ো। আমি বলছিলাম কি তোমার ভগ্নিপতির হাতে অনেক চাকরি আছে শুনেছি। তুমি যদি আমার হয়ে তাকে একটু বলো; কিম্বা তাকে চিঠি লিখে দাও।

ও এই ব্যাপার। মুখখানা কালো হয়ে গেলো মাহমুদের।

আমার জন্যে অন্তত এইটুকু তুমি করো মাহমুদ। নইলে মেয়েটির ওরা বিয়ে দিয়ে ফেলবে অন্য কোথাও। মনে হচ্ছিলো সে এক্ষুণি কেঁদে ফেলবে। ডুকরে গড়িয়ে পড়বে ওর পায়ের ওপর।

মাহমুদ নির্বাক চোখে তাকিয়ে রইলো ওর দিকে। তারপর মৃদু গলায় বললো, তার চেয়ে একখানা ছুরি নিয়ে আমার গলাটা কেন কেটে দাও না বন্ধু?

তোমার কি আমার জন্যে এতটুকু অনুভূতি নেই মাহমুদ?

নেই।

মেয়েটির কথাও কি তুমি একটু ভাবছো না?

না।

তুমি কি পাথর দিয়ে তৈরি? এবার সত্যি সত্যি কেঁদে ফেললো রফিক।

হ্যাঁ আমি পাথর দিয়ে তৈরি। ছুটে সেখান থেকে বেরিয়ে এলো মাহমুদ। ওর জল ছলছল চোখজোড়া আর সহ্য হচ্ছিলো না মাহমুদের।

 

বাসায় এসে লম্বা একটা ঘুম দিলো মাহমুদ। ঘুম যখন ভাঙলো দুপুর গড়িয়ে গেছে। কুয়োতলায় বসে অনেকক্ষণ ধরে গায়ে পানি ঢেলে স্নান করলো সে। বাসায় এখন মা আর দুলু ছাড়া কেউ নেই। বাবা অফিসে, হাসিনা স্কুলে, খোকন মরিয়মের সঙ্গে গেছে। স্নান সেরে আসতে সালেহা বিবিও এলেন পিছু পিছু। মাহমুদ বুঝলো মা কিছু বলতে চান। চুলে চিরুনি বুলিয়ে নিয়ে সে তাকালো মায়ের দিকে–কিছু বলবে কি মা?

মা বললেন, মরিয়ম নেই, বাড়িটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে।

মাহমুদ কোন মন্তব্য করলো না দেখে ক্ষণকাল পরে আবার বললেন তিনি–তুই একটা বিয়ে কর মাহমুদ। এ কথাটা বলতেই বোধ হয় এসেছিলেন সালেহা বিবি।

মৃদু হাসলো মাহমুদ।

হাসছিস কেন?

মা অবাক হয়ে বললেন, বয়স কি কম হযেছে তোর?

মাহমুদ হাসি থামিয়ে বললো, বিয়ে করে আরেকটা ঝামেলা বাড়িয়ে লাভ কি মা?

ঝামেলা হতে যাবে কেন? মা জবাব দিলেন, বউ আনলে লক্ষ্মী আসবে ঘরে।

মাহমুদ ভ্রু বাঁকিয়ে বললো, খাওয়াবে কি?

সালেহা বিবি বললো, কেন আমরা কি উপোস থাকি?

অনেক জোড়াতালি দেয়া, মায়ের পরনের শাড়িটার দিকে চোখ নামিয়ে এনে আস্তে করে বললো, যেভাবে আমরা থাকি, সেভাবে মানুষ থাকে না মা! কি দরকার আরেকটা নিরীহ মেয়েকে অমানুষ বানিয়ে?

নিজের শতচ্ছিন্ন শাড়িটার দিকে তাকিয়ে চুপ করে গেলেন সালেহা বিবি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *