০৮. নাহারের বিয়ে (শেষ)

নাহারের বিয়ে

আজ সকালে খালু এসে নাহারকে নিয়ে গেছেন ওদের বাড়িতে। কাল ওর বিয়ে।

মা মারা যাবার পর ক’দিন মেয়েটা একটানা কেঁদেছে। শেষের দিকে শুধু চােখ দিয়ে পানি ঝরতে কোন আওয়াজ বেরুতো না।

মায়ের শূন্য বিছানার পাশে বসে বসে কি যেন ভাবতো সে।

আজ সেও চলে গেছে।

যাবার আগে পা ছুঁয়ে সালাম করে গেছে তাকে।

বলেছে, ছোট্ট করে বলেছে, যাই।

এখন এ বাড়িতে কাসেদ একা।

চারপাশটা কেমন ফাঁকা লাগছে ওর।

মনটা শূন্য।

সারাদিন বাইরে বেরুলো না কাসেদ।

বিছানায় শুয়ে শুয়ে কাটালো। একবার এপাশ আর একবার ওপাশ। আর সারাক্ষণ অনেক কিছু কথা ভাবলো সে। অনেকের কথা মনে পড়লো।

মায়ের বড় ইচ্ছে ছিলো জাহানারাকে বউ করে আনবে ঘরে। মুখ ফুটে কোনদিন না বললেও বেশ বুঝতে পারতো কাসেদ। মায়ের ইচ্ছাটা গোপন ছিলো না।

কিন্তু জাহানারা?

থাক, যার নাম জীবন থেকে মুছে গেছে তাকে স্মৃতির পাতায় ঠাঁই দিয়ে ক্ষতি ছাড়া লাভ নেই। ওকে নিয়ে অনেক ভেবেছে কাসেদ। শিউলিকে নিয়েও কম ভাবেনি সে। দুই দেহ, এক মন। মেয়ে জাতটাই বোধ হয় আমনি।

না, তা নয়? সালমা তো ওদের মত নয়। আর মকবুল সাহেবের মেয়ে? কত শান্ত, কত সরল। বড় সাহেবের জীবনটাকে কি সুন্দর করে তুলেছে সে। ওরা কত সুখী।

না, কাসেদ বিয়ে করবে না।

একা থাকবে।

মাঝে একটু তন্দ্ৰা এসেছিলো। একটা বড় ইঁদুরের কিচ কিচ শব্দে তন্দ্ৰা ছুটে গেলো ওর। বিছানা ছেড়ে উঠে বসলো সে।

খোলা জানােলা দিয়ে এক টুকরো রোদ এসে পড়েছে। ঘরের মাঝখানে। কাসেদ বিছানা ছেড়ে দাঁড়িয়ে জানালার পাশে সরে গেলো। বাইরের আকাশটা মেঘে ছেয়ে আছে।

কোথাও মেঘের রঙ কালো, কোথাও সাদা, কোথাও ঈষৎ লাল। এখন শেষ বিকেল।

লাল সূৰ্যটা হারিয়ে গেছে উঁচু উঁচু দালানের ওপাশে। ওটাকে এই জানােলা থেকে দেখা যাচ্ছে না। শুধু তার শেষ আভাটুকু বাড়িগুলোর মাথার ওপর দিয়ে আকাশে ছড়িয়ে আছে। মনে হচ্ছে দূরের দিগন্তে কোথাও যেন আগুন লেগেছে। তার উত্তাপ থেকে বাঁচবার জন্যে টুকরো টুকরো মেঘগুলো উর্ধ্বশ্বাসে ছুটছে আরেক দিগন্তের দিকে।

বাতাস বইছে জোরে।

পাশের বাড়ির ছাদে মেলে দেয়া কুমারী মেয়ের হাল্কা নীল শাড়িখানা বাতাসে পতাকার মতো উড়ছে পতপত করে।

আরো দূরের আকাশে একটা চিল একা একা ঘুরছে। শেষ বিকেলের সোনালি আভায় মসৃণ পাখাটি চিকচিক করছে তার।

পুরো শহরটা একটা থমথমে ভাব নিয়ে রাত্রির অপেক্ষা করছে। সহসা বাইরের দরজায় কড়াটা নড়ে উঠলো।

একবার।

দু’বার।

তিনবার।

কাসেদ ঠিক ভেবে উঠতে পারলো না। এ সময়ে তার কাছে কে আসতে পারে। মা মারা যাবার প্রথম দুদিন আত্মীয়-স্বজন অনেকে দেখা করতে এসেছিলো। আজকাল তারা আসে না।

তবে কে আসতে পারে এমনি বিকেলে?

দরজাটা খুলে দিতে কাসেদ অবাক হয়ে দেখলো নাহার দাঁড়িয়ে। এক হাতে খোলা কপাটটা ধরে নীরবে দাঁড়িয়ে রয়েছে সে।

পরনের সাদা শাড়িটায় হলুদ মাখানো। হলুদ ছড়ানো সারা দেহে তার। হাতে মেহেদি, গাঢ় লাল।

কাসেদ বিস্মিত গলায় বললো, একি নাহার তুমি!

কোন কথা না বলে নিঃশব্দে ভেতরে এলো নাহার। তারপর আলতো চোখ বুলিয়ে নিয়ে বললো, এতকাল যার সাথে ছিলাম, তাকে ছেড়ে থাকতে পারলাম না বলে চলে এসেছি। যেতে বলেন তো আবার ফিরে যাই।

কাসেদ বিস্ময় বিমূঢ় স্বরে বললো, কাল তোমার বিয়ে আর আজ হঠাৎ এখানে চলে আসার মানে?

নাহার নির্বিকার গলায় বললো, বিয়ে আমার হয়ে গেছে।

কার সাথে? কাসেদ চমকে উঠল যেন।

ক্ষণকাল ওর দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো নাহার। তারপর অত্যন্ত সহজ কণ্ঠে বললো, যার সাথে হয়েছে তার কাছেই তো এসেছি আমি। তাড়িয়ে দেন তো চলে যাই। কাসেদ বোবার মত ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো ওর হলুদ মাখানো মুখের দিকে। কিছুতেই সে ভেবে পেলো না, সেই চাপা মেয়েটা আজ হঠাৎ এমন মুখরা হয়ে উঠলো। কেমন করে?

পেছনের দরজাটা বন্ধ করতে করতে সে শুধু মৃদু গলায় বললো, চলো, ও ঘরে চলো।

Leave a Reply to তাওহীদ বুরুজ Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *