• Skip to main content
  • Skip to header right navigation
  • Skip to site footer

Bangla Library

Read Bengali Books Online (বাংলা বই পড়ুন)

  • লেখক
  • My Account
  • লেখক
  • My Account
  • বাংলা ডিকশনারি
  • বাংলা কৌতুক
  • বাংলা লিরিক
  • বাংলা রেসিপি
  • হেলথ টিপস এন্ড নিউজ

বাংলা PDF ডাউনলোড

বাংলা নতুন/পুরাতন বইয়ের পিডিএফ ডাউনলোড/সন্ধান করতে আমাদের বাংলা পিফিএফ সাইটে ক্লিক করুন।

Bangla PDF

০৬. আসবে বলেছিলো জাহানারা

লাইব্রেরি » জহির রায়হান » শেষ বিকেলের মেয়ে (উপন্যাস) » ০৬. আসবে বলেছিলো জাহানারা

আসবে বলেছিলো জাহানারা

রোববার দিন আসবে বলেছিলো জাহানারা।

এলো না।। সকাল থেকে বাসায় অপেক্ষা করেছে কাসেদ। সকাল গড়িয়ে দুপুর হলো, দুপুর পেরিয়ে বিকেল, তখনো না আসায় বিচলিত বোধ করলো সে। একবার মনে হলো, হয়তো সে আর আসবে না, কাপড় পরে বাইরে বেরুবার তোড়জোড় করলো। কিন্তু কাপড় পরা হয়ে গেলে মনে হলো যদি সন্ধ্যার পরে আসে সে, তাহলে? কাসেদকে ঘরে না পেয়ে হতাশ হয়ে ফিরে যাবে জাহানারা। কে জানে, কি কথা বলার আছে তার–এমনো হতে পারে। শিউলি যা বলেছে তার সবটুকু মিথ্যা। হায় খোদা, যদি তাই হতো।

ভাবতে গিয়ে আর বাইরে বেরুনো হয় না তার।

কিন্তু সন্ধ্যার পরেও এলো না জাহানারা। রাতেও না।

বিরক্ত হয়ে রাত দশটার পরে রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছে কাসেদ।

ফিরেছে রাত দুটাে বাজিয়ে।

সে রোববার না এলেও পরের রোববারে এলো জাহানারা।

তখন বিকেল।

ঘরে এসে মায়ের মাথার কাছে বসলো সে।

অসুস্থ মা অনুযোগভরা কণ্ঠে বললেন, এতদিন পরে এলে মা।

জাহানারা মৃদু গলায় বললো, কাজ ছিলো।

কাজ ছিলো না হাতি ছিলো। অদূরে দাঁড়ানাে কাসেদ আনমনে বিড়বিড় করে উঠলো।

মা অত্যন্ত স্নেহের দৃষ্টিতে দেখছিলেন তাকে। আর ফিরে তাকাচ্ছিলেন কাসেদের দিকে।

মা কি চান আর এ মুহুর্তে তিনি মনে মনে কি ভাবছেন তা ভালো করে জানে কাসেদ।

যাঁরা ধর্মপ্রাণ, খোদা নাকি তাদের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করে থাকেন, তবে কি মায়ের বাসনা বাস্তবে রূপ পাবে?

কাসেদ কি বিয়ে করতে পারবে জাহানারাকে?

ওহ! এসব কি ভাবছে সে।

মা আর জাহানারার সামনে থেকে সরে নিজের ঘরে চলে এলো কাসেদ। একটা বিষয় সে এখনো বুঝতে পারছে না। আজ আসার পরে থেকে কাসেদের সঙ্গে এখনো একটা কথাও বলে নি জাহানারা। বললে নিশ্চয় ওর সম্মান হানি হতো না।

সেতারের মাস্টারকে যদি ও বিয়ে করতে চায় করুক না, তাতে কাসেদের কোন বক্তব্য থাকবে না। ব্যথা যদি সহ্য করতে হয় নীরবে সহ্য করবে। সে। পাশের ঘরে মা আর জাহানারা কি আলাপ করছে, সব এ ঘর থেকে শুনতে পাচ্ছে কাসেদ।

মা এখন নাহারের বিয়ের কথা শোনাচ্ছে তাকে।

ওর বিয়ের পাকা কথা দিয়ে দিলাম মা! দিন তারিখ আসছে হপ্তায় ঠিক হবে। ছেলেটি বড় ভালো।

জাহানারা শুধালো, ছেলে কি ঢাকাতেই আছে?

মা বললেন, হ্যাঁ। ঢাকায় বাসা আছে ওর।

জাহানারা বললো, তাহলে ভালোই হলো, সব সময় আমাদের কাছে কাছে থাকবে।

তা মা আমি যত দিন বেঁচে আছি। ওকে চোখের আড়াল করছি নে। বিয়ের পরেও ও আমার কাছে থাকবে। মা ভাঙ্গা গলায় বলছেন, ও আমার ডান হাত। ও কাছে না থাকলে আমি চোখে দেখিনে মা। বড় ভালো মেয়ে। লক্ষ্মী মেয়ে। অমনটি আর হয় না। বলতে গিয়ে একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ছাড়লেন তিনি। কিন্তু থামলেন না। আবার বললেন, মেয়েদের পাঁচ দশটা স্বাদ আহলাদ থাকে। ওর তাও নেই। কোনদিন মুখ ফুটে কিছুই চায় নি সে আমার কাছে। বলতে গিয়ে একবার কেঁদে ফেললেন তিনি। কান্নায় বন্ধ হয়ে এলো তাঁর কণ্ঠস্বর।

নাহার ডাকলো, মা।

জাহানারা নীরব। কি বলবে হয়তো সে বুঝে উঠতে পাচ্ছিলো না। আঁচলে চোেখ মুছতে মুছতে মা বললেন, যাও, তুমি এবার ও ঘরে গিয়ে বসো। নাহার, মা আমার ওদের জন্যে দু’কাপ চা বানিয়ে দে। কাসেদ বিছানায় বসে বসে এতক্ষণ ওদের আলাপ শুনছিলো।

উঠে দাঁড়িয়ে জানালার পাশে সরে গেলো সে।

দরজার দিকে পেছন ফিরে থাকায় সেদিককার কিছুই এখন সে দেখতে পাচ্ছে না। দেখছে বাইরের আকাশ। যদিও সজাগ মন তার পেছনেই পড়ে আছে। জাহানারার পায়ের শব্দ শোনা গেলো। এ ঘরে।

জানালার ওপর আরো ঝুঁকে এলো সে।

শব্দ থেমে গেছে।

কাসেদ আড়চোখে একবার তাকালো পেছনে।

ঘরের মাঝখানে এসে দাঁড়িয়েছে জাহানারা। দেখছে ওকে।

ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়ালো কাসেদ। ও, আপনি!

ও কখন এসেছে যেন জানে না সে।

জাহানারা মৃদু গলায় শুধালো, অমন তন্ময় হয়ে কি দেখছিলেন বাইরে?

কিছু না। এমনি দাঁড়িয়েছিলাম। সরে এসে বিছানায় বসলো কাসেদ, বসুন। চেয়ারটা টেনে জাহানারা বসলো। গত রোববার দিন আসবো বলেছিলাম। হঠাৎ একটা কাজ পড়ে যাওয়ায় আসতে পারি নি।

যেন কৈফিয়ত দিচ্ছে সে।

কাসেদ বললো, অবশ্য আমিও বাসায় ছিলাম না। একটা কাজে সারাদিন বাইরে থাকতে হয়েছিলো। মিথ্যে কথাই বললো সে, কেন যে বললো হঠাৎ তার কোন যুক্তিসঙ্গত কারণ নিজেও খুঁজে পেলো না।

জাহানারা হেসে বললো, তাহলে না এসে ভালোই করেছি। কি বলেন?

কাসেদ হাসতে চেষ্টা করলো, পারলো না। টেবিলের ওপর থেকে একখানা বই তুলে নিয়ে তার পাতা ওল্টাতে লাগলো জাহানারা। কিছু বলবে সে। কিন্তু, কোথেকে যে শুরু করবে। তাই ভেবে উঠতে পারছে না। বার দুয়েক ব্যর্থ হয়ে অবশেষ জাহানারা বললো, আপনার সঙ্গে একটা কথা ছিলো আমার।

কাসেদ ঢোক গিলে বললো, বলুন।

বুকটা আবার অস্বাভাবিকভাবে কাঁপছে তার। হাত-পাগুলো ঠাণ্ডা হয়ে আসছে। বইটা বন্ধ করে জাহানারা বললো, আপনি হয়তো জানেন না যে শিউলি একটি ছেলেকে ভালবাসতো।

না, নাতো। কাসেদ অবাক হয়ে তাকালো জাহানারার দিকে। সে বুঝতে পারলো না জাহানারা হঠাৎ শিউলির প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বলছে কেন। স্বল্প বিরতি নিয়ে জাহানারা আবার বললো, ছেলেটি এখন ইটালিতে আছে। ফাইন আর্টসের ছাত্র সে।

কিন্তু–কিছু বলতে গেলো কাসেদ।

ওকে থামিয়ে দিয়ে জাহানারা আবার বললো, দু’বছরের ট্রেনিং-এ গেছে সে। ফিরে এসে ওদের বিয়ে হবে।

কিন্তু সেতো কোনদিন বলে নি আমায়। ঈষৎ বিস্মিত স্বরে কাসেদ বললো। আজ আপনার কাছ থেকেই প্ৰথম শুনছি।

জাহানারা স্থিরদৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো ওর দিকে। তারপর টেনে টেনে বললো, আপনি জানেন না বলেই আপনাকে জানানো প্রয়োজন। নইলে–সে থেমে গেলো হঠাৎ ৷

কাসেদ ইতস্তত করে বললো, কিন্তু এসব আপনি কেন বলছেন। আমি ঠিক বুঝতে পারছি না।

আপনি অবুঝ নন। জাহানারা পরীক্ষণে বললো, কাউকে ভালবাসতে যাওয়ার আগে তার সব কিছু জেনে নেয়া উচিত, নইলে পরের দিকে অশেষ অনুতাপে ভুগতে হয়। বলতে গিয়ে চােখেমুখে রক্ত এসে জমেছে তার। কথাগুলো জড়িয়ে আসতে চাইছে বারবার।

কাসেদ চমকে উঠলো।

কিছু বলতে যাবে এমন সময় চা হাতে নাহার এসে ঢুকলো ঘরে।

দু’জনের দিকে দু’কাপ চা বাড়িয়ে দিতে গিয়ে উভয়ের দিকে তাকালো নাহার। তারপর নিঃশব্দে বেরিয়ে গেলো সে।

টেবিলের ওপর চায়ের পেয়ালাটা নামিয়ে রেখে জাহানারা আবার বললো, অবশ্য শিউলি মেয়ে হিসেবে খারাপ নয়। আমার কাজিন। আমি ওকে ভালো করে জানি।

তাছাড়া আপনার সঙ্গেও মানাবে বেশ। কিন্তু কথাটা শেষ করলো না সে।

বিছানা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে, কি ভেবে আবার বসে পড়লো কাসেদ। চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিয়ে শুধালো, আপনার কথা কি শেষ হয়েছে?

জাহানারা কথার জবাবে বললো, আমার অনধিকার চর্চার জন্যে হয়তো আপনি রাগ করেছেন। তাই ক্ষমা চাইছি।

কাসেদ বললো, ক্ষমা চাওয়ার কোন প্রশ্ন আসে না। কিন্তু কথা কি জানেন, আপনি যে এই এতক্ষণ এত কিছু বললেন আমি তার কোন হদিস খুঁজে পাচ্ছি না। শিউলিকে আমি ভালবাসি এ কথা আপনাকে কে বললো শুনি?

ভয় নেই। জাহানারা মৃদু হেসে বললো, আমি নিশ্চয় এ নিয়ে দশ জায়গায় আলোচনা করবো না।

কাসেদ বিরক্তির সঙ্গে বললো, আপনি ভুল করছেন। শিউলির সঙ্গে আমার তেমন কোন সম্পর্ক নেই। বিশ্বাস করুন।

সহসা গম্ভীর হয়ে গেল জাহানারা। স্থিরচিক্ষে ওর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো সে। কি যেন খুঁজতে চেষ্টা করলে ওর দু’চোখের মণিতে। তারপর টেনে টেনে বললো, সেদিন বাসা থেকে ফিরে আসার পথে আপনি কি কিছু বলেন নি ওকে?

কাসেদ ভাবতে চেষ্টা করলো। সেদিন অনেক কথা হয়েছে শিউলির সঙ্গে। অনেক আলাপ। সঠিক সব কিছু ভাবতে গিয়েও মনে হলো না তার।

ওকে চুপ থাকতে দেখে জাহানারা মৃদু হাসল। উঠে দাঁড়িয়ে বললো, অনেক রাত হয়ে গেলো, এখন উঠি তাহলে।

কাসেদ সঙ্গে সঙ্গে বললো, একটা ভুল ধারণা নিয়ে আপনি চলে যাবেন? বসুন। আপনার সঙ্গে আমার কথা আছে।

জাহানারা বসলো। বসে বললো, বলুন কি কথা।

পাশের ঘরে মা নামাজ শেষে টেনে টেনে সুর করে কোরান শরীফ পড়ছেন। শরীরটা আজ একটু ভালো যাচ্ছে তাঁর। তাই উঠে বসেছেন বিছানায়।

কাসেদ নীরবে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো মেঝের দিকে। তারপর ধীরে ধীরে বললো, সেদিন ওর সঙ্গে আমার তেমন কোন কথা হয়নি। যা হয়েছিল তার সবটুকু আমার মনে নেই। তবে যে কথাই হােক না কেন, তা থেকে আপনি যে সিদ্ধান্ত টেনেছেন তা–সত্যি বলতে কি হাসি পাওয়ার মতো।

জাহানারা মৃদু হাসলো। আপনার কাছে কৈফিয়ত চাই নি কাসেদ সাহেব।

আমি কৈফিয়ত দিচ্ছিও না। সহসা রেগে গেলো কাসেদ। আপনি শুনতে চেয়েছিলেন তাই বলছিলাম। না করলে বলবো না। বিছানা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে জানালার দিকে সরে গেলো সে।

দু’জনে নীরব।

পাশের ঘর থেকে শুধু মায়ের সুর করে কোরান পড়ার শব্দ আসছে ভেসে। ধীরে ধীরে রাত বাড়ছে বাইরে।

আকাশে অনেক তারা।

এবার চলি। পেছন থেকে জাহানারার কণ্ঠস্বর শুনতে পেল কাসেদ। ফিরে তাকালো না।

বললো, আসুন।

ঘরের মাঝখান থেকে জুতোর শব্দ ধীরে ধীরে ঘরের বাইরে চলে গেলো। পাশের ঘরে মায়ের সঙ্গে কথা বলছে জাহানারা।

কাসেদ তখনও জানালার পাশে দাঁড়িয়ে।

মানুষের সঙ্গে সহজভাবে মেলামেশার পরিণাম অবশেষে এই দাঁড়ায়। জাহানারার মাধ্যমে আলাপ হয়েছিলো। তারপর দেখা হলে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলতো। আলোচনা করতো। এর উর্ধের্ব অন্য কোন সম্পর্ক ছিলো না।

কে জানে হয়তো এটা জাহানারার একটা মনগড়া ব্যাপার। নিজে থেকে হয়তো একটা সিদ্ধান্ত টেনেছে সে। আর তাই নিয়ে ছুটে এসেছে কাসেদকে বলতে। বলতে নয় ঠিক, বকতে। কিন্তু কেন?

কাসেদ যদি শিউলিকে সত্যি ভালবেসে থাকে তাতে জাহানারার এত মাথাব্যথ্যা কেন। ভাবতে গিয়ে হঠাৎ যেন একটু আলোর সন্ধান পেলো কাসেদ।

জাহানারা ভালবাসে ওকে।

শিউলি যা বলেছে সব মিথ্যে।

এতো অস্থিরতার মধ্যে কিছুক্ষণের জন্য মনটা ভালো হয়ে গেলো। ওর। বেশ হাল্কা বোধ করলে সে।

কাল বিকেলে অফিস থেকে বেরিয়ে জাহানারাদের বাসায় যেতে হবে তাকে। ওকে বুঝিয়ে বলতে হবে সব। তুমি যা ভেবেছো তার সবটুকু মিথ্যে জাহানারা। শিউলির সঙ্গে আমার তেমন কোন সম্পর্ক নেই। যদি কিছু থেকে থাকে সেতো তোমার সঙ্গে।

আমি তোমাকে ভালবাসি জাহানারা।

না। তা হয় না। মাস্টার সাহেবের সঙ্গে আমাদের বিয়ের সব ঠিক হয়ে গেছে।

জাহানারা অটল।

না জাহানারা। একবার চেয়ে দেখো তোমাকে ভালবেসে আমি যে নিঃশেষ হয়ে গেলাম।

আমি একটি মেয়ে, ক’জনকে ভালবাসবো বলুন তো? জাহানারার চোখে মুখে কৌতুক।

শুধু আমাকে। শুধু আমাকে জাহানারা। কাসেদের গলার স্বর কাঁপছে। বুকের নিচে যন্ত্রণা।

বাইরে কাক ডাকছে। বোধ হয় ভোর হয়ে এলো।

বিছানা ছেড়ে উঠে বসলো কাসেদ।

চোখজোড়া জ্বালা করছে।

মাথা ঘুরছে।

সারা দেহে ঘাম করছে। ওর।

মা আর নাহার চাপাস্বরে কথা বলছে পাশের ঘরে।

ভোর হবার অনেক আগে ঘুম থেকে উঠে। ওরা। সাংসারিক আলাপ আলোচনাগুলো বিছানায় শুয়ে শুয়ে এ সময়ে সেরে নেয়।

কলতলায় গিয়ে অনেকক্ষণ ধরে মাথায় জল ঢাললো কাসেদ।

মাথা তুলতে দেখে, নাহার তোয়ালে হাতে পেছনে দাঁড়িয়ে।

হাত বাড়িয়ে তোয়ালেখানা ওকে দিলো নাহার। আস্তে করে বললো, সাবান এনে দেবো?

তোয়ালেখানা হাতে নিয়ে কাসেদ বললো, না।

নাহার আর দাঁড়ালো না, যেমন নিঃশব্দে এসেছিলো তেমনি চলে গেলো। সে।

ঘরে এলে মা শুধালেন, কিরে আজ এত সকাল-সকাল উঠলি যে?

কাসেদ সংক্ষেপে বললো, এমনি।

বেলা ন’টার সময় অফিসে যাবার জন্যে বেরুচ্ছে, মা কাছে ডাকলেন, পাশে বসিয়ে গায়ে-মাথায় হাত বুলালেন ওর। বললেন, আজ একটু তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরে আসবি বাবা, আমার কেমন যেন লাগছে।

কাসেদ বললো, ভেবো না মা, তুমি খুব শিঘ্রী ভালো হয়ে যাবে।

মা স্নান হাসলেন।

 

বাসা থেকে বেরিয়ে খানিকটা পথ এসেছে, একখানা রিক্সা এসে থামলো সামনে।

শিউলি বসে, মিটমিটি হাসছে সে।

মুহুর্তে বিগত বিকেলের কথা মনে পড়ে গেলো কাসেদের।

বাহ্‌, বেশ তো! রিক্সা থেকে দ্রুত নেমে এসে শিউলি বললো, আমি এলাম বাসায় আর আপনি চলে যাচ্ছেন?

আপনার কোন বাঁধন নেই, আমাকে অফিসে চাকুরি করে খেতে হয়।–যথাসম্ভব গভীর হবার চেষ্টা করলো কাসেদ।

শিউলি বললো, সে আমি জানি। আর এও জানি আপনি একজন অনুগত কেরানী। কাজ ফেলে বসে থাকেন না। মিষ্টি করে কথাটা বললো সে, বলে হেসে উঠলো তার স্বভাব সুলভ ভঙ্গীতে।

কাসেদ তেমনি গম্ভীর স্বরে বললো, বাসায় মা আছেন, নাহার আছে, যান না, ওদের সঙ্গে গল্প করে বেশ কিছুটা সময় কাটবে আপনার।

আমি ওদের কাছে আসি নি তা আপনি জানেন, শিউলির কণ্ঠস্বর সহসা পাল্টে গেলো।

কাসেদ ইতস্তত করে বললো, তাহলে কার কাছে এসেছেন?

তাও আমাকে বলতে হবে? ভ্রূজোড়া বিস্তারিত করে অপূর্ব ভঙ্গীতে হাসলো শিউলি, তাহলে শুনুন, আমি আপনার কাছে এসেছি এবং আপনার কাছেই আসি।

কিন্তু কেন? উত্তেজিত গলায় কাসেদ শুধালো, আপনার সঙ্গে আমার কোন সম্পর্ক নেই যার জন্যে আপনি আমার কাছে আসতে পারেন। সারা মুখ কালো হয়ে গেলো শিউলির।

ঠোঁটের কোণে একসূতো হাসি জেগে উঠলো ধীরে ধীরে, তারপর সে হাসি অতি সুক্ষ্ম ঢেউ তুলে ছড়িয়ে পড়লো তার সম্পূর্ণ ঠোঁটে, চিবুকে, চােখে, সারা মুখে।

শিউলি মৃদু গলায় বললো, রাস্তায় দাঁড়িয়ে ঝগড়া না করে, আসুন রিক্সায় উঠুন। ভয় নেই আপনাকে নিয়ে আমি কোথাও পালিয়ে যাবো না, অফিসে নামিয়ে দিয়ে আমার হোস্টেলে ফিরে যাবো।

কাসেদ বললো, আমি রোজ হেঁটে যাই, আজও যেতে পারবো।

শিউলি বললো, দেখুন মেয়েমানুষের মত রাগ করবেন না, উঠন, রিক্সায় উঠুন। শিউলির চোখের দিকে তাকিয়ে এবার আর না করতে পারলো না কাসেদ, নীরবে উঠে বসলো সে।

রিক্সাওয়ালাকে যাবার জন্যে নির্দেশ দিয়ে শিউলিও উঠে বসলো পাশে। আজ একটু ছোট হয়ে বসতে চেষ্টা করলো কাসেদ।

শিউলির গায়ে গা লাগতে পারে সেই ভয়ে।

শিউলি আড়চোখে এক পলক দেখে নিয়ে মৃদু হাসলো। হেসে বললো, আপনারা পুরুষ মানুষগুলো এত সহজে বদলে যেতে পারেন যে কি বলবো!

কাসেদ চুপ করে থাকবে ভেবেছিলো, কিন্তু জবাব না দিয়ে পারলো না। অন্য পুরুষের কথা আমি বলতে পারবো না। নিজে আমি সহসা বদলাই নে। আমি যা ছিলাম। তাই আছি, তাই থাকবো।

তাই নাকি? চোখজোড়া বড় বড় করে ওর দিকে তাকালো শিউলি। শুনে বড় খুশি হলাম। কিন্তু জনাব, একটা কথা যদি জিজ্ঞেস করি তাহলে রাগ করবেন না তো? মুখ টিপে হাসছে শিউলি।

কাসেদ বললো, বলুন।

ক্ষণকাল চুপ করে থেকে শিউলি ধীরে ধীরে বললো, সেদিন বিকেলে সেই একসঙ্গে রিক্সায় চড়ে হাতে হাত রেখে বেড়ানো আর মাঝে মাঝে একটা কি দুটো কথা বলা এর সবটুকুই কি মিথ্যা। মুখখানা নুইয়ে ওর চোখে চােখে তাকাতে চেষ্টা করলো শিউলি।

সহসা কোন উত্তর দিতে পারলো না সে।

একটু পরে কি ভেবে বললো, আপনি যা ভাবছেন সে অর্থে মিথ্যে।

আমি কি ভেবেছি তা আপনি বুঝলেন কি করে?

কারণ আমি শুনেছি সব। কাসেদ বিরক্তির সঙ্গে বললো : জাহানারা এসেছিলো বাসায়, কাল বিকেলে।

শিউলি হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেলো।

অনেকক্ষণ চুপচাপ কি যেন ভাবলো সে।

রিক্সাটা কাসেদের অফিসের কাছাকাছি এসে পৌঁছেছে।

শিউলি আস্তে করে বললো, সেদিন আপনি একটা অনুরোধ করেছিলেন, আমি রেখেছিলাম। আজ আমার একটা কথা। আপনি রাখবেন? ওর কণ্ঠস্বরে আশ্চৰ্য আবেগ।

নড়েচড়ে বসে কাসেদ শুধালো, কি কথা বলুন?

শিউলি ধীর গলায় বললো, আজ বিকেলে আমি নিউ মার্কেটের মোড়ে আপনার জন্যে অপেক্ষা করবো, আপনি আসবেন, কিছু কথা আছে আপনার সঙ্গে। আসবেন তো?

রিক্সা থেকে নেমে কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে রইলো কাসেদ।

তারপর মৃদুস্বরে বললো, চেষ্টা করবাে।

চেষ্টা করবো নয়, অবশ্যই আসবেন।

ততক্ষণে অফিসের দৌড়গোড়ায় পা দিয়েছে কাসেদ।

শিউলি রিক্সা নিয়ে তখনো দাঁড়িয়ে রইলো, না চলে গেলো, একবার ফিরেও দেখলো না সে।

অফিসে এখন আর সে উত্তেজনা নেই।

সব শান্ত।

মকবুল সাহেব পক্ষাঘাত রোগে এখনও বিছানায় পড়ে আছেন। ভালো হবার কোন সম্ভাবনা নেই।

পরস্পরের কাছ থেকে শোনা যায়। আজকাল আর আগের সে আর্থিক অনটন নেই তাঁর। বড় সাহেবের শ্বশুর এখন, বেশ সুখেই আছেন। বড় সাহেবও বেশ সুখী।

রোজ দুপুরে মকবুল সাহেবের মেয়ে বাড়ি থেকে খাবার নিয়ে আসে তাঁর জন্যে। পরনে সুন্দর একখানা শাড়ি, মাথায় ছোট একটা ঘোমটা, হাতে একটা টিফিন ক্যারিয়ার, পায়ে পাতলা স্যাণ্ডেল। নিঃশব্দে মেয়েটি উঠে আসে ওপরে। হাল্কা পায়ে সে এগিয়ে যায় বড় সাহেবের কামরার দিকে। তারপর দু’জনে একসঙ্গে খায়। খাওয়া-দাওয়া হয়ে গেলে নীরবে। আবার বাড়ি ফিরে যায় মেয়েটি।

প্রথম প্রথম অফিসের সবাই মুখ টিপে হাসতাে। চাপা ঘরে আলােচনা চলতাে ওদের

আজকাল তাও বন্ধ।

শুধু মেয়েটি যখন আসে আর সামনে দিয়ে হেঁটে বড় সাহেবের ঘরের দিকে এগিয়ে যায়। তখন কি একটা অস্বস্তিতে ভোগে কাসেদ।

ইচ্ছে করে মেয়েটিকে দেখতে।

কিন্তু ও যখন আসে তখন ওর মুখের দিকে তাকাতে গিয়েও পারে না সে। কোথা থেকে একটা জড়তা এসে সারা দেহ গ্ৰাস করে নেয় ওর। মেয়েটি ওর বউ হতে পারতো।

ইচ্ছে করলে ওকে বিয়ে করতে পারতো। কাসেদ।

হয়তো ওকে নিয়ে বেশ সুখী হতে পারতো সে। আজ বড় সাহেবের জন্যে খাবার নিয়ে আসে, সেদিন কাসেদের জন্যে আসতো মেয়েটি।

দু’জনে এক সঙ্গে খেতে ওরা।

কথা বলতো।

গল্প করতো।

কত না আলাপ করতো খেতে বসে।

কিন্তু জাহানারা।

জাহানারা, একি করলে তুমি?

অফিসের কাজ করতে বসে একটুও মন বসল না। ওরা। গতদিন বিকেলের ছবিটা বার বার ভেসে উঠছে চােখে। জাহানারার প্রতিটি কথা আবার নতুন করে কানে বাজছে এখন। টাইপরাইটারটা একবার কাছে টেনে নিয়ে আবার দূরে ঠেলে দিলো সে। হঠাৎ সামনে টেবিলের উপর বিছানো কাগজের দিকে চোখ পড়তে চমকে উঠল কাসেদ।

জাহানারার নাম লিখে সম্পূর্ণ কাগজটা ভরিয়ে তুলেছে সে।

চারপাশে দ্রুত তাকিয়ে নিয়ে একটা কলম দিয়ে ধীরে ধীরে নামগুলো কেটে ফেললো সে।

কাটতে গিয়ে একটুখানি স্নান হাসলো সে।

ওর জীবনে থেকেও জাহানারার নামটাকে হয়তো এমনি করে কেটে ফেলতে হবে একদিন।

অফিস থেকে বেরুবার আগে মন স্থির করে নিয়েছিলো কাসেদ। বিকেলে যাবে জাহানারার ওখানে। কাল যে ভুল বুঝাবুঝির মধ্য দিয়ে সে চলে এসেছে তা দূর করে আসবে আজ।

যে কথাটা এতদিন বলে নি, বলতে গিয়েও পিছিয়ে এসেছে। আজ সে কথাটা ওকে খুলে বলবে সে। হয়তো শুনে হাসবে জাহানারা। শব্দ করে হেসে উঠবে, তবু বলবে কাসেদ।

যা হবার হােক।

জীবনে একটা চরম সিদ্ধান্ত নিতে চায় সে।

জাহানারাদের বাসার বারান্দায় দাঁড়িয়ে ওর মনে হলো কে জানে হয়তো আজ এখানে এই শেষ আসা।

বুড়িটা বাচ্চা কোলে নিয়ে বারান্দায় বসেছিলো। ডেকে এনে ওকে বসালো ভেতরে। বললো, বয়েন, উনি উপরে আছেন, খবর দিই গিয়া। বলে সে চলে গেলো ভেতরে। সেই যে গেলো অনেকক্ষণ আর তার দেখা নেই, একা ঘরে বসে বসে ক্লান্তিবোধ করলো সে। উঠে দাঁড়িয়ে বারকয়েক পায়চারী করলো। বসলো, আবার উঠে দাঁড়ালো।

জাহানারা এলো না, এলো সেই বুড়ি। ওর মুখের দিকে সন্ধানী দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে শুধালো, আপনার নাম কি?

কাসেদ নাম বলতে আবার ভেতরে চলে গেলো বুড়ি।

আবার সব চুপ।

অনেকক্ষণ হলো কারো আসার লক্ষণ দেখা গেলো না।

চোখ মেলে প্রতিনিয়ত দেখা দেয়াল আর কড়িকাঠগুলো দেখতে লাগলো কাসেদ।

কিভাবে জাহানারার সঙ্গে আলোচনা করা যেতে পারে, মনে মনে একবার তার মহড়া করে নিলো।

তবু কেউ আসে না।

অবশেষে এল।

জাহানারা নয়। বুড়িটিও নয়। ওদের বাচ্চা চাকরিটা।

চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো কাসেদ।

চাকরাটা মৃদু হেসে বলল, আপাজানের শরীর খারাপ, আজ দেখা হবে না। অন্যদিন আসতে বলেছে।

শরীর খারাপ বলে নিচে নেমে এসে একবার কাসেদের সঙ্গে দেখাও করতে পারলো না জাহানারা? এর আগে জুর নিয়েও ওর সঙ্গে বাইরে বেরিয়েছে সে, কাসেদ নিষেধ করলেও আমল দেয়নি।

আর আজ!

কথাটা সহসা বিশ্বাস হতে চাইলো না ওর।

চাকরটা মৃদু হেসে চলে গেলো ভিতরে।

হাসলো না, যেন বিদ্রুপ করে গেলো ওকে।

আবার একা।

ঘরের মধ্যে বারিকয়েক পায়চারি করলো কাসেদ। ভালো লাগছে না, বারবার করে মনে হলো, জাহানারা আজ ইচ্ছে করে অপমান করলো তাকে। সে কোন অপরাধ করে নি। তবু তাকে শাস্তি দিলো জাহানারা। কাসেদের মনে হলো পুরো দেহটা জুলছে ওর।

অপমান আর অনুশোচনার তীব্ৰ জ্বালা যেন পাগল করে তুলেছে তাকে। কেন ওকে ভালবাসতে গেল সে!

সামান্য ভদ্রতা আর সহজ মানবিক বৃত্তিগুলোও হারিয়ে ফেলেছে জাহানারা। অতি নিচে নেমে গেছে সে।

ওর তুলনায় সালমা অনেক বড়ো। অনেক উদার মনের মেয়ে সে। দেখতে শুনতেও সে খারাপ নয়। প্রাণভরে কাসেদকে ভালবাসতো সালমা। মুহুর্তের জন্যে কাসেদের মনে হলো সালমার ডাকে সেদিন সাড়া না দিয়ে মস্ত বড় ভুল করেছে সে।

আর শিউলি?

শিউলির কথা মনে হতে কাসেদের মনে পড়লো, সন্ধ্যার আগে আগে শিউলি ওর জন্যে অপেক্ষা করবে বলেছে নিউমার্কেটের মোড়ে।

শিউলির পাশে জাহানারাকে আজ অনেক ছোট মনে হলো কাসেদের। শিউলির হাসি। কথা। আলাপের ভঙ্গী আর বাচ্চা মেয়ের মতো ব্যবহার সব সুন্দর। অন্তত জাহানারার চেয়ে।

Category: শেষ বিকেলের মেয়ে (উপন্যাস)
পূর্ববর্তী:
« ০৫. অফিসের কানাঘুষো
পরবর্তী:
০৭. শিউলিকে ছায়ার মত মনে হলো »

Reader Interactions

Leave a Reply Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

বাংলা লাইব্রেরি : উল্লেখযোগ্য বিভাগসমূহ

লেখক ও রচনা

অনুবাদ সাহিত্য

সেবা প্রকাশনী

ডিকশনারি

কৌতু্ক / জোকস

লিরিক

রেসিপি

কোরআন

হাদিস

ত্রিপিটক

মহাভারত

রামায়ণ

পুরাণ

গীতা

বাইবেল

বিবিধ রচনা

বাংলা ওসিআর

Download Bangla PDF

হেলথ

লাইব্রেরি – ফেসবুক – PDF

top↑