• Skip to main content
  • Skip to header right navigation
  • Skip to site footer

Bangla Library

Read Bengali Books Online (বাংলা বই পড়ুন)

  • লেখক
  • My Account
  • লেখক
  • My Account
  • বাংলা ডিকশনারি
  • বাংলা কৌতুক
  • বাংলা লিরিক
  • বাংলা রেসিপি
  • হেলথ টিপস এন্ড নিউজ

বাংলা PDF ডাউনলোড

বাংলা নতুন/পুরাতন বইয়ের পিডিএফ ডাউনলোড/সন্ধান করতে আমাদের বাংলা পিফিএফ সাইটে ক্লিক করুন।

Bangla PDF

০৫. অফিসের কানাঘুষো

লাইব্রেরি » জহির রায়হান » শেষ বিকেলের মেয়ে (উপন্যাস) » ০৫. অফিসের কানাঘুষো

অফিসের কানাঘুষো

অফিসের কানাঘুষো ইদানীং অন্য রূপ নিয়েছে।

মকবুল সাহেবের প্রতি বড় সাহেবের পক্ষপাতিত্ব সবার মনে ঈর্ষার জন্ম দিয়েছে। আর তাই রোজ অফিসে এসে কাজের ফাঁকে তারা চাপা সুরে এই অর্থপূর্ণ সম্পর্ক নিয়ে আলোচনার ঝড় তুলছে। রোজ বিকেলে সাহেব হাসপাতালে যান অসুস্থ মকবুল সাহেবকে দেখতে, তাঁর খবরাখবর নিতে।

কিন্তু কেন, কিসের জন্য?

শহরে এমন আরেকটি অফিস কি কেউ দেখাতে পারবে যার একজন কর্মচারী অসুস্থ হয়ে পড়লে বড় সাহেব রোজ তাকে দেখতে যান? শুধু কি দেখতে যাওয়া?

রোজ যাবার সময় বিঙ্কিট, হরলিক্স, ফলমূল কত কিছু নিয়ে যান তিনি। তাছাড়া ওঁর পেছনে টাকা খরচ করার ব্যাপারেও এতটুকু কাৰ্পণ্য করছেন না তিনি। শোনা যাচ্ছে কোলকাতা থেকে একজন নামকরা ডাক্তার আনার কথাও ভাবছেন বড় সাহেব।

কিন্তু কেন?

কাসেদ বলে, যদি টাকা খরচ করেই থাকেন, আপনাদের এত মাথাব্যথা কেন? শুনে বিশ্ৰীভাবে হাসে এক নম্বর কেরানী। বলে, মাথাব্যথা হতো না, যদি না এই টাকা খরচের পেছনে অন্য কোন উদ্দেশ্য লুকানো থাকতো।

বলে আবার হাসে লোকটা।

কাসেদ বুঝতে পারে না, ও কি বলতে চায়। ইতস্তত করে আবার প্রশ্ন করে, তার  মানে?

মানে? মানে অত্যন্ত সহজ। চারপাশে তাকিয়ে নিয়ে এক নম্বর বলে, মকবুল সাহেবের একটি বয়স্ক মেয়ে আছে সে খবর রাখেন?

কাসেদ বলে, হ্যাঁ রাখি। একটি নয় দু-তিনটি মেয়ে আছে তাঁর।

ব্যাস। মাথা দুলিয়ে এক নম্বর কেরানী আবার বলে, বাকিটুকু আপনি নিজেই বুঝে নিন।

কাসেদের বুঝতে বাকি থাকে না।

একাউন্‌টেন্ট তার টেবিল থেকে গড়া বাড়িয়ে বলেন, পরশু দিন বিকেলে দেখলাম বড় সাহেব তাঁর গাড়ি করে ওদের হাসপাতাল থেকে বাসায় পৌঁছে দিচ্ছেন।

কাসেদ পরীক্ষণে বলে, ওটা অন্যায় কিছু করেন নি তিনি।

আরে সাহেব আপনার এত গা জুলছে কেন শুনি? এক নম্বর কেরানী টেনে টেনে বলেন, আমরা তো আর আপনাকে বলছি না।

জবাবে কিছু বলতে যাচ্ছিলো কাসেদ, বড় সাহেবকে এদিকে আসতে দেখে চুপ করে গেলো সে।

বড় সাহেব কেন যে এ ঘরে এলেন কিছু বুঝা গেল না।

লম্বা অফিস ঘরটায় বার কয়েক পায়চারী করলেন তিনি। মনে হলো কি যেন গভীরভাবে ভাবছেন, চিন্তা করছেন।

স্ত্রীর সঙ্গে ডিভোর্স হবার আগে এবং পরে সব সময় তাঁকে কিছুটা চিন্তাক্লিষ্ট দেখাতো।

কিন্তু আজকের ভাবনার মধ্যে রয়েছে একটা অনিবাৰ্য অস্থিরতা। কেরানীরা এখন আর কথা বলছে না।

কাজ করছে।

বিকেলে কাসেদের মনটা হঠাৎ উদাস হয়ে গেলো।

বাড়িতে মায়ের অসুখ। তবু বাসায় ফিরতে ইচ্ছে করলো না তার।

ইচ্ছে হলো জাহানারাদের ওখানে যেতে।

কি করছে জাহানারা?

হয়তো বাগানে বসে বসে গল্প করছে পাড়ার বান্ধবীদের সঙ্গে।

কিম্বা তার শোবার ঘরে জানালার পাশে বই পড়ছে, উপন্যাস, গল্প অথবা কবিতা।

জাহানারা, এভাবে আর কতদিন চলবে বলতে পারে? কতদিন আমি ভেবেছি আমার মনের একান্ত গোপন কথাটা ব্যক্ত করবো তোমার কাছে। বলবো সব। বলবো এসো আমরা ঘর বাঁধি। তুমি আর আমি। আমরা দু’জনা, আর কেউ থাকবে না সেখানে।

কেউ না।

রাস্তায় কত লোক। আসছে। যাচ্ছে। কথা বলছে। ওরাও হয়ত ভাবছে কারো কথা। কারো স্বপ্ন আঁকছে মনে মনে, কল্পনার চোখে দেখবার চেষ্টা করছে। ভবিষ্যতের দিনগুলোকে, রোমাঞ্চকর অনাগত দিন।

আজকাল জাহানারাকে নিয়ে একটু বেশি করে ভাবছে কাসেদ।

মূলে রয়েছে মা। রোজ একবার করে তাড়া দিচ্ছেন তিনি। বিয়ে করা। আমি বেঁচে থাকতে একটা বউ নিয়ে আয় ঘরে।

আর বিয়ের কথা যখনি ভাবে কাসেদ জাহানারা ছাড়া অন্য কারো চিন্তা মনে আসে না তার।

একমাত্র জাহানারা স্ত্রী হিসেবে ঘরে আসতে পারে তার।

আর কেউ নয়।

বাইরে, বাসার সামনে কমলা রঙের শাড়ি পরে মেয়েটি দাঁড়িয়ে, সে জাহানারা নয়, শিউলি।

শিউলির সঙ্গে সেই অনেকদিন আগে জাহানারার জন্মদিনে এই বাড়িতেই প্ৰথম আলাপ হয়েছিলো তার।

শিউলি হাসলাে। জাহানারার কাছে এসেছেন বুঝি?

কাসেদ সংক্ষেপে বললো, হ্যাঁ।

শিউলি বললো, ও এখন সেতার শিখছে, ডিস্টার্ব করা ঠিক হবে না। আসুন না, আমরা এখানে মাঠের ওপর বসি।

কাসেদ ইতস্তত করে বললো, হ্যাঁ বসা যেতে পারে, আমার কোন আপত্তি নেই।

শিউলি ঠোঁট টিপে হাসলো। মনে হলো কিছু বলবে। বললো না।

মাঠের ওপরে যেখানে কয়েকটা ফুলের টবে লাল, সাদা ফুল ফুটে আছে সেখানে এসে বসলো। ওরা।

কাসেদ বললো, কই আপনি এলেন না তো একদিনও?

শিউলি বললো, যেতাম। কিন্তু, পরে ভাবলাম আসা-যাওয়ার উৎসাহ দেখে আপনি যদি শেষে ভুল বুঝে বসেন আমায়?

ভুল! ভুল কিসের? কাসেদ অবাক হলো।

শিউলি হেসে হেসে বললো, যদি ভাবেন আমি আপনার প্রেমে পড়ে গেছি তাহলে? বলে শব্দ করে হেসে উঠলো। সে। হাসির দমকে সরু দেহটা যেন নেতিয়ে পড়তে চাইলো ঘাসের ওপরে।

কাঁধের ওপর থেকে কোলে নেমে আসা আঁচলখানা আবার যথাস্থানে তুলে দিয়ে শিউলি বললো, আচ্ছ একটা কথার জবাব দিতে পারেন?

কি কথা?

মাঝে মাঝে আপনাকে বড় দেখতে ইচ্ছে করে, কেন বলুন তো?

শিউলি তার চোখের দিকে তাকালো।

পর পর কয়েকটা ঢোক গিললো কাসেদ।

জবাব দেবার মত কোন কথা খুঁজে পেলো না সে। আলোচনাটা অন্য দিকে ঘুরিয়ে নেয়ার জন্যেই হয়তো সে পরীক্ষণে বললো, চলুন না, জাহানারার ঘরে গিয়ে বসা যাক। এতক্ষণে তার সেতার শেখা নিশ্চয় শেষ হয়েছে। এত শিষ্ট্ৰী? শিউলি যেন চীৎকার করে। উঠলো। তারপর ঠোঁটের কোণে অর্থপূর্ণ হাসির ঈষৎ তরঙ্গ তুলে ধীর গলায় বললো, আপনি কি ভাবেন সেতার শেখানটাই মুখ্য?

কাসেদ শুধালো, কেন বলুন তো?

শিউলি হাসলো, আপনি কিছুই জানেন না। তাহলে?

কাসেদের বুকটা কেঁপে উঠলো সহসা। কিছু বলতে গিয়ে আবার বার কয়েক ঢোক গিললো, কই জানি না তো?

শিউলির চোখেমুখে কৌতুক। সামনে ঝুঁকে এসে আস্তে বললো, তারের সঙ্গে তারের জোর প্ৰেম চলছে।

তার মানে? হৃৎপিণ্ডতা গলার কাছে এসে আঘাত করছে যেন। সপ্ৰসন্ন দৃষ্টি মেলে ওর দিকে তাকিয়ে রইলো কাসেদ।

শিউলি বললো, এখনো বুঝলেন না? ঠোঁট টিপে আবার হাসলো সে। এই সহজ কথা বুঝতে এত দেরি হচ্ছে আপনার? চারপাশে এক পলক দেখে নিয়ে আরো কাছে সরে এলো শিউলি। মাস্টার আর ছাত্রীতে মন দেয়া নেয়ার পালা চলছে, বুঝলেন?

কাসেদের মনে হলো, ওর দেহটা যেন ক্লান্তি আর অবসাদে ভেঙে আসতে চাইছে। উঠে দাঁড়াবার শক্তি পাচ্ছে না। সে।

কেন এমন হলো জাহানারা?

এ সিদ্ধান্ত নেবার আগে আমাকে একবার জিজ্ঞেস করলে কি ক্ষতি হয়ে যেতো তোমার? আমি নিশ্চয় বাধা দিতাম না, কেন দেবো?

পৃথিবীতে আমরা সবাই প্রথমে নিজের কথা ভাবি, পরে অন্যেরা। তুমি তোমার পথে চলবে, আমি আমার পথে। তোমারটা আমি কোনদিনও কেড়ে নিতাম না। তবে কেন তুমি সব কিছু লুকিয়ে গেলে আমার কাছ থেকে?

ওকি আপনি একেবারে চুপ করে গেলেন যে? শিউলির কণ্ঠস্বরে জিজ্ঞাসার সুর, কি ভাবছেন?

না, কিছু না তাে? কাসেদ নিজেকে আড়াল করতে চাইলো শিউলির দৃষ্টি থেকে।

শিউলি আবার বললো, আপনি যেন কেমন একটু গম্ভীর হয়ে গেলেন মনে হচ্ছে?

তাই নাকি? না, এমনি। কাসেদ নড়েচড়ে বসলো।

শিউলি শুধালো, উঠবেন নাকি?

কাসেদ বললো, হ্যাঁ, না ভাবছি–।

কি ভাবছেন?

এখানে আর একটু বসা যাক, কি বলেন? অনেকটা সহজ হবার চেষ্টা করলো কাসেদ।

শিউলি বললো, জাহানারার সঙ্গে দেখা করবেন না?

করবো না কেন? দেখা করতেই তো এসেছি। বলতে গিয়ে গলার স্বরটা কাঁপলো ওর।

কি আশ্চর্য! আজি বিকেলে জাহানারাদের বাসার পথে আসতে আসতে অনেক কিছু ভেবেছে কাসেদ, অনেক কল্পনার জাল বুনেছে। কিন্তু ভুলেও ভাবে নি, মাস্টারের সঙ্গে এমন একটা সম্পর্ক পাতিয়ে বসতে পারে জাহানারা। কেন এমন হলো?

শিউলি শুধালো, আপনার শরীরটা খুব খারাপ লাগছে?

কাসেদ উত্তরে কিছু বলতে যাচ্ছিলো, শিউলি তাকে বাধা দিয়ে আবার বললো, ওই যে জাহানারা।

মাঠ থেকে বারান্দার দিকে দেখলো কাসেদ।

এইমাত্র মাস্টারকে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এসেছে জাহানারা।

মাস্টার বললো, এবার যাই তাহলে?

জাহানারা বললো যাই নয়, আসি। কাল ঠিক সময় আসবেন তো? আসবেন কিন্তু। নইলে আরো বেশিক্ষণ বসিয়ে রাখবো। একটু শাসন, একটু রাগ, একটু অভিমান।

এমন করে তো কাসেদের সঙ্গে কথা বলে নি জাহানারা।

শিউলি বিড়বিড় করে কি বললো কিছু বোঝা গেল না।

জাহানারা তার মাস্টারের দিকে চেয়ে চেয়ে হাসছে।

দাঁতগুলো চিকচিক করছে বিকেলের রোদে।

ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালো ওরা।

শিউলি ডাকলো, জাহানারা।

ওদের দেখে চোখ জোড়া বড়ো বড়ো করে তাকালো জাহানারা, তোমরা ওখানে করছো কি?

শিউলি হেসে দিয়ে বললো, প্ৰেমালাপ করছি, তাই না কাসেদ সাহেব?

ঘাড় বাকিয়ে বাঁকা চোখে কাসেদের দিকে তাকালো সে।

জাহানারা ততক্ষণে এগিয়ে এসেছে সামনে।

কাসেদ কোন উত্তর না দিয়ে গম্ভীর হয়ে গেলো।

জাহানারা শুধালো, আপনি কখন এসেছেন?

কাসেদ কোন জবাব দেবার আগেই শিউলি বললো, অনেকক্ষণ হয়। উনি এসেছেন, আমি আটকে রেখেছি। এখানে।

জাহানারা বললো, ভিতরে গেলেই তো পারতেন।

না, ভাবলাম আপনার অসুবিধা হতে পারে। যতই লুকোতে ইচ্ছে করুক না কেন, গলার স্বর অস্বাভাবিক শুনালো জাহানারার কানে।

জাহানারা মিষ্টি হাসলো, কি যে বলেন, অসুবিধে কেন হবে! আসুন ভেতরে বসবেন।

কাসেদের মনে হলো জাহানারার কথাবার্তায় আগের সেই আন্তরিকতা নেই। বাড়িতে এসেছে। যখন বসাতে হবে তাই বসতে বলছে সে। সামনে জাহানারা আর পেছনে শিউলি আর কাসেদ। পাশাপাশি। শিউলি চাপা স্বরে শুধালো, আপনার কি হয়েছে বলুন তো, সেই তখন থেকে কেমন যেন গুম হয়ে আছেন।

কাসেদ বললো, ও কিছু না।

জাহানারা পেছন ফিরে জিজ্ঞেস করলো, আমাকে কিছু বললেন কি?

কাসেদ সংক্ষেপে বললো, না।

হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে ওর। দেহটা কাঁপছে। বুকের মধ্যে একটা চিনচিনে ব্যথা। যন্ত্রণা। কাসেদের মনে হলো এ মুহূর্তে এখান থেকে ছুটে দুরে কোথাও পালিয়ে যেতে পারলে যেন কিছুটা শান্তি পেত সে। স্বস্তি পেতো। মাথাটা ভার হয়ে আসছে। ধীরে ধীরে। মনে হচ্ছে দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গড়িয়ে পড়তে চায় মাটিতে।

কেন এমন হলো?

পা থেকে মাথা পর্যন্ত জাহানারাকে দেখে নিলো কাসেদ। আজ ওকে আগের চেয়ে অনেক বেশি সুন্দর দেখাচ্ছে। অনেক আকর্ষণীয়। ওর চােখের আর মুখের লাবণ্য অনেক বেড়ে গেছে। কথার মধ্যেও আশ্চর্য পরিবর্তন।

কাসেদের মনে হলো সে যেন এ মুহুর্তে আরো বেশি করে ভালবেসে ফেলেছে। ওকে। তাকে পাবার আকাজক্ষা আরো তীব্র হয়ে দেখা দিয়েছে। ওর মনে।

না। জাহানারাকে বাদ দিয়ে ভবিষ্যতের কোন কিছুই কল্পনা করতে পারে না কাসেদ। কিছুই না।

জাহানারা শুধালো, চা খাবেন, না কফি?

কাসেদ কোন উত্তর দিলো না। শুধু একদৃষ্টি তাকিয়ে রইলো ওর দিকে।

জাহানারা বললো, আপনার কি হয়েছে বলুন তো? আজ কেমন যেন অন্য রকম মনে হচ্ছে আপনাকে।

কাসেদ মনে মনে ভাবলো, পরিবর্তন আমার মধ্যে নয়, তোমার মধ্যে এসেছে। তুমি আগের সেই মেয়েটি নেই, সম্পূর্ণ ভিন্ন।

কিন্তু মুখে বললো, আমার শরীরটা ভালো নেই।

সে কি, অসুখ করে নি তো? জাহানারার চোখেমুখে আতঙ্কের ছায়াপাত হলো। হাত বাড়িয়ে ওর কপাল স্পর্শ করে দেখলে সে, বললো, কই টেম্পারেচার নেই তো?

শিউলি বললো, ওর তো জ্বর হয়নি যে টেম্পরেচার পাবে। ওর শরীর খারাপ করছে।

জাহানারা বললো, এক কাপ কফি খান, শরীর ভালো হয়ে যাবে।

কাসেদ বললো, থাক। এখন আমার কিছুই খেতে ইচ্ছে করছে না। তাছাড়া এখনি আমাকে উঠতে হবে।

জাহানারা চোখ বড় বড় করে বললো, সেকি, এই এলেন আর চলে যাবেন?

কথাটা কানে গেলো না ওর। ও তখন ভাবছে জাহানারার জন্যে একটা সেতারের মাস্টার ঠিক না করে দিয়ে কত বড় ভুল করেছে। জাহানারা বারবার করে বলেছিলো, একটা মাস্টার ঠিক করে দিন। তখন যদি ওর অনুরোধ রক্ষা করতো সে তাহলে হয়তো এত বড় বিপর্যয় ঘটতো না।

শিউলি শুধালো, আপনি কি বাসায় ফিরবেন?

কাসেদ বললো, হ্যাঁ।

খুলে যাওয়া খোঁপাটা ভালো করে বাঁধতে বাঁধতে জাহানারা জানালার পাশে সরে দাঁড়ালো। তারপর সেখান থেকে জিজ্ঞেস করলো, রোববার দিন বিকেলে কি আপনি বাসায় থাকবেন?

কেনো?

যদি থাকেন তাহলে বাসায় আসবো। আপনার সঙ্গে কিছু কথা আছে আমার। বুকটা আবার মোচড় দিয়ে উঠলো। ওর। আড়চোখে একবার ওকে দেখে নিয়ে বললো, রোববার ছাড়া অন্য কোন দিন আসতে পারেন না?

জাহানারা বললো, রোববার দিন আমার ছুটি কিনা তাই। অন্যদিন গেলে আমার সেতার শেখা হবে না। মাস্টাের ভীষণ রাগ করবেন।

আবার সেতার শেখা!

আবার সেতারের মাস্টার!

রাগে দেহটা জ্বালা করে উঠলো ওর। পরক্ষণে উঠে দাঁড়িয়ে বললো, ঠিক আছে, আমি বাসায় থাকবো, আসবেন। এখন চলি।

ওর সঙ্গে শিউলিও উঠে দাঁড়ালো। আমার একটা কথা রাখবেন কাসেদ সাহেব?

কি?

বাড়ি যাবার পথে আমাকে হােস্টেলে পৌঁছে দিয়ে যাবেন?

কিন্তু…কাসেদ ইতস্তত করে বললো, পথটা তো এক হলো না। উল্টো।

শিউলি বললো, আমার জন্যে না হয় একটু উল্টো পথ ঘুরেই গেলেন। যাবেন কি?

কাসেদ জাহানারার দিকে এক পলক তাকালো; ও জানালা গলিয়ে বাইরে আকাশ দেখছে, দেখুন।

কাসেদ বললো, যাবো বইকি, চলুন। গলার স্বরে উৎসাহের আধিক্য দেখে নিজেই চমকে উঠলো। বুঝতে পারলো না কথাটা হঠাৎ এত জোরের সঙ্গে কেন বলতে গেলো সে।

জানালা থেকে সরে এলো জাহানারা।

শিউলি শুধালো, তুমি এখন ঘরে বসে বসে করবে কি জাহানারা?

জাহানারা ধীর গলায় বললো, কি আর করবো, মাস্টার একটা নতুন গদ দিয়ে গেছেন, বসে বসে সেতার বাজাবো।

আবার মাস্টার!

আবার সেতার!

শিউলিকে সঙ্গে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলো কাসেদ।

কিছুই ভালো লাগছে না।

মনটা একেবারে শূন্য হয়ে গেছে ওর।

আকাশে অনেক তারা জুলছে। রাস্তায় অনেক লোক। বাতাসে কার বাগানের মিষ্টি গন্ধ আসছে ভেসে। কিন্তু এর কোন কিছু দিয়ে এ শূন্যতা ভরানো যাবে না।

শুনেছেন? সহসা কাসেদ বললো, আপনার প্রস্তাব মেনে নিয়েছি। আপনি আমার একটা কথা রাখুন। আজ।

কি কথা? শিউলির দুচোখে ঔৎসুক্য ভীড় করেছে এসে।

কাসেদ মৃদু গলায় বললো, আমার সঙ্গে একটু বেড়াবেন। ঘুরবেন যেখানে যেখানে আমি নিয়ে যাই। আজ বড় একা লাগছে আমার।

শিউলি ভ্রূজোড়া প্রসারিত করে তাকালো ওর দিকে, তারপর হেসে বললো, কিন্তু আমাকে যে ন’টার মধ্যে হােস্টেলে ফিরতে হবে, নইলে সুপার ভেতরে ঢুকতে দেবে না। শেষে অনেক ঝামেলা পোহাতে হবে।

কাসেদ স্নান হেসে বললো, আমি যদি আপনার জন্যে উল্টো পথে পাড়ি দিতে পারি, আপনি আমার জন্য এ ঝামেলার ঝুকিটা নিতে পারেন না?

কিন্তু কেন বলুন তো? কণ্ঠে ঈষৎ বিস্ময় নিয়ে শিউলি শুধালো, আজ হঠাৎ বেড়াতে ইচ্ছে হলো কেন আপনার? বিশেষ করে আমাকে সঙ্গে নিয়ে।

কাসেদ সহসা জবাব দিলো না।

নীরবে কি যেন ভাবলো।

জাহানারা, কেন এমন করলে তুমি! তোমাকে ভালবেসে পরিপূর্ণ ছিলাম আমি। যেদিকে তাকাতাম ভালো লাগতো আমার। আজ আকাশের নীল আর নিওনের আলো সব কিছু বিবৰ্ণ মনে হচ্ছে আমার চােখে।

কেন এমন হলো জাহানারা?

আমি জাহানারা নই, শিউলি। শিউলি মিটমিটি হাসছে। কপালে কয়েকটা ভাঁজ পড়েছে ওর।

কাসেদ অপ্ৰস্তুত হয়ে গিয়ে বললো, না–মানে। কথাটা শেষ করলো না সে। সহসা শিউলির একখানা হাত নিজের হাতে তুলে নিয়ে আবেগভরা গলায় কাসেদ বললো, আচ্ছা! বলতে পারেন, আমি যা চাই তা পাইনে কেন?

হাতখানা সরিয়ে নিলো না শিউলি। মৃদু চাপ দিয়ে শুধু বললো, চাওয়া পাওয়ার সঙ্গে সাপে-নেউলের সম্পর্ক রয়েছে যে। এই দেখুন না, আমি চাই ছেলেদের সঙ্গে বন্ধু হিসেবে মিশতে আর ওরা চায় আমাকে ঘরের গিনী হিসেবে পেতে। ভাবুন তো কেমন বিচ্ছিরি ব্যাপার। শিউলি হাসল শব্দ করে। কিন্তু আপনাকে যদি কেউ গিনী হিসেবে পেতে চায়, সেটা কি অন্যায়?

ওর হাতে একটা নাড়া দিলো শিউলি।

শিউলি পরীক্ষণে বললো, একতরফা চাওয়াটা অন্যায় বইকি।

কথাটা তীরের ফলার মত এসে বিঁধল ওর বুকে।

শিউলি কি বলতে চায় জাহানারার সঙ্গে একতরফা প্ৰেম করে অন্যায় করেছে কাসেদ? না। আপনার সঙ্গে একমত হতে পারলাম না। আমি। কাসেদ জোরের সঙ্গে বললো, ভালবাসা অন্যায় নয়। সে একতরফা হােক কিম্বা দুতরফা। হাতখানা ওর হাত থেকে টেনে নিয়ে শিউলি অপূর্ব কণ্ঠে বললো, ধরুন আমি যদি আপনাকে ভালবাসি। আপনি কি তা সহজ করে নিতে পারেন? অবশ্য, আপনাকে ভালবাসতে যাওয়ার কোন প্রশ্নই আসছে না।

কেন, কেন বলুন তো; শিউলির কথার জবাব দিতে গিয়ে বিচলিত বোধ করলো। কাসেদ। সে বুঝে উঠতে পারলো না। আর পাঁচটি ছেলেকে যদি ভালবাসা যেতে পারে, ওকে কেন নয়।

শিউলি কিছুক্ষণ স্থির চোখে তাকিয়ে রইলো তার দিকে, তারপর বললো, এসব কেনর উত্তর দেয়া কঠিন কাসেদ সাহেব। আমার তরফ থেকে কিছু বলতে গেলে বলতে হয়, আপনি বন্ধু হিসেবে অত্যন্ত ভালো, কিন্তু প্রেমিক হিসেবে নন। বলে মুখ টিপে হাসলো সে।

নিজেকে বড় অসহায় মনে হলো কাসেদের।

হাত-পাগুলো ভেঙ্গে আসছে।

না, আমি তো বন্ধু হিসেবে জাহানারাকে পেতে চাইনে।

আমি চাই আরো আপন করে।

একান্তভাবে নিজের করে।

কেন, কেন আমাকে ভালবাসা যেতে পারে না? আবেগের চাপে গলাটা ভেঙ্গে আসছে তার। আপনি কি মনে করেন- কথাটা শেষ করতে পারলো না কাসেদ। শিউলির হাসির শব্দে থেমে গেলো। শিউলি বললো, আপনার কি যেন হয়েছে আজ। এসব বাদ দিয়ে এখন বাসায় ফিরে যান; আমারও হােষ্টেলে যেতে হবে।

কাসেদ কোন জবাব দেবার আগেই রিক্সাওয়ালাকে হােস্টেলের পথে যাবার নির্দেশ দিলো শিউলি।

পথে আর কোন কথা হলো না।

শিউলি চুপ। ঠোঁটের কোণে শুধু একটুখানি হাসি। মাঝে মাঝে জেগে আবার মিলিয়ে যাচ্ছে।

কাসেদ নীরব। মাথাটা ভীষণ ব্যথা করছে ওর।

সারা রাত ঘুমালো না সে।

সকালে স্নান সেরে বড় সাহেবের কাছে একখানা দরখাস্ত লিখলো কাসেদ। দিন সাতেকের ছুটি চাই।

এ সাত দিন কোথাও বেরুবে না সে।

একা ঘরে বসে থাকবে। শুধু ভাববে। আর ভাববে।

কেন এমন হলো?

আগামী রোববার বাসায় আসবে বলেছে জাহানারা। কেন আসবে? কিছু কথা আছে তার। কি কথা?

একবার ডেকেছিল সেতারের মাস্টার ঠিক করে দেবার জন্য।

এবার হয়তো বলবে, মাস্টারের সঙ্গে আমার বিয়ের আয়োজন করে দাও।

কাসেদ যেন এ জন্যেই এসেছিলো জাহানারার জীবনে।

দরখাস্তখানা লিখে পকেটে রাখলো কাসেদ।

সাত দিনের ছুটি চাই তার। যদি না দেয় তাহলে, ও চাকরিই ছেড়ে দেবে সে। কি হবে দশটা থেকে পাঁচটা পর্যন্ত গাধার খাটুনি খেটো?

তারচে’ লিখবে সে। দিন রাত শুধু লিখবে আর লিখবে।

সেই ভালো।

দরখাস্ত নিয়ে অফিসে এসে, খবর শুনে বোবা হয়ে গেলো কাসেদ। বড় সাহেব আবার বিয়ে করছেন। বিয়ে করছেন মকবুল সাহেবের মেজো মেয়েকে।

আগেই জানতাম, এ না হয়ে পারে না। এক নম্বর কেরানী বিশেষ জোরের সঙ্গে বললেন, বলি নি আমি, এতো যে ছুটােছুটি এর পিছনে কিন্তু আছে, দেখলেন তো?

একাউন্‌টেন্ট বললেন, আমারও তাই সন্দেহ হয়েছিল। বলে একটা লম্বা হাই তুললেন তিনি, কিন্তু কি বলেন, ব্যাপারটা ঠিক বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হয় না? দুনিয়াতে কতো মেয়ে থাকতে কিনা ওই কালো কুৎসিত মেয়েটাকে–কথাটা শেষ করলেন না। তিনি। অঙ্গভঙ্গী দিয়েই বাকিটুকু বুঝিয়ে দিলেন।

এক নম্বর কেরানী হাসলেন কাসেদের দিকে তাকিয়ে।

কাসেদ নিজের খবরটা বিশ্বাস করতে পারছিলো না। সেই সেদিন মকবুল সাহেবের বাড়িতে, সন্ধ্যার আবছা আলোয় আবিষ্কার করা মেয়েটি এখন গিন্নি সেজে বড় সাহেবের বাড়িতে এসে উঠেছেন ঘর-সংসার করার জন্য। ইচ্ছে করলে কাসোদও বিয়ে করতে পারতো।

তাহলে এখন বড় সাহেবের ঘরে না থেকে মেয়েটি থাকতো কাসেদের ঘরে। অফিস শেষে বাড়ি ফিরে গেলে ছুটে এসে দরজা খুলে দিত সে। হেসে বলতো, ফিরতে এতো দেরি হলো যে?

কাসেদ গম্ভীর গলায় বলতো, একগাধা কাগজ ফেলে আসি কি করে বল তো?

বলতে বলতে এক হাতে দরজাটা বন্ধ করে দিতো সে আর অন্য হাতে কাছে টেনে নিতো তাকে।

কিন্তু এসব কি চিন্তা করে কাসেদ?

গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে, বেয়ারার হাতে দরখাস্তখানা বড় সাহেবের কাছে পাঠিয়ে দিলো কায়েদ।

একটু পরে বড় সাহেব ডেকে পাঠালেন।

কাসেদ ভাবছিলো, কি বলে ছুটি নেবে।

কিন্তু সাহেবের মুখের দিকে তাকিয়ে সব ভাবনা মুহুর্তে দূর হয়ে গেলো।

অবাক হয়ে তাঁর দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলো সে।

কোট-প্যান্ট নয় আজ পায়জামা-পাঞ্জাবী পরে অফিসে এসেছেন তিনি। সারা মুখে পরিতৃপ্তির উজ্জ্বল আভা। দু’চােখে আনন্দের অপূর্ব ঝিলিক। যেন জীবনে এ প্রথম প্রেমে পড়েছেন বড় সাহেব। তার এ রূপ আর কখনো দেখে নি কেউ।

সাহেব মৃদু গলায় শুধােলেন, হঠাৎ ছুটি চাইছেন, কি ব্যাপার?

কাসেদ বললো, মায়ের ভীষণ অসুখ। সারাক্ষণ তার কাছে থাকতে হচ্ছে, তাই। কথাটা সম্পূর্ণ সত্য না হলেও একেবারে মিথ্যে নয়। সাহেব উৎকণ্ঠা জানিয়ে বললেন ভীষণ অসুখ, সেকি? ভালো দেখে ডাক্তার দেখিয়েছেন তো?

মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো কাসেদ, বললো, ডাক্তার বলেছে সব সময় রোগীর কাছে কাছে থাকতে, তাইতো–কথাটা শেষ করলো না সে।

টেবিলের ওপর থেকে কলামটা তুলে নিয়ে দরখাস্তের একপাশে কি যেন লিখলেন বড় সাহেব। বললেন ছুটি আমি দিয়ে দিচ্ছি, কিন্তু এর মধ্যে মায়ের শরীর যদি ভালো হয়ে আসে, তাহলে অফিস করবেন এসে। নইলে অনেক কাজ জমা হয়ে পড়ে থাকবে।

দরখাস্তখানা টেবিলের এক পাশে রেখে দিয়ে বেয়ারাকে ডাকবার জন্য বেল টিপলেন বড় সাহেব। তাকে সালাম জানিয়ে ধীরে ধীরে বাইরে বেরিয়ে এলো কাসেদ।

Category: শেষ বিকেলের মেয়ে (উপন্যাস)
পূর্ববর্তী:
« ০৪. দুটাে ঘটনা
পরবর্তী:
০৬. আসবে বলেছিলো জাহানারা »

Reader Interactions

Leave a Reply Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

বাংলা লাইব্রেরি : উল্লেখযোগ্য বিভাগসমূহ

লেখক ও রচনা

অনুবাদ সাহিত্য

সেবা প্রকাশনী

ডিকশনারি

কৌতু্ক / জোকস

লিরিক

রেসিপি

কোরআন

হাদিস

ত্রিপিটক

মহাভারত

রামায়ণ

পুরাণ

গীতা

বাইবেল

বিবিধ রচনা

বাংলা ওসিআর

Download Bangla PDF

হেলথ

লাইব্রেরি – ফেসবুক – PDF

top↑