০৪. দুটাে ঘটনা

দুটাে ঘটনা

দুটাে ঘটনাই পরপর ঘটলো।

আগের দিন পুরো অফিসটা একটা চাপা উত্তেজনায় ভুগেছে। কারণটা তেমন অভাবিত কিছু নয়। বড় সাহেবের সঙ্গে তার বউয়ের ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। বউ ডিভোর্স করেছে তাকে। হাজার হােক অফিসের বড় সাহেব, তাকে নিয়ে হাসির হুল্লোর ছড়ান যায় না। গলা কাটা যাওয়ার ভয় আছে। তবু কর্মচারীরা এ নিয়ে আলোচনা করতে ছাড়ে নি।

অবশেষে এমনি কিছু যে ঘটতে পারে তা সবাই আঁচ করছিলো। যেখানে স্বামী-স্ত্রীতে আদায়-কাচকলায় সম্পর্ক, সেখানে সকল সম্পর্ক বর্জন করাই বাঞ্ছনীয়।

তবু অনেকে সাহেবের জন্যে আফসোস করলো। বললো, বেচারা।

আবার কেউ কেউ বললো, ভালই হয়েছে, সাহেব বেঁচেছে। নইলে সারাটা জীবন ছারপোকা হয়ে থাকতে হতো।

কেউ বললো, বিয়ে করে বড় ঠিকেছে সাহেব! কি লোক ছিলো কেমন হয়ে গেছে।

সাহেবকে নিয়ে জল্পনা-কল্পনার শেষ না হতেই পরবতী ঘটনাটা ঘটলো।

মকবুল সাহেব, যিনি সারাদিন পান খেতেন আর অফিসটাকে জমিয়ে রাখতেন, তিনি হঠাৎ পক্ষাঘাত রোগে আক্রান্ত হয়েছেন।

সেদিন অফিসে এসেই দারোয়ানের কাছ থেকে খবরটা শুনলো কাসেদ। প্ৰথমে চমকে গিয়েছিলো, পরে সামলে নিয়ে শুধালো, কার কাছ থেকে শুনলে?

দারোয়ান জানালো, তার ছেলের কাছ থেকে।

অফিসের সবাই জেনেছে একে একে।

দুঃখ করেছে, আহা লোকটা বড় ভালো ছিলো। তাদের শোক প্রকাশের ধরন দেখে মনে হলো, যেন বুড়ো মকবুলের মৃত্যু-সংবাদ শুনেছে তারা। তা পক্ষাঘাতে ভোগা আর মারা যাওয়া এক কথা। আফসোস জানাতে গিয়ে একাউনটেন্ট বলেন, যতদিন বেঁচে থাকবে একটানা কষ্ট করতে হবে। কাসেদ শুধালো, এখন তিনি আছেন কোথায়?

কনিষ্ঠ কেরানী বললো, হাসপাতালে। সকালবেলা নাকি মেডিক্যালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।

একাউনটেন্ট বললেন, মেডিক্যাল গেলে কি হবে, ও রোগ ভালো হবার নয়। কথাটা বেশ জোরের সঙ্গে বললেন তিনি। গলাটা অস্বাভাবিক শোনালো। মনে হলো রোগটা না। সারুক তাই যেন চান তিনি।

টাইপরাইটারের উপর হাত জোড়া ছড়িয়ে দিয়ে চুপচাপ একাউন্‌টেন্টের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো কাসেদ।

মকবুল সাহেবের অনুপস্থিতে তাঁর কাজের দায়িত্ব পড়বে একাউন্‌টেন্ট সাহেবের হাতে। প্রমোশন হবে তাঁর। আয় বাড়বে। পদমর্যাদা বাড়বে।

খোদা করুন। তিনি ভালো হয়ে যান তাড়াতাড়ি। কাজের ফাঁকে এক সময় একাউনটেন্ট বললেন, আল্লা তাকে আবার আমাদের মাঝখানে ফিরিয়ে আনুক। এটা কি তার মনের কথা? সত্যি কি তিনি মনেপ্ৰাণে তাই চাইছেন? কাসেদের কেন যেন বিশ্বাস হলো না। মানুষ মাত্র স্বার্থপর। স্বার্থের প্রশ্নের সঙ্গে বিরোধ বাঁধে। বাবাতে ছেলেতে সম্পর্ক ছিন্ন হয়। ভাই ভাইয়ের বুকে ছুরি বসায়।

একাউনটেন্ট সাহেব ভালো করে জানেন, বুড়ো মকবুল যদি সুস্থ হয়ে আবার কাজে ফিরে আসে তাহলে তাঁর পক্ষে সেটা শুভ হবে না। এসব জানা সত্ত্বেও কি তিনি পক্ষাঘাত আক্রান্ত ব্যক্তিটির রোগমুক্তি কামনা করছেন? নাকি, এ তাঁর বাইরের কথা। মনে মনে হয়তো ভাবছেন অন্য কিছু। ভাবছেন বুড়ো আর সুস্থ না হােক। হয় মারা যাক কিম্বা অসুস্থ অবস্থায় পড়ে থাকুক বিছানায়।

মানুষ তাই চায়। নিজের মঙ্গলের জন্যে অন্যের ক্ষতি চিন্তা করতে সে একটুও বিলম্ব করে না।

কাসেদ কাজে মন বসাতে চেষ্টা করলো।

কিন্তু বুড়ো মকবুলের কথা বারবার করে মনে হতে লাগলো তার।

বিকেলে অফিস শেষ হবার কিছু আগে বড় সাহেব ডেকে পাঠালো তাকে। স্ত্রীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে যাবার পর এ ক’দিন কারো সামনে আসেন নি। তিনি। কথা বলেন নি কারো সঙ্গে। অফিসে এসেছেন। থেকেছেন। কাজ করেছেন। কাসেদ যখন বড় সাহেবের রুমে এসে ঢুকলো, সাহেব তখন একগাদা ফাইলের মধ্যে মুখ গুজে আছেন। তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্যে কয়েকবার কাশলো কাসেদ। তবু তিনি তাকাচ্ছেন না দেখে নীরবে সে দাঁড়িয়ে রইলো।

দেয়ালঘড়ির পেন্ডুলাম দুলছে, দোলনার মত শব্দ হচ্ছে।

বড় সাহেব ফাইলটা বন্ধ করে রাখলেন। তারপর কাসেদের দিকে চোখে পড়তে একটু অবাক হয়ে শুধালেন, আপনি এখানে কেন?

কাসেদ বললো, আপনি আমাকে ডেকে পাঠিয়েছেন।

সাহেব কি যেন ভাবলেন। কপালের আঁকাবাঁকা রেখাগুলো ধীরে ধীরে নষ্ট হয়ে আসছে তাঁর। দু’চােখে কি এক শূন্যতা।

হঠাৎ নড়েচড়ে বসলেন সাহেব। বললেন, হ্যাঁ, আপনাকে ডেকেছিলাম। ডেকেছিলাম মকবুল সাহেবের খবর জানতে। ও’র কি খবর?

কাসেদ বললো, আমি ঠিক জানি নে। শুনেছি। হাসপাতালে আছেন। মেডিক্যাল কলেজে।

হুঁ। টেবিলের উপর ছড়ানো কয়েকখানা কাগজ ফাইলের মধ্যে রেখে দিতে দিতে সাহেব শুধালেন, আপনার কি এখন কোন কাজ আছে?

না।

তাহলে চলুন। একবার হাসপাতালে যাওয়া যাক। টেবিলের ড্রয়ারগুলো বন্ধ করে রেখে উঠে দাঁড়ালেন বড় সাহেব।

হাসপাতালে মকবুল সাহেবের বেডটা খুঁজে বের করতে বিশেষ বেগ পেতে হলো না। পাঁচ নম্বর ওয়ার্ডের সতেরো নম্বর বেড।

দূর থেকে কাসেদ দেখতে পেলো বিছানার চারপাশে মকবুল সাহেবের বউ এবং ছেলেমেয়েরা দাঁড়িয়ে রয়েছে।

বড় সাহেব চাপা গলায় শুধোলেন, এখন কি ওখানে যাওয়া ঠিক হবে?

কাসেদ কি বলবে ভাবছিলো, এমন সময় মকবুল সাহেবের স্ত্রীর চােখ পড়লো এদিকে।

এদের সেদিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে মাথায় ঘোমটা টেনে এক পাশে সরে দাঁড়ালেন।

বড় ছেলে সামনে এগিয়ে বিনীত স্বরে বললো, আসেন স্যার।

সাহেব যেতে যেতে শুধোলেন, এখন উনি কেমন আছেন?

আগের চেয়ে কিছুটা ভাল আছেন স্যার।

ওরা বেডের যে পাশে গিয়ে দাঁড়ালো তার অন্য পাশে পাশাপাশি তিনটি মেয়ে দাঁড়িয়ে। তিনজনের মাথায় ঘোমটা টানা।

প্রথম জনের কোলে একটি বাচ্চা মেয়ে। হয়তো সে সবার বড়। বিবাহিতা। দ্বিতীয় জনের বয়স কুড়ি একুশের মতো হবে। মুখখানা ভালো করে দেখতে না পেলেও কাসেদের চিনতে ভুল হয় না।

এই সেই মেয়ে যাকে বিকেলে বাড়ির আঙ্গিনায় বসে থাকতে দেখেছিলো সে। তৃতীয় মেয়েটির গায়ের রঙ ওদের চেয়েও ফর্সা। বয়স অল্প।

সাহেব অত্যন্ত মেহের সঙ্গে মকবুল সাহেবের কপালে একখানা হাত রাখলেন। চোখ মেলে তাকালেন মকবুল সাহেব।

একদৃষ্টি তাকিয়ে রইলেন সাহেবের দিকে। চােখের পলক পড়ছে না। ঠোঁট জোড়া কাঁপছে শুধু। যেন কিছু বলতে চান তিনি।

সাহেব মৃদু গলায় বললেন, চিন্তার কিছু নেই। ভালো হয়ে যাবেন।

মকবুল সাহেবের খোলা চোখ দিয়ে দরদর করে অশ্রু ঝরতে লাগলো।

ওপাশে দাঁড়ান তিনটি মেয়ে আর তাদের মা আঁচলে চােখ মুছলো।

ওরাও কাঁদছে।

কাঁদছে না শুধু ছেলেরা।

ওদের সারা মুখ স্নান। চেহারায় যন্ত্রণার ছাপ। কিন্তু চােখে অশ্রু নেই। সাহেব বললেন, চাকরীর জন্য চিন্তা করবেন না। ওটা আপনারই থাকবে, কিছুদিন পর ভালো হয়ে গেলে আবার জয়েন্ট করবেন।

মকবুল সাহেব আবার কিছু বলতে চেষ্টা করলেন। বলতে পারলেন না, ওপাশে দাঁড়ান স্ত্রী-কন্যার ওপর চােখের দৃষ্টি ঘুরিয়ে এনে আবার বড় সাহেবের দিকে তাকালেন তিনি। পলক পড়ছে না চোখের।

শুধু পানি ঝরছে আর ঠোঁট জোড়া কাঁপছে।

সাহেব বললেন, টাকা-পয়সার কথা ভাবতে হবে না। আমি বন্দোবস্ত করে দেবো।

এবার, এতক্ষণে কান্না কমে এল তার। যেন অনেকটা আশ্বস্ত বোধ করলেন তিনি।

কাসেদকে দেখলেন। দেখলেন চারপাশে।

কাসেদের দিকে মুখখানা এনে বড় সাহেব চাপা স্বরে বললেন, এদের দেখাশোনার দায়িত্বটা আপাততঃ আপনাকেই নিতে হবে।

কাসেদ সন্মতি জানিয়ে মাথা নত করলো।

সাহেব। আবার বললেন, আমি অফিস থেকে কিছু টাকা স্যাঙ্কশন করিয়ে দেবো। প্রয়োজন মত খরচ করবেন।

কাসেদ আবার মাথা নোয়ালো।

একটা নার্স টেম্পারেচার নিয়ে গেলো। তাকে এক পাশে ডেকে নিয়ে গিয়ে কি যেন আলাপ করলেন বড় সাহেব।

মকবুল সাহেবের মুখের ওপর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে এসে সেই মেয়েটিকে দেখতে চেষ্টা করলো কাসেদ।

দেখা গেলো না।

সন্ধ্যার মত আবছা-ই রয়ে গেলো সে।

রাস্তায় বেরিয়ে একটা ফলের দোকান থেকে কিছু ফল কিনে দিলেন সাহেব। বললেন, এগুলো হাসপাতালে পৌছে দিয়ে আপনি বাসায় চলে যান।

ফলের ঠোঙ্গাটা হাতে নিয়ে চলে আসছিলো কাসেদ।

সাহেব পিছন থেকে আবার ডাকলেন, বললেন, আপনাকে কষ্ট দিচ্ছি। কিছু মনে করবেন না। সাহেবের গলার স্বরটা কেমন যেন ক্লান্ত আর জড়ানো। কাসেদ অবাক হয়ে তাকালো ওর দিকে।

গাড়ি আছে। বাড়ি আছে। চাকরী আছে ভালো, টাকা-পয়সার অভাব নেই। তবু সুখী হতে পারলো না লোকটা।

কাসেদ নীরবে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো। ওঁর দিকে। কিছু বললো না। পুরো অফিসটা চাপা কথার গুমোট হাওয়ায় ভরে আছে সেই সকাল থেকে।

মকবুল সাহেব। পক্ষাঘাতে আক্রান্ত মকবুল সাহেব কি ভালো হবেন?

এ রোগ তো ভালো হবার নয়। আর তিনি যদি ভালো না হন তাহলে তার জায়গায় নিশ্চয় এই অফিসের একজনকেই নেয়া হবে। কাকে নেবে কিছু জানেন? এক নম্বর কেরানী চাপাস্বরে শুধোলেন দু’নম্বর কেরানীকে।

দু’নম্বর কি বললেন কিছু শোনা গেলো না।

দুপুরে বড় সাহেব ডেকে পাঠালেন তাকে।

কিছু টাকা দিলেন।

খোঁজখবর নিলেন।

বললেন, আমি অবশ্য বিকেলের দিকে একবার যাবো।

কাসোদও ভাবছিলো বিকেলে একবার হাসপাতালে গিয়ে দেখে আসবে লোকটাকে।

লোকটাকে দেখতে যাওয়ার আগ্রহের আড়ালে আরেকটি বাসনা লুকিয়ে ছিলো। সেই মেয়েটিকে দেখবে। বিকেলের রঙে যার দেহ রাঙানাে। কিন্তু অফিস ছুটি হবার একটু আগে সালমা এসে হাজির।

মুখখানা গভীর। কালো। চুলগুলো এলোমেলো। চােখে চরম বিতৃষ্ণা। কাসেদ চমকে উঠলো। কি ব্যাপার, হঠাৎ অফিসে?

সালমা বললো, বিশেষ প্রয়োজনে এসেছি।

কাসেদ বললো, দাঁড়িয়ে কেন, বসো।

সালমা বললো, এখানে একগাদা লোকের সামনে কিছু বলতে পারবো না। আমি। তোমার কি বাইরে আসতে অসুবিধা হবে?

না, অসুবিধা কিসের। এইতো একটু পরেই অফিস ছুটি হবে, তারপর বাইরে বেরুনো যাবে খ’ন। কিন্তু অমন কি ঘটলো কিছু বুঝতে পাচ্ছিনে। তোমাকে যেন একটু ক্লান্ত মনে হচ্ছে?

ক্লান্ত বইকি, সালমা চাপাস্বরে বললো, বড় ক্লান্ত, ভীষণ ক্লান্ত হয়ে পড়েছি আমি। শেষের কথাগুলো স্পষ্ট শোনা গেলো না।

কাসেদ বুঝলো, কিছু একটা ঘটেছে। হয়তো স্বামীর সঙ্গে ঝগড়া করেছে সে। কিম্বা মা-বাবার সঙ্গে।

অফিসে আর কোন আলাপ হলো না।

রাস্তায় নেমে কাসেদ বললো, কি দরকার বলো।

সালমা বললো, এই রাস্তায়? চলো না কোথাও গিয়ে বসা যাক।

কোথায় যাবে?

কেন, কোন রেস্টুরেন্টে?

খোলা রেস্তোরায় বসা ঠিক হবে না।

তাহলে কেবিনে বসবে।

কাসেদ ইতস্তত করলো কিন্তু সালমার অনুরোধ এড়াতে পারলো না সে।

চায়ের পেয়ালা সামনে নিয়ে অনেকক্ষণ চুপ করে রইলো সালমা।

টেবিলের ওপর হিজিবিজি কাটলো।

কাসেদ বললো, কি চুপ করে রইলে যে, কিছু বলবে না?

সালমা একবার আড়চোখে দেখে নিলো তাকে। তারপর বললো, আচ্ছা আমাকে দেখে তোমার কি মনে হয় বলতো?

কাসেদ শুধালো, হঠাৎ এ প্রশ্ন?

সালমা বললো, না মানে বলছিলাম কি, আমাকে দেখে কি তোমার মনে হয় আমি খুব সুখী?

চায়ের পেয়ালাটা মুখের কাছ থেকে নামিয়ে এনে কাসেদ বললো, এ প্রশ্নের জবাব দেয়া অত্যন্ত কঠিন। কারণ সুখ জিনিসটা হচ্ছে মনের ব্যাপার, ওটা যদি বাইরের হতো, তাহলে সাদা চোখে দেখা যেতো। তোমার মনকে তো আর আমি দেখতে পাচ্ছি নে।

দেখবার চেষ্টাই-বা করলে কবে। সালমার কণ্ঠস্বরে অভিমান ঝরছে, নিজেকে নিয়েই তো ব্যস্ত থাকলে চিরকাল, অন্যের কথা ভাববার অবকাশ কোথায়। কথা বলতে গিয়ে বারবার মুখখানা লাল হয়ে উঠছিলো ওর। কিন্তু কাসেদের দিকে একবারও দেখলো না সে।

চায়ের কাপটা টেবিলের ওপর নামিয়ে রাখলো কাসেদ। বিব্রত গলায় বললো, আমার কথা বাদ দাও। তোমার নিজের কথা কি বলছিলে তাই বলো।

অল্পক্ষণের জন্যে চুপ করে গেলো সালমা।

কাসেদের জবাবে সন্তুষ্ট হতে পারে নি। সে।

এক চুমুক চা খেয়ে গলাটা পরিষ্কার করে নিয়ে সালমা আবার বললো, সব মানুষই জীবনে সুখী হতে চায়। আমিও চেয়েছি। যাকে ভালবাসলাম তাকে পেলাম না। যাকে বিয়ে করতে হলো তাকে ঠিক মনের মতোটি করে পেতে চাইলাম। কিন্তু–

বলতে গিয়ে সহসা থেমে পড়লো সালমা।

মাথার ওপরে ফ্যানটা ঘুরছে জোরে।

এলোমেলো চুলগুলো উড়ছে বাতাসে।

মুখ খুলে কাসেদের দিকে তাকালো সালমা। আস্তে করে বললো, সে চাইলো আমি তার মতো হই। পাতলা সিফনের শাড়ি পরে ঠোঁটে আর মুখে রঙ মেখে ওর সঙ্গে ক্লাবে যাই। ওর বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে আড্ডা দিই, গল্প-গুজব করি। দুই মন, দুই মেরুতে বসে। মিল যেখানে নেই সেখানে সুখের তালাশ করা পাগলামো, তাই না?

কাসেদ কি বলবে ভেবে পেলো না।

সালমা নীরব।

কাসেদের কাছ থেকে উত্তরের অপেক্ষায় আছে সে।

কাসেদ বললো, এ নিয়ে চিন্তা করে কি হবে সালমা? এ চিন্তার কি কোন শেষ আছে?

সালমা উত্তরে বললো, বিপাশাকে যদি তোমার কাছে দিয়ে যাই তুমি রাখবে? কাসেদ অবাক হয়ে তাকালো ওর দিকে, কেন বলতো?

সালমা কি যেন ভাবলো। ভেবে বললো, ওকে তোমার কাছে রেখে আমি কোথাও চলে যাবো।

এ পাগলামাের কোন মানে হয় না, কাসেদ হাসতে চেষ্টা করলো। বললো, জীবনের পথ যত কঠিন আর যত দুৰ্যোগময় হােক না কেন, তার কাছ থেকে পালিয়ে যাওয়ার কোন অর্থ হয় না। ওটা কাপুরুষতার লক্ষণ।

তাই নাকি? অপূর্ব হাসলো সালমা। টেনে টেনে বললো, কাপুরুষ আমি না তুমি?

কাসেদ ইতস্তত করে বললো, তার মানে?

মানে, তুমি কি বলতে চাও, তুমি একজন বীর-পুরুষ?

কাসেদ হেসে দিয়ে বললো, বীর-পুরুষ হয়তো নই, তবে কাপুরুষও নই।

কাপুরুষ নও? সালমা শব্দ করে হাসলো, তাহলে একটা কথা বলি?

বলো।

সালমা নীরবে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো ওর দিকে। ওর ঠোঁটের কোণে মৃদু মৃদু হাসি। তারপর টেনে টেনে বললো, আজ এখান থেকে বেরিয়ে, তুমি আমাকে নিয়ে পালিয়ে যেতে পারবে দূরে বহু দূরে কোথাও?

কাসেদ চমকে উঠলো। সহসা সে বুঝতে পারলো না কি বলবে। কি বলা যেতে পারে। সালমা আবার লাল হলো। মুখখানা সরিয়ে নিলো অন্যদিকে।

কিছুক্ষণ দু’জনে একেবারে চুপ।

একটু পরে সালমা আবার বললো, কি, চুপ করে রইলে যে, বীর-পুরুষের সাহসে কুলোচ্ছে না বুঝি?

কাসেদ গম্ভীর গলায় বললো, একটা অসম্ভব প্রস্তাব করে বসলে তো আর চলে না।

অসম্ভব? টেবিলের উপর ঝুঁকে এলো সালমা, তীক্ষা গলায় বললো, সাহসে কুলোচ্ছে না। তাই বলো। কেন মিছামিছি বাজে অজুহাত দেখাচ্ছে! সালমা নড়েচড়ে বসলো। বেয়ারাকে ডাকো। বিলটা চুকিয়ে দিই।

কাসেদ বললো, কিন্তু কি দরকারী কথা আছে বলেছিলে, তাতো বললে না।

সালমা বললো, থাক তার প্রয়োজন আর নেই। যে গাছে প্ৰাণ নেই তার গোড়ায় পানি ঢেলে কি হবে? খুব তো বড়াই করছিলে কাপুরুষ নই, কাপুরুষ নই। সহসা কান্নায় গলাটা ধরে এলো তার।

কাসেদ বললো, অকারণে কেন একটা সহজ সম্পর্ককে জটিল করে তুলেছে বলো তো? তুমি কি চাও আমার কাছ থেকে?

কিছু না। কিছু না। কিছু না। এতক্ষণে সত্যিকার কান্না নেমে এলো তার দু’চোখ বেয়ে। কাপড়ের আচলে অশ্রুবিন্দু মুছে নিতে নিতে সে আবার বললো, কিছুই চাই না, আমি। চাই শুধু ঝগড়া করতে। সারাটা জীবন তাইতো করে এসেছি।

এতক্ষণে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো কাসেদ। বললো, ওটা বোধ হয় আমাদের কপালে লেখা ছিলো সালমা। নইলে যখনই তোমার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে, আমরা ঝগড়া করেছি। করি। কেন করি?

তুমি আমাকে আঘাত দিয়ে আনন্দ পাও, তাই।

কাউকে আঘাত দিয়ে কেউ আনন্দ পায় না সালমা।

সালমা কোন জবাব দিলো না।

পরনের শাড়িটা গুছিয়ে নিতে নিতে উঠে দাঁড়ালো সে।

ওকি, চললে নাকি?

চিরকাল বসে থাকবো বলে এখানে আসি নি নিশ্চয়। সালমার গলার স্বরটা অদ্ভুত শোনালো।

কিছু বলতে গিয়ে চুপ করে গেলো কাসেদ। সালমা ততক্ষণে কেবিনের বাইরে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। কেবিন ছেড়ে কাসেদও বেরিয়ে এলো সঙ্গে সঙ্গে।

 

দিন কয়েক থেকে মায়ের শরীরটা ভালো যাচ্ছে না।

মাঝে মাঝে জ্বর আসে। ছেড়ে যায়। আবার আসে।

এই জ্বরের মধ্যেও মা নামাজ পড়া বাদ দেন নি। পড়েন, বসে বসে।

আর সারাক্ষণ শব্দ করে দেওয়া দরুদ পাঠ করেন।

মাঝে মাঝে দুঃখ প্রকাশ করেন নাহারের জন্যে আর কাসেদের জন্যে।

বলেন, আমি মরে গেলে তোদের যে কি হবে ভেবে পাই না।

আজ বিকেলে কাসেদ বাসায় ফিরে এলে মা কাছে ডাকলেন ওকে।

বললেন, এখানে এসে বসো, আমার মাথার কাছে।

কপালে হাত রেখে কাসেদ দেখলো জ্বর আছে কিনা। নেই।

নাহার বললো, এই একটু আগে জ্বর নেমে গেছে।

মা বললেন, আমাকে নিয়ে তোরা ভাবিস নে। বুড়ো হয়ে গেছি, আর ক’দিন বাঁচবো।

কাসেদ বললো, ওসব অলক্ষুণে কথা কেন বলছে মা, তুমি এখন ঘুমোও। এইতো কাল সকালেই ভাল হয়ে যাবে।

মা চুপ করলেন না। কথা বলতে কষ্ট হচ্ছিলো তাঁর। তবু বললেন, তোর খালু এসেছিলো, নাহারের বিয়ের সেই পুরানো প্রস্তাবটা নিয়ে।

শ্বাস নেবার জন্যে থামলেন মা।

নাহার বিছানার ওপাশে এতক্ষণ দাঁড়িয়েছিলো। বিয়ের কথা শুনে বারকয়েক ইতস্তত করে পাশের ঘরে সরে গেলো সে।

মা আবার বললেন, আমি এ বিয়েতে মত দিয়েছি। অসুখে যেমন ধরেছে কে জানে কখন মরে যাই। যাবার আগে ওকে স্বামীর ঘরে তুলে দিয়ে যেতে চাই। নইলে মরেও শান্তি পাবো না। আমি। গলাটা ধরে এলো মায়ের। বার দু’য়েক ঢোক গিলে নিয়ে বললেন, তাছাড়া ছেলেটাও তো খারাপ না, ভালোই, এখন তুই মত দিলেই হয়ে যায়।

মায়ের কথায় মৃদু হাত বুলোতে বুলোতে কাসেদ আস্তে করে বললো, আমার মতামতের কি আছে, তোমরা যা ভালো মনে করো, করবে। অবশ্য নাহারকে একবার জিজ্ঞেস করে নিয়ো।

ওকে আবার জিজ্ঞেস করবো কি? মা চোখ তুলে তাকালেন ওর দিকে।

আমরা কি ওর খারাপ চাই? ছেলেটা শুনেছি, দেখতে শুনতে ভালো।

মা পাশ ফিরে শুলেন।

কাসেদ নীরবে ওঁর মাথায় হাত বুলোতে লাগলো।

রাতে ওর ঘরে খাবার নিয়ে এলে নাহারকে বসতে বললো কাসেদ।

বললো তোমার সঙ্গে কিছু কথা আছে।

নাহার ঈষৎ বিস্ময় নিয়ে তাকালো ওর দিকে। বসলো না। দরজার কপাট ধরে নীরবে: দাঁড়িয়ে রইলো সে।

কাসেদ ভাবলো কথাটা কিভাবে বলা যেতে পারে।

বিছানার ওপর থেকে উঠে টেবিলের পাশে গিয়ে বসলো সে।

নাহার অপেক্ষা করছে দাঁড়িয়ে।

থালার মধ্যে ভাত ঢেলে নিতে নিতে কাসেদ বললো, তোমার বিয়ের জন্যে খালু একটা প্ৰস্তাব এনেছেন শুনেছো–

নাহার কোন জবাব দিলো না।

কাসেদ ভাতের থালা থেকে মুখ তুলে দেখলো তাকে।

তবু সে চুপ।

কাসেদ বললো, মা অবশ্য তাঁর মত দিয়েছেন। তুমি যদি মত দাও, তাহলে আমারও আপত্তির কিছু নেই।

নাহার নড়েচড়ে দাঁড়ালো।

ক্যাঁচ করে একটা শব্দ হলো দরজায়।

কাসেদ এবার আর তাকালো না।

নিঃশব্দে ভাত খেতে লাগলো সে। খেতে খেতেই বললো, তোমার ইচ্ছা হলে ছেলেটিকে দেখতেও পারো। আর যদি মত না থাকে তাও বলতে পারো। সঙ্কোচের কিছু নেই।

তবু চুপ করে রইলো নাহার। মুখখানা নুইয়ে পায়ের পাতার দিকে চেয়ে রইলো সে।

কি ব্যাপার, কিছু বলছে না যে?

নাহার নীরব।

তোমার কি কোন মতামত নেই?

তবু চুপ সে।

তুমি কি কিছুই বলবে না? কাসেদ স্থির দৃষ্টিতে তাকালো ওর দিকে।

আমি কি বলবাে? এতক্ষণে কথা বললো নাহার। ওর গলার স্বরে বিরক্তি আর বিতৃষ্ণা, আপনারা যা ভালো মনে করেন তাই করবেন, আমার কোন মতামত নেই। এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে গেলো। সে।

শেষের দিকে গলাটা জড়িয়ে এলো তার।

তখনো দাঁড়িয়ে সে।

হ্যারিকেনের আলোয় মুখখানা ভালো করে দেখা গেলো না।

পাশের ঘরে মা দরুদ পড়ছেন শুয়ে শুয়ে। এখান থেকে সব কিছু শোনা যাচ্ছে স্পষ্ট।

ভাত খেয়ে উঠে দাঁড়াতে থালাবাসনগুলো নিয়ে বেরিয়ে গেলো নাহার।

ও চলে যেতে খাতা-কলম নিয়ে বসলো কাসেদ।

লিখবে।

ভীষণ লিখতে ইচ্ছে করছে ওর।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *