১১. জিহাদি বৈজ্ঞানিকদের কাজ শেষ

জিহাদি বৈজ্ঞানিকদের কাজ শেষ

জিহাদি বৈজ্ঞানিকদের কাজ শেষ হয়ে গেছে, তারা সবাই নেমে এসেছে মঠ থেকে, আমি মঠটিকে দেখি।

জিহাদিদের প্রধান বৈজ্ঞানিক এসে বলে, ‘হুজুর, কাম শ্যাষ অইয়া গ্যাছে, অহন খালি সুইচ টিপলেই অইব, সব চুরমার অইয়া যাইব।’

আমি বলি, ‘আলহামদুলিয়া, বিছমিল্লা বলে ঠিক মতো সব করেছে তো?’

প্রধান বৈজ্ঞানিক বলে, ‘আলহামদুলিয়া, সব কাম ঠিক কইর‍্যা করছি; এইডা অইল আমার সবচেয়ে বড় কাম, সব ঠিক মতন করছি, যা বাসাইছি তা দিয়া পাচ দশটা টুইন টাওয়ার হালাই দেওন যায়।’

আমি বলি, ‘আলহামদুলিল্লা, তোমার জন্যে আছে জান্নাতুল ফেরদাউছ।’

সে বলে, ‘অহন সুইচ মারুম, হুজুর?’

আমি বলি, ‘আলহামদুলিল্লা, আমি বড়ো সড়কে গিয়ে দাঁড়াই, সেখান থেকে আমি দেখতে চাই কাফেরের পতন, মূর্তির ধ্বংস; আমি মোবাইল করলেই তুমি সুইচ টিপবে, দেরি করবে না, আলহামদুলিল্লা।’

প্ৰধান বৈজ্ঞানিক বলে, ‘বিছমিল্লা, আলহামদুলিয়া।’

আমার বডিগার্ডদের ও মোঃ আবু লাদেনকে নিয়ে আমি আধমাইল দূরে সড়কের ওপরে গিয়ে দাঁড়াই, বেশ দেখা যাচ্ছে, হয়তো ধ্বংসের সৌন্দৰ্য আমি দেখতে চাই, হয়তো সৌন্দর্যের ধ্বংস আমি দেখতে চাই; মঠটিকে আমি শেষবারের মতো দেখি, আর দেখবো না, আমার বুক কেঁপে ওঠে, সুখে না কষ্টে আমি বুঝতে পারি না। আবছা রঙের মতো, দালির রঙের দাগের মতো, পাখিরা উড়ছে মঠটিকে ঘিরে, আমার মনে হয়। আমিই উড়ছি, কখনো মনে হয় উড়ে উড়ে পাখিগুলো খুশিতে বলছে, ‘আলহামদুলিল্লা, সোভানাল্লা’; সবুজের ভেতর থেকে আকাশের দিকে উঠে যাওয়া হে মঠ, হে পৌত্তলিকতা, হে উজ্জা, হে লাৎ, হে মানৎ, তুমি আর থাকবে না, তুমি অবিনশ্বরী নও, তুমি তুচ্ছ।

আমি আর কখনো এক মাইল দৌড়ে এসে তোমার দিকে তাকিয়ে থেকে বিকেল ও সন্ধ্যা মাথায় ও বুকে নিয়ে বাড়ি ফিরবো না; আমি আর ঘাসফুল নাই, আমি আজ তোমার থেকে বৃহত্তর, মহত্তর; তোমার পক্ষে চিরকাল বৃহৎ মহৎ থাকা সম্ভব নয়, নতুন বৃহৎ ও মহতেরা নিয়মিতই দেখা দেয়। ধ্বংস না করে বৃহৎ মহৎ হওয়া যায় না।

পাখিগুলো পাগলের মতো উড়ছে; ওই পাখিগুলো কি তায়রান আবাবিলা? না, তাহলে তাদের মুখে প্রস্তরখণ্ড থাকতো, ওগুলোর চঞ্চু থেকে বুলেটের থেকেও প্ৰচণ্ড প্রস্তরখণ্ড পড়তো; ওগুলো শুধুই রঙ, শুধুই সুর, শুধুই ব্যৰ্থতা, শুধুই ক্ৰন্দন; কবুতর, শালিক, টিয়ে, ময়না। ওগুলো ঘাসফুলের থেকেও তুচ্ছ। আমি একবার কষ্ট বোধ করি, একবার সুখ বোধ করি। একটি বালক আমার বুকের ভেতর দিয়ে বার বার দৌড়ে আসতে থাকে, মঠটির দিকে তাকিয়ে থাকে, মুগ্ধ হয়ে আবার বাড়ি ফিরে যেতে থাকে।

তবে কোনো ভাবালুতায় আচ্ছন্ন হলে আমার চলবে না; আমি আর বালক নই, আমি সাম্যবাদ থেকে সর্বহাৱা থেকে জামাঈ জিহাদে ইছলাম। আমি বুকে একবার শুনি ‘আল্লাহু আকবর’, আরেকবার শুনি ‘আলহামদুলিল্লা’। আমি দেখতে পাই একটির পর একটি ভেঙে পড়ছে ধ’সে পড়ছে জাহেলিয়ার মূর্তি।

আমি মোবাইলে বলি, ‘জিহাদি মোঃ আব্দুর রহমান।’

সে বলে, ‘জি, হুজুর?’

আমি বলি, ‘আল্লার রহমতে সব ঠিক আছে?’

সে বলে, ‘আলহামদুলিল্লা, সব ঠিক আছে, হুজুর।’

আমি বলি, ‘তাহলে বিছমিল্লা বলে সুইচ টেপো।’

সে বলে, ‘আলহামদুলিল্লা, বিছমিল্লাহির রাহমানির রাহিম।’

আমি শুধু শুনি হাজার হাজার পাখির আর্তনাদ ও দেখি বিপন্ন রঙের ওড়াউড়ি; আমি এতো রঙের ওড়াউড়ি দেখবো, এতো হাহাকার শুনবো, কখনো ভাবি নি; সুরে ও সঙ্গীতে আমার বুক ভ’রে ওঠে।

সৃষ্টি করতে সময় লাগে, ধ্বংস করতে সময় লাগে না; আমার চোখের সামনে ছাই হয়ে নিচের দিকে পড়তে থাকে মঠ, আমি একবার বলি, ‘সোভানায়া, আলহামদুলিল্লা’। মঠটি পুরোপুরি প’ড়ে যাওয়ার পর, ছাই হওয়ার পর, আমি মহাশূন্যতা দেখতে পাই, একটি বালক আর কখনো এটি দেখতে এক মাইল দৌড়ে আসবে না। ওই বালকের মৃত্যু হয়েছে। দূর থেকে শুধু শুনতে পাই ‘আল্লাহু আকবর’, ‘আলি আলি জুলফিক্কার’, ‘নারায়ে তকবির’, ‘শ্যামসিদ্ধি হলো আলিগঞ্জ’, ‘শ্যামসিদ্ধির মঠ ধ্বংস হলো, ধ্বংস হলো’, ‘জামাঈ জিহাদে ইছলাম জিন্দাবাদ’, ‘মালাউন ও দালালদের কতল করো’, ‘জাহেলিদের কতল করো’, ‘মুরতাদদের কতল করো’।

কিন্তু তখনো আকাশে অনেক রঙ উড়ছে, আমি দেখতে পাই, পাখিদের আর্তনাদের মধুর সুর শুনতে পাই।

অনেকগুলো পাখির বাচ্চ উড়তে গিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ছে মঠটির মতোই। জিহাদিরা সেখানে নিশানের পর নিশান উড়োচ্ছে—‘আল্লাহু আকবর’-এর নিশান, ‘আলিগঞ্জ’-এর নিশান; নিশানগুলো খুবই উঁচু বাঁশের ওপর, কিন্তু আমার কাছে মনে হয় যে-মহাশূন্যতা সৃষ্টি করা হয়েছে, তার পাশে ওগুলো বামনের মতো। আমি বিশাল উচ্চ মহাশূন্যতা দেখতে পাই, মনে হয় মহাশূন্যতা দাঁড়িয়ে আছে। মঠের মতো, ওখানে এখন মহাশূন্যতার মঠ; আর তাকে ঘিরে উড়ছে নানান রঙ, নানান সুর; পাখিরা উড়ছে কেঁদে কেঁদে, ওগুলো বুঝতে পারছে না কোথায় বসবে; ওগুলোর বাচ্চাগুলো যে ছাই হয়ে গেছে, তা তারা বুঝতে পারছে, পাখিরাও বোঝে। আমার বুকে একটি নিঃসঙ্গ পাখি কাঁদতে শুরু করে, আমি বুকে তার ডানার করুণ স্পর্শ বোধ করি।

মোবাইলে একটি গভীর আর্তনাদ শুনতে পাই, যেনো একটি কবুতর হাহাকার করছে, ‘আমার হুজুর, হুজুর, হুজুর, এইটা আপনে কী করলেন? আমি বিষ খামু নি, হুজুর, আমি বিষ খামু?’

আমি বলি, ‘না, তুমি সন্ধ্যায়। তাঁতের শাড়ি প’রে আসবে।’

কণকলতা বলে, ‘হুজুর, এইটা আপনে পারলেন? অহন আমি সকালে দুইফরে বিয়ালে কি দেহুম?’

আমি বলি, ‘আল আকসা দেখবে, সেটা হবে। আরো সুন্দর।’

কণকলতা বলে, ‘এর থিকা হুজুর আমারে বলি দিতেন।’

আমি বলি, দরকার হলে তাও দেয়া যাবে।’

কণকলতা বলে, ‘তইতেও আমি এত কষ্ট পামু না অহন যেই কষ্ট পাইলাম, হুজুর, আমি ত বলি হইয়াই গেছি, আর কি বলি দিবেন আমারে?’

আমি বলি, ‘তাঁতের শাড়ির কথা মনে আছে?’

কণকলতা বলে, ‘আছে, হুজুর, সাত রকমের সাতটা কিনছি, হুজুর।’

আমি বলি, ‘এতোগুলো কেনো?’

কণকলতা বলে, ‘হুজুরের বিবি একেক দিন একেকটা পরব।’

আমি বলি, ‘তুমি অপূর্ব, কণকলতা৷’

কণকলতা বলে, ‘আমি বিবি কণকলতা।’

আমি বলি, ‘তুমি এখন কী দেখতে পাচ্ছো?’

কণকলতা বলে, ‘কিছুই দ্যাকতে পাইতেছি না, হুজুর, আমার চোক অন্দ অইয়া গ্যাছে, কিছু দেহি না।‘

আমি বলি, ‘আমি দেখছি পাখিদের রঙ, তাদের কান্না, আর মহাশূন্যতার একটি মঠ, যা আমাকে ভেদ ক’রে উঠেছে।’

জিহাদিরা আশমান জমিন কাঁপিয়ে আওয়াজ তুলছে ‘আল্লাহু আকবর’, ‘আলি আলি জুলফিক্কার’, ‘নারায়ে তকবির’, ‘শ্যামসিদ্ধি হলো আলিগঞ্জ’, ‘শ্যামসিদ্ধির মঠ ধ্বংস হলো, ধ্বংস হলো’, ‘জামাঈ জিহাদে ইছলাম জিন্দাবাদ’, ‘মালাউন ও দালালদের কতল করো’, ‘জালেহিদের কতল করো’, ‘মুরতাদদের কতল করো’; আমি দেখতে পাই শুনতে পাই ‘শূন্যতা, শূন্যতা’। আমি কেনো ‘শূন্যতা, শূন্যতা’ শুনছি, আমি কি সুস্থ নই?

আমাকে এখন কিছু বলতে হবে, কিন্তু বলতে আমার ইচ্ছে করছে না, আমার বলার কিছু নেই।

মোঃ আবু লাদেন এসে বলে, ‘হুজুর, আপনের বক্তৃতা সগলে হুনতে চায়।’

আমি বলি, ‘তুমি বরং বলো।’

সে বলে, ‘নাউজুবিল্লা, আমি কি বক্তৃতা দিতে পারি? আমার কতা কেও হুনব? সাগলে আপনের কতা হোনতে চায়।’

আশমান জমিন কাঁপিয়ে আওয়াজ উঠতে থাকে ‘আল্লাহু আকবর’, ‘আলি আলি জুলফিক্কার’, ‘নারায়ে তকবির’, ‘শ্যামসিদ্ধি হলো আলিগঞ্জ’, ‘শ্যামসিদ্ধির মঠ ধ্বংস হলো, ধ্বংস হলো’, ‘জামাঈ জিহাদে ইছলাম জিন্দাবাদ’, ‘মালাউন ও দালালদের কতল করো’, ‘জালেহিদের কতল করো’, ‘মুরতাদদের কতল করো’।

মোঃ আবু লাদেন বলে, ‘হুজুর, কিছু কন।’

আমি বলি, ‘তুমি বলো।’

মোঃ আবু লাদের বলে, ‘নাউজুবিল্লা; হুজুর আপনের পায়ে পড়ি, আপনে কিছুকন। আপনের কতা সগলে হোনতে চায়।’

আমার কিছু বলতে ইচ্ছে করে না; কিন্তু আমাকে বলতে হবে।

আমি বলি, ‘বিছমিল্লাহির রহমানের রাহিম। আলহামদুলিল্লা, জামাঈ জিহাদের ভাইয়েরা, তোমরা ইছলামের গৌরব, তোমরা জাতির পথপ্রদর্শক, তোমরা উম্মার অগ্রপথিক, আল্লার বরকত তোমাদের ওপর বর্ষিত হচ্ছে।‘

‘তোমরা ভৈরবকে ওমরপুর, শ্যামসিদ্ধিকে আলিগঞ্জে পরিণত করছে। তোমরা দেশকে পাক করেছো। আমরা স্তান চাই, সার জমিন সাদ বাদ চাই; সেদিকে তোমরা দেশকে এগিয়ে দিয়েছো, আলহামদুলিল্লা।‘

‘তোমরা মুহম্মদ বিন কাশিম, তোমরা তারিক, তোমরা ইখতিয়ারউদ্দিন বিন বকতিয়ার খিলজি। তোমাদের নাম জামাঈ জিহাদের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে, আলহামদুলিল্লা। তোমরা নবযুগ নিয়ে এসেছো, আইয়ামে জাহেলিয়া এখনো দুনিয়া থেকে দূর হয় নি, জাহেলিয়ার অন্ধকারে তোমরা নতুন শাম্‌স্‌।’

আওয়াজ উঠতে থাকে, ‘আল্লাহু আকবর’, ‘আলি আলি জুলফিক্কার’, ‘নারায়ে তকবির’, ‘শ্যামসিদ্ধি হলো আলিগঞ্জ’, ‘শ্যামসিদ্ধির মঠ ধ্বংস হলো, ধ্বংস হলো’, ‘জামাঈ জিহাদে ইছলাম জিন্দাবাদ’, ‘মালাউন ও দালালদের কতল করো’, ‘জালেহিদের কতল করো’, ‘মুরতাদদের কতল করো’।

আমি বলি, ‘কাফেরদের এই মঠ তোমরা যেভাবে ছাইয়ে পরিণত করছে, তা হবে বিশ্ব মুছলমানের আদর্শ, আলহামদুলিল্লা। এখানে উঠবে আল আকসা; দুনিয়ায় ইছলাম ছাড়া আর কোনো ধর্ম থাকবে না। ’

আওয়াজ উঠতে থাকে, ‘আল্লাহু আকবর’, ‘আলি আলি জুলফিক্কার’, ‘নারায়ে তকবির’, ‘শ্যামসিদ্ধি হলো আলিগঞ্জ’, ‘শ্যামসিদ্ধির মঠ ধ্বংস হলো, ধ্বংস হলো’, ‘জামাঈ জিহাদে ইছলাম জিন্দাবাদ’, ‘মালাউন ও দালালদের কতল করো’, ‘জালেহিদের কতল করো’, ‘মুরতাদদের কতল করো’, ‘আল আকসা স্থাপন করো’, ‘আল্লাহু আকবর’, ‘আলি আলি জুলফিক্কার’, ‘নারায়ে তকবির’, ‘শ্যামসিদ্ধি হলো আলিগঞ্জ’।

আমি বলি, ‘এই গ্রাম আজ থেকে আলিগঞ্জ, আজ থেকে এই গ্রাম তোমাদের সকলের, আলহামদুলিল্লা, এখানে কোনো মালাউন ও দালাল থাকবে না, মুরতাদ থাকবে না; যেমন উতরিব থেকে দূর করা হয়েছিলো নাছারাদের, নতুন নাম হয়েছিলো মদিনাতুন্নবি, আজ থেকে শ্যামসিদ্ধির নাম আলিগঞ্জ।’

আমি বলি, ‘এই গ্রামের প্রতিকণা মাটি, প্ৰতিবিন্দু পানি তোমাদের, তোমরা দখল করে; প্রতিটি পাতা, প্রতিটি গাছ তোমাদের, তোমরা দখল করে; এর প্রতিটি ফল, প্রতিটি শস্যকণা তোমাদের দখল করে; এর প্রতিটি মাছ, প্রতিটি মাছের পোনা তোমাদের, তোমরা দখল করে; এই গ্রামের প্রতিটি গাভী ও বাছুর তোমাদের, দখল করে; প্রতিটি গৃহ তোমাদের, দখল করো, আলহামদুলিল্লা।’

আমি বলি, ‘দখল করা নিয়ে তোমরা নিজেদের মধ্যে কলহ করবে না, সবাই সব কিছু সমান ভাগে ভাগ করে নেবে; এই গ্রামের মাটি তোমাদের, আশমান তোমাদের, গৃহ তোমাদের, তোমরা ভোগ করো, আলহামদুলিল্লা।’

দখল তারা অবশ্য আগেই করেছে।

কিন্তু তাদের মুখে একটা গভীর কষ্টের দাগ দেখতে পাই; তারা কাউকে কতল করতে পারে নি, এবং তার থেকেও মারাত্মক হচ্ছে যে ছহবত করার মতো কোনো হুর গ্রামে নেই। তারা ভেবেছিলো হুর পাবে, নিঃশব্দে হুরদের সঙ্গে ছহবত করবে, যেমন করেছিলো শান্তির ঠাণ্ডা আগুনের কালে।

আমি বলি, ‘ছহবত করার মতো কোনো মালাউন স্থার আজ তোমরা পাবে না, আজ তোমরা ছহবত থেকে বিরত থাকবে। বেশি ছহবতে ধাতু ক্ষয় হয়। ধাতু অতিশয় মূল্যবান, দশ সের ঘি খেলে এক ফোঁটা ধাতু উৎপন্ন হয় তোমরা বীৰ্য ধারণ করো, ছহবতের সুযোগ তোমরা পাবে, শান্তির ঠাণ্ডা আগুন দেশ ভরে জুলছে, তোমরা বীৰ্যবান হও, তোমরা শিগগিরই গনিমতের মাল পাবে, শান্তির ঠাণ্ডা আগুন তোমরাও জ্বালাবে।’

আওয়াজ উঠতে থাকে, ‘আল্লাহু আকবর’, ‘আলি আলি জুলফিক্কার’, ‘নারায়ে তকবির’, ‘শ্যামসিদ্ধি হলো আলিগঞ্জ’, ‘শ্যামসিদ্ধির মঠ ধ্বংস হলো, ধ্বংস হলো’, ‘জামাঈ জিহাদে ইছলাম জিন্দাবাদ’, ‘মালাউন ও দালালদের কতল করো’, ‘জালেহিদের কতল করো’, ‘মুরতাদদের কতল করো’।

আমি বলি, ‘মাদ্রাছা-ই-মদিনাতুন্নবিতে তোমাদের জন্য সুআহারের ব্যবস্থা আছে, তোমরা দু-দলে ভাগ হও, প্ৰথম দু-দল দ্রুত আহার করে এসো, দু-দল পাহারায় থাকো, পরে দু-দল গিয়ে দ্রুত আহার করে এসো, এবং আলিগঞ্জে নিজেদের দখল কায়েম করবে, যাতে মালাউন ও মালাউনদের দালালরা ফিরে আসতে না পারে, ইনশাল্লা তারা ফিরতে পারবে না, আলহামদুলিল্লা।’

তারা আওয়াজ তুলতে থাকে ‘আল্লাহু আকবর’, ‘আলি আলি জুলফিকার, ‘নারায়ে তকবির’, ‘শ্যামসিদ্ধি হলো আলিগঞ্জ’, ‘শ্যামসিদ্ধির মঠ ধ্বংস হলো, ধ্বংস হলো’, ‘জামাঈ জিহাদে ইছলাম জিন্দাবাদ’, ‘মুরতাদদের কতল করো’, মালাউন ও দালালদের কতল করো’, ‘জাহেলিদের কতল করো’।

আমি এক বিশাল উচ্চ শূন্যতার দিকে তাকিয়ে থাকি; আর একটি বালক এটি দেখার জন্যে দৌড়ে আসবে না; দেখি পাখিগুলোও আর নেই, রঙ নেই, সুর নেই, এমন কি তাদের ক্রন্দন নেই।

মোঃ আবু লাদেন ও বডিগার্ডদের নিয়ে অনেক দূরে গিয়ে আমি ওই শূন্যতার দিকে তাকিয়ে থাকি; একটি দীর্ঘশ্বাস আমি বুকে চেপে রাখি।

মোঃ আবু লাদেন জিজ্ঞেস করে, ‘হুজুর, ওইহানে কি আল আকসা উঠব?’

আমি বলি, ‘ইনশাল্লা, উঠবে।‘

মোঃ আবু লাদেন বলে, ‘তরাতরি উড়াইলে ভাল আইব, হুজুর।’

আমি বলি, ‘কেনো?’

মোঃ আবু লাদেন বলে, মালাউনগো দালালরা ঘুদি আবার পাওয়ারে আহে, তাইলে মশকিল অইব, এই ঘরবাড়িগুলি ছাইর‍্যা দিতে অইব।

আমি বলি, ‘ইনশাল্লা, তারা আর দুই শো বছরে পাওয়ারে আসবে না, আল্লা তাদের পাওয়ারে আসতে দেবে না, তারা অভিশপ্ত।’

আমার বডিগার্ডদের ও প্রথম দু-দল নিয়ে আমি মাদ্ৰাছা-ই-মদিনাতুন্নবিতে ফিরে আসি; ফেরার সময় আমি একবার পেছনের দিকে তাকাই; একটি অতি উচ্চ শূন্যতা দেখতে পাই। এর পর, আমার মনে হয়, ওখানে শুধু আমি শূন্যতাই দেখবো, কোনো পূর্ণতা দেখবো না; কোনো রঙের ও কাকলির ওড়াউড়ি দেখবো না; একটি বালক আর ব্যাকুল হয়ে এক মাইল দৌড়ে এসে উচ্চতা দেখার জন্যে দূরের সড়কে দাঁড়াবে না।

আমার মনে হয় একটি মহাউচ্চ শূন্যতা আমার পিছে পিছে আসছে, নিশ্বাস ফেলছে আমার পেছনে, আমাকে ঠাণ্ডা হাত বাড়িয়ে ধরছে।

দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, সিলেট, যশোর, লণ্ডন, হেলসিংকি, বার্লিন, লস এঞ্জেলেস, নিউ ইয়র্ক, সিডনি, ইসলামাবাদ, দুবাই, রিয়াদ, জেদ্দা, কাতার, করাচি, টরেণ্টো, মাইজদি, টাঙ্গাইল, ময়মনসিং, রাজশাহী, তেঁতুলিয়া, নারায়ণগঞ্জ, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, খুলনা, পাঁচবিবি, ঘাটাইল পাগল হয়ে আছে, তারা শুনছে ‘ক্যানট বি রিচ্‌ড্‌ নাউ, প্লিজ কল লেটার’; কিন্তু আমি কি লেটার তাদের রিচ করতে দেবো?

গোলাপ-ই-সাহারায় ঢুকে বিছানার ওপর আমি মোবাইলগুলো ছুঁড়ে দিই, একটি ছুটে নিচে প’ড়ে যায়; একটিকেও আমার অন্য করতে ইচ্ছে করে না। সব মোবাইল যদি মঠটির মতো ধ্বংস হয়ে যেতো আমি শান্তি পেতাম। কিন্তু শান্তি কোথায়? আমার জন্যে কি আর শান্তি আছে?

আমার মোবাইল বন্ধ, দুনিয়া নিশ্চয়ই পাগল হয়ে আছে।

আলহজ কোরবান আলি ব্যাপারি মোঃ আবু লাদেনকে নিয়ে পাগলের মতো আমার গোলাপ-ই-সাহারায় ঢোকে।

আলহজ কোরবান আলি ব্যাপারি বলে, ‘হুজুর, আপনেরে ফোন করতে করতে পাগল  অইয়া গেছি, আসনের পথে পথে ফোন করছি, ফোনের পর ফোন করছি, ধরেন নাই দেইখ্যা ডরে কাপতে আছিলাম।‘

আমি জিজ্ঞেস করি, ‘ডর কেনো?’

কোরবান আলি ব্যাপারি বলে, ‘কি জানি কি অয়, বলন তা যায় না। মালাউন আর মালাউনগো দালালরা যুদি কিছু কইরা থাকে?’

আমি বলি, ‘এখন তাদের সে-সাহস নেই।’

কোরবান আলি ব্যাপারি বলে, ‘আলহামদুলিল্লা, হুজুর মোবাইলগুলি অন করেন, নেতারা নিশ্চয়ই আপনেরে চাইতেছে, না পাইলে অনেকের হার্টের রোগ বাইর‍্যা যাইব, ডায়াবেটিস দেহা দিব, পেশাব বাইর‍্যা যাইব।‘

মোঃ আবু লাদেন বলে, ‘হুজুর অহনও আহার করেন নাই।’

কোরবান আলি ব্যাপারি বলে, ‘এই লাদেন ভাই, হুজুরের লিগা তরাতরি আহার লইয়া আসেন, একলগে আমরা আহার করি।’

আমার সামনে মেঝের ওপর কোরবান আলি ব্যাপারি একটি বেশ বড়ো বস্তা রেখেছে, আমি জানি ওর ভেতরে কী আছে। আমি ওদিকে আবার তাকাই।

কোরবান আলি ব্যাপারি বলে, ‘আইজ হুজুরের অনেক পেরাশানি গেছে, তাই মনে করলাম পাচ সাতটা ব্যালাক লেভেল আর ছিবাছ রেগাল লইয়া যাই। জিহাদের পর এই জিনিশ শরীলে কুয়াৎ আনে। আর হুজুরের লগে দিনটা ছেলিবেরেট করতে সুক পামু।‘

আমার বেশ ক্ষুধা লেগেছে, খেতে হবে; আমরা তিনজন খেতে বসি।

কোরবান আলি ব্যাপারি বলে, ‘হুজুর, আইজ আসনের সোম যা দ্যাকলাম, সোভানাল্লা, তাতে আমার দিল জুরাই গ্যাল, ঠাণ্ডা অইয়া গ্যাল দিলে আমি এত শান্তি আগে পাই নাই।‘

আমি বলি, ‘কেনো?’

আলহজ কোরবান আলি ব্যাপারি বলে, ‘হুজুর, মক্কা মদিনায় আমি তিনবার গেছি হজ করতে, দিল ঠাণ্ডা হইছে, তয় আইজ ঠাণ্ডা অইছে সব খিকা বেশি। আগে আসনের সোম পরথমই চোকে পরত কাফেরগো উচা মডটা, দেইক্যা দিলে আগুন লাইগ্যা যাইত, আইজ দেহি হেইডা নাই, দিল জুরাই গ্যাল, হুজুর আমাগো পাক স্তান, সাদ বাদ, আর ইছলামের দিকে হাজার মেইল আগাই দিলেন, আলহামদুলিল্লা, সোভানাল্লা।‘

মোঃ আবু লাদেন বলে, ‘হুজুর আমাগো পির আওলিয়াগো সমান, হুজুরের পায়ের নিচে আমি সারাজীবন পইর‍্যা থাকুম।‘

আলহজ কোরবান আলি ব্যাপারি ও মোঃ আবু লাদেন কয়েক কেজি গরুর গোস্ত আর ভাত শেষ করে ওঠে, আমি খেতে পারি না।

মোঃ আবু লাদেন বলে, ‘হুজুর ত কিছুই খাইলেন না।’

আমি বলি, ‘বেশ তো খেলাম।‘

খাওয়ার পর কোরবান আলি ব্যাপারি বলে, ‘হুজুর, নতুন একটা বোতল ভাঙ্গি, একটু টেইস্ট কইর‍্যা দ্যাহেন।‘

মোঃ আবু লাদেনের চোখমুখও উজ্জ্বল দেখায়, সেও একটু টেস্ট করতে চায়; সে ভালো জিনিশের স্বাদ পেয়েছে।

আমি বলি, ‘কোরবান আলি ছাহেব, এখন টেস্ট করতে আমার ভালো লাগছে না, আমি একটু রেস্ট নোবো।’

তারা বলে, ‘আইচ্ছা হুজুর, আপনে রেস্ট নেন, আমরা অহন যাই; আমগো ডাকলেই আমরা আসুম।‘

আমার খুব রেস্ট নেয়া দরকার, যাতে আমি ওই শূন্য স্থানটিকে দেখতে না পাই; কিন্তু আমি দেখতে পাই শূন্য স্থানে আরেকটি মঠ উঠে দাঁড়িয়ে আছে, না কি আগের মঠটিই ওখানে দাঁড়িয়ে আছে? ওটি কি আসলে ভাঙা হয় নি, চুরমার হয় নি? তাহলে আমি ওটি দেখতে পাচ্ছি কেনো?

লাল নীল হলদে সবুজ পাখিগুলোকে আমি উড়তে দেখছি, তাদের অবিরাম কলকাকলি শুনছি, একটি বালক এক মাইল দূর থেকে এসে সড়কে দাঁড়িয়ে মঠটি দেখছে–এসব আমি দেখছি কেনো, শুনছি। কেনো? একবার কি আমি গিয়ে দেখে আসবো মঠটি সত্যিই দাঁড়িয়ে আছে কি না? ওটি কি চুরমার হওয়ার পর সেই পাখিটির মতো আবার জীবন লাভ করে মেঘ ভেদ করে আকাশের দিকে  উঠছে, আর উঠছে?

মোবাইলগুলো অন করি নি, কিন্তু মনে হয় প্রত্যেকটি কাঁপছে।

এগুলো অন্ন করা দরকার, অন্তত একজনের জন্যে; তবে সে হয়তো ঢুকতে পারবে না, অন্যরা ‘আল্লাহু আকবর’ বলে ঢুকে পড়বে।

‘তোমারে ফোনের পর ফোন করতেছি, পাইতেছিলাম না, তয় বোজতে পারছিলাম আল্লার রহমতে তুমি বিজয় কইর‍্যা চলতেছ, আলহামদুলিল্লা, তুমি আমাগো নকিব, তোমার পথেই দ্যাশ আগাইব।‘

‘তোমারে না পাইয়া অন্য সোর্স থিকা খবর নিছি, অছি জানাইছে আমাগো মিশন সাকসেকফুল হইছে, আলহামদুলিল্লা, তুমি ছাড়া এইডা আর কেও পারত না, আলহামদুলিল্লা।’

‘পাক সার জমিন সাদ বাদটা দুই একবার বাজাইছ নি?’

‘কংগ্ৰেচুলেশন্স, আওয়ার গ্রেট হিরো, আওয়ার কায়দ-এ-আজম, আই হ্যাভ বিন তিন ঘণ্টা ধইর‍্যা ট্রাই করছিলাম টু রিচ ইউ, আই হ্যাভ গ্যাদার্ড দি গ্রেট নিউজ ফ্রম দি ডিছি, দ্যাট ব্লাডি মঠ ইজ নো মোর দেয়ার। আলহামদুলিল্লা, কংগ্ৰেচুলেশন্স, লুকিং ফরোয়ার্ড টু সিইং ইউ ইন মাই প্যালেস।’

‘আই হ্যাভ অলরেডি ডিছাইডেড টু জয়েন জামাঈ জিহাদে ইছলাম, বাট অই শ্যাল কিপ মাই পোস্ট, এ মিনিস্টার কেন হেল্প দি পার্টি ইন মেনি ওয়েজ।’

‘আই হ্যাভ অলরেডি ডিছাইডেড টু বিন্ড এ হিল দেয়ার।’

‘ফোর ক্রোরস ফর আল আকসা হ্যাভ বিন স্যাংশন্ড।’

‘পাকিস্তান আর বেশি ফার না, অই ফিল ইট ইন মাই ব্লাড।’

‘অছি বলতেছি ছার…’

‘ইউএনও বলতেছি ছার…’

‘ডিসি বলতেছি ছার…’

‘এক্সিকিটিভ ইনজিনিয়ার বলতেছি ছার…’

‘ছিভিল ছারজন বলতেছি ছার…’

‘স্পিকিং ফ্রম মালয়েশিয়া…’

‘স্পিকিং ফ্রম ইন্দোনেশিয়া…’

‘স্পিকিং ফ্রম কালিফরনিয়া…’

‘ইসলামাবাদ থিকা বলতেছি…’

‘লন্ডন থিকা বলতেছি…’

স্পিকিং ফ্রম সুইডেন…’

‘রিয়াদ থিকা বলতেছি…’

‘করাচি থিকা বলতেছি…’

‘দিনাজপুর থিকা বলতেছি’ , ‘মাইজদি থিকা বলতেছি…’, ‘চরমনাই থিকা‘বলতেছি…’, ‘চাটগাও থিকা বলতেছি…’,  ‘ছিলেট থিকা বলতেছি…’ ‘লালমনির হাট থিকা বলতেছি…’,  ‘বলতেছি’, ‘বলতেছি’, ‘বলতেছি’, ‘বলতেছি’, ‘বলতেছি’, ‘বলতেছি’, ‘বলতেছি’, ‘বলতেছি’, ‘বলতেছি’, ‘বলতেছি’, ‘বলতেছি’, ‘স্পিকিং’, ‘স্পিকিং’, ‘স্পিকিং’, ‘স্পিকিং’, ‘স্পিকিং’, ‘স্পিকিং’, ‘স্পিকিং’, ‘স্পিকিং’, ‘মোবারকবাদ’, ‘কংগ্ৰেচুলেশন্স’, ‘মোবারকাবাদ’, ‘কংগ্ৰেচুলেশন্স’, ‘মারহাবা’, ‘মারহাবা’, ‘কংগ্ৰেচুলেশন্স’, ‘কংগ্ৰেচুলেশন্স’, ‘কংগ্ৰেচুলেশন্স’, …

ওই ফোনটি আর পাই না, ওটি নিশ্চয়ই ঢুকতে পারছে না। দুনিয়ায় এতো বড়ো বড়ো পাহাড় থাকলে কী করবে একটি ‘কণাকলতা’?

আমি ফোন করে বলি, ‘কণকলতা।’

আমি বলি, ‘না, ভালো নেই।‘

কণকলতা বলে, ‘কি অইছে, হুজুর, ভাল নাই কেন?’

আমি বলি, ‘আমি এক মহাশূন্যতা দেখতে পাচ্ছি, শূন্যতার মধ্যে ডুবে যাচ্ছি, আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে।’

কণকলতা বলে, ‘আমি আছি, হুজুর, আপনেরে ভাইর‍্যা দিমু। আপনেরো ভইর‍্যা দেওনের লিগা আমি বইস্যা আছি।’

আমি বলি, ‘আমি হয়তো বাঁচবো না।‘

কণকলতা হাহাকার করে ওঠে, ‘তাইলে আমিও বাচুম না, হুজুর। ‘

আমি বলি, ‘সন্ধ্যার পর চ’লে এসো, তাঁতের শাড়ি প’রে।’

কণকলতা বলে, ‘হেই কতা কি আমি ভোলতে পারি, হুজুর? আপনার বিবি কণকলতা আসনের লিগা পাগল অইয়া রইছে।‘

আমি একটু পান করি, সাদ বাদ গানটা বাজিয়ে শুনি।

শোনার সময় আমি মহাশূন্যতা দেখতে পাই, হঠাৎ লাথি মেরে প্লেয়ারটাকে উল্টে ফেলে দিই, গানটা ছাছ্যাছা ক’রে বন্ধ হয়; একটি বালকের জন্যে, অজস্র পাখির রঙ ও সুরের জন্যে আমার কষ্ট হয়, আমার কাঁদতে ইচ্ছে করে। আমি কাঁদতে পারি না, কী ক’রে কাঁদতে হয় আমি ভুলে গেছি।

ওই মঠটি কি এখনো ওখানে আছে, ওটি সত্যিই চুরমার হয়েছে তো?

আমি মোঃ আবু লাদেনকে ডেকে জিজ্ঞেস করি, ‘মোঃ আবু লাদেন, মঠটি সত্যিই চুরমার হয়েছে তো? না কি ওটি এখনো দাঁড়িয়ে আছে?’

মোঃ আবু লাদেন বলে, ‘কি যে কন, হুজুর, অহন অইডার একটা ইডও নাই, সব কিছু ধুলা অইয়া গেছে।‘

আমি বলি, ‘তাহলে ওখানে কী আছে?’

মোঃ আবু লাদেন বলে, ‘কিছু নাই, হুজুর, সব খালি, রাহমানির রাহিম আল্লার আশমান ছাড়া আর কিছু নাই।’

আমি বলি, ‘আশমান চুরমার হয়ে যায় নি তো?’

মোঃ আবু লাদেন বলে, ‘কি যে কন, হুজুর, আশমান চুরমার অইব ক্যান?’

আমি বলি, ‘হতে পারে না?’

মোঃ আবু লাদেন বলে, ‘না, হুজুর, অইহানে তা আমরা বোমা মারি নাই; আর আল্লার আশমান চুরমার অইতে পারে না।’

আমি বলি, ‘তাহলে কোথায় মেরেছো?’

মোঃ আবু লাদেন বলে, ‘হুজুর, আপনে ত দ্যাকছেনই, মডে মারছি, কতগুলি বমা আর গ্রেনাইড মারল হেরা।‘

আমি বলি, ‘মঠটি সত্যিই চুরমার হয়েছে?’

মোঃ আবু লাদেন বলে, ‘হুজুর, গুরা অইয়া গ্যাছে।’

আমি বলি, ‘তুমি গিয়ে একটু দেখো তো মঠটি ওখানে আছে কি না?’

মোঃ আবু লাদেন তাজ্জব হয়, এতোটা তাজ্জব সে জীবনে কখনো হয় নি; সে তার দুটি ভোতা চোখ মেলে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।

আমি বলি, ‘তুমি যাও, গিয়ে দেখো মঠটি আছে কি না? চুরমার হয়েছে কি না? ধবংস হয়ে কি না? গিয়ে আমাকে কল করো।’

মোঃ আবু লাদেন ছুটে যায়, কিছুক্ষণ পরই মোবাইলে শুনি, ‘হুজুর, এইহানে অহন কোনো মড নাই, জিহাদিরা একটা মছিদ তোলছে, আলহামদুলিল্লা।‘

আমি বলি, ‘খেয়াল রেখে ওখানে যেনো মাটির নিচ থেকে কোনো মঠ মাথা তুলে না। ওঠে, দিনরাত পাহারা দিও।’

মোঃ আবু লাদেন বলে, ‘হুজুর, মাডির তল থিকা কি মড ওটতে পারে?’

আমি বলি, ‘পারে না?’

মোঃ আবু লাদেন বলে, ‘না, হুজুর, পারে না; খালি রাহমানির রাহিম চাইলে পারে। ‘

আমি বলি, ‘মোঃ আবু লাদেন, তুমি ঠিক জানো যে মাটির নিচ থেকে কোনো মঠ উঠতে পারে না?’

মোঃ আবু লাদেন বলে, ‘হুজুর, আমরা পাহারা দিতে আছি, আপনে একটুও চিন্তা কইরেন না, আমরা খাড়া আছি, আমুন কোনো মন্ড ওটলে ওডনের সোমাই চুরমার কইর‍্যা হলাম, আলহামদুলিল্লা!’

আমি বলি, ‘দ্যাখো তো অন্য কোনো দিকে কোনো মঠ উঠছে কি না?’

মোঃ আবু লাদেন বলে, ‘না, হুজুর, কোনো দিকই ওটছে না।’

আমি বলি, ‘দ্যাখো তো, অনেক দূরে একটি বালক মঠের দিকে তাকিয়ে আছে কি না? মঠ না দেখে সে কাঁদছে কি না?’

মোঃ আবু লাদেন বলে, ‘না, হুজুর, দূরে কোনো পোলাপান নাই; যে-দুই চাইরজন আছে, তারা কাছেই আছে, হাসাহসি করতেছে।’

আমি বলি, ‘তুমি দূরের রাস্তায় গিয়ে দ্যাখো কোনো বালক একলা দাঁড়িয়ে আছে কি না? সেখান থেকে আমাকে কল করো।’

কিছুক্ষণ পর মোঃ আবু লাদেন কল করে, ‘হুজুর, রাস্তায় কোনো পোলা নাই, তয় দূরে মালাউন বাড়ির একটা মাইয়া এই দিকে চাইয়া রইছে। তারে ধইর‍্যা লইয়া আহুম নি, হুজুর?’

আমি বলি, ‘না; তুমি গিয়ে সালাত আদায় করো।’

একটু ঘুম এসেছিলো হয়তো, একটা মধুর স্বপ্ন দেখতে চেয়েছিলাম।

স্বপ্নের বদলে আমি বিভীষিকা দেখতে শুরু করি।–ধারাবাহিক, পথে পথে বিভীষিকা, দেখি আমি আগুন লাগিয়ে চলছি গ্রামের পর গ্রামে, সেই আগুন নরকের আগুনের থেকেও প্ৰচণ্ড, শহরের পর শহরে, সমস্ত ধানখেতে, পাটখেতে, সরষেখেতে, শিউলিগাছে আগুন জ্বলছে, গন্ধরাজে আগুন জ্বলিছে; ছুটে চলছে আমার জামাঈ জিহাদে ইছলামের জিহাদিরা; তারা দখলের পর দখল করছে, চুরমার করছে, কতল করছে, আওয়াজ তুলছে আকাশ দীর্ণজীৰ্ণ করে; টেনে এনে ছহবতের পর ছহবত করে চলছে ঘরে, আঙ্গিনায়, রাস্তায়, মাঠে, ইস্কুলের পথে; আমি আর জামাঈ জিহাদিরা আগুন লাগাচ্ছি বিশ্ববিদ্যালয়ে, বিদ্যালয়ে, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে, লাল সূর্যের পতাকায়, গেয়ে চলছি। পাক সার জমিন সাদ বাদ, আর গাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নদী শুকিয়ে যাচ্ছে, পুকুরে মাছ মরে ভেসে উঠছে, নারীরা মৃত সন্তান প্রসব করছে, আকাশ থেকে আগুন ঝরে পড়ছে, পাখিরা লুটিয়ে পড়েছে; রক্তে ভিজে উঠছে মাটি, পুকুরে পানির বদলে রক্ত, নদীতে রক্তের ঢেউ, আকাশ থেকে রক্তবৃষ্টি হচ্ছে, গাভীদের ওল্যান থেকে রক্ত ঝরছে; কবিতা থেকে রক্ত করছে, সব নর্তকী খোঁড়া হয়ে যাচ্ছে, চিত্রকরের আঙুলে কুষ্টরোগ দেখা দিচ্ছে।

আমি দেখি আমার দেশ জেনায়–জেনায়–জেনায়–মূৰ্ছিতা হয়ে রাস্তার পাশে প’ড়ে আছে।

তার নাম পাক স্তান; তার গান পাক সার জমিন সাদ বাদ।

ভয়ে আমি চিৎকার ক’রে উঠি, আমার শরীর ঘামে ভিজে গেছে। বাইরে আমার বডিগার্ডরাও আমার চিৎকার শুনতে পায়।

একজন নক ক’রে বলে, ‘হুজুর, কি অইছে আপনের?’

আমি বলি, ‘আলহজ কোরবান আলি ব্যাপারি ও মোঃ আবু লাদেনকে খবর দাও, তাদের আসতে বলো।’

আমি মুখহাত ধুয়ে নতুন পাজামাপাঞ্জাবি পরি, বিভীষিকা কাটিয়ে উঠি।

কোরবান আলি ব্যাপারি এসে বলে, ‘হুজুর, আপনের ডাকের লিগাই পাগলের মতন ওয়েট করছিলাম, আপনের লগে একটু ড্রিংক কইর‍্যা ধইন্য হইয়া তারপর ঢাকা যামু, আটটার মইদ্যে যাইতে অইব।‘

আমি মোঃ আবু লাদেনকে বলি, ‘মোঃ আবু লাদেন, তিনটি গেলাশে হুইস্কি ঢালো, বেশি ক’রে ঢালো, খুব বেশি ক’রে।’

মোঃ আবু লাদেন বলে, ‘ঢালি, হুজুর।’

সে এখন বেশ ঢালিতে শিখেছে, ঠাণ্ডা পানিও ঠিক মতো মেশাতে শিখেছে।

কোরবান আলি ব্যাপারি বলে, ‘হুজুরের লগে ড্রিংক করনের সুকই আলাদা, অনেকের লগে করছি, সোনারগাঁও করছি, ব্যাংকক করছি, দুবাই করছি, সিঙ্গাপুর করছি, নিউ ইয়র্ক করছি, আটলান্টিক ছিটিতে তাজমহল কেছিনোয় করছি, এমুন কি সৈদি আরবের ফাইভ স্টারেও করছি, তায় হুজুরের লগে ড্রিংক করলে মনে অয় জান্নাতে বইস্যা খাইতে আছি; আর আইজ ত আমাগো ভিকটরি ডে, দিলডা সুকে ভইরা আছে, হেইডা ছেরিবেরেট করনের সুকই আলাদা।’

আমি বলি, ‘বেগম লায়লাতুন কদর কেমন আছেন?’

কোরবান আলি ব্যাপারি বলে, ‘হে আবার কেমুনি থাকিব? প্যাড উচা কইর‍্যা চিৎ অইয়া হুইয়া রইছে, তার ত অই বিজিনেছ।’

আমি বলি, ‘আপনি তাঁকে বিজি রাখলে তিনি আর কী করবেন?’

তিনি বলেন, ‘আল্লায় বীজ দিছেন, মাডিতে বীজ পরলে চারা ত অইবই; আর আমি ভিজা মাডিতে বীজ বোনতেই পছন্দ করি।‘

আমি বলি, ‘আর আপনার গার্মেন্টসের সুন্দরীরা?’

কোরবান আলি ব্যাপারি বলে, ‘তাগো লিগাই তা টিকা আছি; হেরা শিলাই পছন্দ করে, কচি জিনিশ ত, মাজেমইদ্যে শিলাই করি। বিবিরে দিয়া ত অহন কাম আয় না। তয় আলহামদুলিল্লা, হের প্যাড থিকা খালি পোলা বাইর অয়, একটা মাইয়া বাইর হয় না, সোভানাল্লা।‘

আমি বলি, ‘আপনার বুড়ো ছেলে মুহাইমেন বিন কোরবান কেমন আছে?’

কোরবান আলি ব্যাপারি বলে, ‘অই শালার পুত অখন আমার থিকাও ভাল আছে, মাসে গার্মেন্টসের ৩০টা মাইয়ার প্যাট বানায়, একবার ব্যাংকক না গেলে তার সুক অয় না, তয় আল্লারছুলরে ভোলে নাই, এজতেমায় যায়, হজে যায়, আর বিজিনেছ বোঝে ভাল, সোনা আইন্যাই মাসে কয়েক কোটি বানায়। অর বাড়িতে কাস্টমসের কর্তারা পইরা থাকে, অরো ‘ছার’ কয়।’

আমি বলি, ‘তাকে নিয়ে আপনি গর্ব করতে পারেন।‘

কোরবান আলি ব্যাপারি বলে, ‘হ, শালার পুতরে দেখাইয়াই একদিন আমার চলতে অইব, অখন অর ৩০টা মাইয়ার প্যাট ছাপের কাম আমার করতে অয়।’

আমি বলি, ‘আপনার দুই নম্বর ছেলে জিল্লুর বিন কোরবান?’

কোরবান আলি ব্যাপারি বলে, ‘হে ত অল্প বয়সেই পাইক্কা গ্যাছে, প্যাট বানান হেও শিখছে, মাসে মাসেই বানায়।’

আমি বলি, ‘বেশ তো।’

কোরবান আলি ব্যাপারি বলে, ‘ওই শালার পো আবর কয় ডিগ্রি ওপরে, গার্মেণ্টেসের দুইটা মাইয়ারে আমি টার্গেট কইর‍্যা রাকছিলাম, তার আগে হে নিয়া প্যাট বানাইছে। কাম করে না, মাসে মাসে দশ লাক নেয়। অখন একটা মডেলরে প্যাট বানাইছে, অর থিকা ১০ বছরের বড়, কয় তারে বিয়া করব।’

আমি বলি, ‘সে বেশ সৎ মনে হয়।’

কোরবান আলি ব্যাপারি বলে, ‘বিয়া করনের কি দরকার? প্যাট ত আর কত বানাইবা, সব গুনিয়ে বিয়া করতে পারব?’

আমি বলি, ‘একবার করে দেখুক না।’

কোরবান আলি ব্যাপারি বলে, ‘মডেলডার আগের ঘরের আবার একটা মাইয়া আছে, হেরেও আনতে অইব।’

আমি বলি, ‘ধর্মকর্মে মতি আছে তো?’

কোরবান আলি ব্যাপারি বলে, ‘মাসাল্লা, সেইতে মন আছে, সালাত ভোলে না, এস্তেমা ভোলে না।’

আমি বলি, ‘আপনার বড়ো বিবি?’

কোরবান আলি ব্যাপারি বলে, ‘হে ত আর আমার বিবি না, তারে ত তালাক দিছি। হুনি হেও আহন মাসে মাসে ব্যাংকক সিঙ্গাপুর যায়, হে মডান অইয়া গেছে, বোরকা হিজাব ছাইর‍্যা দিছে, কাস্টমসের একটা কালেক্টর না কি তার পাটনার আর বয়ফ্রেণ্ড।‘

আমি বলি, ‘আপনার কেমন লাগে?’

কোরবান আলি ব্যাপারি বলে, ‘মনে আইলে একটু খারাপ লাগে। আমার এক সোমের বিবি অন্যের লগে হুইছে ভাবলে আমি তিনডার লগে হুই।’

কোরবান আলি ব্যাপারি ঢকঢক ক’রে তিন গেলাশ কয়েক মিনিটে শেষ ক’রে দেয়, আরো দুই গেলাশ নিয়ে বসে।

মোঃ আবু লাদেনকে জিজ্ঞেস করি, ‘ব্ল্যাক লেবেল কেমন লাগছে?’

সে বলে, ‘হুজুর, এইডার তুলনা নাই, নাছারারা যে কি জিনিশ বানায়, কি কিতাব পইর‍্যা যে নাছারারা এই জিনিশ বানায়!’

সেও কয়েক গেলাশ শেষ করেছে, একটু কাঁপছে।

আমি বলি, ‘ওই বস্তায় পাঁচটি বোতল আছে, তুমি নিয়ে যেও।’

মোঃ আবু লাদেন বলে, ‘আপনের রহমতের কতা কোন দিন ভুলুম না, হুজুর, আপনের পায়ে পইরা থাকুম।’

রাত আটটা বেজে এসেছে, পাজেরোও গেছে, আমি জানি এখনই কণকলতা আসবে, সে দেরি করবে না।

বোরখা পরে কণকলতা এসে ঢোকে, এসে পায়ে সালাম করে, তার মুখ ঢাকা। আমি জানি সে এসেই আমাকে জড়িয়ে ধরতে চেয়েছিলো, চুমো খেতে চেয়েছিলো; কিন্তু এদের দেখে মুখ ঢেকেছে।

মোঃ আবু লাদেন ও আলহজ কোরবান আলি ব্যাপারির সঙ্গে কণকলতার পরিচয় করিয়ে দিই: বলি, ‘আমার বিবিজান।’

কোরবান আলি ব্যাপারি বলে, ‘আলহামদুলিল্লা।’

আমি বলি, ‘বিবিজান, তোমার মুখটি দেখতে দাও।’

কণকলতা মুখ থেকে ঢাকনা সরাতেই একটি পূর্ণিমার চাঁদ দেখা দেয়।

কোরবান আলি ব্যাপারি দিল থেকে বলে ওঠে, ‘সোভানাল্লা, আলহামদুলিল্লা, মারহাবা, মাশাল্লা, আল্লায় হুজুররে বেহেশতের নারী দান করছেন, যে আল্লার কাম করে আল্লা তারে উপযুক্ত পুরুস্কার দেয়।’

আমি বলি, ‘আপনি ঢাকা যাবেন না?’

কোরবান আলি ব্যাপারি বলে, ‘হ, সময় অইয়া গেছে, চলেন আবু লাদেন ভাই, আমরা যাই, হুজুর বিবির লগে একটু মহব্বত করেন; জিহাদের পর হুজুরের একটু মহব্বত দরকার।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *