কবি অথবা দণ্ডিত অপুরুষ – ০৭

কবি অথবা দণ্ডিত অপুরুষ

পরদিন ভোরে কয়েকটি বাঙলা দৈনিক দেখে শিউরে ওঠে হাসান। তার কথা দিয়েই সংবাদের শিরোনাম করা হয়েছে, আর তার বক্তৃতারই রয়েছে বিশদ বিবরণ; সভাপতি, প্রধান অতিথির শুধু নাম রয়েছে। হায়, সভাপতি, হায়, প্রধান অতিথি। একটিতে তার ছবিও ছাপা হয়েছে, কিন্তু ছবিটা হাসানের পছন্দ হচ্ছে না, পাশ থেকে ছবিটা না তুলে কি মুখোমুখি তোলা যেতো না? হাসান পত্রিকাগুলোর সংবাদ বারবার পড়ে। এই কথাগুলোই কি সে বলেছে? মনে পড়ে সে বলেছে, তবে অনেক বাক্য ঠিক তার নয়, সাংবাদিকেরা নিজেদের মতো ক’রে লিখেছে। সে কি এমন বাসি বাক্য বলে?

তাহলে আমিও শিরোনামযোগ্য? সংবাদযোগ্য? হো হো ক’রে মনে মনে হাসে সে। আমিও তাহলে হয়ে উঠছি?

কিন্তু হয়ে ওঠা কাকে বলে, হাসান? নিজের সাথে কথা বলতে থাকে সে।

জমিরালি তো অনেক আগেই হয়ে উঠেছে, আরো হয়ে উঠবে; তুমি কি জমিরালি হ’তে চাও? হতে চাও ওই সভাপতি, প্রধান অতিথি? এক পাতিল বাসি পচা পুঁটি মাছের সিদলের মতো মঞ্চে মঞ্চে পচা বাসি কথা বলতে চাও তুমি? চাও না? তাহলে তোমার কিছু হবে না। কবিতা লিখে তুমি স্বীকৃতি পাবে? তোমার কবিতা ওরা বুঝবে? তুমি ওদের পেছনে পেছনে না হাঁটলে কখনো ওরা তোমার নাম নেবে? কখনো নেবে না।

আলাউদ্দিন রেহমান ফোন করে, দোস্ত, তোমার অনুষ্ঠানে যাইতে পারি নাই, কিন্তু কাগজে যা পড়লাম তাতে মনে হইতেছে তুমি তুলকালাম কাণ্ড বাধাই দিছো। মনে হইল সুকান্তজয়ন্তী না হইয়া হাসান জয়ন্তী হইয়া গেছে।

হাসান বলে, না, না, হাসানজয়ন্তী নয়, তুমি একটু ভুল করেছে, এর নাম হওয়া উচিত হাসানক্ষয়ন্তী; আমার আর ভবিষ্যৎ নেই।

আলাউদ্দিন রেহমান বলে, কবির আর ভবিষ্যৎ কি, মরার পর অমর হওয়া ছারা। হাসান বলে, তাহলে ওই ঘটনাটি শিগগির ঘটা দরকার।

আলাউদ্দিন রেহমান বলে, দোস্ত, একটা ভাল খবর আছে, তোমার জন্যে, ম্যাডাম মরিয়ম মাঝেমইন্দ্যেই তোমার নাম লয়, বলে তুমি আর আসলা না।

হাসান বলে, কার কথা বলছো, বুঝতে পারছি না তো। আলাউদ্দিন রেহমান বলে, আরো দোস্ত, অই যে একদিন আসছিলা আর তোমারে হুইস্কি ঢাইল্যা খাওয়াইছিলো, সেই ম্যাডাম মরিয়াম; মাঝেমইন্দ্যেই তোমার কথা কয়। মনে হয় দিলে দাগ কাইট্যা গেছো।

হাসান বলে, খুবই চমৎকার মেয়ে ম্যাডাম মরিয়ম, তুমি বেশ ভালোই আছো।

আলাউদ্দিন রেহমান বলে, দোস্ত, ভাল থাকা কি অতই সহজ, মাইয়ালোক লইয়া?এই এরিয়ায় গার্মেন্টস আর প্রিন্সেসে তফাৎ নাই; মাইয়ালোক শুরুতে গোলাপের পাপড়ির মতন পাতলা আর শ্যাষে পাথরের মতন ভারি। দোস্ত, আমি ভাল থাকতে চাই না, মাঝেমইধ্যে আনন্দে থাকতে চাই। আইজ সন্ধ্যায় আমার বাইড়তে আইসো, দোস্ত, একটু খাঅনদাঅনগিলন যাইবো, আনন্দ করন যাইবো।

হাসান বলে, আচ্ছা, অবশ্যই আসবো।

আলাউদ্দিন বলে, আরও দুই চাইরটা কবিরেও বলতেছি, অই দোস্তারা গিলার বেশি চান্স পায় না, কিন্তু গিলতে চায়, অগো গিলাইতে ভালই লাগে, ইম্মরটালগো লগে খাইতে আমার ভালই লাগে, অগো যতই গাইল্লাই অরা কমবেশি ইম্মরটাল এইটা আমি বুঝি। অগো নাম থাকবো, আমার নাম থাকবো না।

হাসান বলে, তুমি গার্মেন্টস, নও তুমি অ্যাড নও, তোমার ভেতর সেই কবিটি এখনো আছে, তুমি আবার কবিতা লেখো। তোমার কবিতা আমি পছন্দ করতাম। তোমার ভেতরেও অমর হওয়ার রোগ আছে, আলাউদ্দিন।

আলাউদ্দিন রহমান বলে, আরো দোস্ত, গার্মেন্টস্, আর পয়েট্রি একলগে যায় না, ট্যাকা বানাইতে চাইলে আর ইম্মরটাল হ’অন যায় না। ইম্মরটাল হইতে হইলে সেক্রিফাইস করতে হয়, পাগল হইতে হয়, আয়নায় নিজেরে দেইখ্যা গুডমৰ্নিং বলার প্রতিভা থাকতে হয়, খানকি ট্যাকারে গুডবাই জানাইতে হয়, আমি পয়েট্রিরে গুডবাই জানাইছি, অই বিউটি আমার লগে শুইবো না, তোমাগো লগেই রাইত কাটাইবো। তয় ট্যাকার শরিলটাও শোঅনের মতন।

অনেক দিন পানটান হয় নি, হাসান একটু তৃষ্ণা বোধ করে, আজ সন্ধ্যায় বেশ পান করা যাবে, রক্তনালি ভ’রে নিতে হবে ব্ল্যাক লেবেলে। সন্ধ্যার বেশ পরে, কখন যাবে কখন যাবে ভাবতে ভাবতে একটু দেরি ক’রে, সে উপস্থিত হয় আলাউদ্দিন রেহমানের লালমাটিয়ার বিশাল বাড়ির তেতলার ফ্ল্যাটে।

হাসানকে দেখে হৈ হৈ ক’রে ওঠে আলাউদ্দিন, শ্যাষম্যাষ কবি হাসান রশিদ আসছেন, বেশি দেরি করেন নাই, ঘণ্টা দুই দেরি করছেন, বইস্যা যাও, দোস্ত, খাও, গিলো।

ঢুকেই হাসান দেখে পাঁচ অমর পান ক’রে চলছেন।

আলাউদিনের কাব্যরুচি গার্মেন্টস ইন্ডেন্টিং অ্যাডে নষ্ট হয় নি–এজনোই ওকে আজো কবি মনে হয়, আলাউদ্দিন বেছে বেছেই গিলতে ডেকেছে হাসানের ভালোই লাগে। মাঝখানের দুটি সোফায় বসে আছেন কবি কামর আবদিন ও কথাশিল্পী করিম আহমেদ; এ-পাশের বড়ো সোফাটিতে বসেছে কবি শাহেদ আলতাফ ও কবি রাকিব সুলতান, ওপাশের আরেকটি বড়ো সোফায় একলা বসে আছে কবি সালেহ ফরিদউদ্দিন।

কথাশিল্পী করিম আহমেদটি সবার বড়ো, দু-খানা বই লিখে সাতখানা পুরস্কার পেয়ে তিনি সব সময় গাল ফুলিয়ে এবং সব কিছুর ওপর নিরন্তর বিরক্ত হয়ে থাকেন, সহজে কাউকে দেখতে পান না, তার চোখ দুটি যে-কাউকে দেখার জন্যে নয়; হাসানের মতো সামান্যতাকে তিনি দেখতে পেয়েছেন বলে মনে হলো না। তিনি পান ক’রে চলছেন, পানিপাত্রে হয়তো তার নায়িকাদের নগ্ন সাঁতার কাটতে দেখছেন, চমৎকারভাবে কাঁপছেন, কারো দিকে তাকাচ্ছেন না, মনে মনে তিনি দস্তয়োভস্কির বা হেমিংওয়ের সাথে হয়তো কথা বলে চলছেন।

কবিদের মাঝে এই গদ্য কেনো? হাসান নিজেকে জিজ্ঞেস করে।

ওহ! কবি কামর আবদিন আবার এঁকে ছাড়া কোথাও যান না, তাঁরা দুজন দুজনকে প্রশংসা ক’রে ক’রে পুরস্কার পাচ্ছেন ও বুড়ো হচ্ছেন।

তাঁরা দেশকে একদিন দুটি অতুলনীয় বুড়ো উপহার দেবেন।

হাসান মনে মনে অনেকক্ষণ ধ’রে হাসে।

কবি কামর আবদিন এখন খুব সাড়া জাগাচ্ছেন, এবং তিনি আপাদমস্তক অকবিসুলভ ভদ্রজন, বুড়ো হ’লে লোকটি হয়তো এতো ভদ্র হবেন যে সব কিছু ঘিনঘিনে ক’রে তুলবেন; তার চুল ঢেউ খেলানো, মুখখানি সুন্দর–এটা তার বড়ো সম্পদ, এটা ভেঙে তিনি খেয়ে যাবেন আরো তিরিশ বছর, এবং তিনি কথা বলার সময় মৃদুমধুর তোতলান, সব সময়ই মধুর কথা বলেন।

কবি কামর আবদিন পান করতে করতে বলেন, আআআসুসুসুন হাসান রশিদ সাহেব, আআআপপপনার ককককথাই হহহচ্ছিলো।

আদিম অভদ্র কবিদের মধ্যে এমন দু-একটি ভদ্র উদাহরণ থাকা দরকার।

হাসান হাত নেড়ে সবাইকে সালাম দেয়, কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে।

কবি শাহেদ আলতাফের মুখটি বিশাল, ঠোঁট ঝুলন্ত, চুল এলোমেলো, চোখ ঘোলাটে লাল; এর মাঝেই প্রচুর পান ক’রে ফেলেছে বলে মনে হয়, সে ঝিমোচ্ছে একটু পরই হয়তো সিঁড়ির নিচে গড়িয়ে পড়বে, হাসানের দিকে একবার তাকিয়ে বলে, পিয়ো, ইয়াং পোয়েট অ্যান্ড রেবেল, হ্যাঁভ এ গ্লাস।

শাহেদ আলতাফ হাত বাড়িয়ে দেয় হাসানের দিকে; কয়েক সেরা ওজন হবে শাহেদ আলতাফের হাতটি, হাসানের হাতটি ভেঙে যেতে চায়।

শাহেদ বলে, ইয়াং পোয়েট অ্যান্ড রেবেল, হাতটা তো রমণীদের মতো নরম।

হাসান বিব্রত হয়ে হাসে, বলে, কবির হাত।

শাহেদ আলতাফ বলে, পোয়েট, নাই-এ-ডেইজ পোয়েটদের হাত ডাকাতদের হাতের মতো শক্ত হওয়া দরকার, লিরিকেল রোম্যান্টিসিজমের কাল কবে শেষ হয়ে গেছে, এখন কবির হাত দিয়ে নর্দমা ঘাটতে হবে, চৌরাস্তায় গুণ্ডামি করতে হবে, রাবীন্দ্ৰিক চম্পক আঙুলে আর চলবে না; এ পয়েট নাউ-এ-ডেইজ ইজ অ্যান অ্যাকজিকিউশনার।

কবি রাকিব সুলতান এরই মাঝে উৎসবমুখর হয়ে উঠেছে।

রাকিব সুলতান বলে, গিলতে আসতে দেরি করলে আর কবি হওনা হইবো না ভাই, মদের গন্ধ পাইলেই কবিগো কুত্তার মতন ছুইট্টা আসতে হইবো শুয়োরের মতোন ঘোৎঘোৎ করতে করতে আসতে হইবো, মদই হইল কবি গো পানি কবিগো নিশ্বাস, হায়, তাও অই গরিবরা পায় না, গার্মেন্টস্‌রা পায় খানকির পুতরা পায়, কবিরা পায় না। বইল্যা দিলাম। আপনে ভাই কবি হইতে পারবেন না, যান, গ্যারামে গিয়া চেয়ারম্যানের মোটাগাটা একটা মাইয়ারে বিয়া কইর‍্যা সুখে ঘরসংসার করেন, পোলাপান পয়দা করেন।

কবি সালেহ ফরিদউদ্দিন একপাশে তার প্রুফগুচ্ছ বিছিয়ে বসেছে, কাবাব আর নান খেয়ে চলছে, ও সব সময়ই ক্ষুধার্তা থাকে, এবং নিজের কবিতাও আবৃত্তি ক’রে চলছে, আর পান ক’রে চলছে।

সে বলে, আসো, দোস্ত, বসো আমার পাশে; তোমারে একটা কবিতা শুনাই।

সালেহ প্রুফগুচ্ছ থেকে একটি কবিতা পড়তে শুরু করে, ওর দেখে পড়তে হয়। না, চােখ বুজেই সে আবৃত্তি করতে থাকে।

ম্যাডাম মরিয়ম ঢোকার সময়ই হাসানকে সালাম ও হাসি জানিয়েছিলো, এবং আরো দুটি তরুণীও তাকে সালাম ও হাসি জানিয়েছিলো; তারা পরিবেশকে খুবই সেনাসুয়্যাল শৈল্পিক ক’রে রেখেছে, পাত্রে পাত্রে ব্ল্যাক লেবেল ঢেলে দিচ্ছে, এগিয়ে দিচ্ছে কাবাব আর নান।

হাসান কবি সালেহ ফরিদউদিনের পাশে বসে।

ম্যাডাম মরিয়ম একটি প্লেটে কাবাব আর নানা নিয়ে তার সামনে হেসে দাঁড়ায়, সে প্লেটটি নেয় ম্যাডাম মরিয়মের হাত থেকে। মরিয়মের একগুচ্ছ আঙুল তার আঙুলের ওপর একপশলা বৃষ্টিধারার মতো ঝরে পড়ে।

অনেক দিন পর তার আঙুলের ফাটা মাটির ওপর শ্রাবণ নামলো।

ম্যাডাম মরিয়ম তার গেলাশে হুইস্কি এবং চােখে বৃষ্টি ঢালতে ঢালতে জিজ্ঞেস করে, পানি না বরফ, কবি?

বিস্মিত হয়ে হাসান তাকায় তার দিকে, এবং হেসে বলে, পানিও নয় বরফও নয়, একটু সবুজ মেঘ একটু সোনালি কুয়াশা এক টুকরো নীল চাঁদ যদি থাকে।

মরিয়ম মধুরভাবে তাকায় হাসানের দিকে।

হাসান বলে, প্রিয়, এখানে আমি একা কবি নাই, একা আমাকে কবি বললে অন্যরা আপনাকে খুন ক’রে ফেলবে। সেনাপতিরাও অবহেলা সহ্য করে, কিন্তু কবিরা করে না, কবিরা নিজেকে ছাড়া আর কাউকে কবি মনে করে না।

মরিয়ম তার গ্লাশে পানি ঢালতে ঢালতে বলে, খুন করুক, আপনারে এই একটু

সবুজ ম্যাঘ দিলাম, কবি।

হাসান মরিয়মের মুখের দিকে তাকিয়ে গেলাশে একবার চুমুক দেয়।

বরফ নেই। সে কাপতে কাঁপতে এক চুমুকে অর্ধেকটাই শেষ করে ফেলে, তার ঝকঝকে গায়ের রঙ ঝিলিক দিয়ে ওঠে, এবং বলে, ইম্মরটালগো লগে পান করতে পাইর‍্যা আমি নিজেরে ধইন্য বোধ করতেছি।

আলাউদ্দিন সম্ভবত এর আগেই দু-এক গ্লাশ গিয়েছে।

কবি কামর আবদিন খুবই সামাজিক ভদ্র, তিনি জিজ্ঞেস করেন, আলাউদ্দিন সাহেব, ভাভাভাবীকে তো আআআজ দেখছি না।

তাঁর ভদ্রতায় মুগ্ধ হয় হাসান, নিজেকে অভদ্র মনে হয়; আলাউদিনের বাসায় এসে প্রথমেই তো তার উচিত ছিলো ভাবীর সংবাদ নেয়া।

তবে কামর আবদিনের ভদ্রতা ভিন্ন প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে।

আলাউদ্দিন আরেক চুমুকে গোলাশটি শেষ ক’রে ম্যাডাম মরিয়মের দিকে এগিয়ে দিতে দিতে বলে, তারে কি দ্যাখনের সাধ এত তারাত্যারিই হইয়া গেলো আপনের আবদিন ভাই? এখনও তা রাইত বেশি হয় নাই, এক গোলাশও শ্যাষ করেন নাই, আরও কয়েক গেলাশ গিলেন, তারপর তারে দেখনের কথা ভাইবেন। রাইত ফুরাই যায় নাই।

খুবই বিব্রত হন ভদ্র কবি কামর আবদিন, তাঁর হাত থেকে গোলাশটি পড়ে যেতে চায়; গোলাশটি ধরতে ধরতে তিনি লাজুকভাবে বলেন, না, না, কিকিকিকিছু মমমনে কককরবেন না, আমি কিছু খারাপ মিন করি নি, আআআমি এএইভাবেই জিজিজিজ্ঞেস কককরেছিলাম। ভাবী খুব সন্ত্রান্ত মহিলা।

আলাউদ্দিন বলে, ওই সব সম্ভ্রান্তফম্ভ্রান্ত মহিলার কথা ভুইল্যা যান, আইজ ম্যাডাম মরিয়ম আছে, লগে আরও দুইজন প্রিন্সেস আছে।

কবি রাকিব সুলতান বলে, অই হারামজাদা আলাউদ্দিন, তুই তা আমার আগেই মাতাল হইয়া যাইতেছছ, আগে আমারে মাতাল হইতে দে, এইটা আমার অধিকার, তারপর তুই মাতলামি করিছ। আসল কথাটা কইয়া দে যে ভাবী দ্যাশে নাই, দিল্লি দাৰ্জিলিং গ্যাছে।

আলাউদ্দিন বলে, আর ফিইররা না আসলে বাচি, ওয়াইফ আর হুইস্কি আর কবিতা একলগে চলে না। এই দ্যাখেন না, ওয়াইফাগো ডরে আপনেরা নিজেগো বাড়িতে গিলেন না, বাড়িতে ঢোকনের আগে পানজর্দা খাইয়া লন।

শাহেদ আলতাফ বলে, আরো ছালা, বউটউ লইয়া ডিস্কাশন ছারো, পান করো আর কবতে লইয়া কথা বলো, কবতেই আমাদের ফিয়াঁসে, কবতেই আমাদের ওয়াইফ। অ্যান্ড মিস্ট্রেস, কবতেই আমাদের ইটারন্যাল গডেজ। ওয়াইফ থাকবে হারামজাদাদের, আমাদের কোনো মেয়েলোক ওয়াইফ থাকবে না। হিজড়েদেরই ওয়াইফ লাগে, কবিদের ওয়াইফ লাগে না; দি পয়েটস ডোন্ট নিড ওয়াইভস্‌।

রাকিব সুলতান বলে, ওস্তাদ, কইতে থাকো, কবতের স্তব গাইতে থাকো, কবতের জইন্যে আমি হাজেরার লগে ঘুমাইতে অস্বীকার করছি, কবিতের জাইন্যে আমি পশ্চিম পাড়ার সুনীল্যার মতন অম্‌রতা অস্বীকার করছি।

আলাউদ্দিন বলে, শালা, অইটা কোনো কবি না, অইটা একটা সেন্টিমেন্টাল স্টেরিটেলার, অইটার নাম মুখে আনিছ না। অই শালা কবি না।

রাকিব সুলতান বেশ খেয়েছে, সে ঢকঢক ক’রে খায়, সে গড়িয়ে পড়ে, উঠতে উঠতে বলে, তাইলে কি আমি এই পোস্ট-এডিটরিয়াল রাইটার কামর আবদিনের কথা বলুম? ও আইজ পর্যন্ত একটা মেমোরেবল লাইন লিখছে? ও তা একটা ঈশ্বরগুপ্ত। এই পাড়ার মুসলমানরা অরে লইয়া মাতামাতি করন শুরু করছে, আগে জসিমুদ্দিন আছিল, এখন অরে লইয়া ফালাফালি করছে, ও আমার এইটার কবি।

রাকিব সুলতান দাঁড়িয়ে ট্রাউজারের জিপ টানতে টানতে বলতে থাকে, ও আমার এইটার কবি, ও হইল পোস্ট-এডিটরিয়াল রাইটার, ও হইল রিপোর্টার, রিপোটিং আর কবতে এক জিনিশ না। কবিরা মহাকালের জাইন্যে লেখে, ও লেখে একদিনের জইন্যে; ওর কবিতা পাঁঠার পদ্য, তপসে মাছের পদ্য।

কামর আবদিন বিব্রত হয়ে তোতলাতে শুরু করেন, তাঁর চোখমুখ লাল হয়ে ওঠে, এবং বলেন, আআআমি যা লিলিলিখেছি আআআগে তা লিলিলিখুন, ওই সব নাগরিক ইমেজারি তৈরি করুন, পরে এএএইসব বববলবেন।

রাকিব সুলতান গিয়ে দাঁড়ায় কামর আবদিনের সামনে, সে জিপ খুলতে থাকে, কামার আবদিন ভয় পেয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে।

রাকিব সুলতান বলে, তুমি আমার এইটা ল্যাখছো, আই ল্যাওরা আমি লিখুম না, কবিতা লিখতে গিয়া আমি জার্নালিজম করুম না। কবিতা হইল পিউরেস্ট ডায়মন্ড, আর তুমি কবিতার নামে কয়লা চালাইতেছ।

সালেহ ফরিদউদ্দিন নিজের কবিতা আবৃত্তি ও পান করা থেকে জেগে উঠে বলে, মহাকবি জীবনানন্দের আগে আর পরে বাঙলায় কোনো শালা কবিতা ল্যাখে নাই, আমি দুই একটা ল্যাখতেছি। আবদিন ভাই ত আঠার মাত্রার গদ্য লেখে।

কামর আবদিনকে বাঁচাতে কাঁপতে কাঁপতে গোলাশ উল্টে ফেলতে ফেলতে ধরতে ধরতে এগিয়ে আসেন কথাশিল্পী করিম আহমেদ।

তিনি খশখ’শে পুরস্কারপ্রাপ্ত গলায় বলেন, কবি কামর আবদিন বাঙলা কবিতায় যুগান্তর এনেছেন, তিনি নকশিকাঁথা সোজানবাদিয়ার কবিতাকে খালেঝিলে ফেলে দিয়ে কবিতাকে নাগরিক কবিতা ক’রে তুলেছেন, তিনি আমাদের টি এস এলিয়ট, তাঁর কবিতা বোঝার শক্তি আপনাদের নেই।

রাকিব সুলতান এবার করিম আহমেদের দিকে তার জিপ টানাটানি নিয়ে এগিয়ে যায়, বলে, আমার চুলমার্কা দুইখানা পিরিতির গল্প লেইখ্যা আপনে সাতখানা পুরস্কার পাইছেন, আপনে অইগুলি লইয়াই থাকেন, কবিগো মইধ্যে কথা কইতে আইসেন না। নাগরিকতা আর এলিয়টের এইটা বোঝেন আপনে, হইছেন ত মুসলমানের নীহাররঞ্জন গুপ্ত, সেইটা হইয়াই থাকেন।

কামর আহমেদ চিৎকার ক’রে ওঠেন, আমাকে একটা সিগারেট দিন, আমাকে একটা সিগারেট দিন।

তিনি আসন থেকে মেঝের ওপর প’ড়ে যেতে যেতে আসন জড়িয়ে ধরেন।

কামর আবদিন তাঁকে বলেন, করিম ভাই, আপনার হার্ট অ্যাটাক হয়েছিলো, আপনার সিগারেট খাওয়া ঠিক হবে না।

করিম আহমেদ বলেন, রাখুন। হার্ট অ্যাটাক, আমাকে একটা সিগারেট দিন, আমাকে একটা সিগারেট দিন।

হাসান উঠে গিয়ে তাকে একটি সিগারেট দেয়।

করিম আহমেদ সিগারেটটি ঠোঁটে রাখতে রাখতে একবার সিগারেটটি নিচে প’ড়ে যায়, তিনি সেটি খুঁজতে থাকেন।

হাসান সিগারেটটি তুলে তার হাতে দেয়।

তিনি বলেন, আগুন দিন, আগুন দিন।

হাসান আগুন জ্বালাতে জ্বালাতে দেখে করিম আহমেদের কোলে একটা ছােটাে অদ্ভুত বোতল, বোতলটা পিছলে পড়ে যাচ্ছে।

হাসান বোতলাটা তুলে বলে, এটা কী?

করিম আহমেদ চিৎকার করে বলে, এটা সিভাস রিগাল, এটা সিভাস রিগাল, এটা আমার জন্যে, আমি এটা ছাড়া খেতে পারি না।

রাকিব সুলতান এসে বোতলটি ছিনিয়ে নেয়। হাসানের হাত থেকে, চিৎকার ক’রে বলে, কবিরা খাইবো ব্ল্যাক লেবেল, আর সিভাস রিগাল খাইবো একটা থার্ড ক্লাস নভেলিস্ট, এইটা হইতে পারে না।

করিম আহমেদ হাহাকার ক’রে ওঠেন, আমার সিভাস রিগাল, আমার সিভাস রিগােল; সিভাস রিগাল ছাড়া আমি খেতে পারি না।

আলাউদ্দিন ঢুলতে ঢুলতে বলে, দ্যাখো শালা নভেলিস্টরা কিৎনা ছােটােলোক, ঘরে ঢুইকাই সিভাস রিগালের বোতলটা নিজের প্যাটের ভিতর ঢুকাইয়া রাখছে। কবিরা যদি ব্ল্যাক লেবেল টানে তাইলে নভেলিস্টগো টাননের কথা মেথরপট্টির কেরু, ব্যাটারি ভিজাইন্যা অ্যাসিড।

রাকিব সুলতান ঢকঢক ক’রে বোতল থেকেই গলায় ঢালতে থাকে সিভাস রিগাল, এবং টলতে টলতে মেঝের ওপর বসে পড়ে।

করিম আহমেদ কেঁপে কেঁপে বলেন, হাসান সাহেব, আরেকটা সিগারেট দিন।

হাসান বলে, আপনার আর সিগারেট খাওয়া ঠিক হবে না।

করিম আহমেদ রেগে ওঠেন, ধমক দিয়ে বলেন, আরে হাসান সাহেব, আপনি তো খুবই কৃপণ লোক, একটা সিগারেট, তাও দিতে চাচ্ছেন না।

শাহেদ আলতাফ অনেকক্ষণ চুপচাপ পান করছিলো, অল্প অল্প ঢুলে পড়ছিলো, এক সময় সব কিছু তার অসহ্য মনে হয়; সে ব’লে ওঠে, শালা এই গাইয়া কবিয়ালগো সাথে পান করতে আসার থিকা মেথরপট্টিই ফার বেটার, শালারা কবিতাও ল্যাখতে জানে না পান ও করতে জানে না। আমি এখনই বেরিয়ে বাদামতলি চ’লে যাবো, সেইখানে গোলাপির সাথে মদ খাবো।

শাহেদ আলতাফ একবার উঠতে গিয়ে ব’সে পড়ে; বিড়বিড় করতে থাকে, গোলাপি গোলাপি, পেতে দে তোর পবিত্ৰ দেহখানা।

পান করতে বেশ লাগছে হাসানের, বেশ লাগছে তার এই পরিবেশ। কবি, এখানে পান করছে কবিরা, যারা এই শহরের রাষ্ট্রের কেউ নয়, যারা নির্বাসিত এই শহর রাষ্ট্র বন্দুক কামান থেকে,–হাসানের মনে হ’তে থাকে–, কিন্তু তারাই এই সময়। আজ সন্ধ্যার আজ রাতের এই অসামান্য সময়টুকুই শুধু স্মরণীয় শুধু উল্লেখযোগ্য সারা শহরের আজকের ইতিহাসে, আর কিছু স্মরণীয় নয় উল্লেখযোগ্য নয়। কয়েক দিন আগে সে একটা ঝকঝকে উচ্চ আমলার চকচকে বাসায় পান করতে গিয়েছিলো, চারজনকে বসতে হয়েছিলো পৃথিবীর চার প্রান্তে, এবং তারা কেউ কথা বলছিলো না, যে যার পাত্র নিয়ে অল্প অল্প খাচ্ছিলো, হয়তো তারা ফাইল ঘাটছিলো, উন্নতি মাপছিলো, টাকা হিশেবে করছিলো, সভ্যতা বজায় রাখছিলো, আর হাসানের মনে হচ্ছিলো সে একটা গোয়ালঘরে বসে সাত দিনের বাসি পান্তাভাত লবণ ছাড়া খাচ্ছে। বারবার সে নিজেকে বলছিলো, হাসান, দ্যাখো, প্রতিভাহীনতা কাকে বলে, ভালো ক’রে দেখে নাও, সাফল্য হচ্ছে এই রকম, চুপচাপ, অতিশয় সভ্য, চারপ্রান্তে, নীরবে নিঃশব্দে পান্তাভাত। একটু পরেই সে বেরিয়ে এসেছিলো, ঠিক করেছিলো ওই সাফল্যের পান্তাভাতে সে আর যাবে না।

পান করতে তার বেশ লাগছে, সব কিছু সুন্দর মনে হচ্ছে, কয়েক দিন আগে যেরঙিন ট্রাকটি তাকে চাপা দিতে দিতে স’রে গিয়েছিলো, সেটির মুখ সে দেখতে পাচ্ছে–সুন্দর বিষন্ন পবিত্র মুখ, সেটির গলা জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করছে, এবং তার ভেতর থেকে দু-তিনটি কবিতা না পাখি না কী যেনো গড়িয়ে গড়িয়ে বেরোতে চাচ্ছে, কয়েকটি চিত্রকল্প কোপে কেঁপে বারবার হানা দিচ্ছে, কয়েকটি শব্দ প্রজাপতির মতো উড়ছে ঘুরছে উড়ছে বসছে কাঁপছে নাচছে; একটু একটু ঘোলাটে বোধ করছে সে নিজেকে, এক অসম্ভব সরলতা তার ভেতরটাকে কোনোদিন না-দেখা দিঘির জলের মতো দোলাচ্ছে। সে বিষগ্ন হয়ে উঠছে তাদের পুকুরের পাড়ের নিঃসঙ্গ হিজল গাছটির ছায়ার মতো। হিজল, তুমি আমার থেকে পাঁচ বছর দূরে আছাে আমি আছি তোমার থেকে, কেমন আছো, তুমি? কী রকম ব্যথিত সুদূর নক্ষত্রের মতো মনে হচ্ছে সবাইকে, কী যেনো তারা জয় করতে চাচ্ছে যা তারা কখনো জয় করতে পারবে না, তারা চিরপরাভূত থেকে যাবে। আমি এই চিরপরাজিতদের একজন, আমি এই চিরপরাজিতদের একজন হ’তে চাই, যেমন পরাজিত রবীন্দ্রনাথ, যেমন পরাভূত সুধীন্দ্রনাথ জীবনানন্দ বুদ্ধদেব, যেমন পরাভূত বদলেয়ার র‍্যাঁবো মালার্মে ইয়েট্‌স্‌, এবং আরো অজস্র মত্ত উন্মত্ত উদ্ধাস্তু।

হাসান নিজের পাত্রটিকে ভ’রে নেয়ার জন্যে উঠে দাঁড়ায়, একটুকু কাঁপে, মধুর কম্পনটুকু সে উপভোগ করে, সে নির্ভার হচ্ছে, মধ্যরাতে হয়তো কোনো খ’সে পড়া গাছের পাশ দিয়ে গড়িয়ে যাবে ছোট্ট কোনো পুকুরের দিকে।

 

সে দেখে আলাউদ্দিন নদীর পাড়ে একটি বিশাল নৌকোর মতো কাৎ হয়ে আছে, মেঝের ওপর শাশ্বত বিকলাঙ্গ ভিখিরির মতো প’ড়ে আছে রাকিব সুলতান, চুপচাপ পান করছে কামর আবদিন, করিম আহমেদ, শাহেদ আলতাফ, হয়তো তারা অন্য কোনো নক্ষত্রে আছে যার নাম তারা জানে না; সালেহ ফরিদউদ্দিন তার প্রুফগুচ্ছ জড়িয়ে ধ’রে কাঁদছে।

মরিয়ম এসে তার পাত্রটি ভ’রে দেয়, একগুচ্ছ মেঘ তার আঙুলে লাগে।

মরিয়মকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করছে, ওর চুলের ভেতর একরাশ আঙুল প্রবাহিত ক’রে দিতে ইচ্ছে করছে, ওর শাড়ির ভেতর দিয়ে একটা কোমল নরম সাপের মতো এঁকেবেঁকে ওপরের দিকে উঠে বিড়া পাঁকিয়ে ঘুমিয়ে পড়তে ইচ্ছে করছে, ওর বুকে একটা ছোটো পাখি হয়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছে।

মরিয়ম বলে, কবিদের মদ খাওয়া খুব সুন্দর, দেখতে আমার ভাল লাগে।

ঝলক দিয়ে উঠছে মরিয়ম।

মরিয়মের পায়ের তালু দুটি কেমন? সেখানে ওষ্ঠ ছোঁয়াতে ইচ্ছে করছে; ও কি শোয় আলাউদিনের সাথে, তা শোক, ওর ঠোঁটে হুইস্কি হয়ে লেগে থাকতে ইচ্ছে করছে, ওর গ্ৰীবায় একটা লাল তিল হয়ে থাকতে ইচ্ছে করছে; ওকে একটি কবিতার পংক্তি ক’রে চিরকালের জন্যে অমরতা দিতে ইচ্ছে করছে।

হাসান বলে, কবিরা ব্যর্থ, ব্যর্থতা সব সময়ই সুন্দর।

মরিয়ম বলে, আমার কাছে আপনে সুন্দর।

হাসান মরিয়মের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকে, ওর মুখে একটা উজ্জ্বল শহর দেখতে পায়, যেখানে জুলছে অজস্র নিদ্ৰাতুর বাতি।

হাসান সালেহ ফরিদউদ্দিনের দিকে এগিয়ে যায়, একটু কাঁপছে সে, সালেহের কান্না আরো বেড়ে গেছে।

হাসান জিজ্ঞেস করে, কাঁদছো কেনো সালেহ?

সালেহ বলে, আমার এই কবিতাগুলো অমর হবে না, এগুলো জীবনানন্দের কবিতার মতো হবে না।

সালেহ কাঁদতে থাকে; আজ রাতে অনন্তের কানে সে তার কান্না পৌঁছে দিতে চায়, হাসানের মনে হয় সে নতুন কবিতার কান্না শুনছে।

তার ভেতরেও কেঁদে চলছে তার কবিতাগুলো।

রাকিব সুলতান মেঝে থেকে হুহু ক’রে কাদতে কাঁদতে উঠে বসে, হাসানকে দেখতে পেয়ে সে উচ্চকণ্ঠে কাঁদতে কাঁদতে হাসানের পা জড়িয়ে ধরে।

রাকিব সুলতানের কান্নার শব্দে সবাই যেনো অবলুপ্ত অতলতা থেকে এক অপরিচিত অস্বস্তিকর বাস্তবতায় জেগে ওঠে।

হাসানের পা জোরে জড়িয়ে ধ’রে চুমো খেতে থাকে রাকিব, এবং কাঁদতে থাকে যেনো এইমাত্র তার সবচেয়ে প্রিয়জনের মৃত্যু হয়েছে, আর বলতে থাকে, আমারে মাফ কইর‍্যা দেও, দোস্ত, মাফ কইর‍্যা দেও, বাঙলা কবিতা, মাফ কইর‍্যা দেও, চণ্ডীদাস, মাফ কইর‍্যা দেও, মুকুন্দরাম, আমি বড়ো পাপী, আমি নদীর কাছে পাপ করছি, নারীর কাছে পাপ করছি, ম্যাঘের কাছে পাপ করছি, অক্ষরবৃত্তের কাছে পাপ করছি, পাখির কাছে পাপ করছি, আমারে মাফ কইর‍্যা দেও।

হাসান তাকে টেনে তুলতে তুলতে বলে, তুমি কী করছো, কী করছো রাকিব, ওঠো, তুমি কোনো পাপ করো নি, পাপ আমরা সবাই করেছি, তুমি কোনো পাপ করো নি, কবিরা সবাই পাপী।

রাকিব সুলতান পাপের ভারি বোঝা মাথায় নিয়ে পা থেকে পায়ে ছুটতে থাকে। পাপের ভারে সে হাঁটতে পারছে না, কাঁপছে, প’ড়ে যাচ্ছে, কিন্তু সে ছুটছে; সব মানুষের পাপ থেকে মুক্ত হয়ে পবিত্র হয়ে উঠতে হবে তাকে।

সে ঢুলতে ঢুলতে গিয়ে জড়িয়ে ধ’রে কামর আবদিনের পা।

কামর আবদিন ভয় পেয়ে লাফিয়ে ওঠেন, এমন বর্বর তিনি আগে দেখেন নি, তার হাতের পাত্রটি দূরে ছিটকে পরে হাহাকার করতে থাকে, পারলে তিনি দৌড়ে বেরিয়ে যেতেন। পৃথিবী থেকে। বেরোতে না পেরে তিনি কাঁপতে থাকেন।

রাকিব সুলতান কামর আবদিনের পা জড়িয়ে ধ’রে চুমো খেতে খেতে কাঁদতে কাঁদতে বলতে থাকে, আমারে মাফ কইর‍্যা দেও, ভাই, তুমি আমার অগ্রজ, তুমি আমার বাবা, তুমি আমার পিতামহ, তোমার কাছে আমার পাপের শ্যাষ নাই, তুমি হইলা আমাগো রবীন্দ্রনাথ, আমাগো জীবনানন্দ, আমাগো এলিঅট; তোমার কবিতা ছাড়া আর কোনো কবিতা নাই, আমারে মাফ কইর‍্যা দেও, তুমি ছাড়া আর কোনো মুসলমান কবিতা ল্যাখতে জানে না, তুমিই শুধু থাকবা, আমরা থাকুম না, আমারে মাফ কইর‍্যা দেও।

কামর আবদিন বুঝতে পারেন না। কী করবেন। তিনি রাকিব সুলতানকে জড়িয়ে ধ’রে বলতে থাকেন, এ আআআপনি কী কাককরছেন, এ আপনি কি বলছেন, আপনি আআমাদের বড়ো কবি হহবেন, আমার কবিতা কিছু না কিছু না, আপনার কবিতা পিউউর ককবিতা, আমি আজো শুদ্ধ কবিতা লিলিলিখতে পারি নি।

রাকিব সুলতান কামর আবদিনের পা ছেড়ে গিয়ে লুটিয়ে পড়ে করিম আহমেদের।

করিম আহমেদ বলেন, এ কি অসভ্যতা, এ কি গ্ৰাম্যতা, এ কি ভালগারিটি।

রাকিব কাঁদতে কাঁদতে বলে, আমারে মাফ কইর‍্যা দেও, ভাই, তোমার কাছে আমি অনেক পাপ করছি, তুমি হইলা আমাগো হেমিংওয়ে, আমাগো টমাস মান, আমাগো জেমস জয়েস, আমাগো লরেন্স; আমারে তুমি মাফ কইর‍্যা দেও। কবতে কিছু না, বেশ্যার দালালও কবতে ল্যাখতে পারে, নভেল ল্যাখ্যার জিইন্যে দরকার জিনিয়াস। তুমি আমাগো জিনিয়াস।

রাকিব সুলতান তাঁর পা ছেড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্যে পথ খুঁজতে থাকে, পথ খুঁজে পায় না; সে কাঁদতে থাকে, হাজেরারে, তার কাছে আমি পাপ করছি, তর বুকের কাছে আমি পাপ করছি, তার ঠোঁটের কাছে আমি পাপ করছি, তার শাড়ির কাছে আমি পাপ করছি, আমারে তুই মাফ কইর‍্যা দে।

হুহু ক’রে কাঁদতে থাকে রাকিব সুলতান।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *