০৬. লৈঙ্গিক রাজনীতি

লৈঙ্গিক রাজনীতি

নারীপুরুষের অন্তরঙ্গতম সম্পর্ক হচ্ছে সঙ্গম, যাতে একজনের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে আরেকজন। সব কিছুই রাজনীতি ব’লে যাঁরা মনে করেন, তাঁরাও মাংসের ভেতরে মাংসের অনুপ্রবেশকে রাজনীতি ব’লে মনে করেন না। সঙ্গমক্রিয়াকে দ্য বোভোয়ার (১৯৪, ৫৩-৫৪) বৰ্ণনা করেছেন এভাবে : নারী যখন ইচ্ছুকও হয়, তখনো পুরুষই নারীকে অধিকার করে, নারী অধিকৃত হয়। এটা হয় আক্ষরিকার্থেই, বিশেষ কোনো প্রত্যঙ্গের সাহায্যে বা বলপ্রয়োগে পুরুষ নারীকে কাবু করে, তাকে ঠিকমতো আটকে ধরে; পুরুষই সম্পন্ন করে সঙ্গমের প্রয়োজনীয় অঙ্গসঞ্চালন। পতঙ্গ, পাখি, ও স্তন্যপায়ীদের মাঝে পুরুষ বিদ্ধ করে নারীকে। বিদ্ধকরণের ফলে নারীর অভ্যন্তরতা ধর্ষিত হয়। পুরুষের আধিপত্য প্রকাশ পায় সঙ্গমের আসনেই;– অধিকাংশ প্রাণীর ক্ষেত্রেই পুরুষ থাকে নারীর ওপরে। পুরুষ যে-প্রত্যঙ্গটি ব্যবহার করে সেটি একটি বস্তু, তবে উত্তেজিত অবস্থায় সেটি হয়ে ওঠে হাতিয়ার, কিন্তু নারীর প্রত্যঙ্গটি থাকে এক নিষ্ক্রিয় আধার। বোভোয়ারের বর্ণনায় সঙ্গম হয়ে উঠেছে একধরনের সমর। কিন্তু বোভোয়ার একে যুদ্ধ বলেন নি, বা নারীপুরুষের অন্তরঙ্গতম সম্পর্কের প্রকৃতি বোঝানোর জন্যে ব্যবহার করেন নি এর চেয়েও ভয়ানক শব্দটি- রাজনীতি। কিন্তু সঙ্গমও একধরনের রাজনীতি, তাতে শক্তির আধিপত্য ও অধীনতার সম্পর্ক অত্যন্ত স্পষ্ট। সঙ্গম থেকে নারীপুরুষের সমস্ত সম্পর্ককে একটি তাত্ত্বিক কাঠামোতে ব্যাখ্যা করেছেন কেইট মিলেট তাঁর সেক্সুয়াল পলিটিক্স (১৯৬৯) বা লৈঙ্গিক রাজনীতি গ্রন্থে। দ্য বোভোয়ার দ্বিতীয় লিঙ্গ (১৯৪৯) গ্রন্থে অস্তিত্ববাদী দৃষ্টিকোণ থেকে উপস্থাপন করেছেন নারীকে, বিশ্বাসও করেছেন তিনি সমাজতন্ত্রে, আশা করেছেন সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন হ’লে নারী তাঁর স্বাধিকার পাবে। পরে হতাশ হয়েছেন, দেখেছেন সমাজতন্ত্রও পুরুষতন্ত্র। বোভোয়াবের বইয়ের ঠিক দু-দশক পরে বেরোয় কেইট মিলেটের লৈঙ্গিক রাজনীতি, যেটি সম্ভবত সব সময়ের সবচেয়ে সাহসী, এবং একমাত্র বেস্টসেলার, পিএইচডি অভিসন্দর্ভ। মিলেট সাহিত্য-সমাজ-সভ্যতা ঘেঁটে দেখিয়েছেন যে নারীপুরুষের অন্তরঙ্গতম সম্পর্ক থেকে চরম বাহ্যিক সম্পর্ক হচ্ছে শক্তির সম্পর্ক, যার নাম তিনি দিয়েছেন লৈঙ্গিক রাজনীতি। কেইট মিলেট তীব্র, তীক্ষু, প্রখর ও প্রচণ্ড; এবং বিস্ময়করভাবে মননশীল।

শুরুতেই মিলেট হেনরি মিলারের সেক্সাস, নরম্যান মেইলারের অ্যান আমেরিকান ড্রিম, জাঁ জোনের দি থিফ্‌স্‌ জর্নাল ও আওয়া্র লেডি অফ দি ফ্লাওয়ার্স থেকে নারীপুরুষের অন্তরঙ্গতম সম্পর্ক সঙ্গমে লৈঙ্গিক রাজনীতির পরিচয় দিয়েছেন; দেখিয়েছেন সঙ্গমেও সক্রিয় থাকে আধিপত্য ও ক্ষমতা (বা শক্তি)। এটা শুধু জৈব ও শারীরিক ক্রিয়া নয়, ব্যক্তিগত পর্যায়ে সঙ্গম হচ্ছে লৈঙ্গিক রাজনীতি। প্রশ্ন উঠবে। সঙ্গমের মতো অন্তরঙ্গ মিলনকে এবং নারীপুরুষের সম্পর্ককে রাজনীতির সীমার মধ্যে আনা যায় কিনা? এটা নির্ভর করে ‘রাজনীতি’ বলতে কী বুঝি আমরা, তার ওপর। রাজনীতি বলতে মিলেট বুঝিয়েছেন ক্ষমতাসংগঠন বা বিন্যাসকে, যার সাহায্যে একদল মানুষ নিয়ন্ত্রণ করে আরেক দল মানুষকে। শুধু এ-রাজনীতি ধারণার সাহায্যেই বোঝা সম্ভব নারীপুরুষের ঐতিহাসিক ও বর্তমান অবস্থান বা মৰ্যাদা। ‘রাজনীতি’ বিশ্বের সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত শব্দ, তবে নারীপুরুষের সম্পর্কের ক্ষেত্রে এর প্রয়োগ আপত্তিকর বা অশ্লীল মনে হতে পারে অনেকের কাছে; কিন্তু দুঃখজনক হচ্ছে যে অশ্লীল এখন সত্য আর সত্য এখন অশ্লীল! আগে জন্মসূত্রেই একদল আধিপত্য করতো আরেক দলের ওপর, এখন করে না; কিন্তু এখনো, পুরোনো কাল থেকেই, চলছে জন্মাধিকারবশতই মানুষের একদলের ওপর আরেক দলের আধিপত্য; সেটা লিঙ্গের, নারীপুরুষের, এলাকায়। এখন, ও ঐতিহাসিকভাবে, নারীপুরুষের সম্পর্ক হচ্ছে আধিপত্য ও অধীনতার। পৃথিবী জুড়েই চলছে, কিন্তু চোখে পড়ে না বা স্বীকার করা হয় না যে জন্মাধিকার বলেই পুরুষেরা শাসন করছে নারীদের। এ-পদ্ধতিতে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। চমৎকার একধরনের ‘আভ্যন্তর ঔপনিবেশিকতা’। এর কারণ হচ্ছে সমস্ত পুরোনো ও আমাদের ‘সভ্যতা’ পিতৃতান্ত্রিক। এটা এতো স্পষ্ট যে চোখে পড়ে না : সামরিক, শিল্পকারখানা, বিশ্ববিদ্যালয়, বিজ্ঞান, রাজনীতিক কাৰ্যালয়, পুলিশ,-সমাজের ক্ষমতার সমস্ত এলাকাই পুরুষের হাতে। রাজনীতির মূলকথা হচ্ছে ক্ষমতা। ওই ক্ষমতা পুরুষের নিয়ন্ত্রণে; আর অলৌকিক ঈশ্বর, রাষ্ট্রপতি ও তার মন্ত্রণালয়, সমস্ত নীতি ও মূল্যবোধ, দর্শন ও শিল্পকলা সবই পুরুষের তৈরি। পিতৃতন্ত্রের বড়ো ষড়যন্ত্র হচ্ছে যে পুরুষ আধিপত্য করবে নারীর ওপর। আবহমান কাল ধ’রে পথিবী জুড়ে এটা চলছে। পিতৃতন্ত্র নারীর ওপর আধিপত্য করার জন্যে গ্ৰহণ করেছে সার্বিক পরিকল্পনা। মিলেট (১৯৬৯, ২৬-৫৮) সেগুলোকে ভাগ করেছেন : [এক] ভাবাদর্শগত, [দুই] জৈবিক, [তিন] সমাজতাত্ত্বিক [চার] শ্রেণী, [পাঁচ] আর্থ ও শিক্ষাগত, [ছয়] বলপ্রয়োগ, [সাত] নৃতাত্ত্বিক : পুরাণ ও ধর্ম, ও [আট] মনস্তাত্ত্বিক ভাগে। এগুলোর সংক্ষিপ্ত পরিচয় নিলে বোঝা যাবে পিতৃতন্ত্রের পুরুষাধিপত্যের ক্রূর পরিকল্পনা কতো ব্যাপক।

[এক] ভাবাদর্শ

কোনো সরকার ক্ষমতায় আসে দু-উপায়ে; সকলের সম্মতিতে, বা বলপ্রয়োগে। মানুষকে কোনো একটি ভাবাদর্শে দীক্ষিত করতে পারলে তাদের সম্মতি পাওয়া সহজ হয়ে ওঠে। লৈঙ্গিক রাজনীতি পুরুষ-নারী দু-লিঙ্গেরই সম্মতি আদায় করে সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। পিতৃতন্ত্র পুরুষ ও নারীর জন্যে যে-মেজাজ, ভূমিকা, ও অবস্থান স্থির করে, সামাজিকীকরণের ফলে তা মেনে নেয় তারা। পুরুষই শ্রেষ্ঠ, এমন একটি কুসংস্কার বদ্ধমূল ক’রে তোলে পুরুষতন্ত্র, তাই অবস্থানগতভাবে পুরুষ পায় উচ্চ মর্যাদা, নারী পায় নিম্ন মর্যাদা। পুরুষ তা মেনে নেয় ও ভোগ করে তার জন্ম-অধিকার ব’লে, আর নারীও তা বিশ্বাস ও স্বীকার করে। মেজাজ গড়ে তোলে মানুষের ব্যক্তিত্ব। পুরুষতন্ত্র আপন স্বার্থে লিঙ্গ-অনুসারে পরিকল্পিত বিশেষ ছকে বেঁধে দিয়েছে নারীপুরুষের ব্যক্তিত্বকে; স্থির হয়ে গেছে যে পুরুষ হবে আক্রমণাত্মক, বুদ্ধিমান, বলশালী, ফলপ্ৰদ, আর নারী হবে নিষ্ক্রিয়, মূর্খ, বশমানা, সতী ও অপদার্থ। এর প্রকাশ দেখা যায় নারীপুরুষের লৈঙ্গিক ভূমিকায়। পিতৃতন্ত্র তাদের জন্যে তৈরি করেছে বিশদ বিধিমালা, স্থির করে দিয়েছে কীভাবে আচরণ করবে নারীপুরুষ : কেমন অঙ্গভঙ্গি করবে, ও পোষণ করবে কী প্রবণতা। স্থির করে দিয়েছে যে নারী দেখবে ঘরসংসার, পালন করবে সন্তান; আর পুরুষ অর্জন করবে অন্যান্য সাফল্য। এতে নারী রয়ে গেছে পশুর স্তরেই, পশুরাও সন্তান লালনপালন করে; আর পুরুষ উন্নীত হয়েছে মানুষের স্তরে;–যে-সব কাজ বিশেষভাবেই মানবিক, তার সবই রাখা হয়েছে পুরুষের জন্যে। পুরুষকে দেয়া হয়েছে উচ্চ অবস্থান, যা তাকে করেছে প্ৰভু আর তার ভূমিকা যেহেতু প্রভুর, তাই তার মেজাজও হয়ে উঠেছে পুভুর অর্থাৎ আধিপত্যবাদী। নারীর ভূমিকা দাসীর, তাই তার মেজাজও অধীনস্থের। পুরুষের চোখে নারীর ভূমিকা চারটি : মাতা, কন্যা, বধু; এ-তিনটির কোনোটি না হ’লে নারী হয় উর্বশী অর্থাৎ পতিতা। শুধু নারীরূপে নারী কোনো মর্যাদা পায় না।

[দুই] জৈবিক

পিতৃতান্ত্রিক ধর্ম, সাধারণ বিশ্বাস, এবং অনেকাংশে বিজ্ঞানও, মনে করে যে নারীপুরুষের সামাজিক-মনস্তাত্ত্বিক পার্থক্যের মূলে রয়েছে তাদের শারীরিক পার্থক্য। সংস্কৃতি যে মানুষের স্বভাবকে নিয়ন্ত্রণ করে, তা গোপন ক’রে পুরুষতন্ত্র প্রচার যে সংস্কৃতি বিকাশ ঘটায় স্বভাবের। এমন ধারণা তৈরি করা হয়ে গেছে যে পৌরুষ ও নারীত্ব সহজাত; কিন্তু নারীপুরুষের নারীত্ব ও পৌরুষ কোনো সহজাত ব্যাপার নয়, তাদের অবস্থান ও মর্যাদা পুরোপুরি অস্বাভাবিক। পুরুষের শরীর পেশল হয, এটা অনেকটা জৈবিকা; তবে সাংস্কৃতিকভাবেই খাদ্য, ব্যায়াম প্রভৃতির সাহায্যে নিজের পেশি গঠনে উৎসাহ দেয়া হয় পুরুষকে। যদি ধ’রেও নেয়া হয় যে পেশিতে পুরুষেবা অধিকার জন্মগত, তবু পেশি কোনো রাজনীতিক অধিকারের ভিত্তি হতে পারে না। পুরুষাধিপত্য পেশিশক্তির ওপর নির্ভরশীল নয়; নির্ভরশীল কিছু অজৈবিক মূল্যবোধের ওপর। আধুনিক কালে পেশির মূল্য বেশ ক’মে গেছে। চিরকাল পেশির ওপর নির্ভর করেছে গরিবেরা, তাদের পেশিতে শক্তি না থাকলেও। পিতৃতন্ত্র শরীরের ওপর দেয় বিশেষ গুরুত্ব; আর পিতৃতন্ত্রের প্রবক্তারা মনে করেন মানুষের শারীরিক কারণেই পিতৃতন্ত্রের উদ্ভব ছিলো অনিবার্য। তবে এটা মনে করার যুক্তিসঙ্গত কারণ রয়েছে যে মানবসমাজের শুরুতেই পিতৃতন্ত্রের উদ্ভব ঘটে নি; এর আগে ছিলো প্রাকপিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা, যাতে নারীরই গুরুত্ব ছিলো বেশি; কারণ নারী সন্তান জন্ম দেয়। প্রথমে জন্ম দেয়ার ব্যাপারটিই ছিলো বড়ো; কিন্তু পরে পিতৃত্বের ব্যাপারটি বড়ো হয়ে উঠলে সমাজ পিতৃতন্ত্রের দিকে বাঁক নেয়। সন্তান জন্মদানে নারীর ভূমিকাকে গৌণ ক’রে সন্তান উৎপাদনের গৌরব দেয়া হয় শুধু পুরুষলিঙ্গকে। পিতৃতান্ত্রিক ধর্ম পিতৃতন্ত্রকে সুগঠিত করে পুরুষ ঈশ্বর বা দেবতা সৃষ্টি ক’রে; এ-ধর্ম বিতাড়িত বা বিচ্যুত করে আগের দেবীদের। পিতৃতান্ত্রিক ধর্মশাস্ত্র পুরোপুরি পুরুষাধিপত্যবাদী; এর মূল দায়িত্বই হচ্ছে পিতৃতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠিত ও রক্ষা করা। ভূমিকা, মেজাজ, ও বিশেষ করে অবস্থানের ক্ষেত্রে পুরুষের আধিপত্যের মূলে কোনো জৈব কারণ নেই, রয়েছে সাংস্কৃতিক কারণ। কিন্তু যুগেযুগে বহু পুরুষ প্রমাণ করার চেষ্টা করেছে যে জৈব কারণেই পুরুষ শ্ৰেষ্ঠ। অনেক চতুর পুরুষ আবার শ্ৰেষ্ঠ-নিকৃষ্ট তত্ত্বের বদলে পেশ করে পার্থক্যতত্ত্ব। যেমন, বাকলে নামক এক পুরুষ প্ৰবন্ধ লিখেছেন ‘বিজ্ঞানের ওপর নারীর প্রভাব’ নামে। তিনি প্রকাশ্যে পুরুষাধিপত্যবাদী নন, তাই তিনি পুরুষকে উৎকৃষ্ট নারীকে নিকৃষ্ট না বলে বৈজ্ঞানিকভাবে দেখিয়েছেন যে নারীপুরুষ একে অন্যের থেকে উৎকৃষ্ট-নিকৃষ্ট নয়, তারা ‘পৃথক’! তিনি নারীর মন কেটেছেটে দেখিয়েছেন যে নারীর পক্ষে পুরুষের আর পুরুষের পক্ষে নারীর সমস্ত যোগ্যতা আয়ত্ত করা অসম্ভব। তিনি প্রমাণ করেন যে প্রকৃতি নারীকে করেছে বোধিবাদী আর পুরুষকে উপাত্তবাদী বা অভিজ্ঞতাবাদী। প্রকৃতি নারীকে দিয়েছে বোধি আর পুরুষকে বুদ্ধি; তাই নারী যদিও পুরুষের মতো স্পষ্ট ক’রে কিছুই দেখতে-বুঝতে পারে না, তবে নারী অনুভব করে খুব তাড়াতাড়ি [দ্র ব্লক (১৯৫৮, ৫৮)]! কিন্তু পুরুষের জগতে অনুভবের কোনো মূল্য নেই, সব মূল্য দেখার আর বোঝার!

পুরুষনারীর মধ্যে যদি থাকে কোনো সহজাত অসাম্য, তা প্রমাণ করার উপায় হচ্ছে তাদের সমান সুযোগসুবিধা দেয়া ও দেখা কোথায় রয়েছে কোন লিঙ্গের সহজাত অপকর্ষ। এমন পরিবেশ এখন কোথাও নেই। এখন নারীপুরুষের স্বভাব নিয়ে যে-সব গবেষণা হচ্ছে, তাতে দেখা যায় মেয়েলি-পুরুষালি হিশেবে যা-কিছুকে শাশ্বত ব’লে ধ’রে নেয়া হয়েছে, সে-সব আসলে সাংস্কৃতিক। বাঙলায় একটিই শব্দ আছে: লিঙ্গ, ইংরেজিতে আছে দুটি : সেক্স, ও জেন্ডার। সাম্প্রতিক লিঙ্গবিশেষজ্ঞরা, যেমন কালিফোর্নিয়া লিঙ্গশনাক্তি কেন্দ্রের রবার্ট জে স্টোলার, নির্দেশ করেছেন ‘সেক্স’ ও ‘জেন্ডার’-এর পার্থক্য। ‘সেক্স’ জৈব, আর ‘জেন্ডার’ মনস্তাত্ত্বিক, অর্থাৎ সাংস্কৃতিক। ‘পুরুষ’, ‘নারী’ বললে বোঝায় জৈবলিঙ্গ [সেক্স], আর ‘পুরুষালি’, ‘মেয়েলি’, ‘পুরুষসুলভ’, ‘নারীসুলভ’ বোঝায় সাংস্কৃতিক লিঙ্গ জেন্ডার। সাংস্কৃতিক লিঙ্গ ও জৈবলিঙ্গ অবিচ্ছেদ্য নয়; পুরুষ হতে পারে মেয়েলি, নারী হতে পারে পুরুষালি। স্টোলার বলেছেন, ‘বাহ্যিক জননেন্দ্ৰিয়গুলো (শিশ্ন, অণ্ডকোষ, মুষ্ক) যদিও সাহায্য করে পৌরুষবোধে, তবে এর জন্যে কোনোটিই প্রয়োজনীয় নয়, সবগুলোর একত্রে প্রয়োজন তো নেই-ই।… সাংস্কৃতিক লিঙ্গ নির্ধারিত হয় জন্মোত্তর বিভিন্ন শক্তির দ্বারা, বাহ্যিক জননেন্দ্ৰিয়গুলোর গঠন যাই-হোক-না কেনো’ [“দ্র মিলেট (১৯৬৯, ৩০)]। এখন তো মনে করাই হয় যে মানবভ্রূণ আদিতে থাকে নারী; গর্ভধারণের কিছু পরেই শুধু মাত্র একটি ওয়াই ক্রোমোসোমের ক্রিয়ায় ভ্রূণটি পুরুষে পরিণত হয়। নারীপুরুষ মেয়েলি বা পুরুষালি গুণ নিয়ে জন্ম নেয় না; জন্মের পরে সমাজসংস্কৃতির চাপে তারা অর্জন করে মনোলৈঙ্গিক ব্যক্তিত্ব।

জন্মের পরে মানুষকে আবার জন্ম দেয়া হয়; মানুষমাত্রই দ্বিজ। জন্মের পর থেকে শুরু হয় পুত্রকে পুরুষ আর কন্যাকে নারীরূপে দ্বিতীয় জন্ম দেয়া: এবং নারী ও পুরুষ হয়ে ওঠে দুই সংস্কৃতির অধিবাসী। তাদের জীবন, জগৎ অভিজ্ঞতা, স্বপ্ন হয় সম্পূর্ণ ভিন্ন। শৈশব থেকেই বাবা-মা, সমাজ-সংস্কৃতি-সভ্যতা শেখায় মেজাজ কেমন হবে তাদের; তারা হাসবে, দাঁড়াবে, বসবে কীভাবে; পালন করবে তারা কী ভূমিকা, আর কার হবে কী মর্যাদা বা অবস্থান। তাই নারী ও পুরুষ নারী ও পুরুষ হয়ে জন্ম নেয় না, সামাজিকীকরণপ্রক্রিয়ায় তাদের নারী ও পুরুষ ক’রে তোলা হয়। পিতৃতন্ত্রের জৈবিক ভিত্তি দুর্বল; তাই নারীকে নারী ও পুরুষকে পুরুষ ক’রে তোলার জন্যে চলে ধারাবাহিক সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়া। তাদের, শৈশব থেকেই, অভ্যস্ত ক’রে তোলা হয় নারী বা পুরুষের ভূমিকায়। প্রতিটি সংস্কৃতি চায় ছেলেরা হবে সক্রিয় বা আক্রমণাত্মক, আর মেয়েরা হবে নিষ্ক্রিয়, অন্তর্মুখি বা আত্মসমৰ্পণাত্মক; তাই ছেলেরা হয় মাস্তান আর মেয়েরা থাকে একটি রন্ধ নিয়ে বিব্রত। এটা যে সাংস্কৃতিক ব্যাপার, তা স্বীকার না ক’রে পিতৃতন্ত্ৰ মনে করে পুরুষের পৌরুষ বাস করে তার একটি ঝুলন্ত নির্বোধ প্রত্যঙ্গে ও তার নিচে থলের ভেতরের একজোড়া অণ্ডকোষে! আধুনিক সব সংস্কৃতিই ধ’রে নেয় সক্রিয়তা বা আক্রমণাত্মকতা হচ্ছে পৌরুষ, নিষ্ক্রিয়তা বা ভীরুতা হচ্ছে নারীত্ব। তবে মার্গারেট মিড তিনটি আদিম সমাজে লিঙ্গ ও মেজাজ (১৯৩৫), দক্ষিণ সমুদ্র থেকে (১৯৩৯), নর ও নারী (১৯৫৫) প্রভৃতি গ্রন্থে দেখিয়েছেন এটা সব সংস্কৃতির জন্যেও সত্য নয়। তিনি প্রশান্ত মহাসাগরীয় নারীপুরুষের প্রকৃতি সম্পর্কিত গবেষণায় দেখিয়েছেন নারীপুরুষের সক্রিয়তা/নিষ্ক্রিয়তা ধ্রুব বিশ্বজনীন ব্যাপার নয়। ওই এলাকার আরাপেশদের নারীপুরুষ উভয়ই ‘মেয়েলি’ ও ‘মাতৃসুলভ এবং নিক্রিয়; এর কারণ তাদের ছেলেবেলা থেকে শেখানো হয় একে অন্যকে সহায়তা করতে। আবার মুন্ডুণ্ডমরদের নারীপুরুষ উভয়ই প্ৰচণ্ড, আক্রমণাত্মক, ‘পুরুষালি’; এবং চামবুলিদের নারীরা আধিপত্যপরায়ণ, আর পুরুষেরা অধীনতাপরায়ণ [দ্র ফ্রাইডান (১৯৬৩, ১২০)]। তাই পুরুষের পৌরুষ আর নারীর নারীত্ব বা মেয়েলিপনা জৈবিক তো নয়ই, এমনকি সৰ্ব্বজনীনও নয়।

[তিন] সমাজতাত্ত্বিক

পিতৃতন্ত্র সৃষ্টি করেছে নানা রকম সংস্থা, তার মধ্যে প্রধান হচ্ছে পরিবার। সমাজ ও রাষ্ট্র নরনারীদেব সব সময় সরাসরি শাসন করতে পারে না, তাই পিতৃতন্ত্র পরিবারের সাহায্যে শাসন ও নিয়ন্ত্রণ করে প্রতিটি ব্যক্তিকে। তাদের বাধ্য করে পিতৃতন্ত্রের বিধি মেনে চলতে। পরিবার কাজ করে বৃহত্তর সমাজের প্রতিনিধিরূপে: পরিবার তার সদস্যদের খাপ খাওয়ায় পিতৃতন্ত্রের আদর্শের সাথে। পরিবার অনেকটা পিতৃতান্ত্রিক রাষ্টের ভেতরে রাষ্ট্র; আর পরিবার-রাষ্ট্রের পতি হচ্ছে পরিবারের প্রধান পুরুষটি। রাষ্ট্র পরিবারের প্রধান পুরুষটির মাধ্যমে শাসন করে নাগরিকদের। এ-শাসনের বিশেষ শিকার নারীরা। যে-সব পিতৃতান্ত্রিক সমাজে নারীদের আইনসঙ্গত নাগরিক অধিকারও দেয়া হয়েছে, সেখানেও দেখা যায় নারী শাসিত হয় পরিবারের দ্বারাই। রাষ্ট্রের সাথে সাধারণত নারীদের কোনো প্রত্যক্ষ সম্পর্ক থাকে না, বা থাকে খুবই সামান্য।

পিতৃতন্ত্রের তিনটি সংস্থা–পরিবার, সমাজ, ও রাষ্ট্র একে অন্যের সাথে গভীরভাবে জড়িত, ও পরস্পরনির্ভরশীল। টিকে থাকার জন্যে পিতৃতন্ত্র পরিবারের প্রধান পুরুষটিকেই দিয়েছে সমস্ত কর্তৃত্ব; এবং তা ধর্মীয় বিধানের সাহায্যে বিধিবদ্ধ করেছে। মনুসংহিতায় [৯:৩] বলা হয়েছে, ‘পিতা রক্ষতি কৌমারে, ভর্তা রক্ষতি যৌবনে। রক্ষন্তি স্থবিরে পুত্রা ন স্ত্রী স্বাতন্ত্রমর্হতি’ : কুমারীকালে পিতা, যৌবনে স্বামী ও বার্ধক্যে পুত্ররা রক্ষা করবে নারীকে; নারী স্বাধীনতার অযোগ্য। ইহুদিধর্মে পিতা পেয়ে থাকে পুরোহিতের অধিকার; বাইবেলে সদাপ্ৰভু নারীকে বলে, ‘সে তোমার উপরে কর্তৃত্ব করিবে [মানবজাতির পাপে পতন : আদিপুস্তক]; ক্যাথলিকদের বিধান হচ্ছে ‘পিতাই পরিবারের কর্তা’; কোরানে আছে : ‘পুরুষ নারীর কর্তা’ [৪:৩৪]; এবং হাদিসে পুরুষকে দ্বিতীয় বিধাতায় পরিণত করা হয়েছে : ‘যদি আমি অন্য কাউকে সিজদা করতে আদেশ দিতাম তাহলে নারীদেরই বলতাম তাদের স্বামীদের সিজদা করতে’ [ দ্র রফিক (১৯৭৯, ১৮১)]। আধুনিক সরকারগুলো মেনে চলে এসব বিধানই; সব ক্ষেত্রেই পুরুষকে গণ্য করে পরিবারের প্রধানরূপে।

পিতৃতন্ত্রে পিতা কুলপতি; তিনিই সব কিছুর মালিক। পিতা মালিক তার স্ত্রীর বা স্ত্রীদের, সন্তানদের; পিতার অধিকার রয়েছে স্ত্রী ও সন্তানদের প্রহারের, এমনকি বিক্রি ও হত্যার! পিতৃতন্ত্রে আত্মীয়তার ধারা পুরুষপরম্পরায় প্রবাহিত হয়; উত্তরাধিকার নির্ণয় করা হয় পুত্রপৌত্রাক্রমে। দুহিতা ও দৌহিত্রাক্রম এক সময় হয়ে পড়ে বিচ্ছিন্ন। গোত্ৰতা অনুসারে নারীপরম্পরার উত্তরাধিকারীরা সম্পত্তিব অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। পিতৃতান্ত্রিক পরিবারের ক্রিয়াকলাপ, রোমের পত্রিয়া পোতেসতেস অনুসারে, প্রথম নির্দেশ করেছিলেন হেনরি মেইন। তাঁর মতে পরিবারের মধ্যে জ্যেষ্ঠ পুরুষটি সার্বভৌম। তার আধিপত্য জীবন থেকে মৃত্যু পর্যন্ত প্রসারিত; আর ওই আধিপত্য তার সন্তানাদি, তাদের ঘরবাড়ি থেকে দাসদাসীর ওপর বিস্তৃত। আদিম পিতৃতান্ত্রিক পরিবারে জ্যেষ্ঠ পুরুষটির একনায়কত্বের অধীনে সবাই ও সব কিছু-স্ত্রী, সন্তান, জমিজমা, সজীব বা অজীব সম্পত্তি, দাসদাসী প্রভৃতি। মেইন অবশ্য মনে কবতেন যে পিতৃতান্ত্রিক পরিবার বিশ্বজনীন ব্যাপার, কিন্তু তা নয়। অনেকেই মনে করেন যে পিতৃতান্ত্রিক পরিবারের প্রতিষ্ঠা হয়েছে বেশ পরে, নারীদের অধিকার ধীরেধীরে হরণ করে। সাম্প্রতিক পিতৃতন্ত্রে পুরুষের আধিপত্য কিছুটা কমানো হয়ছে নারীদের কিছুটা অধিকার দিয়ে; যেমন দেয়া হয়েছে নারীদের বিবাহবিচ্ছেদের অধিকার, নাগরিকত্ব, সম্পত্তির মালিক হওয়ার অধিকার। তবে তারা এখনো স্বামীদের অস্থাবর সম্পত্তিই রয়ে গেছে। পিতৃতন্ত্র পরিবারকে দেয় একটি বড়ো দায়িত্ব, আর পরিবার সেটি পালন করে চমৎকারভাবে। পরিবারকে দেয়া হয় তার সন্তানসন্ততিদের সামাজিকীকরণের ভার। পরিবার পিতৃতন্ত্রের আদর্শানুসারে গড়ে তোলে পুত্র ও কন্যাদের, শিখিয়ে দেয়। তারা পালন করবে। কোন ভূমিকা, কার মেজাজ হবে কেমন, আর অবস্থান হবে কোথায়। রয়েছে পিতৃতন্ত্রের আরো নানা সংস্থা-বিদ্যালয়, পুরোহিত, প্রচারমাধ্যম, এবং কী নয়? প্রতিষ্ঠা করা হয় জীবনের সমস্ত এলাকায় পুরুষাধিপত্য, নারীকে করা হয় অধীন। পিতৃতন্ত্র নারীর সতীত্বের ও সন্তানের বৈধতার ওপর দিয়ে থাকে চরম গুরুত্ব; এর কারণও পুরুষাধিপত্য অক্ষুন্ন রাখা। এর সাহায্যে সন্তান ও মাতাকে সম্পূর্ণ নির্ভরশীল ক’রে তোলা হয় পুরুষের ওপর।

[চার] শ্রেণী

লিঙ্গের ক্ষেত্রে বর্ণ দুটি : ব্ৰাহ্মণ ও শূদ্র। পুরুষ ব্ৰাহ্মণ, নারী শূদ্র বা পুরুষ বুর্জোয়া, নারী প্রলেতারিয়েত। তবে লিঙ্গের এলাকায় শ্রেণী ব্যাপারটি ঢাকা থাকে ধুয়োজালে, তাই সত্য সহজে চোখে পড়ে না। যে-সমাজে মানুষের অবস্থান বা মর্যাদা নির্ভর করে সামাজিক, আর্থিক, শিক্ষাগত পরিস্থিতির ওপর, সেখানে কিছু নারী কিছু পুরুষের ওপরে মর্যাদা পায়; এ-কারণেই ঘোলাটে হয়ে ওঠে লিঙ্গগত শ্রেণীর ব্যাপারটি। একটি উদাহরণ দিই। হিন্দুসমাজের একজন শূদ্র চিকিৎসক বা আইনজীবী শিক্ষা ও অর্থের কারণে একজন ব্ৰাহ্মণ চাষীর থেকে বেশি গুরুত্ব পায়, কিন্তু ব্ৰাহ্মণটি বর্ণের কারণেই ভোগ করে বেশি মর্যাদা। নিম্নবর্ণের চিকিৎসক বা আইনজীবী অর্থ ও শিক্ষা দিয়েও ওই মর্যাদা আয়ত্ত করতে পারে না, বরং ভোগ করে মানসিক যন্ত্রণা। ঠিক তেমনই একটি শ্রমিক বা রিকশাআলা নিজের পৌরুষের জন্যেই উচ্চ শ্রেণীর নারীর থেকেও বেশি মর্যাদা পায় বা দাবি করে। তৈক্তিরীয় সংহিতায় আছে, ‘সর্বগুণান্বিতা নারীও অধমতম পুরুষের থেকে হীন।’ ইসলামে একজন পুরুষ দুজন নারীর সমান; ওই পুরুষটি যে-ই হোক, ওই দুই নারী যারাই হোক। কোরানে আছে : ‘তোমাদের পছন্দ মতো দুজন পুরুষকে সাক্ষী রাখবে, আর যদি দুজন পুরুষ না থাকে, তবে একজন পুরুষ ও দুজন স্ত্রীলোক’ [২ : ২৮২]; তাই একটি বিকলাঙ্গ ভিখিরিও একজন মহিলা রাষ্ট্রপতির দ্বিগুণ মৰ্যাদাসম্পন্ন। পাকিস্তানে একটি পুরুষ চোরকে শনাক্ত করতে দরকার হয় দুটি নারীপুলিশ! জনহীন কক্ষে নারী প্রধান মন্ত্রীও অসহায় হয়ে উঠতে পারে তার ভূত্যের কাছে; ভূত্য হয়ে উঠতে পারে প্রভু আর নারী প্রধান মন্ত্রী দাসী। যে-অঞ্চলে পিতৃতন্ত্র যতো উগ্র, সেখানে নারীর শ্ৰেণী-অবস্থান ততো নিচে ও ততো স্পষ্ট। পাশ্চাতো পিতৃতন্ত্র কিছুটা নমনীয় ব’লে সেখানে নারীর শ্রেণীগত অবস্থান ততোটা নিচে নয়, কিন্তু প্রাচ্যে উগ্র অনমনীয় পিতৃতন্ত্র নারীকে শূদ্র করে রেখেছে। হিন্দু আর মুসলমানদের একটি বড়ো অংশ উগ্ৰ পিতৃতন্ত্রের ধারক বলে এ-দু-সমাজে আজো নারীদের শ্রেণীগত অবস্থান অত্যন্ত নিচে।

পিতৃতন্ত্রের একটি সুন্দর ষড়যন্ত্র হচ্ছে নারীদের এক শ্রেণীকে লাগিয়ে রাখা আরেক শ্রেণীর বিরুদ্ধে; বেশ্যার বিরুদ্ধে লাগিয়ে রাখা সতীকে, কর্মজীবী নারীর বিরুদ্ধে লাগিয়ে রাখা গৃহিণীকে। একদল ঈর্ষা করে আরেক দলের সুখ স্বাচ্ছন্দ্য নিরাপত্তাকে; আবার আরেক দল নিরাপত্তা মৰ্যাদার অবরোধের মধ্যে বাস ক’রে ঈর্ষা করে অন্য দলের স্বাধীনতা ও মুক্তিকে। পুরুষ বিচরণ করে ঘরে-বাইরের দু-জগতেই; আর নিজের সামাজিক আর্থনীতিক ক্ষমতার সাহায্যে নারীদের দু’দলকে লিপ্ত রাখে চিরশত্ৰুতায়। নারী জন্মসূত্রে কোনো এক বিশেষ পরিবার ও শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত; কিন্তু আসলে নারী কোনো পরিবার বা শ্রেণীর সাথেই অচ্ছেদ্যভাবে জড়িত নয়। নারী যেহেতু আর্থিকভাবে পুরুষনির্ভর, তাই যে-কোনো শ্রেণীর সাথে তার সম্পর্ক অস্থির ও অনিশ্চিত, যে-কোনো সময় তা ছিন্ন হয়ে নারী নেমে যেতে পারে নিম্নতম শ্রেণীতে। নারীর কখনোই শ্রেণী-উন্নতি ঘটে না; যদি জন্মশ্রেণীতে থাকতে না পারে, তাহলে ঘটে তার শ্রেণী-অবনতি। হিন্দুসমাজে অনুলোম ও প্রতিলোম বিবাহ বলে দু-রকম বিয়ে রয়েছে। নিম্নবর্ণের পুরুষ ও উচ্চবর্ণের নারীর বিয়ে প্রতিলোম বিবাহ; এবং উচ্চবর্ণের পুরুষ ও নিম্নবর্ণের নারীর বিয়ে অনুলোম বিবাহ। অনুলোম বিবাহে উচ্চবর্ণের পুরুষকে বিয়ে ক’রেও নারীর বর্ণোন্নতি ঘটে না, আর প্রতিলোম বিবাহের ফলে নারীর ঘটে বর্ণচ্যুতি; অর্থাৎ সমাজচ্যুতি। জর্মনিতেও ছিলো একই রীতি। মধ্যযুগে জার্মনিতে একজন নিম্নশ্রেণীর পুরুষ যখন উচ্চশ্রেণীর নারীকে বিয়ে করতো, প্রতিলোম বিয়ের মতো নারীটি থাকতো জাতিচ্যুত; আবার নিম্নশ্রেণীর নারী যখন কোনো উচ্চশ্রেণীর পুরুষকে বিয়ে করতো তখন সে স্বামীর শ্রেণীতে উঠতো না [দ্র ভূপেন্দ্রনাথ (১৯৪৬, ৮৬-৮৯)]। মুসলমানদের মধ্যেও একই রকম ঘটে; উচ্চশ্রেণীর মুসলমানেরা দাসীসম্ভোগে উৎসাহ বোধ করে, ধর্মে তার বিধানও রয়েছে, এবং বাধ্য হয়ে বিয়েও করে; কিন্তু ওই নারীটির শ্রেণী-উন্নতি ঘটে না। এখনো শিক্ষিত কোনো নারী যদি বিয়ে করে কোনো অশিক্ষিত পুরুষকে, তবে পুরুষটির উন্নতি ঘটে না; সৃষ্টি হয় এক কেলেঙ্কারি, নারীটি সমাজের তলদেশে নেমে যায়। তার কোনো ভবিষ্যৎ থাকে না। শুধু নিজের ওপর নির্ভর করতে হ’লে খুব কম নারীই শ্রমিক শ্রেণীর চেয়ে কোনো উচ্চশ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত হবে। কোটিপতির স্ত্রী একদিনে দাসী হয়ে উঠতে পারে। তাই তারা পরগাছার মতো জীবন ধারণ করে–তারা হয় পরগাছার পরগাছা; এবং নিজেদের রক্ষার জন্যেই হয়ে ওঠে রক্ষণশীল, যারা তাদের ভরণপোষণ করে তাদের সমৃদ্ধির সাথে আপ্রাণ চেষ্টা করে নিজেদের জীবনকে জড়িয়ে রাখার। দাস যেমন প্রভুর সমৃদ্ধিকে মনে করে নিজের সমৃদ্ধি নারীও স্বামীর বা পুত্রের, অর্থাৎ পুরুষের, সমৃদ্ধিকে মনে করে নিজের সমৃদ্ধি। তারা নিজেদের মুক্তির কথা ভাবতেও পারে না।

[পাঁচ] আর্থ ও শিক্ষা

নারীকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্যে পিতৃতন্ত্র সমস্ত আর্থ কর্তৃত্ব রেখেছে পুরুষের হাতে। সমস্ত পিতৃতন্ত্ৰেই, হিন্দু-ইহুদি-খ্রিস্টান-মুসলমান, নারীর কোনো আর্থ অস্তিত্ব নেই। কোরানে আছে : ‘পুরুষ নারীর কর্তা,… আর এজন্যে যে পুরুষ ধনসম্পদ থেকে ব্যয় করে’ [৪:৩৪]। নারী নিজের অধিকারে কোনো সম্পত্তি অর্জন করতে বা সম্পত্তির মালিক হতে পারতো না। এখন এ-বিধি কিছুটা শিথিল হয়েছে, কিন্তু তাতে নারীর আর্থভিত্তি শক্ত হয় নি। নারী চিরকালই খেটেছে, পুরুষের চেয়ে বেশিই খেটেছে; কিন্তু তার পারিশ্রমিক পায় নি। আধুনিক ভদ্র পিতৃতন্ত্রে নারী কিছুটা আর্থ অধিকার পেয়েছে, কিন্তু সেখানেও নারীরা পুরুষের সমান পারিশ্রমিক পায় না। অর্থের ওপরই যেখানে নির্ভর করে সম্মান ও স্বাধীনতা, সেখানে এর অভাবের পরিণতি মারাত্মক। তারই শিকার নারী। নারীদের অধীনতার মূল কারণ আর্থিক পরনির্ভরতা; অর্থের অভাবেই তারা পরাশ্রিত। নারীরা খেখানে কোনো পেশায় নিযুক্ত হয়, বেতন পায় পুরুষদের থেকে কম; উচ্চ যোগ্যতাসম্পন্ন নারীরাও কম যোগ্যতাসম্পন্ন পুরুষদের থেকে কম বেতন পায়। চাকুরিতে তাদের উন্নতিও ঘটে না। আধুনিক পুঁজিবাদী দেশগুলোতে নারীদের রাখা হয় সংরক্ষিত শ্রমশক্তি হিশেবে। বিপদে পড়লে উগ্র পিতৃতান্ত্রিক দেশগুলোও অবরোধ ও বোরখার ভেতর থেকে বের করে আনে তাদের সতীসাধ্বী নারীদের। যুদ্ধ বা সংকটের সময় পুরুষতন্ত্র ঘর থেকে বের ক’রে এনে নানা কাজে লাগায় নারীদের, আবার শান্তির সময় তাদের দলবেঁধে ঢোকোনো হয়। ঘরে। তখন বলা হয় গৃহই নারীর নিজের ভুবন, নারীই গৃহের শান্তি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় পশ্চিমের দেশগুলো নারীদের লাগায় সমস্ত কাজে–এমনকি সৈনিকদের চিত্ত ও শরীরবিনোদনের কাজে, এবং যদ্ধের পর ঢোকায় ঘরে। ১৯৯১-এর উপসাগরীয় যুদ্ধের সময় ঘটে যুদ্ধের থেকেও তাৎপৰ্যপূর্ণ এক ঘটনা। যুদ্ধের পূর্বমুহূর্তে সৌদি আরবের মতো কঠোর পিতৃতন্ত্ৰও নারীদের ঘর থেকে বের ক’রে লাগায় নানা ‘সেবামূলক’ কাজে। যুদ্ধের সময় গৌণ হয়ে যায় পিতৃতন্ত্রের বিধান; কিন্তু যুদ্ধশেষেই তা আবার প্রবলভাবে জেগে ওঠে, নারীদের পালে পালে ঢোকানো হয় ঘরে । যুদ্ধের পরে সৌদি পিতৃতন্ত্র নারীদের সাথে আদিম আচরণ করতে ভোলে নি; তাদের এমনকি গাড়ি চালানোর অধিকারও দেয় নি। কয়েকজন উচ্চশিক্ষিত নারী বিদ্রোহ করেন, নিজেরা গাড়ি চালিয়ে বেড়িয়ে পড়েন; সৌদি পিতৃতন্ত্র তাঁদের গ্রেফতার করে, চাকুরিচ্যুত করে, এবং আরো নানা হিংস্ৰ শাস্তি দেয়, যা বাইরের জগত আজো জানতে পারে নি। সমাজতান্ত্রিক দেশে নারীদের অধিকাংশই নিয়োজিত নিচের শ্রেণীর কাজে, তবে কিছু পেশায় সেখানে নারীদের আধিক্য রয়েছে, যেমন চিকিৎসায়। কিন্তু এখানেও পিতৃতন্ত্র কৌতুক করে নারীদের নিয়ে। যে-পেশায়ই নারীরা ঢোকে, হ্রাস পায় সে-পেশারই মূল্য, কমে যায় বেতন। নারীরা যেমন বিনাবেতনে পরিবারের সেবা করে, তেমনি রাষ্ট্র ও সমাজও মনে করে যে নারীর চাকুরি হচ্ছে সেবা । পুরুষের কাছে সেবা প্রত্যাশা করা হয় না, কিন্তু নারী যেখানেই কাজ করে সেখানেই তার কাছে সেবা চাওয়া হয়, যেনে টাকার তার কোনো দরকার নেই। নারীকে অসহায় ক’রে রাখার জন্যে এটা এক সুন্দর চক্রান্ত ।

নারীর আর্থ স্বাধীনতাকে দেখা হয় কুটিল সন্দেহের চোখে । তাই পিতৃতন্ত্রের সমস্ত সংস্থা প্রচার চালায় নারীর, মধ্যবিত্ত শ্রেণীর নারীর, পেশাগ্রহণের বিরুদ্ধে। নিম্নবিত্ত নারী নিয়ে তাদের মাথাব্যথা নেই, তারা তো নিম্নকাজের জন্যেই জন্মেছে, খুব সস্তায় পাওয়া যায় তাদের; কিন্তু বড়োই উদ্বিগ্ন তারা মধ্যবিত্ত নারীকে নিয়ে। পরিবার, ধর্ম, মনোবিজ্ঞান, প্রচারমাধ্যম ও আরো নানা সংস্থা তিরষ্কার করতে থাকে পেশাজীবী নারীদের। বাঙলার প্রথম উচ্চশিক্ষিত নারীরা পিতা, বা স্বামীর পবিবারের আদেশে, বা সামাজিক নিন্দায় পেশাগ্ৰহণ থেকে বিরত থেকেছেন বা পেশাগ্রহণে বিলম্ব করেছেন: অনেকে বিয়ের পর বিয়েকেই পেশারূপে গণ্য ক’রে আর্থিক চাকুরি ছেড়ে দিয়েছেন। নিম্নশ্রেণীর নারীদের কাজ নিয়ে পিতৃতন্ত্রের দুশ্চিন্তা নেই, বরঙ তারা কাজ না করলেই আতংকিত বোধ করে করে পিতৃতন্ত্র; কারণ তারা শস্তা। তারা মধ্যবিত্ত নারীদের মতো ভয়াবহ নয়, তাদের নিয়ে কোনো ভয় নেই। মধ্যবিত্ত নারীরা যদি কাজ করে-বিচার, চিকিৎসা, অধ্যাপনা করে, আমলা হয়, তাহলে তা পিতৃতন্ত্রের বা পুরুষতন্ত্রের আর্থ ও মনস্তাত্ত্বিক ভিত্তিটাকেই ভেঙে দিতে পারে। পেশাজীবী নারীরা আসলে নিযুক্ত থাকে দুটি পেশায়;— তাদের ঘরসংসার দেখতে ও সন্তান পালন করতে হয়, আর পালন করতে হয় পেশার দায়িত্ব। পেশাকে তারা পুরোপুরি পেশা হিশেবে নিতে পারে না, পরিবারই হয়ে থাকে তাদের মূলপেশা। পৃথিবী জুড়ে নারীরা যে-সব পেশায় এখন জড়িত, তা শ্রমিকের পেশা: তাই তাদের নির্দেশ করা যায় সাম্প্রতিক বিশ্বের প্রধান শ্রমিক শ্রেণীরূপে।

পৃথিবী জুড়ে নারী এখনো শিক্ষা থেকে দূরে থাকতে বাধ্য হচ্ছে; আর যারা শিক্ষা পাচ্ছে, তারাও ঠিক শিক্ষা পাচ্ছে না। পুরুষতন্ত্র তাদের সে-শিক্ষাই দিতে আগ্রহী, যা নারীদের নারী ক’রে রাখে, যা পরিশেষে কল্যাণে আসে পুরুষের। পুরুষ প্রথমে নারীদের লেখাপড়া শেখাতেই রাজি হয় নি, বা মূর্খের মতো কিছুটা ধর্মশাস্ত্ৰ শিখিয়েছে; পরে যখন বিদ্যালয়ে পাঠাতে বাধ্য হয়েছে, তখনো বের করেছে বিশেষ একধরনের নারীশিক্ষা। উনিশশতকের বাঙলার নারীশিক্ষার এ-রূপ সম্পর্কে রাজনারায়ণ বসু (১৮৭৪, ৪৭-৪৮) বলেছেন, ‘স্ত্রীলোকদিগকে যেরূপ শিক্ষা দেওয়া হইতেছে, তাহা তাহাদিগকে কেবল অশ্লীল গল্প ও নাটক পাঠে পারগ করে’, আর ‘তাহারা কেবল কার্পেটই বুনছে, কার্পেটই বুনছে। যদি তাহা না করিয়া পিরাণ শিলাই করিতে শিখে, তাহা হইলেও জানিলাম যে, কিছু উপকারে আইল।‘ পুরুষ নিজের স্বার্থে নারীদের যে শিক্ষা দেয়, তা হয়ে ওঠে এমনই নিরর্থক ও হাস্যকর। পুরুষদের একটি যুক্তি হচ্ছে নারীর দেহ সব রকম শিক্ষার উপযুক্ত নয়। ক্রীতদাস একসময় বিশ্বাসী হয়ে ওঠে। প্রভুর দর্শনে, নারীরাও প্রচার করে পুরুষের দর্শন। এর পরিচয় পাওয়া যায় শিক্ষিতা ইন্দিরা দেবী চৌধুরাণীর উক্তিতে। এ-আধুনিকাও মনে করেন, ‘গৃহধর্ম নারীজীবনের সারবস্তু, যাহার জন্য সমাজে নারীর স্থান ও মান’, আর নারীর দেহ খুবই পেলাব, তাই তিনি ‘বিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষকে মনে রাখতে’ বলেছেন যে ‘পরীক্ষা দেওয়াই নারীজীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য নহে।’ এ-আধুনিকার মতে, বঙ্গরমণীর শরীর মন ও ভবিষ্যৎ জীবনের গঠন স্মরণ রাখিয়া, বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষার কঠিন সংগ্রামে তাহাদের যোগ দিতে না দেওয়াই ভালো।‘ কারণ ‘স্ত্রীলোক ও পুরুষের ভবিষ্যৎ জীবন এমন স্বতন্ত্র ছাচে ভগবান টালিয়াছেন, তখন শেষ পর্যন্ত তাহাদের একই রকম শিক্ষা দেওয়া কখনই সমীচীন নহে’ [ দ্র ইন্দিরা (১৯২০, ১৩-১৫)। এ হচ্ছে নারীর কণ্ঠে পুরুষতন্ত্রের উক্তি, বা দাসীর মুখে প্রভুর ভাষা। আধুনিক পিতৃতন্ত্রগুলো এখন নারীদের জন্যে উচ্চশিক্ষার সমস্ত দরোজা খুলে দিয়েছে; তবে নারীপুরুষের উচ্চশিক্ষার বিষয় ও মানে পরিকল্পিত পার্থক্য রাখতে তারা ভোলে নি। শৈশব থেকেই পিতৃতন্ত্র ঠিক ক’রে দেয় ছেলেরা ঢুকবে কোন দরোজা দিয়ে আর মেয়েরা কোন দরোজা দিয়ে। শিক্ষার ক্ষেত্রেও রয়েছে কিছু নারীর বিষয় কিছু পুরুষের বিষয়। মনে করা হয় যে নারীরা পড়বে মানববিদ্যা ও সমাজবিদ্যার কিছু গৌণ বিষয়; আর পুরুষেরা পড়বে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যা, প্রকৌশল, ব্যবসাশাস্ত্র প্রভৃতি। আজকের পৃথিবীতে মান-সম্মান-অর্থ রয়েছে। পুরুষের বিদ্যাগুলোতে; আর এগুলোর ওপর নিয়ন্ত্রণের অর্থ হচ্ছে রাজনীতিক আধিপত্য বা শক্তি। পিতৃতন্ত্র লিঙ্গানুসারে মর্যাদা স্থির করে; যে-সমস্ত এলাকায় পুরুষের আধিপত্য সেগুলো ভোগ করে অবিমিশ্র মর্যাদা, আর যেগুলোতে পুরুষের প্রাধান্য নেই বা রয়েছে নারীর অংশ, সেগুলোর মর্যাদা কম। তাই মানববিদ্যা পায় কম মর্যাদা, কেননা এগুলোতে পুরুষাধিপত্য নেই; আর বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল, ব্যবসা, সামরিক বাহিনী পায় নিরঙ্কুশ মর্যাদা, কেননা এগুলোতে পুরুষতন্ত্রের প্রতাপ অপ্রতিহত।

[ছয়] বলপ্রয়োগ

পিতৃতন্ত্র নিজের আদর্শ বিশ্বজনীনভাবে বাস্তবায়নের জন্যে প্রধানত আশ্রয় নেয় সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ার; কিন্তু দরকার হলে বলপ্রয়োগ করতেও দ্বিধা করে না। সামাজিকীকরণের পেছনে বলপ্রয়োগের ভয়টাকে সব সময়ই জাগিয়ে রাখে; ত্রস্ত ক’রে রাখে সবাইকে, যাতে তারা মেনে নিতে বাধ্য হয় পিতৃতন্ত্রের অনুশাসন। অধিকাংশ পিতৃতন্ত্র বলপ্রয়োগ ক’রে থাকে তার আইনপদ্ধতির মাধ্যমে; আইনপদ্ধতি হচ্ছে পিতৃতন্ত্রের বলপ্রয়োগসংস্থা। যেমন, ইসলামে যৌনবিধি লংঘনের শাস্তি খুব কঠোর। বিধান হচ্ছে পাথর ছুড়ে মৃত্যুদণ্ড। সৌদি আরবে রখনো একজন মোল্লার নেতৃত্বে পাথর ছুড়ে হত্যা করা হয় ব্যভিচারিণীদের। আগে অনেক সমাজে পুরুষের ব্যভিচারকে কোনো অপরাধ ব’লেই ধরা হতো না। যখন অপরাধ গণ্য করা হতো, তখন সেটাকে মনে করা হতো কোনো পুরুষের সম্পত্তির ওপর অন্য পুরুষের হস্তক্ষেপ বলে। ব্যভিচারের শাস্তির বিধিও ছিলো একক শ্রেণীর জন্যে একেক রকম; যেমন জাপানে সামুরাইরা নিজেদের মহিমা রাখার জন্যে হত্যা করতে বাধ্য হতো তাদের ব্যভিচারিণী স্ত্রীদের; কিন্তু সাধারণ নাগরিকদের তেমন বাধ্যবাধকতা ছিলো না। প্ৰায় সব সমাজেই দেখা গেছে নিম্নশ্রেণীর কোনো পুরুষ যখন উচ্চ শ্রেণীর নারীর সাথে ব্যভিচারে লিপ্ত হয়েছে, তখন শিরচ্ছেদ করা হয়েছে দুজনেরই; কিন্তু উচ্চশ্রেণীর পুরুষ যখন ব্যভিচারে লিপ্ত হয়েছে নিম্নশ্রেণীর নারীর সাথে, তখন নারীটি অসতী ব’লে সমাজচ্যুত হ’লেও পুরুষটির কোনো শাস্তি হয় নি। এখনো এই নিয়ম। নিম্নশ্রেণীর পুরুষ যখন উচ্চশ্রেণীর নারীর সাথে ব্যভিচারে জড়িত হয়, তখন তারা অপরাধ করে উচ্চশ্রেণীটির বিরুদ্ধে, তাই তারা দুজনেই পায় চরম শাস্তি। এটা দ্রোহিতার শাস্তি, চলে ব্যভিচারের নামে।

পিতৃতন্ত্র তার বলপ্রয়োগের অধিকার অর্পণ করেছে পুরুষের ওপর। সমাজের নিম্নশ্রেণীর পুরুষেরা তাদের এ-অধিকার নিয়মিত প্রয়োগ ক’রে থাকে; আর উচ্চশ্রেণীর পুরুষেরা তা শারীরিকভাবে প্রয়োগ না করলেও মনস্তাত্ত্বিকভাবে প্রয়োগ করে ভালোভাবেই। পুরুষ মানেই সে পীড়নের অধিকার রাখে, যদিও সে পীড়ন নাও করতে পারে-এটা তার স্বাধীনতা; আর পিতৃতন্ত্র নারীকে এমনভাবে দীক্ষা দেয় যেনো সে পীড়নের শিকার হাতে বাধ্য থাকে, পীড়নকে সঙ্গত বলে মেনে নেয়। কোনো পুরুষ যখন কোনো নারীকে আক্রমণ করে, নারীটি সশস্ত্ৰ হ’লেও সহজেই অসহায় হয়ে পড়ে, কেননা পিতৃতন্ত্র তাকে শারীরিক মানসিকভাবে এভাবেই তৈরি করেছে। পিতৃতন্ত্রের নারীর ওপর বলপ্রয়োগের হিংস রূপ হচ্ছে বলাৎকার বা ধর্ষণ। আমাদের দেশে বলাৎকার নিয়মিত ঘটনা, যাতে প্ৰকাশ পায় আমাদের পিতৃতান্ত্রিক হিংস্রতা। অধিকাংশ বলাৎকারের ঘটনাই লোকলজ্জার ভয়ে নারীরা প্ৰকাশ করে না। আগে অনেক সমাজে বলাৎকারকে কোনো নারীর ওপর পীড়ন ব’লেও গণ্য করা হতো না, গণ্য করা হতো এক পুরুষের কাছে আরেক পুরুষের অপরাধ বলে, যাতে একটি পুরুষ দূষিত করেছে আরেকটি পুরুষের নারীসম্পত্তি। ফ্রয়েড তো এমন সিদ্ধান্তেই তার অনুসারীদের পোঁছে দেন যে বলাৎকার নারীর জন্যে এক ধরনের সুখ! ধর্ষণ লিঙ্গরাজনীতির এক চরম রূপ। সাহিত্যেও বলাৎকার ব্যাপারটি পুরুষেরা উপভোগ করে থাকে, লেখকেরাও ধর্ষণ বর্ণনার সময় উপভোগ করেন নারীকে চরমভাবে পর্যুদস্ত করার সুখ।

বাঙলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাসেও মুক্তি ও যুদ্ধের থেকে অনেক সময় বড়ো হয়ে উঠেছে ধর্ষণ। সৈয়দ শামসুল হকের নিষিদ্ধ লোবান (১৯৮১, ১৫১) থেকে একটি উদাহরণ দিচ্ছি। পাকিস্তানি মেজরটি বিলকিসকে শারীরিক ধর্ষণের আগে ধর্ষণ করে মানসিকভাবে, যা শারীরিক ধর্ষণের থেকে অনেক বেশি হিংস্র। মানসিক ধর্ষণের রূপটি এমন :

‘আমাকে একটা কথা বলো, হিন্দুরা কি প্রতিদিন গোসল করে?’
নীরবতা।
‘হিন্দু মেয়েদের গায়ে নাকি কটু গন্ধ?’
নীরবতা।
‘তাদের জায়গাটা পরিষ্কার?’
নীরবতা।
‘আমি শুনেছি, মাদী কুকুরের মতো। সত্যি।’
‘নীরবতা।
‘শুনেছি, হয়ে যাবার পর সহজে বের করে নেয়া যায় না?’
নীরবতা।
‘আমাকে কতক্ষণ ওভাবে ধরে রাখতে পারবে?’

ধর্ষণের আগে এই যে মানসিক ধর্ষণ ও জাতিবিদ্বেষ, এতে শুধু পাকিস্তানি মেজরটি অংশ নেয় নি, অংশ নিয়েছেন লেখক নিজে ও সমগ্র পিতৃতন্ত্র। এমন পুরুষ পাওয়া যাবে না যে বাস্তবে না হ’লেও মনে মনে কোনো নারীকে বলাৎকার করে নি। পিতৃতন্ত্রের নারীবিদ্বেষ প্রকাশ পেয়েছে বিপুল পরিমাণে রচিত নারীবিদ্বেষমূলক সাহিত্যে। ভারতে, চীনে, জাপানে ও ইউরোপে লেখা হয়েছে। এ-ধরনের বিপুল সাহিত্য। পিতৃতন্ত্র নারীর প্রতি নিষ্ঠুরতা দেখিয়েছে নানাভাবে : ভারতে সতীদাহ, চীনে কাঠের জুতো, আফ্রিকার কোনো কোনো দেশে মেয়েদের ভগান্ধুর কেটে ফেলা নিষ্ঠুরতার উদাহরণ। নারীর ওপর পুরুষের বলপ্রয়োগের শেষ নেই। পুরুষ চায় নারীকে সব সময় ত্রাসের মধ্যে রাখতে।

[সাত] নৃতাত্ত্বিক : পুরাণ ও ধর্ম

পিতৃতন্ত্র নারী সম্পর্কে পোষণ করে যে-সব বদ্ধমূল ধারণা, নারী তার কোনোটিরই স্রষ্টা নয়। ওই সব ধারণা সৃষ্টি করেছে পুরুষ। নারীর যে-ভাবমূর্তি তৈরি হয়েছে কয়েক হাজার বছরে, তার শিল্পীও পুরুষ। নারীর ওই ভাবমূর্তি পুরুষ সেভাবেই তৈরি করেছে, যা পুরুষের চাহিদা মেটায়। নৃতত্ত্ব, ধর্মীয় ও সাহিত্যিক পুরাণে রূপায়িত হয়ে আছে নারী সম্পর্কে পুরুষতন্ত্রের বিচিত্র ধারণা। পুরুষতন্ত্রের নারীধারণার মূলকথা নারী নিকৃষ্ট; কেননা নারীর শরীর ভিন্ন। নারীকে পুরুষ নিজের গোত্রের ব’লে মনে করে নি, মনে করেছে। ‘অপর’ বা শত্রু; তাই তাকে পীড়ন করার জন্যে তার ওপর বিস্তার করেছে। ব্যাপক আধিপত্য। তাকে বলেছে বিকলাঙ্গ, ঘেন্না করেছে তাকে কলুষিত বা অশুচি বলে; রেখেছে নিজের পবিত্র সীমা থেকে দূরে। নারীর যৌন বা শারীর ব্যাপারগুলোকে বিশ্বজনীনভাবেই গণ্য করা হয় অশুচি ব’লে, যার পরিচয় পাওয়া যায় পুরাণে, ধর্মগ্রন্থে, সাহিত্যে। নারীদের সৃষ্টিশীল পর্বের একটি নিযামত ব্যাপার ঋতুস্রাব। পুরাণ ও ধর্মগ্রন্থে একে অত্যন্ত অশুচি ব’লে বার বার উল্লেখ করে নারীকে দেখানো হয়েছে একটি অসুস্থ অশুচি প্রাণীরূপে, যদিও ব্যাপারটি রোগও নয় অশুচিতাও নয়। আদিম সমাজে ঋতুকালে নারীদের গ্রামের প্রান্তে কুঁড়েঘরে রাখা হয়; এবং সভ্য সমাজেও এ-সময় নারীকে গণ্য করা হয় অস্পৃশ্য। নারী ঋতুকালে যে-যন্ত্রণা বোধ করে, তার অনেকটাই মনস্তাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিক, কিন্তু তা-ই পুরুষতন্ত্রের বিধিবিধানের ফলে শারীরিক হয়ে ওঠে।

আদিম সমাজে নারীর যোনিকে মনে করা হয় একটি ক্ষত। তারা বিশ্বাস করে ওই স্থানে কোনো পাখি বা সাপ গর্ত খুঁড়ে ক্ষত সৃষ্টি ক’রে গেছে; তাই মাসে মাসে ওই ঘা থেকে রক্ত চোয়ায়। ফ্রয়েডীয়রাও মনে করেন নারী হচ্ছে খোজা। অর্থাৎ পুরুষতন্ত্র নারীর একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গকে দেখে ঘৃণার চোখে; কিন্তু নিজের অঙ্গটিকে দেখে গর্ব ও গৌরবের চোখে। আদিম ও আধুনিক সব সমাজেই শিশ্ন বা পুরুষাঙ্গকে মনে করা হয় পৌরুষের অপরাজেয় ঝাণ্ডা। একে নিয়ে পুরুষের গর্ব গৌরব ও উদ্বেগ অশেষ। বাঙলা ‘পুরুষাঙ্গ’ শব্দটি তাৎপর্যপূর্ণ, শব্দটিতে প্রকাশ পেয়েছে বাঙালির জাতীয় বিশ্বাস : পুরুষের সব অঙ্গই পুরুষাঙ্গ, কিন্তু অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গপ্রত্যঙ্গকে বাদ দিয়ে নির্বোধ প্রত্যঙ্গটিকেই দেয়া হয়েছে পুরুষের সম্মান ও গৌরব। এতে বোঝা যায় বাঙালি একে কতো মহৎ মনে করে। বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষায় এর যে-সব নাম রয়েছে, যেমন ‘সোনা’, ‘ধন’, সেগুলোও নির্দেশ করে এটি কতো অমূল্য। সব পিতৃতন্ত্রই নারীকে নিষিদ্ধ ক’রে রেখেছে পবিত্র এলাকা থেকে; তারা যুদ্ধ ও ধর্মীয় অনেক বস্তু ছুঁতে পারে না, এমনকি খাদ্যও স্পর্শ করেতে পারে না। আদিম সমাজে, এবং আমাদের সমাজেও, পুরুষের সাথে নারীদের খাওয়া নিষেধ। এ-বিধানের মূলে রয়েছে এমন ভয় যে দূষিত নারী থেকে কোনো ব্যাধি সংক্রমিত হবে পুরুষের দেহে। নারী খাদ্য প্রস্তুত করে, কিন্তু পুরুষের সাথে খেতে পারে না; অনেক সমাজে খাবার পরিবেশনও করতে পারে না। প্রত্যেক পিতৃতন্ত্রেই পুরুষ আগে, বেশি ক’রে, ও ভালোটা খায়; আর যেখানে তারা একসাথে খায়, সেখানেও নারী পরিবেশন করে, পুরুষ খায়।

প্ৰত্যেক পুরুষতন্ত্র কুমারীত্ব ও কুমারীত্বমোচনকে ঘিরে রেখেছে একরাশ আচার ও নিষেধে। অনেক আদিম সমাজে কুমারীত্ব নিয়ে রয়েছে চমৎকার বিপরীত মনোভাব! একদিকে প্রত্যেক পিতৃতন্ত্র একটি অক্ষত যোনি পাওয়ার জন্যে ব্যগ্র, কেননা পুরুষেরা নিজের জিনিশ অব্যবহৃত টাটকা অবস্থায় পেতে চায়; আবার অনেক সমাজ সতীচ্ছদসম্পন্ন অক্ষত যোনিকে ভয়ঙ্কর ভয়ও পায়। কোনো কোনো সমাজে কুমারীত্বমোচনকে এমন ভয়ঙ্কর শুভ কাজ ব’লে মনে করা হয় যে পুরুষটি তার নারীর সতীচ্ছদ ছিন্ন করতে ভয় পায়, সে ওই পবিত্র কাজের দায়িত্ব তুলে দেয় তার চেয়ে শক্তিমান বা বয়স্ক কারো ওপর। পুরুষতান্ত্রিক পুরাণ এমন এক সোনালি যুগের কথাও বলে যখন আবির্ভাব ঘটে নি নারীর। বাস্তবে এটা রূপ নেয়। নারীসঙ্গ পরিহারের। পুরুষের পৃথিবীতে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নারী নিষিদ্ধ: সাম্প্রতিক পিতৃতন্ত্রে সমস্ত শক্তিমান সংঘই পুরুষ সংঘ। পুরুষ সংঘগুলো হচ্ছে পুরুষপ্রাধান্য রক্ষার দুর্গ।

আদিম সমাজের নারীবিদ্বেষ এক সময় রূপ পায় পৌরাণিক উপাখ্যানে; এবং আরো পরে তাকে দেয়া হয় নৈতিক, সাহিত্যিক, এমনকি বৈজ্ঞানিক রূপ। অনেক পৌরাণিক উপাখ্যান নারীর বিরুদ্ধে সরাসরি অপপ্রচার। পশ্চিমের দুটি বিখ্যাত পৌরাণিক উপাখ্যান হচ্ছে প্যান্ডোরার সিন্দুক ও বাইবেলের মানুষের পতনের কাহিনী। এ-দুটিই নারীবিদ্বেষের অসামান্য উপাখ্যান। নারী অশুভ; এমন একটি আদিম বিশ্বাস এ-উপাখ্যান দুটিতে সাহিত্যিক ও ধর্মীয় রূপ পেয়ে হয়ে উঠেছে অত্যন্ত প্রভাবশালী। প্যান্ডোরা সম্ভবত ছিলো ভূমধ্যসাগরীয় কোনো উর্বরতার দেবী, যে পরে মহিমাচ্যুত ও নিন্দিত হয়। কবি হেসিয়ডের মতে প্যান্ডোরাই প্রথম সূচনা করে কাম বা যৌনতার, এবং ওই কামের পাপেই পৃথিবী থেকে লোপ পায় সে-স্বর্ণযুগ, ‘যখন মানবজাতি পৃথিবীতে যাপন করছিলো নিষ্পাপ জীবন, যখন মানুষকে করতে হতো না কোনো শ্রমসাধ্য কাজ, এবং ভুগতে হতো না রোগে৷’ (দ্র মিলেট (১৯৬৯, ৫১)}। হেসিয়ডের মতে, প্যান্ডোরাই ‘সূচনা নারকীয় নারীজাতির, যে-মহামারীকে নিয়ে বাস করতে হচ্ছে পুরুষদের।‘ নারীকে দায়ী করা হয়েছে পুরুষের দুর্দশার জন্যে; এ-দুর্দশার মূল কারণরূপে দেখানো হয়েছে কামকে, যা হচ্ছে নারীর একান্ত অনন্য জিনিশ। হেসিয়ড আরো বলেছেন, প্যান্ডোরা বা নারী এক ভয়াবহ প্রলোভন, ‘যার আত্মা কুকুরীর, যার কামনাবাসনার নৃশংসতায় দেহ জীর্ণ হয়।‘ জিউস ওই ফাঁদকে পাঠায় ‘পুরুষকে ধ্বংস করার জন্যে।’ পিতৃতন্ত্র সৃষ্টি করেছে বিধাতা, এবং রেখেছে নিজের পক্ষে। নারীকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্যে পিতৃতন্ত্র রচনা করেছে নারীর উদ্ভবের ও তার স্বভাব সম্পর্কে অশালীন উপাখ্যান; এবং তার ওপরই চাপিয়ে দিয়েছে কামের সমস্ত কলুষ, যৌনতার সমস্ত পাপ। পুরুষতন্ত্ৰ কামকে যখন মহিমান্বিত করে, তখন শিশ্নকে দেবতায় পরিণত করে; আর যখন নিন্দা করে, তখন যোনির কুৎসায় মুখর হয়। গ্রিকরা যখন কামকে গৌরব দেয়, তখন তারা উর্বরতার উৎসরূপে পুজো করে পুরুষাঙ্গের; যখন তারা কামকে নিন্দা করে তখন তিরষ্কার করে প্যান্ডোরোকে। পিতৃতন্ত্র কামের সমস্ত পাপ, কলুষতা, অপরাধ চাপিয়ে দেয় নারীর ওপর। পিতৃতন্ত্রের চোখে নারী যৌনপ্রাণী, পুরুষ হচ্ছে মানুষ। প্যান্ডোরার উপাখ্যানের সাহায্যে নারীকে দণ্ডিত করার হয়েছে যৌনতার অপরাধে। নারী যেনো মানুষ জাতিকে পাপিষ্ট করেছে তার কামে, তাই পুরুষতন্ত্র তার শাস্তিও বিধান করেছে। নারী তার পাপের ফল ভোগ করছে জীবন দিয়ে। ‘প্যান্ডোরার সিন্দুক’ নামে যে-পৌরাণিক গল্পটি রয়েছে, তাতে সিন্দুকটি যোনির প্রতীক। পিতৃতন্ত্রের চোখে ওই কামনাজাগানো সিন্দুক থেকে জন্ম নিয়েছে জগতের সমস্ত দুঃখ।

বাইবেলের আদম-হাওয়ার পতনের উপাখ্যান প্যান্ডোরার উপাখ্যানেরই সংস্কৃত রূপ। এ-গল্পের অসীম প্রভাব রয়েছে ইহুদি-খ্রিস্টান-মুসলমানের ওপর; অর্থাৎ সাম্প্রতিক সভ্যতার অধিকাংশ মানুষের ওপর। তারা বিশ্বাস করে নারীই সমস্ত পাপের মূল, সমস্ত দুঃখের উৎস। হাওয়া সম্ভবত ছিলো, প্যান্ডোরার মতোই, এক উর্বরতার দেবী; তবে পুরুষতন্ত্র তাকে উৎখাত করে তার মর্যাদার অবস্থান থেকে। এর কিছুটা পরিচয় বাইবেলে রয়ে গেছে। তাদের পতনের আগে, বাইবেলে বলা হয়েছে, ‘আদম আপনি স্ত্রীর নাম হবা [জীবিত] রাখিলেন, কেননা তিনি জীবিত সকলের মাতা হইলেন’ [আদিপুস্তক : মানবজাতির পাপে পতন]। এ-উপাখ্যান প্রচলিত লৌকিক কাহিনীর রূপান্তর ব’লে হাওয়াকে সৃষ্টি করার দুটি বিরোধী কাহিনী বাইবেলে রয়ে গেছে। একটিতে নারীপুরুষকে একই সাথে সৃষ্টি করা হয়, আরেকটিতে নারীকে সৃষ্টি করা হয় পুরুষের অস্থি থেকে। আদম-হাওয়ার কাহিনী মানুষের সঙ্গম আবিষ্কারের কাহিনীও। এ-কাহিনীতে আরো নানা বিষয় রয়েছে, যেমন মানুষ কী ভাবে হারায় তার আদিম সারল্য, জ্ঞান কীভাবে আসে, বা আসে মৃত্যু। তবে এ-সবই আবর্তিত কামকে ঘিরে। বিধাতা আদমকে জানিয়েছিলো যে নিষিদ্ধ ফল খেলে তারা মারা যাবে, কিন্তু দেখা যায় বিধাতা সত্য কথা বলে নি, বরং শয়তানই বলেছিলো সত্য যে তারা মরবে না। নিষিদ্ধ ফল খাওয়ার ফলে তারা মারা যায় নি, শুধু বুঝতে পেরেছে যে তারা নগ্ন; এবং সে-জন্যে লজ্জা বোধ করেছে। এতে যৌনতা সুস্পষ্ট। হিব্রু ভাষায় ’খাওয়া’ বলতে সঙ্গমও বোঝাতে পারে। বাইবেলে ‘জানা’ আর যৌনতা একই অর্থ বোঝায়; আর বাইবেলের সাপটি শিশ্নেরই প্রতীক। বাইবেলে মানুষের দুঃখকষ্ট ও স্বৰ্গ হারানোর জন্যে দায়ী করা হয়েছে কামকে। ওই নিষিদ্ধ কামের অপরাধে পুরুষের ভালো রকমেরই অংশ রয়েছে; কিন্তু ওই অপরাধ থেকে পুরুষকে মুক্তি দিয়ে সব অপরাধ চাপানো হয়েছে হাওয়া বা নারীর ওপর। বলা হয়েছে তারই জন্যে পতন ঘটেছে পুরুষের অর্থাৎ মানবজাতির।

প্রথম পুরুষটিও দোষ চাপিয়েছে নারীরই ওপর; বলেছে, ‘তুমি আমার সঙ্গিনী করিয়া যে স্ত্রী দিয়াছ, সে আমাকে ঐ বৃক্ষের ফল দিয়াছিল, তাই খাইয়াছি’ [আদিপুস্তক: মনিবজাতির পাপে পতন]। হাওয়া দণ্ডিত হয়েছে কামে আদমের অংশ গ্রহণের অপরাধে। তারা দুজনে শাস্তি পেয়েছে দু-রকম। আদম বা পুরুষকে যে-শাস্তি দেয়া হয়েছে, তা শাস্তিই নয়। বিধাতা আদমকে বলেছে, ‘তোমার নিমিত্ত ভূমি অভিশপ্ত হইল; তুমি যাবজীবন ক্লেশে উহা ভোগ করবে’: অর্থাৎ পুরুষ পেয়েছে সভ্যতা সৃষ্টির ভার। হাওয়াকে যে-শাস্তি দেয়া হয়, তা রাজনীতিক। তার দণ্ড হচ্ছে : ‘আমি তোমার গৰ্ভবেদনা অতিশয় বৃদ্ধি করিব; তুমি বেদনাতে সন্তান প্রসব করিবে; এবং স্বামীর প্রতি তোমার বাসনা থাকিবে; ও সে তোমার উপরে কর্তৃত্ব করবে।’ নারীকে সাপের বা কামের সাথে চিরদ্বন্দ্বেও লিপ্ত ক’রে দেয়া হয় : ‘সদাপ্ৰভু সৰ্পকে কহিলেন, ‘…আমি তোমাতে ও নারীতে…পরস্পর শত্ৰুতা জন্মাইব; সে তোমার মস্তক চূর্ণ করিবে, এবং তুমি তাহার পাদমূল চূৰ্ণ করিবে’ [আদিপুস্তক  : মানবজাতির পাপে পতন]। পুরুষতন্ত্র নারীকে ক’রে তোলে কাম ও পাপের আধার; এবং নারীকে পুরুষের রাজনীতিক অধীনতায় নিয়ে আসে তার কল্পিত স্বৰ্গেই। পিতৃতন্ত্রের চোখে নারী অশুভ; অশুভের পায়ে নিবেদিত। পিথাগোরাস বলেছেন, ‘রয়েছে এক শুভ নীতি, যা সৃষ্টি করেছে। শৃঙ্খলা, আলোক, ও পুরুষ; এবং রয়েছে এক অশুভ নীতি, যা সৃষ্টি করেছে বিশৃঙ্খলা, অন্ধকার, ও নারী’ [দ্র দ্য বোভোয়ার (১৯৪৯, ১১২)]। পুরুষের প্রয়োজন নারী; তাই নারীকে সমাজে স্থান দিয়েছে। পুরুষ, কিন্তু তাকে মেনে নিতে বাধ্য করেছে বশ্যতা।

[আট] মনস্তাত্ত্বিক

পিতৃতন্ত্র শুধু নরনারীর বাইরের জগতটিকেই নিয়ন্ত্রণ করে নি, নিয়ন্ত্রণ করেছে তাদের মনোজগতকেও। নারী ও পুরুষ মনের মধ্যে গ্ৰহণ করেছে অর্থাৎ অন্তরীকরণ করেছে পিতৃতন্ত্রের ভাবাদর্শ। নারীপুরুষের অবস্থান (মর্যাদা), মেজাজ, ও ভূমিকার মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব তাদের ওপর অত্যন্ত ব্যাপক। বিবাহরীতি, পুরুষের আর্থিক প্ৰভুত্ব নারীর মনকে মারাত্মকভাবে নিয়ন্ত্রণ করে। তার ওপর রয়েছে নারীর যৌন অপরাধবোধ, যেনো নারীই সব যৌনতার মূলে। এর ফলে নারী ব্যক্তি না থেকে হযে ওঠে যৌনসামগ্ৰী। নারী বিবেচিত হয় আস্থাবর সম্পত্তি হিশেবে। নারীর কোনো যৌন স্বাধীনতা নেই। নারীর কুমারীত্ব বা সতীত্বের ওপর পিতৃতন্ত্র এতো জোর দেয় যে নারীর নিজের শরীরও তার নিজের থাকে না; তার শরীর পুরুষের জন্যে। নারীর ওপর এতো অভিভাবকত্ব করা হয় যে তাকে অনেকটা চিরশিশু ক’রে রাখা হয়। নারী তার জীবনধারণের জন্যে বা উন্নতির জন্যে নির্ভর করতে বাধ্য হয়। পুরুষের ওপর নারীর কোনো ক্ষমতা নেই, পুরুষের রয়েছে ক্ষমতা। পিতৃতন্ত্রে নারীকে দেয়া হয় তুচ্ছ মর্যাদা। এতো পীড়নের ফলে নারীর স্বভাবে এমন লক্ষণ দেখা দেয়, যা সংখ্যালঘুদের বৈশিষ্ট্য। সমাজ তাদের দেখে অশ্রদ্ধার চোখে, তাই তারাও নিজেদের দেখে অশ্রদ্ধার চোখে। তারা নিজেদের কারো কৃতিত্বকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করে না। ফিলিপ গোল্ডবার্গ ‘নারীরা কি নারীদের বিরুদ্ধে সংস্কারগ্রস্ত’ নামের একটি গবেষণায় দেখান যে নারীরা নারীদের সম্বন্ধে পোষে খুবই নিম্ন ধারণা। তিনি একই লেখার লেখক হিশেবে দেন দুটি নাম : জন ম্যাককে, ও জোয়ান ম্যাককে; এবং ছাত্রীদের ওই লেখা দুটির মূল্যায়ন করতে বলেন। ছাত্রীর জনের মৌলিকতা ও পাণ্ডিত্বের উচ্ছসিত প্ৰশংসা করে, আর জোয়ানকে নিন্দা করে তার মেধাহীনতার জন্যে [দ্র মিলেট (১৯৬৯, ৫৫)]। দুটি লেখাই ছিলো অবিকল এক, তবু নারীদের কাছেও পুরুষের লেখাটি হয়ে ওঠে অসাধারণ, নারীর লেখাটি তুচ্ছ।

পিতৃতন্ত্রে নারীরা নাগরিক অধিকারই পায় না, যেখানে পায় সেখানেও থাকে প্রান্তিক নাগরিক। সংখ্যায় তারা সংখ্যাগুরু, কিন্তু মর্যাদা পায় সংখ্যালঘুর। তাই তাদের মানসিকতাও হয়ে ওঠে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানসিকতা। তারা নিজেদের ঘেন্না ও অবজ্ঞা করে, ও নিজের শ্রেণীকে অবজ্ঞা করে। কয়েক হাজার বছর ধরে শুনে আসছে তারা নিকৃষ্ট, দেখে আসছে তাদের নিকৃষ্ট অবস্থান; তাই তারাও মনে করে নিজেদের নিকৃষ্ট। তাদের যে-কোনো অপরাধকে বাড়িয়ে দেখে সমাজ; সমান অপরাধের জন্যে তারা পুরুষের থেকে অনেক কঠোর শাস্তি পায়। সংখ্যালঘুরা যেমন নিজের বা নিজ সম্প্রদায়ের কারো অপরাধকে বাড়িয়ে দেখে, অনাবশ্যক ক্ষমা চায়, নারীরা তেমনি। নারীদের অনেকেই পুরুষ হতে চায়; বেগম রোকেয়ার মধ্যে এটা বেশ প্রবল ছিলো। পুরুষ হতে চায়, কেননা নারী হিশেবে তারা নিজেদের অস্তিত্ব নিয়েই অনিশ্চয়তায় ভোগে। তারা মনে করে পুরুষ হ’লে তারা নিশ্চয়তা পাবে। মার্কিন গবেষকেরা দেখেছেন কৃষ্ণকায়েরা ও নারীরা মানসিকতায় একই রকম। তারা বুদ্ধিতে খাটো, তাদের স্বভাব আদিম ও শিশুর মতো আবেগপরায়ণ; তারা নিজেদের ভাগ্যে সন্তুষ্ট, ছালনাপরায়ণ, ও লুকিয়ে রাখে নিজেদের অনুভূতি। পুরুষ এসবই পছন্দ করে নারীর। শাণিত নারীর থেকে নির্বোধ নারীকে বেশি পছন্দ করে, আর নিবুদ্ধিতাকে রমণীয় ব’লে প্ৰশংসা করে। ইংরেজি উপন্যাসে নির্বোধ স্বর্ণকেশিনীর কাছে হেরে যায় তীক্ষ্ণ কৃষ্ণকেশিনী; বাঙলা উপন্যাসেও মাংসস্তুপের কাছে পরাজিত হয় ব্যক্তিত্ব। অন্যান্য সংখ্যালঘুদের মতো নারীদেরও এক-আধজনকে অন্যদের থেকে উচ্চ মর্যাদা দেয়া হয়। এটা নারীদের উপকারে আসে না, কেননা পুরুষতন্ত্রের স্বীকৃত নারীরা কাজ করে পুরুষতন্ত্রের পক্ষে। এ-নারীরা গ্ৰহণ করে ‘নারীত্ব’ ও পুরুষের প্রাধান্য রক্ষার দায়িত্ব। পশ্চিমে এ-ভূমিকায় রাখা হয় সাধারণত গায়িকানায়িকাদের, যারা বিরাজ করে জনগণের যৌনসামগ্ৰীরূপে। সংখ্যালঘুদের মধ্যে ভাগ্যবান দু-একজনকে সুযোগ দেয়া হয় তাদের প্রভুদের চিত্তবিনোদনের। নারীরা তাদের কাম দিয়ে পুরুষদের বিনোদন যোগায়, সুখী করে, এবং একেই মনে করে তারা গৌরবের কাজ। ‘রাজা করিতেছে রাজ্য শাসন, রাজারে শাসিছে রানী’ ব’লে নজরুল নারীর শক্তির অসাধারণত্ব বোঝাতে চেয়েছিলেন; তিনি বুঝতে পারেন নি রাজাকে শাসন নারীর শক্তির অসাধারণত্ব নয়, শোচনীয়তা। নজরুল, বাহ্যিক সদিচ্ছাসত্ত্বেও, ছিলেন পুরুষতন্ত্রেরই প্রতিনিধি; এবং তিনিও পুরুষতন্ত্রের শিকাররূপেই দেখতে চেয়েছেন নারীকে। রানী রাজাকে যেটুকু শাসন করে, সেটুকু রক্ষিতার শাসন। এর বেশি নয়। পুরুষতন্ত্র খুবই আনন্দ বোধ করে ‘রাজারে শাসিছে রানী’তে; কিন্তু তার প্রবল আপত্তি নারীর শাসনে। পিতৃতন্ত্র রাজাকে বা স্বামীকে শাসন করা শিখিয়ে নারীকে ক’রে রেখেছে চিরন্তন রক্ষিতা। তাই নারীর মানসিকতাও হয়ে উঠেছে রক্ষিতার। পুরুষতন্ত্রের প্রিয় নারীমাত্রই পুরুষতন্ত্রের রক্ষিতা, তারা পুরুষতন্ত্রকে গ্রহণযোগ্য করার সাধনা করে তাদের সমস্ত কাজে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *