০২. অবতরণিকা : তৃতীয় সংস্করণ

অবতরণিকা : তৃতীয় সংস্করণ

বিশশতকের শেষ দশকের মাঝামাঝি পৌঁছে আজ খুবই কঠিন হয়ে পড়েছে মানুষের ওপর বিশ্বাস রাখা;- গ্ৰহ ভ’রে মানুষ আজ মত্ত পাশবিক আচরণে; মানুষ হনন ক’রে চলছে মানুষ; মানুষ বন্দী আর পীড়ন ক’রে চলছে মানুষকে। কয়েক বছর আগে নারী লিখেছিলাম মানুষের পরাভূত লিঙ্গটির মুক্তির প্রস্তাব হিশেবে; এখন দেখছি মানুষের হাত থেকে উদ্ধার করা দরকার নারী ও পুরুষ উভয় লিঙ্গকেই। আমি পেশাদার নারীউন্নয়নজীবী নই; নারীর উন্নয়নের জন্যে আমি সংস্থা খুলি নি; আমি লিখেছি। একটি বই। বইটির খ্যাতি আমাকে যেমন সুখী করে, তেমনি অভিভূত করে এজন্যে যে বইটি নারীসম্পর্কে আমাদের প্রথাগত দৃষ্টি অনেকখানি বদলাতে সাহায্য করেছে। তবে এটি শুধু নারীমুক্তির প্রস্তাব নয়; এটি মানুষ প্রজাতিরই মুক্তির প্রস্তাব। বইটিতে আমি প্রথাগত প্ৰায়-সমস্ত চিন্তা আর ভাবাদর্শ বাতিল করেছি; কেননা প্রথাগত চিন্তাধারা মানুষের মুক্তির বিরোধী। কোনো কিছুরই শাশ্বত মহত্ত্বে আমার বিশ্বাস নেই; কোনো কিছু মহৎ বলে প্রচারিত ব’লেই তা বিনাপ্রশ্নে মেনে নিতে হবে, তাও আমি মনে করি না। তাই প্রথাগত সমস্ত কিছু সম্পর্কেই আমি প্রশ্ন তুলেছি; বৈজ্ঞানিক রীতিতে বাতিল করেছি। পৃথিবী জুড়েই মানুষ নিজের কাঠামোতে বাঁচে না; বেঁচে থাকতে বাধ্য হয় অন্যের কাঠামোতে; ওই কাঠামো তাকে বন্দী ক’রে রাখে। অন্যের কাঠামোতে সবচেয়ে বেশি বাস করে নারী; অন্যের কাঠামোতে বাস করে করে নারী বিপর্যস্ত হয়ে গেছে।

মানুষের এক বড়ো সমস্যা ভাবাদর্শ। মানুষকে বিভিন্ন ভাবাদর্শের মধ্যে বাস করতে হয়; এবং মানুষকে শেখানো হয়েছে যে ভাবাদর্শের মধ্যে বাস করাই শ্ৰেষ্ঠ কাজ। তবে মানুষ জন্মেছে মানুষরূপে বাস করার জন্যে, ভাবাদর্শ যাপনের জন্যে নয়। ভাবাদর্শের এক মারাত্মক ব্যাপার হচ্ছে তা হিংস্র হয়ে উঠতে পারে; যেমন আজকাল দেখা দিচ্ছে মৌলবাদী ভাবাদর্শ। মৌলবাদী ভাবাদর্শ হচ্ছে বন্দী করার ভাবাদর্শ; তা একগোত্র মধ্যযুগীয় মানুষের দখলে আনতে চায় মানবসমাজকে। মৌলবাদ মানুষের বিকাশের বিরোধী; আর মৌলবাদ যেহেতু পীড়নবাদ, তাই পীড়ন করে সব কিছুকে। নারী তার পীড়নের প্রধান লক্ষ্য। মৌলবাদ প্রতিষ্ঠিত হ’লে নারীর মুখ আর দেখা যাবে না;–তাকে পথে দেখা যাবে না, বিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখা যাবে না; একেবারেই দেখা যাবে না কোনো কর্মস্থলে। নারী হবে নিষিদ্ধ; আর সব কিছু হবে নারীর জন্যে নিষিদ্ধ। কিন্তু পৃথিবীটা মানুষের–নারীর ও পুরুষের; উভয়ে মিলেই বিকাশ ঘটাবে সভ্যতা ও মানুষের। তাই দরকার মৌলবাদ সম্পর্কে সাবধান থাকা; বিশেষ ক’রে নারীকে সাবধান থাকতে হবে; কেননা ওই মতবাদে নারী সত্তাহীন প্ৰাণী।

বাঙলাদেশ প্রতিমুহূর্তে হয়ে উঠছে পূৰ্ববতী মুহুর্তের থেকে অধিক মধ্যযুগীয়; খুব দ্রুত এখানে লোপ পাচ্ছে মুক্তচিন্তার অধিকার। দিকে দিকে এখন প্রচার পাচ্ছে পুরোনো বুলি; পুরোনো বুলির অসার মহত্ত্বে সবাই এখন মুগ্ধ। সবাই ভয় পাচ্ছে সত্যকে, আর মিথ্যেকেই আঁকড়ে ধরছে সত্য বলে। এর মূলে রয়েছে বাঙলাদেশের রাজনীতি, যা মানুষকে আলো থেকে অন্ধকারের দিকে নিয়ে চলছে। এ-রাজনীতি নারীকে ঠেলে দিচ্ছে চরম অন্ধকারের দিকে। ষাটের দশকেও নারীরা যতোটা অগ্রসর ছিলো, এখন আর তা নেই; তারা পিছিয়ে পড়ছে-চিন্তা ও জীবনের সব দিকে; শিক্ষিত নারীরাও আজকাল যে-সব বিশ্বাস পোষণ করেন, তার থেকে শোচনীয় অপবিশ্বাস আর হয় না। এমন এক ধারণা প্রচলিত হচ্ছে এখন যেনো পৃথিবীতে সব সিদ্ধান্ত নেয়া হয়ে গেছে; আমাদের কাজ ওই সিদ্ধান্তগুলো মেনে চলে জীবন সার্থক করা। কিন্তু সত্য হচ্ছে মানুষ আরো কয়েক কোটি বছর টিকে থাকবে; তার ভবিষ্যৎ গত তিন হাজার বছরের নির্দেশে চলতে পারে না।

অতীত হচ্ছে অতীত :- অতীতকে জানতে হবে, কিন্তু অতীতের বিধানে চলা হাস্যকর ও শোককর। কিন্তু অতীত আমাদের ওপর বোঝার মতো চেপে আছে; দিন দিন তার বোঝা আরো বাড়ছে। মানুষকে আমি ওই বোঝা থেকে মুক্ত দেখতে চাই; তাই নারীতে প্রবলভাবে পেশ করা হয়েছে অতীত বিরোধিতা। মানুষ কতোটা মুক্ত তার একটি মানদণ্ড হচ্ছে সে অতীত থেকে কতোটা মুক্ত। বইটি শুধু নারীমুক্তির প্রস্তাব নয়; এটি বর্তমান সভ্যতাকেই বদলে দেয়ার প্রস্তাব। তাই নারী যেমন জনপ্রিয়তা লাভ করেছে; তেমনি, খুবই সচেতন আমি, প্রতিপক্ষও জুটেছে প্রচুর। আমি নিয়মিত প্ৰগতিবিরোধী প্রতিপক্ষের সদস্যদের দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার অভিজ্ঞতা লাভ করি। কিছু আগে এক মৌলবাদীগোত্র আমাকে মুরতাদ, শব্দটির কী অর্থ আমি জানি না, উপাধি দিয়েছে; একটি গোত্র হত্যার সংক্ষিপ্ত তালিকায় রেখে আমাকে সম্মানিত করেছে। আমার মাতৃভূমি হয়ে উঠেছে এমনই মর্মস্পশী ও ভয়াবহ। বাঙালি মুসলমানের এটা এক বড়ো দুৰ্ভাগ্য; তারা বিকশিত হতে চায় না; তারা জীবিত প্ৰতিভাদের হত্যা করতে চায়,–আমি অবশ্য প্রতিভা নাই–, আর মৃতদের মাজারে মোমবাতি জ্বলে। কেউ কেউ কাজ করছে আরো নিপুণভাবে; তারা গোপনে চক্রান্ত করছে বইটির বিরুদ্ধে; যাতে বইটিকে বিলুপ্ত করে দেয়া যায়, তার উপায় খুঁজছে তারা। আমি আশা করবো অমন কলঙ্ক ঘটবে না।

এ-সংস্করণে যোগ করা হলো একটি পরিচ্ছেদ, যার নাম ‘ধর্ষণ’। এটি যোগ করার কারণ ধর্ষণ নারীপীড়নের চরম রূপ; এবং এখনকার বাঙলাদেশ ধর্ষণপ্রবণ। যখন পরিচ্ছেদটি লিখছিলাম, তখনই ব্ৰজমোহনে দলবেঁধে ছাত্ররা ধর্ষণ করে একটি ছাত্রীকে; আর দিনাজপুরে পুলিশ দলবেঁধে ধর্ষণ ও হত্যা করে একটি কিশোরীকে, যার ফলে দেখা দেয় গণঅভ্যুত্থান; নিহত হয় দশজন বিবেকী পুরুষ। এছাড়াও বইটিতেই করা হয়েছে নানা সংশোধন ও সংযোজন, যা বইটিকে দিয়েছে পরিশুদ্ধ রূপ।

হুমায়ুন আজাদ

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *