১১. গৃহ্যসূত্র

গৃহ্যসূত্র

শৌতসূত্রগুলিতে যেখানে প্রধান সামূহিক যজ্ঞসমূহ বিবৃত হয়েছে, গৃহ্যসূত্রগুলিতে সেখানে গাৰ্হস্থ্য অনুষ্ঠানবিষয়ের নিয়মাবলী আলোচিত হয়েছে। এদের মধ্যে রয়েছে পারিবারিক অনুষ্ঠানসমূহ-সন্তানসম্ভাবনা থেকে মৃত্যুর বহু পরবর্তী পারলৌকিক ক্রিয়া পর্যন্ত সেসব বিস্তৃত। এগুলি তাদের লক্ষ্য, বিষয়পরিধি ও ক্রমিক অগ্রগতির ক্ষেত্রে শৌতি অনুষ্ঠান অপেক্ষা ভিন্ন। শ্রৌত অনুষ্ঠানগুলি যেখানে মূলত সমগ্ৰ গোষ্ঠীর সামূহিক কল্যাণ কামনা করে, গাৰ্হস্থ্য অনুষ্ঠানসমূহ সেক্ষেত্রে বিপরীত মেরুতে অবস্থান করে, কেননা এগুলি সর্বতোভাবে পরিবার-কেন্দ্ৰিক। গৃহ্যসূত্রগুলি বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এদের মধ্যে ‘পাকযজ্ঞ’ নামে অভিহিত প্ৰায় চল্লিশটি অনুষ্ঠানের নিয়মাবলী বিবৃত হয়েছে। এদের আবার তিনটি শ্রেণীতে বিভক্ত করা যায় : (ক) হুত অর্থাৎ যখন অগ্নিতে আহুতি অৰ্পণ করা হয়; যেমন বিবাহে বা গর্ভবতী রমণীর সীমস্তোন্নয়ন অনুষ্ঠানে হয়ে থাকে। (খ) অহুত অর্থাৎ যেখানে আহুতি আদান-প্ৰদান হয়; যেমন উপনয়নে ও স্নাতকদের জন্য দীক্ষান্ত অনুষ্ঠানে। (গ) প্ৰহুত অর্থাৎ যেখানে বিশেষ ধরনের আহুতি অৰ্পণ করা হয়; যেমন জন্মপরবর্তী অনুষ্ঠানে। প্রধান অনুষ্ঠানগুলির সঙ্গে বহু গৌণ সহায়ক আচারও রয়েছে; যেমন, গর্ভাবস্থার অনুষ্ঠানগুলি-এদের মধ্যে আছে গর্ভাধান, পুংসবন ও সীমন্তোন্নয়ন।

জন্মের পরে নবজাত শিশুর কল্যাণের জন্য জাতকর্ম অনুষ্ঠিত হয়। তারপর একে-একে পালিত হয় আদিত্যদর্শন, নামকরণ, অন্নপ্রাশন, চোল বা চুড়াকরণ, গোদান ও উপনয়ন অনুষ্ঠান। উপনয়নের পরে বেদাধ্যয়ন বা স্বাধ্যায়ের সূচনা হয়; এই সঙ্গে থাকে। অন্যধ্যায় ও শেষে সমাবর্তন। তারাপ স্নাতক গ্রামে প্ৰত্যাবর্তন করে গ্ৰাহঁত্যু আশ্রমে প্রবেশের জন্য প্ৰস্তুত হয়। বিবাহ অনুষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে পাণিগ্রহণ, অগ্নিপরিগ্রহণ, অশ্বারোহন, সপ্তপদী ও লাজহােম। বিবাহিত গৃহস্থকে প্রতিদিন আবশ্যিক নিত্যকর্ম ও বিভিন্ন সাময়িক যজ্ঞানুষ্ঠানের আয়োজন করতে হয়।

এইসব প্ৰধান অনুষ্ঠান ছাড়াও দৈনন্দিন জীবনের প্রায় সমস্ত সম্ভাব্য ক্ষেত্রের জন্য নানাধরনের অনুষ্ঠান রয়েছে; যেমন–গৃহনির্মাণ, বীজ বপন, শস্য আহরণ, সর্প ও বিষাক্ত কীট বিতাড়ন, অতিথিকে খাদ্য ও আশ্রয়দান, আরোগ্যলাভ, দারিদ্র্য নিবারণ, বিভিন্ন উদ্যোগে সফলতা, অমঙ্গলসূচক লক্ষণ, এমনকি অশুভ স্বপ্নের জন্য উপযুক্ত প্ৰতিবিধান। মানুষের সমগ্র জীবন প্রায় সম্পূর্ণভাবে অনুষ্ঠান দ্বারা আবৃত ছিল; আদিম মানুষের মানসিকতায় ধর্মীয় ও লোকায়িত জীবনধারার মধ্যে কোনও স্পষ্ট ভেদরেখা ছিল না। এই মানসিকতায় পৃথিবী ও অন্তরীক্ষ অসংখ্য অমঙ্গল শক্তির দ্বারা আকীর্ণ ছিল; এদের মধ্যে রয়েছে জীবনের সুখকর ভোগ থেকে বঞ্চিত মৃতমানুষের আত্মা—এরা জীবিত মানুষ সম্পর্কে অসূয়াপরায়ণ হয়ে সর্বদা ক্ষতিসাধনের চেষ্টা করে এমন বিশ্বাস ছিল। জীবনকে যেহেতু নেতিবাচক ও ধবংসাত্মক শক্তি থেকে রক্ষা করতে হবে, তাই প্রত্যেক গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যযুক্ত পরিস্থিতির জন্য কোনো অনুষ্ঠান নির্দেশিত হয়েছিল, যার সাহায্যে এইসব অমঙ্গলপ্রদ শক্তিকে শান্ত, সন্তুষ্ট, বিতাড়িত বা সংগ্রামে প্রতিহত করা যায়। তাই শ্রৌতসূত্রগুলির তুলনায় গৃহ্যসূত্ৰসমূহ অনেক বেশি স্পষ্টভাবে ঐন্দ্রজালিক। এটা সত্য যে সূত্র-সাহিত্য রচিত হওয়ার সময় ভারতীয়রা আদিম অবস্থা থেকে বহুদূর সরে এসেছিলেন; কিন্তু সূত্রগুলি বহু সহস্ৰ বৎসরের পুরাতন বিশ্বাসের উপর প্রতিষ্ঠিত অনুষ্ঠানগুলিকে বিধিবদ্ধ করেছে মাত্র। জীবনের প্রতি প্ৰাগ-বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি অতিপ্রাকৃতিক স্তরে মানুষকে প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে সংগ্রাম করতে প্ররোচিত করেছে।